দুপুর গড়িয়ে বিকেল। সূর্যটাও রক্তিম থেকে লাল হতে শুরু করেছে। কালো রঙের চারটি গাড়ি গ্রামের কাঁচা রাস্তা পেরিয়ে চৌধুরী বাড়ির দিকে যাচ্ছে। সেহরিশ খোলা মাঠের দিকে তাকিয়ে। মাথা ঘুরিয়ে রোদেলার দিকে তাকাল সে। সিটের সঙ্গে হেলান দিয়ে জানালা দিয়ে বাহিরে তাকিয়ে রেখেছে মেয়েটা। সেহরিশ মাথা নিচু করে ভারী নিঃশ্বাস ফেলল। দুই'বছর পর আবার দেশে এসেছে রোদেলা। তেমন কিছুই বদলায়নি। রোদেলা তৃপ্তি নিয়ে চেনা গাছ, বাড়ি-ঘর, কাঁচা বাজার পথঘাট দেখে খুশি হয়ে উঠল। সহসা বুকের ভেতরটা মুচড়ে ওঠে। মাথার মধ্যে একটাই নাম ঘুরপাক খাচ্ছে, জোজো। রোদেলা মাথা নেড়ে নিজেকে সামলে নিলো। সেহরিশ হাসার চেষ্টা করে জিজ্ঞেস করল, 'খারাপ লাগছে?'
'না।'
কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে রইল রোদেলা।হঠাৎ একবার সেহরিশের দিকে তাকাতেই চোখাচোখি হয়ে গেলো। মানুষটা নিঃশব্দে এতক্ষণ তাকেই দেখছিল। সেহরিশ বলল, 'মন খারাপ করে থেকো না। তোমাকে এভাবে দেখতে আমার ভালো লাগে না।'
রোদেলা সেহরিশের দিকে তাকাল। অনেকক্ষণ পর রোদেলা খুব অসহায়ভাবে বলল, 'আমি কী একবার জোজোকে দেখতে যেতে পারবো?'
চমকে উঠল সেহরিশ। বলল,
'কিন্তু জোজো তো..' শেষ কথাটুকু বলতে নিয়েও থেমে গেলো সেহরিশ। জোজো আর নেই। এই কথাটা তার থেকেও রোদেলা ভালো জানে। সত্য জেনেও সে বলেছে, ওর সঙ্গে দেখা করতে চায়। এর অর্থ একটাই হতে পারে। জোজোকে যেখানে কবর দেওয়া হয়েছে। রোদেলা একবার সেখানে যেতে চায়। সেহরিশ জবাব দিলো না। একই ভঙ্গিতে বসে রইল।
রোদেলা বলল, 'কিছু বলবেন না?'
এবার রোদেলার দিকে তাকাল সেহরিশ। চাপা গলায় বলল, 'তুমি অবশ্যই যাবে। কিন্তু জোজোকে কোথায় রাখা হয়েছিল আমি জানি না। বাড়ি যাওয়ার পর সময় করে তোমাকে জোজোর কাছে নিয়ে যাবো।'
রোদেলা গম্ভীর মুখে বলল,
'আমি একা যাবো।'
বাড়ির রাস্তায় এসে সেহরিশ চমকে গেল। দেখল বাড়ির সামনে অনেক অচেনা মানুষের ভিড়। এক মূহুর্তের জন্য থমকে গেল সে। মানুষগুলোর দিকে তাকাতেই মাথায় এলো বাবার কথা। সঙ্গে সঙ্গে মাথা নাড়লো, 'না, না বাবা ঠিক আছেন। আমি ভুল ভাবছি।'
এত মানুষের ভিড়ে গাড়ি গেট দিয়ে ঢুকবে না। অগত্যা ওদের নামতে হলো। বডিগার্ড খুব সাবধানে ওদেরকে গেট দিয়ে ভেতরে নিয়ে গেলেন। বাড়ির পরিবেশ থমথমে। যেনো বাড়ির উপর দিয়ে ঝড় বয়ে গেছে। সেহরিশ ও রোদেলা দরজা দিয়ে গিয়ে ড্রয়িংরুমে দাঁড়াল। ঘরের কোনা থেকে চিনচিনে গলার কান্নার আওয়াজ ভেসে আসছে। সেহরিশ সেখানে দাঁড়িয়ে জানতে চাইল,
'কি হয়েছে? মা, কান্না করছে? আমাকে বলবে কি হয়েছে?'
