চায়ের ট্রে হাতে পাত্র পক্ষের সামনে আসতেই পাত্ররূপে বসে থাকা ব্যক্তিটিকে দেখে থমকে গেল প্রজ্ঞা। স্তব্ধ বিমূঢ়ভাবে দু'পা পিছিয়ে যেতে হাত থেকে চায়ের ট্রে'টা পড়ে সব ছরিয়ে ছিটিয়ে পড়লো নিচে।
সবাই অবাক হয়ে প্রজ্ঞার দিকে তাকালো, তবে প্রজ্ঞার বিন্দুমাত্র ভাবান্তর হলো না এতে। মেয়েটা যেন নিজের মধ্যে নেই। কাঁপা কাঁপা পা বাড়িয়ে নিজের রুমে এসে বিছানার উপর ধপ করে বসে পড়লো। বিরবির করে বললো,
-- "এটা কিভাবে হতে পারে? আমি কি ভুল দেখলাম? উনি,,, উনি! ওনার তো....
প্রজ্ঞা আর কিছু ভাবতে পারলো না। একহাত কপালে ঠেকিয়ে চোখ বন্ধ করে বসে রইলো কিছু সময়। এর মধ্যে প্রজ্ঞার মা রুমে এলেন। তাঁর হাতে একখানা লাল টুকটুকে বেনারসি আর সামান্য কিছু গয়না।
প্রজ্ঞা চোখ তুলে সেদিন তাকালো একপলক। প্রজ্ঞার আম্মু মিতা বেগম মেয়ের হাতে শাড়িটা দিয়ে তাড়া দিলেন,
-- " প্রজ্ঞা! তাড়াতাড়ি যাও, এটা পড়ে আসো।
প্রজ্ঞা প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তাকাতেই মিতা বেগম হেসে বললেন,
--" আসলে কি হয়েছে? ওনাদের তো আজ শুধু তোমাকে দেখে যাওয়ার কথা ছিল! কিন্তু অভিক চাইছে একেবারে কাবিন করে রাখতে । তাই আমরাও সিদ্ধান্ত পাল্টে ফেললাম। আজকে তোমার বিয়ে।এবার যাও, তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে এসো।
প্রজ্ঞা কিছু বলার ভাষা হারিয়ে ফেললো, কি হচ্ছে এটা তার সাথে? কাঁপা কাঁপা হাতে মায়ের হাত থেকে শাড়িটা নিল। ওয়াশরুমে গিয়ে কোন রকমে শাড়িটা পড়ে রুমে এলো।
মিতা বেগম মেয়েকে গয়না দিয়ে সাজিয়ে বাইরে নিয়ে গেল। সবার মাঝে অভিকের পাশে বসানো হলো প্রজ্ঞাকে। এতে যেন প্রজ্ঞার অস্থিরতা আরো বৃদ্ধি পেল। বুকের মধ্যে কেমন ঢিপঢিপ শব্দ হচ্ছে!
পাশে তাকিয়ে দেখার সাহসটাও যেন প্রজ্ঞা পাচ্ছে না। চোখ দিয়ে অনবরত জল গড়িয়ে পড়ছে। অনুভূতিগুলোও কেমন দলা পাকিয়ে যাচ্ছে!
মুহূর্তে মাঝে বিয়েটাও সম্পন্ন হয়ে গেল।
নিজের রুমে এসে বসলো প্রজ্ঞা। কান্নার ফলে ইতিমধ্যে চোখ মুখ লা'ল বর্ণ ধারণ করেছে তার। হাত দিয়ে চোখ মুছতে চোখ গেল দরজার দিকে। অভিক বুকে হাত গুজে প্রজ্ঞার দিকে তাকিয়ে। প্রজ্ঞা নিজেকে সামলে নিয়ে ভা'ঙ্গা গলায় বললো,
--" আপনি,,
অভিক এই পর্যায়ে রুমে এসে বসলো প্রজ্ঞার মুখোমুখি হয়ে। প্রজ্ঞার কান্নারত মুখশ্রীখানা দু'হাতে আঁচলায় নিয়ে বললো,
--" এই মেয়ে, এভাবে কাঁদছো কেন? হুম।
প্রজ্ঞার কান্না কমলো না, বরং বাড়লো। অভিক নিজেই আবার বললো,
--" জানো, বেশ কয়েক বছর আগে এক সপ্তদশী মেয়ের চোখে নিজের জন্য ভালোবাসা দেখেছিলাম আমি। মেয়েটার হৃদয়ে ওঠা ঝ'ড়ের আভাস আমি পেয়েছিলাম। তখন তেমন পাত্তা দিই নাই।
ভেবেছিলাম বাচ্চা মেয়ে, জাস্ট মোহ পড়েছে। তোমার আমার দিকে তাকানো, না বলা অনেক কথায় আমি বুঝতে পারতাম।
ধিরে ধিরে আমিও যেন মেয়েটার প্রতি আ'সক্ত হয়ে গেলাম। মেয়েটার হৃদয়ে ওঠা ঝ'ড়ে কখন আমি নিজেই তো'লপাড় হয়ে গেলাম টেরই পেলাম না। মেয়েটার প্রতি জন্মানো আমার ওই আ'সক্তি আর কা'টলো না।হয়তো আমি নিজেই কাটাতে চাই নি।
প্রজ্ঞা নিজের কান্না থামিয়ে নাক টেনে বললো,
--" আপনার তো বিয়ে ঠিক হয়েছিল? না! সেটার কি হলো?
অভিক হাসলো এবার। প্রজ্ঞা বরাবরের মতো মুগ্ধ হলো সেই হাসিতে।
--" বিয়ের ব্যপারে আমি নিজেই কিছু জানতাম না। এটা সম্পূর্ণ পারিবারিক সিদ্ধান্ত ছিল।জানার পরপরই আমি বিয়েতে না করে দিই।
আর অন্য কোথাও বিয়ে করতামই বা কি করে? আমি তো আমার লাভ বার্ড এর মাঝে খুব বা'জে ভাবে আটকে গেছি।
অন্য কাউকে জীবনে জড়াবো, এটা যেন আমার কল্পনাতীত!
প্রজ্ঞা নিজের দু'র্বলতা প্রকাশ করলো এবার অভিকের কাছে। অভিককে জড়িয়ে ধরে ঝরঝর করে করে কেঁদে দিল।
সেদিনের সন্ধ্যায় অভিক চলে এসেছিল প্রজ্ঞাদের বাড়ি থেকে।শ্বশুর বাড়িতে থাকতে ভারি আপত্তি তার! এর মাঝে কেটে গেছে বেশ কিছু দিন। আর দু'দিন বাদেই প্রজ্ঞা-অভিকের বিয়ের অনুষ্ঠান। অনুষ্ঠানিকভাবে প্রজ্ঞাকে অভিকে হাতে তুলে দেওয়া হবে।
আজ মেহেদী সন্ধ্যা ছিল। প্রজ্ঞা সারাদিনের ধকল কা'টিয়ে বিছানায় পিঠ ঠেকলো। হঠাৎ কিছু একটা শব্দে চোখ খুলতেই অবাক হয়ে গেল। ওর সামনে অভিক দাঁড়িয়ে। প্রজ্ঞা বিস্ময় নিয়ে প্রশ্ন ছুঁড়লো,
--" আপনি এখন এখানে? কিভাবে এসেছেন?
অভিক গিয়ে বসলো প্রজ্ঞার পা'য়ের দিকটায়। প্রজ্ঞার প্রশ্নের উত্তর দিয়ে বললো,
--" ছাঁদ টপকে এসেছি।
প্রজ্ঞা চোখ বড়বড় করে চেঁচিয়ে বললো,
--" হোয়াট!!
অভিক চটজলদি প্রজ্ঞার মুখ চেপে ধরলো, বললো,
--" আরে আসতে কথা বলো, ফাঁ''সিয়ে দেবে নাকি?
প্রজ্ঞা নিজের মুখ থেকে হাতটা ছড়িয়ে বললো,
--" তো মিস্টার! আপনি এতো বউ ভক্ত যে দুটো দিন বউয়ের জন্য অপেক্ষা করতে পারলেন না? আপনাকে ছাঁদ টপকে আসতে হলো!
--" বউ ভক্ত তো আমি অবশ্যই। তবে এখানে আসার আরেকটা বিশেষ কারণ আছে।
প্রজ্ঞা ভ্রু কুঁচকে তাকালো। অভিক নিজেই প্রজ্ঞার হাত দুটো ধরে নিজের সামনে আনলো।মেয়েটার দু'হাতে দারুণভাবে মেহেদী আঁকানো হয়েছে।
অভিক পাশের টেবিল থেকে একটা মেহেদীর কোণ নিয়ে গুটি গুটি অক্ষরে মেয়েটার মেহেদী আঁকা হাতের মধ্যিখানে ওদের দুজনের নাম লিখে দিল। অভ্যাস না থাকার দরুন মেহেদী খানিটা ঘেঁ'টে গেল, কিন্তু তা নিয়ে বিন্দুমাত্র আক্ষেপ দেখা গেল না প্রজ্ঞার মাঝে।
সে বরাবরের মতোই মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে দেখলো তার অতি প্রিয় কাছের, মানুষটিকে। অভিক মেহেদী দেওয়া শেষে কোণটা টেবিলের উপর রাখলো। এরপর প্রা'ণ ভরে দেখে নিল তার প্রেয়সীকে। মগ্ধ নয়নে আওড়াল,
--" আমার লাভ বার্ড!
প্রজ্ঞা লজ্জা পেল। অস্বস্তি কাটাতে বললো,
--" এবার প্লিজ যান, কেউ চলে এলে সমস্যা হতে পারে।
অভিক আমলে নিল না। বললো,
-- " তাহলে আগে ভালোবাসি বলো।
প্রজ্ঞা অবাক হয়ে বললো,
--" মানে!
-- " মানে, তুমি আজ অব্দি একবারো আমাকে নিজের মুখে ভালোবাসি বলো নি। ভালোবাসতে পারো আর সেটা মুখ ফুঁটে বলতে পারো না? আমার তো নিজের স্ত্রীর মুখে ভালোবাসি শোনার অধিকার আছে নাকি।
--" এটা আবার কেমন কথা?
--" এটাই লাক্ষ কথার এক কথা, এবার ভালোবাসি বলো, নাইলে কিন্তু যাব না।এখানেই থেকে যাব।
প্রজ্ঞা নিজের দু'হাত অভিকের বুকে রেখে মোহগ্রস্থের ন্যায় বললো,
--" আই লাভ ইউ মাই ওয়ান এন্ড ওনলি ব্যক্তিগত পুরুষ!
অভিক হেসে বললো,
-- "আই লাভ ইউ টু মাই লাভ বার্ড!"
.
.
.
সমাপ্ত.....................................................................