কামিনী - পর্ব ১১ - মম সাহা - ধারাবাহিক গল্প


দুর্দমনীয় আকর্ষণে প্রাতঃ বেলা ঘনিয়ে আসতেই গহীন বন থেকে ভেসে এলো অজানা জন্তুর হাঁক। থেকে-থেকে ডাকছে। কোন বিরহী সুর যে তার কণ্ঠে বেঁধে আছে তা কেউ বুঝতে পারবে না। আঁচ করার সাধ্য নেই কারো। 
 সেই গহীন জঙ্গলটিতে শুয়ে রুগ্ন স্বরে একটি নারী দেহ কেবল অস্ফুটস্বরে উচ্চারণ করতে লাগলেন, "পিপাসা পেয়েছে খুব। একটু তৃষ্ণা মেটানোর কেউ আছো?"

কেউ নেই চারপাশটায়। নারীটির তৃষ্ণা মেটানোর জন্য অগাধ জল ঝর্ণা থেকে ঝমঝম শব্দে গড়িয়ে পড়ছে। অথচ নির্জীব, প্রাণহীন ঝর্ণাটি চাইলেও সেই জল দিয়ে নারীটির তৃষ্ণা মোচন করতে পারছে না। সে অপারগ। তাই ফ্যালফ্যাল করে দেখেই গেলো কেবল। দেখে যাওয়া ছাড়া তার আর কী গতিই-বা আছে?
নারীটি জল চেয়ে চেয়ে আবারও জ্ঞান হারালো। গগণে উড়ে যাওয়া পাখিটি কেবল দেখলো বিস্ময় ভরে। যার ভয়ে রাজ্য কাঁপে থরথর করে, সে-ই কি-না নিস্তেজ হয়ে গিয়েছে এমন করে!

 ১৩…

 একটি অচেনা ফুলের সুঘ্রাণ ছড়িয়ে পড়েছে চারপাশ জুড়ে। বাহির থেকে মৃদু সমীরণে উড়ছে জানালার পর্দা গুলো। বিশাল কক্ষটি জুড়ে কেবল রানি কামিনী ও রাজা ইনান ণেকিতান বসে আছেন। রানির মুখের সেই কাঠিন্যতা আজ নেই। অন্যদিনের তুলনায় আজ তিনি বেশ হাসিখুশি রাজা ইনানের সাথে। যা রাজাকে বেশ আনন্দিত করছে। 
রাজা ইনান আপ্লূত কণ্ঠে বললেন, "আপনি ডেকেছেন, আর আমি না এসে কি থাকতে পারি?"

ইনানের বাক্যের বিপরীতে গাল ভরে হাসলেন রানি। অতি আহ্লাদ দিয়ে তিনি বললেন,
 "সেই ভরসা আমার ছিল আপনার প্রতি, রাজা ইনান। আমি ডাকলে আপনি আসবেন তা সে আমি জানি।"

"এবার বলুন কী কাজে আমায় ডেকেছেন, রানি?"

রানি নিজের কাঁধ টান টান রেখেই বললেন, "ডেকেছি আপনাকে আপ্যায়ন করার জন্য।"

"তা কীভাবে আপ্যায়ন করবেন, রানি?"

রানি কামিনী তখন ডাকলেন কক্ষের বাহিরে পাহারায় অবস্থান করা হ্যাব্রোকে। রানির ডাকে সে বেশ দ্রুতই এলো। মাথা নত চিরায়ত প্রথা মতন। 
 রানি হ্যাব্রোকে নির্দেশ দিলেন রাজা ইনানকে কোথাও একটা নিয়ে যাওয়ার। রাজা ইনানের সাথে তার একনিষ্ঠ মন্ত্রী এবং দেহরক্ষীদের নিতেও যেন ভুল না করে তা নিয়ে রানি বার বার বলে দিলেন। 

হ্যাব্রো মাথা পেতে রানির নির্দেশ মেনে নিলো। অতঃপর রাজা ইনানকে নিয়ে কক্ষের বাহিরে চলে গেলো। বিশাল কক্ষটিতে রানি একা বসেই ভাবতে লাগলেন কত কত ভাবনা। ঠিক সেই সময়ে উচ্চশব্দে প্রবেশ করলো যামিনী। হাতে রৌপ্যের থালায় একটি জলভর্তি গ্লাস, একটি দুধের পাত্রসহ দেখা গেলো কিছু জড়িবুটিও। এসেই সেগুলো রাখলো রানির সামনের টেবিলটায়। তড়িঘড়ি তার গলার স্বর। উৎকণ্ঠা চোখে-মুখে।

 "সখী, জড়িবুটি গুলো খাওনি কেন? নাও। এখন খেয়ে নাও।" বলেই জড়িবুটি গুলো এগিয়ে ধরলো রানির দিকে। 
রানি নাকচ করলেন, "জড়িবুটির প্রয়োজন নেই। আমি সুস্থ এখন।"

কিন্তু সেই নাকচের ধার ধারলো না যামিনী। বরং রাগী স্বরে বলল, "সুস্থ হলেও খেতে হবে। খাও, এখনই খাবে। নাও।"

এই একটু শাসন, একটু যত্নে রানি গলে গেলো। খানিক হেসে জড়িবুটি গুলো মুখে তুলে নিলো। জলের পাত্রটি থেকে খানিক জল পান করল। পাত্রটি জায়গায় রাখতে রাখতে বলল,
"জড়িবুটি খাচ্ছি কি-না, যত্ন নিচ্ছি কি-না এত কিছু কেন খেয়াল রাখো? আমার প্রতি তোমার ঘৃণা আসে না, সখী? রাগ আসে না?"

যামিনীর একটু হেসে রানির পাশ ঘেঁষে বসলো। রানির বাহুতে ভরসার হাত রেখে আলতো স্বরে বলল, 
"আমার তোমার প্রতি রাগ আসার আগে মৃত্যু আসুক, সখী। তুমি মানুষটা ছায়া দিয়েছিলে বলেই আজ এই জীবনটা আমি পেয়েছি। তোমায় কোন কারণে রাগ, ঘৃণা করবো?"

 "সবাই যে কারণে করে। আমি মরে গেলেই যেন সবাই বেঁচে যায় ভাব।"

"সবাই যে তোমায় বুঝতেই পারেনি, সখী। তোমাকে বুঝতে পারে যারা, তারা জানে তোমার বেঁচে থাকা দরকার। তোমাকে বাঁচিয়ে রাখা দরকার।"
 যামিনী কথাটা স্বাভাবিক ভাবে বললেও রানির মাথায় তৎক্ষণাৎ খেলে গেলো সেই রাতের ঘটনাটি। সে যখন তুমুল ব্যথা আর ক্লান্তিতে প্রায় লুটিয়ে পড়েছিলো তখন একজন বলেছিলো যেন তাকে আর তীর না মারতে। রানিকে বাঁচিয়ে রাখতে। রানি ভালো করেই জানেন সেই একজন লোকটি হ্যাভেন। তবে, হ্যাভেন কেনই বা এ কথা বলেছিলো? কেনই-বা রানিকে বাঁচিয়ে রাখার তার এত ইচ্ছে? কোন লাভ?

রানির ভাবনার মাঝেই যামিনী রানিকে জড়িয়ে ধরলো। মেয়েটার কণ্ঠ কাঁপছে মৃদু। কাঁদছে বোধহয় নীরবে। কম্পনরত স্বরে বলল,
 "তোমাকে সেদিন যখন সেনাপতি অমন পাঁজাকোলে করে নিয়ে আসছিলো তখন আমার পুরো পৃথিবীটা ঘুরে উঠেছিলো জানো? আমার মনে হচ্ছিলো এই দুনিয়ায় আমি যেন নিঃস্ব হয়ে গিয়েছি। আমার পায়ের নিচে মাটি সরে গিয়েছিলো। আমি সেই মুহূর্তে অনুভব করলাম, তোমার কেন বেঁচে থাকা দরকার! তুমি না বেঁচে থাকলে আমার মতন যামিনীরা কোথায় যাবে? কার কাছে যাবে?"

 রানি কামিনী আলগোছে জড়িয়ে নিলেন যামিনীকে। এই উষ্ণ জড়িয়ে ধরায় যামিনীর চোখে ভেসে উঠলো তাদের প্রথম সাক্ষাতের স্মৃতি। বিধ্বস্ত, ভেঙেচুরে একসার হয়ে যাওয়া যামিনীকে বালুর পাহাড়ে এমন করেই প্রথম জড়িয়ে ধরে ছিলেন রানি। নয়তো সে কি বাঁচতো? বাঁচতো না। 

 ১৪...

রাজ্যটির নাম ক্যামিলাস। লোকে রাজ্যটিকে সবুজ রাজ্য বলে। চারপাশে কেবল সবুজ গাছপালা, ফুল, পাখি দিয়ে ভরা। সুন্দরের আরেক সমাহার যেন এই রাজ্য। 
 রানি কামিনীকাঞ্চন ও উনার সেনাপতি, দেহরক্ষীরা যখন এই রাজ্যটিতে প্রবেশ করলো তখন মধ্যাহ্নের প্রায় প্রথম প্রহর। বাঁশি, ঢাক বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্র বাজিয়েই তাদের বরণ করে নেওয়া হলো। আনুষ্ঠানিকতার কোনো কমতি ছিলো না। যখন রাজপ্রাসাদে যখন প্রবেশ করলেন রানি তাকে কালো ফুলের বিরাট একটি তোড়া দেওয়া হলো। তিনি যখন গিয়ে বসলেন তখন ঠিক আটাশ জন দাসী এসে রানির চরণ ধৌত করল। গোলাপের জল, দুধ, চন্দন, সুবাস জল কিছুই বাদ রাখল না। 
 এমন উষ্ণ ও রাজকীয় অভ্যর্থনায় রানি খানিকটা ভ্যাবাচেকাই খেলেন। তবে মুখ ফুটে কিছু বললেন না। রানির আসনের পাশে হ্যাব্রো দাঁড়িয়ে রইল। এই অভ্যর্থনার বিষয়টিতে তারও মনের ভেতর কিছুটা কৌতূহল জাগ্রহ হয়েছে বোধহয়। রানির দাসী ফ্রেয়া দাঁড়িয়ে রইল আসনের অপরপাশে। বৈঠকখানাটি পরিপূর্ণ হয়ে গেছে বিভিন্ন রাজ্যের রাজাদের দিয়েই। যদিও এখানে আমন্ত্রিত সকলে ক্যামিলাস রাজ্যের হয়ে কিন্তু সকলের আকর্ষণ গিয়ে যেন আটকে গেলো রানি কামিনীর দিকে। তার জৌলুশ, তার রূপের দাম্ভিকতা, তার হাসির ছন্দ, তার নিটোল-সুন্দর ঢেউ খেলানো দেহ... সবকিছুই যেন উপস্থিত রাজাদের ভেতর মোহ, ভ্রম জাগিয়ে তুলল। 
কেউ প্রকাশ্যে তাকিয়ে রইলেন ড্যাবড্যাব করে, কেউ-বা নিজেদের চোখকে সংযত রাখার চেষ্টা করে আঁড়চোখে তাকাচ্ছিলেন। রানি এই সমস্তই উপলব্ধি করলেন। কোনো পুরুষ তাকে দেখে এমন করে তাকাবে না তা হয় নাকি? উত্তর থেকে দক্ষিণ, পারস্য থেকে পাঞ্জাব.. এমন কোনো পুরুষ নেই যে রানি কামিনীর রূপকে না দেখার ভান করে থাকতে পারে। 

বিভিন্ন রাজ্যের রাজাদের ভেতরই একটা আগ্রহ দেখা গেলো। কারো পিতা কিংবা কারো মন্ত্রী এসে সেনাপতি হ্যাব্রোর কাছে নিজেদের রাজাদের আর্জি পেশ করে গেলো। বেশিরভাগের আর্জিই ছিলো রানি যেন রাজাদের রাজ্যতে গিয়ে পদধূলি দেন। 
উপস্থিত সকলের মাঝে ছিলেন রাজা ইনান। রানির প্রতি সকলের এই আকৃষ্টতা তাকে বেশ উতলা করে তুলছিল বারংবার। কিছুদিন আগেই এ্যাজেলিয়া রাজ্যে গিয়ে তিনি রানির কাছ থেকে যেই খাতিরযত্ন পেয়েছেন তাতে ধরেই নিয়ে ছিলেন রানিকে এবার বুঝি তিনি লাভ করতে পারবেন। কিন্তু বর্তমানের চলমান এই বৈঠক তার ভেতর অনিরাপত্তার আভাস দিচ্ছেন। এত শত রাজাদের, এত-শত প্রস্তাবে না তিনি আবার রানিকে হারিয়ে ফেলেন! 

 এই সমস্ত উদগ্রীবতার ভেতর দক্ষিণের কোনো এক রাজ্যের রাজা বলেই বসলেন, "রানি কামিনীকাঞ্চনকে এই বৈঠকে উপস্থিত দেখে সত্যিই চমকে গেলাম। যার দর্শন পেতে যুদ্ধ করতে হয় তাকে বিনা শ্রমে দেখতে পাবো, কেউ কখনো কি ভেবেছিলাম?"

অধিকাংশ সহমত পোষণ করলেন প্রকাশ্যে। কেউবা গোপনে সহমত পোষণ করলেন ভদ্রতা বজায় রেখে। 
এখানে আরও কয়েকটি রাজ্যের রাজকন্যা উপস্থিত ছিলো৷ কিন্তু তাদের দিকে কেউ কোনো ধ্যান দিচ্ছিলেন না বিধায় তার প্রায় ভেতর ভেতর ক্রোধে ফেটে পড়ছিলো। জ্বলেপুড়ে যাচ্ছিলো। তবে রানির এই আকর্ষণীয় রূপের দাম্ভিকতা তারাও অস্বীকার করতে পারলো না। 

 ঠিক তখনই ক্যামিলাস রাজ্যের সেনাপতি উপস্থিত হলেন। বুক উঁচিয়ে, কণ্ঠ সরু করে বললেন, 
"ক্যামিলাস রাজ্যের রাজা হাজির হচ্ছেন।"

এর পরপরই বিশাল দুয়ার দিয়ে প্রবেশ করতে দেখা গেলো কতগুলো দেহরক্ষী, মন্ত্রী এবং সবশেষে সুন্দর, ঘোলাটে চোখের রাজাকে। 
.
.
.
চলবে.......................................................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

WhatsApp