শাহজাহান তন্ময় - পর্ব ৭৬ - নাবিলা ইষ্ক - ধারাবাহিক গল্প


শাহজাহান বাড়ির সকলেই কমিউনিটি সেন্টার থেকে ফিরে বসবার ঘরে খুঁটি গেঁথে বসেছে। থমথমে পরিবেশ বিরাজমান। ক্ষণে ক্ষণে নিস্তব্ধতা ভেঙে কান্নার শব্দ তুলছেন জবেদা বেগম। কান্নারত তাকে বাম হাতে নিজের বাম পাশে খুব যত্নের সাথে আগলে নিয়েছে তন্ময়। সে এখনো শুভ্র রঙের পাজামা-পাঞ্জাবি পরে আছে। পরিবর্তন করা আর হয়ে ওঠেনি। এখনো জবেদা বেগমের মাথাটা দুর্বল ভাবে ছুঁয়ে আছে তন্ময়ের চওড়া কাঁধ। তার মিহি কান্নার স্বর বড়োই যন্ত্রণার।
তন্ময় স্বান্তনার কথাবার্তা তেমন বলতে পারে না৷ অগত্যা মায়ের মাথা বুলিয়ে চলেছে। যেমন ভাবে মা তার মাথার চুল আদুরে হাতে বুলিয়ে দেন।

মোস্তফা সাহেবের চোখের ভেতরটা এখনো রক্তিম। তবে তিনি আগের চেয়ে অনেকটাই নিজেকে সামলে নিয়েছেন। পিঠ এলিয়ে দিয়েছেন সোফায়। একচিত্তে চেয়ে আছেন শূন্যে। এই দৃশ্যে তন্ময় দীর্ঘশ্বাস ফেলে অগোচরে। পরপর অরুর খোঁজ করে তার চোখ দুটি। অরু সিঁড়িতে বসে আছে হাতে গাল রেখে। মুখে দুঃখিনী ভাব আনিয়ে রাখলেও ওর চঞ্চল চোখদুটো বেইমানি করে বসে আছে। নাজুক, সরল চোখদুটো বোধহয় আর অভিনয় করতে পারছে না। সুন্দর চোখদুটো সবার মুখের ভঙ্গিমা খুব আগ্রহের সাথে দেখছে। ওর চঞ্চল সেই দৃষ্টি এবারে ঘুরে এসে থেমেছে তন্ময়ের রসাত্মক চোখে। তন্ময়কে চেয়ে থাকতে দেখে ও হকচকিয়ে ওঠে ক্ষণিকের জন্য। ফের চোখ দুটো ছোটো ছোটো করে দুঃখিনীর অভিনয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। তন্ময়ের হাসি পায়। কী বিশ্রী ব্যাপার! মেয়েটা তাকে নষ্ট করে ফেলছে। নাহলে এমন এক পরিস্থিতিতে হাসার মতন ছেলে সে ছিল? কখনো না। নিত্যদিন এমনিতেও তো তার হাসি আসতো না। মানুষ কৌতুক করে হেসে গড়াগড়ি খেলেও সে থাকতো নির্বিকার মানুষ। তার মোটেও মজার মনে হতো না। তাহলে হাসবে কীভাবে? জোরপূর্বক? কিন্তু এখন তাকে দেখো। এই মেয়ের অনর্থক ব্যবহার, কথাবার্তাও সে বেশ হাসছে। পারছে না শব্দ করে হাসতে। কী আশ্চর্য! এমনও হয়? হয়তো। এইযে হচ্ছে! অরু উঠে এদিকে আসছে৷ আনোয়ার সাহেব বসে আছেন উত্তর দিকের ডিভানে। ম্যাগাজিন দেখছেন খুব চিন্তিত দৃষ্টিতে। অরু তার বাবার পাশে গিয়ে বসেছে। এসময়তে হঠাৎ করে খুব অপ্রত্যাশিত দু'জন তাড়াহুড়ো পায়ে দুয়ারে এসে দাঁড়িয়েছে। বঁধু বেশে শাবিহা আর তার পাশেই বর বেশে অয়ন। শাবিহা কাঁদছে হেঁচকি তুলে। চোখমুখ সাংঘাতিক লাল। মেকাপ নষ্ট হয়ে জুবুথুবু দুর্দশা। অয়নও স্বাভাবিক নেই। চোখের ভেতরটা রক্তিম, আর্দ্র। মোস্তফা সাহেব চমকে দাঁড়িয়ে পড়েছেন। তিনি দাঁড়াতেই শাবিহা দৌড়ে গিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল তার বুকে। ধাক্কায় টালমাটাল হয়ে কিছুটা পিছিয়ে গিয়েছিলেন মোস্তফা সাহেব। পরে যেতেই পারতেন। কিন্তু আগেই তন্ময় উঠে গিয়ে দাঁড়িয়েছে মোস্তফা সাহেবের পেছনে। দু'হাতে ধরে ফেলেছে বাবার দুর্বল কাঁধ। জবেদা বেগম কেঁদে কাছে যেতেই, তাকেও জড়িয়ে নিয়েছে শাবিহা। তাদের কান্নার শব্দে উপস্থিত বাকিরাও কেঁদে ফেলেছে। তন্ময় অপ্রস্তুত, বিষণ্ণ অয়নের কাছে গিয়ে হাত রাখে কাঁধে। তার প্রশ্নাত্মক দৃষ্টি দেখে অয়ন ম্লান কণ্ঠে জানায়,

‘ভাই, শাবিহা কেঁদেই যাচ্ছে। কোনোভাবেই ওকে শান্ত করতে পারছিলাম না। আমি ওর কান্না সহ্য করতে পারিনি তাই নিয়ে এসেছি।’

অয়নের এই উক্তি শুনে আবেগে আপ্লূত অরু। উড়িউড়ি পদচারণে এগিয়ে এসেছে তন্ময়ের পাশে। অয়নের দিকে আদুরে চোখে চেয়ে বিমোহিত স্বরে বলে,

‘ভাইয়া তুমি কতো ভালো! কতো চমৎকার তোমার ব্যক্তিত্ব।’

মুহূর্তেই তন্ময়ের দু’ভ্রু কুঁচকে আসে। তড়াক করে চায় পাশে। অরু মুগ্ধ চোখে তখনো অয়নকে বলে যাচ্ছে,

‘আপুকে কত বোঝ তুমি, ভাইয়া। আপু খুব লাকি তোমাকে পেয়ে। তুমিও লাকি আপুকে পেয়ে।’

তন্ময়ের ভ্রু’দ্বয়ের মধ্যিখানের ভাঁজ আরও কয়েক ধাপে দৃঢ়, ঘন হয়। মেজাজটা নষ্ট হয়ে গেছে। অয়ন ব্যাপারটা বুঝে আনমনে হাপিত্যেশ করে ওঠে। অরুর উদ্বিগ্নতার সামনে থেকে আলগোছে সরে আসে। এতে অরুর আগ্রহ বিন্দুমাত্র কমে না। সে পিছু পিছু গিয়ে আরও কিছু প্রশংসার বাণী ঝাড়তে ব্যাকুল। তন্ময় খুব সন্তর্পণে ওর পথের মধ্যে বাঁধ সেধে দাঁড়ায়। মেয়েটা তো তাকে বড্ড জ্বালায়। এতো মিষ্টি করে প্রশংসা করতে হবে কেনো? অদ্ভুত তো। তন্ময়ের প্রেমিক হৃদয় তো এসব মানবে না। এসব সইবে না। ওর সাথে সে কিছুক্ষণ কথাই বলবে না। অবুঝ মেয়েমানুষ! 

ইতোমধ্যে শাবিহা বাবা-মা ছেড়ে বড়ো ভাইয়ের দিক এগিয়ে আসছে। তন্ময় এক হাতে আগলে নিলো শাবিহাকে। মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো। শাবিহা কাঁদতে কাঁদতে অরুকেও এক সময় টেনে নিয়ে এলো তাদের দুজনের মধ্যে। তিনজনকে একত্রে দেখে আকাশ, রুবি আর দীপ্তও ছুটে এসেছে। কাকে ধরে কে কাঁদছে অজানা। তবে উপস্থিত মেয়েজাতের সবগুলো কাঁদছে। তন্ময় আশ্চর্য, হতবিহ্বল! এই কিছুক্ষণ আগেও অরু হাসছিল লুকিয়ে-লুকিয়ে। আর এখন এমনভাবে কাঁদছে যেন ওকেই শ্বশুরবাড়ি তুলে দেয়া হচ্ছে। 
কেঁদেকেটে অস্থির ওকে দেখে শাবিহাও নিজের কান্না ভুলে বসেছে। ব্যগ্র হাতে, আদুরে কণ্ঠে অরুকে শান্ত করতে ব্যস্ত। কাহিনী কেমন মুহূর্তেই উল্টে গিয়েছে। আকাশ কিছুক্ষণ আগেও বেশ আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েছিল। তবে এখনকার ঘটিত কাহিনী দেখে সে সন্দিহান এবং দ্বিধাগ্রস্ত কিছুক্ষণ আগের যত্নের আবেগ ঢেলে দেয়ায়। অয়ন এই অবস্থা দেখে মন খারাপ করে বসে। খুব মিহি গলায় না চাইতেও এবেলায় বলে বসে,

‘ভাইয়া, শাবিহা থাকুক।’

অয়নের বলতে দেরি শাবিহার তৎক্ষণাৎ থমথমে কণ্ঠে সীৎকার পড়তে দেরি হয়নি,

‘না।’ এতটুকু বলে থামল সে। মিইয়ে গেল সকলের দৃষ্টি অনুভব করে। নাক টানল। হেঁচকি কমে এসেছে। তবে গলার স্বর ভেঙে বসেছে। কণ্ঠে নমনীয়তা লাজুকতা। মাথা নুইয়ে সে মিনমিনে ভাবে বলল,

 ‘বলছিলাম যে.. উম..মানে.. ’

তন্ময় হেসে ফেলল শব্দ করে। তার হাসির শব্দে পালা দিয়ে হাসল বাকিরাও। অয়নের ম্লান মুখখানা কেমন প্রাণোচ্ছল হয়ে উঠল মুহূর্তেই। মনে হলো বাগিচার নেতিয়ে যাওয়া ফুলটা আচমকা ফুটে উঠেছে৷ তন্ময় ছোটো বোনের মাথা বুলিয়ে আশকারা দেবার ভঙ্গিতে আহ্লাদী স্বরে বলল, 

‘যা। যখন মন চাইবে আসবি। আর নাহয় আমরাই যাব নিয়ম করে তিনবেলা।’

অয়ন সঙ্গে সঙ্গেই পাখির মতন সুর তুলল, 

‘জি, ভাইয়া। রোজ দশবার করে আসুন। আমার কোনো আপত্তি নেই। বরংচ খুশি হব।’

মোস্তফা সাহেব সন্তুষ্ট হলেন বোধহয়। মুখের থেকে কালো মেঘ সরেছে। তিনি গম্ভীর তবে নরম কণ্ঠে অনুনয়ের সুরে বলেন,

‘শাবিহা যখন আসতে চায় ওকে আসতে দিও।’ ভদ্রলোক থামলেন একটুর জন্য। বাকি কথাটুকু মিনমিনে স্বরে বললেন। তবুও সবাই পরিষ্কার শুনতে পেলো, ‘কৃতজ্ঞ থাকব।’

অয়ন চমকায়। বড্ড বিমূঢ় হয়ে পড়ে৷ চিন্তচেতনা হারিয়ে দ্রুত এগোয় সামনে। মোস্তফা সাহেবের হাত দুটো আগলে ধরে বলে, 

‘বাবা, আপনি এভাবে বলবেন না। শাবিহা আপনাদের মেয়ে। আমি ওর স্বামী হয়ে গিয়েছি বলে ওর আমার থেকে পারমিশন নিয়ে এই বাড়ি আসতে হবে —এমন কিছু কখনো হবে না। ও সারাদিন আসুক। যখন তখন আসুক। শুধু আমাকে জানালেই হবে। আর যখন তখন আমিও চলে আসব এই পারমিট দিলেই হবে।’

মোস্তফা সাহেব মুগ্ধ হলেন। আবেগী হলেন বড়ো। অয়নের হাতের মধ্যিখানে থাকা তার হাত দুটো সামান্য নড়ে ওঠে। অবশেষে তিনি হাত উঠিয়ে রাখেন অয়নের ডান কাঁধে। তার কৃতজ্ঞতা, মুগ্ধতা সবই একটিমাত্র পদক্ষেপে অনুভব করা যাচ্ছে। অয়ন সবার থেকে বিদায় নিয়ে শাবিহার হাত ধরে বেরিয়ে গিয়েছে। জবেদা বেগম অবশ্য মেয়ে জামাই আপ্যায়নের জন্য উতলা হয়ে ছিলেন। কিন্তু অন্যদিকে তার মেয়েজামাই মেয়ে নিয়ে বেরিয়ে যেতে উতলা। সেখানে কী আর করার তার?

— — —

ক্লান্ত দেহে তন্ময় ঘরে এসে পৌঁছাল। পাঞ্জাবির ওপরের কোটি খুলতে নিয়ে এগুল বারান্দায়। বারান্দার দরজা খোলা। মধ্যরাত তখন। গাঢ় কুয়াশা পড়েছে। বাতাসের স্পর্শ কনকনে ঠান্ডা। বাইরে বিয়ের বাতি এখনো মিটমিট করে জ্বলছে। শীতল বাতাসে ঘর ঠান্ডা হয়ে আছে। বারান্দার দরজা, জানালা বন্ধ করে পর্দা টেনে দিলো সে। রুমের ভেতরে হিটার চলছে আপাতত। তারপরও উষ্ণতা বিরাজমান। এবারের শীত যেন একটু বেশিই। তন্ময় ওয়াশরুম গেল। ফ্রেশ হয়ে বেরিয়েই দেখ্ল অরু পা’জোড়া দুলিয়ে বসেছে। দৃষ্টি তার দিকটাতেই। এক দৃষ্টিতে ওয়াশরুমের দিকে চেয়েছিল মনে হয়। সাজসজ্জা এখনো তোলেনি। বিয়েতে পরে যাওয়া পোশাক অঙ্গপ্রত্যঙ্গে। মুখ ভার। বোঝার বাকি নেই যে মহারানি ভিক্টোরিয়ার মন খারাপ। ওর মন খারাপের কারণ দুটো হতে পারে। প্রথমটি হচ্ছে, তন্ময় ভোরে বেরিয়ে পড়বে খুলনার উদ্দেশ্যে। দ্বিতীয়টি হতে পারে, শাবিহার বিয়ে হয়ে গিয়েছে। সে আর তাদের সাথে একই ছাদের তলেতে থাকতে পারবে না। তন্ময় তোয়ালেতে মুখ মুছতে নিয়ে এগুল টেবিলের দিক। সফরের ব্যাগটা গুছিয়ে নিতে হবে। কিছু ডকুমেন্টস, ল্যাপটপ সহ কার্যকরী জিনিসপত্র এখনোই সামনে রাখা প্রয়োজন। কর্মে ব্যস্ত সে ঠিকই আড়ালে অরুকে লক্ষ্ম করছে। এখনো এসে তার পাশে ঘেঁষেনি কেনো মেয়েটা? তন্ময় কিছুক্ষণ অপেক্ষা করেও ওর অস্তিত্ব পাশে অনুভব করল না। অগত্যা কাজ রেখে পিছু ফিরল। অরু অভিমানী চোখে চেয়ে আছে। এযাত্রায় বিষণ্ণ কণ্ঠে জানতে চাইল,

‘আমার সাথে কথা বলছেন না কেনো?’

যাক, এতটুকু বুঝতে পেরেছে গাধিটা৷ এভাবে তো ওর মাথায় মস্তক বলতে কিছুই রয় না। তাই তন্ময় আশা ছেড়েই দিয়েছে একপ্রকার। যেহেতু জিজ্ঞাসাবাদ করছে, একটু বাজিয়ে দেখাই যায়। 
অগত্যা আগের মতন ফের কাজে ব্যস্ত হলো। সেভাবেই গমগমে তবে নির্বিকার গলায় বলল,

‘কী কথা বলব?’

কথাটুকু বলে কান পেতেই ছিল অরুর প্রতুত্তর শোনার জন্য৷ তবে আকাঙ্ক্ষিত প্রত্যুত্তরটি এলো না। তন্ময় মিনিটখানেক অপেক্ষা করল। না কোনো শব্দ, অনুভূতি, উপস্থিতি কিছুই পাচ্ছে না। অবশেষে না পেরে ফিরে তাকাল। অরুর দু'চোখ বেয়ে যেন ঝর্নাধারায় জল নামছে, ঝরঝর করে। মিষ্টি নাকটার পাটা দুটো ফুলেফেঁপে উঠছে। অঝোর ধারায় কান্না করাটা শুধু বাকি। তন্ময় মুহূর্তেই ব্যাকুল হয়ে যায়। হাতের ডকুমেন্টস ফেলে দ্রুত কদমে এগোয় ওর দিকে। অরু কান্নারত অবস্থায় শুধায়,

‘অয়ন ভাইয়াকে তখন প্রসংশা করেছিলাম বলে কি আপনি আমার সাথে কথা বলছেন না?’

তন্ময় আশ্চর্য হয়। ধরতে পেরেছে তাহলে? তারমানে এতটাও বলদি নয়। একটু বুঝ আছে। তন্ময় শান্তি অনুভব করে। ব্যাকুলতা দমিয়ে ফেলে চটপট। ডান ভ্রু তুলে গম্ভীরমুখে জিজ্ঞাসুক সুরে বলে,

‘তেমনটা হলে কী করবি? আর না হলেইবা কী করবি?’

অরু নাক টানে। আআশ্চর্যজনক ভাবে ওর ঝর্নার মতন চোখের জল আর পড়ছে না। মিনিটের মধ্যে কেঁদেকেটে আবার নিজেই থেমে গিয়েছে। ওর অভিনয় নিয়ে কাজ করা দরকার। খুব ট্যালেন্টেড এই চ্যাপ্টারে। এবারে কিঞ্চিৎ সংশয় নিয়ে বলে, 

‘যদি তেমনটি হয় তাহলে আমি বেশি করে অয়ন ভাইয়ার প্রশংসা করব।’

তন্ময়ের কিংকর্তব্যবিমূঢ়তার সীমা রইল না। অবাক হয়ে শুধালো, 

‘হোয়াট?’

অরু এবেলায় মিটিমিটি হাসল। হাসিটুকু বুঝিয়ে দিচ্ছে, ও যে ইচ্ছে করে ওমনভাবে গদগদ স্বরে প্রশংসা করছিল। এখনো গদগদ স্বরেই বলল,

 ‘আপনি জেলাস হবেন আর আমাকে অনেক ভালোবাসবেন।’

তন্ময় মূর্তি বনে গেল। সরু চোখে অনিমেষ চেয়ে রইল। অরু আড়চোখে চেয়ে সেই দৃষ্টি দেখে মিইয়ে গেল। বেশি করে ফেলল নাকি? দুরুদুরু কম্পিত বুকে ঝটপট পেছাল কয়েক কদম। কিছু একটা বলতে মুখ খুলল। তবে কথা বলার সুযোগ পেলো না। তন্ময় ঝরের গতিতে সামনে এসে দাঁড়াল। ঠোঁটে চুমু খেলো শক্ত করে। পরমুহূর্তেই ওকে পাজা করে কোলে তুলে ফেলল। এমনভাবে তুলল যে অরু ভয়ে সেঁটে গেল। ওকে সেভাবে নিয়েই তন্ময় দরজা লাগাল ব্যস্ত হাতে। তাকাল ঘড়ির দিকটায়। তিনটা বিশ। তার বেরোতে হবে ছয়টায়। বিছানার দিক এগুতে নিয়ে নির্বিকার কণ্ঠে বলে,

‘অনেক ভালোবাসবো। ডেসপারেটলি।’

তন্ময় নিগূঢ় চোখে চেয়ে রহস্যময়ী কণ্ঠে ফের আওড়াল,

‘তিন ঘণ্টা সময় আছে। উড ইট বি এনাফ ফর ইউ?’

অরু হতবিহ্বল। সে এসব ভালোবাসার কথা তো বলেনি, ‘ত..তন্ম….’

তন্ময় সেক্ষেত্রে খুব বিনয়ী, ‘তুই চাইলে সময় আরেকটু বাড়ানো যেতেই পারে।’

— — —

সূর্য ওঠেনি আজ। আবহাওয়া অধিদপ্তর জানাচ্ছে সূর্য উঠবে না। চল্লিশ পার্সেন্ট বৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনাও নাকি আছে। বাইরেটা এখনো অন্ধকার হয়ে আছে কুয়াশায়। কেমন সন্ধ্যা সন্ধ্যা আবহাওয়া। ঠান্ডাও পড়েছে বিশ্রী রকমের। অরু গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। থাকার কথাই—কিছুক্ষণ আগেই ঘুমিয়েছে। ঘুমোতে চায়নি। শক্ত করে দু’চোখ মেলে চেয়েছিল। বারবার করে বলেছে, যাওয়ার সময় ওকে ডেকে ওঠাতে। কিন্তু তন্ময় চাচ্ছে না ও উঠুক। তার বিদায়ের পথ দেখে কাঁদুক। মাত্র দু'দিনের সফর অথচ মেয়েটা এমন করছে যেন তন্ময় চিরজীবনের জন্য চলে যাচ্ছে। সে ইতোমধ্যে তৈরি হয়ে দাঁড়িয়ে আছে বিছানার সামনে। ঘুমন্ত অরুকেই দেখছে। ঝুঁকে কপালে চুমু খেলো। এরপর ঠোঁটেও। গাঢ় চোখে স্নিগ্ধ, ক্লান্ত মুখটা দেখল অনেকক্ষণ। ফিসফিস করল আনমনা,

‘তোর আমাকে বর বেশে দেখার খুব সখ, হুঁ? আমি পূর্ণ করব। আমরা বিয়ে করব তুই যেভাবে চাস।’

ছোটো একটা নোট অরুর বিছানার পাশে রাখল তন্ময়। কম্ফর্টার থেকে বেরুনো মসৃন হাতটা কম্ফর্টারের ভেতরে ঢুকিয়ে দিলো। শেষবার দেখে বেরিয়ে গেল সে। ভুলেও ফিরে তাকাল না। ফিরে তাকালেই বিপদ। বড়ো বিপদ। হয়তোবা যেতেই পারবে না সে। অরুকে ফেলে যাওয়াটা যে তার পক্ষেও অসহনীয়।
.
.
.
চলবে.................................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন