প্রাণোদাহ - পর্ব ১৪ - নবনীতা শেখ - ধারাবাহিক গল্প


-“নতুন কেউ এসেছে?”

নক্ষত্র ওপর নিচ একবার মাথা নেড়ে বলল,
-“হ্যাঁ।”

অতসীর হাসি ভয়াবহ করুণ শোনাল। হাসতে হাসতে চোখের কোণে জল চলে এলো, গলার আওয়াজে শোনা গেল নিজের প্রতি ভীষণ চাপা ক্ষোভ,
-“তুমি আমার সবক্ষেত্রেই কী বিচ্ছিরি এক ভুল, নক্ষত্র! তোমার জন্য আত্মসম্মানের অবশিষ্টাংশও আমি আজ হারালাম। অতিশোকে লোকে নাকি পাথর হয়ে যায়, আর আমার হাসিই থামছে না। আহ নক্ষত্র, তুমি আমার এ কী দশা করে ছাড়লে!” 

নক্ষত্র অনুতপ্ত হলো। নতমুখী হয়ে অতসীর ঠিক পাশে বসে রইল। অতসী দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলল। ভুলক্রমেও আর তাকাল না নক্ষত্রের দিকে। 

নক্ষত্র প্রসঙ্গ পালটাতে বলল,
-“তোমার বাংলা অনেক বেটার হয়েছে।”
-“হ্যাঁ, জানি। প্রাক্টিস করছি যে।”
-“হঠাৎ বাংলায় আগ্রহ?”
-“আমার প্রতি যেই মানুষটার চরম আগ্রহ, তার আবার বাংলায় আগ্রহ। তাই আর কী।”

নক্ষত্র বার বার অপ্রস্তুত হচ্ছে। অতসী বলল,
-“তোমার গ্র‍্যাজুয়েশন শেষ হয়নি?”
-“উঁহু। এক্সাম চলছে।”
-“কোন ইউনিভার্সিটিতে আছো?”
-“নর্থসাউথে।”
-“সাবজেক্ট?”
-“ফিজিক্স।”

অতসী কিঞ্চিৎ বিস্ময় নিয়ে এবার জানতে চাইল,
-“তোমার না বুয়েটে হয়েছিল?”
-“হ্যাঁ।”
-“পড়োনি কেন?”
-“আত্মগ্লানিতে।”
-“আত্মগ্লানি?”
-“কাইন্ড অভ শেইমনেস, নিজের প্রতি।”
-“আমি জানি গাঁধা, আত্মগ্লানির অর্থ। আমি এটার কারণ জানতে চাইছি।”
-“কোনো কারণ নেই।”
-“কোনো কারণ না থাকলে মানুষ স্বপ্নপূরণের সুযোগ পেয়েও ছেড়ে দেয় না। তুমি কত পরিশ্রম করেছ, কেউ না জানলেও আমি জানি, আমি দেখেছি। এসব ভংচং তুমি আমাকে বোঝাতে এসো না।”

নক্ষত্র প্রসঙ্গক্রমে এক খণ্ড হাসল,
-“আমার ফ্রেন্ড হবে, অতসী?”

অতসী স্বস্তি পেল,
-“কেন নয়? ইউ আর মাই টাইপ..”

এটুকু বলার পর দুইজনেই হাসল। মনে পড়ে গেল অতীত, চোখের সামনে ভেসে উঠল ছয় বছর আগের সেই সংঘর্ষ। আঠারো-উনিশের দ্বারে দাঁড়িয়ে, অনুভূতিহীন দুই হৃদয় একে-অন্যের সাথে জড়াতে উন্মুখ হয়েছিল। সেই হৃদয় দুটো ঠিক ক'টা মাস পর থেকেই একে-অন্যের বিপরীত রাস্তা বেছে নিল। আজ তারা দুইজন ঠিক বিপরীত শীর্ষে, মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বন্ধুদের প্রস্তাবনা রাখছে। 

________

প্রীতির সাথে নক্ষত্রের দেখা হলো পরদিন সন্ধ্যায়। নক্ষত্র পড়াতে এসেছে। আগামীকাল এক্সাম আছে, অথচ সে এখন প্রীতির বাসায়। কারণ মেয়েটাকে না দেখে সে স্বস্তিতে পড়তে পারবে না। পড়াশোনা ভালো ভবিষ্যতের জন্য প্রয়োজন, তবে ভালো ভবিষ্যতের জন্য একমাত্র প্রয়োজনীয়তা কেবল পড়াশোনাই নয়। এরও অধিক গুরুত্ব রাখে প্রীতিলতা।

সে চোখ তুলে তাকাল প্রীতির দিকে। মেয়েটা ঠিক সামনেই বসে আছে। এত শান্তশিষ্ট মেয়ে প্রীতি কখনোই না। তবু আজ সে ভীষণ নিশ্চুপ, উদাসীন৷ চুলগুলো বেনি করে রাখা। হালকা রঙের এক সুতির গোলজামা, ওড়না মাথায় টানা। ছোট্ট মুখটা ফুলে আছে। বোধহয় ঘুম থেকে উঠেছে মাত্র। নক্ষত্র চশমাটা ঠিক করে বই বের করল। এরপর ডাকল,
-“প্রীতিলতা?”
-“বলুন।”
-“কোনো কিছু নিয়ে টেনসড?”
-“সম্ভবত। আচ্ছা...”

প্রীতি তাকাল নক্ষত্রের দিকে, ঠোঁট উলটে মুখভঙ্গিতে প্রশ্নবোধক রেখা ফুটিয়ে বলল,
-“আচ্ছা, আপনার সাথে আলোচনা করতে পারি?”
-“হুম, নিশ্চয়ই।”

নক্ষত্র চেয়ার টেনে এদিকে ঘুরে বসল। একহাতে প্রীতির চেয়ারটা টান দিয়ে তার মুখোমুখি করে নিল। প্রীতি প্রথমত ছিটকে উঠল। পর পর শান্ত হলো। বুকে হাত রেখে দম ছাড়ল। নক্ষত্র প্রীতির চেয়ারটার একপাশে হাত রেখে ওর দিকে তাকিয়ে রইল,
-“বলো।”
-“আচ্ছা।”

প্রীতি বড়ো করে একটা দম নিল। উদাসীন হয়ে বলা শুরু করল,
-“আমার এক ফ্রেন্ড আছে। আমাদের বয়সী মেয়েরা তো জানেনই কেমন হয়। যেই গাঙ্গে অন্যরকম কিছু খুঁজে পায়, সেখানেই আগ্রহের সাথে ডুব দেয়। তো আমার ফ্রেন্ড ডুব দেওয়ার আগেই ফ্যামিলি থেকে ওই জিনিসটাকে তার করে দেওয়ার প্ল্যান করতে লাগল। সহজে পেয়ে যাওয়া জিনিস তো, আমার ফ্রেন্ড এখন আর আগের মতো আগ্রহ পাচ্ছে না। তার ওপর আগ্রহের জিনিসটাতে অন্য কারোর ভাগ আছে। এটা জানার পর থেকে পুরোপুরি আগ্রহ উঠে যাচ্ছে। এই অবস্থায় আমার ফ্রেন্ডের কী করা উচিত? আমি ওর জন্য চিন্তিত।”

এতগুলো শব্দ উচ্চারণ করার পর নৈঃশব্দ্যে প্রীতি বলল, “আর ওই ফ্রেন্ডটা হচ্ছে আমার অন্তরাত্মা”—যে কথা নক্ষত্রের শোনা হলো না। 

নক্ষত্র বেশ রয়ে সয়ে বলল,
-“প্রতিটা গল্পের দুটো পিঠ থাকে। একপিঠ দেখে কোনো কমেন্টস করা উচিত না। যেহেতু আমি কেবল মেয়েটার দিক থেকে জানি, তাই বলব মেয়েটাকে ধৈর্য ধরতে। সময় ও পরিস্থিতি নিজেদের গন্তব্যের পথ নিজেরাই বেছে নেবে।”

প্রীতি টেবিলের ওপর দুই হাত রেখে সেখানেই মাথে এলিয়ে দিলো। অকস্মাৎ প্রতিক্রিয়ায় নক্ষত্র থমকাল। চিন্তিত গলায় শুধাল,
-“অল ওকে?”
-“হয়তো।”
-“নিশ্চিত হও। অনিশ্চিত শব্দেরা গল্পের মোড় পালটে দেয়।”

প্রীতি মাথা তুলে তাকাল নক্ষত্রের দিকে, 
-“আমি ঠিক নেই, নক্ষত্র। আমি আমার মনের সাথে কানেক্টেড হতে পারছি না। আমি ব্যথা পাচ্ছি না, আমার কষ্ট হচ্ছে না, আমার কান্না আসছে না। চাপা অনুভূতিরা বিষ হয়ে জ্বালাচ্ছে। আমি শ্বাস নিতে পারছি না।”

নক্ষত্র টেবিলে একহাত ভাঁজ করে রেখে, তার ওপর নিজের মাথা রাখল। তাকাল প্রীতির দিকে। স্থির চাহনি তার। গলার আওয়াজে নমনীয়তা,
-“তুমি গতকাল কিছু দেখেছ?”

প্রীতি স্বাভাবিকভাবেই বলল,
-“দেখেছি।”
-“কিছু শুনেছ?”
-“নাহ।”

এই ছোট ছোট সংলাপগুলো কতখানি ভয়াবহ তার পরিমাপ করা যেত কেবল তখন, যখন মানুষ দুটো স্বাভাবিক অবস্থায় থাকত। অস্বাভাবিক অবস্থায় বলা অস্বাভাবিক বাক্যগুলো কাটাকাটিতে স্বাভাবিক হয়ে এসেছে। 

নক্ষত্র অন্য হাতটা প্রীতির মাথায় রাখল, অপ্রশস্ত হেসে বলল,
-“সে আমার প্রাক্তন। বর্তমানে আমি তোমার। ইন ফিউচার, যদি জীবিত ও সুস্থ থাকি, তোমারই থাকব। প্রীতিলতা? জাস্ট রিমেম্বার দ্যাট, আ'ম অল ইয়োর্স।”

প্রীতি দু'চোখের পাতা বন্ধ করে ফেলল। 
.
.
.
চলবে.............................................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

WhatsApp