অন্তর্নিহিত কালকূট - পর্ব ১০৮ - অনিমা কোতয়াল - ধারাবাহিক গল্প


ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছে নাঈমের শরীরটা। পোড়া মাংসের দুর্গন্ধের সঙ্গে পেট্রল আর ধোঁয়ার গন্ধ মিশে ভীষণ অস্বস্তিকর পরিবেশ তৈরী হয়েছে। এতক্ষণ চারপাশে ভীড় থাকলেও কিছুক্ষণ আগে ক্রাইম স্পট হিসেবে রেস্ট্রিক্টেড করে দেওয়া হয়েছে জায়গাটা। এখন এখানে কেবল তুহিন, তমাল, ফারিয়া, স্থানীয় ওসির সঙ্গে গোয়েন্দা বিভাগের ফরেনসিকের দুজন লোক এসেছে।
নাঈমের লা*শটা দেখার সঙ্গে সঙ্গেই ঠেলে বমি চলে আসছিল ফারিয়ার। কোনমতে দুহাতে মুখ চেপে সামলেছে নিজেকে। ফরেনসিক ডিপার্টমেন্টে আছে ও। আগেও বিভৎস লাশ দেখেছে। কিন্তু আজ এমনটা কেন হল ওর জানা নেই। বোধহয় মানুষটা কাছের বন্ধু ছিল বলে। ভেতর থেকে কাঁপুনি ধরে গেল ফারিয়ার। টলমল করে উঠল চোখজোড়া। তমাল ফারিয়ার অবস্থা দেখে আলতো করে কাঁধে হাত রাখল। বলার মতো কিছু নেই। দীর্ঘ একটা শ্বাস গিলে ইশারা করল ফরেনসিকের লোকেদের। নাঈমের ছিন্নবিচ্ছিন্ন লাশের টুকরোগুলো স্ট্রেচারে তুলে নিয়ে গেল তারা। সঙ্গে গেল ফারিয়া। সেদিকে উদাস চোখে তাকিয়ে রইল তমাল। গাড়িটা যতক্ষণ দেখা গেল, ঠিক ততক্ষণ তাকিয়ে থাকল।
বুকের ভেতরটা কেমন শক্ত, ভারী হয়ে আছে। কিছুতেই বিশ্বাস হচ্ছেনা মারা গেছে নাঈম। তাও এমন ভয়ানক, করুণ মৃত্যু! অল্পদিনের পরিচয় হলেও খুব সুন্দর সাবলীল একটা সম্পর্ক তৈরী হয়েছিল ওদের। সকালেও ছেলেটা হাসিমজা করছিল ওদের সঙ্গে। কতভাবে ঠাট্টা করছিল। আর এখন...। ক‍দিন পর বিয়ে ছিল ছেলেটার! কত কী বলছিল সে নিয়ে। অথচ নিয়তি কী ভয়ংকর! তারচেয়েও ভয়ংকর কথা হলো এই ফাঁদটা পাতা হয়েছিল ওরই বসের জন্যে। আজ যদি রিপোর্টটা নিতে তুহিন আসতো, তবে? কল্পনা করেও গলা শুকিয়ে এলো তমালের। চোখে সামান্য ভীতি নিয়ে তাকাল তুহিনের দিকে।

ওসির সঙ্গে কথা বলছে তুহিন। চোখমুখ ফ্যাকাশে হয়ে আছে। মানুষটা শক্ত, প্রফেশনাল। কিন্তু মনে ভীষণরকমের আঘাত পেয়েছে তা বলার অপেক্ষা রাখেনা। ধীরপায়ে ওদের দিকে এগিয়ে গেল তমাল। তুহিন তখন ওসিকে বলছে, ' সব এভিডেন্স কালেক্ট হওয়ার আগ পর্যন্ত এখানে টিমের লোক ছাড়া আর কেউ যেন ঢুকতে না পারে।'

ওসি বললেন, ' জি স্যার। কড়া পাহারা থাকবে এখানে। আপনি চিন্তা করবেন না। তবে স্যার, আপনি একটু_'

থেমে গিয়ে খানিকটা ইতস্তত করল ওসি। তুহিন ভ্রুকুটি করল। সংকোচ নিয়েই ওসি বলল, 'একটু সাবধানে থাকবেন স্যার।'

তুহিন কিছু বলল না। শার্টের পকেট থেকে রোদচশমাটা বের করে চোখে পড়ে নিল। হাঁটতে শুরু করল নিজের গাড়ির দিকে। পেছন পেছন আসছে তমাল। তুহিন পেছনে না তাকিয়েই বলল, ' ওর পরিবারের লোককে খবর দেওয়া হয়েছে?'

' জি স্যার। চলে আসবে তাড়াতাড়ি। শহরের বাইরে থেকে আসছে, তাই সময় লাগবে। তাছাড়া একমাত্র ছেলেতো, ধাক্কাটা সামলাতে পারেনি। আর_'

' আর?' 

