দিনভর থমথমে গরমে সারা শহর হাঁসফাঁস করেছে। বিকেলের দিকে আকাশের গায়ে ভেসে উঠল পেঁজা তুলোর মতো সাদা মেঘের পাল। একটু একটু করে সূর্যের আলো মিলিয়ে যেতে লাগল। দূরে কোথাও থেকে ভেসে আসা কাক-চিলের ডাকে বিকেলটা আরও মায়াময় হয়ে উঠেছে।
বাসায় ফিরে জাওয়াদ প্রথমেই হাত-মুখ ধুয়ে নিল। তারপর একটু দ্বিধা নিয়ে গুলনূরের ঘরে উঁকি দিল। আবছায়া অন্ধকারে গুলনূর বিভোর হয়ে ঘুমাচ্ছে।
বন্ধু আরাফের সহায়তায় সপ্তাহখানেক হলো তারা এই নতুন বাসায় উঠেছে। এই কটা দিনে গুলনূরের সঙ্গে তার কথাবার্তা হয়নি বললেই চলে। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত সে কাজের খোঁজে ছুটোছুটি করেছে। গুলনূর প্রতিদিন রান্না করে রাখে, জাওয়াদ ফিরে এলে খাবার বেড়ে দেয়। এই পর্যন্তই তাদের যোগাযোগের সীমানা।
গুলনূরের ঘুমন্ত মুখ থেকে চোখ সরিয়ে জাওয়াদ নিজের ঘরে গিয়ে বসল।
ক্ষুধার জ্বালায় পেট চুঁই চুঁই করছে। গুলনূরের ঘরের পাশেই রান্নাঘর। হঠাৎ করে খাবার নিতে গেলে গুলনূর চমকে উঠতে পারে। এই কয়দিনে সে লক্ষ্য করেছে, যতই পরিচিত পুরুষমানুষ হোক না কেন, হঠাৎ করে সামনে পড়লে গুলনূরের মুখে ভয়ের ছায়া নেমে আসে। চোখে-মুখে আতঙ্ক দেখা যায়। তাই নিজের ঘর থেকেই মৃদু গলায় ডাক দিল, "গুলনূর... গুলনূর।"
সেই হালকা ডাকেই গুলনূর ঘুম থেকে চমকে উঠল। তড়িঘড়ি করে মাথায় ওড়না টেনে দ্রুত পায়ে এসে কুর্নিশ করল।
জাওয়াদের কপালে বিরক্তির ভাঁজ পড়ল। গভীর একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, "আবার কুর্নিশ? কতবার বলব তোমাকে? যেদিন জমিদার বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে এসেছি, সেদিন থেকে আমি আর জমিদার পুত্র নই। এখন আমি তোমার মতোই একজন সাধারণ মানুষ।"
গুলনূর তাড়াতাড়ি সোজা হয়ে দাঁড়াল। জমিদার-বেগমদের কুর্নিশ করা ছিল তার দৈনন্দিন জীবনের অংশ। তাই যখনই জাওয়াদের পায়ের শব্দ শোনে, যখনই তার ডাক কানে আসে, পা নিজের থেকেই এগিয়ে যায়, শরীর আপনা-আপনি নুয়ে পড়ে।
জাওয়াদ একটু নরম সুরে বলল, "আমি জানি এটা তোমার অভ্যাস। কিন্তু এখন আমরা দুজনেই ভিন্ন পরিস্থিতিতে আছি। আমরা বন্ধুর মতো। আমার সামনে তোমার নত হওয়া সাজে না। আর কুর্নিশ করবে না, ঠিক আছে?"
গুলনূর মাথা নেড়ে সম্মতি জানাল। জাওয়াদ হাত ধুয়ে এসে জিজ্ঞেস করল, "কী রান্না করেছ আজ?"
গুলনূর দ্রুত রান্নাঘরে গেল। থালায় গরম ভাত বেড়ে, পাশে মুরগির ঝোলের বাটি রাখল। ভাতের ওপর একটু ঘি ছড়িয়ে দিতেই চারদিকে মিষ্টি সুগন্ধ ছড়িয়ে পড়ল।
জাওয়াদ মুরগির ঝোল দেখে অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, "মুরগি কোথায় পেলে?"
গুলনূর খাতা আর কলম নিয়ে লিখল, "আরাফ সাহেব সকালে দিয়ে গেছেন।"
"কখন এসেছিল?" জাওয়াদ খাবারের থালার সামনে বসতে বসতে জিজ্ঞেস করল।
"সকালে।"
জাওয়াদ গুলনূরের দিকে তাকিয়ে বলল, "তুমিও বসো। একসঙ্গে খাই।"
"কিছুক্ষণ আগে খেয়েছি। আপনি খান।"
জাওয়াদ মুরগির ঝোলে ভাত মাখতে মাখতে বলল, "একটা চাকরি পেয়েছি। কিছুদিন চাকরিটা করি। তারপর তোমাকে সাইন ল্যাংগুয়েজ শেখানোর জন্য একটা ভালো প্রতিষ্ঠানে ভর্তি করাব।"
গুলনূর ফ্যালফ্যাল করে তাকাল জাওয়াদের দিকে। স্পষ্টতই সে বুঝতে পারেনি 'সাইন ল্যাংগুয়েজ' বলতে কী বোঝানো হচ্ছে। জাওয়াদ তার অবুঝ চাহনি দেখে উৎসাহের সাথে বলল, "তোমাকে হাতের ইশারায় কথা বলা শেখাব। এই যেমন..." বলে সে হাত তুলে 'সালাম' আর 'ধন্যবাদ'-এর ইশারা দেখিয়ে দিল। "দেখলে? এভাবে ইশারায় কথা বলা শিখলে তুমি সবার সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারবে।"
গুলনূর শুধু মাথা নাড়ল।
তখন শহরে বধির ও মূক প্রতিষ্ঠান খুব বেশি ছিল না। আজ চৌরাস্তার মোড়ে জাওয়াদ একটা এনজিও দেখেছে। যারা বধির-মূকদের জন্য কাজ করে। সেখানে গুলনূরকে ভর্তি করে দিলে হয়তো সে নতুন জীবনের স্বাদ পাবে।
হঠাৎ জাওয়াদের মাথায় একটা চিন্তা খেলে গেল, "গুলনূর তো জন্মগত বোবা নও। আঘাতের কারণে ও কথা বলতে পারে না। ওর তো চিকিৎসা করা যাবে!"
গুলনূরের কণ্ঠস্বর কেমন হবে? তার এই মায়াবী মুখের মতোই কি মিষ্টি হবে তার গলার স্বর? জাওয়াদ চোখ তুলে তাকাল গুলনূরের দিকে। গুলনূর তখন নিজের নখ খুঁটছে।
জাওয়াদ গলা পরিষ্কার করে বলল, "গুলনূর, আমি তোমার চিকিৎসা করাব। তুমি আবার কথা বলবে, তখন আর ইশারায় কাউকে কিছু বোঝাতে হবে না।" একটু থেমে নিচু স্বরে বলল, "তবে...সেজন্য টাকাপয়সার প্রয়োজন। জোগাড় করতে একটু সময় লাগবে।"
গুলনূর মাথা নাড়ল। তার কাছে জাওয়াদের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত। নিজের মতামত প্রকাশ করার সাহস বা অভ্যাস কোনোটাই তার নেই।
সে শুধু লিখল, "এত দৌড়াদৌড়ি করবেন না। আপনার পিঠের ক্ষতটা এখনো শুকায়নি।"
জাওয়াদ খেতে খেতে হাসল। বলল, "মনের ক্ষতই এতদিন ধরে টাটকা হয়ে আছে। তবুও তো বেঁচে আছি, শ্বাস নিচ্ছি। দেহের ক্ষত আর কতটুকু!"
খাওয়া শেষ করে উঠতে গিয়ে লক্ষ্য করল, গুলনূর অনেকটাই রোগা হয়ে গেছে। সে উঠে যাচ্ছিল, এমন সময় গুলনূর গামছা নিয়ে এল।
জাওয়াদ কিছুক্ষণ ভেবে জিজ্ঞেস করল, "গুলনূর, তুমি কি আমার ওপর অসন্তুষ্ট?"
গুলনূর আবারও সেই অবুঝ চোখে তাকাল।
জাওয়াদ বলল, "এই যে তোমাকে নিয়ে এসে আমার এই অনিশ্চিত জীবনের সঙ্গে জুড়ে দিলাম, সেজন্য! ওই বাড়িতে তোমার অনেক সঙ্গী ছিল। স্বাধীনভাবে চলাফেরা করতে পারতে, খাওয়া-দাওয়া সবই ছিল..." জাওয়াদের কণ্ঠ রুদ্ধ হয়ে এল। " আমি বাধ্য হয়েই এই সিদ্ধান্ত নিয়েছি। বাবা যা বলেছেন, তারপর ওই বাড়িতে থাকা আমার পক্ষে সম্ভব ছিল না। আর তোমাকে একা রেখে এলে..."
জাওয়াদের চোখে উদ্বেগ ফুটে উঠল, "মা তোমাকে কিছুতেই বাড়িতে রাখতেন না। মা আমাকে জীবন দিয়ে ভালোবাসেন। উনি কতটা জেদি, আমার চেয়ে বেশি কে জানে! মনে মনে এটাই ধরে নিতেন, তোমার কারণেই আমি ঝগড়া করে বাড়ি ছেড়েছি। তখন তোমার জীবন জাহান্নামে পরিণত হতো।"
জাওয়াদ চুপ করে গেল। এই বাড়িটা আরাফের চাচার। তাই সহজেই ভাড়া পেয়ে গেছে। নইলে গুলনূরকে কী পরিচয় দিয়ে বাড়ি ভাড়া নিত? তাছাড়া এভাবে আর কতদিন চলবে! সে ধীরে ধীরে বলল, "সমাজের চোখে দুজন অবিবাহিত ছেলে-মেয়ে একসঙ্গে থাকা অশোভন। কিন্তু আমরা তো জানি আমরা কতটা শুদ্ধ। তাই আমার একসঙ্গে থাকতে কোনো সমস্যা নেই। আমি তোমাকে প্রতিষ্ঠিত করতে, স্বাভাবিক একটা জীবন দিতে সরকিছু করব। কিন্তু যদি তোমার কোনো অস্বস্তি হয়, যদি কোনো খারাপ অনুভূতি হয়, তবে খোলাখুলি বলতে পারো। আমি চেষ্টা করব অন্য কোনো ব্যবস্থা করা যায় কি না..."
গুলনূর লিখল, "কী করবেন?"
জাওয়াদের চোখ মেঝেতে। নিজের ঘাড় ম্যাসাজ করতে করতে বলল, "পুনর্বাসন কেন্দ্রের খোঁজ নেব। সেখানে অসহায় মানুষদের সাহায্য করা হয়। তুমি অনেক নারীদের সঙ্গে থাকতে পারবে। নতুন অনেক কিছু শেখার সুযোগ পাবে। নিরাপদ জায়গা। আর বাইরে থেকে আমিও..."
গুলনূর তড়িৎ বেগে লিখল, "সেটাই করুন।"
শব্দ দুটি পড়ে জাওয়াদের চোখ দুটি সজল হয়ে উঠল। গুলনূর তার সঙ্গে থাকতে চায় না! তার সমস্ত অনুভূতি যেন থমকে দাঁড়াল। নিজেকে বোঝানোর চেষ্টা করল, গুলনূরের চাওয়াই সঠিক। তারা একসঙ্গে থাকতে পারে না!
কিন্তু... কিন্তু গুলনূর তার সঙ্গে থাকতে আগ্রহী নয়, এই সত্যটা কেন এত তীব্রভাবে বুকে বিঁধছে?
জাওয়াদ ভারী গলায় বলল, "ঠিক আছে। আমি খোঁজ নেব।"
গুলনূর নীরবে নিজের ঘরে চলে গেল।
নাভেদ হাত মুঠো করে দাঁড়িয়ে আছে। তার শরীর থেকে টপ টপ করে ঘাম ঝরছে। জমিদারদের চোখে নিজেকে সৎ প্রমাণ করতে গিয়ে গোলামের মতো খাটছে দিনরাত। কিন্তু যার জন্য এত কিছু, সেই জুলফা তাকে এড়িয়ে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত। কিছুতেই মুখোমুখি হওয়া যাচ্ছে না, কথা বলা তো দূরের কথা। যেখানেই দেখা হোক না কেন, বাগানে, বৈঠকখানায়, অন্দরমহলের সামনে - জুলফা কোনো না কোনো অজুহাত খুঁজে বের করে সরে পড়ে।
শুধুমাত্র জুলফার জন্যই তো সে তার সমস্ত পরিকল্পনা বদলে ফেলেছিল। কেন এমন হচ্ছে? জুলফার চোখে-মুখে যে মোহ, যে প্রেমের ছায়া দেখেছিল, তা কী করে এত অল্প সময়ে মিলিয়ে গেল?
সকালে আবর্জনার স্তূপের মধ্যে সে তার দেওয়া রেডিওটা খুঁজে পেয়েছে। জুলফা ফেলে দিয়েছে, যেন কোনো অপ্রয়োজনীয় জিনিস! সেই থেকে তার মাথা গরম হয়ে আছে, সব কিছু এলোমেলো লাগছে।
কী করবে সে? কীভাবে জুলফার মন ফিরে পাবে? নাকি সব শেষ হয়ে গেছে?
নাভেদ গভীর শ্বাস নিয়ে নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করল। তখন কানে ঘোড়ার ক্ষুরের ঠক্ঠক্ শব্দ ভেসে এল। সঙ্গে শোনা গেল চাকার ঘর্ষণের আওয়াজ। কেউ একজন ঘোড়া গাড়ি করে এসেছে জমিদার বাড়িতে।
নাভেদ উঁকি দিল জানালা দিয়ে।
একটি সুসজ্জিত ঘোড়া গাড়ি থেকে দুজন চাকর অতি সন্তর্পণে একজন বৃদ্ধাকে নামাচ্ছে। বৃদ্ধার সারা চেহারায় রাজকীয় আভিজাত্যের ছাপ। পরনে দামি বেনারসি শাড়ি, যার পাড়ের সোনালি জরির কাজ বিকেলের রোদে ঝিকমিক করছে। শাড়ির আঁচল মাথায় টেনে রাখা। হাতের রূপার লাঠিতে ভর দিয়ে তিনি দাঁড়িয়ে আছেন দৃপ্ত ভঙ্গিতে।
তার শক্ত চোয়াল, তীক্ষ্ণ চোখ। সেই চোখে বয়সের ছাপ পড়লেও এখনো জ্বলজ্বল করছে অগ্নিশিখা। কিছু মানুষ হয় না দেখলেই সমীহ করতে ইচ্ছে করে? কথা বলার আগে দু'বার ভাবতে হয়। অনেকটা সেরকম চেহারা।
তাকে দেখে জমিদার বাড়ির চারদিকে হৈচৈ পড়ে গেল। দাসী-চাকররা ছুটোছুটি শুরু করে দিল। কেউ পান সাজছে, কেউ শরবত বানাচ্ছে, কেউবা খবর দিতে ছুটল অন্দরমহলে। বৃদ্ধা ধীর পদক্ষেপে এগিয়ে চললেন অন্দরমহলের দিকে।
নাভেদ নিজের ঘর থেকে বেরিয়ে এল। সন্ধ্যা নামতে আর বেশি দেরি নেই। পশ্চিম আকাশে সূর্য হেলে পড়েছে। সোনালি আভা ছড়িয়ে পড়েছে জমিদার বাড়ির প্রাচীন দেওয়ালে।
কোহিনূর ভুঁইয়া সুফিয়ান ও শব্দরের একমাত্র ফুফি। বয়সে সুফিয়ানের চেয়ে কিছুটা বড় হলেও এখনো শক্তিমান, তেজস্বী। কলকাতার এক রাজ পরিবারের বড় বউ হিসেবে দীর্ঘ পঞ্চাশ বছর কাটিয়েছেন অসামান্য মর্যাদায়। স্বামীর পাশে থেকে বিশাল সংসার সামলেছেন। তার স্বামী যখন কোনো সিদ্ধান্ত নিতেন, তিনি হতেন প্রধান পরামর্শদাতা।
এখন বয়স হয়েছে। ছেলেমেয়েরা নিজেদের সংসার পেতেছে, নাতি-নাতনিরাও বড় হয়েছে। কেউ বিলেতে, কেউ বোম্বাইয়ে। সবাই নিজের নিজের জীবন নিয়ে ব্যস্ত। তবে প্রত্যেকেই তার কথা শিরোধার্য করে চলে। কোহিনূর ভুঁইয়ার একটি কথাতেই সব কাজ থমকে যায়।
ললিতার চিঠি পেয়ে তিনি ছুটে এসেছেন পৈতৃক এই জমিদারবাড়িতে। তাছাড়া গত কয়েক মাস ধরে প্রায়ই স্বপ্নে দেখছিলেন বাবা-মাকে। পিতৃভূমির টানে মন ব্যাকুল হয়ে উঠেছিল।
"এই মেয়ে! ভালো করে সিঁড়ি মুছো।"
দ্বিতীয় তলায় উঠতে গিয়ে দুই দাসীর কাজ দেখে ধমকে উঠলেন।
লাঠি দিয়ে দেখিয়ে বললেন, "প্রথমে সিঁড়ির কোণগুলো ভালো করে মুছবে, তারপর মাঝখানের অংশ। ভিজে কাপড় দিয়ে মুছবে, শুকনো নয়। কোনো ফাঁক-ফোঁকর রাখবে না।"
দাসীরা মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল। কোহিনূর রূপার লাঠি ঠুকে ঠুকে এগিয়ে গেলেন।
তার চোখ দুটি সজাগ প্রহরীর মতো সব কিছু খুঁটিয়ে দেখছে। দক্ষিণের জানালার কাঠের খিলানে সামান্য ধুলো জমেছে, পূর্বদিকের বারান্দায় মখমলের পর্দাটা একটু তেরছা হয়ে আছে, বৈঠকখানার টেবিলের ফুলদানিতে গোলাপগুলো শুকিয়ে কালো হয়ে গেছে।
নিয়মানুবর্তিতা যেন তার রক্তের সঙ্গে মিশে আছে। ছোটবেলা থেকেই। তখন তিনি এই বিশাল জমিদার বাড়ির একমাত্র কন্যা। বাবা বলতেন, "আমার কোহিনূর হীরার চেয়েও দামি।" সেই থেকেই নাম হয়ে গেল কোহিনূর। বাবার শেখানো শৃঙ্খলা, নিয়মনিষ্ঠা সব কিছু এখনো অক্ষুণ্ণ।
একটা গভীর দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল বৃদ্ধার বুক থেকে। এত বড় জমিদার বাড়ি, এত নাম-যশ-প্রতিপত্তি। কিন্তু একটাও যোগ্য বউ এল না এই বংশে! তার ভাইয়ের বউ থেকে সুফিয়ানের বউ ললিতা। বিয়ের পর থেকেই হাওয়ায় ভাসছে। না আছে গৃহকর্মের ধার, না আছে কোন দায়িত্বজ্ঞান।
আর শব্দর? তার কথা ভাবলেই বুকের ভেতরটা মুচড়ে ওঠে। চল্লিশেরও বেশি বছর বয়স হলো, একটাও ভাল সম্বন্ধ পছন্দ হলো না। কত ঘরের কত মেয়ে এল, কত জমিদার-বণিক পাত্রী দেখাতে এলো। সব ফিরিয়ে দিল। আর এখন? এখন নাকি কোন গরিব ঘরের মেয়েকে বিয়ে করে এনেছে। শুধু শুনেছেন, চোখে দেখেননি। কেমন সেই মেয়ে? কোন বংশের? কী শিক্ষা-দীক্ষা?
চারপাশে দৃষ্টি বুলালেন কোহিনূর। কেউ নেই। পিছনে তার বিশ্বস্ত ঘোড়াসওয়ার আসাদ নীরবে দাঁড়িয়ে আছে। পথেঘাটে গাড়ির চলন বেড়েছে। তিনি এখনো ঘোড়া গাড়িতেই যাতায়াত করতে পছন্দ করেন। আসাদ ছেলেটি বিশ্বস্ত। তার প্রতিটি যাত্রার সঙ্গী।
"তুমি বাইরে থাকো।"
আসাদকে নির্দেশ দিয়ে তিনি ললিতার ঘরে ঢুকলেন।
ললিতা শয্যাশায়ী। ছেলের শোকে ভেঙে পড়েছেন। একমাত্র ছেলে জাওয়াদকে তিনি প্রাণ দিয়ে ভালোবাসেন। একবার হারিয়ে তাকে খুঁজে পেয়েছিলেন, এখন আবার হারিয়ে ফেলেছেন। সুফিয়ানের পায়ে ধরেও ছেলেকে ফিরিয়ে আনাতে রাজি করাতে পারলেন না। এ জীবনে বেঁচে থাকার মতো আর কী-ই বা আছে তার! চোখের নিচে কালি পড়েছে, মুখ শুকিয়ে গেছে। বিছানার পাশের টেবিলে খাবার ভর্তি থালা। খাওয়ার রুচি নেই। মায়ের এই করুণ অবস্থা দেখলে জাওয়াদের হৃদয় কি গলবে ?
কোহিনূর বিছানা থেকে কিছুটা দূরে বসলেন। তাকে দেখে ললিতার নিস্তেজ চোখে আলো ফুটে উঠল। তিনি উঠে বসার চেষ্টা করলে কোহিনূর শক্ত গলায় বললেন, "শুয়ে থাকো। এই অবস্থায় উঠে বসতে হবে না।"
ললিতা তবুও মাথা তুলে অসহায় কণ্ঠে বললেন, "আপনি এসেছেন। আপনি... আপনি আমার ছেলেকে ফিরিয়ে আনুন। জাওয়াদের বাবাকে বোঝান। আমার ছেলে ছাড়া আমি..."
"কান্নাকাটি করো না। প্রথমে সুস্থ হও। তারপর কথা হবে।"
ললিতা কাতর স্বরে বললেন, "আপনি তো জানেন, আমার জাওয়াদ কত ভালো ছেলে। ও কখনো..."
"জাওয়াদ নিজের পথ নিজে বেছে নিয়েছে। ওকে তো আটকে রাখতে পারোনি। এখন কান্নাকাটি করছো কেন?"
তিনি উঠে দাঁড়ালেন। দরজার কাছে গিয়ে হঠাৎ থমকে দাঁড়িয়ে ফিরে তাকালেন।
বললেন, "তোমার অনুরোধে আমি আসিনি। আমি এসেছি আমার বাবার জমিদারি বাঁচাতে। এই জমিদারি আমার পিতৃপুরুষের সম্পত্তি। জাওয়াদকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেওয়ার অধিকার তোমাদের কারোর নেই। না তোমার, না সুফিয়ানের।"
ললিতা অসহায়ভাবে বিছানায় শুয়ে রইলেন। কোহিনূর আবার বললেন, "জাওয়াদ যদি ফিরেও আসে, তবে সেটা হবে ওর নিজের ইচ্ছায়। কারো অনুরোধে নয়, কারো আদেশে নয়। ওকে শুধু চেনাতে হবে ও কোন বাড়ির ছেলে! ওর পূর্বপুরুষরা কারা...তারা কী ছিল! যেটা তোমরা পারোনি।"
কথা শেষ করেই ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন।
পূর্ণিমার রাত। আকাশে টলটলে জ্যোৎস্না। তিনতলা বাড়ির ছাদে একা বসে আছেন রাজ্জাক। হাতে দেশি মদের বোতল। চোখে জল। মাঝে মাঝে উঁচু করে বোতল ধরে ঢক ঢক করে খাচ্ছেন। তারপর আকাশের দিকে তাকিয়ে অশ্রুসিক্ত চোখে বিড়বিড় করে কিছু বলছেন।
হঠাৎ 'ধপ' করে একটা শব্দ হলো। শব্দটা এল ছাদের চিলেকোঠা থেকে। রাজ্জাক চমকে উঠলেন। মদের ঝোঁকে ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ালেন। পা টলছে। তবুও টলতে টলতে এগিয়ে গেলেন চিলেকোঠার দিকে।
দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ধীরে ধীরে টোকা দিলেন।
ভেতর থেকে অস্পষ্ট, অদ্ভুত শব্দ ভেসে আসছে। আবার টোকা দিলেন।
নীরবতা। শুধু দূরে কোথাও একটা কুকুর ডাকছে। হঠাৎ রাজ্জাকের মনে পড়ে গেল পাঁচ বছর আগের সেই ঘটনাটা। বুকের ভেতর ধক করে উঠল।
এবার তিনি জোরে জোরে দরজায় ধাক্কা দিতে শুরু করলেন।
"দরজা খোলো! খোলো বলছি!"
কেউ দরজা খুলল না। তিনি দ্রুত জানালার ভাঙা ফাঁক দিয়ে উঁকি দিলেন ভেতরে। যা দেখলেন, তাতে তার মুখ দিয়ে আর্তনাদ বের হয়ে এল। হাত থেকে মদের বোতল পড়ে চুরমার হয়ে গেল। তিনি প্রাণপণে ছুটে গেলেন সিঁড়ির দিকে।
অরিজিত বিকাল থেকে ঘরের কোণায় রাখা পুরনো রোটারি ফোনটা নিয়ে ব্যস্ত।
শ্রুতির সঙ্গে আধঘণ্টা কথা বলার পর, সে হ্যান্ডসেট নামিয়ে ফের ডায়াল ঘুরাতে শুরু করল। এবার শিউলির পালা।
"শিউলি, আজ কলেজে গেলে না কেন?"
"কিছু কাজ ছিল। তাছাড়া তুমি তো সকালে ফোন করবে বলেছিলে। করোনি কেন?"
কথা চলতে থাকে। একসময় শিউলির কণ্ঠ নরম হয়ে এল। ঠিক তখনই অরিজিতের চোখ পড়ে ঘড়িতে। প্রায় আধঘণ্টা হয়ে গেছে!
সে হুট করে কথা শেষ করে ফোন রেখে দিল। তার হাত আবার ডায়ালের দিকে যায়। এবার লগ্না। ডায়াল ঘোরাতে ঘোরাতে তার আঙুল ব্যথা হয়ে গেল।
তাতে অবশ্য তার কষ্ট নেই। সুন্দরীদের সঙ্গে কথা বললেই তার পরিশ্রম সার্থক হয়ে যায়।
লগ্না ফোন ধরার সঙ্গে সঙ্গে বলে ওঠল, "অরিজিত, সকাল থেকে কোথায় ছিলে? আমি তো ভেবেছিলাম, ভুলে গেছো।"
"ভুলবো কীভাবে? সকাল থেকে শুধু তোমার কথাই তো ভাবছি।"
তিনজনের সঙ্গে কথা বলতে বলতে বিকেল গড়িয়ে রাত হলো।
খাওয়াদাওয়া শেষ করে অরিজিত পকেট থেকে একটা দোমড়ানো কাগজ বের করল। কাগজে লেখা নাম্বারটা নতুন। গতকাল রাতে পরিচিত এক দোকানদারের কাছ থেকে জোগাড় করা।
মেয়েদের সঙ্গে আলাপ জমানোর একটা অদ্ভুত ক্ষমতা আছে অরিজিতের। তার বয়স কম হলেও, কণ্ঠ বেশ পরিণত ও আকর্ষণীয়। তার গলা শুনেই যে কোনো রমণী মুগ্ধ হয়ে যায়।
ডায়াল ঘোরাতে ঘোরাতে অরিজিত ভাবল, আজ কী কী বলবে!
"হ্যালো?" ওপার থেকে একটি কোমল কণ্ঠস্বর।
অরিজিত দেয়ালে হেলান দিয়ে চোখ বুজে বলল, "কথা বললেন নাকি বুকে তির ঢুকালেন?"
"জি?" মেয়েটির গলায় বিস্ময়।
"আপনার গলার স্বর শুনে মনে হচ্ছে স্বর্গ থেকে দেবী নেমে এসেছে ...."
"কে বলছেন আপনি?"
"আমি একজন কবি। দেখা হলে চিনবেন। ঠিক উত্তম কুমারের মতো সুদর্শন।"
"তাই?"
"আপনার কণ্ঠস্বর শুনে আমার মনে কবিতা জেগে উঠছে..."
"আচ্ছা? শুনি একটা।"
অরিজিত গলা পরিষ্কার করে বলল, "চাঁদের আলোয় স্নান করা তোমার গলার স্বর... বাতাসে ভেসে আসা তোমার সুরের লহর..."
"বাহ্! আপনি তো দারুণ কবিতা বলেন..."
অরিজিত উৎসাহিত হয়ে বলল, "আপনার নামটা জানতে পারি? আমার নাম অরিজিত। আমি ইউনিভার্সিটিতে পড়ি..."
হঠাৎ ওপার থেকে একটা কর্কশ মহিলা কণ্ঠ ভেসে এল, "এই হারামজাদা! তুই আমার মেয়ের বয়স জানিস? এগারো বছর।"
অরিজিত থতমত খেয়ে গেল। গলায় কথা আটকে গেল। ওই চিকন গলাটা একটা এগারো বছরের মেয়ের ছিল? ছিঃ ছিঃ।
"আমার স্বামী পুলিশের ডিএসপি। এক্ষুনি তোর ঠিকানা বের করে তোকে ধরতে পাঠাচ্ছি। তারপর দেখবি তোর কবিতার শক্তি কত!"
"না প্লিজ আন্টি... ভুল হয়ে গেছে..."
"সরি না ছাই! তোর বাপের নাম কী? কোথায় থাকিস? নাকি পুলিশ দিয়ে খুঁজে বের করব?"
অরিজিত তাড়াতাড়ি ফোন রেখে দিল। হাত-পা কাঁপছে। বাইরে রাত গভীর হচ্ছে। গায়ে ঠাণ্ডা ঘাম। যদি সত্যি পুলিশের ঝামেলা পড়ে! রাজ্জাক কাকা যদি জানতে পারেন... উঃ, ভাবতেই বুক শুকিয়ে যাচ্ছে।
হঠাৎ দরজায় প্রচণ্ড শব্দ।
"খোল! জলদি দরজা খোল!" রাজ্জাক সাহেবের কণ্ঠস্বর।
দরজা খুলতেই রাজ্জাক ঝড়ের বেগে ঢুকলেন। পিছনে দারোয়ান কামাল। দুজনের চোখেই আতঙ্ক।
"চল, উপরে চল!" হাঁপাতে হাঁপাতে বললেন রাজ্জাক। "চিলেকোঠায়..."
তিনজন ছুটল উপরের দিকে। রাজ্জাকের হাতে টর্চ। পিছনে কামাল আর অরিজিত।
চিলেকোঠার সামনে এসে থমকে দাঁড়াল।
"ভাঙ্গো! দরজা ভাঙ্গো!" চিৎকার করে উঠলেন রাজ্জাক।
কামাল আর অরিজিত মিলে দরজায় ধাক্কা দিতে লাগল। একবার, দুইবার, তিনবার... চতুর্থ ধাক্কায় দরজা ভেঙে গেল।
টর্চের আলোয় যা দেখল, তাতে তিনজনের মুখ থেকেই আর্তনাদ বের হয়ে এল।
"জলদি! জলদি!" রাজ্জাক ছুটে গিয়ে দেহটা ধরলেন। "অরিজিত, দড়ি কাট! কামাল, ধর ওকে!"
অরিজিত আশেপাশে চোখ বুলিয়ে একটা চাকু পেল। সেটা দিয়ে দড়ি কাটতে লাগল। হাত কাঁপছে। দেহটা খুব ভারী। তিনজনে মিলে ধরে রাখল।
"বাঁচবে... এখনও বাঁচবে..." রাজ্জাক সাহেবের গলা কাঁপছে। "গাড়ি...গাড়ি লাগবে..."
"আমি যাচ্ছি স্যার!" কামাল ছুটে নিচে নামল।
.
.
.
চলবে....................................................