নির্মোচন - পর্ব ৩৫ - ফাবিয়াহ্ মমো - ধারাবাহিক গল্প


সাংঘাতিক আর্তস্বরে গমগম করে উঠল সিঁড়ির নিঃশব্দ জায়গাটা। টব ভেঙে চুরমার হয়ে পড়ল সিঁড়ির তিন তিনটে ধাপে। প্রচণ্ড চিৎকার করে কতটুকু ব্যথার জাহির করা হলো, তা অনুমান করা গেল না। হতবাক, আশ্চর্য, বিস্ফোরিত নয়নে নাজনীন ও ফিমা উদ্বেলিত চিত্তে ছুটে আসতে আসতেই ঘুটঘুটে অমাবস্যার ঘোর অন্ধকারে তলিয়ে গেল ফিহার স্নাযু। হাঁটুর নীচ থেকে দুর্বোধ্য এক পীড়ায় সারামুখ রক্তিম হয়ে বুজিয়ে নিল চোখ। অস্পষ্ট, ভাসা ভাসা একনাগাড়ে চিৎকার চেঁচামেচির তপ্ত গলাদুটো শুনতে পেল কানে। কিন্তু শত শত মারণ যন্ত্রণার হিংস্র ছোবলে চেতনা, শক্তি, দৈহিক ভারসাম্যটুকু আর ধরে রাখতে পারল না। “ধপাস” করে রক্তমাংসের ওইটুকু শরীর যেন চোখের সমুখে লুটিয়ে পরল। কয়েক লহমায় অবর্ণনীয় এক রণ তোলপাড় সৃষ্টি হয়ে গেল ওইটুকু জায়গায়। হাতের টব ফেলে দিয়ে ধরাধরি করে রুমে এনে বিছানায় শুইয়ে জ্ঞান ফেরাতে লেগে পড়ল ফিমা। বেসিন থেকে মগভর্তি পানি এনে অনবরত পানির ছিটা ছিটাতে ছিটাতে জোর গলায় ডেকে চলল সে। অন্যদিকে মা নাজনীন পাগলের মতো রুম তোলপাড় করে ফেলতেই আকস্মিক দুর্ঘটনার কথা ফোন করে জানিয়ে দিলেন স্বামীকে। ভরা মার্কেটের ভেতর অসংখ্য ভারী শপিংব্যাগ হাতে স্তব্ধ হয়ে কথাগুলো শুনে চললেন নিয়াজ। মাথার ভেতরে মৌমাছির চাক যেন হুঁল ফুটাতে ভোঁ ভোঁ করছে। চতুর্দিকে মানুষের হৈচৈ করা ব্যস্তমুখর ঢলের মাঝে তিনি যেন এক প্রাণহীন কাকতাড়ুয়া। রিকশার অসহ্যকর ক্রিং ক্রিং হর্ণের আওয়াজ, অশ্রাব্য ভাষায় “.... বাচ্চা” বলে অশুদ্ধ বাণী, দোকানে দর কষাকষি লোকদের মাঝে তর্কবিতর্ক সবই উপেক্ষা করে তিনি দুর্বার ছুটলেন গন্তব্যের দিকে। পাশের বিল্ডিংয়ে থাকা দারোয়ান সালামকে ফোন করে পাঠিয়ে দিলেন একজন নিকটস্থ ডাক্তারকে এখুনি নিয়ে আসার জন্যে। পুরো ব্যাপারটা ঘটতে এবং ঘটাতে বেশি সময় লাগল না। বয়োজ্যেষ্ঠ ডাক্তার এলেন দশমিনিট পর। মনোযোগ দিয়ে একটু একটু করে জ্ঞান ফিরে পাওয়া ফিহার অবস্থা দেখে ঘোষণা দিয়ে জানান, শরীরের পুরো ভরটা ডান পায়ে রেখে ওভাবেই মেয়েটা সিঁড়ি থেকে অসংলগ্ন ভাবে পরেছে। পায়ে ফ্র‍্যাকচারের লক্ষণ সুস্পষ্ট। একটা এক্স-রে করানো অতি আবশ্যক। তিনি ব্যথানাশক কিছু ট্যাবলেটের নাম লিখে দিয়ে বিদায়ের পালা চুকালেন আধঘণ্টার মাঝে। এদিকে মহা টেনশনের ভেতর হাতাপিতা করতে লাগল নাজনীন কাদির মিলা। তিনি কী বোনের কাছে ব্যাপারটা খুলে বলে কাবিনের এই দিনক্ষণ পেছাতে বলবেন? মুখ ঘুরিয়ে চিন্তা আচ্ছন্ন স্বামীর দিকে আস্তে করে শুধালেন, 

  - কাল জুম্মা নামাজের পর কাবিন। হাতে শুধু আজকের দিন। এই অবস্থায় কী কাবিন সম্পণ্ণ করা ঠিক হবে ফিমার বাপ? 

ফিমাকে শপিংব্যাগের ঝোলাটা ঠিকঠাক মতো বুঝিয়ে দিতেই স্ত্রীকে নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন নিয়াজ। স্ত্রীকে এক কাপ চায়ের জন্য চুলোর পাড়ে দাঁড় করিয়ে রান্নাঘরের তাক থেকে সল্টেজ বিস্কুটের বয়ামটা তুলে বললেন, 

  - এখনই কিছু ভাবা ঠিক হবে না। আমরা বরং অপেক্ষা করে দেখি মেয়ের অবস্থা বিকেল পর্যন্ত কেমন দাঁড়ায়। এটা কাবিনের ডেট। ডেট পিছানোর কাজটা চট করে করা হলে আমার মনে হয় ব্যাপারটা সুন্দর দেখায় না। পরিস্থিতির উপর ছেড়ে দেখি। আর তুমি এক কাজ করো নাহয়। তাদের একটা ফোন করে মেয়ের অবস্থা সম্পর্কে জানিয়ে রাখো। এটা ভালো হবে। 

চুলায় টগবগ করতে থাকা ফুটন্ত পানির ভেতর ক'চামচ চাপাতা ছাড়লেন নাজনীন। মিইয়ে যাওয়া কণ্ঠে স্বামীর দিকে শুধালেন, 

  - কী একটা দুর্ঘটনা ঘটল বলুন! আজই এটা ঘটতে হলো? আমি বারবার বলেছি সিঁড়ি দিয়ে নামার সময় চোখদুটো নীচের দিকে রাখতে, পাদুটো সাবধানে ফেলতে। একটা কথা যদি আপনার মেয়ে আমার শোনে? লজ্জা বলতে লজ্জা নেই। আমি একশোবার করে . . .

ক্ষিপ্ত ক্রুদ্ধ মেজাজি বাক্যের মাঝে দ্রুত বাঁধ সেধে দমালেন নিয়াজ সাহেব, 

  - আহ! থামো তুমি। ওটা দুর্ঘটনা ছাড়া কিছুই নয়। সর্বক্ষণ একটা মানুষ সতর্কতার ভেতর থাকতে পারে? অতো সতর্কতা যদি পালন করা হয়, তাহলে এই পাদুটো মাটিতে রাখা যাবে না। ডাক্তার তো বললই পা ছাড়া অন্যকোথাও ভারি আঘাত পায়নি তাহলে অতো টেনশন করা হচ্ছে কেন? তুমি চা বানিয়ে রুমে আসো। আজ আর রুটি দিয়ো না আমাকে। বিস্কুট দুটো খেয়ে পেট ভরে গেছে। 

চমকে ফিরে তাকালেন নাজনীন, 

  - নাস্তাই তো করলেন না সকালে? খালিমুখে মার্কেটের ওখানে চলে গেলেন। একগ্লাস পানি দুটো বিস্কুট খেয়ে পেট ভরে গেল? 

আলগা করে রাখা বয়ামের ঢাকনাটা গোল গোল চাকতির মতো ঘুরিয়ে মুখটা বন্ধ করতেই উঁচু তাকে রেখে দিচ্ছিলেন নিয়াজ। হাতে মাখা বিস্কুটের গুড়োগুলো সিংকের ট্যাপে ধুয়ে নিতেই স্ত্রীর দিকে শান্তমুখে জানালেন, 

  - কাজের মধ্যে খাওয়া দাওয়া চলে নাকি? এখনো অনেক কাজ দেখতে হবে। তুমি উপরে গিয়ে মেয়েদুটোকে খাওয়ানোর ব্যবস্থা করো। দেখি আমি ভাইজানকে একটা ফোন দিয়ে ব্যাপারটা জানাই। না জানালে স্বস্তি পাওয়া যাচ্ছে না। কী না কী ভাবে . . 

নিয়াজ সাহেব চায়ের কাপটা বুঝে নিয়ে প্রস্থান করলেও ভীতসম্ভ্রন্ত নাজনীন পৃথিবীর দুই মেরু ওলোটপালোট করে ভাবনা কষে যাচ্ছেন। কাবিনের আগেরদিন এমন একটা দুর্ঘটনা ঘটা কী স্বাভাবিক কিছু? নাকি এর পেছনে কুসংস্কারগ্রস্ত যুক্তি লাগিয়ে অশুভ, অমঙ্গল কিছু একটা ভাবা দরকার? যুগ যুগ ধরে চলে আসা নানী-দাদীদের মুখে সবসময় যা শুনেছেন, তার ভিত্তিতে এই পা ভাঙার লক্ষণটা কোনোভাবেই মঙ্গলজনক ইশারা নয়। ফিহার দাদীকে এ সম্পর্কে বলাই যাবে না।

•••••••••••••

সাতসকালে এমন একটি সংবাদ শুনে প্রফুল্লে ভরা মুখ অপ্রসন্ন মুখে বদলে গেল। টেবিলে সাজানো হরেক রকমের নাস্তা মুখে আর রুচলো না। কান থেকে ফোনটা নামানোর পরপরই পর্বত সম গম্ভীরতা নিয়ে বসে রইলেন সোয়াদ। টেবিলের ঠিক মুখোমুখি দিকটায় মন বেজার করে দুশ্চিন্তায় হাবুডুবু খাচ্ছেন আফসানা। ছেলে ভোরসকালে ওয়ার্কআউট করতে বেরিয়ে গেছে। এখনো বাড়ি ফেরেনি। ফেরার পর এই সংবাদ শুনলে কী ধরণের অবস্থা করে ছাড়বে আগে থেকে অনুমান করা যাচ্ছে না। ক্ষেপবে? চেঁচাবে? রাগে সুন্দর চোখদুটো ভীষণ ক্ষুদ্ধ হবে? একবার ভেবেছেন সুফিয়াকে দিয়ে রয়েসয়ে ব্যাপারটা বুঝিয়ে তারপর ডেট পিছানোর একটা প্রসঙ্গ তুলে দিবেন। কিন্তু এই প্রথমবার সুফিয়া বোধহয় সাঈদের সামনে যেতেই মিনমিন শুরু করে দিয়েছে। কী একটা বিপর্যস্ত ব্যাপার! বুকে জমে উঠা চিন্তার বাষ্পগুলো ঠোঁট নিঃসৃত শব্দে স্বামীর দিকে বললেন, 

  - মেজর সাহেব, ছেলেকে যা বলার আপনি বলবেন। আমি এসবের মধ্যে থাকছি না। আপনার যত ধরণের বদ মেজাজি মুদ্রাদোষ আছে সব আপনার ছেলে পেয়েছে। আমি ওর মেজাজ দেখতে পারব না। আপনি সামলান। 

এক মূহুর্ত্তের জন্য মনে হলো তার কর্মজীবি স্ত্রী যথেষ্ট স্বার্থপরের মতো আচরণ করছে। আগুনের সামনে ধাক্কা দিয়ে পেছন থেকে ঘরের দরজাটা বন্ধ করে দিচ্ছে। কী নিষ্ঠুর মনুষ্য! সোয়াদ চোখ খাটো করে নিষ্ঠুর স্ত্রীর দিকে আরো গম্ভীর কণ্ঠে শুধোলেন, 
  
  - তুমি বলতে চাইছ সাঈদের গমগম করা মেজাজ আমার কাছ থেকে পেয়েছে? 

  - বলতে চাইছি না, ওটাই বোঝাচ্ছি। আপনি যে পথে হেঁটেছেন সেও এখন একই পথে হাঁটে। দুজনের মধ্যে আলাদা পার্থক্য আমি দেখছি না। উলটো এখন ভাবছি আমার বোনঝিটা আপনার পাষাণ ছেলের সাথে মানিয়ে উঠতে পারে কিনা। 

এবার যেন গায়ে আগুনের হল্কা লাগল সোয়াদের। যতই ছেলের কর্মকাণ্ডে বিরূপ মনোভাব পোষণ করুক, দিনশেষে তারই রক্তকে নিয়ে পাষাণ উগ্র কটাক্ষ মন্তব্য করছে, এসব মানা যায়? তিনি বাজখাঁই স্বরে দ্বিগুণ ক্ষিপ্র মেজাজে আফসানার যুক্তিকে ফালা ফালা করতে এগুলেন, কিন্তু সেসময় ভাগ্য সারথি যেন উলটো সোয়াদকেই কলাগাছ দেখিয়ে থামিয়ে ছাড়ল। হাঁট করে খোলা সদর দরজা দিয়ে ঘর্মাক্ত শরীরে প্রবেশ করল সেই চিন্তার দূত। গায়ে তার জংলী সবুজ রঙা টিশার্ট, কালো ট্রাউজার। রোদ্দুরের মৃদু তাপে গলা ও মুখ ঘামে ভিজে হালকা কেমন লালচে ছাপ পরেছে। ডাইনিং টেবিলে বরফের মতো ঠাণ্ডামূর্তিতে বসে থাকা আফসানা আলুর মতো চোখদুটো বড়ো বড়ো করে বারবার ছেলেকে কথাটা জানানোর জন্য চোস্ত ইশারা করতে লাগলেন। সোয়াদ আড়চোখে ছেলের আগমন দেখে সেই যে চোখদুটো ঠাণ্ডা নাস্তার দিকে নত রেখেছেন, আর সেটা তুলছেন না। একটু আগে এই নাস্তাই কিনা ভদ্রলোকের মুখে রুচছিল না। কী নাটক! আফসানা চরম অতিষ্ঠ হয়ে দ্রুত একটা কাশি দিলে এবার চোখ তুলে তাকান সোয়াদ। বুঝতে পারেন ইশারাটা। সঙ্গে সঙ্গে জোর গলাতে থামিয়ে উঠেন ছেলেকে, 

  - তোমার জন্য একটা সংবাদ আছে, দাঁড়াও। আমার মনে হয় সংবাদটা শোনা উচিত। 

আচমকা পা থামিয়ে বাবার পানে চাইল সাঈদ,

  - ওকে। সংবাদ পাঠ শুরু করুন। লাইভ টেলিকাস্ট শুনে ফ্রেশ হতে যাব।  

কথার ছিরি দেখে সোয়াদ সাহেবের মেজাজ রুক্ষ রুক্ষ হলেও আফসানা বহুকষ্টে বাপ-বেটার তামাশায় হাসি আঁটকে রেখেছেন। এবার সোয়াদও ঠাণ্ডা মাথায় সুক্ষ্ম একধাপ চাল চাললেন, 

  - ডেট সম্ভবত পেছানো দরকার। তুমি তোমার মায়ের সাথে ব্যাপারটা আলোচনা করে মিটমাট করো। 

এক খাবলা চুন মাখানোর মতো ফ্যাকাশে দেখাল আফসানাকে। তিনি পারছেন না চোখের দৃষ্টিতেই ভস্ম করে দেন স্বামীকে। অন্যদিকে স্বাভাবিক ভ্রুঁ কঠিনভাবে কুঁচকে এমন উদ্ভট কথার হেতু বুঝতে পারল না সাঈদ। রান্নাঘরে থাকা সুফিয়া খানমের দিকে নজর ঘুরাতেই বেচারি সুফিয়া ভয়ে আঁতকে উঠে দুমাদুম রুটি বেলার বেলুনে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। সুক্ষ্ম সংকেতটা ভালো ঠেকল না। নির্ঘাত কিছু একটা বিপদ হয়েছে। মাথা ভরা প্রশ্ন নিয়ে সরাসরি প্রসঙ্গে ঢুকল সাঈদ, 

  - আপনি কী সংবাদ পাঠের নামে আবারও আমার ধৈর্য পরীক্ষা করতে চাইছেন? 

  - তোমার ধৈর্য পরীক্ষা নেওয়ার কোনো ইচ্ছে আমার নেই। এখানে কাবিনের ডেট পিছানো নিয়ে আলোচনা করা হচ্ছে। এটা নিয়ে খোলাখুলি বলা প্রয়োজন। 

  - একদিন আগে কোন অর্থে এটা আলোচনার বস্তু হয়? ডেট পিছানোর কথা এখন উঠবে কেন? যাবতীয় খোলাখুলি আলাপ গত শনিবার সন্ধ্যায় হয়নি?

  - প্রশ্ন করা বন্ধ করো। যেটা নিয়ে আলোচনা করছি সেটা একটু আগে ঘটেছে। মেয়েটা ওই বাড়িতে সিঁড়ি থেকে পড়ে পাটা সম্ভবত ফ্র‍্যাকচার করে ফেলেছে। এখন তুমি কী চাও ফ্র‍্যাকচার পায়ের ব্যথাটা নিয়ে কাবিন হোক? 

কুঁচকে রাখা ভ্রুঁদুটো আস্তে আস্তে আশ্চর্য রকম স্বাভাবিক হয়ে উঠল সাঈদের। যেন সে জানতো এরকম একটা কিছু অঘটন কাণ্ড তার ভাগ্যে ঘটবেই। প্রথম ক'মিনিট দুর্মনা ভাবটার সাথে খাপ খাইয়ে সচকিত হলো স্নায়ু মন। ডেট সে কিছুতেই পেছাবে না। দেখা যাক না, ভাগ্য আরো কী কী ছলাকলা দেখায়! দুর্মর চেতনায় উদ্দীপ্ত হয়ে বুকভরা দম ছেড়ে জানালো, 

  - এটা ডেটিং ডেট হলে পোস্টপন করে দিতাম। আমার পক্ষে ওয়েডিং ডেট পেছানো সম্ভব নয়। কথাটা খারাপ শোনালেও কিছু করার নেই। আমি আমার জায়গা থেকে ভীষণ ব্যস্ত। যদি আগামীকাল না হয় তাহলে আজ হবে। আজ মানে আজই। এখন আগামীকাল ব্যাপারটা জুম্মা ওয়াক্তের পর ভালো হবে, নাকি আজ রাত আটটার সময় ঠিক হবে, সেটা মায়ের সাথে আলোচনা করে নিবেন। ব্যাপারটা নিয়ে খোলাখুলি বলা প্রয়োজন। 

নিজের অকাট্য সিদ্ধান্ত থেকে একপাও নড়চড় করল না জুনায়েদ সাঈদ। যে কথাগুলো একটু আগে সোয়াদের মুখ থেকে বেরিয়েছিল, সেগুলোই যেন যত্ন করে তার দারস্থে ফিরিয়ে দিল সে। আফসানা মজলুম জনতার মতো স্বামীর অবস্থা দেখে হাসতেও পারছেন না, আবার ছেলের অকাট্য ঠাস ঠাস বাচনভঙ্গি শুনে বেজারও হতে পারলেন না। তিনি জব্দ হওয়া ডাকাতের মতো অসহায় চোখে দূরপানে সুফিয়ার দিকে চাইলেন। সুফিয়া রান্নাঘর থেকে বত্রিশ দাঁতের ভেটকি হাসি দিয়ে খুশি খুশি ভাব বোঝাচ্ছে। সাঈদ যদি অমাবস্যার রাতে দেখে বলে “ওইযে সূর্য উঠেছে”, সুফিয়া তাতে সায় জানিয়ে বলবে “হ বাবা, রাইতের আন্ধারে কী ভালা সূর্য উঠছে!” তিনি আর ভাবাভাবির ভেতর গেলেন না। এই স্বৈরাচারী অবস্থার ভেতর দশ কদম দূরে সরে শান্তচিত্তে জানান দিলেন, 

  - আজ কোনো ঝামেলা করা ঠিক হবে না। তুই উপরে যা। হাতমুখ ধুয়ে নে। নাস্তা তোর সুফি খালা রুমে দিয়ে আসবে। আমি যা শোনার শুনে নিয়েছি। তোর যদি আপত্তি না থাকে তাহলে এই প্রসঙ্গ এখানেই শেষ। আমি নাজুদের ফোন করে বাকিটা জানিয়ে দিচ্ছি।

  - ধন্যবাদ। মাঝে মাঝে তুমি বুদ্ধিমানের মতো আচরণ করো। ককর্শভাষী মেজরদের মতো খ্যানখ্যানে স্বভাবটা দেখাও না। ভালো। 

গনগনে আগুনের ভেতর এক বোতল কেরোসিন ঢেলে চুপচাপ সেখান থেকে প্রস্থান করল জুনায়েদ সাঈদ। আফসানা কী যেন বুঝতে পেরে মিটিমিটি হাসিতে পানি পান করলে সামনে থেকে সোয়াদ ভ্রুঁযুগল খিঁচে তড়বড়িয়ে করল, 

  - সানা? ও কী আকারে ইঙ্গিতে আমাকে খোঁচাটা দিল? আমি কর্কশভাষী? খ্যানখ্যানে?

••••••••••••••

পর্দার ফাঁক গলে একচিলতে দুষ্টু রোদ কোলের উপর তাড়া করে ঘুরছে। মৃদু ভোল্টেজে চলতে থাকা ফ্যানের বাতাসে দুলছে জানালার পর্দা। পর্দার দুলকি চালে দেখা মিলল সোনালি সূর্যের দাপটে চিত্র। যেন সবটুকু তেজ ঐশ্বর্য লালন করে মধ্য আকাশে অবস্থান করছে সূর্যপিণ্ড। বাঁহাত ভরে রিনিঝিনি শব্দতরঙ্গে একঝাঁক চুড়ি পরতেই আয়নায় দৃষ্টি তুলে চাইল। কাঠের চেয়ারে বসে ফ্র‍্যাকচার পাটা নীচু একটা টুলে রাখা। একটা নরম কাপড় দিয়ে পা-টাকে বেঁধে ছোট্ট একটা কুশনের উপর রেখে গেছে মা। আয়নায় গুচ্ছ গুচ্ছ নক্ষত্রের মতো জ্বলজ্বল করছে গায়ের সমস্ত বর্ণিল আভরণ। নিজেকে নিয়ে ভারী দুর্ভাবনার ভেতর কুণ্ঠিত হচ্ছে মন। বিয়ের রঙ সবসময় হয় লাল। টকটক করা অরুণ রাঙা লাল। সেখানে ওই অদ্ভুত মানুষটা পছন্দ করেছে আরো অদ্ভুত রঙ। ঘিয়ে রঙের মাঝে হালকা সোনারঙ মেশানো স্বল্প ভারী শাড়ি। মাথায় শাড়ি ম্যাচিং লম্বা একটা দোপাট্টা। মাঝারি শেপে গলা, কনুই সম হাতা, ওভার সাইজ একটা ব্লাউজ। ব্লাউজটা ইচ্ছে করে আর চাপিয়ে নেওয়া হয়নি। লাজ মাখা চেহারায় হালকা মেকআপের ক্ষীণ স্পর্শ। ঠোঁটে লাল খয়েরি রঙের চিত্ত আকর্ষণ করা সৌন্দর্যটুকু, দু'চোখের পাপড়িতে মাসকারার ঘন প্রলেপ, চিকন করে টানা আইলাইনারের রেখা, আদুরে পেলব গলায় মোটা প্রশস্ত হার। কোনো এক বিশেষ কারণে চুলগুলো ছেড়ে রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। কপালে ঝুলে থাকা ওই গোল টিকলি, টিকলির পথ ধরে চুলের মাঝ সিঁথিতে মাথাপট্টি অলংকার, নাকে হালকা ভারের নাথনি। কানে কোনোপ্রকার অলংকার জড়াতে নির্দেশ দেয়নি। লাল বেনারসি শাড়িতে আপাদমস্তক গহনায় জড়ানো যে ছকবাঁধা নিয়মটা যুগ যুগ ধরে চলে এসেছে, তা যেন ফুঁ মেরে নিজের মর্জিটাই এখানে পালন করেছে ওই জাঁদরেল লোক। কানে স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছে নীচতলা থেকে মায়ের সচকিত উচ্ছ্বাস। বাবার আমোদে ভরা গর্বিত কণ্ঠ। ফিমা আপুর হঠাৎ বদলে যাওয়া অন্যরকম আচরণ। কিন্তু নিজের ভেতরে টের পাচ্ছে ঝড়ো ঝড়ো অবস্থার কাঁপন। হঠাৎ টুকটুক শব্দে দরজায় মৃদু কড়াঘাত করতেই দৃষ্টি আকর্ষণ করল আফসানা, 

  - বুড়ি কী রেডি? 

ভ্রম ভেঙে আয়নার মাঝে ওই প্রিয়মুখটি দেখতেই ঠোঁটে সলজ্জ হাসি ঝুলালো। উঠে দাঁড়াতে অক্ষম বলে মাথাটা নিঃশব্দে নাড়িয়ে ভেতরে আসার ইঙ্গিত বোঝাল। কিন্তু তা বোঝানোর মাঝেই ঘরে প্রবেশ করল একগাদা মুরুব্বি মানুষ। সঙ্গে বাবার মলিন মুখ। পিছু পিছু মার নীচু রাখা দৃষ্টি। বারবার আঁচলের প্রান্ত টেনে ' “চোখে ময়লা ঢুকেছে' কথাটা বলে চোখ মুছে নিচ্ছে। ও জানে, মায়েদের চোখে কেন হঠাৎ হঠাৎ এমন ময়লা ঢোকে। গতরাত থেকে শব্দশূন্য ঠোঁটদুটো সহসা কেঁপে নাকের আদুরে ডগায় লাল আঁচ পড়ে। ঝরঝর করে দুচোখ থেকে ঝরতে থাকে মুক্তো ফোঁটা। নত করে রাখা ওই মানবীর কাছে তিনবার জানতে চাওয়া হয় “কবুল” শব্দ। তিনবারই গলায় কাঁটার মতো আঁটকে যাওয়া স্বর নিংড়ে উচ্চারণ করে কবুল। প্রতিবার ওই একটি শব্দ শুনে হাতের রুমালটা চোখে ব্যবহার করেন নিয়াজ। মনে পড়ে যায় দু'হাতে দুটো মেয়ের হাত ধরে ধরে ঘুরার মূহুর্ত। ডানহাতে শক্তভাবে ধরা চন্ঞ্চলমতি হাতটিই তিনি ছেড়ে দিচ্ছেন অন্যের দ্বারে। ছেলে সন্তানের মতো যদি মৃত্যুর শেষদিন অবধি কাছে রাখার নিয়ম হতো, তবে তিনি মেয়েদের বেলাতে তা-ই করতেন। “আলহামদুলিল্লাহ্” স্বরে বধূর রুম থেকে সবাই বেরিয়ে গেলে এবার দ্বিতীয় কার্যের জন্য ব্যস্ত হলো তারা। মসজিদ প্রাঙ্গণে বরপক্ষের কবুল পড়ানোটুকু সমাপ্ত করা হলো একইভাবে। মোহরানা ধার্য এবং অন্যান্য কুশলাদি নির্বিঘ্নতার সাথে সম্পন্ন হল অবশেষে। বিদায়কালে মায়ের হাত ধরে ধরে সিঁড়ি দিয়ে নামা ফিহা একপলকের জন্য ফাহাদের পাশে চাইল। কবুল বলে গ্রহণ করা “স্বামী” নামক পুরুষটি সোফায় বসে টি টেবিলে কিছু একটা সাইন করছে। সিঁড়ির দিকটায় পিঠ দিয়ে থাকায় তাঁর আজকের মুখটি দেখতে পায়নি ও। শুধু একপলকের দেখায় বুঝতে পারছিল ওই স্বভাবসিদ্ধ কালো রঙটা আজকেও ছাড়েনি। গায়ে কালো রঙের শেরওয়ানি চড়িয়েই সে এসেছে।

গাড়ি পর্যন্ত মেয়েকে তুলে দেওয়ার কাজটুকু করে দিলেন নিয়াজ। দোপাট্টায় ঢাকা মেয়ের মুখের দিকে একবার শুধু তাকিয়ে মাথায় হাত বুলালেন নীরবে। কিছু একটা বলতে গিয়েও রুদ্ধ স্বর চিঁড়ে কিছুই বেরুলো না। অতঃপর বিদায় আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে দু দুটো গাড়ি প্রকৃতির কমলা রোদ মাখিয়ে যাত্রা করল। আসরের ওয়াক্ত শেষে শান্ত বিকেলের নির্জনতায় ডান হাত নেড়ে বিদায়ী সম্ভাষণ জানিয়ে দিলেন। গাড়িদুটো দৃষ্টিসীমানার বহুদূর পথে অদৃশ্য হয়ে গেলে নিজের ঘরে যান নিয়াজ। স্ত্রীকে নির্দেশ দেন এক কাপ চায়ের জন্যে। একটা প্রেশারের ঔষুধ খাওয়ার ইচ্ছায় নিজের ঔষুধের বাক্সটা খুলে ফেললে সেখানে দেখতে পান এক খাম চিঠি। চিঠি কোত্থেকে এলো এটা ভাবতে ভাবতেই খামের মুখটা ছিঁড়ে ফেললেন তিনি। টানটান করা কাগজটায় ছোটো ছোটো হস্তাক্ষর দেখে চোখে চশমা পড়লেন নিয়াজ। ঝকঝকে দৃষ্টিতে ফুটে উঠল সুন্দর মুক্তো ঝরা হস্তাক্ষর,  

একজন সৎ বাবা,

জানি এটা কাবিন পরবর্তী বিয়ে। বিয়ের পর একটা মেয়ে বাবার বাড়িতে থাকে না। যেখানে আমার নিঃশ্বাস শুরু, সেখানেই আমি মেহমান। তোমার ঘরে ছেলে হয়ে জন্মাইনি বলে আমার খুব দুঃখ আছে। ছোটো থেকে দেখে এসেছি দাদী আমাকে পছন্দ করতেন না। তিনি সবসময় বলতেন আমি তোমার জন্য ঝোলাভর্তি বোঝা হয়ে এসেছি। আমার তখন কেমন লাগতো সেটা আর বলব না। কিন্তু প্রচণ্ড খারাপ লাগতো আমার। কখনো এমন কিছু করিনি যেটা দ্বারা তুমি বা মা কষ্ট পাও। আমার জন্য সত্যিই এটা দুর্ভাগ্য যে এতো বড়ো হয়ে গিয়েছি, কিন্তু করতে পারলাম না কিছুই। আমার বয়সী কোনো ছেলে থাকলে তোমার ওই ভারি কাঁধদুটোর বোঝা অনায়াসে তুলে নিতে পারতো। সেখানে আমি তোমার সর্বস্ব সম্পদ কেড়ে নিয়ে চলে যাচ্ছি। বাবা, এই ঠুনকো সমাজের নিয়মটা যদি এমন হতো, যেখানে আজীবন একটা মেয়ে থাকবে বাবার কাছে, বাবা থাকবে মেয়ের কাছে, তাহলে চোখ বন্ধ করে আমি তা-ই করতাম। আমি জানি না শেষ বয়সে এসে কীভাবে তোমাদের দিনগুলো কাটবে। কীভাবে আমার মাকে নিয়ে একা একা নিরালার ভেতর গুজরান করবে তুমি। আমরা দুটো মেয়েই তোমাদের নিঃস্ব সর্বস্ব করে দিয়ে চলে যাব। যদি কিছু করতে পারতাম শুধু তোমার জন্য, শুধু তোমাদের মতো দুটো মানুষের জন্য, আমার এই ছোট্ট জীবনে একধাপ দুঃখগুলো বোধহয় ঘুচে যেতো . . 

টিউশনির প্রথম বেতনটা তোমার আলমারির ড্রয়ারে রেখে এসেছি। মা জানে না। তাকে জানিয়ো না। ওগুলো তুমি খরচ করো। সেখানে অল্পকিছু টাকা আছে। বেশি রাখতে পারিনি। গত দু ইদে যেটুকু টাকা পেয়েছিলাম, সেটাও তোমার হিসাবের খাতায় ভাঁজ করে রাখা আছে। মা দেখার আগেই তুমি সময় করে ওগুলো বুঝে নিয়ো। কিছু কথা থাকে, যা কখনো বলা যায় না, মুখ ফুটে জানানো হয় না। সে কথাগুলো বলতে গেলে চোখ ভিজে আসে করুণভাবে। গলা আঁটকে আসে বাজেভাবে, বুকের ভেতরটা দুমড়ে-মুচড়ে ছিঁড়ে যায়। কী অদ্ভুত এক অবস্র্থ চলে তা তো আসলে বোঝানো যায় না। আজ তোমার হাত, তোমার ছায়া, তোমারই স্নেহ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছি। বিদায় নিচ্ছি তোমার বিশ্বস্ত ছায়া কাছ থেকে। দুনিয়ায় হাজারো মানুষ আদর দিয়ে ' মা ' ডাকবে, কিন্তু তোমার মতো মধুর স্বরে কেউ কোনোদিন ডাকবে না। তোমার ক্লান্ত চোখে আজ পানি দেখলাম, তোমার জীর্ণ মুখে কষ্ট, তোমার আদরে বড়ো হয়েছি, তোমারই হাতে আজ ছিন্ন। 

ভালো থেকো। জীবনের কষ্টগুলো তোমার স্বার্থক হোক। এই আমৃত্যু ঋণ চুকাতে পারব না। 

ইতি, 
ঋণী সন্তান,
নাবিলা হক ফিহা। 

•••••••••••••••

ফুলে লাল হয়ে যাওয়া চোখদুটো ঘোমটার আড়ালে ঢাকা। গায়ে মখমলী কাপড়ের খয়েরী নরম চাদর। নববধূর বেশে ওই নরম চাদরটুকুই সমস্ত শীত নিবারণ করে দিচ্ছে। কোত্থেকে গা শিরশির করা শীতালু কামড় এসেছে জানা নেই। ডানপায়ের উপর এখনো কাবু করতে পারছে না। ভাগ্যিস ড্রাইভ করা পুরুষটি বেশ দক্ষ এবং সচেতনতার সাথে আঁকাবাঁকা ভাঙা রাস্তা বুঝে শুনে চালাচ্ছে। এখনো ডানপাশে চোখ ঘুরানোর মতো ভয়াবহ সাহসটি হয়নি। কুণ্ঠা জড়ানো মনটা নিয়ে ভীষণ চুপটি করে বসে আছে। কানে ভেসে আসছে তীব্র বলিষ্ঠ কণ্ঠের কিছু পরোক্ষ ছোট্ট খাটো নির্দেশ—যা মূলত ইংরেজি বাক্যে ভরপুর। মুখ ফুটে বলতেও পারছে না এসির পাওয়ারটা কমিয়ে দিতে অথবা বন্ধ করে দেওয়ার কথাটা। দু-একবার কান্নাভেজা কণ্ঠে নাক টেনে নেওয়ার শব্দ করলেও পাশ থেকে ব্লুটুথে কথা চালানো ব্যক্তিটি শুনতে পেল না। শুক্রবার বলে বিকেলের ব্যস্ত সড়ক বেশ ফাঁকা ফাঁকা, যানজট নেই। পুরোটা রাস্তাজুড়ে ওভাবেই ব্যস্ত সমস্ত কড়া আদেশের ফোনালাপ চালিয়ে একরাশ বেজার মুখ নিয়ে ধানমন্ডির বাড়িতে প্রবেশ করল সাঈদ। গেটের দুই দারোয়ান সালাম ঠুকে গেট খুলে দিলে গাড়িটা ড্রাইভ-ওয়ের জায়গাটুকু অতিক্রম করে গাড়ির পার্ক দোরগোড়ায় এসে থেমে গেল। মুখ ঘুরিয়ে নিজের সদ্য বিবাহিতা স্ত্রীর পানে তাকালে হঠাৎ বুঝতে পারল ওর গায়ে থাকা খয়েরী চাদরটা ভীষণ আষ্টেপৃষ্ঠে ধরে আছে। ব্যাপারটা অনুমান করতেই সঙ্গে সঙ্গে এসির পাওয়ারটা পুরোপুরি বন্ধই করে দিল সে। স্টিয়ারিং থেকে হাত সরিয়ে ঘোমটায় নীচু করে থাকা মুখটির মাথায় আলতো হাত রেখে শুধোলো, 

  - ঠিক আছেন? 

মাথায় অনুভব করা শক্ত হাতের স্পর্শের চাইতে কণ্ঠের ওই চিন্তাটুকুই ভীষণ স্পর্শ করল ওকে। মৃদুভাবে “হ্যাঁ' সূচকে মাথাটা নাড়িয়ে দিলে প্রাপ্ত উত্তরটুকু বুঝতে পেরে হাতটি সরিয়ে নিল সাঈদ। গাড়ি থেকে নেমে সামনের দিকটা আধা পাক ঘুরে বাঁদিকের দরজায় এসে ওরকম প্রশ্রয় মেশানো কণ্ঠে বলল,

  - পায়ে ভর রাখতে পারেন?  

একবার ভাবল পূর্বের মতোই মাথা নাড়িয়ে “না' জবাবটুকু বুঝিয়ে দিবে। কিন্তু কী যেন ভেবে নীচু করে রাখা চোখদুটো নিঃশব্দ ভাবনা কষে কিছুটা স্তিমিত স্বরে জানাল, 

  - হাত ধরলে হাঁটতে পারব। 

একপলক পায়ের অবস্থার দিকে নজর বুলিয়ে মনে মনে অন্য আরেক দুর্ভাবনা নিয়ে ভেবে চলেছে ফিহা। সিঁড়ি থেকে পরে যাওয়ার সময় কিছুটা বিপজ্জনক ভাবে আরেকটি চোট শরীরে লেগেছে। গাড়ির সীটটা ভীষণ আরামদায়ক ও নরম ছিল বলে এতোক্ষণ সেই চোটটা নিয়ে ভয়ংকর সব চিন্তা কাজ করেনি। দুঃসাহস দেখিয়ে নিজেই সীট থেকে নামার চেষ্টা করলে হঠাৎ দুটো বিপজ্জনক হাত ওর হাঁটুদ্বয়ের নীচে, ঘাড়ের কাছে প্রবেশ করে ঝট করে তুলে নিল শূন্যে। ফিহা কিছু বুঝে উঠার আগেই বুঝতে পারল ও এখন বাহুদৃঢ়তার ভেতর আঁটকা, নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তায় আগল দেওয়া ওই শক্ত সৌমর্থ বুকটার অসম্ভব কাছে, ঘোমটায় ঢেকে থাকা নিজের সলজ্জ মুখের ভীষণ নিকটে একপ্রস্থ গরম শ্বাসগুলো অনুভব করতে পারছে। চোখজোড়া এখনো খুলেনি ও। হয়ত চোখ খুলে রাখলে এটাও দেখতে পেতো অতো কাছাকাছি এসেও দোপাট্টার পর্দাটুকু যেন সহ্য করতে পারছে না সাঈদ। পরমা স্ত্রীর মুখটা এমন নির্জনে দেখার দুর্লভ লোভে লোভী হয়ে মুখ নামিয়ে ঘোমটার কাপড়টুকু দু'ঠোঁট দ্বারা চেপে ধরল সে। হাতদুটো বাঁধা না থাকলে হয়ত দুহাতেই সরিয়ে দিতো ঘোমটার আবরণটুকু। অবস্থা প্রচণ্ড খারাপ অনুভব করতেই গলায় শ্বাস আঁটকানোর মতো অদ্ভুত বিহ্বলতায় কুঁকড়ে উঠল ফিহার মন। কী করতে চাইছেন উনি? এই গাড়ি পার্ক করা জায়গায় খোলা আকাশের নীচে এখনই . . ওরকম . . আকণ্ঠ কুণ্ঠায় কুণ্ঠিত হয়ে মুখে রক্ত জমলো ফিহার। অন্যদিকে এককথার জাঁদরেল লোকটা তখন দুঠোঁটের ফাঁকে চেপে ধরা ঘোমটাটুকু এক ঝটকায় সরিয়ে দিতেই নির্মোচন করল স্ত্রীর সলজ্জ মুখ। অনিমেষ চোখদুটো দিয়ে মন ভরে ভরে অপেক্ষমাণ প্রতিটি সময়ের ফোঁকর যেন ভরাট করল সে। দীপের বাড়ি থেকে বিদায়কালীন মূহুর্ত্তেও দেখা দেয়নি নিজেকে, কিন্তু ভেতরে ভেতরে আকাঙ্ক্ষী মন কেমন ব্যগ্র প্রলুব্ধ হয়ে উশখুশ করছিল, তা বুঝতে দেয়নি একদণ্ড। বুকে জমাটবাঁধা কথাগুলো ছেঁকে ছেঁটে একবাক্যেই জানান দিল সে, 

  - আপনাকে মিস করেছি। 

চোখ বুজে রাখা পাতাদুটো মেলে চাইতেই নিঃশব্দ দৃষ্টির মাঝে ধরা দিল নাবিলা হক হয়ে। এতোখানি মিস করেছে বলেই কী সঙ্গে করে একমাসের জন্য এনে ফেলল? আর থাকতেই দিল না এ কদিনের দূর সীমানাতে? মুখের উপর ঝুঁকে থাকা ওই আবেগ বর্জিত স্থিরমুখ কিছুই তখন করল না। মুখ ঘুরিয়ে পিছু থাকা বড়ো গেটের দিকে একপলক তাকাতেই দু দুটো দারোয়ানকে দেখতে পেল যথেষ্ট কর্তব্যপরায়ণ হিসেবে। যাক, এবারের দারোয়ান দুটো অতিশয় ভদ্র এবং সুশীল; প্রাইভেসি জিনিসটা দক্ষভাবেই বোঝে ও জানে। পা চালিয়ে ভেতরে প্রবেশ করতেই সুনশান বাড়ির আনাচে কানাচে হাঁটার পদশব্দ ছাড়া তেমন কোনো আওয়াজ হচ্ছে না। এখনো ফেরেনি দ্বিতীয় গাড়িটির মানুষজন। সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠার সময় শরীরের ওই চোটপ্রাপ্ত স্থানে আর ব্যথা না লাগুক, তাই ডানহাত বাড়িয়ে কালো পান্ঞ্জাবীর কলারটা মুঠোয় চেপেছে ফিহা। সিঁড়ি ভেঙে যত উপরের দিকে উঠছিল, মনে মনে ততই আশ্চর্য হয়ে ভাবছিল, একদিন মেহমান হয়ে এ বাড়ির প্রতিটি ঘরে ঘুরেফিরে এসেছে, দেখেছে, কখনো কিছু কিছু ব্যাপারে হাত ছোঁয়াতে নিজে থেকেই গুটিয়ে গেছে। আর আজ এ বাড়ির একছত্র রাজশ্রী রূপে রাজার একান্ত বাহুশয্যাতেই আবদ্ধ হয়ে সুন্দর ঘরটায় অগ্রসর হচ্ছে। এই নির্জন নিস্তব্ধ শেষ বিকেলের অরুণ রাঙা রক্তিম প্রকৃতির মাঝে আসঙ্গ গ্রন্থি রচনা হবে কী? হবে কী প্রকৃতির বানানো সেই আদম থেকে আসা আদিম এক নিয়মের প্রণয়সঙ্গ? কাঠের আধ ভেজানো দরজাটা বাঁ কাঁধের আলতো ধাক্কায় খুলে ফেললে গলাটা সহসা ভয়ে শুকিয়ে এলো ফিহার। ফ্লোর ছুঁই ছুঁই পর্দা ঝুলোনো জানালায়, বার্নিশে চকচক করা বাদামী রঙের বারান্দার দরজা, শূন্য টানটান পরিচ্ছন্ন বিছানা . . এখন সবই তার। শুধুমাত্র তারই। বড়ো অদ্ভুত কারণে ঘরের ভেতরে না ঢুকেই চৌকাঠের বাইরে থেকে আবারও মুখ নীচু করল জুনায়েদ সাঈদ। কোমল কপালে থাকা গোল ওই টিকলির অলংকার ঠোঁটের দ্বারা সরিয়ে সেখানে বসিয়ে দিল দুই তপ্ত ঠোঁট। বুকের ভেতরে সপাটে আছড়ে পরা অনুভূতিগুলো ফিহার আকম্প অন্দরে এলোমেলো করে ছুটল। ছুঁয়ে থাকা ওই ওষ্ঠ স্পর্শের মাঝে পায়ে পায়ে হেঁটে সাঈদ বিছানার কাছে এসে শুইয়ে দিল বাহু আবেষ্টন রাখা শরীরটুকু। একটা হাত বালিশের উপর ভর হিসেবে রেখে মুখের উপর খানিকটা ঝুঁকে আশ্বস্ত করা কণ্ঠে বলল, 

  - ঘর থেকে বের হবেন না। একটু পর সবাই চলে আসবে। রেস্ট নিন। 

কথাটা শুনে হঠাৎ মনে হলো সে এখন চলে যাচ্ছে। কপাল কুন্ঞ্চন করা কৌতুহল বিদ্ধ চোখে ফিহা জিজ্ঞেস করল, 

  - আপনি কোথায় যাচ্ছেন? 

  - কাজ আছে। 

  - আজ শুক্রবার! 

  - অফিসে যাচ্ছি না। বাইরে কিছু কাজ আছে। সাম আনসর্টেড ওয়ার্ক। থাকুন। 
  
এ দফায় আর কিছু বলার মতো খুঁজে পেল না ফিহা। শুক্রবার অফিস বন্ধ থাকা একজন লোক ওই শেষের কথাগুলো দ্বারা কী বোঝাল তাও ঠিক বুঝে উঠতে পারেনি। ওর প্রশ্ন জর্জরিত মুখের পানে চেয়ে সাঈদ চতুর একটা ইঙ্গিত ছেড়ে বলল, 

  - আপনি আমার সিচুয়েশন বুঝলে শুক্রবারের রেসপেক্টটা করতেন। নিজের প্রতি খেয়ালটাও রাখতেন। আপনি কোনোটাই রাখেননি। এভাবে পা ফ্র‍্যাকচারের অজুহাত দেখিয়ে আপনাকে কোলে তুলতে হতো না। যে কারণে আপনাকে এমনিই কোলে তুলে আনতাম, সেটা এতোক্ষণে আমার কাজে কর্মে ভালোভাবে বুঝে যেতেন। আই উইল কাম ব্যাক স্যুন। টেক রেস্ট। 

ঝুঁকিয়ে রাখা মুখ, বাঁ হাতের ভর উঠিয়ে একপ্রস্থ মন খারাপ করা প্রশ্ন ছেড়ে সাঈদ বেরিয়ে গেল। দরজা বন্ধ করে অখণ্ড নীরবতার ভেতর রেখে গেল ফিহাকে। একটুপর ফিহা শুনতে পেল গাড়ির ভুম ভুম শোরযোগে চলে যাওয়া শব্দগুলো। জানালা দিয়ে আসা দিনের ফ্যাকাশে আলোয় ম্লান হয়ে আছে সদ্য নববধূর মুখ। 

••••••••••••••

শূন্য হয়ে যাওয়া ছোটোবোনের ঘরটা গুছিয়ে দিচ্ছে ফিমা। আজকের পর ওর ঘাড় থেকে একমণ টেনশনের বোঝা নামলেও কতদিন সত্যটা গোপন রাখতে পারবে জানা নেই। বাবার কান অবধি যদি ওই সত্যটা পৌঁছে যায়, তাহলে বাবা এক্ষুণি ওর গলা কেটে শীতলক্ষ্মার নদীতে ভাসিয়ে দিয়ে আসবে। এতো বড়ো অপকর্মের পর সুস্থভাবে বেঁচে থাকা যায় কিনা সেটাও এক প্রশ্ন। যদি ফিমা জানতো ওর একটা ভুল পদক্ষেপের জন্য পুরো জীবন ধ্বংসের মুখে পতিত হবে, তবে কক্ষনো বন্ধুদের প্ররোচনায় সাজেক ট্যুরে যেত না। বারবার ফিহার নিষেধ করা বাক্যগুলো যদি রাগ দেখিয়ে বুক চিতিয়ে দমিয়ে না দিতো, তবে হতো না এই মহা ভুল। ভয় ঘনানো দুশ্চিন্তার ভেতর বিকট শব্দযোগে বেজে উঠল ফোন। সামান্য রিংটোনে পিলে চমকে উঠার মতো কেঁপে উঠলে তাড়াতাড়ি ফোনটা হাতে তুলল সে। কলার নামটা দেখে বুক শুকিয়ে এলো। ঘণ্টা দুয়েক আগেই যাকে চোখের সামনে থেকে বিদায় দিয়ে এলো, সেই ব্যক্তি এখন বিবাহিতা স্ত্রী রেখে কল দিচ্ছে? তাড়াতাড়ি ঘরের দরজাটা বাড়তি সতর্কতার জন্য বন্ধ করে আবারও বিছানার কাছে এসে থামল, 

  - হ্যা-হ্যা-হ্যালো . . .

  - নীচে নাম। তোর মাকে বলবি অমুক ফ্রেন্ড তোকে অ্যাসাইমেন্ট দেওয়ার জন্য মেইন রোডে ডেকেছে। তুই ইম্পর্ট্যান্ট অ্যাসাইমেন্ট শীটটা নেওয়ার জন্য যাচ্ছিস। ঠিক আধঘণ্টার ভেতর ব্যাক করবি। বাসায় টেনশন না করতে। 

  - ঠিক আছে, আমি আসছি। 

  - সঙ্গে করে ওর সেলফোনটাও আনবি। ওটা ভুল করে রেখে আসবি না। 

  - আচ্ছা ওটাও আনব। 

  - স্পটে এসে কল দে। আমাকে অপেক্ষা করাবি না। আমি আর্জেন্ট বাসায় ফিরব। 

  - ওকে ভাইয়া, লেট করব না। আমি আসছি। 

কান থেকে ফোন নামিয়ে তৎক্ষণাৎ হুড়মুড়িয়ে নীচে যেয়ে দুগ্লাস ঢকঢক করে ঠাণ্ডা পানি খেল। তৃষ্ণা নিবারণের চাইতে ভয় নিবারণের জন্যই যেন গলাটা খাঁ খাঁ করছিল। ফিহার ফোনটা মায়ের তত্ত্বাবধানে থাকায় মায়ের রুমে চুরি করে ঢুকে ড্রয়ার থেকে ফোনটা গুম করে বেরুল। বাবা বাথরুমে, হাতমুখ ধুচ্ছে। মা রান্নাঘরে এঁটো বাসনগুলো সিঙ্কে পরিষ্কার করছে। কেউ দেখেনি, বাঁচা গেল। এই ফাঁকে তোড়জোড় করে কাঁধে ওর ভার্সিটি ব্যাগ ঝুলিয়ে গলা উঁচু করে বলল, 

  - মা? আমি আধঘণ্টার ভেতর আসছি। সামান্তা কলেজের কিছু অ্যাসাইমেন্ট এনেছে, ওগুলো নিতে গেলাম। টেনশন করার দরকার নেই। 

রান্নাঘর থেকে নাজনীন পুরো কথাটা শুনতে শুনতেই ভ্রুঁ খিঁচিয়ে “কোথায় বেরুচ্ছিস? এখন সন্ধ্যা . . ” বাকি কথাগুলো আর কর্ণগোচর হলো না ফিমার। ত্রস্তপায়ে বাড়ির বাইরে এসে অস্থিরপায়ে মেইনরোডের দিকে পা বাড়াল সে। যদি দশ মিনিটের মাঝে একমিনিটও দেরি করে পৌঁছয়, তাহলে আরেক স্তবক ঝাঁজালো ধমকানি শুনতে হবে ওর। এতোদিন চোখের এতোটা সামনে থাকা সত্ত্বেও নূন্যতম ভয় কাজ করেনি, বরং দুর্মর সাহসের মাত্রা যেন তিরতির করে বেড়েই গেছে। আর এখন কিনা অসুরের মতো ভয় লাগে তার আসল রূপটা দেখার পর। প্রচণ্ড ভয়! পাক্কা দশমিনিটের মাথায় মেইনরোডের উলটোপাশে একসাইডে পার্ক করে রাখা কালো গাড়িটা দেখতে পেল ফিমা। ব্যস্ত রাস্তার দুদিকে খেয়াল করতেই এবার দ্রুতবেগে রাস্তা ক্রস করে গাড়ির ড্রাইভিং সীটের পাশের দরজাটা খুলতে চাইল। কিন্তু তার আগেই একজোড়া অপলক চোখ শান্ত ইশারায় বুঝিয়ে দিয়েছে তাকে পেছনে গিয়ে বসতে। পাশে নয়। অর্ধেক খুলে ফেলা দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে পেছনের ব্যাকসীটে উঠে বসলো ফিমা। ব্যাগ থেকে তড়িঘড়ি করে বের দিল ফিহার স্মার্টফোন। বাইরে সন্ধ্যে ঘনিয়ে প্রতিটি মসজিদের মাইকে মাইকে মাগরিবের সুরেলা আযান শুরু হয়েছে। জানা নেই কোথায় নিয়ে যাচ্ছে এই লোক। এই সন্ধ্যা, অন্ধকার নামা অবস্থায় গাড়ির ভেতরে থাকা লাইটটা জ্বালিয়ে দিতেই সামনের ওই চারকোণা আয়নায় দৃষ্টি আঁটকালো ফিমার। একহাতে স্টিয়ারিং সামলে কালো শেরওয়ানি পড়া কট্টর সুদর্শন লোকটা নীচের ঠোঁট কামড়ে আছে। কপালে তাঁর মৃদু কুন্ঞ্চন। কিছু যে একটা নিরবচ্ছিন্ন ভাবে ছকে চলেছে তা অনুমান করা সম্ভব। গাড়িটা কিছুদূর এগিয়ে ডানে মোড় নিয়ে বিসিক এরিয়ার পরিত্যক্ত একটা ফ্যাক্টরির সামনে থামল। চারপাশে কঠিন নীরবতা, আযান শেষ হয়ে সন্ধ্যের আঁচল আকাশের বুকটা ঢেকে দিয়েছে। দুটো শ্বাপদ চক্ষুর মতো জ্বলজ্বল করতে থাকা হেডলাইটের আলোয় সামনে যা দেখতে পেল, তা দেখে রক্ত হিম হয়ে গেল ফিমার! অপ্রত্যাশিত ঘটনার মোড়ে চোখ বড়ো বড়ো করে চমকানো চাহনিতে মুখ হাঁ করে ফেলল। কখন যে ভয়াবহ শ্বাসকষ্টের মতো জোরে জোরে শ্বাস নিতে শুরু করেছে সে হুঁশটুকুও নেই। কানে আদেশসূচকে সাঈদের সেই আসলরূপী কণ্ঠটা শুনতে পেল ফিমা,  

  - ডোন্ট ট্রায় টু ওয়েস্ট মাই টাইম ফিমা। আই হেভ টু গো! 

ফিমা গাড়ি থেকে বের হতেই কিছুটা দূরে দেখতে পেল একটা র‍্যাবের গাড়ি। গাড়ির দরজা খুলে বের হয়ে এলো র‍্যাবের অফিশিয়াল পোশাক পড়া একজন কর্মকর্তা। মাথায় কালো টুপি। বুকের ডানদিকে ছোট্ট নেমপ্লেটে লেখা “ইয়ামিন”। সাঈদ সেই কর্মকর্তার সাথে প্রোফেশনাল ভঙ্গিতে হ্যান্ডশেক করতেই চোখের নিমিষে চরম ক্রুদ্ধ হয়ে উঠল সেই র‍্যাব, 

  - বাটপার শা° লা! কই ভাবছি ধুমধাম করে বিয়ে খাব। তুই তো শা° লা নো বলে একা ছক্কা হাঁকায় বসে আছস! '

কথাগুলো বলতে বলতেই সটানে বুকে জড়িয়ে ধরল বন্ধু বর সাঈদকে। বহুদিন পর সাক্ষাৎ পাওয়া বন্ধু ইয়ামিন আদিবকে গম্ভীরতা নিয়েই প্রত্যুত্তর করল জুনায়েদ সাঈদ, 

  - সবাইকে মনে হয় না সেপারেটলি ইনভাইট করতে হবে। তোদের সবাইকে আসতে বলেছিলাম। একেকজন বিজি স্ক্যাজিউলে আঁটকা পরলে আমার এখানে কোনো দোষ নেই। 

দুই বন্ধুর অবস্থা দেখে ফিমা অবাক, হতবাক, বাকরুদ্ধ হয়ে ঢোক গিলছে। পাঁচ বন্ধুর ভেতর আরেক বন্ধু কিনা পেশায় “র‍্যাব” কর্মকর্তা! যেই র‍্যাবদের দূর থেকে দেখলে আত্মারাম বাবাজি উড়াল দেওয়ার জন্য পাঁয়তারা করতে থাকে, সেই সাক্ষাৎ যমদূত কিনা সাঈদ ভাইয়ের বন্ধু! কী ভয়ংকর চিত্র খোদা! সংক্ষিপ্ত কুশলাদি শেষ করে এবার ফিমাকে তর্জনীর ইশারায় কাছে আসতে বলল আদিব। ভয়ে ভয়ে ফিমা সামনে এসে দাঁড়াতেই আদিব পকেট থেকে প্রিন্ট করা কাগজের একটা ছবি সামনে ধরল, 

  - মিস ফিমা, একে চিনেন নাকি দেখেন তো। চিনলে বলেন। 

ফিমা কিছু সেকেন্ড খরচ করে ছবি থেকে চোখদুটো র‍্যাবের দিকে ফেলল। মাথা নাড়িয়ে সম্মতির স্বরে জানান দিল, 

  - চিনি। 

  - নামটা প্লিজ বলবেন? আপনার মুখ থেকেই শুনি। বলেন। 

 একপলক দৃষ্টি ঘুরিয়ে সাঈদের ভ্রুঁ কুঁচকানো মুখের দিকে চেয়ে আবারও র‍্যাবের পানে জবাব ছুঁড়ল, 

  - আআফিফ। 

  - আফিফ ইসলাম? 

  - হ্যাঁ। 

  - আপনার “ওই” ভিডিয়োটা অন এয়ারের পেছনে এই ছেলেরই হাত? 

  - হ-হ. .হ্যাঁ।

  - কী কারণে আপনার বোনের পেছনে প্রতিশোধ তুলতে চাইছিল? সেদিন তো আপনার তখন বাসে থাকার কথা ছিল, তাই না মিস? 

এই পর্যায়ে মুখ থুবড়ে পরার মতো মাথা নীচু করে ফেলে ফিমা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অধিভুক্ত সাত কলেজের ইডেন প্রতিষ্ঠানে যখন ভর্তি হয়, তখন থেকেই আফিফ ইসলামের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ যোগাযোগ। যোগাযোগ শুরু হওয়ার মাধ্যম সোশ্যাল সাইট হলেও পরবর্তীতে সেটা পাকাপাকি হয় দেখা সাক্ষাতের মাধ্যমে। আফিফ বেসরকারি একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে মাস্টার্সে তখন অধ্যয়নরত, দেশ ছেড়ে বাইরের দেশে স্যাটেল হওয়ার জন্য কষে পরিকল্পনা করে যাচ্ছে। বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কটা কখন কীভাবে অন্য সম্পর্কে রূপ নেয় তা আজও ওর অজানা। তবে শুরু থেকেই এ সম্পর্কের ব্যাপারে ধরা পড়ে যায় ছোটোবোন ফিহার কাছে। প্রথমদিনেই ফিহা কড়ায় গণ্ডায় শক্ত গলায় জানিয়ে দিয়েছিল, 

  - তুমি যার সাথে রিলেশন চালানোর চেষ্টা করছ আপু, তার ব্যাপারে আরো খোঁজখবর নাও। এভাবে ঠাস করে সম্পূর্ণ অচেনা একজন ছেলের সাথে যেখানে সেখানে ঘুরতে যেয়ো না। তুমি কী জানো ওই ছেলেটার পরিবার কেমন? জিজ্ঞেস করেছ কোনোদিন? না জেনে কীভাবে প্ল্যান করছ সাজেকের ট্র‍্যাকে ওই ছেলেটার সাথে ঘুরার কথা? 

সেদিন ঠাস করে ছোটোবোনের ডান চোয়ালে চড় মেরেছিল ফিমা। কিন্তু আজ ওর মনে হচ্ছে সেই চড়টাই যেন উলটো সপাটে নিজের গালে ফিমার পরেছে। যদি বুঝতো, ওই ছেলে আবেগ অনুভূতির মিঠে মিঠে বুলি দ্বারা অন্যকোনো প্রপন্ঞ্চ করতে ব্যস্ত, তবে ওই পা° ষা ণটা পোশাক বদলানো ভিডিয়োটা কক্ষনো ধারণ করতে পারতো না। 

  - মিস ফিমা, আপনি থম মেরে শুধু শুধু সাঈদের সময়টা নষ্ট করছেন। ও কিন্তু আপনার মতো খালি হাত-পা নিয়ে বসে নেই। আপনার এই জবানবন্দ তামাশা শেষ করে তাড়াতাড়ি বাড়ি ফেরার চিন্তা করেন। বলেন এখন। 

এতোক্ষণ পুরোনো ভাবনার খোলস থেকে বের হয়ে গলা খাকারি দিল ফিমা। পুনরায় চোখ তুলে স্বাভাবিক মুখভঙ্গি করে বলল, 

  - আমাকে অনেকদিন ধরেই শাষাচ্ছিল। একদিন রাতের বেলা পড়তে বসেছি, তখনও আমাকে কল দিয়ে ইচ্ছেমতো কথা শোনাতে শুরু করে। আমার বোন আমার পাশেই ছিল। ওর একটা বাজে ধরণের সমস্যা আছে। একবার ও চটে গেলে সামনে কে আছে ওটা কখনো বাছ বিচার করে না।

এতটুকু বলতেই স্বাভাবিক নিঃশ্বাস নেওয়ার জন্য কিছুটা থামল ফিমা। গলা ভিজিয়ে আবারও কথাগুলো প্রস্তুত করতে থাকলে সাঈদের মনে তখন একটা কথা গভীরভাবে আঁচড় কাটল। বারবার, অগণিতবার ওই বাক্যটা মনের ভেতরে তর্জমা করল সাঈদ। “একবার ও চটে গেলে সামনে কে আছে ওটা কখনো বাছ বিচার করে না।” এর মধ্যে আবারও ফিমা বলতে শুরু করে দিল,

  - আফিফের আচরণ সেদিন মোবাইলের বাইরে থেকে এতোটা রুডলি বোঝা যাচ্ছিল যে ফিহা বুঝতে পারে আমাকে বাবা-মা তুলে গালি দেওয়া হচ্ছে। সেখানে আমি আর কিছু করব বা বলব, ও আমার কাছ থেকে ফোন কেড়ে নিয়ে সেদিনই আফিফকে চরমভাবে অপমান করে দেয়। আমি আগেই বলে নিচ্ছি, ও কিন্তু অশালীন ভাষায় কথা বলেনি। যা বলেছে সেটা যেকোনো মানুষের পিণ্ডি চটকে দেওয়ার জন্য এনাফ ছিল। ও তখনো ভিডিয়োর ব্যাপারে কিছুই বলতে গেলে জানতো না। জানলে হয়ত সেদিন আমার পক্ষে কথা না বলে চুপই থাকতো। আর আফিফকেও কিছু শোনাতো না। আমি বাসের ওই ব্যাপারে কিছু করিনি স্যার। আমি কিছুই জানতাম না। 

কণ্ঠ আর্দ্র হয়ে আর কিছুই তেমন বলতে পারল না ফিমা। নতমুখে চোখ ভিজে আসা পানিটা মুছতে থাকলে ইশারায় আদিবকে থামতে বলল সাঈদ। ওকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে তারও এখন বাড়িমুখো ফিরতে হবে। হাতে আজ অফুরন্ত সময় নেই। আদিব বন্ধুর ইশারায় সমর্থন জানিয়ে ফিমাকে সেদিনের মতো ইস্তাফা জানিয়ে যেতে বলল। চোখ মুছতে মুছতে ও গাড়িতে উঠে বসলে সাঈদ আর দেরি করল না। আধঘণ্টার জায়গায় দেড়ঘণ্টা লেগে যাওয়ায় হয়ত ফিমা ছোটো আন্টির কাছে মারদাঙ্গা বকা খাবে, কিন্তু তবু ওকে বিন্দুমাত্র বাঁচানোর মতো দয়ামায়া কাজ করছে না সাঈদের। একদণ্ড নয়।  

•••••••••••••

টইটুম্বর জোৎস্নার আলো ফিনকি দিয়ে ছড়িয়ে পরেছে রাতের শান্ত শহরটায়। দূরের বিল্ডিংগুলোতে পিছলে পরেছে রূপোলি ছটা। সেখানে ফুটে আছে ধোঁয়া জড়ানো ঝাপসা দৃশ্য। যেন ফুঁ দিলেই সমস্ত ধোঁয়া উবে গিয়ে পরিষ্কার হবে জায়গাটা। সুফিয়া খালার সাহায্যে হাত ধরে ধরে বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছে ফিহা। বাঁপায়ে সম্পূর্ণ ভরটা রেখে ডানপা আলগা করে রাখা। ফ্র‍্যাকচার হিসেবে ঘোষণা দেওয়া পাটা আসলে হাড় ভাঙা অবস্থার মতো গুরুতর হয়নি। তবু যদ্দুর ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে তাতে সবাই ঘুরিয়ে ফিরিয়ে ফ্র‍্যাকচার শব্দ দ্বারা বেডরেস্টের পরামর্শ দিয়েছে। এই জায়গাটা এতো অদ্ভুত ধরণের ঠাণ্ডা ও নির্জন যে প্রকৃতির মাঝে জোৎস্নার বন্দনা দেখতে দেখতে সময় গুজরে যায়। চোখ বুজে বাকি ইন্দ্রীয় দ্বারা অনুভব করতে পারল, এই মূহুর্তে একটা গাড়ি প্রবেশ করেছে এবং গাড়িটির মালিক জোরে একটা নির্দেশ ছুঁড়ে বলল, 

  - এই সাইডের লাইটদুটো বন্ধ করে দিন। বাড়তি আলো লাগবে না। 

ঝপ ঝপ করে বারান্দা মুখোমুখি ফর্সা লাইটগুলো নিভে গেলে কেমন একটা চাপ চাপ অন্ধকারে ঢাকা পড়ল ওটা। তবু সে অন্ধকার ফুঁড়ে জায়গা করে নিল চাঁদের গা চুয়ে পড়া আলো। হঠাৎ কয়েক মূহুর্ত পেরিয়ে যেতেই দরজার নব মোচড়ানোর শব্দটুকু শুনতে পেল ফিহা। বিকেল, সন্ধ্যা, রাতের নয়টা পেরোনো সময়টায় তাঁর আসা বুঝি এখন হলো। টাস করে রুমের লাইট নেভানো শব্দটা পেতেই পায়ের তলায় যেন ঠাণ্ডা ছোবল লাগল ওর। চোখ মেলে নিজেকে স্বাভাবিক দেখানোর অভিনয়ে আকাশ পানে নিবিষ্ট হলো চোখ। সেই সঙ্গে টের পেল ওর বাঁদিকটা দখল করে দাঁড়িয়ে পরেছে সুদীর্ঘ মূর্তি। তাঁর দিকে ফিরে না চাইলেও বুঝতে পারছে, তাঁর ঠাণ্ডা প্রলুব্ধ চোখদুটো ওর মুখের দিকে স্থির। সহসা ও অনুভব করল, ভীষণ সন্তর্পণে ওই বিপজ্জনক হাতটা বাঁদিক থেকে কোমর বেষ্টন করে ডানদিকটায় থেমেছে। লজ্জায় ডুবো ডুবো চোখটা নত করতেই দেখতে পেল, পেটের ডানদিকটায় সাড়াশির মতো হাতটা রেখে দিয়েছে। ঢোক গিলে নীচের ঠোঁটে জিভ বুলাতেই পাশ থেকে ধীরকণ্ঠে প্রশ্ন ছিঁটকে এলো, 

  - রেস্ট না নিয়ে ব্যালকনিতে কি করছেন? 

বুজে আসা স্বরটা ধাতস্থ করে জবাব ছুঁড়ল ফিহা,

  - শুয়ে থাকতে থাকতে বিরক্ত লাগছিল। এখানে এসে দাঁড়িয়েছি বেশিক্ষণ হয়নি। 

  - ওহ। পায়ের ব্যথা সেরে গেছে? 

  - সুফি খালার হাত ধরে এসেছি। 

  - এই রুমে কী আপনি আগেও এসেছেন? 

হঠাৎ এমন বেখাপ প্রশ্নের মানেটা বুঝতে পারল না ফিহা। মুখ ঘুরিয়ে বাঁপাশে চাইতেই সাঈদের মুখ দেখে মজা, দুষ্টুমি করা বা অন্যকোনো হেতু বোঝা গেল না। ফিহা কৌতুহল নিয়ে স্বাভাবিক সুরে জবাবটা রাখল, 

  - জ্বী . . অল্পক্ষণের জন্য। আপনার কফিম্যাট জারটা নিয়ে যাওয়ার সময় এসেছিলাম। 

এবার মুখের গম্ভীর অবয়ব যেন চাপা কৌশলে বদলে গেল সাঈদের। বাঁ ভ্রুঁ উঁচু করা তীক্ষ্ম কুটিল চাহনিতে ফিহার উচ্চতা বরাবর মুখ নীচু করে শুধোল, 

  - কফিম্যাট জারের উপর কিছু কী ছিল নাবিলা? মনে আছে দ্যাট নোটচিট? 
.
.
.
চলবে......................................................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

WhatsApp