তুমি রবে নীরবে - পর্ব ৩৭ - নাদিয়া সাউদ - ধারাবাহিক গল্প


কথাটুকু বলেই কুহুকে কোলে তুলে নিল রওনক। নেমে যাওয়ার জন্য হাত,পা ছোড়াছুড়ি করলো কুহু। খাটে এসে কুহুকে নামিয়ে দিয়ে শক্ত করে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে রাখলো রওনক। কুহুর কোনো প্রতিক্রিয়া দেখা গেল না। নিশ্চুপ হয়ে রইল। মাথা তুলে কুহুর দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল রওনক। মাথা কাত করে অন্যপাশে দৃষ্টি ফেলে তাকিয়ে আছে কুহু। চোখদুটো জলে ভাসা মনে হচ্ছে। নাকের ডগা রক্তিম হয়ে উঠলো। যে কোনো সময় কেঁদে ফেলবে ভাব! মুচকি হাসলো রওনক। মাথা নুইয়ে কুহুর থুতনিতে চুমু খেল। দৃষ্টি ঘুরিয়ে রওনকের দিকে তাকিয়ে বলল কুহু,

"আপনার এই আদিখ্যেতা ভালো লাগছে না আমার। আমাকে যখন আপনার পছন্দই নয় তাহলে সেদিন বিয়ে কেন করেছিলেন? এইসব আমার প্রতি আপনার দয়া আর সহানুভূতি নয় তো? আপ.....

কুহুর ঠোঁটের মাঝে আঙ্গুল রেখে কথা থামিয়ে দিল রওনক।তপ্ত শ্বাস ফেলে বলল, 

" তো তোমার কি ধারণা? এই বোকামোর জন্য ভালোবেসে ফেলবো তোমাকে? এমন গর্দভ মেয়েকে কি ভালোবাসা যায়? তোমার বন্ধুরা তো ভাবছে আগে থেকেই কিছু চলছে আমাদের মাঝে। সেটাই ক্লিয়ার করে দিয়ে আসলাম।

কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেল কুহু। কপালে সুক্ষ্ম ভাজ পড়লো। রওনক ভাই তাকে কথা থেকে বাঁচাতেই তবে ওই কথাটা বলেছেন? মুহূর্তে অপ্রতিভ হলো। বার কয়েক চোখের পাতা ঝাপটে নিয়ে বলল, ফেশ হতে যাবে সে। রওনক ছাড়লো না। আরেকটুখানি শক্ত করে জড়িয়ে নিয়ে বলল,

"আজ গোটা শহর আমাদের প্রেমের সাক্ষী হবে। যাও তৈরি হয়ে এসো। শাড়ি পরবে। বের হবো এখন। যতদূর চোখ যায় হাতে হাত রেখে হাঁটবো।

কুহু কিছু বলতে গিয়েও বলল না। হঠাৎই ইচ্ছে জেগে উঠলো তার। রওনক ভাইয়ের সঙ্গে এভাবে কখনো বের হওয়া হয়নি তার। চট করেই কেমন মন ভালো হয়ে গেল। হাতের বাঁধন আলগা করে দিল রওনক। উঠে চলে গেল কুহু।

