কামিনী - পর্ব ০২ - মম সাহা - ধারাবাহিক গল্প


 ব্যথার ঘোরে চক্ষু দু'টো রক্তিম বর্ণ ধারণ করেছে। মুখে অস্ফুটস্বরে গোঙানি। দক্ষিণে বারান্দার কোলে এক মুঠো জোছনার সাথে মৃদুমন্দ সমীরণ এসে ধাক্কা খাচ্ছে রাজপ্রাসাদের চারপাশটা। সেই পবনের খানিক ছোঁয়া এসে লাগছে রানি কামিনীর ব্যথায় জর্জরিত দেহটায়। 
মিহি বাতাসের নিবিড় আলিঙ্গনে কেঁপে কেঁপে উঠছে তার শরীরটা। যতবার বাতাসের ছোঁয়া এসে ছুঁয়েছে গা ততবার তিনি বিড়বিড় করে বলেছেন, 
 "ধরো না আমায়। স্পর্শ করো না আমায়। ঘৃণা আসবে তোমার।"

যামিনী মাথার পাশটাতে বসেই সবটা শুনেছে চুপচাপ। নিশ্চুপ ঘরটাতে শব্দ গুলো স্পষ্ট হয়ে এসে এসে কানে লাগছে। লাগছে অন্তরের গভীরে। বৈদ্য এসে ওষুধ দিয়েছেন। কুসুম গরম জলে রানির আঘাতপ্রাপ্ত স্থান গুলো মুছিয়ে দিয়েছে যামিনী। তাকে সাহায্য করেছে রেবেকা উযোয়ার। রানি কামিনীর হুঁশ নেই বললেই চলে। যার হুঙ্কারে রাজ্য কাঁপে সে-ই এখন চরম দুঃখিনীর মতন আর্তনাদ করছে। ক্ষণে-ক্ষণে জানাচ্ছে নিজেকে নিয়ে নিজের মনে তৈরি হওয়া ঘৃণার কথা। 

 রাত পেরিয়ে রবির জাগরণের প্রহর ঘনিয়ে আসে। যামিনী মাথার কাছটাতেই ঘুমিয়ে দিশেহারা প্রায়। শেষ রাতের দিকেই চোখ লেগে গিয়েছে তার। বাতায়নের কোল ছুঁয়ে থাকা বিরাট ভারি পর্দা গুলো উড়ে বাতাসে। সূর্য তখনও উঠেনি তবে ধরার মাঝে উঁকি দিয়েছে এক খণ্ড আলোর রশ্মি। সেই আলোর এক ছটাক এসে রানির চোখে-মুখে লাগতেই তার ঘুম ভেঙে গেলো। চোখের পাতা ভারি হয়ে আসছে। রাতে অনেক বেশিই মদ্যরস খাওয়ার প্রভাবেই হয়তো এই চোখের পাতা এতটা টানছে। 
রানি শরীর নাড়াতে গিয়েই অনুভব করলো দেহের বিভিন্ন জায়গা ব্যথায় ঝিম মেরে আছে। নাড়াতে পারছেন না শরীরটা। গা এতটাই উত্তপ্ত যেন বিছানাটাসহ সেই তাপে গরম হয়ে গেছে। কিন্তু রানি কামিনী সেই ব্যথাকে তোয়াক্কা করলেন না। আড়ম্বরশূন্য ভাবেই উঠলেন বিছানা থেকে। জানালা দিয়ে কিছুটা আলো কক্ষে প্রবেশ করছিলো বিধায় আটকে দিলেন জানালাটা। যামিনীর শরীরে জড়িয়ে দিলেন চাদরখানা। 

টেবিলের উপরে তখনও তরল নেশা জাতীয় পানীয়টি পড়ে আছে। রানি সেই ভারি হয়ে আসা মাথাটা নিয়েই একটু চুমুক বসালো পানীয়র শিশিতে। তখন সূর্য উঠল সবে। এতক্ষণ বোধহয় রানির জাগরণেরই অপেক্ষা করছিলো সে! 
ভোরের ঠিক প্রথম প্রহরের সূর্যের রশ্মিটুকু এসে চুম্বন আঁকলো অনিন্দ্যসুন্দরী এই রানি কামিনীর মুখমণ্ডলে। মনে হলো সূর্য সে নয়, এই রানি কামিনীকাঞ্চনই একটি সূর্য। অগ্নির একটুকরো জ্বলন্ত লাভা। গায়ের চাকচিক্যময় গহনা আর পোশাক দ্বিগুণ রূপে ঝলমলিয়ে উঠলো। প্রথম কিরণের একখণ্ড সূর্য মানবীকে দেখে পৃথিবী বোধকরি মুগ্ধ হলো। মুগ্ধ হলো আসমান। অথচ রানির কাছে এই রূপ প্রচণ্ড ঘৃণার। তুমুল আফসোসের। 

রানির গায়ের গহনার রুনুঝুনু ঝঙ্কারে ঘুম ছুটে গেলো যামিনীর। সাত-সকালে রানিকে নেশায় বুদ হতে দেখে খানিক চিন্তিত হলো। চিন্তা প্রকাশ পেলো তার কণ্ঠে,
 "সখী, এই প্রভাতকালেই এসব খাচ্ছো! তোমার শরীরটা যে বিশেষ ভালো নেই।"

রানির তির্যক দৃষ্টি তখনো বাহিরে, "সখী, আমার শরীরে খোঁজ রেখে তোমার বিশেষ কাজ নেই। আর আমি চাইবও না তুমি খোঁজ রাখো।"

রানির কণ্ঠে কাঠিন্য প্রচন্ড। যামিনী মাথা ঝুঁকালো, "কাল খুব কষ্ট পেয়েছিলে তুমি। তা-ই তো...."

 "আমার কষ্ট! সে আবার কী বস্তু? আমার কোনো কষ্ট নেই, সখী। আমি নিজেও মানি আমি ক্লেশ-দুঃখের উর্ধ্বে। তুমিও এবার থেকে সেটাই মানবে কেমন? এবার নিজের কক্ষে যাও। সকাল হয়ে যাচ্ছে। ঘুমিয়ে নাও।"

রানির রুক্ষ বাক্যের বিপরীতে যামিনী উত্তর দিতে পারলো না। মাথা নত করেই বেরিয়ে গেলো নীরবে। চোখেই লুকিয়ে ফেললো বেদনার অশ্রুদের। 
 রেবেকা বাহিরে দাঁড়িয়ে ঠিকই শুনলো সব। যামিনীকে বের হতে দেখেই অসহায় চোখে তাকালো সে। খুব ধীরে বলল, "রানি সুস্থ আছেন এখন?"

যামিনী লুকিয়ে নিলো অশ্রুকণা। জবাব দিলো, "হ্যাঁ।"

 "এতগুলো দিন হলো এই রাজপ্রাসাদে এলাম। এখনো বুঝতে পারলাম না রানি এমন কেন? আপনাকেও কিছু বলতে বাঁধে না তার মুখে!"

রেবেকার বাক্যে হুঁশিয়ার করলো যামিনী। সাবধানী কণ্ঠে বলল, 
 "ভুলেও রানির মহলে দাঁড়িয়ে রানির নামে কিছু বলো না। কথায় আছে, এই মহলের প্রতিটি কোণা রানির আয়ত্তে। কেউ কিছু বলে বাঁচতে পারবে না।"

"তাই বলে সে আপনাকেও দুঃখ দেবে?"

 "আমাকে দুঃখ দিয়েছে কে বলল? আমি কখনো ওর কথায় দুঃখ পাই না। এই ধরাতে সব কঠিন কথার ভেতরে আঘাত থাকে না, রেবেকা। কখনো কখনো নিজেকে কঠিন প্রমাণ করার জন্যও মানুষ এমন বলে। আমি ছাড়া ওর কেই-বা আছে!"

