জুবরানে'র কথায় থতমত খেল অগ্নিলা।তারমানে ছেলে'টা ঠিক সুর শুনে নিয়েছে।মুখের আদল দেখে বোঝার উপায় নেই বিরক্ত হয়েছে কিনা!বার কয়েক চোখের পাতা ঝাপটে নিয়ে বলল সে,
"না তো!আমি ওসব বাজাতে জানি না।কেন বলুন তো?
সারারুম জুড়ে শুভ্র মেঘের ছড়াছড়ি!কিয়ৎক্ষণ অগ্নিলার পানে তাকিয়ে থেকে ফের বেলকনিতে চলে গেল জুবরান।ঘুমের ঘোরে বাস্তবতা'কে এতটা সুক্ষ্ম ভাবে অনুভব করা যায়?নাকি আজকাল সুকন্ঠী কে নিয়ে একটু বেশি'ই ভাবছে সে?একেবারে কাছ থেকে অস্তিত্ব অনুভব করার মতো!অপরিচিতা কে নিয়ে এতটা ভাবা কি আদৌ উচিৎ?কেবল সুর ছাড়া আর কিছু'ই জানা নেই তাঁর সম্পর্কে।খানিক মাথা চুলকে শুয়ে পরলো জুবরান।মাথা থেকে অহেতুক চিন্তা ঝেড়ে ফেলতে হবে।অনিশ্চিত কিছু নিয়ে ভাবার কোনো মানে হয় না।
◼️
খাটে বসে হাঁটুতে মাথা রেখে কাঁদছে রুহি।কান্নার জল তার গালের সাথে লেপ্টে শুকিয়ে গেছে।পাত্রপক্ষ প্রথম দেখাতে'ই বিয়ের দিনক্ষণ ঠিক করে যাবে ভাবতে পারেনি।তারউপর বিয়ে'র একমাস বাদে'ই ইউরোপে পাড়ি জমাতে হবে তাকে।এখানে মা ছাড়া তো কেউ নেই রুহি'র।যৌথ পরিবারে বসবাস।তাদের দুজনের খরচাপাতি দেয় বাকি দুই চাচ্চু।সেজন্য মা'কে কখনো উঁচু গলায় কথাও বলতে দেখেনি।সে এখানে না থাকলে মায়ের দুশ্চিন্তায় একটা দিনও ভাল কাটবে না।ইচ্ছে ছিল পড়াশোনা শেষ করে চাকরি করবে।নিজের মাকে নিয়ে একাই থাকবে।স্বাধীনভাবে ঘুরবে।কথাগুলো ভাবতে ভাবতে আবারো ফুপিয়ে কেঁদে উঠলো।দরজা খানিক ঠেলে ঘরে প্রবেশ করলো রাজিয়া।মনমরা মেয়ের মুখশ্রী দেখে বুকের ভেতর চিনচিন করে উঠলো তার।এমুহূর্তে রুহির মনে কি চলছে বেশ ভাল করে'ই জানেন।সারাজীবন তো আর বেঁচে থাকবেন না তিনি।মেয়েরও ভবিষ্যতে আছে।শিক্ষিত ছেলে।ভাল জব করে।ইউরোপে সেটেল্ড!বিয়ের পর অন্তত এই বাড়ি'তে এসে মেয়ে আর জামাই'কে কটু কথা শুনতে হবে না।দূর প্রবাসে পড়ে থাকলেও ঢের ভাল।যত লাঞ্চনা রাজিয়া সহ্য করুক।মেয়ের মাথায় হাত রাখতে'ই চমকে তাকাল রুহি।পাশেই খাটে বসলো রাজিয়া।মা'য়ের কোলে মাথা রেখে চুপটি করে শুয়ে কম্পিত স্বরে বলল রুহি,
"তোমার ঋণ আমি কোনোদিন শোধ করতে পারবো না মা।বাবার মৃত্যুর পর তুমি শুধু আমার কথা ভেবে একাকি এখানে পরে আছো এতবছর ধরে!সেই আমি কিনা নির্দয়,স্বার্থপরের মতো তোমাকে ফেলে চলে যাব?এই বিয়েতে তুমি কেন রাজি হলে মা?তোমাকে ছেড়ে আমি কোথাও যাব না।
মেয়ে'র মাথায় হাত বুলিয়ে নিয়ে ভেজা গলায় বললেন রাজিয়া বেগম,
" আমি তোর ভাল চাইতে'ই রাজি হয়েছি রে মা।ছেলেটা'র কথাবার্তা শুনে মনে হয়েছে খুব ভদ্র আর অমায়িক।তা ছাড়া তোর তো ঘুরে বেড়ানোর শখ।দেশের বাইরেটাও ঘুরতে পারবি।ইচ্ছে,শখ পূরণ হবে।
চাপা স্বরে বলল রুহি,
"তুমি আমার সবচেয়ে বেশি শখের,ভালবাসার।আর কিচ্ছু চাই না।এ বিয়েটা তুমি ভেঙ্গে দাও মা।
মেয়ের পাগলামি'কে অগ্রাহ্য করে বললেন রাজিয়া বেগম,
"তুই কতদিন আর আমাকে দেখেশুনে রাখবি?বড়োজোর চার,পাঁচবছর!তারপর বিয়ে তো করতে'ই হবে।কিন্তু ভাল সম্মন্ধ বার বার আসে না।আমার মন বলছে এখানে বিয়ে করলে তুই অনেক সুখি হবি।
পাল্টা আর কিছু বলতে পারলো না রুহি।নীরবে চোখের জল ফেলল।এই মুহূর্তে জুবরান ভাইয়া বাড়ি'তে থাকলে সমস্যার একটা সমাধান হতো।
•••••••••••••
সকালেই কংলাক যাওয়ার উদ্দেশ্য সবে সিএনজি নিয়েছিল জুবরান।তারমাঝে'ই মায়ের ফোন আর জরুরি তলব।আজকেই ঢাকা ফিরতে হবে।রুহি'র বিয়ে ঠিক হয়েছে।কথা'টা শুনে বেশ ধাক্কা লাগলো জুবরানে'র।এত তাড়াতাড়ি হুট করে'ই রুহি'র বিয়ে ঠিক হবে অকল্পনীয় ছিল!বিপত্তি ঘটেছে অগ্নিলা'কে নিয়ে।মেয়েটা তো এখানকার কিছু'ই চেনে না।একা রেখে যেতেও মন সায় দিবে না।দূরে জুবরান'কে হতভম্ব হয়ে দাড়িয়ে থাকতে দেখলো অগ্নিলা।মনে হচ্ছে গভীর কোনো চিন্তায় মগ্ন সে।কয়েক পা ফেলে এগিয়ে এসে ব্যস্ত গলায় বলল জুবরান,
" আমাকে এক্ষুনি ঢাকায় ফিরতে হবে।আপনার বাড়ির ঠিকানাটা যদি দিতেন তাহলে পৌছে দিতাম।
কয়েক সেকেন্ড চুপ থেকে বলল অগ্নিলা,
"প্রয়োজন নেই।আপনি চলে যেতে পারেন।আমি যেহেতু ঘোরার উদ্দেশ্য নিয়ে এসেছি,সম্পূর্ণ সাজেক দেখে তবে'ই ফিরবো।
অগ্নিলার শক্তকথা শুনে বেশ চমকাল জুবরান।একটু আগে অবধিও বেশ নমনীয় ছিল!নাকি নিজের দূর্বলতা'কে চাপা দিতে চাইছে মেয়ে'টা?তীর্যক দৃষ্টি ফেলে বলল সে,
" আচ্ছা!বেশ সাহসী আপনি।মানে আমি খামোখা একদিন ধরে গাইড দিচ্ছি আপনাকে!ঠিক আছে ভাল থাকবেন মিস।
কথাটুকু বলে'ই পাশে সিএনজি'র সাথে কথা বলতে চলে গেলে জুবরান।অগ্নিলা হতভম্ব!মানে এত সহজে ছেলেটা তাকে নিঃসঙ্গ করে চলে যাবে ভাবতে পারেনি!অবশ্য একদিক থেকে ভালো'ই হয়েছে।যদি জোরপূর্বক ঠিকানা চেয়ে পৌছে দিতে চাইতো লোকটা?তখন দেবার মতো কোনো উত্তর থাকতো না তাঁর কাছে।দীর্ঘশ্বাস ফেলে দূরে দৃষ্টি রাখলো।আকাশে মেঘ ভেসে যাচ্ছে!কতটা কাছে!অথচ ছুঁয়ে দিতে গেলে নেই!হাওয়াই মিঠায়ে'র চেয়েও হালকা!ইচ্ছে ছিল আরো দু'টো দিন মেঘপল্লী'তে থাকার।জুবরান চলে গেলে সেও চলে যাবে।তবে নিজ শহরে ফেরা যাবে না কোনোমতে।আবারও রুহি'র সাহায্য নিতে হবে তাকে।জুবরান চলন্ত সিএনজি থেকে ডাকলো অগ্নিলা'কে।ভাবনার ঘোর কাটতে'ই চাইল সে।হাত নেড়ে বিদায় জানাল জুবরান।ছোট্ট একটুখানি হাঁসি ফিরিয়ে দিল অগ্নিলা।ততক্ষণে অনেকটা দূর চলে গেল গাড়ি।আশপাশ তাকিয়ে মস্তবড়ো একটা গাছের ছায়াতলে বসলো অগ্নিলা।কতদিন যাবৎ পেজে গান পোস্ট করে না সে।অবশ্য তার এই খালি গলার গান মানুষ এতটা কেন পছন্দ করে জানা নেই।ফোন চালু করতে ভয় করছে ভীষণ।এতকিছু ভাবলে চলবে না এখন।এই মুহূর্তে মন ভাল করতে একটুখানি গান গাইতে'ই হবে তাঁকে।জুবরান চলে যাওয়া'তে হুট করে'ই মনটা খারাপ হয়ে গেছে কেমন।বাড়ি'র কথা আরো বেশি করে মনে পরছে!একরাশ মন খারাপ নিয়ে সুর তুলল সে,
‘পথ হারাবো বলে'ই এবার পথে নেমেছি,
সোজা পথের ধাঁধায় আমি অনেক ধেঁধেছি।
নিষেধের পাহারাতে ছিলেম রেখে ঢেকে,
সে কখন গেছে ফিরে আমায় ডেকে ডেকে...
নয়ন মেলে পাবার আশায় অনেক কেঁদেছি।
এই নয়নে পাবো বলেই নয়ন মুদেছি,
সোজা পথের ধাঁধায় আমি অনেক ধেঁধেছি।
পথ হারাবো বলে'ই এবার পথে নেমেছি।
গান গাওয়া শেষ হতে'ই পেজে পোস্ট করে দিয়ে পুনরায় ফোন বন্ধ করে দিল অগ্নিলা।ভেতর'টা একটু ফাঁকা,শান্তি লাগছে এখন।তবে মাথা থেকে চিন্তা নামছে'ই না।আচ্ছা সে যদি ঢাকায় গিয়ে কোনো একটা কাজের ব্যবস্থা করে নেয়,তাহলে তো মামি'কে নিয়ে চলে যেতে পারবে!ওই নরকে আর থাকতে হবে না তাদের।অন্তত বাকি জীবনটুকু শান্তি'তে শ্বাস নিয়ে বাঁচা যাবে!কিন্তু কে দেবে তাঁকে ঠাঁই আর কাজের সন্ধান?ভাবনা যত সহজ বাস্তব তারচেয়ে দ্বিগুণ কঠিন!রুহি সামান্য নিজের বাড়ি'তেই একটুখানি জায়গা দিল না।সেখানে এসব আকাশকুসুম চিন্তা করা বিলাসিতা ছাড়া কিছু'ই না।
"অনেক'টা পথ চলে গিয়েছিলাম জানেন।আবার ফিরতে হলো।তখন যদি কথা মতো আমার সাথে চলে যেতেন,তাহলে অযথা এই কষ্টটুকু আমার হতো না মিস!
চিরচেনা ভরাট পুরুষালি কন্ঠস্বর পেয়ে চমকে পাশ ফিরে তাকাল অগ্নিলা!জুবরান দাঁড়িয়ে আছে।সে কি সত্যি'ই চলে এলো?জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে উঠে দাঁড়াল অগ্নিলা।পাল্টা আর কিছু বলল না জুবরান।নিজের হাতে থাকা সেলফোন বাড়িয়ে ধরলো অগ্নিলার সামনে।কিছুই বুঝতে পারলো না অগ্নিলা।স্থবির দাঁড়িয়ে রইল কেবল।কপালে ঈষৎ ভাজ ফেলে বলল জুবরান,
" রুহি কথা বলবে।ধরুন?
তৎক্ষনাৎ ফোন হাতে নিয়ে কানে জড়াল অগ্নিলা।ওপাশ থেকে বলল রুহি,
"আসলে হুট করে'ই আমার বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে অগ্নিলা।সেজন্য ভাইয়া ঢাকায় চলে আসতেছে।তুমিও চলে আসো তাঁর সাথে।আসলে কালকে হুট করে তোমাকে বাড়ি'তে নিয়ে আসিনি কারণ আমরা যৌথ পরিবারে থাকি।অনেক প্রশ্নে'র সম্মুখীন হতে হতো।তুমি প্লিজ কষ্ট পেয়ো না।এখন বিয়ে উপলক্ষে সপ্তাহ খানেক থাকতে পারবে।আমার বন্ধু'র পরিচয়ে।
অগ্নিলা নিশ্চুপ শুনলো রুহি'র কথা।যাওয়ার একটা পথ তৈরি হয়েছে তবে!কৃতজ্ঞতা'য় চোখ ভিজে উঠলো তাঁর।আমরা যখন মনে করি সব শেষ,তখন একটা না একটা উপায় ঠিক বের হয়।হাঁসিমুখে রুহি'কে বিয়ের আগাম অভিনন্দন জানাল অগ্নিলা।সে অবশ্যই যাবে বলল।সম্মুখে দাঁড়িয়ে অগ্নিলার হাসিমুখ'টা দেখছিল জুবরান।আচমকাই মেয়ে'টা রুহি'র বিয়ের খবর পেয়ে এতটা কেন খুশি হয়ে গেল বুঝতে পারলো না।বান্ধবী হিসেবে তার তো কষ্ট পাবার কথা ছিল!যাইহোক এতকিছু ভাবলে এখন চলবে না।তাঁকে আবারো এই অপরিচিতা ললনার বডিগার্ড হতে হবে!
◼️
ঘড়ি'তে রাত নয়টা বাজছে।রান্নাবান্নার আয়োজনে ব্যস্ত বাড়ির তিন বউ।কদিন পরে'ই রুহি'র বিয়ে।হিসেব মতো বাড়ি'তে প্রথম বিয়ে।মহা ধুমধামে করবেন আশফাক আহমেদ।যেন লোকে বলতে না পারে, পিতৃহীন মেয়ে'টাকে কোনোমতে বিদেয় করেছে চাচারা।কিছু লোকের কাজ'ই খুঁজে খুঁজে দূর্বল জায়গাগুলো বের করে আঘাত করা!কলিং বেল বাজছে মিনিট এক হবে।তরকারি কাটা রেখে উঠে চলে গেল তানিয়া।বাড়ি'তে সবাই'ই উপস্থিত আছে।তবে এই সময় কে এলো?ভাবতে ভাবতে দরজা খুলে দিল সে।জুবরান দাঁড়িয়ে আছে।তার পাশে যুবতী বয়সী এক মেয়ে।বেশ সাদামাটা জামাকাপড়।কাঁধে ব্যাগ।কেমন জড়তা ভাব মুখ জুড়ে!বেশ ক্লান্ত দেখতে লাগছে জুবরান'কে।চোয়াল আপনাআপনি হা হয়ে গেল তানিয়ার!সবে পাশ কাটিয়ে ভেতরে পা বাড়াল জুবরান।চেঁচিয়ে উঠে বলল তানিয়া,
"সর্বনাশ!জুবরান বিয়ে করে বউ নিয়ে চলে এসেছে ভাবী!মানে কি শুরু হয়েছে এই বাড়িতে?
.
.
.
চলবে.................................................................