অনন্যা যখন চোখ খুললো, ততক্ষণে সকাল গড়িয়ে দুপুরের পথে। তবে চোখ খুলে শান্তি পেল না। মাথার ওপরে ধীরে ঘুরছে একটি ডিজাইনেবল ফ্যান। বিছানায় হাত-পা ছড়িয়ে আরাম করে ঘুমিয়েছিল সে। নিজের অবস্থান গুছিয়ে কাত হয়ে শুয়ে পড়লো আবার। কিছুক্ষণ চোখ বন্ধ রেখে শুয়ে রইলো, যেন আরামের পরশটা আরও একটু উপভোগ করতে পারে। চোখ দুটো ঘুম ঘুম করছে শুধু। কিন্তু বেশিক্ষণ সময় লাগলো না আরাম সরিয়ে বিছানা থেকে উঠে বসতে।
কাল রাতে ঘটে যাওয়া অবাস্তব ঘটনাগুলো হঠাৎ করেই অনন্যার মনের দরজায় কড়া নাড়লো। একের পর এক স্মৃতির পর্দায় ভেসে উঠতে লাগলো স্যারের বিরূপ আচরণ, তার চোখে দেখা সেই অদ্ভুত ভয় আর একটি নাম শুনেই শিশুর মতো তার ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে যাওয়ার দৃশ্য। কিন্তু এরপর কী হলো?
বিছানায় এসে কীভাবে শুয়ে পড়লো অনন্যা? নিজের দিকে তাকিয়ে দেখলো, টিশার্টটা তো সেই কালকেরই। কিন্তু স্যার তো ওটা ছিঁড়ে ফেলেছিলেন! তাহলে এটা আবার ঠিকঠাক হলো কীভাবে?
অনন্যার চোখ হঠাৎ আয়নার দিকে চলে গেলো। দূর থেকেই দেখতে পেলো তার মুখে কোনো ক্ষ/তের চিহ্ন নেই। অথচ কাল রাতে তার গালে স্যারের নখের আঁচড়ে র/ক্ত ঝরেছিল। মনের জট ছাড়ানোর চেষ্টা করতে করতে হঠাৎই অনন্যার মনে হলো, একবার কাছ থেকে দেখে নেওয়া দরকার।
দ্রুত পায়ে ছুটে গেলো আয়নার কাছে। নিজের প্রতিবিম্ব দেখেই বিভ্রান্ত হয়ে গেলো অনন্যা। মুখে দাগ, কোনো চিহ্ন, কিছুই নেই। কিন্তু কীভাবে? অনন্যা নিজের ঠোঁট কয়েকবার পরখ করলো। যেভাবে কামড়ে ধরেছিল লোকটা, এখনো ফুলে থাকার কথা কিন্তু কিছুই হয়নি। একদম স্বাভাবিক সবকিছু। কানের পেছনেও কোনো চিহ্ন চোখে ধরলো না। সবকিছু স্বপ্ন মনে হলেও অনন্যা মানতে পারছিলো না।
আরো কিছু মনে পড়তেই অনন্যা দরজা খুলে বেরিয়ে গেল। স্যারের রুমের দরজা খুলতে চাইলেও পারলো না। লক করে রেখেছে বাদরটা। অনন্যা ক্ষীপ্ত হলো। অগোছালো অবস্থাতেই দ্রুতগতিতে নীচে নেমে এলো। বাঘটা একপাশে বসে কাঁচা মাংস খাচ্ছিলো। শরীর কাঁটা দিয়ে উঠলো অনন্যার। পরমুহূর্তেই বিষয়টিকে গুরুত্ব না দিয়ে সে রান্নাঘরের দিকে এগোলো।
লারা রান্নাঘরেই ছিল। অনন্যা ধীর পায়ে রান্নাঘরের সামনে এসে দাঁড়ালো। ভেতরে লারা ব্যস্ত হাতে কিছু কাটছিল। তাকে দেখেই অনন্যা সরাসরি বললো,
"কাল রাতে আমি স্যারের রুমে এক গ্লাস দুধ আর পাউরুটি নিয়ে গিয়েছিলাম, তাই না?"