◼️

শয্যারত বাবার দিকে তাকিয়ে আছে রাতিম। চোখদুটো তার জলে ভাসা। পাশে বসা মায়ের মলিন মুখশ্রী। বাবার লিভার ক্যান্সারের চিকিৎসা করাতে করাতে ঋণ গলা অবধি ছুঁয়েছে। দিনশেষে বাবার জীবিত মুখখানা দেখলে কোথাও একটা শান্তি কাজ করে। মুখে আঁচল গুঁজে চোখের পানি ফেলছেন পারভীন বেগম। ইচ্ছে ছিল সামর্থ্য মতো ধুমধামে একমাত্র ছেলের বিয়ে দিবে। তা আর হচ্ছে কোথায়? স্বামীর শেষ ইচ্ছে মতো কোনোভাবে ঘরোয়া ভাবে বিয়ে সম্পন্ন করবেন। কেন যে এত করুণ দিন আসে! হাতে করে গরম গরম ভাতের ঝাউ নিয়ে আসলো রূপা। গায়ে সুতির মলিন একটা নীল রঙা শাড়ি। আঁচল গুঁজে রাখা কোমড়ে। ব্যস্ত হয়ে এগিয়ে আসলো। পারভীন বেগম মায়াভরা দৃষ্টি নিয়ে দেখছে কাজে মনোযোগী রূপাকে। মেয়েটা রাতদিন খেটে যাচ্ছে অসুস্থ মানুষটার জন্য। রাতিমের দিকে দৃষ্টি পরতেই তাড়া দিল রূপা। হাতমুখ ধুয়ে আসতে বলল। খাবার সাজিয়ে এসেছে সে। তপ্ত শ্বাস ফেলে চলে গেল রাতিম। তীব্র মন খারাপ আজ ঘিরে রেখেছে তাঁকে। রিশার সঙ্গে বাজে ব্যবহার করায় কলিজা ছি ড়ে যাচ্ছিল! করুণ, কান্নামাখা সেই মুখখানা ভেতর চূর্ণবিচূর্ণ করে দিয়েছে। রূপা দ্রুত ভেতরের রুমে চলে গেল রাতিমকে খাবার দিতে। খানিকক্ষণের মধ্যে ফ্রেশ হয়ে চলে আসলো রাতিম। ততক্ষণে খাবার বেড়ে নিয়েছে রূপা। নিঃশব্দে খাওয়া আরম্ভ করল রাতিম। পাশেই মেঝেতে হাঁটু তুলে বসে রইল রূপা। হলদেটে আলোয় রাতিমের মুখের জৌলুশ বেড়েছে যেন। পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর দৃশ্য বোধহয় একজন পুরুষের মায়াবী মুখ! সম্পূর্ণ খাবার শেষ করতে পারলো না রাতিম। গিলতে কষ্ট হলো। কন্ঠনালী চেপে আছে কেমন। উঠে চলে গেল সে। রূপা করুণ চোখে রাতিমের যাওয়ার পানে তাকিয়ে রইল। বাবার দুশ্চিন্তায় নাওয়াখাওয়া বন্ধ করে দিচ্ছে লোকটা। সম্ভব হলে সবকিছু ঠিক করে দিত রূপা।


সারারুম অন্ধকার করে শুয়ে আছে রিশা। খানিক্ষন আগে জোড় করে মা তাকে খাইয়ে দিয়ে গেছে। এখন কেমন হাঁসফাঁস লাগছে। চোখের কার্নিশ বেয়ে জল গড়িয়ে বালিশ ভেজাচ্ছে। ফোন বারকয়েক হাতে নিয়েও রেখে দিয়েছে। রাতিম ভাইকে নির্লজ্জের মতো আর ফোন করবে না। মানুষটা নিজের মুখে বলেই দিলো রিশার জন্য তার মনে কোনো ভালোবাসা নেই। তাহলে এত কেন কষ্ট হচ্ছে রিশার? দম বন্ধকর লাগছে। ফোনের টুংটাং শব্দে ভাবনার ঘোর কাটলো রিশার। পাশ থেকে ফোন নিতেই দেখলো রাতিমের ফোন। বুক ধ্বক করে উঠলো মুহুর্তে! শোয়া থেকে তৎক্ষনাৎ উঠে বসলো সে৷ ফোন রিসিভ করে কানে জড়ালো। শরীর মৃদু কাঁপছে রিশার। ওপাশ থেকে বেশ গম্ভীর স্বর ভেসে আসলো।

"তুমি কি ঠিক আছ, আইরিশ? খেয়েছ রাতে?

" ঠিক নেই আমি। একটুও ঠিক নেই। সেটা আপনিও জানেন। জেনে-বুঝে কেন কষ্ট দিচ্ছেন আমাকে? 

কয়েক সেকেন্ড চুপ থেকে বলল রাতিম,

"রাস্তায় তোমার এমন করা উচিত হয়নি। তোমার প্রতি আমার কখনো অনুভূতি ছিল না, আইরিশ। তুমি অযথা কষ্ট পেয়ো না। 

" ঠিকাছে মেনে নিলাম আপনার কোনো অনুভূতি নেই! কিন্তু আমার আছে। আমি আপনাকে বিয়ে করতে চাই। বাসা থেকে বিয়ের কথা বলেছিল। আমি রাজি হইনি।

"কি পাগলামো করছো? বিয়েতে রাজি হয়ে যাও, যদিও আমার জন্য অনুভূতি থেকে থাকে তাহলে বলবো ভুলে যাও। পৃথিবীতে সবাই সবকিছু পেতে আসে না। তেমনি আমাকে তুমি পাবে না।

কথাটুকু বলেই লাইন কেটে দিল রাতিম। কন্ঠস্বর কাঁপছে তার। কান্না লুকিয়ে রাখা দায় হয়ে যাবে। রিশা হতভম্ব হয়ে বসে রইল। কোনো অনুভূতিই আর স্পর্শ করতে পারলো না তাকে। ছাদের কার্নিশ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে রাতিম। নিয়তি মাঝেমধ্যে বড্ড নিষ্ঠুর হয়ে যায়। রিশার প্রতি অনুভূতি নীরবেই রয়ে যাবে আজন্ম। হয়তো প্রকাশ করা হবে না কখনো।ভাগ্যে রিশার ভালোবাসাই ছিল, একত্রে সংসার করা নয়। নুপুরের শব্দ পেয়ে ভাবনার ঘোর কাটলো রাতিমের। রূপা এগিয়ে আসছে ধীর পায়ে। চোখেমুখে ঈষৎ হাসি। শাড়ির আঁচল ভাসছে বাতাসে। রাতিম দৃষ্টি ঘুরিয়ে নিল। রূপার বিষয়টাও তার ভাবতে হবে। চাচা, চাচীর মৃত্যুর পর বাবা নিজেই রূপার দায়িত্ব নিয়েছে। ভিটেবাড়িই তাদের শেষ সম্বল। সেখান থেকে কিছুটা বিক্রি করে দিলে কেবল রূপার ভাগটাই থাকবে। সেটুকু রক্ষা করতেই বাবা, মায়ের ইচ্ছে রূপাকে বিয়ে করতে হবে রাতিমের। এই টানাপোড়েন জীবনে কি রিশাকে পাওয়ার স্পর্ধা দেখানো যায়? চাঁদ যে চাইলেই ছোঁয়া যায় না। জ্ব-লসে যাবে সব। রাতিমের থেকে কিছুটা দূরে দাঁড়ালো রূপা। দৃষ্টি রাখলো চাঁদের পানে। রাতিম পাশ ফিরে তাকালো। দৃষ্টি আঁটকালো রূপার কাজল টানা চোখে। হলুদাভ মুখশ্রী চাঁদের আলোয় জ্বলজ্বল করছে! এতসব রূপ কি রাতিমকে আকৃষ্ট করতে পারবে? মন যে অন্যত্র! বেশ অনেকটা নীরবতার পর বলল রূপা,

"এই মুহূর্তে আমার কি মনে হচ্ছে জানো রাতিম ভাই? তুমি যদি হলুদ পাঞ্জাবী পরতে তাহলে তুমি হতে হিমু আর আমি তোমার রূপা! দেখো নীল শাড়ি পরেই আছি আমি।

দূরে চাঁদের পানে দৃষ্টি রাখলো রাতিম। রূপার কথায় স্পষ্ট বুঝতে পারছে মেয়েটা তাকে নিয়ে স্বপ্ন বুনতে শুরু করে দিয়েছে। রাতিম যে স্বাভাবিক হতে পারছে না।৷ থমথমে গলায় বলল,

" হিমুরা কেমন হয় জানিস তুই? আমি যদি সত্যিই হিমু হই মেনে নিবি তুই?

"না না! তুমি বরং বাস্তব জীবনের রূপার রাতিম হইয়ো। ঠিক তোমার মতো। 

কথাটুকু বলতেই চোখমুখ খিঁচিয়ে নিল নিল রূপা। জিভ কামড়ে ধরলো। পরক্ষণে দ্রুত নেমে গেল। ভীষণ লজ্জা পেয়ে গেল। দীর্ঘশ্বাস ফেলল রাতিম। 

◼️

রাস্তায় দুপাশে সোডিয়াম আলো জ্বলছে। কুহুর হাতে ওয়ানটাইম কাপ চা। কথা বলতে বলতে হেঁটে যাচ্ছে। পেছনে পকেটে হাত পুরে হাঁটছে রওনক। ওষ্ঠকোণে তার মৃদু হাসি। পাগলাটে মেয়ে আজ বাচ্চাদের মতো সব বায়না করেছে। কুহুর শাড়ির আঁচল পিচঢালা রাস্তায় পড়ে গড়াগড়ি খাচ্ছে। লম্বা লম্বা পা ফেলে এগিয়ে গিয়ে শাড়ির আঁচল কুঁড়িয়ে নিল রওনক। আঙ্গুলে পেচিয়ে নিয়ে হাঁটা ধরলো কুহুর পাশাপাশি। কুহু বকবক করেই যাচ্ছে। কে বলবে এই মেয়েটার খানিক্ষন আগে রাগ ছিল? কুহুর খোঁপায় বেলি ফুলের মালা বাঁধা। যেটা কিছুক্ষণ আগে রওনক পরিয়ে দিয়েছে। মিষ্টি এক ঘ্রাণ ভেসে আসছে সেটা থেকে। সামনে রিকশা পেতেই ডাকলো রওনক। রাত ভালোই হয়েছে। এতটা সময় কখন পাড় হয় খেয়ালেই ছিল না! হাতের কাপটা ফেলে রিকশায় উঠে বসলো কুহু। পাশে বসলো রওনক। খানিকটা মাথা এলিয়ে দিল কুহুর কাঁধে। এই সুমিষ্ট ফুলের ঘ্রাণে নাক ডুবিয়ে দিল। অদ্ভুত এক মায়ার আবেশে জড়িয়ে গেল। কুহু আর কোনোরকম কথা বলল না। দৃষ্টি পাশ ঘুরিয়ে রাখলো। ঠোঁটের কোণে হাসি ধরা দিল তার। রওনক ভাইকে পাওয়ার পর সবচেয়ে সুন্দরতম দিন ছিল আজ। উষ্ণ শ্বাস গন্ডস্থল ছুঁয়ে যাচ্ছিল কুহুর। অন্যরকম এক ভালো লাগা ছুঁয়ে দিচ্ছিল। চোখ বুজে প্রলম্বিত শ্বাস নিয়ে তাকালো কুহু। গুনগুন সুর তোলে গান গাইতে আরম্ভ করলো।

‘তোমার ইচ্ছেগুলো ইচ্ছে হলে আমায় দিতে পারো,
আমার ভালোলাগা, ভালোবাসা তোমায় দিব আরো’

রওনক মাথা তুলে তাকালো। কুহুর হাতটা টেনে নিল নিজের হাতের মুঠোয়। দমকা একগুচ্ছ হাওয়া ছুঁয়ে দিলো কুহুর চোখেমুখে। পাশ ফিরে তাকাতেই চোখাচোখি হলো। দৃষ্টি নিচু করলো কুহু। অপর হাত রাখলো রওনকের হাতের উপর। 

◼️

মাস খানেক পাড় হলো। রাতিমের নাম্বার থেকে আর ফোন আসেনি। এই কয়টাদিন চাতকের মতো অপেক্ষা করে গিয়েছে রিশা। যে বারবার ফিরিয়ে দেয় তার দুয়ারে কতবার গিয়ে দাঁড়ানো যায়? বেলা মধ্যাহ্নে। জানালার পাশে বই নিয়ে বসে আছে রিশা। পড়াশোনা থেকে বেশ অনেকদিনই দূরে ছিল। এভাবে জীবন চলে না। কয়েকদিন পরেই সেমিস্টার পরীক্ষা। কষ্ট ভুলতে পুনরায় পড়াশোনায় মনোযোগী হলো রিশা। তার বিশ্বাস রাতিম ভাই চাকরি পেলে ঠিক আগের মতোই হয়ে যাবে। ভালো কিছু পেতে অবশ্যই দূরত্বের প্রয়োজন। 

"কিরে পড়া হলো তোর? গোসল করেছিস? নাকি পড়ছিস এখনো? হয়েছিস তো ভাইয়ের মতোই। পড়া ছাড়া বুঝিস কিছু? 

মায়ের কথায় ভাবনার ঘোর কাটলো রিশার। ততক্ষণে মেয়ের রুম গোছাতে ব্যস্ত হয়ে গেলেন শারমিন বেগম। বই খাতা গুছিয়ে নিল রিশা। ওয়ারড্রব থেকে কাপড় বের করলো। মেয়ের দিকে এপলক তাকিয়ে নিয়ে বললেন শারমিন বেগম,

" আশফিক দেশে আসছে সামনের সপ্তাহে। তোর সঙ্গে আশফিকের বিয়ে নিয়ে আলোচনা হয়েছে। বাকি কথা খাওয়ার সময় তোর বাবা বলবে। তাড়াতাড়ি গোসল করে খেতে আয়।
·
·
·
চলবে...............................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন