সকাল বেলার নরম সূর্যটা সৈয়দ ভবনের ঠিক ছাদের ওপর দাঁড়িয়ে। অল্পস্বল্প রোদ পড়েছে আজ। তবে গরম তেমন নেই। বাড়ির বাইরেটা শান্ত-চুপচাপ হলেও, ভেতরে হুলস্থুল বেঁধেছে নাস্তা নিয়ে। প্রত্যেক সকালেই হয় এমন। ছেলেমেয়েরা যে যার কাজে যাওয়ার সময়, দুই রমণী দাঁড়াবার ফুরসত অবধি পান না। রেহণূমা রান্নাঘরে ব্যস্ত। সাথে গৃহকর্মী আছেন।
তনিমা বেগম খাবার টেবিলের এখানটায়। পা জিরোচ্ছে না ওনার। ছুটে ছুটে বারবার এটা-সেটা আনছেন। শওকত আলী,সাইফুল দুজনেই আজ বাড়িতে। পেশায় শওকত আর্মি অফিসার ছিলেন। অবসর নিয়েছেন এক বছর হবে। সাইফুল ইসলাম গ্রামীণ ব্যাংকের কর্মকর্তা। গড়িয়ে আসা বেলা দেখে ঠাওর হলো,দশটা বাজবে হয়ত৷ দুজনেই খেতে নামবেন একটু পর। আবার অয়ন,মিন্তু ওরাওতো বের হবে।
মিন্তুর গায়ে স্কুল ইউনিফর্ম। ক্লাস নাইনে পড়ে সে। দেখতে ভালো,গোলগাল মুখ। তবে ভীষণ চালাক। বাঁদরামিতে এগিয়ে থাকলেও, ক্লাসে পরিচিত ব্যাকবেঞ্চার নামে।
আজ অবধি ওকে সামনে বসতে দেখা যায়নি। প্রতি পরীক্ষায় টেনেটুনে পাশ করা মিন্তুর কাছে ডালভাতের মতো। তার ফার্স্টক্লাস দুষ্টুমিতে অতীষ্ঠ হয়ে ক্লাস টিচার যে কতবার অভিভাবক ডেকে পাঠিয়েছেন! । এজন্যে ভাইবোনদের কাছে সে বিশেষ পাত্তা পায় না। ইউশা এই তালিকায় সবথেকে এগিয়ে। একই মায়ের পেটের বোন হয়েও যে কী দূরছাই করে ওকে!
মিন্তু পোড়া শ্বাস ফেলে চেয়ারে বসল।
অয়ন বের হবে। দেরি হয়েছে অনেক। খুব তাড়াহুড়ো করে কাপের চা শেষ করল। উঠে দাঁড়াতেই বাধ সাধলেন তনিমা।
কণ্ঠে উদ্বেগ,
“ বের হচ্ছিস? দাঁড়া দাঁড়া।”
কাজ ফেলে এগিয়ে এলেন তিনি। ফিসফিস করে দোয়া পড়ে ছেলের গায়ে- মাথায় ফুঁ দিলেন কয়েকবার। অয়ন হেসে ফেলল,
“ মামুনি,আমি প্রথম পরীক্ষা দিতে যাচ্ছি না। রিল্যাক্স!”
“পরীক্ষা পরীক্ষাই হয়, বাবা। প্রথম শেষ বলে কিছু নেই। ভালো করে মন দিয়ে লিখবি। তাড়াহুড়ো করবি না। কেমন?”
মিন্তু খেতে খেতে বলল,
“ বড়ো মা, তুমিতো এমন ভাবে বলছো যেন ছোটো ভাইয়া ক্লাস সিক্সের এক্সামে বসবে। এটা ভাইয়ার ক্লিনিকাল টেস্ট। ছোটো ভাইয়া এখন বড়ো হয়ে গেছে। ওই আদর ওকে না দিয়ে,আমাকে দিলেও তো পারো।”
তনিমা হাসলেন। মিন্তুর গালটা টেনে বললেন,“ তোকে কি আমি কম ভালোবাসি?”
“ তা বাসো । কিন্তু সারাদিন মা আর বোনের কাছে যেই মুখ ঝামটা খাই,তুমি ওটা বেশি করে পুষিয়ে না দিলে তো হিসেব মিলবে না।”
ওদের কথার মাঝে অয়ন হাতঘড়ি দেখল। চোখ তুলে দোতলার ঘরটায় নজর ফেলল আরেক বার। মেজো ভাইয়া রাতে বলেছিল একসাথে বের হবে। এখনও আসছে না যে! বেলা তো কম হয়নি। ভাবনার মধ্যেই ওর খেয়াল পড়ল গলায় স্টেথোস্কোপ নেই। নির্ঘাত তাড়াহুড়োয় ঘরে ফেলে এসেছে। চ সূচক শব্দ করে বলল, “ ওহ হো,মামুনি আমার স্টে…”
তক্ষুনি ওপর থেকে দৌড়ে নামল ইউশা। দুরন্ত পায়ে এসে দাঁড়াল অয়নের সামনে। লম্বা শ্বাস টেনেটুনে বলল, “ এই যে,ফেলে যাচ্ছিলে।”
অয়ন চমৎকার করে হাসল। স্টেথোটা নিয়ে ঝোলাল গলায়। “ থ্যাংক ইউ! তুই এত লক্ষ্মী না ইউশা! মাঝেমধ্যে মনে হয় তুই আছিস বলে আমি ইচ্ছে করে সব ভুলে যাই।”
ইউশা লজ্জা পেলো। শ্যামলা গাল দুটো রক্তের মতো লাল হলো আরো। মনে মনে ভাবল,
“ লক্ষ্মী মেয়েদের বেশিক্ষণ চোখের সামনে ফেলে রাখতে নেই, অয়ন ভাই। চট করে বিয়ে করে ফেলতে হয়। ডাক্তারি বোঝো,আর এটা বোঝো না?”
মিন্তু ঠোঁট উলটে বলল,“ কী খারাপ রে তুই আপু। আমি তোর একটা মাত্র ছোটো ভাই,অথচ তুই আজ অবধি আমার একটা বইও এগিয়ে দিসনি। আর অয়ন ভাইয়ের জন্যে পারলে পানির বোতল টেনে আনিস। ভাইয়ে ভাইয়ে এত বৈষম্য করছিস! বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনে তোকে ধরে নিলো না কেন!”
ইউশা চোখমুখ কোঁচকাল। মিন্তুর মন খারাপ গেল না। দুঃখী দুঃখী মুখ করে চোখ তুলল আকাশে। বলল,“ ইয়া আল্লাহ! এই বোন আমার চাই না। হয় এটাকে আমার প্রতি যত্ন দাও, নাহয় তুলে নাও, তুলে নাও, তুলে নাও।”
তনিমা হেসে ফেললেন। তাও ছোটো ধমক দিয়ে বললেন,“ যাহ,এ আবার কী কথা!”
ইউশা চোখ পাকিয়ে বলল,“ তবে রে! দাঁড়া তুই।”
ওকে তেড়ে আসতে দেখেই কাধব্যাগটা তুলে ছুট লাগায় মিন্তু। তনিমা হাঁক ছুড়লেন,
“ আরেহ,খাবারটা শেষ করে যা।”
মিন্তু ছুটলেও জবাব দিয়ে গেল,“ তোমার লক্ষ্মী মেয়েকে বলো। ডাইনি বুড়ি একাই সব খেয়ে নিক।”
ইউশা চ্যাঁচিয়ে ওঠে,
“ মিন্তুউউউউ! আমি ডাইনি? বাড়ি আসবি না তুই? মজা দেখাব তখন।”
মিন্তু ওসব শোনেনি। সে দৌড়ে বাড়ি ছেড়ে গেছে। অয়ন হাসল মাথা নেড়ে। ইউশার রাগটা দপ করে নিভে গেল তাতে। অয়ন দেখতে সুন্দর। স্বাস্থ্যও ভালো। সাথে ফরসা শরীরের ওপর সাদা শার্ট পরেছে। হাতে এপ্রোন,গলায় স্টেথো। ইস,এত ভালো লাগছে দেখতে! ইউশার মনটা আরেকবার মুগ্ধতায় থুবড়ে পড়ল মাটিতে। ঠিক যেমন পড়েছিল অয়নের প্রতি অনুভূতি হবার পর। বয়ঃসন্ধির সময়সীমায় এসে যে পুরুষকে তার মনে লেগেছে সেই তো অয়ন। ইউশার সকাল-বিকেল-রাত। ইউশার প্রহর,ইউশার মুহুর্ত, ইউশার গোটা জীবন।
অয়ন অপেক্ষায় ক্লান্ত হয়ে ধপ করে বসে পড়ল আবার। মাকে বলল,
“ মামুনি, একটু ভাইয়াকে ডেকে দাও না।” তনিমা কাজ করছিলেন। ইউশাকে বললেন,
“ যা তো,সার্থকে ডেকে নিয়ে আয়।” মেয়েটা তখন গভীর ধ্যানে। নেত্রমণি অয়নেই আটকেছে। তনিমা সাড়া না পেয়ে বাহু ঝাঁকালেন,“ কী রে,যা।”
নড়ে উঠল ইউশা,“ হু? হ্যাঁ।” পা বাড়িয়েও থামল সে। বোকা চোখে বলল,
“ কোথায় যেন যাব?”
“ ওমা,এইত বললাম সার্থকে ডেকে আনতে। এর মাঝে ভুলে গেলি?”
রেহণুমা সদ্য এ ঘরে এসেছেন। শেষ কথাটা শুনেই বললেন,“ ভুলবে না? সারাদিন ফোন টিপলে মাথায় ব্রেইন বলতে কিছু থাকে? কোনদিন দেখবে মাথার ঘিলুর সাথে রক্তটাও চুষে খেয়েছে। ও যে এখনো বেঁচে আছে এই তো অনেক, আপা।”
ইউশা ঠোঁট ওল্টাল। তর্ক করার অভ্যেস তার ধাতে নেই। তাও আবার মায়ের সাথে! মুখ গোঁজ করে হাঁটা ধরল ইয়াসিরকে ডাকতে। রেহণুমা বললেন,
“ আপা,ও বাড়িতে ফোন করেছিলে? কথাবার্তা এগিয়েছ?”
“ হ্যাঁ রে। ওনাকে দিয়ে করালাম। এই সপ্তাহেই ভাবছি আংটিবদলটা সেড়ে ফেলব। ”
“ বাহ,খুব ভালো হবে। শুভ কাজে দেরি করতে নেই। আপা,আমাদের একজন কথা বলার নতুন সঙ্গী হবে বলো!”
অয়নের হাতে মোটা বই। ইয়াসির নামতে নামতে যতটা চোখ বোলানো যায়। স্বভাবে তার মতো পড়াকু এ বাসায় কেউ নেই। মনোযোগ ওখানে থাকলেও মায়েদের কথা শুনেছে। মাঝখানে বলল,
“ এখনকার যুগের মেয়ে ছোটো মা,গল্প করবে? নাকি দুদিন পরেই বরকে বলবে চলো আমরা আলাদা থাকি।”
রেহনূমা ঘাবড়ে গেলেন।
চিন্তিত হয়ে বললেন,“ এ মা,তাইতো। আপা তাহলে কী হবে? আমাদের সার্থের বউ যদি সত্যি এরকম করে!”
“ আরেহ,ও মজা করছে। তুইও না অয়ন,কেন এসব বলছিস? একটা ভালো কাজের শুরুতে এমন বাজে কথা বলতে নেই।”
অয়নের চোখ বইয়ে। আঙুল চালিয়ে একটা পাতা ওল্টাল। ওভাবেই বলল,
“ কী জানি! তোমাদের ব্যাপার-স্যাপার। আমার যা মনে হলো তাই বললাম। দেখিতো আমার ব্যাচমেটদের বউগুলোকে। দুদিন যেতে না যেতেই তাদের আলাদা সংসার চাই। এজন্যেই আমি এসব বিয়ে টিয়ের ফ্যাসাদে পড়তে চাই না। ভাইয়াও যে কেন রাজি হলো! যাক গে,ভাইয়া করছে কী এতক্ষণ? অলরেডি আম গেটিং লেট! এরপর বেশি দেরি করলে তো ঢুকতেই দেবে না।”
ওপরে দাঁড়িয়ে সবটা দেখছিল আইরিন। মুখখানায় ঘন আমাবস্যা তার। ইয়াসিরের বিয়ের আলাপ তার বুকের দোরে একেকটা ছুরির ঘা। কেন যে ওই পুরুষকে ওর চোখে লাগতে গেল! এখন না পারছে বলতে,না পারছে গিলতে।
এর মাঝেই রুম ছেড়ে বের হলো ইয়াসির। পায়ের শব্দে ফিরে চাইল আইরিন। লম্বা গড়নের, সুঠাম দেহের অধিকারী এই পুরুষকে ও নিজের সবটা দিয়ে চায়। ইয়াসির দেখল আইরিনকে। পাশ কাটানোর সময় চোখে পড়ল একবার। সেকেন্ড কয়েক? পরপরই নজর ফিরিয়ে নেমে গেল নিচে। কিন্তু ওই অল্প তাকানোতেই আইরিনের গলায় উগলে এলো কান্না। এমনই হয়,ইয়াসির কখনো ওর সাথে আগ বাড়ি কথা বলেনি। আইরিন যতটা বলে, যা জিজ্ঞেস করে তার উত্তর দেয়,এই যা! ইয়াসিরের যাওয়ার পুরোটা সময় সে চেয়ে রইল। মানুষটার প্রতিটি কদমে আত্মবিশ্বাস৷ গভীর চোখজোড়া যেন গল্প বলে আবেগের। ঘন ভ্রু, তীক্ষ্ণ নাক আর নিখুঁত সাজানো চুল কতটা আকর্ষণীয় তার ব্যখা হয়ত নেই।
কিন্তু এই চাওয়া পাওয়ার একটুও কী বুঝবে ইয়াসির? ওর বিয়ে আইরিন দেখতে পারবে স্বচক্ষে? ওর কলিজা ছিঁড়ে বাইরে আসবে না?
যে মেয়ের সাথে ইয়াসিরের বিয়ে ঠিক হয়েছে,সে নিখুঁত সুন্দরী। পড়াশোনা জানা,ভালো ঘরের মেয়ে। আইরিনদেরও কিছু কম নেই। কিন্তু ওই যে বয়স! ওই যে সাহস! এসব নিয়ে ও কাউকে কিছু বলতে পারছে না। মা জানলে তো উলটো ওকেই বকবে। তখন কী হবে আইরিনের? ইয়াসিরকে তো পাবেই না। উলটে সম্মান যেটুকু আছে,তাও শেষ। আইরিনের বুক ভেঙে গেল। চলে যাওয়া শরীরটাকে দেখে,এক ফোটা জল নেমে এলো গালে। আর দাঁড়াল না। ত্রস্ত ছুটল ঘরের দিকে।
ইউশা ইয়াসিরের পেছন পেছন এসেছে। ওর ব্যগ্র চোখদুটো ঘুরেফিরে অয়নকেই দেখছিল। মানুষটা যতক্ষণ বাড়িতে, ততক্ষণে ও লিভিংরুম ছাড়বেই না। ইয়াসির নেমে আসতেই উঠে দাঁড়াল সে। ফোস করে শ্বাস ফেলে বলল ,
“ ফাইনালি এলে। তুমি না খুব পাংকচুয়াল, ভাইয়া? আজ কী হোলো?”
“ দশটায় বলেছিলাম? ঠিক দশটাই বাজে। তুই-ই আধঘন্টা আগে এসেছিস।” কণ্ঠের প্রতাপ শুনে কপাল গোছাল অয়ন।
“ আধঘন্টা? হাউ? আমি যে ঘড়িতে দেখলা..” বলতে বলতে চট করে হাতঘড়িটা দেখল আবার। প্রায় এগারটা বাজে। পরপর মনে পড়ল, ওতো ঘড়ির টাইম সব সময় ৪০ মিনিট ফাস্ট করে রাখে। যাতে কোনো কাজে দেরি না হয়।
অয়ন জ্বিভ কাটল। দাঁত মেলে বলল,
“ সরি! পরীক্ষার টেনশানে সব ভুলে গেছি।”
“ আয়। মা আসছি।”
তনিমা বললেন,“ সাবধানে যাস।”
ইয়াসির বেরিয়ে যায়। ওর একটা বাজে অভ্যাস,সকালে ফ্রেশ হয়েই খাবার মুখে তুলতে পারে না। কোনো জোরাজোরি, কোনো আদর-আপ্যায়নেও বদল হয়নি এতে। বলতে বলতে মা-চাচি হাল ছেড়ে দিয়েছেন।
রেহণূমা বললেন,“ আপা, আমি মায়ের খাবারটা দিয়ে আসি।”
“ যা। তুই এলে খেতে বসব।”
“ আচ্ছা। ইউশা,বাবাকে গিয়ে তোল। কটা বাজে,খাবে না?”
প্লেটে রুটি-ভাজি গুছিয়ে ভদ্রমহিলা সিঁড়ির পথে চললেন। তনিমা এঁটো থালাবাটি নিয়ে গেলেন রান্নাঘরে। এখন বসার ঘর ফাঁকা। ইউশার হঠাৎ চোখ পড়ল সেন্টার টেবিলের গ্লাসটার ওপর। অর্ধেক পানি পড়ে আছে তলায়। এই গ্লাসে তো একটু আগেই পানি খেলেন অয়ন ভাই।
ইউশা চারপাশটা দেখল। সতর্ক পায়ে গিয়েই তুলল গ্লাসটা। কেমন করে চোখের সামনে ঘোরাল ওটাকে। এই গ্লাসে অয়নের ছোঁয়া আছে। অয়ন আছে। ইউশা স্বলজ্জে হাসল একটু! চুমুক দিয়েই ঢকঢক করে খেয়ে নিলো বাকিটা। লম্বা শ্বাস নিয়ে চুমু খেল সেখানে। বুকে জড়িয়ে বিড়বিড় করল,
“ কী শান্তি ! কী শান্তি!”
ইয়াসির পার্কিং থেকে বাইক নিয়ে এসেছে। অয়ন আবদার ছুড়ল,“ আজকে আমি চালাই?”
“ হঠাৎ!”
“ তুমি যে হিরো টাইপ,পেছনে বসলে আমাকে চোখে লাগবে?”
“ কোথায় শিখিস এসব বাজে কথা?”
ইয়াসিরের কণ্ঠে বিরক্তি। অয়ন হাসল। দুষ্টুমি করে বলল,
“ হিউম্যান বডি স্ট্রাকচারে পেয়েছি। স্ক্যাল্পের ভেতরে এক কোণায় থাকে। তোমার লাগবে?”
ইয়াসির যুক্তিতে গেল না। চুপচাপ চাবিটা হাতে দিলো ভাইয়ের। অয়ন সানন্দে সামনে উঠে বসে। বাইক চালাতে তার দারুণ লাগে। স্টার্ট দেয়ার মাঝেই, ইয়াসির হেলমেটটা ওর মাথায় চড়িয়ে দিলো। অয়ন পিছু ফিরে বলল,
“ আবার এটা কেন? গরম তো।”
“ দিস ইজ রুলস।”
“ পুলিশের সাথে যাচ্ছি,তাও?”
ইয়াসির বলল,“ পুলিশ কেন, প্রাইম মিনিস্টারের সাথে গেলেও পড়তে হবে। দ্য রুলস আর ইক্যুয়াল ফর এভ্রিওয়ান। এখন চল।”
অয়ন আর কিছু বলল না। ঘাড় নেড়ে বাইক ছোটাল। গেট মাড়িয়ে যাওয়া বাহনটাকে জানলার ফাঁক গলে দেখলেন শওকত। তৃপ্তির মৃদূ হাসিটা ছুটে এলো ঠোঁটে! ছেলেদুটো আজ নিজ নিজ জায়গায় প্রতিষ্ঠিত। একজন ডাক্তার,অন্যজন এ-এস-পি। আজ যদি বড়ো ছেলেটাও থাকত! শওকত ঢোক গিললেন। চোখদুটো ভিজে গেল জলে। ইয়াসিরের বড়ো ভাই সায়ন। কত মেধাবি ছিল ছেলেটা! আজ ও থাকলে নিশ্চয়ই অনেক বড়ো হতো! এমন সুনাম কুড়াতো! একটা ভুলের জন্যে কোথায় কেমন জঘন্য ভাবে মোড় নিয়েছে জীবনটা! শওকতের বুক জ্বালাপোড়া করে। অনুশোচনার আগুন দাউদাউ করে জ্বালিয়ে দেয় সব।
তক্ষুনি ঘরে এলেন তনিমা। “ উঠেছো? আমি আরো ডাকতে এলাম।”
শওকত চোখ মুছলেন ব্যস্ত হাতে। ঘুরে চেয়ে বললেনে,
“ হ্যাঁ, ওই মাত্রই উঠলাম।”
“ ঠিক আছে। ফ্রেশ হবে তো? গিজার কিন্তু অন করেই রেখেছি।”
শওকত একটু থেমে বললেন,“ সার্থ দেখলাম বের হলো। খেয়েছে?”
“ না। ওতো সকালে খেতে পারে না,জানোই তো। বলল থানায় গিয়ে খেয়ে নেবে। তোমার নাস্তা কি ঘরে নিয়ে আসব? না টেবিলে গিয়ে বসবে।”
“ হু? টেবিলেই দাও। সার্থ নেই যখন,নিচে যাই।”
তনিমার সাবলীল চেহারা মুছে গেল সহসা। ইয়াসির কখনোই বাবার সাথে এক টেবিলে বসে না। শুধু টেবিল কেন,বাবার ছাঁয়া মাড়াতেও আপত্তি তার।
ভদ্রমহিলা আর্ত চোখে চাইলেন। শুধালেন ভেজা স্বরে,“ ছেলেটা এমন করে বলে তোমার অনেক খারাপ লাগে, তাই না?”
শওকতের মুখের হাহাকার স্পষ্ট চাউনীতে। কাষ্ঠ হেসে বললেন,
“ খারাপ লাগবে কেন? কষ্ট হয় তনিমা। একটা ভুলের জন্যে আমার নিজের ছেলেই আমাকে ঘৃণা করে। এত বড়ো হলো,পুলিশ অফিসার বনে গেল,তাও কথা বলে না। বাবা বলেও ডাকে না অবধি। এতটা জ্বালা কি শুধু খারাপ লাগায় আটকে থাকে?”
তনিমা চুপ রইলেন। কথার যুতসই জবাব জানা নেই। না আছে সান্ত্বনা দেয়ার ভাষা। শওকত টের পেলেন চোখ জ্বলছে আবার। কিন্তু আর কাঁদতে চান না তিনি, তনিমার সামনে তো একেবারেই নয়। স্বাভাবিক থাকার প্রয়াসে গলার শ্লেষা কাটিয়ে বললেন,“ যাই,ফ্রেশ হয়ে আসি।”
স্ত্রীর পাশ কাটিয়ে ওয়াশরুম অবধি গেলেন ভদ্রলোক। কী ভেবে, ফিরে চাইলেন আবার। ডাকলেন আস্তে করে,
“ তনি!”
তনিমা তাকালেন,
“ হ্যাঁ, কিছু লাগবে?”
শওকত চটজলদি বললেন না। একটু সময় নিয়ে শুধালেন,
“ মনে মনে তুমিও আমাকে অনেক ঘৃণা করো, তাই না?”
*******
সকাল বেলা বস্তির চিত্র মানেই জনজীবনের কোলাহলময় সূচনা। ভোরের আলো ফুটতেই প্রতিটি খুপড়িতে শুরু হয় দিনের প্রথম কর্মযজ্ঞ। ছোটো ছোটো ঘরগুলোর চালের বাঁকে উনুনের ধোঁয়া উড়তে শুরু করেছে। পানির আশায় আবার লম্বা জট বেঁধেছে কলপাড়ে। তুশি আজ আর পানি আনতে যায়নি। সে এখনো ঘুমে। তাই হাসনা চলে গেলেন।
তুশির ঘুম ভাঙল দরজায় টসটস শব্দে। একেই টিনের দোর,দুইয়ে গভীর নিদ্রা। সব মিলিয়ে মেয়েটার মেজাজ চটল খুব! উঠে এলো ধুপধাপ পায়ে। ওপাশে দুটো চেনা মুখ দাঁড়িয়ে। বাবলু,আর টিনটিন।
তুশি কপাল কুঁচকে বলল,
“ তোরা? এত মন্নিং (morning) মন্নিং কী চাই?”
ওরা যেন অবাক হোলো। টিনটিন দুই ভ্রু উঁচিয়ে বলল,
“ ওস্তাদ,তুমি বাইত্তে?”
বাবলু বলল,
“ কহন আইলা? ও আল্লাহ! তুমি দেহি পুরা ফিট। আমরা তো ভাবছিলাম পুলিশ তোমারে ঘা দিয়া অজ্ঞান বানাইলাইছে।”
তুশি চোখ রাঙিয়ে বলল,“ শেটাপ, মাউথ বন্ধ। আমাকে ঘা দেবে কোন ব্যাটার কলিজা? আর তোরা কাল ও কথা দাদীকে এসে বলে দিলি কেন? তোদের আমি বলতে বলেছিলাম?”
“ আমগো কী দোষ? কবির চাচা রুডি আর চায়ের ট্যাকার লইজ্ঞা দৌড়ানি দিছে। তুমিতো কইছিলা তুমি দিবা। কিন্তু তোমারে তো পুলিশ ধইররা নিয়া…”
তুশি ঠোঁটে আঙুল চেপে বলল,“ শশশ! সম্মান ইটিং করবি নাকি? সবাই লিসেন করে নিলে সমস্যা না? এসব কথা কাউকে টেল করা যাবে না।”
ওরা ঘাড় নাড়ল। টিনটিন বলল,
“ আইচ্ছা। কিন্তু ওস্তাদ, কবির চাচা কইলাম দেইখালাইছে। হেয় তো ওই পাড়ায় কইয়া দিছে। এহন কী হইব?”
“ ওসব তোদের ভাবতে হবে না।” তুশি ঘরে ফিরে এলো। বাবলুরাও পেছনে আসে। তুশি টিনের বেড়ায় ঝোলানো ব্রাশদানি থেকে টুথপেস্টটা তুলে লাগাল ব্রাশে। দাঁতে ঘষতে ঘষতে বলল,
“ আজ এই এলাকায় বসে থাকলে চলবে না বুঝলি। ভাবছি মিডল মন্নিং-এ শাহবাগের দিকে যাব। ওখানে ভালো পাখি পাওয়া যায়।”
ফের ঘাড় নাড়ল ওরা। তুশি তৈরি হলো। চুল গুলোয় টেনেটুনে ঝুঁটি করল কোনোরকম। বুকপকেটে সানগ্লাস গেঁথে আঙুল নাঁচাল,
“ আয়।”
একপাশে বাবলু,অন্যপাশে টিনটিন হাঁটছে। তুশিকে দেখে কয়েকটা ঘর থেকে মুখ বাঁকালেন কয়েক জন। তার চালচলনের বহরে বিরক্তি যাদের। তুশির যায়ই এলো না। কখনো আসেও না। সে সব সময় নিজের মতো দর্প নিয়ে হাঁটে।
কিন্তু বাবলুদের এসবে কষ্ট হয়। ওস্তাদকে কেউ কিছু বললে খারাপ লাগে ওদের। আজকেও বলল,
“ তিন্নির আম্মা তোমারে দ্যাখলেই কেমন করে। মহিলা একটা রিনা খান।”
টিনটিন স্বায় মেলাল,
“ ঠিক কইছোস। মনডা চায় গিয়াই এক কোপে কল্লা কাইট্টা দিই।”
তুশি ধমক দিলো। বিজ্ঞ হাবভাব করে কিছু বলবে,কথা কেড়ে নিলো টিনটিন,
“ ওস্তাদ, যা কইবা বাংলায়। তোমার ইংজিরি অদ্দেক কইলো বুজি না।”
তুশি চোখমুখ কোঁচকাল।
“ ইংরেজি ছাড়া আমি কথা বলতে পারি? ঠিক আছে! তোদের জন্যে ড়ুয়িং ট্রাই।”
তারপর বলল,
“ শোন,কে কীভাবে তোকে ভাবছে সেসব নিয়ে কখনো বসে থাকলে চলবে না। আমি পকেটমারি দেখে ওরা আমাকে পেছনে গালমন্দ করে। কানাঘুষা করে আমাকে নিয়ে। তাতে আমার কী? আমি যদি ওদের কথা ধরে কাজ ছেড়ে দিই,ওরা কি আমার ঘরে দুটো ভাত দিয়ে যাবে? আর সব থেকে বড়ো কথা হলো,সামনে হাঁটতে গেলে পেছনের মানুষ কথা বলবেই। আরে আমি সেলবিরিটি তুশি,আমাকে নিয়ে সমালোচনা না হলে চলে? আলোচনার যোগ্য যে,সমালোচনা পায় সে। বুঝলি?”
টিনিটিন সানন্দে বলল,“ হ বুজজি। একটাও ইংজিরি কও নাই হেইর লইজ্ঞা আরো বেশি ভালো বুজ্জি।”
তুশি হেসে ফেলল। খেয়াল করল বাবলু ওকে হাঁ করে দেখছে। চোখেমুখে কী মুগ্ধতা। তুশি টোকা দিলো মাথায়।
“ হট হিপিন? এমন আ করে সি(see)করছিস কেন?”
বাবলু হাসিহাসি মুখ করে বলল,
“ ওস্তাদ,তোমার লগে থাকতে আমার এত ভাল্লাগে ক্যান জানো? তুমি নায়িকাগো মত সুন্দার কইররা কথা কও। আমাগো মত যামুগা খামুগা কও না। এই বস্তিতে একমাত্র লোক তুমি,যার কতা খালি হুনতেই মন চায়। এত সুন্দর কতা তুমি কইত্তে শিখছো ওস্তাদ?”
ওরা হাঁটতে হাঁটতে ইটের টিলার কাছে এসেছে। পাশে বিল্ডিংয়ের কাজ ধরবে বলে,এগুলো একটার ওপর আরেকটা জমিয়ে রাখা। তুশি এসে বসল তারওপর। ভীষণ ভাবসাব নিয়ে বলল,
“ সিনেমা দেখে।”
“ হেডি তো আমরাও দেহি ওস্তাদ। কই, পারি না তো।”
“ আরে আহাম্মক,সবাই কি তুশি হতে পারে? সাধে কি বলি আমি সেলবিরিটি? নেহাৎ ভুল করে বস্তিতে জন্মে গেছি। নাহলে এই বস্তি কি আমাকে ডিজেব (ডিজার্ভ) করে রে? এক্ষুনি যদি এফডিসির দরজায় গিয়ে দাঁড়াই ,পরিচালকদের লাইন লেগে যাবে আমাকে নায়িকা বানানোর জন্যে। খালি তোদের ভালোবাসি দেখে যাই না।”
টিনটিন বাবলু একে অন্যের মুখ দেখে হাসল।তুশি বুকপকেট থেকে সানগ্লাসটা নিয়ে পড়ল চোখে। উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
“ যাক,ওসব বাদ। হেবি টাইম ওয়েস্টিং। নাউ আই গোয়িং । ইউ ওন্ট (want) গো? সো কাম।”
******
তুশির আজ দিন ভালো। কাজে নেমেই ছক্কা হাঁকিয়ে ফেলেছে। সকাল থেকে আটটা পকেট হাতানো শেষ। যদিও তার মধ্যে তিনটে পকেটই ফাঁকা। এরা কি বের হওয়ার সময় মানিব্যাগে একটু টাকাপয়সা নিয়ে আসতে পারে না? কিন্তু তাও,কথায় বলে নাইয়ের চেয়ে কিছু থাকা ভালো।
তুশি মন দিয়ে টাকা গুণছে। দুপাশে বাবলু-টিনটিন বসে। ওদের মনোযোগও টাকার নোটে। সব মিলিয়ে টাকা পাঁচ হাজার হলো। তুশি হিসেব মিলিয়ে আলাদা করল সেসব। এর থেকে গোলাপ আর কবিরকে দিলে থাকবে দেড় হাজার। দাদিকে এখনো মালিকপক্ষ বেতন দেয়নি। রান্নার কাঠও ফুরিয়ে এসছে। বাকি টাকা দিয়ে তাহলে আজ ঘরের সব দরকারি জিনিস কিনবে তুশি। ও সব টাকা পকেটে ভরল। শুধু দুটো একশ টাকার দুটো নোট, দুজনকে দিয়ে বলল,
“ নে, কিছু কিনে খাস।”
ওরা খুশি হয়ে গেল। ময়লা মুখখানা চকচকে হলো অমনি। বাবলু আনন্দে মাথা ঝাঁকিয়ে বলল,
“ ওস্তাদ, তুমি কত্ত ভালো।”
তুশি মৃদূ হাসল। উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
“ তোরা থাক। আমি মানি দিয়ে আসি।”
বড়ো রাস্তার বাজারের পথ ধরল মেয়েটা। ওটার পাশ দিয়েই মেইন রোড গিয়েছে। ও সোজা গোলাপের দোকানে এলো। আজ কোনো কাস্টমার নেই। বসে বসে রেডিও শুনছে গোলাপ। বাংলাদেশের ম্যাচ চলছে হয়ত।
গোলাপ মধ্যবয়সি পুরুষ। একটা ইয়া বড়ো ভুড়ি আছে সামনে। বসলে সেটা কুমড়োর মতো ঝুলে থাকে। তুশি এসে দাঁড়াল। কালো,মোটা গোলাপকে দেখল কিছুক্ষণ। এই ব্যাটা ঘরে বউ রেখে ওর পেছনে ঘুরে বেড়ায়। নেহাৎ ধারে জিনিসপত্র নেয় বলে কিছু বলে না। কিন্তু মেজাজ চটলে কবে এটারও মেইন পয়েন্ট থেতলে দেবে,কে জানে!
তুশি টাকা বাড়িয়ে ধরল,“ নাও। ইওর পাওনা টাকা।”
গোলাপ বিঘ্ন পেয়ে একটু মেজাজ খারাপ করল। তুশিকে দেখতেই সেসব উবে গেল আবার। ঠোঁটে চওড়া হাসি টেনে বলল,
“ তুশিইইই! কেমন আছো?”
“ আমি অলওয়েস গুড থাকি, চাচা। নাউ টাকা ধরো। ক্যাচ।”
“ আহা, আবার চাচা! সেদিন না নাম ধরে ডাকলে? অমন ডাকো না।”
তুশি চ সূচক শব্দ করল। “ টাকা ধরো।”
“ তোমার থেকে টাকা নেব? না, না। তুমি শুধু ভালোবাসা দিও তাহলেই হবে।”
তুশি দুহাত কোমরে রেখে ছেলেদের মতো দাঁড়াল। কপাল কুঁচকে বলল,
“ লে হালুয়া! আমি থাকি বস্তিতে। বাসাটাও ভাঙা। তোমাকে দেয়ার জন্যে ভালো বাসা কি আকাশ থেকে পড়বে?”
গোলাপ থতমত খেল,“ এ্যাহ! আমি তো ওই ভালোবাসার কথা বলিনি! আমি বলে…”
তুশি কথা কেড়ে নেয়।
“নো টক। রইল তোমার মানি। আর ৭০০ পাবে। গিভিং নেক্সট।”
তুশি চলে গেল। গোলাপের চোখেমুখে বিভ্রান্তি। তুশি না কাল ভালো ছিল? আজ হঠাৎ এমন চ্যাটাং চ্যাটাং করে গেল কেন? বেচারার মন খারাপ হয়। তুশিকে তার কী যে ভালো লাগে! কী সুন্দর চোখ,নাক গায়ের রং। কিন্তু ও তো পাত্তাই দেয় না। এ জন্মে তুশি কি তার মন বুঝবে না?
তুশি কবিরের টাকা দিয়ে ফিরে এলো জায়গায়। তার শিষ্য দুজন ওখানেই বসে। চিপস খাচ্ছে বাবলু। তবে টিনটিনের মাঝে একটু মুরুব্বিয়ানা আছে। তার এসব চিপসে পোষায় না। ওকে চুইংগাম চিবোতে দেখে তুশি চোখ ছোটো করল। সন্দিহান শুধাল,
“ এসমোক করেছিস?”
টিনটিন চোখ বড়ো করে মাথা নাড়ল।
“ না না। তুমি মানা করছো,হেরপরেও ওসব আমি খামু ওস্তাদ?”
তুশি বাবলুর দিকে চাইল। ছেলেটার মুখে চিপস। তবে উদ্বেগ নিয়ে জানাল,
“ আমি কিছু জানি না ওস্তাদ। টিনটিন কইছে তোমারে না কইলে আমারে ২০ ট্যাকা দিবো। অহন কইয়া দিলে তো আর ট্যাকা পামু না। তাই আমি কমু না কিছু।”
ত্রস্ত ওর মাথায় চড় মারল টিনটিন। রেগে রেগে বলল,
“ হালার বলদা,কইয়া তো দিলিই। বিশটা জুতা দিমু তোরে।”
তুশি কটমটিয়ে উঠল। পায়ের জুতোয় হাত দিতেই,ছুট লাগাল টিনটিন। ও দমেনি। পিছু নিলো ওর। বাবলু বেকুব বনে যায়। চিপস মুখে নিয়ে হাঁ করে চেয়ে থাকে সেদিকে। মাথা চুলকে ভাবে,
“ আমিতো কিছু কইনাই। ওস্তাদ তাইলে ক্যামনে বুজছে?”
তুশি টিনটিনকে ধরতে পারেনি। রোগা-পাতলা ছেলেটা দৌড়ের তোপে হাওয়ায় মিলিয়ে গেল। তুশি চ্যাঁচিয়ে বলল,
“ পেয়ে নিই তোকে। এসমোকের মজা বোঝাব!”
তুশি ফিরতে নেয়,হঠাৎ চোখ পড়ে অদূরে। বাজারের থলি হাতে একটা মেয়েকে দুজন ছেলে কিছু বলছে। মেয়ের চেহারায় বিরক্তি। অল্প ভয়। ছেলেদুটো হাসছে। মেয়েটা যেতে চাইলে বাধ সাধছে বারবার। তুশি কপাল কুঁচকে দেখল কিছুক্ষণ।
“ কী হচ্ছে ওখানে? ইবটিজিং?” রাগে তুশির মাথা ফুলে গেল। তার এলাকায় ইভটিজিং। শার্টের হাতা গুটিয়ে পা বাড়াল সহসা। আজ এ দুটোকে মেরে মুখের ডিসপ্লে বদলে দেবে।
আচমকা একটা বাইক এসে থামল সেখানে। বাইকের পেছনের আরোহী পুলিশের পোশাক পরা। মাথার হেলমেটটা টা খুলতেই,তুশি থমকে গেল জায়গায়। ইয়াসির থেমে নেই। কেমন ঝড়ের মতো নেমেই,ছেলে একটার গালে চড় মারল। আরেকটার কলার ধরে ঘুষি বসাল মুখে। তুশির এগোনোর সাহস শেষ । ইয়াসিরের মারের হাত টনটনে। ওকে দেখলে যদি মেরে দেয়!
বিড়বিড় করল,
“ ওরে বাবারে বাবা! পালাই।”
তুশি উলটো ঘুরে ছুটতে নেয়। পেছনের সটান তারের খাম্বায় ধাক্কা লাগে অমনি। কপালটা ঠুকে গেল। আর ব্যস, তুশি ছিটকে পড়ল মাটিতে। এক হাত দূরে কিছু পড়ার শব্দে ভড়কে গেল অয়ন। ইয়াসিরের থেকে চোখ সরিয়ে ত্রস্ত চাইল এপাশে। একটা মেয়ে চিৎ হয়ে পড়ে আছে। তাড়াহুড়ো করে বাইকটাকে স্ট্যান্ডে রেখে নামল সে।
তুশি ব্যথায় শেষ। পিচে লেগে পিঠের চামড়া আস্ত নেই। এর মাঝেই অয়ন কাছে ছুটে এলো। হাতটা বাড়িয়ে বলল,
“ পড়লেন কী করে? উঠে আসুন।”
.
.
.
চলবে.........................................................................