লারা একটু থেমে দাঁড়ালো, কিছুক্ষণ চিন্তা করে মাথা তুলে তাকিয়ে বললো,
"হ্যাঁ, কিন্তু তুমি না। আমি গেছিলাম। হঠাৎ কেন জানতে চাইতাছ?"
অনন্যা হতবাক হয়ে লারার দিকে তাকিয়ে বললো,
"তুমি? মিথ্যে বলছো কেনো? আমি গিয়েছিলাম! এখনো মনে আছে স্পষ্টভাবে।"
"আরে ম্যাডাম! আমি দুধ গরম করে তুর হাতে ট্রে দিয়ে বললাম, ' যাও, দিয়ে আহো।' তুমি তখন কিছুক্ষণ দাঁড়ায় ছিলে। পরে বললা, 'যেতে ইচ্ছে করছে না, তুমি দিয়ে আসো!'"
"আমি বলেছিলাম এমন?"
অনন্যা পুরোপুরি বিস্মিত হয়ে গেলো। এসব কী হচ্ছে? কিছুই বুঝতে পারছে না।
"হুম!"
অনন্যার মাথা কাজ করছে না। মাথার চুল ঠিক করে বললো,
"আচ্ছা, স্যার কোথায়?"
"চইলা গেসে। "
"চলে গেছে? আমাকে ছাড়া? আমি ক্লাসে কীভাবে যাবো?"
অনন্যা আরো অবাক হলো।
লারা কাজ করতে করতেই বললো,
" ঘড়ি দেখো মাইয়া! দশটা বাজতে চলতাছে। এতোক্ষণ ঘুমাইবা আবার ভাববা সাব বসে থাকবো।"
"তাহলে আমি কীভাবে যাবো?"
"আমার সোয়ামি নিয়া যাবে। তুমি রেডি হলে ফোন দিমু।"
অনন্যা মাথা নাড়িয়ে চলে গেলো, এখন তো কালকে যা হয়েছে তা স্বপ্ন মনে হচ্ছে কারণ তার শরীরে কোনো দাগ বা ক্ষ/ত কিছু নেই, তাছাড়া স্যার কালকে হঠাৎ ওর সাথে এমন আচরণ কেনো করবেন? তাদের দুজনের মধ্যে না আছে ভালোবাসা আর না আছে গভীর কোনো সম্পর্ক। একটা স্পর্শ বিষয়ক কথাবার্তা নিয়ে সে এতো হিং/স্র কেন হয়ে উঠবেন? আর কেনোই বা পশুর মতো হয়ে যাবেন আর বর্বর অসভ্য লোকের মতো ব্যবহার করবেন? কিন্তু....একটা কিন্তু তো থেকেই যায়। অনন্যার প্রতিটা ঘটনা এখনো স্পষ্টভাবে মনে আছে। সবকিছু চোখের সামনে ঘটতে দেখেছে সে। স্যারের আচরণ, স্যারের হিংস্রতা। এমনকি স্যারের হাতের স্পর্শ। মনে হচ্ছে এখনো সেই স্পর্শ শরীরে মধুর মতো লেগে আছে। না সেই স্পর্শকে মধুর স্পর্শ বলা যায় না, স্যার যা করেছিল ভালোবেসে বা পছন্দ করে করেনি। করেছিল জেদের বশে। জেদ তার সীমা