সেহরিশ এক এক করে সবার দিকে তাকাল। সকলের চোখ মুখ ভাঙা ভাঙা লাগছে। শীর্ণ দেখাচ্ছে, চোখ কোটরে ঢুকে গিয়েছে। সেহরিশ আবারও একই প্রশ্নটি করেও উত্তর পেলো না। শফিকুল চৌধুরী হুইলচেয়ারে চোখ বন্ধ করে বসে আছে। সেহরিশ বুক ভরে শ্বাস নিলো এইভেবে বাবার কিছু হয়নি। তিনি ঠিক আছেন। সেহরিশ তাড়াতাড়ি করে শফিকুল চৌধুরীর উদ্দেশ্য বলল,
'বাবা, আপনি অন্তত বলুন। কি হয়েছে? আমাকে এত জরুরি তলব করে আসতে বলা হয়েছে কেন?'
সেহরিশের বড় ভাই, সোহান সেহরিশকে বলল, 'এক দেশ থেকে আরেক দেশে আসবি। সেজন্য ফোনে সব কথা বলা যায় না। পুরো রাস্তা দুঃশ্চিন্তা করে আসতে হতো।'
সেহরিশ বলল, 'এইযে কিছুই বলোনি এতেও কিন্তু কম দুঃশ্চিন্তা হয়নি।'
সোহান চটপট উত্তর দিলো, 'আরুশি আর নেই।'
সেহরিশ হতভম্ব। সোহান আবার বলল,
'কত পরশু রাতে, আরুশির মরদেহ যমুনা সেতুর ব্রিজের নিচে পাই। ওখানে কিছু মানুষ নদীর তীরে খেঁজুরপাতার পাটি পেঁচানো একটা বস্তু দেখতে পান তারপর সেটার কাছে যান। বাঁধন খুলে দেখে মেয়ের লাশ। তারপর সেখানে পুলিশ যান। খবর চ্যানেলে প্রচার হয়। আরুশির ছবি দেখে আমরা চিনতে পারি। তারপর সেখানে যোগাযোগ করে পৌঁছাতে প্রায় রাত হয়ে যায়। আরুশির লাশ পোস্টমর্টেম করা ততক্ষণে শুরু করে দিয়েছিল। সেখান থেকে বাড়ি পৌঁছাতে পৌঁছাতে ফজরের আজান পড়ে যায়। মা তো এখন শকট হয়েছে যে দুদিন ধরে কথাই বলতে পারছে না।' এতটুকু বলে সোহান একটা বড় নিঃশ্বাস ফেলল। দুই চোখের কোণ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ল। আঙুলের ডগায় জলেরধারা মুছে আবার বলল, 'আরুশি বেঁচে থাকতে তোকে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসতো। তোকে ছাড়া ওর শেষ বিদায় দেওয়া আমাদের পক্ষে সম্ভব হয়নি। বাবা বলল, তোকে আসতে বলার জন্য। মায়ের যা অবস্থা দেখলাম তারপর আর তোকে পুরো সত্যটা ফোনে জানাতে পারলাম না।'
সেহরিশ বিড়বিড় করে বলল,
'আরু কোথায়?'