গাড়িতে ড্রাইভিং সিটে উঠে বসল তুহিন। ফ্রন্ট সিটে উঠে বসল তমাল। খানিকটা ইতস্তত করে বলল, ' নাঈমের উডবি মেয়েটা, এখানকার খবর শোনার সঙ্গে সঙ্গে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে। এখনো জ্ঞান ফেরেনি।'

পাঁচ সেকেন্ডের মতো চুপচাপ বসে রইল তুহিন। নড়ল অবধি না। অতঃপর হতাশ এক শ্বাস ফেলে স্টার্ট করল গাড়িটা।

*****

দিন-দুপুরেও নিস্তব্ধ রুমটা। পিনপতন নীরবতাই হতো। তবে রকিং চেয়ারের মৃদু আওয়াজটা শোনা যাচ্ছে। পারলে সে আওয়াজটুকুও থামিয়ে দিতো শওকত মীর্জা। কিন্তু বিছানায় শুয়ে থাকার মতো মানসিক স্থিরতা তার নেই। আর ক্রাচ নিয়ে একপায়ে কতক্ষণ পায়চারি করা যায়? ছেলে হারানোর ক্ষতটা এখনো তাজা। তাছাড়া শরীরের জখমও ঠিক হয়নি এখনো। জখমগুলোয় ব্যথা লাগতেই বরাবরের মতো রুদ্র আমেরের নামে তিক্ত কিছু গালাগাল বেরিয়ে আসে। বিভিন্ন চিন্তায় ভ্যাঁপসা গরম অনুভব করছে শওকত। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমছে। টিপটিপ করছে কপালের শিরাটা। থাই গ্লাস ভেদ করে আসা মৃদু রোদের আলোটুকুও অসহ্য লাগছে তার। কিন্তু উঠে গিয়ে পর্দা টানার রুচি অবধি নেই। অস্থিরতা সীমা অতিক্রম করতেই পাশের টেবিল থেকে নিজের ফোনটা তুলে নিল সে। ডায়ালপ্যাডে থাকা প্রথম নাম্বারটাই ডায়াল করল। যতক্ষণ রিং হল ছটফট করল শওকত। রিসিভ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে রাগে, হতাশায় ফ্যাশফ্যাশে হয়ে যাওয়া গলায় বলল, ' একটা কাজ নিজ দায়িত্বে করতে বলা হয়েছিল আপনাকে। সেটাও ঠিকঠাক করতে পারেননি। দুবেলা নিজের পজিশনের বড়াই করতে ভুল হয়না, অথচ আসল কাজের বেলায় ঘণ্টা!'

কলের অপাশ থেকে দ্বিগুণ রাগ ঝেড়ে বলল, 'অযথাই দোষারোপ করছো। আমি কীকরে জানব রিপোর্টগুলো আনতে তুহিন আহমেদের বদলে ঐ ছোকরা যাবে?'

রাগ আরও কয়েকগুন বাড়ল শওকতের। দাঁত কিড়মিড় করে বলল, ' তুহিন আহমেদই রিপোর্ট আনতে যাবে। এমন কোন ওহি নাজিল হয়েছিল কী?'

ওপাশের ব্যক্তি ধমক দিয়ে বলল, ' আইরনি করোনা! ও যাবে তার কোন নিশ্চয়তা নেই বলেই শিওর হয়ে নিয়েছিলাম ও অফিসে কোন পোশাকে ঢুকছে। একবার না, কয়েকবার!'

' একইরকম পোশাক দুজন পড়বেনা! গোয়েন্দা বিভাগের নতুন নিয়ম?'

' তোমার কী মনে হয়? আমার কপালে লেখা আছে আমি গাধা? এই সাধারণ জ্ঞানটুকু আমার নেই? ভোটে আমি শুধু তোমার দলের ঐ ছেলেপুলের জন্যেই জিতেছিলাম? আমার এতো স্ট্রং পলিটিক্যাল ক্যারিয়ার পুরোটাই তোমার দান? চেহারা থেকে শুরু করে পোশাক সবকিছুই শতভাগ কনফার্ম করিয়ে নিয়েছিলাম আমি। কয়েকবার করে। ঐ ছোকরা আর যাই হোক, কফি রঙের পোশাক পড়ে অফিসে ঢোকেনি। কিন্তু বের হল কীকরে জানিনা আমি। ঐ মাদার** গোয়েন্দাটার কপালটাই সোনায় বাঁধা। বারবার মরণকে ছুঁয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে।'

' ওর ঐ সোনায় বাঁধানো কপালের তেজ আমাদের কপালকে তামা বানাতে বেশি সময় নেবেনা। যা করার জলদি করতে হবে।'

' জ্ঞান দিওনা। তোমাদের গাধামির দৌলতে গলার কাঁটা বানিয়ে আটকে দিয়েছো ঐ দুই ছোকরাকে।'

' আমাদের!' অবাক হল শওকত।

ওপাশ থেকে ঝাঁঝ নিয়ে বলল, ' নয়? পেনড্রাইভটা নাকের ডগায় ছিল তোমাদের, কিন্তু একটা আবা*ও টের পেলেনা! দুই দুইটা দলের এতোগুলো মাথাকে ঘোল খাইয়ে দিল ঐ দু আঙুলে একটা...'

' ও দু আঙুলে ছিলোনা! আর আমরা কীকরে জানব এমন কিছু ঘটে যাবে? সোলার সিস্টেমটাতো শেষ করেই দিয়েছি। কিন্তু মাঝখান থেকে...'

' খুব বা* ছেড়া গেছে আমার তাতে। সবটাই ঘেঁটে ঘ করে দিয়েছো। যদি ঐ পেনড্রাইভটা রুদ্রর কাছে না থাকতো কোন চিন্তাই ছিলোনা আমার। এখনকার এই বাড়তি প্যারাটাও নিতে হতোনা। তুহিন আহমেদকে মে*রে ফেলাটাযে কতবড় রিস্ক সেটা তোমার অজানা নয়। আর জেলের মধ্যে রুদ্রকে শেষ করা আরও বড় রিস্ক। জেলে পাঠানোর জন্যে সরাসরি কিছু করতেও পারছিনা। মাদার**টা সোজা আমার ঘুম হারাম করে রেখেছি। এদিকে নির্বাচন এগিয়ে আসছে। এক মাথা কটা বিষয়ে ঘামাব? শেষমুহূর্তে ঐ ব্লান্ডারটা না করলে কী হতো?' 

' ওটাতো সম্রাট_'

' থামো! ঐ রাস্কেলের নাম নিবানা! সবগুলোইতো টপকেছে। বাকি আছো তুমি। তোমার কপাল ভালো যে তোমাকে টপকানো আগে ঐ অফিসার অ‍্যারেস্ট করে নিয়েছে ওকে। মানে মানে প্রাণটা বেঁচে গেল, যদিনা পেনড্রাইভটা রুদ্র তুহিনকে দিয়ে থাকে।'

চুপ করে গেল শওকত। শেষের দিকে সিদ্ধান্ত গ্রহনে ভুল হয়েছে তার অস্বীকার করার জো নেই। অজ্ঞাত ব্যক্তি বলল, 'সুতরাং, আমাকে কোনকিছু নিয়ে ব্লেইম করার আগে ভেবেচিন্তে করবে। ঘাস খেতে খেতে হোম মিনিস্টার হইনি আমি। কথাটা মাথায় রাখবে।'

' জি।' গম্ভীর গলায় বলল শওকত।

হোম মিনিস্টার মৌন থাকল কিছুক্ষণ। মেজাজ খানিকটা ঠান্ডা করে বলল, ' তুহিন আহমেদকে সরানো তোমার জন্যে যতোটা জরুরি, আমার জন্যে তার চেয়েও বেশি জরুরি। এই পর্যায়ে এসে আমার পজিশন ডোবাতে আমি রাজি নই। তার জন্যে যা করা দরকার করব আমি। এবার আড়ালে-আবডালে নয়। সোজা আক্রমণ করতে হবে। ঠিক যেভাবে সিংহ স্বীকার করে। সেটা যদি সিংহের গুহায় ঢুকে করতে হয়, তবে তাই সই।'

*****

স্পট থেকে সোজা গোয়েন্দা বিভাগের অফিসেই পৌঁছলো তুহিন। লাঞ্চ টাইম পেরিয়ে গেছে অনেকক্ষণ। কিন্তু খাওয়ার রুচি বা ইচ্ছা কোনটাই নেই। তমালেরও একই অবস্থা। চাইলেও গলা দিয়ে কিছু নামবে না এখন আর। চারপাশটাও অদ্ভুত এক নিস্তব্ধতায় ছেয়ে আছে। কেমন অদ্ভুত শোকময় পরিবেশ। গাড়ি পার্ক করে ভেতরে প্রবেশ করতে করতে তমাল বলল, ' এখন স্যার? আবার রুদ্রর কাছে যাবেন?'

তুহিন বলল, ' না, আগে একবার _'

বাক্য সম্পূর্ণ করার অবকাশ হলোনা তুহিনের। আচমকা কেউ একজন এসে ঝাঁপিয়ে পড়ল ওর প্রশস্ত বুকে। টাল হারিয়ে কু'দম পিছিয়ে গেল তুহিন। থমকে দাঁড়াল তমালও। হতভম্ব তুহিন কিছু বুঝে ওঠার আগেই ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠার শব্দে মিলিয়ে গেল চারপাশের নিস্তব্ধতা। 
লম্বা দুটো শ্বাস ফেলে নিজেকে ধাতস্থ করল তুহিন। অন্যমনস্ক থাকায় চমকে উঠলেও নিজের বুকে আছড়ে পড়া রমনীকে চিন্তে বিন্দুমাত্র অসুবিধা হলোনা ওর। বিশাল এই পৃথিবীতে হাতেগোণা যেকজন স্বজন ওর জীবিত আছে, তারমধ্যে এই মেয়েটি ওকে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসে। সম্পর্কের নামটুকু অস্তিত্ব হারিয়েছে, কিন্তু ভালোবাসা এখনো ততটা জায়গা জুড়েই আছে। 

' ইরাবতী!' ইরার পিঠে আলতো করে হাত রেখে বলল তুহিন।

ইরার কান্নার গতি বৃদ্ধি পেল। হাতদুটো আরও শক্ত করে আকড়ে ধরল তুহিনের পিঠ। ঘটনা বুঝতে অসুবিধা হয়নি তুহিনের। তাই ইরাকে আশ্বস্ত করে বলল, ' শান্ত হও। ঠিক আছি আমি।'

কিন্তু ইরার থামার নামগন্ধ নেই। বাচ্চাদের মতো কেঁদে চলেছে মেয়েটা। আশেপাশের সবার দৃষ্টি এখন ওদের দিকেই। বিপাকে পড়ল তুহিন। ইরাকে আকড়ে ধরেই অস্বস্তি নিয়ে তাকাল চারপাশে। এমনিতেই প্রায় মরতে মরতে বেঁচেছে তুহিন। সে নিয়ে কারো কৌতূহলের অন্ত নেই। তারওপর এমন দৃশ্য সেই কৌতূহলে অনেকটা শেষ পাতে চাটনির মতো।
পুরো ঘটনাটাই খানিকটা স্তম্ভিত হয়ে দেখছিল তমাল। পরিস্থিতি বুঝতে পেরে এগিয়ে এলো খানিকটা। সামান্য গলা ঝেড়ে বলল, ' স্যার, ম্যামকে নিয়ে গেস্টরুমে যান। কেউ নেই এখন ওখানে।'

মাথা নাড়ল তুহিন। এইমুহূর্তে আলাদা কোথাও যাওয়া ছাড়া উপায় নেই। ইরাকে ধরে নিয়ে কোনমতে গেস্টরুমে পৌঁছলো ও। ওদের গেস্টরুম অবধি পৌঁছে দিয়ে নিজের কাজে চলে গেল তমাল। দুজনকে আলাদা কথা বলতে দেওয়া প্রয়োজন।

পুরোটা সময় তুহিনকে আকড়ে ধরেছিল ইরা। সমানতালে চলেছে কান্নাও। তুহিন অবাক হয়ে দেখছিল কেবল। সম্পর্কের এই তিন বছরে মেয়েটাকে কখনও এভাবে কাঁদতে দেখেনি ও। এরকম ছেলেমানুষীরতো প্রশ্নেই ওঠেনা। গেস্টরুমে ঢোকার পরেও প্রায় পাঁচ মিনিট তুহিনকে আকড়ে ধরে হিঁচকি দিয়ে কেঁদে গেছে ইরা। ছাড়ার নামগন্ধ নেই। তুহিন এবার জোরপূর্বক ইরার মুখখানা তুলে ধরল। ভালোভাবে তাকিয়ে দেখল, ফর্সা রঙে লালচে আভা পড়েছে কাঁদতে কাঁদতে। লালচে চোখ, সঙ্গে ভেজা পাপড়িতে অসম্ভব মায়াবী দেখাচ্ছে তার প্রিয়তমাকে। সেইসঙ্গে সাদা স্যালোয়ার-কামিজ যেন আরও খানিকটা স্নিগ্ধতা ঢেলে দিয়েছে মেয়েটার মধ্যে। খানিকক্ষণ একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে দীর্ঘশ্বাস চাপল তুহিন। সযত্নে ভেজা গালদুটো মুছে দিয়ে বলল, ' কান্না থামাও। আ'ম ফাইন।'

কিন্তু থামলোনা ইরা। কেমন বাচ্চাদের মতো গুঙ্গিয়ে উঠল। অস্থির হয়ে উঠল। যেন ঘোর লেগে গেছে মেয়েটার। তুহিন এবার অপ্রত্যাশিত কাজ করে বসল। কোমর টেনে নিজের সঙ্গে মিশিয়ে ফেলল ইরাকে। অপর হাতে টেনে নিল ইরার ঘাড়। নিজের ঠোঁটজোড়া নামিয়ে আনল ইরার ঠোঁটে।
ইরা থমকালো। তুহিনের আচমকা আক্রমণে জমে গেল ও। শিথিল করে ফেলল নিজের শরীর। বেশ অনেকটা সময় পর যখন তুহিন অনুভব করল ইরা শান্ত হয়েছে। ধীরে ধীরে নিজের বন্ধন আলগা করল তুহিন। সরে এসে তাকাল ইরার চোখে। চোখের ইশারায় আশ্বস্ত করল, সে সুরক্ষিত আছে। কিছুক্ষণ স্থির চোখে তাকিয়ে থাকল ইরা। ধীরে ধীরে ভেজা চোখদুটোয় ভয় আর দুশ্চিন্তার জায়গায় রাগ এসে বাসা বাঁধল। ঠোঁটে ঠোঁট চেপে প্রকাশ করল তীব্র অসন্তোষ। দুটো শ্বাস ফেলে সজোরে ধাক্কা মারল তুহিনের বুকে। দু'কদম পিছিয়ে গেল তুহিন। বিস্ময় নিয়ে তাকাল ইরার দিকে। অস্ফুট স্বরে বলল, ' তুমি..'

সপাটে এক থাপ্পড় পড়ল তুহিনের গালে। স্তম্ভিত হয়ে থেমে গেলে তুহিন। শব্দ হারালো। দুকানে যেন ঝিম ধরে গেল। বিস্ময় তরতর করে বাড়ল কয়েকগুণ। ইরা ওকে চড় মেরেছে! ইরা! হজম হলোনা ব্যপারটা। নিঃশ্বাস একপ্রকার বন্ধ করে তাকিয়ে রইল কেবল। তিনবছরে বহু ঝগড়া হয়েছে। বিচ্ছেদও হয়েছে। কিন্তু কখনও ওর গায়ে হাত তোলাতো দূর, চিৎকার করে কথাও বলেনি মেয়েটা। উত্তেজিত ইরা অনেকটা চিৎকার করে বলল, 'কী মনে করো নিজেকে? সর্বেসর্বা! যা ইচ্ছা করতে পারো তুমি? কারো কিছু বলার নেই, জানানোর নেই, কৈফিয়ত দেওয়ার নেই। আমার সঙ্গে ব্রেকআপটাও এজন্যই করেছিলে তাইনা? যাতে এমন বেপরোয়াভাবে যা ইচ্ছা করতে পারো।'

' ইরা...'

' চুপ! ফোন কই তোমার? কতগুলো কল করেছি আমি?'

তুহিনের মনে পড়ল, ফোনটা সাইলেন্ট অবস্থায় অবহেলায় পড়ে আছে। হকচকিয়ে ফোনটা প্যান্টের পকেট থেকে বের করল তুহিন। দেখল, অসংখ্য মিসডকল। যার প্রায় সবগুলোই ইরার নাম্বার থেকে এসেছে। অন্যসময়ের মতো ইরার মনস্থিতি বুঝতে দেরী করল না তুহিন। অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, 'আ'ম স্যরি।'

' শাট আপ!' তেঁতে উঠল ইরা। এক হাতে চোখ মুছে বলল, 'ইউ নো হোয়াট? তোমাকে ভালোবাসাই উচিৎ হয়নি আমার। ইউ আর দ্য মোস্ট সেলফিশ ম্যাম ইন দ্য ওয়ার্ল্ড। অন্যকারো ফিলিংস, টেনশন, ইমোশন কোনকিছুর দাম নেই তোমার কাছে। যেই মুহূর্তে আমি শুনেছি তোমার অফিশিয়াল কারটা ব্লাস্ট করেছে আমার কী অবস্থা হয়েছিল ধারণা আছে তোমার? কলের পর কল করেছি। নিঃশ্বাস আটকে আসছিল আমার, হার্টবিট বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল। আমি গোটা জগৎ অন্ধকার হয়ে গিয়েছিল তুহিন। বোঝ তুমি? বোঝনা! আসলে, তুমি কাউকে আপন ভাবোই না। ভাবলে নিজের জীবন নিয়ে এমন ছেলেখেলা করতে পারতেনা। আমায় এভাবে মেন্টালি টর্চার করতে পারতেনা। তোমার মতো একটা ইরেসপন্সিবল, হার্টলেস মানুষকে ভালোবেসে আমি আমার লাইফটা হেল করে ফেলেছি। আমি! আই জাস্ট হেইট ইউ তুহিন। জাস্ট হেইট ইউ।'

কথাটা বলে একমুহূর্তও দাঁড়াল না। ছুটে বেরিয়ে গেল ইরা। দরজার বাইরে, খানিকটা দূরে অনেকটা পাহারাদারের ভুমিকায় দাঁড়িয়ে ছিল তমাল। ইরাকে ওভাবে ছুটে যেতে দেখে বোকা বনে গেল বেচারা। ওকে আরও চমকে দিয়ে বেজে উঠল হাতের ফোনটা। তুহিনের কল। কল রিসিভ করতেই তুহিন বলল, ' তোমার ম্যামের সঙ্গে যাও। গাড়িতে তুলে দিও এসো। মানসিক অবস্থা ভালো নেই ওর।'

' জি স্যার।' বলতে বলতেই ইরার পেছন পেছন ছুটল তমাল।

কল কেটে দীর্ঘশ্বাস ফেলল তুহিন। ইরার পেছনে যাবে ভেবেও সামলে নিয়েছে নিজেকে। এখন উপযুক্ত সময় নয়। তাড়াহুড়ো করে সমাধান করার মতো সমস্যা হয়নি ওদের মধ্যে।
ওখানকার একটা চেয়ারে বসে পড়ল তুহিন। উঁচু হয়ে দুহাতে নিজের মুখটা চেপে ধরল। চোখ বন্ধ করতেই নাঈমের বিভৎস লা*শটা ভেসে উঠল চোখের সামনে। নাঈমের জায়গার আজ ওর থাকার কথা ছিল এটা চরম সত্যি।এমনভাবেই ছিন্নবিচ্ছিন্ন হয়ে ঝলসে যেতো তুহিনের শরীরটা। মোটকথা ওর জন্যে নির্ধারিত মৃত্যু গ্রাস করেছে নাঈমকে। নাঈমের পরিবার প্রিয় মানুষ হারানোর যন্ত্রণায় উন্মাদপ্রায়। ওর হবু স্ত্রীর সদ্য স্বপ্নে সাজানো মন ভেঙ্গে চূড়মার হয়ে গেছে। এদিকে তুহিন সবসময় ভাবতো ওর পৃথিবীতে কেউ নেই। তাই বেঁচে থাকার কোন লালসা ছিলোনা ওর মধ্যে। কিন্তু আজ ইরার প্রতিক্রিয়া নাড়িয়ে দিয়েছে তুহিনকে। মনে করিয়ে দিয়েছে, এই বিশাল পৃথিবীতে একজন আছে, যে ওকে মন-প্রাণ দিয়ে ভালোবাসে। ওর মৃত্যুতে মেয়েটা কত ভয়ংকর আঘাত পেতো তা যেন হঠাৎ করেই উপলব্ধি হল তুহিনের। এই নিঃস্বার্থ ভালোবাসার জন্যে হলেও ওর বাঁচা প্রয়োজন। তারচেয়েও বেশি প্রয়োজন সবটা ঠিক করে নেওয়া। অনে হয়েছে। ইগোকে সামনে রাখার আর কোন মানে নেই। মেয়েটা অমন তীব্র ভালোবাসার কাছে একবার কেন, বারবার মাথা নত করতেও আপত্তি থাকা উচিত নয়।

আরও একজন আছে, যে তুহিনকে ভালোবাসে। নিজের সন্তানের মতো ভালোবাসে। ওর মৃত্যুতে কষ্ট পাবে সে মানুষটাও। কিন্তু এই মুহূর্তে তার প্রাণও সংকটে। কারণ সে তুহিনের বাড়িতে থাকে। নাঈমকে হারিয়েছে। নতুন কোন রিস্ক নিতে পারবেনা ও। ঝট করে সোজা হয়ে বসল তুহিন। তৎক্ষণাৎ কল করল মাহমুদার নাম্বারে। রিসিভ হতেই ব্যস্ত কন্ঠে বলল, ' হ্যালো খালা?' 

' হ্যাঁ বাবা বলো?'

' তুমি ক'দিনের জন্যে তোমার বোনের বাড়ি থেকে ঘুরে এসো।'

মাহমুদা অবাক হলেন বেশ, 'কী! কিন্তু কেন?'

' দরকার আছে খালা। প্লিজ আজ কোনরকম তর্ক না করে আমার কথা শোন।'

' কিন্তু রান্নাবান্না...'

তুহিন অস্থির গলায় বলল, ' ওসব আমি ম্যানেজ করে নেব খালা। তুমি শুধু আমার কথা শোন।'

কিছুক্ষণ বোঝানোর পরে, বহুকষ্টে রাজি হলেন মাহমুদা। স্বস্তির শ্বাস ফেলল তুহিন। সেমুহূর্তেই ফিরে এলো তমাল। জানাল, ' ম্যামকে ঠিকঠাক গাড়িতে তুলে দিয়েছি স্যার।'

তুহিন উঠে দাঁড়াল। ফোনটা পকেটে রেখে বলল, 'ফরেনসিকের কী খবর?'

' মহিউদ্দিন স্যার দেখছেন। রিপোর্ট রেডি হতে সময় লাগবে।'

' বাইরের কোন ইনফরমেশন। কোন আই উইটনেস, সামথিং?'

তমাল হতাশ নিঃশ্বাস ফেলে বলল, ' না স্যার। এখানো অবধি না। খুবই প্লান করে, সতর্কতার সাথে করেছে স্যার। শওকত মীর্জা কাঁচা কাজ করার লোক নয়। আফসোস একটাই নাঈম অকারণেই _'

চোয়াল শক্ত হয়ে এলো তুহিনের। দাঁতে দাঁত পিষে বলল, 'শুধু মীর্জা নয় তমাল। আরও বড় কোন পলিটিক্যাল পাওয়ার আছে এর পেছনে। এই শেষ সময়ে ব্যাকাপ ছাড়া একা এতো বড় রিস্ক নেবেনা সে। তাছাড়া আমার ব্যক্তিগত নজরদারি আছে ওর ওপর। কেউ আছে ওর সঙ্গে। এবং সেও এই কেইসের সঙ্গে কোন না কোনভাবে কানেক্টেড।'

সকাল থেকেই চোখমুখ শুকিয়ে আছে তমালের। তুহিনের এই কথা আরও বেশি ফ্যাকাশে করে দিল তা। ইতস্তত করে বলল, 'আপনি প্লিজ একটু সাবধানে থাকবেন স্যার।'

মেসেজ টোন বেজে উঠল তুহিনের ফোনে। তুহিন স্ক্রিন ওপেন করতেই ইংরেজি বর্ণের একটা মেসেজ দেখতে পেল।
"দু'বার কপালের জোরে বেঁচে গেছো তুহিন। কিন্তু কপাল বারবার ভালো যায়না। সাবধান!"

তুহিন মেসেজটার দিকে শক্ত চোখে তাকিয়ে থেকেই বলল, 'থাকব।'

ঠান্ডা গলায় কথাটা বললেও ভেতরে ভেতরে লাভা জ্বলে উঠল তুহিনের। যা খুবই দুর্লভভাবে জ্বলে। কিন্তু যখন জ্বলে তা অপরপক্ষের জন্যে ভালো কিছু বয়ে আনেনা। দু'বার খু*নের চেষ্টা, হুমকি এতো মিষ্টিভাবে হজম করার মানুষ তুহিন আহমেদ নয়। শেষটাতো এবার দেখেই ছাড়বে। যেকোন মূল্যে। শার্ট ঠিক করতে করতে বেরিয়ে যাচ্ছিল তুহিন। পেছন থেকে তমাল বলে উঠল, ' কোথায় যাচ্ছেন স্যার?'

তুহিন থামল না। চলমান অবস্থাতেই বলল, 'ডিজি স্যারের রুমে।'

' আর রুদ্র?'

কৌতুহল নিয়ে প্রশ্ন করল তমাল। রুদ্র, প্রিয়তা, আমের ভিলা, সোলার সিস্টেম সবকিছুই মনে গেঁথে গেছে ওর। অসহ্যকর অপেক্ষায় পার করেছে দীর্ঘ এই সময়টা। এসবের শেষটা জানার জন্যে মরিয়া হয়ে উঠেছে ও। যেকোন মূল্যে। তুহিনও বুঝল ব্যপারটা। গম্ভীর গলায় বলল, ' সন্ধ্যা অবধি অপেক্ষা করো। ঐ স্টোরির দি এন্ড আজকেই হবে।'

তমাল স্বভাবসুলভ অসহনশীলতা দেখিয়ে বলল, ' সবটা বলবে ও?'

রেগে থাকলেও মৃদু হাসল তুহিন। বলল, ' বলবে। নিজের প্রয়োজনেই বলবে।'

*****

প্রায় পাঁচ মিনিট হল শাফায়াত হুসাইনের কেবিনে বসে আছে তুহিন। কিছু বলেননি এখনো শাফায়াত। ভ্রুকুটি করে চুপচাপ বসে আছেন। তবে আজকের মৌনতা ব্যস্ততার নয়, দুশ্চিন্তার; তা স্পষ্ট টের পাচ্ছে তুহিন। নিজে থেকেও কিছু বলছেনা। সময় দিচ্ছে শাফায়াতকে। আরও মিনিট দুই পাড় হল নীরবতা দিয়েই। শেষমেশ অনেকটা বাধ্য হয়েই শাফায়াত বলল, ' নাঈমের বাড়ির লোক এসেছে?'

' এখনো পৌঁছয়নি স্যার। তবে পৌঁছে যাবে কিছুক্ষণের মধ্যে। ওনারা এলেই দেখা করব আমি।'

' বডি ফরেনসিকে?'

মাথা দোলাল তুহিন। শাফায়াত জানা প্রশ্নগুলোই ঘুরিয়ে ফিরিয়ে করছে তা ভালোভাবেই বুঝতে পারল তুহিন। জড়তায় পড়েছে আজ বস। তাই সাহায্যের হাতটা তুহিন আজ নিজেই বাড়িয়ে দিল। বলল, ' এসবের মধ্যে রুদ্রর কোন হাত নেই সেটা বলার অপেক্ষা রাখেনা স্যার। কারণ বাইরে কোন ইন্ট্রাকশন দেওয়ার অবস্থা নেই ওর। তাছাড়া লজিক্যালি ভাবলে ওর এসব করার প্রয়োজনও নেই। এটা স্পষ্ট যে টার্গেট আমি ছিলাম। আর আমি আপনাকে আগেও বলেছি স্যার, রুদ্রর কাছে এমন কিছু আছে যা অনেক অনেক বড় বড় মাথার পর্দা ফাঁস করে দেবে। সেকারণেই আমি এখনো ওকে এখানে রেখেছি, আর আমি নিজে ইন্টারোগেট করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।'

গলা ঝেড়ে সোজা হয়ে বসল শওকত। ভ্রুকুটি গাঢ় হল। গম্ভীর গলায় বলল, ' তোমার ওপর হওয়া পরপর আক্রমণ এখন তাই বলে।'

' এক্সাক্টলি স্যার। কেউ চাইছেনা রুদ্র এমন কোন ইনফরমেশন আমাকে দিক যাতে ওদের মুখোশ উন্মোচন হয়ে যায়। আর সেকারণেই আমাকে সরিয়ে ফেলার এতো তোরজোর কারণ আমিই রুদ্রকে জেলে পাঠানো থেকে আটকে রেখেছি। আর এর আরেকটা মানে আছে স্যার।'

' কী?'

' ওদের মধ্যে কোন একজনের প্রশাসনিক পাওয়ার আছে স্যার।'

শাফায়াত মাথা নাড়িয়ে বলল, ' শওকত মীর্জা এমুহূর্তে বেশ নামকরা পলিটিশিয়ান হলেও প্রশাসনিক কোন ক্ষমতা তার হাতে নেই তুহিন। যদিনা টাকার কোন খেলা এখানে ঘটৈ থাকে।'

তুহিন বলল, ' আমি জানি স্যার। আর এ থেকেই ক্লিয়ার বোঝা যাচ্ছে সঙ্গে আছে কেউ। যার এই ক্ষমতা আছে। একবার রুদ্রকে জেলে পাঠাতে পারলে যে সেখানে নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারবে।'

আরও বেশি গম্ভীর হল শাফায়াতের মুখ। টেবিল থেকে পানির গ্লাস নিয়ে অর্ধেকটা খেল। গ্লাসটা টেবিলে রাখতে রাখতে ধীরেসুস্থে বলল, ' তুমি জানো তুমি কী বলছো? কোনদিকে যাচ্ছো?'

তুহিন দৃঢ় কন্ঠে বলল, ' শতভাগ স্যার। অপেক্ষা শুধু রুদ্রর কাছ থেকে সেই প্রমাণ সংগ্রহ করার।'

' কিন্তু তোমাকে খুব বেশি সময় দিতে পারব না আমি তুহিন। কালকের মধ্যেই পুলিশের কাছে হ্যান্ডওভার করতে হবে ওকে। এরপর কোর্ট ক্যাচালের অনেক ঝামেলা আছে! সুতরাং যা করার আজকের মধ্যে করেই আমায় রিপোর্ট করো। ইউ ক্যান গো নাও।'

ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলল তুহিন। ওঠার প্রস্তুতি নিয়ে বলল, ' সন্ধ্যার পরেই আমি আবার রুদ্রকে ইন্ট্রোগেট করতে বসব স্যার। আজকেই শেষ। কথা দিচ্ছি, এই কাহিনীর শেষ না জেনে আমি ইন্ট্রোগেশন রুম ছেড়ে বের হব না।'

অপলক চোখে নিজের ডিপার্টমেন্টের সবচেয়ে তুখোড়, চৌকস গোয়েন্দার দিকে তাকিয়ে রইল শাফায়াত। মনে মনেই বক্র এক হাসি দিল সে। ওপরে শান্তভাব থাকলেও ভেতরে আগুন জ্বলে গেছে, তা আর বুঝতে বাকি নেই অভিজ্ঞ বসের।

*****

আরও একবার বদ্ধ সেই ইন্টারেগেশন রুম, ছোট্ট টেবিল পাশাপাশি বসে আছে তুহিন আর তমাল। টেবিলের অপরপাশে রুদ্র। হাতে ঠিক একইভাবে বাঁধা হ্যান্ডকাফ। তমাল নোটডাউন করার জন্যে তৈরী। তবে টেবিলের মাঝামাঝি বসানো নগ্ন বাল্বটা বেশ তীক্ষ্ম লাগছে আজ। তবে সেসব ছেড়ে মনোযোগ দিল রুদ্র আমেরের দিকে। 
রুদ্রর চোখে-মুখে এখন সেইরকমই ব্যঙ্গ খেলা করছে। কাহিনি যতটুকু শুনেছে তাতে রুদ্রর প্রতি সামান্য করুণাভাব কাজ করলেও, তিরস্কারময় এই প্রতিক্রিয়া মেজাজ খারাপ করে দেয় তমালের।

কথা শুরু রুদ্রই করল। অনেকটা ব্যঙ্গ করেই বলল, 'দুজনের চোখেমুখেই বিষাদ দেখতে পাচ্ছি। কলিগের মৃত্যুতেই কলিজা ছিড়ে যাচ্ছে।'

তমাল ভ্রুকুটি করল। কিন্তু তুহিন রাগল না। উল্টে মুচকি একটু হেসে বলল, ' কলিজা ছিড়লে তোমাকে ইন্টারোগেট করতে আসতাম না।'

' শুধু শুধু সময় নষ্ট করছেন অফিসার। আপনাকে দেওয়ার মতো আমার কাছে কোন ইনফরমেশন নেই। যা বলার, আমি বলে দিয়েছি।'

' তোমাকে কে বলল আমার ইনফরমেশন চাই। আগেই বলেছি কাল অবধি তোমাকে আমার কাছে রাখতে হবে তাই সময়টা কাটিয়ে নিতে। তাছাড়া তোমার অর্ধেক কাহিনী শুনে আমার জুনিয়র খুবই অধৈর্য হয়ে আছে বাকিটা শোনার জন্যে।'

তুহিনের দিকে একপলক তাকিয়ে গলা ঝাড়ল তমাল। নড়চড়ে বসল একটু। চোগ সরিয়ে হাসল রুদ্র। বলল, ' ভালো ছিল। কোথায় ছিলাম যেন আমি?' 

তুহিনের চোখেমুখে অবাক হওয়ার কোন লক্ষণ না থাকলেও তমাল বড়সর রকমের ঝটকা খেল। এতো সহজে আবার বলতে রাজি হয়ে গেল! কীভাবে সম্ভব! নিজের কৌতূহল কোন অংশে দমন করতে না পেরে বলল, ' মিস প্রিয়তা এসেছিলেন আমের ভিলায়। তারপর?'

ঠোঁটে ঠোঁট চেপে একটু ভাববার ভঙ্গি করল রুদ্র। বলল, 'মনে করতে হবে। গোলমেলে কাহিনী। এতোসব মনে থাকে?'

শীতের সন্ধ্যায়ও শরীর উত্তপ্ত হয়ে উঠল তমালের। ইচ্ছে করে মজা নিচ্ছে শালা! দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়ে কিছু বলতে যাবে; হাতের ইশারায় থামিয়ে দিল তুহিন। অদ্ভুতভাবে মেজাজ খুবই ঠান্ডা আছে তুহিনের। অথচ পরিস্থিতি বিচারে উল্টোটাই হওয়ার কথা ছিল। তুহিন মাথা দুলিয়ে বলল, ' ঠিক। এতোসব মনে থাকার কথা না। কিন্তু কিছু জিনিসতো মনে থাকেই।'

' যেমন?' নির্বিকারভাবে উচ্চারণ করল রুদ্র।

' ঘৃণা করো মিস প্রিয়তাকে?'

সঙ্গে সঙ্গে বদলে গেল ইন্টারোগেশন রুমের আবহওয়া। হুট করেই যেন হাওয়া স্তব্ধ হয়ে গেল। রুদ্র নির্বিকার অঙ্গভঙ্গি, ব্যঙ্গাত্মক প্রতিক্রিয়া সবটাই মিলিয়ে যেন কোথায় যেন। অনুভূতিশূণ্য চোখজোরাতে অদ্ভুত অনুভূতি খেলে যেতে স্পষ্ট দেখল তুহিন। অবাক হতে বাধ্য হল ও। এতোকিছুর পরেও কারো প্রতি এতো তীব্র অনুভূতি থাকতে পারে! এ অনুভূতির নাম কী? ভালোবাসা! ভালোবাসা এমনও হয়? নিজের বিস্ময় লুকিয়ে তুহিন বলল, ' তুমি বলেছিলে আমার সব প্রশ্নের উত্তর তুমি দেবে।'

প্রথমবারের মতো ইন্টারোগেশনরুমে রুদ্রর দীর্ঘশ্বাসের শব্দ শোনা গেল। রুদ্র অনেকটা অন্যমনস্ক হয়ে বলল, ' আমি ওকে বলেছিলাম, কাউকে নিজের সর্বস্ব দিয়ে অপাড় ভালোবাসা দেওয়ার পর, সে ভালোবাসা তুলে নেওয়া যায়না। আর তুলে নিলে সেই স্থানে এসে ভর করে তীব্র ঘৃণা। অতোটা ঘৃণা ওকে আমি করতে পারব না।'

' পেরেছিলে?' হালকা গলায় প্রশ্ন করল তুহিন।

তুহিনের বিস্ময়কে এক ধাক্কায় কয়েকগুন বাড়িয়ে দিয়ে তীক্ষ্ম চোখজোড়া ছল করে উঠল রুদ্রর। তুহিন একপ্রকার হা করে তাকিয়ে রইল। মৃত্যুকে সামনে দেখেও যে লোকটার চোখের পাতা অবধি কাঁপেনা। হাজারটা গভীর জখমেও যে 'উফ' অবধি করেনা। নিজের সর্বস্ব শেষ হতে দেখেও যে অটল পাহাড়ের মতো দাঁড়িয়ে ছিল। তার চোখ ভিজে আসছে এক ছলনাময়ী, বিশ্বাসঘাতিনীর জন্যে! এ কেমন প্রেম! কেমন ভালোবাসা! 
ভেতর থেকে অদ্ভুতভাবে কান্না পেল তুহিনের। এই ক'বছরে এমন অভিজ্ঞতা এই প্রথম। চোখ সরিয়ে তমালের দিকে তাকিয়ে দেখল অন্যদিকে তাকিয়ে আছে সে। ছায়ায় আড়াল করছে নিজের মুখ। ওদের গভীর আবেগকে পাত্তা না দিয়ে রুদ্র আমের বলে চলল, ' হিউম্যান সাইকোলজির একটা ইন্টারৈস্টিং পার্ট জানেন অফিসার? মানুষ যখন খুব কাছের কারো কাছ থেকে আঘাত পায়, কিন্তু পাল্টা একই আঘাত করতে পারেনা আউট অফ লাভ। তখন ওরা দুটো রাস্তা অবলম্বন করে। হয় নিজেকে আঘাত করে। নয়তো অপরজনকে তীব্র মানসিক যন্ত্রণায় ঝলসে দেয়। নিজের আঘাত করার মতো অক্ষত জায়গা আমার ছিলোনা। তাই দ্বিতীয় রাস্তাতেই হেঁটেছিলাম আমি। ওকে আমি ঘৃণা করতে পারিনি, কিন্তু ক্ষমাও করতে পারিনি। তাই সেদিন রাতে আমি দ্বিতীয় রাস্তাকেই বেছেছিলাম। শুধু ওর না, বিষাক্ত এই কাহিনীর শেষ অংশটুকু লেখা শুরু হয়েছিল সেই রাত থেকেই!
.
.
.
চলবে...................................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন