আমার মাথাটা ফাঁকা হয়ে আছে। একদম ফাঁকা। কিছু ভাবতে পারছি না। কী করা উচিত আমার? দেখা করব নাকি করব না? আদনান শুধুমাত্র আমার সাথে দেখা করতে বাংলাদেশে এসেছে অথচ আমি দেখা করব না, এমনটা আমি ভাবতেও পারি না। শুধুমাত্র সেদিন পুরো কথা না শুনে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে ফেলেছিলাম বলে সে পুরো কথা শোনাতে ডেনমার্ক থেকে বাংলাদেশে এসেছে! ভাবতেও অবাক লাগছে! কী এমন কথা সে বলবে? আর ঘুম ফিরিয়ে দেয়ার কথা বললো কেন? আমি কীভাবে ওর ঘুম নিয়েছি? এই প্রশ্ন আমার মনে আসতেই ইলেকট্রনিক শক খাওয়ার মত শক খেলাম! তার মানে আদনানও আমাকে ভালোবাসতো? ওর বিয়েটা কী তাহলে টেকেনি? সর্বনাশ করেছি নিজের! উফ সকাল কখন হবে? অসহ্য লাগছে আমার। চাইলে ফোন করে কথা বলতে পারি। কিন্তু করব না। আমি যেমন অস্থিরতায় থেকেছি এবং এখনো আছি। তেমনই অস্থিরতায় থাকুক সেও। সারারাত ঘুমোতে পারলাম না। কমল ফোন করল তার সাথেও কথা বলতে পারলাম না। কীভাবে যে আমি রাতটা পার করলাম তা অবর্ণনীয়। সকাল ১০ টা বাজার ৫ মিনিট আগেই রেস্টুরেন্টে চলে গেলাম। এই রেস্টুরেন্টটা ৯ টায় খোলে। সকাল সকাল মামুষজন কম। যে কজন আছে আমি তাদের মধ্যে আদনানকে খুঁজতে লাগলাম। হঠাৎ পেছন থেকে ডাকটা শুনতে পেলাম,
"তিন্নি।"
সেই কন্ঠস্বর! এক মুহূর্তেই আমার শরীরের লোম দাঁড়িয়ে গেল।
আমি পেছনে ফিরতেই সে বলল,
"আদনান। চিনতে পেরেছো?"
এই মুহূর্তে সেই ছেলেটাই আমার সামনে দাঁড়িয়ে যার ছবি দেয়া ছিল আদনানের প্রফাইলে। তার মানে আদনান সত্যি! আমার আদনান ফেক নয়। মাথা ঘুরতে লাগলো। থর থর করে কাঁপতে লাগলো শরীর।
আদনান বলল ,
"তোমার কি শরীর খারাপ?"
আমি কথা বলতে পারলাম না। মাথা নেড়ে না বললাম। সে আমাকে বসতে বলল। আমি বসলাম। আমার খুব অস্বস্তি লাগছিল কারণ আমি এই অদ্ভুত কাঁপা-কাঁপি থামাতে পারছি না । ব্যাপারটা তার চোখ এড়ালো না।
সে বলল,
"তুমি সম্ভবত খুব নার্ভাস ফিল করছো। পানি খাবে?"
এ কথা বলে সে-ই গ্লাসে পানি ঢেলে এগিয়ে দিল। আমি কাঁপা হাতে পানি খেতে গিয়ে নিজের জামা ভিজিয়ে ফেললাম। আরও ভয়াবহ ঘটনা ঘটল গ্লাসটা রাখতে গিয়ে, টেবিলে রাখতে গিয়ে পড়ে গেল। প্রথমে হাত থেকে টেবিলে, এরপর টেবিল থেকে গড়িয়ে নিচে পড়লো। পড়েই ভেঙে গেল। আমি অপ্রস্তুত হয়ে পড়লাম। একজন ওয়েটার দৌড়ে এলো।
আদনান আমাকে বলল,
"ইটস ওকে তিন্নি, ইটস টোটালি ওকে।"
তারপর ওয়েটারকে বলল,
"বিলের সাথে এড করে দিয়েন।"
ওয়েটার জায়গাটা ক্লিন করে দিল। ততক্ষণ আমরা দুজনেই নিশ্চুপ। আমার হার্ট বিট এত দ্রুত চলছে মনে হচ্ছে ভেতরটা এক্ষুণি ফেটে যাবে। আমি ঘামতে শুরু করলাম।
ওয়েটার চলে যাওয়ার পর আদনান বলল,
"কেমন আছো?"
আমি বললাম,
"ভালো।"
কিন্তু কি অদ্ভুত! গলা দিয়ে কোনো শব্দ বের হলো না। আমি কি বোবা হয়ে গেছি? আবার বললাম, ভালো। এবার শব্দ হলো। স্বস্তি পেলাম। বাকশক্তি হারাইনি তাহলে! কিন্তু প্রথমবার শব্দ হলো না কেন? এসব কী হচ্ছে আমার সাথে!
আদনান বলল,
"জিজ্ঞেস করবে না আমি কেমন আছি?"
"আমার মাথা ঠিক নেই। কেমন আছো তুমি?"
আদনান একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
"আমি এখন ভালো আছি। তোমার বেশি খারাপ লাগলে আমরা আরেকদিন দেখা করি?"
আমি একটু জোরেই বলে ফেললাম,
"না!"
আদনান একটু থামলো।
তারপর আবার বলল,
"তুমি আমার দিকে তাকাচ্ছো না যে? সারাক্ষণ মাথা নিচু করে আছ, এদিক ওদিক দেখছো!"
সত্যিই তো তাকাচ্ছি না কেন? কমলের সাথে তো প্রথম দিন থেকেই চোখে চোখ রেখে কথা বলেছি। কিন্তু যে মানুষটার ছবির দিকে তাকিয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা কাটিয়ে দিয়েছি, সেই মানুষটার চোখের দিকে একবারও কেন তাকাতে পারছি না আমি?
চোখটা তুলে তাকিয়ে বললাম,
"কই না তো!"
এক সেকেন্ডের মধ্যেই আবার চোখ নামিয়ে ফেললাম। না আমার দ্বারা সম্ভব না এই চোখে তাকানো। এই চোখ আমার জন্য মৃত্যকূপ।
আদনান বলল,
"তোমার হয়তো স্বাভাবিক হতে সময় লাগবে। সমস্যা নেই। সময় নাও। ততক্ষণ আমি কথা বলি। কথা না বলতে বলতে হাজারটা বিপদ ডেকে আনি। নিজেকে কারও বোধগম্য করে উঠতে পারি না। তাই এবার প্রতিজ্ঞা করেই এসেছি কথা বলব। সব বলব।"
ধুর আদনান সবকিছু কেন বুঝে ফেলছে! আমি কী বলবো বা এই মুহূর্তে আমার কী বলা উচিত বুঝতে পারছিলাম না।
আদনান বলল,
"তোমার সাথে আমার শেষ কথা হয়েছিল যখন তখন কী বলে কথা শুরু করেছিলাম মনে আছে?"
আমি ওর দিকে না তাকিয়েই বললাম,
"কী?"
"বলেছিলাম ধৈর্য ধরে আমার কথা শোনো। কিন্তু কথার মাঝখানেই রাগ করে ফোনটা রেখে দিলে! একটু ধৈর্য ধরে শুনতে চাইলে না কী বলতে চাচ্ছি? ভালোবাসি বলতে চাচ্ছিলাম তোমাকে।"
আমি চমকে তাকালাম আদনানের দিকে। সে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। মুহূর্তেই আমার চোখ জলে ভরে উঠল। আমি চোখ নামিয়ে ফেললাম। আমি চাই না এই চোখের জল সে দেখুক।
সে বলে চলেছে,
"কিন্তু সেই ভালোবাসার কথা বলার আগে আমার সাথে যে একটা ডিভোর্সি শব্দ যোগ হয়ে আছে সেটা বলতে চাচ্ছিলাম। আমাদের একটা সম্পর্ক তৈরি হবে তারপরে তুমি জানবে আমি ডিভোর্সি এই ব্যাপারটা আমার পছন্দ না।"
"ডিভোর্স কেন হলো?"
"কারণ কন্ট্রাক্ট ম্যারেজ ছিল।"
"কন্ট্রাক্ট ম্যারেজ মানে?"
"মানে সে আমাকে বিয়ে করবে। তাকে বিয়ে করলে আমি বিয়ের সূত্রে সিটিজেনশিপ পাব। নির্দিষ্ট সময় পরে আমাদের ডিভোর্স হবে। আমাদের মধ্যে কোনো মানসিক বা শারীরিক সম্পর্ক হবে না। আর বিয়ে করার জন্য আমার তাকে পে করতে হবে। এরকম একটা কন্ট্রাক্ট ম্যারেজ হয়েছিল। মেয়েটার সাথে আমার পরিচয় ছিল না। আমার বন্ধুর পরিচিত।"
"ও মাই গড! আমি কি ভেবেছিলাম! ব্যাপারটা এমন হলে তো আমাকে বলারই দরকার ছিল না তোমার।"
"একটা নতুন সম্পর্কে যাওয়ার আগে হয়তো অতীতের প্রেমের কথা গোপন রাখা যায়, বিয়ের কথা না। আমি বলেছিলাম, আমি বিয়ে করেছিলাম। পাস্ট টেন্সে বলেছিলাম। তারপরেও ধরে নিলাম তুমি খেয়াল করোনি, ভেবেছো আমি এখনও বিবাহিত। বিবাহিত ভাবলে অথচ এটা একবারও তোমার মনে কেন এলোনা যে বিবাহিত হলে বউ ফেলে তোমার সাথে প্রতিরাতে কথা কীভাবে বলি? বউ থাকলে কোনো পুরুষ মানুষ সারারাত অন্য কোনো মেয়ের সাথে ফোনে কথা বলতে পারে?"
এবার আমার একটু অভিমান হলো।
আমি বললাম,
"কখনোই প্রতিরাতে সারারাত কথা বলতে না।"
"আচ্ছা মেনে নিলাম প্রতিরাতে সারারাত কথা হত না। তবে প্রায়ই তো হত। বউ থাকলে কেউ সেটা বলতে পারে? আর আমাকে তু মি ৫ মাসে এই চিনলে যে ভাবলে বিবাহিত হয়েও তোমার সাথে এইভাবে কথা বলি?"
"এইভাবে কীভাবে?"
"যেভাবে কথা বললে বোঝা যায় ছেলেটা মেয়েটাকে চায়। নাকি শুধু নিজের ভালোবাসা বোঝাতে জানো অন্যেরটা বুঝতে জানো না?"
দুজনের অভিমান একইসাথে উথলে উঠলে যা হয় তাই হচ্ছিল।
আমি বললাম,
"হ্যাঁ আমি বোঝাতে জানি। তু মি তো বোঝাতেও জানো না। সেজন্যই বুঝতে পারিনি।"
এই কথাগুলোও আমি তার দিকে তাকিয়ে বলতে পারলাম না। অন্যদিকে তাকিয়ে বললাম।
সে বলল,
"আমি যথেষ্ট বুঝিয়েছি তিন্নি। তু মি বুঝতে পারোনি। যেহেতু আমি ডিভোর্সি তাই আমার মধ্যে একটা কনফিউশন ছিল যে তুমি মানতে পারবে নাকি না। বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থা ক্লিয়ারলি জানিনা, যতটুকু জানি ডিভোর্সি মানে মহা পাপে পাপিষ্ঠ ব্যক্তি। তার উপর বিদেশিনী ও বিধর্মী বিয়ে করে ডিভোর্সি! তোমাকে বোঝার জন্য একটু সময় নিচ্ছিলাম। তারপর এক সময় যখন বললাম পুরো কথা না শুনেই উধাও হয়ে গেলে।"
"তুমি কীভাবে বুঝিয়েছো? এতবার বলেছি একবার ভিডিও কলে আসতে এসেছিলে?"
"আমি প্রথম দেখায় তোমাকে সামনা-সামনি দেখতে চেয়েছিলাম।"
"সেটা তো আমাকে বলতেও পারতে। একবারও বলোনি।"
"ভুল হয়েছে বলা উচিত ছিল। তুমি তো জানো আমি ভীষণ ইন্ট্রোভার্ট ।"
"আমি তো মাঝে মাঝে তোমাকে ফেইকও ভেবেছি।"
"কী! ফেইক ভাবার কারণ কী?"
অবাক হলো আদনান।
আমি বললাম,
"কারণ তোমার প্রফাইলে তেমন কোনো এক্টিভিটি ছিল না। খুব বেশি ছবিও ছিল না।"
"তিন্নি আমি ফেসবুক এডিক্টেড না। তোমার সাথে যোগাযোগের জন্য একটু রেগুলার হয়েছিলাম। না থাকলো ফেসবুকে কিছু, মানুষটা তো তোমার সাথে কথা বলেছে। সে ফেইক হয় কীভাবে!"
আমি আর কিছু বললাম না এ ব্যাপারে।
আবার সেই বোঝাবুঝির কথায় চলে গেলাম,
"আমি তোমাকে ফোন দিলেই শুধু কথা হতো। আমি ফোন না দিলে বেশিরভাগ সময় তুমি ফোন দিতে না। এতে যদি আমি মনে করি তুমি আমাকে ইগনোর করছ সেটা ভুল হবে?"
"তিন্নি আমার জীবনটা অন্যরকম। আমার বাবা মা মারা যাওয়ার পর আমি কেমন যেন হয়ে গিয়েছিলাম। যতক্ষণ সময় একা থাকতাম ততক্ষণ বাবা মায়ের স্মৃতিগুলো তাড়া করত। ভাইবোনেরা সম্পত্তি নিয়ে এত স্বার্থপরতা করেছে যে জীবনটাকে একটা দুঃস্বপ্ন মনে হত। বাবা মায়ের কথা মনে করে কাঁদার জন্য একটা আশ্রয়স্থলও পাইনি। নানারকম মানসিক সমস্যায় ভুগতাম। ঠিকমতো ঘুমাতেও পারতাম না। এরপর কলেজে উঠে টিউশনি শুরু করার পর এক ঘন্টা পড়ানোর কথা থাকলেও দু'ঘন্টা পড়াতাম। যে কোনো টিউশনির অফার পেলেই নিয়ে নিতাম, যত কম বেতনই হোক না কেন। কারণ আমাকে ব্যস্ত থাকতে হবে। অনেক কাজ করতে হবে। যখন কোনো কাজ থাকত না তখন ঘন্টার পর ঘন্টা দৌড়াতাম। কারণ আমাকে ক্লান্ত হতে হবে। এতটা ক্লান্ত যে বিছানায় যাওয়ার সাথে সাথেই যেন ঘুম আসে। এরপর যখন ডেনমার্কে গেলাম তখন আবার সমস্যাটা দেখা দিল। ফুল টাইম ক্লাস করি, পার্ট টাইম চাকরি করি, রাত হলে ঘুমিয়ে পড়ি। কিন্তু উইকেন্ডে পাগল হয়ে যাই। বন্ধুরা সব উইকেন্ডে বাসায় যায়, কেউ প্রিয়জনের সাথে সময় কাটায়। কিন্তু আমার একা সময়গুলো কাটে ভয়াবহ। তখন উইকেন্ডে আরেকটা পার্ট টাইম কাজ নিলাম। আমার নিজেকে ব্যস্ত রাখতেই হয়। গ্রাজুয়েশন শেষ করেও একই অবস্থা। ফুল টাইম চাকরি করি, পোস্ট গ্রাজুয়েশনের ক্লাস করি তবুও অনেক টাইম পড়ে থাকে। আবার উইকেন্ডে কাজ নিলাম। তোমার সাথে কথা বলা শুরু হওয়ার কয়েক মাস পরে আমি উইকেন্ডের কাজটা ছেড়ে দেই। তুমি নিশ্চয়ই খেয়াল করেছ উইকেন্ডে আমরা সারারাত কথা বলতাম। কিন্তু উইকডেজে অনেক ক্লান্ত থাকতাম। তুমি অভিযোগ করলে যে তুমি ফোন করলেই তোমার সাথে কথা হতো। তুমি ফোন না করলে বেশিরভাগ দিন আমি ফোন করতাম না। মাঝে মাঝে তো করতাম? যে দিনগুলো ফোন করতাম না সেদিনগুলোতে কী হতো জানো?"
"কী?"
"সে দিনগুলোয় ফোনটা হাতে নিয়ে তোমাকে ফোন করতে করতেই ঘুমিয়ে পড়তাম। সকালে ঘুম ভেঙে দেখতাম তোমাকে ফোন করা হয়নি। ইভেন রাতের খাবারটাও খাওয়া হয়নি। কিন্তু তখন আর সময় কোথায়! রেডি হয়ে অফিসে দৌড়! এভাবে কেটে গেছে কতদিন! তোমাকে ভালোবাসি তিন্নি, ইগনোর কীভাবে করব? ৬ টা মাস যে আমি কীভাবে কাটিয়েছি তা শুধু আমি আর আমার আল্লাহ জানে।"
ওর কথাগুলো শুনতে শুনতে আমার ভেতরটা হাহাকার করে উঠছিল। কিন্তু এই কথাটা শোনার পর আমি হঠাৎ দু'হাতে মুখ ঢেকে হাউমাউ করে কেঁদে ফেললাম। এবার আদনান অপ্রস্তুত হয়ে পড়লো।
আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,
"এই তিন্নি! পাগল নাকি মেয়েটা! কান্না থামাও প্লিজ। ৬ টা মাস দুজনে দু-প্রান্তে বসে কষ্ট করেছি, কিন্তু দেখো এখন আমরা একসাথে। আমাদের কষ্টের সময় শেষ।"
.
.
.
চলবে...............................................................