রেবেকা যামিনীর এমন উদারতায় অবাক হলো। রানি কামিনী এবং তার সখী যামিনী দু'জনই যেন দু'জনের বিপরীত। তবুও তাদের এতটা মিল, এতটা সুসম্পর্ক কীভাবে? 
 তাদের কথপোকথনের মাঝেই ভেতর থেকে রানির হাঁক এলো। খুব স্বাভাবিক ভাবেই বললেন, "রেবেকা উযোয়ার, আমার স্নানের আয়োজন করো। হলুদ বাঁটা নিয়ে এসো আজ। চন্দন, গোলাপ সব সাজাও দ্রুত। আমি স্নানে যাবো।"

যামিনী রেবেকাকে ইশারা করলো। শীগ্রই সবকিছু তৈরি করতে বলেই চলে গেলো। 

 দীর্ঘ একটি স্নানের পর রানি স্নানাগার থেকে বের হলো। এসে দাঁড়ালো নিজের ঘরের বিরাট আরশিটির সামনে। মাখনের মতন মোলায়েম শরীর তার। চাঁদের মতন রঙ। সেই শরীরে দাগগুলো ঠিক চন্দ্রের প্রস্তর কলঙ্ক মনে হচ্ছে। যা দেহের শোভা যেন হ্রাস করার বদলে বৃদ্ধি করেছে। 
রানি নিজের শরীরে পেঁচানো কাপড়টুকু সরিয়ে ফেললেন। একটি সুতোও রইলো না দেহে। উনি ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলেন সামনের দর্পণে থাকা নিজের অবয়বটির দিকে। সৃষ্টিকর্তা কতই না যত্ন করে এই দেহটি সৃষ্টি করেছিলেন। কোথাও কোনো ত্রুটি নেই। নিজের দেহের দিকে তাকিয়ে রানির মনে মনে কী তীব্র ঘৃণা এলো! এক দলা থুতু সঙ্গে সঙ্গে নিক্ষেপ করলেন তাই আয়নাটাতে। অবজ্ঞায় চোখ জ্বলজ্বল করল তার। হঠাত দানবীয় হেসে বলল,
 "এ দেহের প্রতি এত লোভ তো পৃথিবীর! তাই এই দেহে দাগ থাকবে। কলঙ্ক থাকবে। এই দেহ কারো হবে না। কারো না। এই দেহ হবে কেবল ঘৃণা, অবজ্ঞার। এই দেহকে ভোগ করতে চাওয়া একটি মানুষেরও এই দেহ হবে না।"

আরশি থেকে তখন মানস প্রতিবিম্বটি কথা বলে উঠলো। বড়োই রহস্য করে শুধালো, "যদি কেউ দেহ রেখে মনকে বাসনায় রাখে তবে কি এই মায়ার শরীর তার হবে?"

প্রতিবিম্বের কথায় চেঁচিয়ে উঠে রানি, "না, না, এই দেহ রেখে কোনো পুরুষ নেই যে আমার মনকে পাওয়ার জন্য আকুল হবে। এই পুরুষশাসিত পৃথিবীটায় যৌনতা সব। সবাই আমাকে যৌনতার জন্য কাছে টেনেছে। সবাই।"

প্রতিবিম্ব হেসে উঠল। অবজ্ঞায় বলল, "পৃথিবীর কি দোষ? তোমার জন্মদাত্রী জননীর দোষ পৃথিবীর উপর দিও না। দিও না তোমার জন্মদাতার দোষ এই ধরাকে।"

প্রতিবিম্বটির কথাগুলো কাঁটার মতন বিঁধতে লাগলো রানির শরীরে। সে টেবিলে থাকা কাঁটাযুক্ত গোলাপ গাছটিকে মুঠ করে ধরল। দাঁতে দাঁত চেপে বিড়বিড় করে বলল, "আমি সবাইকে মেরে ফেলবো। সবাইকে।"

"ঘৃণা তো তোমার নিজের উপর। সবাইকে না মেরে নিজেকে তো মারতে পারো।" 

থেমে গেলেন রানি। তাকিয়ে রইলেন প্রতিবিম্বটির দিকে। তার মন আর মস্তিষ্কের ভেতরে চলা এই দ্বন্দ্ব প্রতিবার শেষ হয় এই বাক্য দিয়ে। নিজেকে মেরে ফেললেই তো তার সব সমস্যা শেষ! তাহলে তিনি কেন নিজেকে মারছেন না? তবে কি ঘৃণার দেহের উপরে তার মায়া আছে? কেউ তাকে আকুল হয়ে ভালোবাসবে সেই আশাতেই কি তিনি বেঁচে আছেন? অপেক্ষায় আছেন?
এই জবাব জানা নেই রানির। আবার হয়তো জানা আছে কিন্তু মানতে পারেন না। 

৩.

