দ্বিপ্রহর শেষে রক্তিম আলোয় জেগে ওঠেছে গোধূলি সন্ধ্যা, আকাশের স্নিগ্ধ নীলচে আভায় গোধূলির সোনালী আলো ছড়িয়ে পড়ায় সে কীর্তিকালের সাক্ষী হয়ে ওঠে এক জোড়া রক্তিম চোখ। দুই তলা বিল্ডিংয়ের ছাঁদে মেরুদণ্ড টানটান করে দাঁড়িয়ে আছে এক সুঠামদেহী পুরুষ। তার বাজপাখির মতো তীক্ষ্ণ নজরে রয়েছে কয়েক মাইল দূরে শিকার। ডান হাতের ভেতর কফির কাপ থেকে ধোঁয়া বেরুচ্ছে, পাশ থেকে একজন পুরুষ লোক নাম তার নাসা। উনি কিছুটা সামনের দিকে ঝুঁকে এসে ইংরেজিতে নিচু স্বরে বললেন,
'বস, এত দূর থেকে শিকারের ওপর নজর রাখার দরকার কী? দুজনকে তুলে নিয়ে আসি?'
রক্তিম চোখের মালিক পুরুষ লোকটার দিকে তাকানোর আগ্রহ পেল না। তার তীক্ষ্ণ দৃষ্টি শিকারের ওপর থেকে সরিয়ে কফির কাপে ফেললো। লম্বা এক শ্বাস ছেড়ে তারপর নিশ্চল পায়ে হেঁটে এসে চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে গেল। ধোঁয়া ওঠা কফির কাপটা নিঃশব্দে টেবিলের উপর রাখে তারপর নাসার উদ্দেশ্য নরম গলায় বলল,
'যেখানে বুদ্ধি দিয়ে সমস্যা সল্ভ হবে সেখানে অযথা শক্তির প্রয়োগ করা বোকামি বটে।'
নাসা একটু থামলো, এরপর দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে নিজ জায়গায় এসে দাঁড়িয়ে গেল। চোখের সামনে বসা চতুর মস্তিষ্কের লোকটির মাথায় কখন কি চলে তা বোঝা ভীষণ মুসকিল। চকিত তাকিয়ে নাসা তার মাথা দু'দিকে নেড়ে বিষয়টি মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলতে চেষ্টা করে। এই কঠোর ব্যক্তিকে নিয়ে যত কম মাথা ঘামানো যায় ততোই মঙ্গল। কয়েক মাইল দূরে থাকা লোক দুজনের কথোপকথন প্রায় শেষ। দুজনে একে অপরের থেকে বিদায় নিয়ে রাস্তার দুদিকে চলে গেল। রক্তিম চোখের মালিক ওষ্ঠদ্বয় বাঁকা করে মুচকি হাসলো। এরপর তার অন্য দুজন লোককে শক্ত গলায় আদেশ করে বলল,
'তারা কার সাথে দেখা করছে তা দেখতে তাদের ফলো করো।'
সাদা রঙের পোশাক পরা দুজন লোক আদেশ দেওয়া মাত্র সে দুজন লোকের পিছনে চলে গেল। কিছুক্ষণ পর চোখের মালিক কফির কাপের দিকে খুব নৈমিত্তিকভাবে তাকাল। কফিটা ঠান্ডা হয়ে গেছে। একজন মানুষ এগিয়ে আসে ঠান্ডা কফির কাপটা নিয়ে চলে যেতে যেতে একজন কে আওয়াজ দিয়ে বলল আরেক কাপ কফি নিয়ে আসার জন্য। এভাবে কেটে গেল পনেরো মিনিট। কফি ভরা কাপ ফুরিয়ে তলানিতে হালকা আঁটসাঁট লেপ্টে আছে। এরইমধ্যে লোকজন হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এসেছে। তারা হাঁপাতে লাগল। ঘন ঘন নিঃশ্বাস ফেলে উত্তেজিত গলায় বলল,
'বস, আমরা ওদের কাছে পৌঁছানোর আগেই ওদের কে কেউ মেরে ফেলে গেছে।'
দুজনের মুখ থেকে লোকগুলোর মৃত্যুর বর্ণনা শুনে তীক্ষ্ণ চোখের মালিক একটুও চমকালো না। সে বরং ঠোঁট জোড়া বাঁকা করে মৃদু হেসে নিল। চকিত তাকিয়ে বলল, 'ডেডবডির আশেপাশে কোনো অদ্ভুত চিহ্ন দেখতে পেয়েছো?'
প্রথমজন লক্ষ্য করেনি সে এই প্রশ্নে চুপ রইলো। দ্বিতীয়জন ফট করে বলে ফেলল, 'হ্যাঁ, বস। আপনার নামের প্রথম অক্ষর ডেডবডির একপাশে পড়ে ছিল।'
এটা শুনে বস লোকটার হাসি চওড়া হলো। সে যেনো এই খবরটা শোনার অপেক্ষায় ছিল। তর্জনী আঙুল দিয়ে কপাল চুলকাতে চুলকাতে হঠাৎ বলল,
'আমি দুই বছর আগে যে চেপ্টারটা ক্লোজ করেছিলাম তা কে খুললো? কে আবার মরতে চায়?' এইটুকু বলে একটু থামলো সে। তারপর কণ্ঠস্বর নিচু করে আবারও বলল, 'এই হাতে এত মানুষের রক্ত লেগেছে যে গন্ধটা এখনো লেগে আছে। নতুন কারো রক্তে আবার রাঙা হবে।'
নাসা ভীত কণ্ঠে হঠাৎ বললেন,
'বস, এইসবের পেছনে একজনের হাত থাকতে পারে।'
কালো পোশাকে আবৃত সুঠাম দেহীর পুরুষ লোকটি চোখ জোড়া ছোট ছোট করে বিপরীতে দাঁড়ানো নাসার দিকে তাকাল। মাস্কের আড়ালে গভীর কালো দুটি চোখ দেখে ভয়ে আবারও থতমত খেয়ে গেল নাসা। তীক্ষ্ণ চাহনি সরু হলো, কণ্ঠ নামিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
'কাকে সন্দেহ করছো?'
নাসা শুঁকনো ঢোক গিললো। এরপর আমতা আমতা করে বললেন,
'বি-এম ব্যান্ড তারকা সেহরিশ ফাতিন চৌধুরী।'
লোকটা থমকাল। হঠাৎ এ-সময় আগমন ঘটে নেমস এর। তাকে আসতে দেখে সাদা পোশাক পরিহিত লোকগুলো মাথা নিচু করে এক সাইড হয়ে দাঁড়িয়ে গেল। বসের পরে এই মানুষটার হুকুম চলে তাই তাকে সবাই ভয় করে। নেমসের, ঠোঁটের কোণে লেপ্টে আছে অমায়িক হাসির রেখা। সে হাসির ছলেই ইতালির ভাষায় বলে উঠল,
'সেহরিশ ফাতিন চৌধুরী! বাহ, সে তো একজন বিখ্যাত সিঙ্গার এবং সাধারণ মানুষ তাকে সন্দেহ হচ্ছে এর পেছনে কারণ?'
নেমস কথা বলতে বলতেই একটা চেয়ারে পায়ের উপর পা তুলে বসলো। আর প্রথম লোকটি ওষ্ঠদ্বয় বাঁকা করে রহস্যময় ভাবে হেসে চেয়ার ছেড়ে উঠে রেলিঙের দিকে এগিয়ে গেল। নাসা ধরা গলায় বলল,
'দুই বছর আগে যখন এভাবে মানুষ মেরে রাস্তায় ফেলে যাওয়া হত তখন সেহরিশ ফাতিন চৌধুরী কে ডেড স্পটে দেখা যেতো। একটা মানুষ বারবার কাকতালীয় ভাবে ওখানে পৌঁছাবে কিভাবে? সে এসব ইচ্ছে করে করছে।'
নেমস উচ্চস্বরে হাসতে লাগল। যেনো এখানে কেউ ভীষণ মজার কৌতুক বলেছে। নেমস দু'হাত তুলে হাততালি দিতে লাগল। এরপর উচু গলায় বলল,
'শুনেছো জেগান, ওই সাধারণ ব্যান্ডওয়ালা নাকি তোমাকে ফাঁসাবে। আমার তো শুনেই হাসি পাচ্ছে।'
___________
সাদ এর বয়স এক বছর। সে এখনই অল্প অল্প করে হাঁটার চেষ্টা করে। মাঝে মাঝে পড়ে যায়, আবার উঠে হাঁটার চেষ্টা করে। ছেলের এই বারবার পড়ে যাওয়া দেখে হন্তদন্ত হয়ে ছুটে আসে উমাইয়া। সারাক্ষণ পেছন পেছন থাকে যখনি পড়তে নেয় টুক করে ধরে ফেলে। সাদ প্রায় এক কদম দু কদম চলে তারপর আর হাঁটতে পারে না। মায়ের দিকে মায়াভরা দৃষ্টিতে তাকিয়ে কান্না করে দেয়। উমাইয়া সাদ কে কোলে নিয়ে সাদাফকে খুঁজতে খুঁজতে ড্রয়িংরুমে এসে হাজির। সাদাফ একপলক মা ও ছেলেকে দেখল তারপর আবার ল্যাপটপের কাজে মনোযোগ দিল। উমাইয়া সাদ কে কোলে নিয়ে সাদাফের পাশে বসে নির্মূল গলায় জিজ্ঞেস করলো,
'একটা কথা বলবো?'
সাদাফ বলল,
'বলো।'
উমাইয়া বলল,
'রোদেলা কল করেছিল ও সাদকে দেখতে চাচ্ছে। আমি কি সাদকে নিয়ে রোদেলার বাড়িতে যাবো?'
সাদাফ তাত্ক্ষণিক জবাব দিলো,
'বাহিরে ঠান্ডা ভীষণ। তুষার পড়ছে, তাই শীতের পোশাক পরে যাও। আর সাদের যেনো ঠান্ডা না লাগে এটার খেয়াল রেখো।'
উমাইয়া ভ্রুকুটি করলো। তারপর প্রশ্ন করলো,
'তুমি এত সহজে আমাদের বাহিরে যেতে অনুমতি দাও না। আর এখন একবার বলাতেই যেতে বলছো।'
সাদাফ সাদকে কোলে নিয়ে আদর করতে করতে জবাব দিলো,
'রোদেলা সাদকে তোমার থেকেও বেশি যত্নে ও আগলে রাখে। তুমি সাদকে জন্ম দিয়েছো কিন্তু ওর কখন কি লাগবে সেটা বুঝো না। কিন্তু রোদেলা তাকে দেখলেই মনে হয় উনিই সাদের মা।'
উমাইয়া কুটিল হাসলো। ঠোঁটের কোণে হাসি রেখে বলল, 'হ্যাঁ ঠিক বলেছো। রোদু ছোটো বাচ্চা অনেক পছন্দ করে ও তাদের ভীষণ ভালোবাসে।'
সাদাফ উমাইয়ার দিকে তাকিয়ে বলল,
'জুবিয়া আসবে না?'
উমাইয়া বলল,
'না, আজ জুবিয়া আসতে পারবে না। শুনেছি গতকাল রাতে পেটের মধ্যে ওর বাবু নড়াচড়া করেনি তাই আজ সকাল সকাল হাসপাতালে ছুটে গেছে। আমি আর সাদ একাই যাচ্ছি রোদেলার বাড়িতে।'
সাদাফ ভ্রু কুঁচকে বলল,
'সাবধান যাবে। আর আমি তোমাদের পৌঁছে দিতে পারছি না। সরি, আমাকে দুই মাস পর কনসার্টের জন্য নতুন গান লিখতে হবে।'
উমাইয়া বলল,
'তুমি টেনশন নিও না, আমরা যেতে পারব। তুমি বরং গানের প্রতিটি শব্দ গুছিয়ে লেখো প্রয়োজনে নিরিবিলি জায়গা বাগানে গিয়ে বসো।'
সাদাফ উমাইয়ার উদ্দেশ্য বলল,
'শোনো, জুবিয়ার গর্ভকালীন কত মাস চলছে?'
উমাইয়া বলল,
'৯ মাস৷ কেনো?'
সাদাফ এবার তড়িঘড়ি করে জবাব দিল না। সাদের মাথার চুলগুলো হালকা নেড়েচেড়ে বলল,
'তাহলে তো তূর্ণর সন্তান আমাদের সাদের থেকে এক বছর এক বা দেড় মাসের ছোটো হবে।'
উমাইয়া বলল,
'কেন তোমার মাথায় সবসময় উল্টাপাল্টা চিন্তা ভাবনা ঘুরপাক খায় বলো দেখি।'
সাদাফ বলল,
'চলো, তোমাকে গাড়ি পর্যন্ত পৌঁছে দেই।'
উমাইয়া বাঁধা দিয়ে বলল,
'আমি একা যেতে পারব। তোমাকে আর আসতে হবে না।'
গাড়িতে বসে কান্না শুরু করে সাদ। তার গাড়িতে চড়তে ভালো লাগে না। উমাইয়া তাকে কোলে নিয়ে এ-ই সেই কথা বলে কান্না থামানোর চেষ্টা করে। জুবিয়ার কল এলো, সে ডাক্তার দেখিয়েছে, ডাক্তার বলেছে বাবু ভালো লাগে। এবং আগামী মাসে ডেলিভারির ডেট দিয়েছে। এখন ওরা সেহরিশের বাড়ির দিকে যাচ্ছে। উমাইয়া ওদের সঙ্গে কথা শেষ করে আবার সাদ কে থামানোর চেষ্টা করতে লাগল। ইতিমধ্যে সাদের চোখ দুটো লাল হয়ে গেছে। সেহরিশের বাড়ির বিশাল গেট দিয়ে গাড়িটা ঢুকতে হাফ ছাড়লো উমাইয়া। বাড়ির সামনে রোদেলা দাঁড়িয়ে আছে। ওর পেছনে অনেক গুলো সার্ভেন্ট দাঁড়ানো। উমাইয়া গাড়ি থেকে নামা মাত্র রোদেলা এগিয়ে গিয়ে সাদকে কোলে তুলে নিল। সাদ রোদেলার বুকের সাথে মিশে গিয়ে হিচকি তুলছে। তূর্ণ সেহরিশের সঙ্গে বসে কনসার্ট নিয়ে আলোচনা করছে। জুবিয়া টেবিলে বসে ফল খাচ্ছে। রোদেলা আর উমাইয়া ওর পাশে গিয়ে বসে। ওদের মাঝে গল্পগুজব শুরু হয়ে গেল। সেহরিশ তূর্ণর পাশে থাকলেও ওর দৃষ্টি রোদেলার উপর। রোদেলা আলতো হাতে সাদ কে খাইয়ে দিচ্ছে।
উমাইয়া মুখ ভার করে বলল,
'তোর হাতে কি শান্তভাবে খাচ্ছে অথচ আমার হাতে খেতেই চায় না।'
জুবিয়া ফিক করে হেসে বলল,
'তুই জানিস খাওয়াতে?'
উমাইয়া বলল,
'তোর ও হবে কিছুদিন পর তখন দেখব।'
রোদেলা সাদের মাথায় হাত রেখে মুচকি হেসে বলল,
'আমারও সাদের মতো একটা মেয়ে চাই। আমি তো আমার মেয়ের নামও ঠিক করে রেখেছি।'
রোদেলার কথাটি শোনামাত্র সেহরিশ মাথা নিচু করে মৃদু হাসলো।
.
.
.
চলবে...................................................