ধীরে ধীরে লঙ্ঘন করতে যাচ্ছিল। কিন্তু থেমে গিয়েছিল কারণ? প্রিন্সেস আরিসা! অনন্যার মনে পড়লো সে ঠিকই শুনেছে। সবাই কি তাকে বোকা পেয়েছে? যে যা বলবে তাই বিশ্বাস করতে হবে? কিন্তু শরীরের দাগ আর পোশাক কীভাবে ঠিকঠাক আছে তা নিয়েই মাথায় জটলা পেকে গেছে।
লারা অনন্যার চলে যাওয়ার পর দীর্ঘশ্বাস ফেলল, তার বুকের ভেতর আটকে থাকা ভারী বাতাস বেরিয়ে এলো। কিন্তু মেয়েটা কি সত্যিই তার কথা বিশ্বাস করল? যদি না করে, তবুও লারার জন্য নতুন ঝামেলা অপেক্ষা করছে। সকালের ঘটনাগুলো আবার ভেসে উঠল লারার মনে।
কৌশিক ভোর হতেই নিজের রুম হতে ছুটে বেরিয়ে এসেছিল, মনে হচ্ছিল বড় কোনো বিপদ এসে পড়েছে। লারা তখনো আধো ঘুমে। তার ঘুমন্ত চেহারা দেখে কৌশিক তাড়াহুড়ো করেই বলেছিল,
"লারা! খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা কাজ আছে তোমার জন্য। আমার সঙ্গে চলো।"
কিছু না বুঝলেও লারা তাকে অনুসরণ করেছিল ড্রেস সিলেকশন রুম পর্যন্ত। বিশাল সেই রুমে কৌশিকের অগণিত স্টাইলিশ পোশাক ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রাখা। নিজের আরামের সঙ্গে ফ্যাশনের প্রতি তার নজর সবসময় ছিল। তবে একবার পড়া ড্রেস সে আবার পড়ত না। নিকও মাঝে মাঝে এখান থেকে পছন্দমতো ড্রেস নিয়ে নিত, তবে যেগুলো ওর শরীরে ধরে।
কৌশিক অনেক খুঁজে অনন্যার টিশার্টের মতো দেখতে দুটো টিশার্ট বের করল। সেগুলো লারার হাতে তুলে দিয়ে বলল,
"শিকদারের ড্রেস চেঞ্জ করে দাও। এগুলো পরিয়ে দাও।"
লারার মুখে বিভ্রান্তি ভাব ফুটে উঠল। ধীরে বলল,
"সে যদি উইঠা যায়....আমি কিতা করুম স্যার? আমি তো ভয় পাইতাছি।"
"উঠবে না। নয়টার আগে তো নয়ই। হাই ডোজের ঘুমের ওষুধ দিয়েছি। আর নিক! নিক কোথায়?"
"ছোট সাব রাতে খাওয়া-দাওয়া কইরা গেছিল বাইরে। একটু আগে মনে হয় আসছে।"
কৌশিক একটু ভেবে নিয়ে বলল,
"তাহলে বলছো নিক রাতে বাসায় ছিল না?"
