ধূসর রঙের গাড়ির ছাদে বসে কৌশিক প্রচণ্ড হাঁপাচ্ছিল। চারদিকে বিশৃঙ্খলা, আর ড্রাইভার সেই কবে পালিয়েছে। হঠাৎই এক চা বিক্রেতা ছুটে এসে কৌশিকের সামনে থামলো। কৌশিক তাকে একঝলক দেখে ঠাণ্ডা গলায় বললো,
"খুব ভালো সময়ে এসেছেন। এক কাপ চা দিন।"
লোকটা কাপ গুঁজতে গুঁজতে বললো,
"ভাই, এখানে কি সিনেমার শুটিং চলতেছিল?"
কৌশিক ভ্রু কুঁচকে তাকালো কিন্তু চুপ থাকলো। লোকটা ধোঁয়া ওঠা প্লাস্টিকের কাপ তার হাতে ধরিয়ে দিল। কৌশিক ধীরে ফুঁ দিয়ে এক চুমুক নিলো।
লোকটা কাপড়ে হাত মুছে কৌশিকের দিকে তাকিয়ে আবার বললো,
"আপনে কি কোনো সিনেমার হিরো?"
কৌশিক হঠাৎ জোরে হেসে উঠলো। কিছু সময় পর মনে পড়লো হাসছে কেনো? এতো হাসাহাসি তো তার স্বভাবে নেই, কিন্তু মেজাজ বেশ ফুরফুরে আজ। কৌশিক হাসি থামিয়ে ঠাণ্ডা চোখে লোকটার দিকে তাকিয়ে গম্ভীর গলায় বললো,
"থ্যাংকস ফর দ্য কমপ্লিমেন্ট। কিন্তু আমি কোনো সিনেমার হিরো নই। একচুয়েলি, আমি বরং ভিলেনই বেশি প্রিফার করি।"
"কি যে বলেন! আপনে আর ভিলেন! যা সুন্দর চেহারা!"
কৌশিক ঠোঁটের কোণে এক রহস্যময় মুচকি হাসি রেখে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
"কিন্তু অনেক অনেক বছর আগে থেকেই মানুষ আমাকে বিশ্বাসঘাতকতার এক উদাহরণ আর ভিলেন হিসেবেই চেনে। সুন্দর মুখ থাকলেই যে ভিলেন হিসেবে সিনেমায় কাজ করতে পারব না, এটা ভাবাও ভুল।"
সে চায়ের কাপে হালকা গোলাপি ঠোঁটের শেষ চুমুক বসালো। এমন সময় পেছন থেকে পুলিশের সাইরেনের তীক্ষ্ণ শব্দ শোনা গেল। কৌশিক ধীরে ধীরে নেমে দাঁড়ালো, মুখ তুলে আকাশের দিকে তাকিয়ে বলল,
"আহ! আকাশের দিকে তাকান, ভাই। দেখুন আকাশ কতটা সুন্দর। আর চা টাও দারুন।"
চা বিক্রেতা তার কথায় বিভ্রান্ত হয়ে মাথা উঁচু করে আকাশের দিকে তাকালো। দিনের আলোতে সূর্যের জ্যোতি ঠিক আগের মতোই ছড়িয়ে পড়েছে। বিশেষ কোনো সৌন্দর্য খুঁজে পেল না আকাশে। সাধারণ চা বিক্রেতা সে, দিন আনতে পান্তা ফুরোয়। আকাশের সৌন্দর্যের দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকা সময় নষ্ট ছাড়া বিশেষ কিছু মনে হয় না তার কাছে।
তাই মাথা নামিয়ে সে আবার কৌশিকের দিকে ফিরে তাকানোর জন্য ঘুরলো, কিন্তু সেখানে কেউ নেই। গাড়ির ছাদে পড়ে ছিল শুধু সেই খালি চায়ের কাপ আর বিশ টাকার একটা নোট। মুচকি হেসে ফেললো লোকটা।
•••••••••••••
"আপনি ছুটি নেওয়ার আগে কার কাছে পারমিশন চেয়েছিলেন?"
রূপালী কবিরের কণ্ঠে ধীর জিজ্ঞাসা। অনন্যাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের অভিজ্ঞ শিক্ষক, ছাত্র ছাত্রীদের উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োজিত আছেন, যিনি সবসময় নিয়ম-শৃঙ্খলাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেন, আজ তীব্র অসন্তুষ্টি নিয়ে কৌশিকের দিকে তাকিয়ে আছেন। ছাত্র ছাত্রীদের অভিযোগের কারণে জরুরি ভিত্তিতে কৌশিককে ডাকিয়ে এনেছেন তিনি।
কৌশিক শান্তভাবে উত্তর দিলো, "অথোরিটির কাছে ই-মেইল পাঠিয়েছি।"
"তাহলে অথোরিটি আপনার ই-মেইলের উত্তর দিয়েছিলো?" রূপালী ম্যাডামের গলায় একটুখানি কৌতূহল মেশানো ছিল।
"না।"
রূপালী ম্যাডামের চশমার কাঁচে আলো ঝলসে উঠল। তার গলার স্বর কঠিন হলো, "তাহলে আপনার এভাবে ছুটি নেওয়া একদম উচিত হয়নি। আপনার নামে অভিযোগ এসেছে। আপনার অনুপস্থিতির কারণে ছাত্র ছাত্রীরা পড়াশোনা করতে পারছে না।"
কৌশিক মৃদু হাসল, ঠোঁটের কোণটা একটু বাঁকিয়ে বলল, "এটাকে অভিযোগ বলা যায় না, ম্যাডাম। আমার ছাত্র-ছাত্রীরা আমার পড়ানোর স্টাইল মিস করছিলো। নাথিং এলস।"
রূপালী ম্যাডাম ক্ষণিকের জন্য স্থির তাকিয়ে রইলেন।
তারপর নিজের চুলগুলো একপাশে সরিয়ে দ্রুত হাতে বাঁধতে লাগলেন। বাঁধা শেষে চোখ পিটপিট করে কৌশিকের দিকে তাকিয়ে বললেন, "আমাকে ম্যাডাম বলবেন না। আমি অবিবাহিত।"
কৌশিক ভ্রু কুঁচকে হালকা কৌতুকের সুরে বলল, "ওহ! তো কি বলবো?"
"অনলি রূপালী! যেটা শুধু আপনার জন্য এভেইলেবল।"
"স্যরি," কৌশিক গম্ভীর মুখে বলল। "কিন্তু আমার জন্য ম্যাডামই ঠিক আছে।"
রূপালী চশমার ফ্রেমটা সামলে নিয়ে দরজার দিকে একবার ভালো করে তাকালেন। সময়টা সন্ধ্যাকালীন। রুমটা একদম নিঃসঙ্গ হয়ে আছে। বেশিরভাগ প্রফেসররা ইতিমধ্যেই বাসায় চলে গেছে। রূপালী কবির নিশ্চিত হয়ে, চেয়ার ছেড়ে কৌশিকের দিকে ধীর পায়ে এগিয়ে এলেন।
"আহ! আপনি এমন কেনো?"
ফিসফিসিয়ে বললেন রূপালী।
কৌশিক এক পা পিছিয়ে গিয়ে বলল, "আপনি একটু বেশিই এগিয়ে যাচ্ছেন!"
রূপালী চোখ সরু করে বললেন, "আপনার বাসার এড্রেস আমার কাছে আছে। ভাবছি, আমার আত্মীয়-স্বজনকে পাঠাবো। আপনাকে আমার পছন্দ হয়েছে।"
কৌশিক হালকা হেসে মাথা নাড়িয়ে মৃদু কণ্ঠে বলল, "বুঝলাম! ধন্যবাদ। কিন্তু আপনাকে আমার পছন্দ হয়নি।"
রূপালী ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসলেন।
"রাজি না হলে আমি কিন্তু অথোরিটির কাছে জানিয়ে দেবো, আপনি বিনা অনুমতিতে দুই দিন ছুটি কাটিয়েছেন।"
"অসুস্থ হলে আমি কীভাবেই বা আসতাম?"
"আসলেই অসুস্থ ছিলেন? আমি শুনলাম কোনো ট্রিপে গেছেন!"
"ডাক্তার দেখানোর জন্যই যাওয়া হয়েছিল।"
গম্ভীর স্বরে বলল কৌশিক।
রূপালী কৌশিকের চুলে আলতো করে হাত বুলিয়ে বললেন,
"সে যাই-ই হোক, এখন ফ্রি থাকলে চলুন একটু বসি। আজ আপনাকে অন্যরকম লাগছে। অসুস্থতা যেন আপনাকে আরও ড্যাসিং বানিয়ে দিয়েছে। আর কলিগরা একসঙ্গে বসতেই পারে, তাই না? আপনার তো কারো সঙ্গে মিশতে দেখিনি। না মিশলে পরিচিতি হবে কীভাবে?"
কৌশিকের ভ্রু সামান্য কুঁচকে উঠল। এক নিঃশ্বাসে বলল, "নো থ্যাংকস। আমাকে যেতে হবে।"
কথা শেষ করে দরজার দিকে হাঁটতে শুরু করল সে। কিন্তু রূপালী পথ আটকালেন। "একটু থামুন!"
কৌশিক ঘুরে দাঁড়িয়ে তার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালো, মনে হচ্ছে সেই চোখ দিয়ে এখনি বিদ্যুৎ ছুটে আসবে। রূপালী ম্যাম তবু থামলেন না। কৌশিকের হাত চেপে ধরলেন। কিন্তু বড় ভুল পদক্ষেপ ছিল তার। কৌশিক এক ঝটকা দিয়ে হাত ছাড়িয়ে নিলো। এক নিঃশ্বাসে কিছুটা সামনে এগিয়ে রূপালী কবিরের চিবুকে ঠাণ্ডা আঙুল ছুঁইয়ে থেমে গেল। কৌশিকের দৃষ্টি এখন সম্পূর্ণ স্থির হয়ে আছে রূপালী কবিরের চোখে, মনে হচ্ছে কোনো তীক্ষ্ণ ছুরি যা এখনি ৩৫ বছর বয়সী রূপালী কবিরের চোখে ভেদ করে বসবে। আকস্মিক স্পর্শে রূপালীও হতচকিত হয়ে আছেন। কিছু বলার জন্য মুখ খুলতেই কৌশিক ধীর লয়ে এক আঙুল তুলে ঘরের কোণায় থাকা সিসিটিভি ক্যামেরার দিকে নির্দেশ করল। মুহূর্তে একটি তীক্ষ্ণ "ক্র্যাক!" শব্দ শোনা গেল। ক্যামেরাটি ধোঁয়া ছেড়ে ব্লাস্ট হয়ে পড়ল মেঝেতে।
ঘরজুড়ে এক মুহূর্তে পিন-ড্রপ সাইলেন্ট। রূপালী কৌশিকের সামনে সম্পূর্ণ এক মিনিট স্থির দাঁড়িয়ে থাকলেন। তারপর জ্ঞান হারিয়ে মেঝেতে পড়ে গেলেন।
কৌশিক শীতল চাহনি নিয়ে এক পা বাড়িয়ে তাকে হালকা ঠেলে সরিয়ে দিলো। তাচ্ছিল্যের সাথে হেসে বলল,
"আমার ইচ্ছার বিরুদ্ধে কেউ কিছু করতে চাইলে তার হাল এমনি হবে, মিস রূপালী কবির।"
কৌশিক চওড়া কাঁধ আর নিঃশব্দ পায়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেল,যেন কিছুই ঘটেনি এখানে।
•••••••••••••
"ক্যান আই কিস ইউ, লিটিল গার্ল?"
প্রশ্নটা শোনামাত্রই নোহারার মুখ থেকে পানির ফোয়ারা বেরিয়ে এলো, যা সরাসরি নিকোলাই ভেস্পারের মুখে গিয়ে পড়লো। তার ফর্সা মুখ, নীল-কালো চুল ভিজে কপালে লেপ্টে গেলো। ভেজা চুলের সাথে তার চিরকালীন আকর্ষণীয় চেহারা আরও আকর্ষণীয় হলো।
নোহারা, রেস্টুরেন্টে বসেই হকচকিয়ে জোরে বলে উঠলো,
"হোয়াট!"
নিক মাথা হালকা কাত করে তার বিখ্যাত মিষ্টি হাসি ঝুলিয়ে বললো,
"ইয়েস! আই ওয়ান্ট টু!"
নোহারা তার তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিকের উপর গেঁথে দিয়ে বোতলের উপর শক্ত করে আঙুল চেপে ধরলো। বোতলের মুখ থেকে পানি ছিটকে ফের নিকের দিকে ছুটে গেলো। এবার পুরোপুরি ভিজে গিয়ে নিক চুল ঝাড়তে লাগলো আর বিরক্তের সাথে তাকালো নোহারার দিকে।
নোহারা টেবিলে হাত দিয়ে জোরে আওয়াজ করে দাঁড়িয়ে পড়লো। নিকের দিকে আঙুল তাক করে বললো,
"অনেক সহ্য করেছি। আর করবো না। আমাকে কী পেয়েছেন আপনি? যা বলবেন তাই করতে হবে? ভয় পাই না আপনাকে। হু!"
নোহারা নিজের ব্যাগটা কাঁধে চড়িয়ে রেস্টুরেন্ট থেকে বের হয়ে যেতে লাগলো। নিক বুঝলো সে ভুল কিছু দাবি করে ফেলেছে, এই মেয়েটা অনান্যদের মতো অতো সহজ নয়। এতো সময় দেওয়ার পরেও নোহারার মন গললো না তার জন্য। নিক কি এতোই অসুন্দর? নিক এক মুহুর্তের জন্য ভেবে নিলো, স্যরি বলতে হবে। সে সজাগ হয়ে দ্রুত পায়ে হেঁটে নোহারার দিকে এগিয়ে মেয়েটার হাত চেপে ধরলো।
নোহারার বুঝতে সময় লাগলো না, সে এক দ্রুত পদে নিকের হাতটা মুচড়ে ছাড়িয়ে ফেললো, আর তারপর এক ঝটকায় পা ঘুরিয়ে নিকের পায়ে একটি শক্ত লাত্থি মেরে, মুখে এক বিশাল ঘুষি বসিয়ে দিলো। নিক আহ! উহ! আওয়াজ করে রেস্টুরেন্টের মেঝেতে মুখ থুবড়ে বসে পড়লো। নিজের মুখের আঘাতপ্রাপ্ত স্থানে হাত দিয়ে অবাক চোখে নোহারার দিকে তাকালো নিক। নোহারা মুচকি হাসলো, নিচু হয়ে হাঁটু গেড়ে বসলো। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে নিকের নাকে আরেকটা ঘুষি বসিয়ে দিলো, সেকেন্ডের মধ্যে রেস্টুরেন্টের মাঝখানে নিক চিৎপটাং হয়ে শুয়ে পড়লো।
অতঃপর বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে নোহারা বললো,
"আরেকবার যদি আমার পিছনে পড়েছেন, একদম পিস পিস করে কাটবো। আপনি কি জিনিস সব ভুলে যাবো! মেয়ে বলে ভেবে নিয়েছে কিছুই পারি না। আসছে! বিদেশি ভাল্লুক!"
তার মুখের শব্দগুলো কাটা ছুরি হয়ে ঝলসে উঠলো নিকের মুখে।
নিক পড়ে থাকা অবস্থাতেই উচ্চারণ করলো,
"প্লিজ! ডোন্ট লিভ মি!"
আশেপাশের কাস্টমাররা সবাই দুজনের দিকে তাকিয়ে সম্পূর্ণ তামাশা দেখছিলো। নোহারা চলে যাওয়ার পর একদল ওয়েটার নিককে উঠাতে আসলো।
••••••••••••
অনন্যা বাসায় এসে অস্থির ভাবে পায়চারি করতে লাগলো। মাথায় তখনও সেই ঘটনার ঝড় বইছে। লোকটা নিঃসন্দেহে কৌশিক স্যারই ছিল, এতে তার আর কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু যদি তাই হয়, স্যার বাসায় আসছে না কেনো? অনন্যার বুকের ভেতর এক অদ্ভুত অস্বস্তি চেপে ধরেছে। সে সোফায় বসে বই আর খাতা নিয়ে পড়ার ভান করলো। চোখ দুটো বারবার ডান পাশের গলির দিকে চলে যাচ্ছে। যদি স্যার হঠাৎ এসে হাজির হন! তাহলে তো এই পথ দিয়েই যাবেন। তখন নিশ্চয়ই দেখা হয়ে যাবে লোকটার সাথে।
সন্ধ্যা থেকে রাত নেমে এলো। তিনজন মিলে রাতের খাবারও সেরে নিলো। কিন্তু স্যার তো দূরে থাক, নিক ভাইয়াও এখনো ফেরেনি। যদিও নিক ভাইয়া প্রায়ই দেরি করে আসে। লারাকে রান্নাঘরে সাহায্য করে আবারো সোফায় এসে বসলো অনন্যা। রাতেও অনন্যা পড়াশোনায় মন বসানোর চেষ্টা করলো। ধীরে ধীরে রাত বাড়তে থাকলো। একসময় অনন্যা নিজেকে বোঝানোর চেষ্টা করলো, "হয়তো ভুল দেখেছিলাম আমি। লোকটা হয়তো স্যার ছিলেন না।"
ঘুমানোর সিদ্ধান্ত নিলো অনন্যা। ক্লান্ত শরীর নিয়ে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠছে। চোখ জড়ানো, ঘুমের ভেতরেই বই আর খাতা এক হাতে সামলে রুমে ঢুকলো। দরজা টেনে বন্ধ করে দিলো। শরীরের সব ভার মাথার দিকে জমে আসছিল, তাই বইখাতা টেবিলের উপর রেখে এক পা এগিয়ে বিছানার দিকে ঘুরে দাঁড়ালো। কিন্তু সামনে চোখে পড়লো অচেনা দৃশ্য। প্রথম সেকেন্ডে বিস্ময়, দ্বিতীয় সেকেন্ডে জোরে চিৎকার করে বসলো অনন্যা।
চোখের সামনে বিছানার ওপর, শান্তভাবে শুয়ে থাকা কৌশিক স্যার। মাথায় হাত দিয়ে আধশোয়া। হাতে তিনটি লাল গোলাপ। দৃশ্যটা একটা ধাক্কার মতো অনন্যার শরীরজুড়ে ছড়িয়ে গেলো। স্যারকে এভাবে বিছানায় দেখে অনন্যা মুখে হাত চেপে নিস্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কৌশিক স্যার মুচকি হেসে উঠে বসলো। গোলাপ ফুল নাকের সামনে নিয়ে গন্ধ শুঁকলো, কিন্তু মুহুর্তেই নাক কুঁচকে ফেললো। মাথা ঝাঁকিয়ে গোলাপ ফুলের গন্ধ ভোলার চেষ্টা করলো। তারপর বিছানা থেকে নেমে অনন্যার দিকে এগিয়ে এলো। ধীরে ধীরে এগিয়ে এসে অনন্যার দিকে ফুলগুলো বাড়িয়ে দিলো।
অনন্যা জিজ্ঞেস করে বসলো,
"গোলাপ...কিসের জন্য?"
"আমম... কোনো কারণ ছাড়াই," কৌশিক হালকা হাসি দিয়ে উত্তর দিলো।
অনন্যার চোখে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি জমাট বাঁধলো। "আপনি না সেদিন বললেন নিজের মুখ দেখাবেন না। তাহলে এখন এখানে?"
কৌশিক এক কদম পেছনে ফিরলো।
"বলেছিলাম, ঠিকই। কিন্তু তোমার মেসেজ-ই তো সব উলটপালট করে দিলো। তাই আসতেই হলো!"
"মেসেজে তো আমি ক্লাসে আসার কথা বলেছিলাম। আমার কাছে আসার কথা না!"
কৌশিক নিঃশব্দে তিনটা গোলাপ হাতে নিয়ে বিছানায় বসে পড়লো। মাথা নিচু করে ফুলগুলোর দিকে তাকিয়ে রইলো। একসময় গভীর কণ্ঠে বললো,
"একই কথা, অনন্যা। ক্লাসে আসিনি মানে তুমি আমাকে মনে করছিলে। আর আমি তো ভেবেই রেখেছিলাম, তুমি নিজে থেকে কিছু করলে...আমি চলে আসবো।"
অনন্যা বিরক্ত হয়ে পড়লো। চোখ থেকে রাতের ঘুম উড়ে হাওয়ায় বিলুপ্ত হয়ে গেছে সেই কখন। কৌশিক স্যারের একেক সময় একেক রূপ দেখে সে প্রচুর হতাশ। চোখের কোণে বিরক্তির স্পষ্ট ছাপ নিয়ে কণ্ঠে ঝাঁঝ এনে বললো,
"ওকে! কিন্তু আমার বেডরুমে কি করছেন আপনি?"
কৌশিক ঠোঁটে সেই চিরপরিচিত রহস্যময় হাসি নিয়ে বললো,
"প্রথমত, এই বেডরুম একসময় খালি পড়ে ছিল, অর্থাৎ এটা আমার ছিল। দ্বিতীয়ত, বেডরুমে মানুষ নরমালি যা করে, তাই করতে এসেছি।"
অনন্যা হাত ভাঁজ করে দাঁড়ালো। ওকে দেখে মনে হচ্ছে মাথায় কিছুই প্রবেশ করছে না ওর। তাই মুখটা অভিব্যক্তিহীন প্রশ্নবোধক চিহ্ন নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কৌশিক বাঁকা হেসে এক হাতে নিজের চুলের এলোমেলো ঝাঁক ঠিক করে হালকা গম্ভীর কণ্ঠে বললো,
"আচ্ছা! লেট মি ক্লিয়ার দিস! যেহেতু সেদিন আমি একটা বড় অন্যায় করে ফেলেছি। তাই অনেক চিন্তা করে ভাবলাম নিজেকে শোধরাবো। সো! শোধরানোর জন্য নিজের জন্য শাস্তি ঠিক করেছি!"
"ওহ! নিজের শাস্তি নিজেই ঠিক করে ফেললেন?"
অনন্যা তাচ্ছিল্যের সাথে হেসে ফেললো।
"ইয়েস!"
"কি শাস্তি?"
"তোমার হাসবেন্ড হবো। এর থেকে বড় শাস্তি আর কিছুই হতে পারে না। "
"কিহ?"
"হুমম! আই উইল বি ইউর পারফেক্ট হাসবেন্ড, সো বি মাই ওয়াইফ!"
অনন্যার মাথা চক্কর খেয়ে গেলো। এরকম নাটকীয় কিছু শুনবে, তা সে কল্পনাও করেনি। চেয়ার ধরে দাঁড়িয়ে থাকা অনন্যা বড় এক ঝটকা খেলো। চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে বললো,
"কি বললেন? আবার বলুন তো!"
কৌশিক ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ালো। হাতের গোলাপগুলো সামনে ধরে শান্ত গলায় বলল,
"হ্যাঁ, তুমি ঠিক শুনেছো। আমার শাস্তি এটাই,তোমার হাসবেন্ড হওয়া।"
অনন্যা কপাল কুঁচকে বলল,
"আপনি কি মজা করার চেষ্টা করছেন? শাস্তি তো নয়, এটা সুবিধা নেওয়া।"
কৌশিক মৃদু হেসে বলল,
"কী বলছো, শিকদার? তোমার মতো মানুষকে প্রতিদিন সহ্য করা...এটা যদি শাস্তি না হয়, তবে কী?"
অনন্যা চোখ বড় বড় করে তাকালো। রাগান্বিত স্বরে বললো,
"কি বললেন?"
"আরে মজা করছি!"
"যান এই রুম থেকে! শাস্তি আমি পরে ঠিক করবো।"
"না। আমি ঠিক করে ফেলেছি।"
অনন্যা প্রশ্নবিদ্ধ চাহনি নিয়ে তাকালো। কৌশিক শ্বাস ফেললো। অতঃপর তিনটি গোলাপের দিকে তাকিয়ে আঙুল দিয়ে বুঝিয়ে বললো,
"তিনটি গোলাপ! অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যৎ। অতীত হতে পারিনি! কিন্তু আমি তোমার বর্তমান হতে চাই আর ভবিষ্যতে ধরে রাখার দায়িত্ব তোমার। বলো রাজি কিনা?"
"না!"
অনন্যার একরোখা উত্তর।
কৌশিক ধৈর্য্য হারালো না,
"ঠিক আছে। প্রথম থেকে শুরু করি। বিবাহ করার ফার্স্ট স্টেজ - প্রেম! চলো প্রেম করি।"
অনন্যা নিজের মাথা চেপে ধরে বললো,
"আপনি আমাকে পাগল করছেন।"
"তাহলে তো আগে থেকেই প্রেমে পড়ে বসে আছো তুমি!"
অনন্যা চিৎকার করে বললো,
"একদম না। ভুল কথা।"
"তাহলে চলো শুরু করি। কি সমস্যা?"
"আপনার সাথে এসব মানাচ্ছে না। আর আমি আপনাকে পছন্দ ও করি না। ডিভোর্স দিয়ে দিন দয়া করে। তারপর ও এতো ঝামেলা ভালো লাগছে না।"
কৌশিক হেসে বললো,
"তো অনন্যাও মিথ্যে বলে? তুমি আমাকে পছন্দ করো সেটা আমি আগে থেকেই জানি। মনে নেই গাড়িতে কিস করেছিলে? পছন্দ না করলে সেটা কীভাবে হলো শিকদার? তারপর একদিন আমার বিছানায় ঘুমিয়ে পড়েছিলে। সেদিন শুনেছিলাম, ইউ লাইক মি। আর ডিভোর্স ওইটা সম্ভব নয়। "
অনন্যা ঠোঁট চেপে কান্নার ভঙ্গি ধরলো। কৌশিক অনন্যার হাতে ফুল তিনটে গুঁজে দিলো। তারপর একজন অভিভাবকের মতো, তার অগোছালো চুলগুলো ঠিক করে দিল। মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো। অনন্যা চোখ বন্ধ করে ফেললো, ওর ভালো লাগছে খুব। কিন্তু কেনো? কৌশিক ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটিয়ে বললো,
"আমাকে রেখে দিও, যেভাবে তোমার চোখের সামনে পড়ে থাকা অগোছালো ছোট চুলগুলোকে রেখে দেও বারবার।"
অনন্যা নিশ্চুপ হয়ে নেত্র দুটো খুললো। দুই দিন! মাত্র দুই দিনে একটা লোক কীভাবে পরিবর্তন হয়ে যেতে পারে? কৌশিক স্যার এই দুই দিনে আরো হ্যান্ডসাম আর আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছেন। একবার তাকালে আর চোখ সরানো যাচ্ছে না, আগের দুর্বল ভাব চোখে পড়ছে না। মনে হচ্ছে অন্য এক মানুষ। মনে হচ্ছে কোনো স্নিগ্ধ পুরুষ, সৌন্দর্যের পূজারী। যার রূপের দিকে অনন্ত কাল ধরে তাকিয়ে থাকলে চোখ দুটো ঝলসে যাবে।
কৌশিক তার নেশা জড়ানো গলায় বললো,
"হেই শিকদার, আই ডোন্ট নো হাউ টু লাভ, বাট আই ডু নো হাউ টু হোল্ড ইউর হ্যান্ড।
শুদ্ধ বাংলায় বললে এটা দাঁড়ায়,
আমি ভালোবাসতে জানি না,
কিন্তু তোমার হাত ধরতে জানি। রাইট?"
অনন্যা বিস্ময়ের সাথে বললো,
"হুম! তাতে কী?"
"আমি তোমাকে ভালোবাসতে চাই না। ভালোবাসা আমি সত্যিই বুঝি না। এটা অনেক কঠিন একটা শব্দ। যার ভার আমি নিতে পারবো না, যেহেতু আমি সম্পূর্ণ মানুষ না। কিন্তু আমি তোমার হাত ধরতে চাই। জোর করতে চাই! পাশে রাখতে চাই। থাকবে?"
কৌশিক স্যারের কথাগুলো কেমন হৃদয়ে গেঁথে যাচ্ছিলো অনন্যার। কিন্তু বারবার ছলনা মনে হয় উনার কথা। মনে হয় মানুষটা আবার পরিবর্তন হবে। দুই দিন পর আবারো অন্য ব্যবহার দেখতে পারবে অনন্যা।
তাই না পারতে বলেই ফেললো,
"আপনি আমাকে মৃত্যু যন্ত্রণা দিয়েছেন। আর কিছু দেওয়া বাকি আছে কী?"
কৌশিক স্যার বেশ কিছুক্ষণ চুপ থাকলেন। তারপর বিছানায় আয়েশ করে বসে বললেন,
"এতো দিনে নিশ্চয়ই জেনেছো, আমি সম্পূর্ণ মানুষ নই। নিজের উপর সবসময় নিয়ন্ত্রণ থাকবে না। কিন্তু তুমি চাইলেই আমাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারো। যদি দ্বিতীয়বার এমন হয় দূরে চলে যেতেই পারো অথবা তোমার ভালোবাসা দিয়ে আমাকে থামাতে পারো। ডিসিশন তোমার!"
.
.
.
চলবে.........................................................................