সোহান বলল,
'বাগানের দিকটায় ফাঁকা জায়গা আছে। ওখানে লাশবাহী ফ্রিজিং গাড়িতে আছে।'
সেহরিশের পা টলতে লাগল।
রোদেলা এগিয়ে গেলো ফারিয়া বেগমের কাছে। রোদেলা কে দেখে হঠাৎ একটা কান্না ছিটকে বেরুলো ফারিয়ার গলা থেকে। হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলেন। দু-হাতে শাশুড়িকে সামলানোর চেষ্টা করে রোদেলা। কান্না চেপে ধরে ছটফট করতে লাগল ভেতর ভেতর সে।
আরুশি চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে। সোহান সেহরিশকে তার কাছে নিয়ে গেলো। সেহরিশ পাশে গিয়ে বসেই জিজ্ঞেস করল, 'আরু, দেখ তোর ভাই এসেছে। চোখ খোল। এভাবে চুপ করে থাকলে কিন্তু আমি রেগে যাবো। আমার লক্ষী বোন, আমি এতদিন তোর কোনো কথা শুনিনি। আজ থেকে সব কথা শুনবো। তুই একবার আমার সঙ্গে কথা বল, ভাই বলে ডাক।'
সেহরিশের ঠোঁট কাঁপতে লাগল। তার ঠোঁট মুচড়ে উঠল। চোখ বন্ধ করল ও। সোহান ধীরে ধীরে সেহরিশের কাঁধে হাত রাখল। সোহান ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো। সেহরিশ শব্দ করে ডাকার পরও আরুশি চোখ খুলছে না। সেহরিশ পরিস্কার গলায় প্রশ্ন করল, 'ভাই, ওকে বলো না চোখ খুলতে।'
সোহান হঠাৎ কানের কাছে বলল,
'পোস্টমর্টেম রিপোর্ট শুনে তুই চমকে যাবি।' এই বলে থামল সোহান। তারপর তর্জনী আঙুল আরুশির গলা থেকে মাথার দিক যতটা দেখা যাচ্ছে সে অংশ সেহরিশ কে দেখিয়ে বলল, 'ওর গায়ে এই যে যত লাল ও নীলচে-কালো দাগ দেখছিস, সব মারের দাগ। ওর হাসবেন্ড অনিক। ওর ওপর শারীরিক নির্যাতন করতো।'
সেহরিশ চোখ বড় বড় করে সোহানের দিকে তাকাল।
'অনিক কোথায়?'
সোহান বলল,
'জানি না। তাছাড়া আমরা তো এটা বুঝতে পারছি না, আরুশি সিলেট থেকে যমুনা সেতুর নিচে ব্রিজের নিচে এলো, কি করে?'
'অনিককে কল করেছিলে?'
'হ্যাঁ, ফোন বন্ধ। পুলিশ খুঁজছে।'
সেহরিশ চোখ ঘুরিয়ে বলল,
'জানাজার ব্যবস্থা করো।'
চারিদিকে মানুষ গিজগিজ করছে। জানাজার পরেই মানুষ কমতে শুরু করে। রোদেলার মামা-মামী দুদিন ধরে এ বাড়িতেই আছেন। বড় বউ মাইমুনার সঙ্গে হাতে হাতে কাজ করছেন পুতুল বেগম। দূর থেকে আসা আত্মীয়দের রাতের খাবার খেতে দেয় মাইমুনা। রোদেলা অনেক জোরাজোরি করে শ্বশুর মশাইকে অল্প খাওয়াতে পেরেছে। কিন্তু শ্বাশুড়ি কিছুই খাননি। সেহরিশ গম্ভীর ভঙ্গিতে তার ঘরে দাঁড়িয়ে আছে। ঘর অন্ধকার। ফোনের সংকীর্ণ আলো চোখেমুখে পড়ছে। দুই অক্ষরের একটা মেসেজে চোখ আটকে গেছে তার। আরুশি মেসেজ করেছিল এক সপ্তাহ আগে। লিখেছিল, ভাই আমাকে বাঁচা। মেসেজটি পাওয়া মাত্র সেহরিশ তাকে কল করে। কিন্তু তখন আরুশি কল ধরেনি। পরবর্তী আরুশি কল ব্যাক করে জানায় সে দুষ্টুমি করে মেসেজ দিয়েছিল। তার ছোট্ট বোনটা কত যন্ত্রণা সহ্য করে তারপরই না, কথা লুকিয়ে মিথ্যে বলতে শিখেছিল।
সেহরিশ চোখ বন্ধ করল, 'অসম্ভব! আমি যা ভাবছি তা কিছুতেই হতে পারে না। কিন্তু যদি হয় তাহলে? আমাকে সত্য খুঁজে বের করতেই হবে।'
.
.
.
চলবে...............................................................