স্বামী'র কথায় স্তব্ধ হয়ে গেল আকলিমা!আলম স্বভাবতই খারাপ।জঘন্য আচরণ ছাড়া ভাল কিছু তাঁর থেকে আশা করা যায় না।যত'ই রাগ,জেদ থাকুক তবুও কোনোদিন অগ্নিলা'র জন্ম তুলে এরকম বিশ্রীরকম কথা বলেনি সে!ঘৃণা'র দৃষ্টি ফেলে স্বামী'র দিকে তাকিয়ে বলল আকলিমা,
"আপনি তো সব'ই জানেন!এরপরেরও এতবড় কথাখান কইতে কলিজা কাঁপলো না আপনে'র?ছিঃ!পাপ আপনারে অন্ধ করে দিছে।আমার মাইয়া ফুলের মতো নিষ্পাপ!
আকলিমা'র কথার প্রতিউত্তরে কিছু বলল না আলম। তার সর্ব শরীর কাঁপছে ক্রোধানলে!উঠে হনহন করে চলে গেলে সে।
••••••••••
সময় দুপুর একটা বাজে প্রায়।গাড়ি এসে পৌঁছেছে সাজেক ভ্যালি।পাশে'ই জবুথবু হয়ে বসে আছে অগ্নিলা।চোখদুটো ভীষণ রকম লালচে হয়ে আছে।মাঝ রাস্তায় বাতাস থেকে রক্ষা করতে'ই মেয়ে'টাকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে নিয়েছিল জুবরান।খানিকক্ষণ আগে সরে বসেছে অগ্নিলা।দৃষ্টি নিচু তার।জুবরান বেশ কয়েকবার কথা বললেও কোনোরকম উত্তর দেয়নি সে।তীব্র অসস্থি'তে পরেছে জুবরান।মেয়েটা তাঁকে মনে মনে চরিত্রহীনে'র তমকা দিয়ে বসে আছে কিনা কে জানে।এরকম বাজে ট্যুর বোধহয় আর জীবনেও হয়নি জুবরানে'র।গাড়ি'র ভাড়া মিটিয়ে দিয়ে বলল সে,
" এবার যে কোনো একটা রিসোর্টে রুম দেখে নিন।আশা করি আমার আর সাহায্যের প্রয়োজন হবে না।
কথাটুকু বলে'ই হাঁটা ধরলো জুবরান।অগ্নিলা ঠাঁয় দাঁড়িয়ে তাকিয়ে রইল জুবরানে'র যাওয়ার পানে।খানিকক্ষণ আগে বেশ দায়িত্ববান'ই মনে হয়েছে লোক'টাকে।হুট করে'ই এমন নির্দয়ে'র মতো আচরণ করার কারণটুকু বুঝতে পারছে না।এখানকার কিছুই তো চেনে না অগ্নিলা।তাঁর উপর মাথা বেগতিক ঘুরছে।মনে হচ্ছে জ্বরের প্রকোপে যে কোনো সময় লুটিয়ে পরবে মাটিতে।বেশ জড়তা নিয়ে'ই ডাকল জুবরান'কে।চলন্ত পা দু'টো থেমে গেল জুবরানে'র।পিছু ফিরে তাকাল সে।নিষ্প্রভ দৃষ্টি ফেলে তাকিয়ে আছে অগ্নিলা।শরীর যেন টলছে।জুবরান বেশ ভাল করে'ই জানে মেয়েটির গাঁ থেকে জ্বর নামেনি।একমূহুর্তে'র জন্য নিজেকে নির্দয় লাগল।ধীর পায়ে এগিয়ে আসল সে।মলিন মুখখানা নিয়ে বলল অগ্নিলা,
"আমি তো কিছুই চিনি না।যদি কোনো রিসোর্টে একটা রুম বুক করে দিতেন তাহলে উপকার হতো।মনে হচ্ছে এভাবে বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে পারব না আমি।
জুবরান খেয়াল করলো কথা বলার সময় কন্ঠস্বর কাঁপছিল অগ্নিলার।চোখমুখের আদল বলে দিচ্ছে ঠিক নেই সে।অগত্যা আর কথা বাড়াল না জুবরান।অগ্নিলা'কে নিয়ে রিসোর্ট খুঁজতে চলে গেল।এ যাবৎ একটাও খালি রুম মিলল না।অনেক্ক্ষণ ঘুরলো দুজন।হতাশা সর্ব মুখ গ্রাস করে নিল অগ্নিলার।তপ্ত শ্বাস ফেলে বলল জুবরান,
" এখানে আসার আগে রুম বুকিং করে আসতে হয়।এভাবে হুট করে এসে রুম পাবেন না আপনি।চাইলে আমার রুম'টা নিয়ে নিতে পারেন।আমি আসার আগে রিসোর্টে রুম বুকিং করে এসেছিলাম।
"তাহলে আপনি কোথায় থাকবেন?
" দেখি আজকে'র মধ্যে রুম খালি হয় কিনা।আপনি অসুস্থ আপাতত রুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নিন।চলুন আমার সঙ্গে।
অগত্যা আর কথা বাড়াল না অগ্নিলা।জুবরান'কে অনুসরণ করলো।খানিকটা পথ যেতেই সম্মুখে দেখা মিলল টিন,বাঁশের তৈরি সারিবদ্ধ ঘর।সেদিকেই এগিয়ে যাচ্ছে জুবরান।প্রবেশ ধারে বড়ো করে লেখা ‘ঝিঁ ঝিঁ পোকার বাড়ি’।রিসিপশনে গিয়ে কিছুক্ষণ কথা বলল জুবরান।আশপাশ'টা ভাল করে দেখছিল অগ্নিলা।সম্পূর্ণ রিসোর্ট'টাই বাঁশে'র তৈরি।দূরে পাহাড় দেখা যাচ্ছে অনায়সে!চারিদিকে শুভ্র,ধূসর মেঘে'র ছড়াছড়ি!ঈষৎ এক ঠান্ডা বাতাস লেপ্টে যাচ্ছে শরীরে।অত্যল্পকালে প্রকৃতির রূপে যেন নিজেকে হারিয়ে ফেলল অগ্নিলা।ঘোর কাটল জুবরানে'র ডাকে।হাতে চাবি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সে।নিচে রাখা ব্যাগ'টা নিয়ে ফের জুবরানে'র পেছন পেছন ছুটল অগ্নিলা।রুমে'র দরজার উপরে লেখা ’ঘাসফড়িং’!ব্যাপার'টা বেশ চমৎকার লাগল অগ্নিলার।তারমানে রুম'টারও একটা সুন্দর নাম দেওয়া হয়েছে!রুমে'র ভেতর অব্ধি গেল না জুবরান।সে জানাল খাবার আর অগ্নিলার জন্য ঔষধের ব্যবস্থা করতে যাচ্ছে সে।ভেতরে ঢুকতেই রুম ঘুরে দেখা'র শক্তি পেল না অগ্নিলা।মাথা যেন বড্ড ভার হয়ে আছে।কাল থেকে জার্নি,ভেজা জামা গাঁয়ে শুকিয়েছে।ব্যাগ খুলে একটা জামা নিয়ে ওয়াশরুমে চলে গেল সে।হাত মুখ ধুঁয়ে এসে খাটে শুয়ে পরলো।শরীর একেবারে নিঃশক্তি হয়ে বিছানায় মিইয়ে গেল অত্যল্পকালে!
◼️
সময় বিকেল চার'টা।আঁধো চোখ মেলে তাকাল অগ্নিলা।আচমকাই অনেক'টা শীত শীত অনুভব হলো অগ্নিলার।মাথা তুলতেও বড্ড কষ্ট হচ্ছে।পাশে থাকা টেবিলে খাবার দেখে হকচকিয়ে উঠলো সে।উঠে বসতে'ই দেখল বেলকনিতে দাঁড়িয়ে আছে জুবরান।তৎক্ষনাৎ দরজার দিকে তাকাতে'ই দেখলো হাঁট করে খোলা।কপালে হাত রেখে চোখ বুজে প্রলম্বিত শ্বাস ফেলল।তখন মনের ভুলে দরজা আঁটকাতে'ই ভুলে গিয়েছিল সে।মৃদুস্বরে জুবরান'কে ডাকল।পিছু ফিরে তাকাতে'ই দ্রুত রুমে চলে আসল জুবরান।চিন্তিত স্বরে বলল,
"টানা তিনঘণ্টা যাবৎ ঘুমাচ্ছিলেন।খাবার,ঔষধ কিছু'ই খাওয়া হয়নি।দরজা'টাও লাগাননি।আপনার কি বেশি খারাপ লাগছে অগ্নি?
অগ্নিলা দু'দিকে মাথা নেড়ে ‘না’ বলল।খাবার দেখতে'ই যেন ক্ষিদে পেয়ে গেল তাঁর।হাত বাড়িয়ে খাবার নিতে নিতে বলল,
" আপনি কি রুম পেয়েছিলেন?
কথার প্রসঙ্গ পাল্টে বলল জুবরান,
"খাবার শেষ করে তাড়াতাড়ি ঔষধ টা খেয়ে নিন।হ্যালিপ্যাড যাব আপনাকে নিয়ে।সূর্যাস্ত দেখতে।এক্ষুনি বেরোতে হবে।নয়তো সন্ধ্যা নামলে সব ভেস্তে যাবে।
খাওয়ার মাঝে'ই জুবরানে'র পানে তাকাল অগ্নিলা।অনেক'টা সহজ ভাবে'ই কথা বলছে জুবরান।দ্রুত খাবার শেষ করে ঔষধ খেয়ে নিল অগ্নিলা।নিজের দিকে তাকাতে'ই দেখল বেশ সাদামাটা গাঢ় সবুজ রঙা থ্রিপিস।এরচেয়ে ভাল জামা নিয়ে আসেনি সে।আপাতত এটা পরে'ই যেতে হবে তাঁকে।
••••••••••
পাহাড়ি আঁকাবাকা রাস্তা।সামনে'ই ছোট টিলার মতো।অগণিত লোকের ভিড় বাট্টা।বেশিরভাগই ছবি তোলায় ব্যস্ত।যতদূর চোখ যায় বিশাল ভূধর'কে ঘিরে ঘন কুয়াশার মতো মেঘমালা!শীতল বাতাস শরীর হীম করে দিচ্ছে!জুবরানে'র পরনে নীল রঙা জিন্স,সাদা টিশার্টে'র উপর লেদারের জ্যাকেট।বেলা গড়িয়ে বিকেল হচ্ছে।উৎসুক জনতার ভীড় সূর্যাস্ত দেখায়।বেশ আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে আছে অগ্নিলা।পাশে'ই জুবরান দাঁড়িয়ে আছে।আচমকা একদম যুবক এসে ঘিরে ধরলো জুবরান'কে।তার রেডিও শো নিয়ে প্রশংসা করতে লাগলো।সবার সঙ্গে'ই বেশ হাসিমুখে কথা বলছে জুবরান।খানিক'টা দূরে সরে দাঁড়াল অগ্নিলা।দৃষ্টি বলিষ্ঠ দেহি জুবরানে'র পানে।শেষ বিকেলের ফিকে হয়ে যাওয়া আলোয় বেশ মায়াবী লাগছে তাঁকে!কপালে পরে থাকা ফিনফিনে চুলগুলো বাতাসে দুলছে।হাঁসলে বাম গালে টোল পড়ে ছেলেটার!অদ্ভুত সুন্দর লাগে দেখতে।আচমকা জুবরান তাকাতে'ই দুজনের চোখাচোখি হলো।দ্রুত দৃষ্টি সরিয়ে দূর পাহাড়ে রাখল অগ্নিলা।ঠান্ডা বাতাস গাঁ কা-টা কা-টা করে তুলছে!মনে হচ্ছে এভাবে সাদামাটা থ্রিপিস পরে চলে আসা উচিৎ হয়নি।পেছন থেকে গাঁয়ে জ্যাকেট জড়াতে দেখে'ই চমকে পাশ ফিরে তাকাল অগ্নিলা।ততক্ষণে নিজের গাঁয়ের লেদারের জ্যাকেট'টা অগ্নিলার গাঁয়ে জড়িয়ে দিল জুবরান।চমকে মূক হয়ে গেল অগ্নিলা!রিসোর্টে ফেরার জন্য তাড়া দিল জুবরান।অগ্নিলার অসুস্থতার জন্য বেশিক্ষণ থাকতে চাইল না সে।
••••••••••
বেশ অনেক জায়গায় খোঁজ করেও কোনো রুম মেলেনি জুবরানে'র।হ্যালিপ্যাড থেকে ফেরার পরপর'ই অগ্নিলা বারংবার জুবরান'কে বলছিল ‘ঝিঁ ঝিঁ পোকার বাড়ি’ রিসোর্টে থাকার জন্য।এভাবে একটা অচেনা মেয়ের সঙ্গে এক রুমে কোনোমতেই থাকতে পারবে না জুবরান।এভাবে বাইরে থাকাও সম্ভব নয়।রাতের খাবার শেষ করে রিসোর্টে ফিরল অগ্নিলা,জুবরান।শেষ বারে'র মতো জুবরানে'র উদ্দেশ্যে বলল অগ্নিলা,
"আপনি রাতে কিভাবে বাইরে থাকবেন?নিজেকে অকৃতজ্ঞ মনে হচ্ছে আমার।শুরু থেকে সাহায্য করে'ই যাচ্ছেন।আপনি না হয় বেলকনিতে থাকবেন।আমি ভেতর থেকে দরজা লক করে দিব।
কিয়ৎক্ষণ ভাবনায় পরলো জুবরান।কথাটা মন্দ লাগেনি।সকাল হলে'ই তো কংলাক চলে যাবে।রাতটুকু কোনোরকম পাড় করে দেওয়া যাবে।অগত্যা রাজি হলো সে।বেশ খুশি হলো অগ্নিলা।এইটুকু সময়ে'র মধ্যে জুবরান'কে যতখানি চিনতে পেরেছে তার দ্বারা অন্যায় হবে না।গাড়ি'তে জড়িয়ে ধরার সময় বেশ আলগোছভাবে ধরেছিল।শরীরে একটুখানিও স্পর্শ লাগেনি সেরকমভাবে।কথা বলার ধরণ,চাহনি বেশ ভদ্র'ই বলা চলে।অন্তত তাঁর নারী মন এইটুকু বুঝতে পেরেছে।
◼️
রাত্র প্রহর যত গভীর হচ্ছে,মেঘের ঘনত্ব বাড়ছে যেন।সারা রুম জুড়ে মেঘ দেখে ভয়ানক চমকে উঠেছে অগ্নিলা!এটা বোধহয় আশা করেনি সে।খাট থেকে নেমে বেলকনির দরজা খুলে দিল সে।বেশ গুটিসুটি হয়ে বেতের চওড়া চেয়ারে শুয়ে আছে জুবরান।শুভ্র মেঘ সম্পূর্ণ মুড়িয়ে রেখেছে জুবরান'কে।পরিবেশ অনেক ঠান্ডা।ঝিরিঝিরি বৃষ্টি পরছে বোধহয়।দৌড়ে রুমে এসে কম্বল নিয়ে বেলকনিতে এসে জুবরানে'র গাঁয়ে জড়িয়ে দিল অগ্নিলা।ভারী নিশ্বাস বলছে ঘুমাচ্ছে লোকটা।ফের রুমে এসে দরজা এঁটে দিল সে।আচমকাই বাড়ি'র কথা বড্ড মনে পরছে।মোবাইল চালু করতেও যে ভয় লাগছে।ব্যাগ হাতড়ে মাউথ অর্গান বের করে বসল অগ্নিলা।তীব্র মন খারাপে মাউথ অর্গান বাজালে মুহূর্তে'ই মন ভাল হয়ে যায় তাঁর।দুদিন যাবৎ পেজে কোনো গান পোস্ট করতে পারছে না।নিশ্চয়ই সবাই অপেক্ষায় আছে!যত'ই হোক লুকিয়ে তো গান করা যায় না।ভাবনার মাঝে'ই মাউথ অর্গান বাজাতে শুরু করলো অগ্নিলা।বদ্ধ রুমে সূর তরঙ্গের মতো বেজে উঠলো!চোখ বুজে সম্পূর্ণ মনোযোগী হলো সে।
•••••••••••
তীব্র নিদ্রা আচ্ছন্ন ঘোরে কানে সূর ভেসে আসছে জুবরানে'র।ঘুমের ঘোর কাটেনি।সাদা-কালো মিশেল শাড়ি পরিহিতা এক মেয়ে হাত বাড়িয়ে দিয়েছে তাঁর দিকে।এক হাতে মাউথ অর্গান।গুগগুন করে গানের সুর তুলছে!সেই চেনা সুর!মেয়েটির মুখ স্পষ্ট নয়!কাঁধ বরাবর একগুচ্ছ কোঁকড়ানো কেশ!গোলাপের পাপড়ি'র ন্যায় অধরযুগল সুরের তালে তালে কাঁপছে!
তন্দ্রা ঘোর ধীরে ধীরে কাটলো জুবরানে'র।সগতোক্তি করলো সে"মিস অগ্নি?
আচমকা দ্রুত চোখ মেলে তাকাল সে।ধরফরিয়ে উঠে বসলো।ঘুমে থাকলেও যেন স্পষ্ট সূর শুনতে পেয়েছে!উঠে গিয়ে দরজা ধাক্কাল সে।কয়েক সেকেন্ডের মাঝে দরজা খুলে দিল অগ্নিলা।ভয়ার্ত দৃষ্টি তাঁর!মাউথ অর্গানের শব্দে কি ঘুম ছুটে গেল লোকটার?ঘন ঘন শ্বাস ফেলে,কম্পিত স্বরে প্রশ্ন ছুড়লো জুবরান,
"আপনি কি মাউথ অর্গান বাজাচ্ছিলেন মিস অগ্নি?
.
.
.
চলবে...................................................................