নির্মোচন - পর্ব ৪০ - ফাবিয়াহ্ মমো - ধারাবাহিক গল্প


রহস্য সন্ধি ঝুট ঝামেলা নিয়ে মাথা খারাপের ইয়ত্তা নেই। যেকোনো সময় যেকোনো একটা ভয়ংকর দুর্যোগ নেমে আসার শঙ্কা আছে। তবু লাবিবের মনে হচ্ছে তাঁর বন্ধু সাঈদ অত্যন্ত জটিল কিছুই শীতল মাথায় লুকিয়ে বেড়াচ্ছে। ওর অন্তর্ভেদী দুটি চোখ স্বভাবসুলভ নিক্তিতে আজও বেশ শান্ত ও ঠাণ্ডা। মুখে ধারালো এক গাম্ভীর্য। চিন্তার ছোবলে আক্রান্ত হয়ে নীচের খয়েরি বর্ণ ঠোঁটে মাঝে মাঝে দাঁত বসিয়ে কিছু একটা ভাবনা কষে যাচ্ছে। ভ্রুঁ দুটোর মাঝখানে চিন্তার সুস্পষ্ট খাঁজ। যেন গোড়া থেকে ঢেলে আবারও ভাবনাটা আনমনে চিন্তা করে যাচ্ছে সে। লাবিব তার সামনে থাকা আয়তাকার ট্রে থেকে একমগ এসপ্রেসো আমেরিক্যানো কফিটা তুলে সেটা ঠোঁটের কাছে আনতে আনতে বলল, 

  - কী ভাবছিস দোস্ত? মুখের ভঙ্গি তো অন্যদিকে ইন্ডিকেট করছে। 

বন্ধুর প্রশ্ন শুনে টনক নড়তেই মুখ তুলে চাইল সাঈদ, 

  - কিছু না। 

কফিতে দুঠোঁট বসিয়ে ছোট্ট চুমুক সেরে লাবিব আবারও নাছোড় কণ্ঠে বলে উঠল, 

  - দোস্তো, তোর ভেতরে এখনো ওই কোয়ালিটি আসে নাই যে তুই লাবিব খন্দকারকে চকবাজার না চিনিয়ে চায়না চেনাতে যাবি। মুখ থেকে তালা খুলে পেটের কথা ছেড়ে বল। হাতের ওই নোটবুকে পেন্সিল দিয়ে কী লিখছিস? দেখা যেতে পারে? 

এবার অন্যপাশ থেকে মুখ তুলে মনোযোগ দিল সাব্বির। বর্তমানে তার হাতে তিন নাম্বার কাজু বরফির টুকরো। খেতে অত্যন্ত সুস্বাদু। বারবার জিভে জল চলে আসছে দেখে আবারও একখণ্ড কামড় বসিয়ে পুরোটা মিষ্টি মুখে পুড়ে নিয়ে বলল,

  - আদিবের ব্রিফটা শোনার পর এতোটা স্থির সিচুয়েশন আশা করিনি তোর থেকে। ভেবেছিলাম তোর বাপকে বলে কয়ে মেবি আর্মড গার্ড বসিয়ে দিবি। তুই ভাই এমন শার্প নার্ভ পাইলি কীভাবে এটাই চিন্তা করছি। আমি শিওর তুই সোয়াদ স্টাফের জেনেটিক সাইড থেকে এটা ভাগ্যক্রমে পাইছিস। 

হঠাৎ অনেক বছর পর নিজের বাবাকে “স্টাফ” সম্বোধন করতে শুনে শান্ত চোখদুটি একপলক সাব্বিবের দিকে ফেলল সে। ঠিক আনুমানিক কত বছর পর এই বিশেষ সম্বোধনটা দুকানে শুনতে পেল তা হিসেব করে নিচ্ছে মনে মনে। সে ওই দিনগুলোর কথা মৃত্যুর শেষ দম অবধি ভুলতে পারবে না হয়ত। হাতের নোটপ্যাডটার বুক থেকে পেন্সিল সরিয়ে সেটা বন্ধুদের দিকে বাড়িয়ে দিল। তার শূন্য বিছানাটায় এখন চার বন্ধু গোল আকারে বসা এবং মাঝে পাঁচ মগ কফির পানীয় রাজ্য বসিয়ে রেখেছে। কৌতুহলে টগবগ করা লাবিব এককাঠি বাড়তি উদ্যোগ দেখিয়ে নোটপ্যাডটা টেনে নিয়ে বাকিদেরও তা দেখাল। প্যাডের সাদা পৃষ্ঠায় পেন্সিলের ধূসর আঁচড়ে ইংরেজি বর্ণমালা বসানো—  

K R N .

K H A G R A C H H A R I . 
R O W A N G C H H A R I .
N A I K H O N G C H H A R I .

আর কিছু বলার প্রয়োজন পড়ল না লাবিব, ফাহাদ, আদিব ও সাবিব্বের। প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত দক্ষ নিপুণ ইন্সটিক্টে লাবিব ও বাকিরা ইতোমধ্যে বুঝে গেছে এই ফাজিলের ফাজিল চরম ফাজিল হিল ট্র‍্যাক নিয়ে বসে বসে ভাবছে। অথচ ব্যাটার বউ যে মহা মসিবতে পা ঢুকিয়ে আসন্ন বিপদের মুখোমুখি হতে যাচ্ছে সেটা নিয়ে কোনো চিন্তাই নেই। মুখটা তেঁতো করে লাবিব ওর পাষাণ চিত্ত বন্ধুকে মুখ ঝামটা মেরে বলল, 

  - তুই তো তোর বাপকেও ছাড়ায় গেছিস রে হারামির টিকটিকি! এতোদিন যে শুধু শুধু ওই জল্লাদ ব্যাটারে স্ট্রিক্টনেসের জন্য দোষারোপ করে আসছি . . আমারই শালা ভুল হইছে। দুই চোখ দিয়ে দেখতে পাচ্ছি সুয়ারেজ লাইনের পাইপ আঁটকে তুই হারামি নিশ্চিন্তে মুড়ি খাচ্ছিস। শরমও নাই। তোর টেনশন হচ্ছে না বউ নিয়ে? কী ধরণের ফ্যাসাদে পরে বসে আছে তোর ভয় নেই?  

বিকারহীন সাঈদ নিশ্চিন্ত ভঙ্গিতে কফি খেতে খেতে নিজের মোবাইলটাকে আবারও দুটো ম্যাসেজ বুঝিয়ে শান্ত করল। কিন্তু মনে হচ্ছে না ওই প্রান্তের ব্যক্তিটি এভাবে স্থির থাকবে। কফির মগে আরেকদফা চুমুক সেরে সাঈদ বলল,  

  - স্যার, টেনশন হলে যে পুরো ধানমন্ডি এরিয়া মাইকিং করে দিতে হবে এটা তো এই জুনায়েদ সাঈদ জানতো না। রিয়েলি স্যরি ফর দ্যাট। আর কথায় কথায় আপনার ওই স্টাফের কথা না তুললে ভালো হয়। মেজাজটা আমি খারাপ করতে চাইছি না। তাছাড়া আপনার মতো ডিফিএফআই ডেপ্টের দুর্দান্ত একজন অফিসার বন্ধু যেহেতু আমার কপালে জুটেছে, তখন তো মনে হয় না আমার বউয়ের সেইফটির জন্য বাড়তি কোনো টেনশন করা দরকার। সাব্বির স্যার? আপনিই বলুন, টেনশনের কোনো প্রয়োজন আছে? 

শেষ প্রশ্নটা যে সাব্বিবের জন্য করা হয়েছে তা বুঝতে পেরে ঠোঁটের কোণে ক্ষীণ হাসি ফুটাল সাব্বির। সেও কফিতে চুমুক দিতে দিতে লাবিবের দিকে চোখ স্থির করে দুই ভ্রুঁ নাচাতে নাচাতে বোঝাল, আলগা পিরিতি কেমন লাগে মামা? খোঁচা মারতে যেয়ে নিজের পায়েই ফোস্কা লাগিয়ে ফেললা। বাপের ঝাল ওর উপর দিয়ে তুলতে যাও কেন? চুলকায়? 

লাবিব ছোটো শ্বাস ছেড়ে বুঝতে পারল এরা জীবনে যত বড়ো বড়ো পর্যায়েই পৌঁছুক না কেন গা থেকে হা রা মি র তকমা জীবনেও এদের ঘুচবে না। এটা ঠিক যে সামরিক জীবনটা শুরুর সময় আর্মির মেজর র‍্যাংকিংয়ে থাকা সোয়াদ জাকির স্টাফ ভয়ংকর ভাবে ওদের উপর রোলার কোষ্টার চালিয়েছিল। আর সেটা চালিয়েছিল বলেই আজ এতদূর পর্যন্ত আসার কঠিন হিম্মত পেয়েছে ওরা। সেটা পিটাতে পিটাতে পশ্চাৎদিকের চামড়া অবশ করে দেওয়া হোক অথবা ভোল্টেজ পয়েন্টে নামিয়ে জোঁকের সাথে খাতির আপ্যয়ন করা সবই ছিল দুর্ধর্ষ ট্রেনিংয়ের কঠোরতম শিক্ষা। প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা মহাপরিদপ্তর সংক্ষেপে ডিজিএফআই [DGFI— Directorate General of Forces Intelligence] বাংলাদেশের প্রধান সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা, যার অবকাঠামো যাত্রা শুরু হয় ১৯৭৭ সালে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের তদরকিতে এবং সদর দপ্তর ঢাকা সেনানিবাস। সম্ভবত হেডকোয়ার্টারে একবার যেতে হতে পারে এ বিষয়ে আলাপ করার জন্য। কী ধরণের আদেশ আর কী রকম নির্দেশনা আসতে পারে সেটা ভেবেই অস্থির লাগছে একটু একটু। বন্ধুর বউ, তার উপর মেয়েটাকে তার ভীষণ আদুরে লাগে, ঠিক ছোট্ট একটা বোনের মতো সম্মান করা মেয়েটাকে কখনোই কানাগলিতে ছেড়ে দেওয়া যাবে না। লাবিব মুখ গম্ভীর করে কফিতে চুমুক দিতে দিতে ঠাণ্ডা মস্তিষ্কে সাদা নোটপ্যাডের অক্ষরগুলো পরোখ করতে লাগে। এ সবগুলো নাম বাংলাদেশের পর্যটন ক্ষেত্রে অবাধ বিস্তারে ভূমিকা রাখে, সেই সঙ্গে ভূমিকা রাখে অপ্রকাশ্য এক লোমহর্ষক গোপন সত্যও, যা জনগণের কাছে আলোচনা করা জাতীয় নিরাপত্তার খাতিরে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এমন সময় ফোনের স্ক্রিন থেকে মুখ তুলে ফাহাদ এক পিস কাজু বরফি তুলে বলল, 

  - মামারা, আমার মনে হচ্ছে বেরুতে হবে। সিএমএইচ থেকে ডাক এসেছে। ইমার্জেন্সী কেস। 

বেশ তাড়াহুড়ো একটা ভাব ফুটে উঠল ফাহাদের নম্র মুখটির চোখের মণিতে। জিভে জড়ানো মিষ্টিটায় দ্রুত দাঁত চালিয়ে ঝটপট ট্রে থেকে পানির গ্লাসটা তুলে নিতেই ডানপাশ থেকে আদিব শয়তানি হাসি দিয়ে বলল,

  - মামা না বললা তোমার আজকে হাসপিটালে ছুটি চলে? পুকুত করে ছুটির ঘণ্টাটা কোথায় হারিয়ে গেল? নাকি অ্যাসিসটেন্ট ওই সুন্দরীটা . . কী যেন নাম . .

সিরিয়াস মূহুর্তে এমন একটা সস্তা ফাজলামি করতে দেখে ফাহাদ খেপাটে মুখে খেকিয়ে উঠল, 

  - ধুর ব্যাটা, তুই আছস রঙের মধ্যে! আমার অবস্থা কী তোদের মতো শান্তিপূর্ণ ভাবোস? হসপিটালে ইমার্জেন্সীতে হেলিকপ্টার যোগে পেশেন্ট আসতেছে। এক্ষুণি বের হওয়া লাগবে। আমি যাই। পরে তোদের সাথে মিট করতেছি। থাক। 

ফাহাদ আর একমিনিটও সেখানে বসে থাকল না। গ্লাসের পানিটাও সে এক চুমুকের বেশি খেয়ে যেতে পারেনি। দায়িত্বের জায়গা থেকে কর্ম তৎপরতার জন্য তাকে বন্ধুদের সাথে আনন্দময় আড্ডাটাও বিসর্জন দিয়ে ছুটতে হচ্ছে। ছুটতে হচ্ছে হাতে গ্লাভস, মুখে মাষ্ক, সার্জিক্যাল একটা গুরুত্বপূর্ণ কেসে যুক্ত হবার জন্য। তার কাছে মানুষের জীবন বাঁচানোর মূল্য নিজের এমন শত শত আনন্দময় আড্ডার চাইতে লক্ষগুণ বেশি। একটু পর রুমের খোলা জানালা দিয়ে গাড়ি ছুটে যাওয়ার শব্দটা শুনে মুচকি হাসলো আদিব। বুকভরা প্রশান্তির একটা দম ছেড়ে বাকিদের দিকে তাকিয়ে বলল, 

  - ওরে দেখলে না আমার কলিজাটা একেবারে ঠাণ্ডা হয়ে যায়। আমি সিরিয়াসলি চাই এবার যেন ইউ এন মিশনে যাওয়ার জন্য ফাহাদ সিলেক্টেড হোক। ওর কাজের মাধ্যমে বাংলাদেশের নামটা এতোই উঁচু পর্যায়ে পৌঁছুক যে, বাইরের বড়ো বড়ো দেশগুলো যেন ওর নাম উচ্চারণ করার সুযোগ পায়। ওর মতো পরিশ্রম মনেহয় আমিও এতদূর করিনি। 

আদিবের ওমন সরল ঝরঝরে অমায়িক স্বীকারোক্তি শুনে মনটা তুলোর মতো নরম হয়ে যায় সবার। ওরা জানে ফাহাদ ঠিক কতটা কষ্ট করে আজ এতদূর আসার মতো যোগ্যতা অর্জন করেছে। এ যোগ্যতা তার জন্য একটুও সহজ ছিল না। বাবা নেই। বিধবা মা ও বড়ো বড়ো তিনটে বোন। মাত্র তেরো বছর বয়সে বাবা হারানো ওই ছোট্ট মুখটি সেদিনই বোধহয় কঠিন বাস্তবতার দেখা পেয়েছিল। দুটো নাজুক নাজুক কাঁধে মা সহ তিনটে অবিবাহিত বোনের ভার তোলাটা একটুও সহজ ছিল না তার পক্ষে। মুখ বুজে নেওয়া অসংখ্য চাপাকষ্ট বুকের পাঁজরে আবদ্ধ করে আজ সে এসেছে এতদূর . . এতখানি পথ . . এতটা সম্মান অর্জন করা “মেজর” র‍্যাংকিং থেকে একজন মিলিটারী মেডিক্যাল অফিসার। তার দুচোখ ভরা স্বপ্ন জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী মিশনে “বাংলাদেশ মেডিক্যাল কন্টিনজেন্ট” তথা সমগ্র বিশ্বে সুনাম অর্জন করা “ব্যানমেড” টিমে সে কাজ করবে। মানুষের জন্য অকাতরে সেবা করবে তার সমাজপ্রেমি মন। এমন একটি স্বপ্ন যেন পূরণ হোক মেজর ফাহাদের। খুব দ্রুত পূরণ হোক। সাঈদ মনে মনে অজস্র শব্দ বুনে সৃষ্টিকর্তার নিকট বোধহয় নীরব আর্জি জানিয়ে দিল।

••••••••••••

ডাক্তারের কাছ থেকে সমস্ত রিপোর্ট দেখিয়ে প্রেসক্রাইব করা ঔষুধ কিনে বাড়ি ফিরছিল ফিহা। আফসানার মতো বিদুষী, রসিকপ্রবণ একজন নারী যদি সফর সঙ্গী হয়, তবে মনে হয় না যাত্রা পথে অসুবিধে হবার কথা। তবে আফসানার একটা কথা শুনে ফিহা এখন গভীর দুশ্চিন্তার ভেতর মুখ বন্ধ করে আছে। 

  - বুড়ি, তুই একটা ব্যাপারে একটু খেয়াল রাখিস তো। সাঈদ ওর গ্যারেজের ভেতরে আসলে করেটা কী . . মানে গান টান কিছু গায় নাকি এটা তুই খোঁজ নিয়ে দেখিস। আমার তো এখনো বিশ্বাস হয় না ও যে সেদিন দীপের অনুরোধে প্যান্ডেলে উঠে গান গেয়েছে। 

ফিহাও নিজের ভেতর থেকে বউ বউ দ্বিধাটা সাইডে ফেলে খালাকে এখন খালারূপেই চিন্তা করে বলল, 

  - গ্যারেজের ভেতরে গান বাজানোর কথা না খালামণি। সেখানে গিটারের শব্দ হলে তুমি তো শুনতে। তাছাড়া আমার কাছে মনে হয়েছে ওটা খালি। একদিন তুমি অফিস যাওয়ার পর আমি ওই গ্যারেজের আশেপাশে গিয়েছিলাম। কিন্তু তুমি যেমনটা সন্দেহ করছ ওরকমটা কিছু চোখে পড়েনি। 

  - আরে পাগলী, ওই বদটা গ্যারেজের ভেতর শব্দ নিরোধক পদ্ধতি বসিয়ে রেখেছে। যার জন্য কোনো শব্দ বাইরে আসে না। তুই শুধু ওই বদটার গ্যারেজে ঢুকে ঝাপসার মতো ঢুঁ দিয়ে আসবি। এটুকুই করবি। পারবি না তুই? 

নিজের আপন খালাকে ডাকাতের মতো নির্দেশ দিতে দেখে চোখ ছোটো ছোটো করে চাইল ফিহা। ভাবটা এমন যেন রাজার নিষিদ্ধ কোষাগারে চুরি করে ঢোকার জন্য স্বয়ং রাজমাতা রাজরাণীকে শয়তানি বুদ্ধি এঁটে প্লেটে বেড়ে এগিয়ে দিচ্ছে। ফিহা মনে মনে প্লেটটা ধাক্কা দিয়ে দূরে সরিয়ে সরাসরি রাজমাতাকে বিজ্ঞ স্বরে বলল, 

  - তুমি আমাকে আগুনের মুখে ধাক্কা দিয়ে ভালো করছ না খালামণি। 

নিজের চোরা উদ্দেশ্যে ঠাস করে ধরা খেতেই আমতা আমতা করতে লাগলেন আফসানা, 

  - ইয়ে . . বুড়ি, তুই যেমনটা ভাবছিস ব্যাপারটা ওরকম না। আমি তো তোকে এমনি এমনিই কথাগুলো বলেছি। তোকে কী আর ওইসব চোরা জিনিসের জন্য কাজ করতে বলব? কী যে ভাবিস না তুই। তুই শুধু খালি খালি একটা ঢুঁ মারবি। খালি খালি ঢুঁ দিলে তো সমস্যা হওয়ার কথা না। তাছাড়া আমি থাকি অফিসের কাজে বাইরে। আমার এসব দেখার সময় কোথায় বল? 

রঙচঙ মাখানো বুলি শুনে হাপিত্যেশ ভঙ্গিতে দম ছাড়ে নাবিলা হক। বেচারা খালামণি তো জানেই তো তাঁর বিশিষ্ট রগচটা পুত্র চিতাবাঘের মতো নিঃশব্দ গতিতে হাঁটে। কখন কোন ফাঁক দিয়ে কলিজা কাঁপাতে চলে আসে তা তো বলা দুঃসাধ্য! হঠাৎ হাতের মুঠোয় থাকা যন্ত্রচালিত বস্তুটা আলো জ্বেলে মৃদু কেঁপে উঠে থামল। নোটিফিকেশন কি এসেছে? স্ক্রিনের উপর বৃদ্ধাঙুলে বার দুয়েক ট্যাপ করতেই ছোট্ট ভয়েস ম্যাসেজটা দেখতে পেল সে। চোখের ডানকোণ দিয়ে আফসানাকে গুরুত্বপূর্ণ একটা ফোনকলে ব্যস্ত দেখে ফিহা এই ফাঁকে ভয়েস ম্যাসেজটা অন করে বাঁদিকের কানে চাপলো। ঢিপঢিপ করে ওর ছোট্ট বুকটার ভেতর হৃৎপিণ্ড কাঁপছে, গায়ের ভাঁজে ভাঁজে ঠাণ্ডা শিরশিরে রোমান্ঞ্চকর অনুভব, শুকনো খরখরে গলায় ঢোক গিলে হৃৎস্পন্দন আঁটকে শুনল— “শুনুন, আমি একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজে বাইরে যাচ্ছি। কখন ফিরব বলতে পারছি না। হয়ত আমার ফিরতে গভীর রাত হতে পারে। আপনি খাবার খেয়ে মেডিসিন নিয়ে ঘুমিয়ে পড়বেন। আর . . ”

এটুকু বলে গম্ভীর কণ্ঠটা থামতেই ফিহা দম আঁটকে চোখ কুঁচকে কেমন অস্থিরপ্রবণ অবস্থার ভেতর জবুথবু হয়ে রইল। ও জানে এরপরের বাক্যটুকু হবে ওর হৃৎপিণ্ড কাঁপানো ভয়ংকর কোনো কথা— “আর . . আপনার কাজু বরফিটা ভাল ছিল। কাজুবাদাম যে আমার পছন্দ, এটা জানেন দেখে অবাক হয়েছি। তবে আপনি জানেন, আমি কোন মিষ্টিটা বেশি পছন্দ করি। রাত জেগে অপেক্ষা করতে হবে না। স্লিপ টাইট ওয়াইফ। রাখছি।” 

খিঁচে রাখা চোখদুটি স্বাভাবিক করে বুকের অবাধ্য অস্থির নিঃশ্বাসটা আস্তে করে ছেড়ে দেয় ফিহা। পিঠের ব্যথাটা উপেক্ষা করে গা এলিয়ে দেয় সীটের সাথে। কান থেকে আস্তে আস্তে ফোনটা নামিয়ে নিলেও বিবশ মনটা জানালার বাইরে রাস্তার ল্যাপপোস্টে ফেলে রাখে। তুষার শুভ্র স্তুপের মতো শীতল অনুভব করছে মানস নিকেত। এইটুকু নারাজও যে ওই লোকটার উপর বেশিক্ষণ টিকল না . . সে কী জানে কী কী শব্দ ব্যবহার করলে ওর নরম মনটা মোমের মতো গলে যাবে? দূর থেকে কী করে গাল ছুঁয়ে ছুঁয়ে বলার মতো আদর দিয়ে বলতে হয়, জানে সে? 

•••••••••••

ঢাকার ওয়ারী এলাকায় ছোট্ট একটি রেস্তোরাঁর সামনে জনা দুজন লোক দাঁড়িয়ে আছে। পড়ণের পোশাক আশাক সাদাসিধে এবং পরিচ্ছন্ন শার্ট প্যান্ট। একজনের হাতে রেস্তোরাঁ থেকে খাবার পার্সেল করা একটি ব্যাগ। অন্যজন বাঁ কানে ফোন এঁটে জোরে জোরে মাতব্বরি কণ্ঠে কথা বলছে। রাস্তায় তুলনামূলক মানুষ আজ কম। কুয়াশায় মুড়োনো ধোঁয়াটে চাদরে পথঘাট ঝাপসা হয়ে একটা অলৌকিক জগতের মতো রহস্যময় লাগছে। হঠাৎ আধো আধো কুয়াশা ফুঁড়ে শাঁই করে ছুটে এলো একটি গাঢ় নীল গাড়ি। রাস্তার পাশে কয়েক মিনিটের জন্য থামতেই খাবার পার্সেল করা লোকটা গাড়িটার উলটো পাশে, ঠিক ময়লা আবর্জনা ফেলা পচাঁ দুর্গন্ধময় জায়গাটার কাছে ওই ব্যাগটা রেখে চুপচাপ পালিয়ে গেল। অন্যদিকে মাতব্বরি স্বরে ফোনে কথা বলতে থাকা লোকটা একবার গাড়িটির নজর বুলিয়ে মনে মনে খুশি হল বোধহয়। ব্যাগটা পৌঁছে দিলেই রাতারাতি আকাশের চাঁদ হাতে পেয়ে যাবে। কানের ফোনটা তখনো ধরে রেখে এগিয়ে এসে তাড়াতাড়ি ব্যাগটার দিকে হাত বাড়াতেই অদ্ভুত ভোঁতা শব্দ হলো একটা! চকিতে ঠাস করে ছিঁটকে পড়ল হাতের ফোন। চুরমার হয়ে পার্টে পার্টে তিনখণ্ড হয়ে ছিঁটকালো ফোনটা! লোকটা দেখল তার বুক বেয়ে ঠাণ্ডা স্যাতস্যাত স্রোত নেমে যাচ্ছে। গলগল করে ছুটছে প্রবল স্রোত। দুচোখ তার ঘোলা . . . 
.
.
.
চলবে....................................................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

WhatsApp