গ্যারেজের মতো অমীমাংসিত জায়গার তথ্য কক্ষনো তিনি দিবেন না। সেটার জন্য যা হওয়ার হয়ে যাক! চুলোক যাক! সবসময় এ ধরণের পরিস্থিতিতে সাঈদ যা করতে বলেছে তাই ডানহাতের মুঠোয় থাকা ছোট্ট বাটন ফোনটাতে করে দিলেন সুফিয়া। সামনে থাকা আফসানা তখন টেরও পাননি তার চেয়েও এককাঠি চতুর ক্ষিপ্রতায় জায়গামতো একটা কল পৌঁছে দিয়েছে সুফিয়া খানম। আফসানা কপালের মসৃণ ভ্রুঁদুটো রুক্ষু কায়দায় কুঁচকে বেশ অপ্রসন্ন সুরে বলল,
- তুমি কী আমাকে চাবিটা দিচ্ছ না সুফিয়া? তোমাকে না বলেছি ওর গ্যারেজের চাবিটা আমার হাতে তুলে দিতে? দাও। আমার হাতে বেশি সময় নেই। এখুনি বাবুর্চির ওখানে কিছু জ্বালানি হিসেবে পুরোনো কাঠ জোগান দিয়ে আসব। আমাকে দেরি করিয়ো না। দাও।
সুফিয়া বুঝতে পারছে না হঠাৎ এই গ্যারেজের তলব এখনই কেন হল। কারণ, গ্যারেজ এ বাড়িতে দুটো। দুটো দুইদিকের দুই প্রান্তে বসানো। সাঈদ নিজস্ব গ্যারেজটা যদিও গাড়ি রাখার সময়ই শুধু খোলে, কিন্তু এই মূহুর্তে সত্যিই উনার নাগালের কাছে চাবিটা নেই। চাবিটা এখনো সাঈদের ঘরে আলমারির ড্রয়ারে একেবারে ভেতর কোণে রাখা। চুলার চাপাতা দেওয়া পানিটা টগবগ শব্দে ফুটতে শুরু করলে সেখানে বাঁহাত বাড়িয়ে চুলার আঁচটা কমাতে কমাতে জানালেন ভদ্রমহিলা,
- আপা, আমার কাছে সত্যি ওর গ্যারেজের চাবি টাবি নাই। আপনের পোলায় একবার আমার কাছে গ্যারেজ পরিষ্কার করনের লিগা চাবির ঝোপ্পাটা দিছিল, পরে হেয়ই আবার ঝোপ্পা শুদ্ধা লইয়া গেছে। এহন কতা তো হেইডা না। এহন আপনের আঁতকা কোন কামে চাবির ঝোপ্পা লাগব? আপনের গ্যারেজে কী সমেস্যা হইছে?
আফসানা মুখটা বেজার ভঙ্গিতে বিবর্ণ করে বলতে শুরু করলেন,
- ওর গ্যারেজটা একটু দেখতে চাইছি। আমার মনে হচ্ছে সাঈদ গ্যারেজটা স্বাভাবিক কাজে ব্যবহার করছে না। আজ সাতটার দিকে ঘরের মধ্যে নতুন বউ রেখে ওখানে কী কাজ করতে চলে যেতে পারে? ব্যাপারটা অবাক কাণ্ড না? আজ ওর গাড়িটাও গ্যারেজের বাইরে রেখে গেছে . . ঘটনাটা আসলে কী! এটা আমি আরো কবার দেখেছি। তখনো কিছু বলিনি। আজ ব্যাপারটা সীমা ছাড়াল মনে হচ্ছে। দাও দেখি . . এক কাপ চা দাও। মেজাজটা ঠাণ্ডা না করলে চলছে না।
গজগজ করতে থাকা আফসানা রান্নাঘরের একপাশে স্টিলের ছোট্ট একটা বসার টুলে বসে পড়লেন। এটা তিনি সুফিয়ার জন্যই রেখেছেন। যদি কখনো হাঁটুর পীড়াটা নেমতন্ন ছাড়াই হাজিরা দিতে চলে আসে, তখন এই টুলে বসলে হাঁটুর বেদনাটা নির্লজ্জের মতো পা গুটিয়ে পালাতে থাকবে। আড়চোখে সুফিয়া বিচলিত আফসানার মুখটা দেখে চা বানানোর দিকে মনোযোগ ছুঁড়লেও এখন তিনি আশা করছেন ঝামেলাটা ডায়ে বাঁয়ে কেটে যাক। এই রহস্য আজীবন যদি ধোঁয়াশার ভেতর থাকে তবেই বোধহয় সকলের জন্য মঙ্গল। চায়ের কাপে চামচ নাড়াতে নাড়াতে সেটা আফসানার দিকে বাগিয়ে দিয়ে বেশ শান্ত চিত্তে বললেন সুফিয়া,
- গ্যারেজে মনে হয় গান টান বাজাইন্না শিখে আপা। হেইদিন যে আপনের বইনের ওইহানে কী সুন্দর কইরা গিটার বাজায়া সবাইরে টাস্কি খাওয়াইয়া দিল, এমন কিছুই হয়ত ওইহানে বইয়া বইয়া বাবায় করে। ওর লুকাইন্না স্বভাব তো আপনে জানেনই। ওর অনুমতি ছাড়া মনে হয় না ওর জিনিসে হাত দেওনডা ঠিক হইব।
- যেই যুক্তি তুমি আমাকে দিচ্ছ, ওখানেও তো প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে। গান যদি ওখানে বসে বসে গেয়েও থাকে তাহলে এতদূর পর্যন্ত শব্দ আসবে না কেন? আমি আজপর্যন্ত কেন একটা বাড়তি শব্দ শুনলাম না?
সুফিয়া এ পর্যায়ে হাসি দিয়ে বললেন,
- আপনে মনে হয় ভুইলা গেছেন আপা। যদিও হেই সময় আপনে রংপুর আছিলেন কামের উছিলায়। সাঈদ বাবায় ওই গ্যারেজের ভিত্তরে একদিন লোক ডাকায়া কী কী জানি করছিল, ওই কাহিনির পর থিকা ওই ব্যাডাগোর কাছে হুনছিলাম বোমা ফাটাইলেও শব্দ হইতো না এমন কিছু ভিত্তরে করছে। আপনেও তো হেইদিন ফোনে ফোনে ঘটনা শুইনা কী একটা ইংলিইশা নাম কইছিলেন। মনে কইরা দেহেন।
আফসানা কপাল কোঁচকানো অবস্থায় চায়ে চুমুক দিয়ে শুধালেন,
- কী নাম বলেছিলাম? মনে তো পড়ছে না। সাউন্ড প্রুফ সিস্টেম নাকি?
ভদ্রমহিলা প্রবল উত্তেজনায় সাড়া দিতে দিতে হ্যাঁ সূচকে বলতে লাগলেন,
- হ হ আপা, ওইডাই ওইডাই! সান্ড পুরুফ! ওইডার কতাই তো আপনে হেসময় ফোনের ভিত্তরে বুঝায়া কইছিলেন। আপনে মনে হয় কাজের চাপে ঘটনাডার কতা ভুইলা গেছেন আপা। মনে করেন, এরপরে এইডাও কইছিলেন যে বাবায় ওইরম কিছু করছে দেইখা কুনো শব্দ নাকি বাইরে আইব না। আপনে কতা মোতা এত্তো তাত্তাড়ি ভুইলা যান গা ক্যা?
হুট করে আফসানার মনে পড়ল তিনি আসলেই একদিন এ বিষয়ে সুফিয়ার সাথে ফোনে কথাবার্তা বলেছিলেন। তখন ঢাকা থেকে দূর সিলেট জেলায় একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজের প্রেক্ষিতে প্রচণ্ড ব্যস্ত স্ক্যাজিউলের ভেতর বাসার খবর নেওয়া হচ্ছিল। কিন্তু নানা কাজের দরুন এটা সম্পূর্ণই মস্তিষ্ক থেকে বেরিয়ে যায় যে সাঈদ ওর গ্যারেজে শব্দ নিরোধক পদ্ধতি ব্যবহার করেছে। এটার পেছনে কেন টাকাগুলো নির্বুদ্ধিতার মতো খরচ করল এটা নিয়েও প্রচণ্ড ক্ষিপ্ত ছিলেন সেসময়। কিন্তু কীভাবে তিনি কথাবার্তা ভুলে যাচ্ছেন! মহা বিপজ্জনক ব্যাপার। আচ্ছা সাধারণ একটা বাসাবাড়িতে কেউ কী গ্যারেজের ভেতর সাউন্ড প্রুফ সিস্টেম লাগায়? এরকম কোনো বিস্ময়কর ঘটনা ঘটেছে কী?
•••••••••••••
সবুজ ঘাসের উপর ঝুরঝুরে শিশির মুক্তোর মতো জ্বলজ্বল করছে সদ্য স্নাতার কোমল দেহে জল বিন্দুগুলি। ঠাণ্ডা পানির পরশে শরীরের প্রতিটি রোমকূপ শিহরিত হয়ে বড্ড শীতল হয়ে যাচ্ছে। একটুখানি তাপীয় সংস্পর্শের জন্য গরম কাপড়ের জানান দিচ্ছে তারা। থরথর করে কাঁপছে শাড়ি মুড়োনো শরীর, শীতল হয়ে আছে দুটি শ্বেত উজ্জ্বল হাত পা। ভেজা চুলের পানিতে পিঠের শুভ্র ব্লাউজটুকু ভিজে হালকা গোলাপিবর্ণের জামদানি শাড়িটাও অবাধ্যের মতো ভিজাতে শুরু করেছে। দেয়াল ধরে ধরে বহুকষ্টে ওয়াশরুমের ছড়ছড় পানির ট্যাপটা বন্ধ করলে আলমারির দরজায় হাজির হয় ফিহা। একটু আগে এই গোলাপি জামদানীটা খুব সুন্দর করে পড়িয়ে দিয়ে গেছে সুফিয়া খালা। এখনো অন্যের সাহায্য ছাড়া কাজ করতে সমর্থ নয়। কতদিন যে এই যন্ত্রণার উদ্রেক সহ্য করতে হবে জানা নেই। শরীরের একটি অঙ্গ আঘাত পেলে পুরো মানব দেহই অচল।
আলমারির দ্বারদুটো খুলে অসহ্য রকম বিরক্তি নিয়ে দেখল, বাঁদিকের তাকে থরে থরে সাজানো সবগুলো শার্টই কেমন মন মরা, গম্ভীর, অত্যন্ত গাঢ় বর্ণের। নেভি, বাদামী, কালো শেডের কাছাকাছি মেরুন, মেটে সবুজ ও অন্ধকার রঙ কালো। তাও সেখানে কালো রঙের শার্টই আঙুল দিয়ে গুণে গুণে দেখল পাঁচটা আছে। এই মানুষটা আর কতটুকু অদ্ভুত আচরণ দেখাবে? আর কত? ঠিক নীচের তাকটা খালি করে সেখানে পরিপাটি করে গুছিয়ে দিয়েছে কিছু ঘরোয়া শাড়ি এবং লাগেজের অন্যান্য কাপড়। সুফিয়া খালার কাছ থেকে জানতে পেরেছে এ কাজগুলো স্বয়ং গম্ভীরমানব নিজের পেশিবল দুটি হাতে করে দিয়ে গেছেন। তাঁর ব্যক্তিগত জিনিসে এখনো অবধি, সেই চৌদ্দ বয়স থেকে অন্য কারোর হাত লাগিয়ে দেওয়ার প্রবণতা সৃষ্টি হয়নি। ফলে, এইটুকু কাজও যে কখন কোন ফাঁক দিয়ে সম্পন্ন করে নিজের কালো গাড়ি নিয়ে অফিস হাজিরা বেরিয়ে গেছে, তাও জানত না ফিহা। ব্যাপারটা দেখে মুচকি হেসে কেন জানি ড্রয়ারটার দিকে কৌতুহলবশত চোখ পড়ল। আধখোলা হয়ে আছে। চিকন ফাঁক দিয়ে দেখা যাচ্ছে আধো আধো অন্ধকার। ড্রয়ারটা কী খুব তাড়াহুড়োতে লাগানো হয়েছে? ডানহাত দিয়ে একটান মেরে ড্রয়ারটা খুলতেই চরম আশ্চর্যে কপালের সবগুলো খাঁজ দৃঢ় হয়ে গেল। ড্রয়ারে একটা ডায়েরি। শোভা পাচ্ছে সেদিনের চিলেকোঠায় দেখা গাঢ় বাদামি চামড়ার শক্ত মলাটের ডায়েরিটা। টেবিলের পাশে এটাই শেষবারের মতো তাঁর ঘুমন্ত মাথার কাছে দেখেছিল। কিন্তু ডায়েরিটা এমন উলটো করে রাখা কেন? সমুখ দিকটা উলটো করে কেউ কেন রাখতে যাবে? তাহলে কী সামনের দিকটায় ভয়াবহ কিছু লুকানো আছে? ফিহা জানে যে কারো ব্যক্তিগত সম্পদ ধরার ব্যাপারে নিষিদ্ধ আকর্ষণ রাখাই ঘোরতর নিষিদ্ধ। কিন্তু মন মানছে না। একদম মানছে না। উগ্র আগ্রাসীরূপে জানান দিচ্ছে, এই ডায়েরিটায় কিছু অপ্রত্যাশিত ব্যাপার লুকানো আছে। হয়ত এমন কিছু লুকোনো, যা এ বাড়ির প্রতিটি মানুষ খুব সন্তর্পণে ওর কাছ থেকে আড়াল করে নিচ্ছে। ঢোক গিলে অবোধ চেতনার কাছে হার মেনে ডানহাতটা ডায়েরির উপর রাখছিল ফিহা, হঠাৎ ওর পুরো হাতটা ঢেকে দিয়ে পেছন থেকে আস্তে আস্তে গ্রাস করল শক্ত, উষ্ণ, পুরুষালি হাতের মুষ্টি। হৃদস্পন্দন ছলকে উঠল! পিঠের মেরুদণ্ড বেয়ে ছুটে গেল ভয়ের শীতল হিম স্পর্শ। মুষ্টি সংকুচিত করতেই ওর চিকন আঙুলের ফাঁকে ফাঁকে নিঃশব্দে শক্ত আঙুল ঢুকিয়ে দিল সে। দৃষ্টিজোড়া প্রবল আতঙ্কে বড়ো বড়ো হয়ে গেলে খুবই ধীরভাবে ঢোক গিলল ফিহা। যেখানে বাঘের ভয় সেখানেই সন্ধ্যে হয়। পেছন থেকে কঠোর উদ্দীপ্ত স্বরে জিজ্ঞেস করে উঠল জুনায়েদ সাঈদ,
- আলমারির সামনে দাঁড়িয়ে কী করছেন আপনি? এখানে আপনার থাকার কথা না।
আত্মা শুদ্ধো কাঁপিয়ে দেওয়ার সুযোগটুকুও পেল না ফিহা। প্রস্তরখণ্ডের মতো জমে গেল পাংশুটে মুখ। এমন আশ্চর্যজনক আগমনে ওর গলাটা গ্রীষ্মের খরা বনে গেছে, দীঘল কালো চোখদুটিতে অতলান্ত বিষ্ময়ের ছোবল। কখন আসলো এই ঘরে? পায়ের শব্দটুকু আজো কেন দুকানে শুনতে পেল না? হঠাৎ ওর মানসপটে ন্যাশনাল জিওগ্রাফি চ্যানেলে দেখা হিংস্র আগ্রাসী বাঘের নিঃশব্দ পদচারণ এবং সেই নিঃশব্দতার মাঝে হরিণের উপয ঝাঁপিয়ে ছিঁড়ে ছিন্নভিন্ন করে দেওয়া! আশঙ্কিত নিঃশ্বাসগুলো বুক ফুলিয়ে ফুলিয়ে নিতেই ফিহা চরমভাবে গলা শীতল রেখে বলল,
- ক. .কখন এসেছেন আপনি? পায়ের শব্দ পেলাম না কেন?
উত্তরে ডান কানের কাছে নিঃশ্বাসের হলকা যেন প্রবলভাবে ছুঁয়ে যায়। বাঁহাত এগিয়ে ফিহার দীঘল সুন্দর চোখদুটো হাতের আড়ালে ঢেকে নেয়। ডায়েরির উপর থেকে ওভাবেই ওর হাতটা করতলে আবদ্ধ করে নিঃশব্দে সেটা সরিয়ে আনতে আনতে বলল সাঈদ,
- আপনাকে রেস্ট করতে বলেছিলাম। যা কিছু প্রয়োজন, কাউকে ডেকে দিলেই হতো। এখানে আলমারির সামনে দাঁড়িয়ে আপনার হাসবেন্ডের ডায়েরিতে তল্লাশি চালাতে হচ্ছে কেন? কোথাও অবিশ্বাস জন্মেছে?
ওইটুকু জায়গার ভেতর পেছন থেকে জড়িয়ে ধরা সাঈদের শারীরিক অস্তিত্বে কোমল হরিণ শাবকের মতো আঁটকা পরে থাকে ফিহা। নড়চড় করবার ক্ষমতাটুকু শূন্য। চোখের উপর বাঁহাত দিয়ে দৃষ্টিযুগল ঢেকে দিয়েছে সে। সে যখন ভালোভাবে ওকে ধরে, তখন এমনভাবেই ধরে যে এক ইন্ঞ্চিও এদিক ওদিক আঙুল নাড়ানো সম্ভবপর হয় না। ওরকম এক জংলী থাবায় আঁটকা পরেছে ফিহা স্তিমিত স্বরে আস্তে আস্তে বলে উঠে,
- আগে ছাড়ুন। চোখ থেকে হাত সরান। তারপর বলছি কেন দাঁড়িয়ে আছি এখানে। এভাবে ধরে থাকলে কিছুই আমি বলব না।
কথা শুনে কোনো হেলদোল ঘটল না দুর্বিনীত সাঈদের মাঝে। সে বরং ক্লান্ত মুখটা ওর ভেজা ভেজা ডান কাঁধের মাঝে লুকিয়ে ভীষণ প্রসন্নসুরে বলে উঠে,
- আপনার সাথে মিশে থাকতে আমার ভালো লাগছে নাবিলা। আজ প্রথমবার মনে হলো, রুমে যত দ্রুত সম্ভব, আমাকে ফিরতে হবে। কেউ আমার জন্য বুকভরা অপেক্ষা নিয়ে বসে আছে। হয়ত আপনার গায়ের এই পবিত্র খুশবুটাই প্রচণ্ড মিস করছিলাম। ঠিক কতটুকু, ওটা তো বলতে পারব না।
জড়বুদ্ধির মতো স্থির হয়ে চুপচাপ ওভাবেই দাঁড়িয়ে রইল ফিহা। মানুষটার ওইটুকু আকুল ভরা কণ্ঠের তীব্র অনুরাগী কথাগুলো ন্যুব্জ করে দিল ওর বিদ্রোহী মন। নরম ডানহাতটা শূন্যে তুলে আস্তে আস্তে নিজের জেল মাখানো চুলের মাঝে বুঝে দিয়েছে সাঈদ। যেন নীরবেই সে বোঝাল, তার চুলগুলোতে আবারও একটু আদর করে দিতে। ঠিক কালরাতের মতো, যেমনটা আঙুলের ফাঁকে মুঠো করে ধরেছিল। ফিহা এরকম ছোট্ট ছোট্ট আবদারে ফিচেল হেসে সরু আঙুলে সত্যিই ছুঁয়ে দেয় দুষ্টু সুন্দর চুলগুলো। বড্ড আদর করে। ফিহা তখনও জানে না সাঈদ এই ফাঁকে কী কী কীর্তিকাণ্ড করে যাচ্ছে চুপচাপ। প্রথমে খোলা ড্রয়ারটা চোরের মতো নিঃশব্দে বন্ধ করে দিল। পকেট থেকে “বিপজ্জনক” একটি জিনিস বের করে সেটাও ত্রস্তগতিতে ঢুকিয়ে দেয় ভাঁজ করা শার্টগুলোর ভেতরে। চোখদুটো তাড়াতাড়ি উপর টু নিচ শেষবারের মতো অ্যানালাইসিস করে দেখে সবকিছু ঠিক আছে কিনা। ইয়েস. . সব পার্ফেক্ট। কিচ্ছু নেই! এরপর পূর্ণ মনোযোগ আবারও ঘুরে যায় তার বন্দিনী প্রাণীটির মাঝে। দুষ্টুমি করে বন্দিনীর সরু কাঁধের শুভ্র ব্লাউজটুকু দু আঙুলে খানিকটা সরিয়ে সেখানে নত করল মুখ। খয়েরি যুগল বসালো শুভ্র নরম চামড়ার উপর। চোখ ঢেকে রাখা বাঁহাতটা আস্তে আস্তে মুখ ছুঁয়ে নামালে প্রথমে কিছুই বুঝতে পারছিল না ফিহা। হঠাৎ কয়েক সেকেন্ড পর ব্যথাতুর শব্দে চিৎকার দিয়ে উঠলে তৎক্ষণাৎ হাতটা চেপে ধরল ওর গোলাপি ওষ্ঠযুগল।
•••••••••••••
দুপুরের খাবার খেয়ে সবাই একটু বিশ্রামের আশায় যার যার জায়গায় গা ছেড়ে দিয়েছে। পাঁচবন্ধু আগে একত্র হলে দোতলার মধ্য রুমে সাঈদের বিছানায় গড়াগড়ি খেত। কিন্তু দিন এখন বদলে গেছে। আদিবের মতো সাঈদও এখন বিবাহিত পুরুষ। ঘরে বউ আছে। যাওয়া যাবে না। সকলের চক্ষু আড়াল থেকে দূর, বাড়ির ছাদে উঠে সেখানে নিজেদের মতো আড্ডা বসায় পাঁচজন। ছাদের দরজাটা সুন্দরমতো ভেতর থেকে লাগিয়ে বিশাল মাদুর বিছানো জায়গাটায় চলে এলো সাঈদ। চিলেকোঠা থেকে দুটো কোল বালিশ এনে তাতে মাথা এলিয়ে শুয়ে পরেছে ফাহাদ ও সাব্বির। ঘুম ঘুম চোখ। ছোটো দিনের সূর্যটা বিকেলের আঁচে ভরন্ত। তাদের পাশে বসে আছে আদিব ও লাবিব। দুজনের হাতে দুটো কমলার জুস। লাবিবের পাশে ফাঁকা স্থানটা ভরাট করে বসে পড়ল সাঈদ।
পাঁচ পাণ্ডবের ষোলকলা পূর্ণ।
বাতাসের গতিতে সকলের হাস্যোজ্জ্বল মুখ ঘন অন্ধকার ঘেরা রহস্যের মতো দুর্বোধ্য হয়ে উঠেছে। আর্মি প্যাটার্নের ফুলপ্যান্ট পরা আদিবের। প্যান্টের ডান পকেটে হাত ঢুকিয়ে সেখান থেকে বের করল এক টুকরো বিশেষ কাগজ। চারজনের দিকে কাগজটা টানটান করে বাড়িয়ে দিয়ে বলল,
- উত্তেজিত হবি না কেউ। ঠাণ্ডাভাবে পড়ার জন্য দিলাম, শান্তভাবে চিন্তা করবি। আমার মনে হয় সাঈদের এখন সর্বোচ্চ সময়টা নাবিলার জন্যই দেওয়া উচিত। ওই মাসুম মেয়েটা নিজেও জানে না কোন ভ° য়ংক র জায়গায় টার্গেট হয়ে আছে। সম্ভবত ওর জীবনে জেলা পর্যায়ে খেলাধূলা করার ব্যাপারটা একটা কঠিন অ ভি শা প ছাড়া কিছুই না। আমি এখনো চাচ্ছি আমার ইনফর্মার লোকটা ভুল হোক! কিন্তু এটা জানার পর থেকে এখনো স্থির হতে পারিনি। যদি এই তথ্য হয়, তাহলে নাবিলার সু রা হা আজন্মের ঘুচে যাবে। অ ভি শ প্ত ইলেভেন কত মেয়ের অ স্তি° ত্ব হাওয়া করে দিয়েছে, এটা আমি মনে করতে চাচ্ছি না এখন।
আদিবের উদ্বিগ্ন স্বর সবাইকেই অতল চিন্তার সাগরে ধাক্কা দিয়ে ফেলেছে। সকলের মুখ থমথমে পাথর। তার চেয়ে বেশি থমথম দেখাচ্ছে সাঈদের রুক্ষু মুখ ও শীতল চোখ। সে কিছু ভাবতে চাইল না এই মূহুর্তে। একপলক শুধু কাগজের টুকরোতে নজর বুলিয়ে চুপচাপ চোখটা দূর রেলিংয়ে ফেলে রাখে। লাবিব কাগজের উপর থেকে দৃষ্টি সরিয়ে সরাসরি আদিবকে প্রশ্নের মুখে ফেলল,
- ইলেভেনের নজর পরেছে মানে? আদিব . . আদিব তুই কী বুঝতে পারছিস এই মূহুর্তে কোন খতারনক শব্দটা উচ্চারণ করছিস?
আদিব নির্বিকার ভঙ্গিতে জবাব দিল,
- অবুঝের মতো কথা বলিস না তুই। তোর “ডিজিএফআই” বিভাগ এটাকে রেড সিগন্যাল হাই সিক্রেসি বলে সি ল মে রে রেখেছে। এটা খুব ভালোমতো তুইও জানিস লাবিব। আমি এখানে মোদ্দাকথায় আলাপ করতে এসেছি। আমার মনে হয়েছে বাংলাদেশের সবচাইতে হাই অ্যালার্ট টপ সি ক্রে ট ঘটনা— যা আজও পর্যন্ত কোনো মিডিয়া বা নিউজ পেপারে সরাসরি লেখার সুযোগ পায়নি, সেই ঘটনাটার সাথে আমাদের বন্ধুর বউ দুর্ভাগ্যক্রমে জড়িত। জড়িয়ে পরাটা ওর জীবনের সবচাইতে বড়ো দুর্ভাগ্যই বলব। নাবিলা এখনো জানে না ওকে চিরুনি অভিযান চালিয়ে খোঁজ করা হচ্ছে। খুঁজে পেলে কী অবস্থা করে ছাড়বে ওটা আমি কল্পনাও করতে পারছি না! ওর কাছে এমন একটা জিনিস আছে যেটার জন্য বেচারি নিজেও দায়ী . . আর . .
এ পর্যায়ে এসে জুসের গ্লাসটা ঠোঁটে ঠেকাল আদিব। চরম গুরুত্বপূর্ণ কোনো বিষয়ে কথা বলতে গেলে তার গলার শুষ্কতা তিনগুণ বেড়ে যায়। ঘন ঘন পানির তেষ্টা পায়। অন্যদিকে তিনজনের মুখ প্রবল উত্তেজনায় উন্মুখ অস্থিরতায় আঁটকে আছে। যেন এক্ষুণি সব কথা শোনার জন্য ঝাঁপিয়ে পরবে আদিবের উপর। আদিব ধীরস্থির ভাবে জুসের গ্লাসটা মাদুরের উপর রেখে গলা পরিষ্কার করে বলল,
- দ্বিতীয় আরেকটা কথা। আফিফ ছেলেটাকে ধরে ফেলেছি। দুটো বাংলা ডলা দিতেই তোতাপাখির মতো বলতে শুরু করেছে। সাঈদ সেদিন বলেছিল দীপের বিয়ের দিন বাসের ভেতরে একটা হামলা হয়েছিল। আর কাজটা ওই হা. . বাচ্চা আফিফেরই। কাহিনিটা তোদেরও একটু খুলে বলি শোন . .
আদিব তার কথাগুলো বলতে শুরু করলে সাঈদ তখন তার মোবাইল ফোনে কিছু একটা করতে মশগুল। দুকানে শুনছে কীভাবে আফিফের নাক বরাবর ভুটানের মানচিত্র বানিয়ে দিয়েছে। তার চপল বউ যে ভয়ের মুখে হিল জুতো দিয়ে এতো সুন্দর সুন্দর শৈল্পিক কর্ম করতে জানে, এটা শুনে অন্যরকম ভালো লাগায় ছেয়ে যাচ্ছিল মন। হাসিও পাচ্ছিল। একটুও খারাপ লাগছিল না শুনতে, অমন নাজুক পরিস্থিতিতে কীরকম দুঃসাহসী কাজটা করেছে। ইচ্ছে করছিল কোমল মুখটায় অসংখ্য চুমু খেয়ে তার গর্বিত উচ্ছ্বাসটুকু বুঝিয়ে দিতে।
সেদিন ফিমাকে দেখা করার জন্য আ ল্টি মে টা ম দিয়েছিল আফিফ। দীপের বাড়ি থেকে আড়ি পেতে অনুসরণ করতে করতে হাজির হয় সেদিন রাতে, বাসের মধ্যে। ভুলবশত ফিহা সেখানে মাইগ্রেনের যন্ত্রণায় একটু আরাম খুঁজতে এলে তখন প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে বাইরে ছিল আফিফ। ফিরে এসে যখন দেখে ফিমার পরিবর্তে ওর ছোটোবোন ফিহার উপস্থিতি এবং পুরোনো এক অপমানের জিঘাংসা থেকে প্রতিশোধ নেবার এমন বর্ণিল সুযোগ— তখন চোখের সামনে সুনশান জায়গায় নারী দেহের লোভটা যেন আঁটকাতে পারেনি। লাইটটা নিভিয়ে তৎক্ষণাৎ ঝাঁপিয়ে পরে ওই মূহুর্তে। কিন্তু বিদ্যুৎবেগে সপাং সপাং ভারি হিলের আ ঘা তে তার নাকের কাছটা দুভাগ হ য়ে ফে টে যায়। পাঁচটার মতো বিশ্রী সেলাই পরেছে মুখে। আপাতত এটুকুই আদিবের মুখ থেকে সকলের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে আসে।
••••••••••••
রুমের দরজা ঠেলে ধীরপায়ে ঢুকতে ঢুকতে শান্ত চোখদুটো বিছানার দিকে পড়ল। পরিপাটি সুন্দর বেশে রেডি হয়ে আছে ফিহা। সমান ঝরঝরে মিষ্টি সুরভির চুলগুলো বাঁপাশে একটা বেণী করে ঝুলিয়ে রেখেছে। মুখের উপরে ছেয়ে থাকা ছোটো ছোটো চুল কখনো ঠোঁটের কাছে, কখনো বা লুকোচুরি খেলছে কৃষ্ণপল্লব নয়নজোড়ার উপর।চামড়ার ব্যাগে চেইন খুলে রাখা অংশে হাত ঢুকিয়ে কপাল কোঁচকানো ভ্রুঁদুটো হঠাৎ দরজার অভিমুখে পুরুষ ছায়াটি দেখে আস্তে আস্তে মসৃণ হয়ে যায়। সুদীর্ঘ মানুষটির পড়ণে ধূসর টিশার্ট, ঘরোয়া সাধারণ কুচকুচে কালো ট্রাউজার। তার মুখের ছায়াপাত আজ একটু অগোছালো। বোধহয় দুপুরে ফিহার মুখ ফোলানো কপট ক্ষুব্ধ মুখায়ব দেখে এখন যেয়ে একটু আধটু অপরাধবোধ কাজ করছে। সে যে ওর ডান কাঁধের ওখানে লাল সীলমোহর বসিয়ে দিয়েছে, এটার জন্য মাথানত করে থাকা উচিত। কিন্তু কেন যেন ওর মনে হল, কিছু একটা নিয়ে তাঁর মনটা ঘোর বর্ষার মতো খারাপ। ভোরে দেখা ফুরফুরে প্রান্ঞ্জল ভাব এখন আর চোখদুটোতে নেই। সে দরজা চাপিয়ে ধীরপদে সামনে এসে ওর দিকে নিজের ডানহাতটা ওর দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলে,
- মা আপনাকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে যাবে। এক্স-রে রিপোর্টগুলো গাড়ির ড্যাশবোর্ডে রেখে দিয়েছি। প্রয়োজন পরলে গাড়ি ঘুরিয়ে আপনার বাবার ওখান থেকেও একরাত থেকে আসতে পারেন। উঠুন।
অন্যসময় হলে এই হাতটা ধরতে একটুও সময় নিত না ফিহা। কিন্তু এখন তার কথাগুলো শুনে বুকটা প্রচণ্ড মোচড় দিয়ে উঠেছে। সে কী নিজ দায়িত্বে ওকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাচ্ছে না? কেন? এখানে “মা” যুক্ত হলো কোত্থেকে? হঠাৎ ফিহা দেখল, তার হাতের ফোনটা ক্রমাগত কেমন অদ্ভুত ভঙ্গিতে অন-অফ হচ্ছে। যেন উন্মত্তের মতো প্রচণ্ড অস্থির হয়ে উঠেছে ওই মুঠোফোন!
.
.
.
চলবে.....................................................................