"না! এইডা সত্যি।"
একটা তৃপ্ত হাসি খেলল কৌশিকের ঠোঁটে। বলল,
"ভালো হয়েছে। এখন দেরি করো না, যাও।"
কৌশিক তারপর নিজের রুমে ফিরে গিয়ে কাঁচগুলো পরিষ্কার করতে শুরু করলো। তার কাজে এক ধরনের অস্বাভাবিক তাড়াহুড়ো ছিল, কিছু গোপন বিষয় অক্ষত রাখা দরকার। লারা কাজ শেষে এসে কৌশিকের পাশে দাঁড়ালো। সেও কৌশিকের রুম পরিষ্কার করতে সাহায্য করতে শুরু করল।
কৌশিক তার কাছে আরেকটি বিষয় চাইল,
"লারা, আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ কাজ করতে হবে তোমাকে। যদি শিকদার কালকে এই রুমে পা রেখেছে কিনা জানতে চায়, তখন তাকে না বলবে, আর এমনভাবে বলবে যেন সে বিশ্বাস করে।"
লারার চোখে কিছুটা সন্দেহ ফুটে উঠল, তবে মুখে কোনো প্রশ্ন না এনে সে কাজটি করতে সম্মতি জানালো।ঠোঁটের কোণে একটি ছোট হাসি রেখে বললো,
"হ্যাঁ স্যার, আমি বুঝছি।"
সব ঠিকঠাকই ছিল। কিন্তু সাবের রুম থেকে বের হওয়ার সময় লারার চোখ পড়লো তার পিঠের দিকে। পোশাকের পেছনের অংশটা র/ক্তে ভিজে গেছে। গাঢ় লাল দাগ স্পষ্ট হয়ে ফুটে উঠছে। লারার চোখ বড় বড় হয়ে গেল, গলা শুকিয়ে আসলো।
কিছু বলার জন্য মুখ খুলতে গিয়েও চুপ করে গেল সে। কৌশিকের মেজাজ সম্পর্কে ভালো করেই জানে লারা। এমন অবস্থায় কিছু বললে হয়তো পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়ে যেতে পারে। তাই নিজের মনে একগাদা প্রশ্ন চেপে রেখেই দ্রুত সরে গেল সে।
•
অনন্যা ক্যাম্পাসে পৌঁছেও স্যারের দেখা পেলো না। তবে তার বিখ্যাত গাড়িটা ঠিক যেখানে রাখা থাকে, সেখানেই দাঁড়িয়ে ছিল। কিছুক্ষণ ধরে সরু চোখে সেখানে তাকিয়ে রইলো সে। আজকের দিনটা ছিল একেবারেই বোরিং। প্রফেসর এসেও তেমন কিছু করায়নি। নতুন সেমিস্টারের শুরু। তাই প্রথম কয়দিন আলাপচারিতায় ক্লাস শেষ হয়ে যায়। দুইটা ক্লাস ছিল আজ। তাড়াতাড়িই শেষ হলো।
ক্লাস শেষে, অনন্যা নোহারাকে জোর করে ধরে রেখে কিছুক্ষণ সময় কাটালো। টিউশনির সময় হতে আরো এক ঘণ্টা বাকি ছিল, তাই একা বসে থাকার চেয়ে নোহারার সাথে সময় কাটানোই বেছে নিলো। নোহারা, আবার একটি শপে পার্ট টাইম জব করে সন্ধ্যা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত। সে জানতো যদি আগে চলে যায়, তাহলে বাসায় গিয়ে কিছুটা অবসর সময় কাটাতে পারবে। কিন্তু আজ আর সেটা হলো না।
টিউশনি শেষে বিকালে বাসায় ফিরলো অনন্যা। খাওয়া-দাওয়া করে পুরোনো পড়ে থাকা প্রজেক্টে মনোযোগ দিলো সে। অনন্যা এবং নোহারা দুজনেই ইঞ্জিনিয়ারিং স্টুডেন্ট হওয়ায় বেশিরভাগ সময় তাদের কাটে ল্যাপটপের সামনে। গত কিছুদিন আগে বন্ধের সময়ে এক সফটওয়্যার প্রজেক্ট শুরু করেছিল অনন্যা, কিন্তু এখনো শেষ করতে পারেনি। আরণ্যক কিছুটা সাহায্য করেছিল, বলেছিল আরো বিস্তারিতভাবে বুঝিয়ে দিবে, কিন্তু এখন মনে হচ্ছে সে সাহায্য আর সম্ভব নয়।
রাতে ডাইনিং টেবিলে না চোখে পড়লো নিক ভাইয়াকে আর না কৌশিক স্যারকে। অনন্যা হতাশ হলো। আজ একবারো স্যারের ইঁদুরের মতো মুখটা দেখার সুযোগ হয়নি। এই কষ্ট কাকে বোঝাবে সে? আর কালকের কথাগুলো জিজ্ঞেস করার ইচ্ছে ছিল তাও করা হলো না। এজন্যই বেশ বিরক্ত বোধ করছে অনন্যা। ঘুমানোর সময় স্যারের সাথে কথা বলার জন্য রুমের দ্বার খুলে রাত দুইটা পর্যন্ত বসেছিল। তারপর আর থাকতে না পেরে গভীর ঘুমে ডুব দিয়েছে অনন্যা।
কৌশিক রাতে বাড়ি ফেরেনি। তার আজকের রেসিং কম্পিটিশনটা ছিল অনেক দূরে, যেখানে তাকে রেসিং কার নিয়ে আগেভাগেই যেতে হয়েছিল। প্রতিবারের মতো এবারও বিজয়ী হয়ে ফিরেছে ইশতেহার কৌশিক। তবে হাতের মাংসপেশিতে চোট পেয়েছে গাড়ির ধাক্কায়। ব্যথা নিয়েই ভোরের আলো ফোটার সময় বাসায় ফিরেছে সে।
গেট পেরিয়েই কৌশিককে দেখে ছুটে এলো রিডো। কৌশিক তার মাথায় হাত বুলিয়ে নিয়ে একসঙ্গে রুমের দিকে এগোল। রুমের দরজা খুলতে গিয়ে হঠাৎ চোখে পড়লো অনন্যার রুমের দরজাটা আধখোলা। ভ্রু কুঁচকে এক পা সেদিকে বাড়িয়ে দিলো কৌশিক। রিডোকে নিজের রুমে অপেক্ষা করতে বললো।
আলতো করে হাত নাড়িয়ে ব্যথা কমানোর বৃথা চেষ্টা করতে করতে কৌশিক অনন্যার রুমে প্রবেশ করে আর এক মুহূর্ত থমকে দাঁড়ায়। বিছানায় মেয়েটা গভীর ঘুমে মগ্ন। হাত-পা ছড়িয়ে শুয়ে আছে, ফুস ফুস করে শ্বাস ছাড়ছে। চোখে মুখে ক্লান্তির রেশ দেখা দিয়েছে। কৌশিক আরো এগিয়ে বিছানার পাশে এসে দাঁড়ালো। চোখ হঠাৎ থেমে গেল অনন্যার টিশার্টে। সেটি উপরে উঠে গিয়েছে খানিকটা আর ধরা দিয়েছে অনন্যার উন্মুক্ত পেট।
চোখ পিটপিট করে মেয়েটার নাভির দিকে চোখ থেমে গেলো কৌশিকের। শীতল স্রোত বয়ে গেল সারা শরীর জুড়ে। নিজের ভেতর একধরণের অস্বস্তি অনুভব করলো কৌশিক। তার ভেতরটা যেন হালকা উত্তাল হয়ে উঠলো। অজানা অনুভূতি আঁকড়ে ধরলো তাকে। পরক্ষণেই চোখ সরিয়ে নিলো। সঙ্গে সঙ্গেই নিজেকে সামলে নিলো সে। অন্যদিকে তাকিয়ে থেকেই অনন্যার টিশার্ট আস্তে করে নামিয়ে দিল, তার হাত অনন্যার শরীর ছুঁলো না। কেনো ছুঁলো না? একবার আফসোস তো হলো কৌশিকের।
অতঃপর কিছুটা ঝুঁকে মেয়েটার মুখমণ্ডল পরখ করতে লাগলো কৌশিক। অজান্তেই ঠোঁটের কোণায় হাসি ফুটে উঠলো। মেয়েটার ঠোঁটটা ঠিক আছে তাহলে? কাল যেভাবে আঘাত করেছিল ঠোঁটে, নিশ্চয়ই অনেক ব্যাথা পেয়েছে মেয়েটা? কিন্তু সকাল হতে সেরেও গেছে। কৌশিক ই সারিয়েছে। নিজের কিছুটা শক্তি ব্যবহার করে সব ব্যথা মুছে দিয়েছিল। কিন্তু এরপর নিজে এর থেকে বেশি ব্যথা সহ্য করে বসে আছে। শক্তি দিয়ে দেওয়ার কারণেই কৌশিকের পিঠের ক্ষত থেকে সকালে আবার রক্ত ঝরতে শুরু করেছিল। ক্ষত ঢাকতে কাপড় বেঁধে রেখেছিল কিন্তু তারপরও যন্ত্রণাটা থামেনি।
কিন্তু দরকার কি ছিল সারানোর? আর কেনোই বা করলো শিকদারকে আঘাত? কেন এতো রেগে গেলো যখন স্পর্শের বিষয়টা আসলো!
কৌশিক আর কিছু ভাবতে চাইলো না। মাথার ভেতর ঘূর্ণায়মান চিন্তাগুলোকে এক ধাক্কায় সরিয়ে দিয়ে অনন্যার দিকে আবার তাকালো। অনন্যার গভীর ঘুমের শান্ত মুখে যেন এক অদ্ভুত মায়া লুকিয়ে আছে। কৌশিক আস্তে আস্তে একটু ঝুঁকে অনন্যার কপালের কাছে এল। ফুঁ দিয়ে কপালে পড়ে থাকা চুলগুলো সরিয়ে দিলো ধীরে।
মেয়েটা একটু নড়েচড়ে পাশ ফিরে গেলো। মুখে মৃদু স্বস্তি বোধ দেখা যাচ্ছে। কৌশিক দীর্ঘশ্বাস ফেলল। অনন্যা ঘুমের ঘোরে টেরও পেলো না যে, কেউ তাকে না ছুঁয়েও এতটা গভীরভাবে মনে বসিয়ে নিয়েছে।
কৌশিক ধীরে ধীরে সোজা হয়ে দাঁড়ালো। আর একবার অনন্যার দিকে তাকিয়ে নিজের র/ক্তে ভেজা পিঠের যন্ত্রণাকে উপেক্ষা করেই নীরবে রুম থেকে বেরিয়ে গেলো। তার পায়ের শব্দও অনন্যার ঘুম ভাঙানোর মতো সাহস পেল না।
•
অনন্যাকে আজও তামং ভার্সিটিতে দিয়ে গেছে। প্রফেসর লোকটার সাথে একবার কথা বলার সুযোগ হচ্ছে না বলে মনের ভেতরটা খুঁত খুঁত করছে অনন্যার। ক্লাসে এসে নোহারার হাস্যোজ্জ্বল মুখ ধরা দিলো চোখের সামনে। অনন্যা মন ভালো নেই বলে নোহারা কেনো খুশি অতোসব কথা জিজ্ঞেস করতে গেলো না। কিন্তু কিছু সময় পরেই বোঝা গেলো কেনো সে এতো খুশি! ইশতেহার কৌশিক মহাশয়ের ক্লাস! কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ কথা হচ্ছে, আজকে তার বাম হাতে ব্যান্ডেজ করা। বিষয়টা দেখেই বুকে চিনচিনে ব্যথা হলো অনন্যার। লোকটা কি গতকাল এক্সিডেন্ট করেছিল? ইশশ! সে তো কিছুই জানে না। অনন্যার মনটা খারাপ হয়ে গেলো হঠাৎ। ব্যান্ডেজের হাল দেখে বোঝা যাচ্ছে সে নিজে করেছে। নিশ্চয়ই অনেক ব্যথা পেয়েছে? স্যারের হাতে ব্যথার কারণ অনেকেই জানতে চেয়েছে কিন্তু সে বলেনি, এড়িয়ে গেছে।
স্যার আজকে হিস্ট্রি পড়াতে এসেছেন। কম্পিউটার সাইন্স ডিপার্টমেন্টে হিস্ট্রি কোর্স কার ভালো লাগে? কিন্তু আজ যেন সবার ভালো লাগছে। বেশ আগ্রহ সহকারে সবাই শুনে যাচ্ছে আইকে স্যারের কথা। তিনি বই অনুসারে পড়াচ্ছেন না।
কৌশিক স্যার বক্তৃতা শুরু করেছেন মধ্যযুগীয় ইতিহাসের বিশদ বিবরণ দিয়ে। অনন্যা প্রথম থেকেই বেশ মনোযোগ দিয়ে শুনছিলো। কিন্তু ধীরে ধীরে তার মন অন্যদিকে সরে যেতে লাগলো। কারণ সে খেয়াল করলো, স্যার সবার দিকে একবার করে তাকালেও তার দিকে একবারও তাকাননি। যেন তার অস্তিত্বই এই ক্লাসে নেই! মনে মনে ক্রোধে ফুটতে লাগলো অনন্যা। তার মনে পড়লো, এই লোকটা সেদিন কতটা কাছাকাছি এসেছিল, স্পর্শ করেছিল তাকে। ঠোঁট কামড়ে ধরার সেই মুহূর্তগুলো যেন আবারও তার চোখের সামনে ভেসে উঠলো। অথচ আজ এমন আচরণ করছে, যেন সেদিন কিছুই ঘটেনি! আসলেই কি ঘটেনি?
রাগে ফুঁসতে থাকা অনন্যা কল্পনায় স্যারকে চর, ঘুষি, এমনকি লাত্থিও মেরে ফেললো। কিন্তু তাতেও যেন ওর মনের জ্বালা কমলো না। নিজের রাগ সামলাতে না পেরে চুপিসারে মাথার চুল টেনে ধরলো।
বেশ অনেকক্ষণ পরে অনন্যা কৌশিকের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,
"নোহারা, তুই কি কখনো নীলচে চোখের মণি হঠাৎ জ্বলতে দেখেছিস?"
নোহারা অনন্যার পাশেই ছিল, খাতায় নোট করছিল। সে স্যারের দিকে তাকিয়েই সহজভাবে উত্তর দিলো,
"হ্যাঁ, দেখেছি।"
অনন্যার কণ্ঠে বিস্ময়,
"কার দেখেছিস? নাম কী তার?"
নোহারা মৃদু হেসে বললো,
"ইশতেহার কৌশিক স্যার।"
অনন্যা হতবাক হয়ে গেলো। তার মনে ধাক্কা লাগলো। তার মানে কী সে যা দেখেছিল তা সব সত্যি? নোহারাও দেখেছে কখনো? অনন্যা কিছুটা সন্দেহ নিয়ে বললো,
"কিন্তু স্যারের মণি তো আকাশি রঙের। নীল কখন দেখলি?"
নোহারা লজ্জায় মাথা নিচু করে মৃদু স্বরে বললো,
"আমি মাঝে মাঝে নীল ও দেখি।"
অনন্যার ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গেলো। তার চোখে প্রশ্ন আর ক্ষোভ মিলে মিশে থাকলো। হঠাৎ রাগ ও উঠলো। সে নোহারার মুখ ঘুরিয়ে নিজের দিকে এনে বললো,
"তুই স্যারকে এত গভীরভাবে দেখেছিস কেনো?"
নোহারা হেসে বললো,
"অনন্যা জান, শুধু আমি নই, আমাদের ক্লাসের সব মেয়েই স্যারকে গভীরভাবে দেখে। ওহ, একমাত্র তুই বাদে।"
অনন্যা নোহারার দিকে তাকিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বললো,
"স্যাররা... পিতার সমান হয়। তা~ছাড়া এভাবে স্যারের দিকে তাকিয়ে থাকলে নজর লাগবে ওনার। আর কখনো দেখবি না।"
অনন্যা নিজের কথায় নিজেই হতবাক হলো। পিতার সমান? সে নিজেই তো এই লোকটাকে বিয়ে করে বসে আছে।
.
.
.
চলবে..........................................................