 রাজ্যের বহুল পরিচিত জায়গা হলো একটি মোটা অশ্বত্থ বৃক্ষ। কারণ রানি আজ অব্দি যত মানুষ মেরেছেন সব এই অশ্বত্থ বৃক্ষের কাছটাতেই। পুরো রাজ্যবাসীকে সাক্ষী রেখেই তিনি একের পর এক মানুষের প্রাণ নিয়েছেন। আজও এই জায়গাটিতে জমেছে প্রজাদের ভিড়। রানি দাঁড়িয়ে আছেন অশ্বত্থ বৃক্ষটির ঠিক সামনে। অশ্বত্থ গাছটির একটি ডালের সামনে দাঁড়ি দিয়ে বাঁধে রাখা হয়েছে একটি মানুষকে। সবাই খুব সহজেই ধারণা করতে পারছেন এই মানুষটির আজই শেষ দিন। কিন্তু তার অপরাধ কী? আর মানুষটিই বা কে? তা ঠিক ঠাহর করতে পারছেন না কেউ। কারণ মানুষটির মুখ ঢাকা আছে একটি কালো কাপড়ে। 

প্রজাদের ভেতর কোনো গুঞ্জন নেই। নেই কোনো কথোপকথন। সবাই স্থবির হয়ে তাকিয়ে আছে সামনের দৃশ্যটির দিকে। রানির সামনে কেউ ফিসফিসিয়ে কোনো কথা বলবে তার সাহস নেই। নিত্যদিনের মতন আজও রানির রাজকীয় সাজগোছ। সোনার মতন অঙ্গে ঝলমলিয়ে উঠছে জোছনার মতন রূপ। সকলে উৎকণ্ঠায় তাকিয়ে আছে রানির দিকে। তাদের সবচেয়ে বেশি উত্তেজনা সামনের কালো কাপড় দিয়ে ঢাকা লোকটির দিকে। কার প্রাণ আজ শেষ হবে তা দেখার জন্যই মুখিয়ে আছে সকলে। 

রানির কিছুটা দূরে দাঁড়ানো যামিনী, রেবেকাসহ তার মহলের আরও দাস দাসী। রানি তার সবচেয়ে বিশ্বস্ত সেনাপতি হ্যাব্রোকে ইশারা করলেন অজ্ঞাত লোকটির মুখের কাপড় সরিয়ে দেওয়ার জন্য। হ্যাব্রো রানির অনুমতি পেতেই কাপড় খুললো। তখনই জনসমুদ্রের ভিড়ে ছড়িয়ে পড়লো গুঞ্জন, বিস্ময়। যামিনীসহ ভীষণ অবাক হয়ে গেলো। রেবেকা আঁতকে উঠে বলল,
 "ইনি আপনার খাস প্রহরী- নাথান না? নাথান কী করেছে? রানি তাকে শাস্তি দিতে এনেছেন কেনো?"

যামিনী নিজেও তখন কিংকর্তব্যবিমুঢ়। যন্ত্রের মতন অস্ফুটস্বরে বলল, "আমি নিজেও তো কিছু জানি না!"

রানি সকলের আতঙ্কিত চোখ মুখের দিকে তাকালো। ভেতর ভেতর শান্তি অনুভব করলো প্রজাদের ভীতি দেখে। 

 "আপনারা নিশ্চয় জানতে চাচ্ছেন ও কে? আবার অনেকে জানেনও। তা-ও আমি দ্বিতীয় বার জানাতে চাচ্ছি। ও আমাদের খাস প্রহরী নাথান।"

সকলেই নাথানকে চেনে। বেশিরভাগ সময় রানির আশেপাশে নাথানকে দেখা যেতো। তাহলে রানি কেন এত বিশ্বস্ত প্রহরীকে শাস্তি দিতে এনেছেন? কী তার অপরাধ? 

 "নাথানের অপরাধ কি জানেন? নাথান আমাকে ছিঁড়ে খেতে চেয়েছে। নাথান বলেছে, ও যদি কোনো দেশের রাজা হতো তাহলে আমাকে ছিঁড়ে খেতো।"

সবাই অবাকের উপর অবাক হচ্ছে। এত খাস প্রহরী এমন একটা কথা কীভাবে বলেছে তা ভেবে ভেবে হয়রান। কেউ খুব ধীরে বলল, "নারী যদি এত সুন্দর হয়, পুরুষ তো আকর্ষিত হবেই। এতে দোষ কী তার?"
কিন্তু এই কথাটি এতটাই ধরে হলো যেন মিলিয়ে গেলো বাতাসের সাথে। 

রানি আবার বললেন, "নাথানকে আজ এখানে কেন আনা হয়েছে সেটা নিশ্চয় ভালো করেই বুঝতে পারছেন? নাথানকে আনা হয়েছে শাস্তি দেওয়ার জন্য। তবে নাথানকে একটিবার বাঁচার সুযোগ দেওয়া হবে। নাথান যেহেতু আমাকে ছিঁড়ে খেতে চেয়েছে তাই এই সমগ্র রাজ্যের সামনে আমি নাথানের সামনে গিয়ে দাঁড়াবো। নাথানকে সুযোগ দেওয়া হবে আমাকে ছিঁড়ে খাওয়ার। নাথান যদি সেটা পারে তাহলে তাকে ছেড়ে দেওয়া হবে। আর যদি না পারে, রাজ্যের কেউ তাকে আটকায়, তাহলে তাকে সবার মতনই নৃশংস শাস্তি দেওয়া হবে।"

 রাজ্য জুড়ে বয়ে গেলো হিমশীতল স্রোত। রানি কী বলছেন এসব? যামিনী খানিক এগিয়ে আসলো, "কী বলছো, সখী!"

 "আমি ঠিকই বলছি। এবার নাথান আমাকে ছিঁড়ে খাবে। আমার রাজ দরবারের কেউ এখানে আসবে না। হ্যাব্রো, তুমি নাথানের গিঁট খুলে দেও। আমি দাঁড়ালাম এখানে।"

সবাই আহম্মক বনে গেলো। বিস্ময় নিয়ে তাকিয়েই রইলো কেবল। হ্যাব্রো নাথানের বাঁধনটা খুলে দিলো। নাথানের চোখ-মুখ তখন ফ্যাকাশে। 
রানি বললেন, "নাথান, দেখি আমাকে কী করবে, করো।"

নাথানের ফ্যাকাশে মুখে এতক্ষণ হতবিহ্বলতা থাকলেও সে পালিয়ে গেলো না। বরং সে রানিকে ছিঁড়ে খাওয়ার প্রস্তাবকেই সাদরে গ্রহণ করল। চোখ মুখ তার জ্বলজ্বল করে উঠল লালসায়। সে এগিয়ে এলো। প্রকাশ্যে এসেই টেনে খুললো রানির মাথার ওড়নাটা। পুরো রাজ্য নিশ্চুপ। রানি দাঁড়িয়ে রইলো ঠাঁই। নাথানের যেন সাহস বেড়ে গেলো। সে হাত দিলো রানীর জামার কাঁধের দিকটাতে। যামিনী আঁতকে উঠল,
 "কী করছো, নাথান! থামো। রানি কামিনীকাঞ্চন এই রাজ্যের রানি। তার গায়ে হাত দেওয়ার দুঃসাহসিকতা দেখাচ্ছো! প্রাণের ভয় নেই তোমার?"

নাথান থামার পাত্র নয়। তার হাতের নখের আঁচড় বসে গেলো রানির গলার দিকটায়। রানি উপস্থিত সকলের দিকে তাকালো নিবিড় ভাবে। অবাক হলো প্রজাদের নিরবতা দেখে। এই রাজ্যের জন্য সে কি না করলো? এই প্রজাদেরকেই সুষ্ঠ, অন্যায় বিহীন রাজ্য দিতে সে কঠিন থেকে কঠিনতম হয়ে উঠেছে। অথচ এরাই কি-না প্রকাশ্যে হওয়া রানির এমন অপমান দেখছে? এই জীবনে তাহলে তার প্রাপ্তি কী? কিছুই না..... 
 ঠিক সেই মুহূর্তে দূর থেকে নিখুঁত তীর তীব্র গতিতে ছুটে এসে লাগল নাথানের হাতে। বিভৎস চিৎকারে নাথান লুটিয়ে পড়লো মাটিতে। রানি চমকে উঠলেন। তীর ছুটে আসা পথটার দিকে তাকালেন। কোথা থেকে এলো এই তীর বুঝে উঠলেন না কিন্তু খুব দূরে ভিড়ের মাঝে মিশে যেতে দেখলেন একটি পুরুষকে। সেই পুরুষের ঘোলাটে চোখ যুগল কেবল দেখলেন রানি। লোকটির মাথার উপর উড়তে লাগলো দু'টো পায়রা। অবাক, বিস্ময় নিয়ে তিনি সেই ভিড়ে মিশে যাওয়া আগন্তুকের দিকেই তাকিয়ে রইলেন। বুকের ভেতর যেই হাহাকার এতক্ষণ আর্তনাদ করছিলো তা যেন থিতিয়ে গেলো নিমিষেই। তার হুট করে মনে হলো এই পৃথিবীতে তাকেও বাঁচানোর জন্য কেউ আছে। তিনি একেবারে হয়তো সকলের অপছন্দের হননি। তিনি পুরোপুরি অমানুষ হয়তো এখনো পৃথিবীর চোখে হতে পারেননি!

নাথান দ্বিতীয় বার উঠার আগেই রানি হ্যাব্রোর কাছ থেকে তলোয়ারটা কেড়ে নিয়েই কেটে দিলেন নাথানের দু'টো হাত। হিংস্র কণ্ঠে আদেশ ছুঁড়লেন, 'নাথানকে উলঙ্গ করে গাছের ডালে ঝুলিয়ে ঠিক ততক্ষণ বেত্রাঘাত করা হোক যতক্ষণ না তার প্রাণ যায়। এবং প্রাণ যাওয়ার আগে তার পুরুষাঙ্গটা যেন কেটে দেওয়া হয়।'
যৌনতার চাহিদায়, আকাঙ্ক্ষায় সে রানির গায়েও হাত দিতে দু'বার ভাবেনি তা-ই তার শাস্তিটার ব্যবস্থা করা হলো ভয়ঙ্কর। 

যামিনী ছুটে এসে রানির মাথার ওড়নাটা তুলে নিল। রানি আরেকবার নিজের রাজ্যবাসীর দিকে তাকালো অগ্নিবর্ণ ধারণ করা আঁখি যুগল নিয়ে। নাথানের শাস্তিটাও এত ভয়ঙ্করতম করলো রাজ্যবাসীর উপর ক্ষোভে। কিন্তু রানির রাগের ভেতর থাকা সেই অভিমান প্রজাদের সামান্য মস্তিষ্ক কি আর ধরতে পারলো? পারলো না।

রাজ্যবাসীর ভিড়ের মাঝে মিশে থাকা একটি মেয়ে এই বিচারে হাসলো। সন্তুষ্টির হাসি। রানি কামিনী তার কাছে হয়ে উঠলো সম্মান, শ্রদ্ধার। কেমন তার সাথে হওয়া অন্যায়েরও বিচার করলেন রানি তার নাম প্রকাশ্যে না এনে। এমন আর ক'জন হতে পারবে?
অপরদিকে আরেকজন রাগে কিড়মিড় করলো। রানির প্রতি তার এই জমে থাকা ক্ষোভ যেন জ্বলন্ত লাভার মতন ফুটতে লাগলো।
.
.
.
চলবে.........................................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন