ডানহাতের মুঠোয় দুমড়ানো মুচড়ানো ব্যান্ডেজটা ওখানেই ফেলে দ্রুতবেগে পালিয়ে গেল ফিহা। ফাহাদ এমন অপ্রতিভ কাণ্ড দেখে দৌড়ে পিছু পিছু ছুটলে এবার যেন একটু শান্ত হয় সাঈদ। মুখের শক্ত ভাবভঙ্গি স্বাভাবিক করে দরজা লাগাতে চলে যায় সে। ঠিক তখনই সে দেখল, ফ্লোরে একটা নতুন ব্যান্ডেজ পড়ে আছে। ইনট্যাক্ট, ওটা ব্যবহার করা হয়নি। কিন্তু অবস্থা একেবারে দুমড়ে মুচড়ে নষ্ট হয়ে গেছে। তাহলে? তাহলে কী এই ব্যান্ডেজটা তার ক্ষত কপালের জন্য এনেছিল? মূহুর্ত্তের ভেতর গা হিম করা অনুভূতিতে স্থির হলো জুনায়েদ সাঈদ। তার মস্তিষ্কের সেন্সরগুলো তীব্রবেগে যেন জানাল দিল,“ইউ ডিড ইট রং সাঈদ। ভুলটা বাজে জায়গায় করেছ। ও তোমার কাছে নিজ থেকেই এসেছিল। কোনো অজুহাত ছাড়া, কোনো কারণ ছাড়াই। তবু যখন নিজ থেকে আসলো, তুমি তাকে কেন দূর দূর ঠেলে দিলে? ও কী তোমার ভুল ভাঙাতে আসেনি? যদি না ভাঙাতো, তাহলে তোমার হাতে এই ব্যান্ডেজ কেন? তুমি তো তাকে কাছে আসার সুযোগটুকুই দিলে না। কেন এরকম উগ্র আচরণ করছ তুমি? কেন মনেহচ্ছে তোমার মতো ব্যক্তিটা কনফিউশনে ভুগছে? তুমি কে, তুমি কি জানো না? দ্যান হোয়াই আর ইয়্যু ওভার থিংকিং? জাস্ট লেট ইট গো।” পুরো ব্যাপারটা ঠান্ডা ভাবে চিন্তা করতেই চোয়ালদুটো শক্ত হয়ে উঠল। ডানহাতে ধরা ব্যান্ডেজটার দিকে নীরবে তাকিয়ে থাকলে সেটা দূর থেকে দেখতে পেল লাবিব। তার হাতে গরমাগরম ধোঁয়া উঠা মালাই চা। দু'কাপ ভর্তি চাটুকু সে বন্ধুর জন্যও এনেছে। পায়ে পায়ে লাবিব কাছে আসতেই বন্ধুর হাতে দুমড়ানো জিনিসটা দেখে ভ্রুঁ কুঁচকে ফেলল,
- সাঈদ, ব্যান্ডেজের এই অবস্থা কেন? ভর্তা বানিয়ে কী করতে চাইছিলি?
যতটা জিজ্ঞাসু মুখে প্রশ্নটা করল লাবিব, ততটাই নিরুত্তাপ ভঙ্গিতে ট্রাউজারের পকেটে ঢুকিয়ে নিল সাঈদ। যেন এ বিষয়ে কথা বলতে সে আগ্রহী না। লাবিব তখনও ভ্রুঁ কুঁচকানো মুখে আশু ব্যাপারটা বোঝার চেষ্টায় আছে। রুমে ঢুকে মাটির কাপদুটো জানালার কাছে রাখতেই একটা কাপ বন্ধুকে দিয়ে বলল,
- গরম গরম দেখে নিয়ে আসলাম। খেয়ে দ্যাখ। কবুল বললে যেই মহিলা তোর শ্বাশুড়ি হতো, সেই মহিলা খুব যত্ন করে চা'টা বানিয়েছে। চেখে দ্যাখ্।
লাবিবের প্যাঁচমুখো কথাটা যে ইঙ্গিতে বলা হয়েছে, সেটা সচরাচর কেউ ধরতে পারবে না। উলটো বোকার মতো ভাবতে থাকবে, “শালা পাঁয়তারা করল? বলছেটা কী? কবুল ... মহিলা ... শ্বাশুড়ি ... এসব আবার কী?” সেদিক থেকে তার বন্ধু যেন সম্পূর্ণ ব্যাপারটা বুঝতে পারল। তার শান্ত চোখের তারায় তারায় কেমন ম্লান একটা ভঙ্গি ফুটে উঠেছে। চাপা গাম্ভীর্যের আড়ালে থেকে কাপটা তুলতে গিয়ে বলল,
- আমি হয়ত ওর জন্য ক্যাপিব্যাল না। আমার চাইতে ও বেটার কাউকে ডিজার্ভ করে। সেন্সিব্যাল, কেয়ারিং, ডিসেন্ট একটা পার্সন। আমি ওর সাধ্যমতো একটাও পাইনি।
সদ্য চায়ে চুমুক দিতেই বিশ্রীভাবে বিষম খেল লাবিব। তৎক্ষণাৎ টগবগানো চায়ের আঁচটা নরম ঠোঁটটাকে পুড়িয়েই দিল। অসহ্য জ্বালায় নীচের ঠোঁট কামড়াতে কামড়াতে উচ্চস্বরে ধমকে উঠল লাবিব,
- ফাজলামি মারাচ্ছিস তুই! খাজুরে কথা না বললে চলে না? সবাই অফডে নিয়ে এই তামাশা দেখার জন্য বসে আছি? তোর খালাতো ভাইয়ের নষ্ট বন্ধুরা আজাইরা নাটকবাজি করছে, সেগুলো বসে বসে লাইভ টেলিকাস্ট দেখব? যা ব্যাগ গোছা তুই! ডিজার্ভ ডিজার্ভ মারালে এখানে তোর থাকা লাগবে না। গেলে এখান থেকে সব যাব!
পুরোটা চা জানালা দিয়ে ঝপ করে ছুঁড়ে ফেলল। খাওয়ার রুচিটাই মরে গেছে লাবিবের। সবসময় এরকম উলটা কথা বললে সহ্য হয়? একপা না যেতেই দশ পা পিছানোর চিন্তা করে, শা. লা খবিশ!লাবিব মুখটা বেজার করে আবার হম্বিতম্বির সুরে বলল,
- নিজের জিনিসটা অন্যের ঘাড়ে চাপাতে যাস না ব্যাটা। যেটা তোর, সেটা নিজের বানাতে শিখ। অন্যের কাছে কি কি ডিজার্ভ করে, না-করে, এসব নিয়ে আলগা পিরিতি তোর দেখাতে হবে না। যেটা ডিজার্ভ করে সেটা নিজের মধ্যে আন। ওকে বোঝা। ওর জন্য নিজেকেই ডিজার্ভ বানা। “বেটার কাউকে ডিজার্ভ করে” — এই ময়লামার্কা আক্কাস আলী ডায়লগ দিস না ভাই। খুবই ছ্যাবলা ছ্যাবলা লাগে।
লাবিব এখনো জানে না, তার প্রাণপ্রিয় বন্ধু একটু আগে কী কাজটা করেছে। সে যে ঠান্ডা মাথায় জবরদস্ত একখানা অপমান করে দিয়েছে, তার জন্যই তো সে ডিজার্ভ নামক শব্দটা উচ্চারণ করল। লাবিব বন্ধুর খামোশ অবস্থা দেখে আবারও চিড়বিড়িয়ে উঠল,
- মাঝে মাঝে মনটা চায় তোর পেটে একটা চাক্কু ঢুকিয়ে দেই। শা. লা শুধু শুধু চুপ থাকিস কেন? কথা বললে কথার উত্তর দেওয়া যায় না?
- আমার কথা বলতে মন চায় না। যা এখান থেকে!
- তাহলে তোমার দস্যু রাণীকে সামনে এনে দেই? কি বলো? তখন তো ঠিকই তোমার মুখ দিয়ে মিছরির মধু ঝরবে!
জানালা থেকে মুখ সরিয়ে বন্ধুর দুষ্টু দুষ্টু মুখটা দেখে নিল সাঈদ। চা'টা তো খেলোই না, উলটো এখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ফাজলামো করে যাচ্ছে। লাবিব জ্বালানোর জন্য আবার কিছু বলতে নিবে, তার আগেই সাঈদ মুখ ঘুরিয়ে দেয়ালঘড়িটার সময় দেখল। চোখ দিয়েই যেন অদৃশ্য হিসাব-নিকেশ করে বলল,
- ফাহাদকে কল কর লাবিব। বাড়ির মেইন কানেকশনটা এক্ষুণি কাট-অফ করতে বল্!
লাবিব কথা শুনে ভয়মিশ্রিত চোখে তাকাল। সেও সাঈদের দৃষ্টি লক্ষ করে ঘড়িটা দেখে বলল,
- কী করবি তুই? বাড়ির মেইন লাইনটা কাট-অফ করতে কেন বলছিস? সাঈদ, এমনিতেই নেটওয়ার্কটা লো। প্লিজ এমন কিছু এই মূহুর্তে করিস না, যা সেধে সেধে —
লাবিবের কথায় কোনো মনোযোগ দিল না সাঈদ। ট্রাউজারের রাইট পকেট থেকে পার্সনাল মোবাইলটা বের করে নিজেই কী যেন একটা করল। অন্যদিকে ধ্যান না দিয়ে দ্রুত দরজা খুলে বেরিয়ে যায় সে। এদিকে লাবিব অদ্ভুত আশঙ্কাটা টের পেতেই জলদি জলদি কাপদুটো হাতে নিয়ে বন্ধুর পিছু পিছু ছুট লাগাল। তিনতলা, দোতলা সম্পূর্ণ খালি। সমস্ত লোকজন চারতলায় উঠে যে যার মতো আড্ডা দিচ্ছে। এদিকে সাঈদ কীসের জন্য দোতলার দিকে ঢুকছে, তা কোনোভাবেই মেলাতে পারছে না লাবিব। ও কেন দোতলায় আসলো? ঘড়িতে কি দেখল? মোবাইলে কী এমন টাইপ করল যার জন্য সে রুমেই থাকেনি! পিছু পিছু দৌড়ে আসতেই দেখল, দোতলার চারটা ইউনিটের সবগুলো দরজা খোলা। তার মধ্যে থেকে দুই নাম্বার দরজা দিয়ে সন্তপর্ণে ঢুকে পড়ল ও। ফোনের স্ক্রিনে দ্রুতগতিতে কী যেন টাইপ করতেই ঝপ করে কারেন্টটা নিভেও গেল। কী আশ্চর্য! কেন মেইন লাইনটা বন্ধ করে দিল? লাবিব ঘুটঘুট্টি অন্ধকারের ভেতর কিচ্ছু দেখতে পাচ্ছে না! অন্ধের মতো ধীরপায়ে এগুতেই পাশ থেকে কে যেন ফিসফিস স্বরে সতর্ক করল, “সাউন্ড করবি না। শশ..”। ঠোঁটে 'শ' জাতীয় শব্দ শুনতেই আস্তে আস্তে চোখ সয়ে এলো লাবিবের। ডাইনিংরুমের একদম শেষ মাথায় একটা বেসিন। বেসিনের সামনে কে যেন মনের সুখে মুখ ধুচ্ছে। সহসা কারেন্টটা চলে যাওয়ায় মুখ বিকৃত করে বলল,
- হলি শী. ট! কারেন্ট চলে গেল নাকি? এখন মুখটা কীভাবে ধুবো ড্যাম!
কণ্ঠস্বর শুনে চিনতে পারল ওটা দীপের বন্ধু। হ্যাঁ . . . তৌকির আহমেদ শিহাব। বাইরে থেকে আসা ফিনফিনে পাতলা আলোয় শিহাবের মুখে ফেসওয়াশের ফেনা দেখা যাচ্ছে। এমন সময় সাঈদ ওর দিকে অদ্ভুত একটা কথা বলল, “আই অ্যাম স্যরি লাবিব।” ওর কথা শুনে যেই লাবিব বলতে নিবে “তুই স্যরি বলছিস কেন?”, তার আগেই বেচারা ট্রাউজারের টালমাটালে ভিড়মি খেয়ে গেল। মাথা নীচু করে দেখল, সাঈদ ওর ট্রাউজারের ফিতাটা খুলে নিয়েছে! তাড়াতাড়ি লাবিব একহাতে ট্রাউজারটা খামচে ধরতেই কোনোমতে নিজের ইজ্জতটুকু বাঁচিয়ে রাখল। চোখ-মুখ বিকৃত করে যেই বিশ্রী গালিটা দিতে নিবে, তখনই পায়ের উপর একটনের পারা খেয়ে তৎক্ষণাৎ ঠোঁটে হাত চাপলো লাবিব। কখন যে ফাহাদ চোরের মতো দোতলায় এসে ঢুকেছে, তা লক্ষ করেনি লাবিব। তার পায়ের উপর পা পারা দিয়ে ফাহাদ চোরের মতো নীচু গলায় বলল, “এ্যাই লাইব্বা, সিনেমা চলছে নাকি? আমিও দেখতে এলাম। শিওর ছিলাম পুংটা সাঈদ পুংটা পুংটা স্টাইলে বাঁশ একটা দিবেই!” লাবিব ব্যথায় গলাকাটা মুরগির মতো ছটফট করলেও অন্ধকারে ফাহাদ কিছুই বুঝতে পারল না। মুখ থেকে হাত সরিয়ে লাবিব অস্ফুটস্বরে বলল, “পা সরা!” ফাহাদ চূড়ান্ত গর্দভের মতো বলল, “পাসরা কী?” লাবিব কাপ হাতে, ট্রাউজার ধরে বহুকষ্টে আবারও বলল, তুই পা সরা!” খুবই ফিসফিসিয়ে বলার জন্য ফাহাদ এবারও বুঝতে পারল না, “হুর ব্যাটা! লুইচ্চা ওয়ার্ড বলতেছিস? পাসরা আবার কী?” চোখ সয়ানো অন্ধকারে ফাহাদ এবার ছোটো ছোটো চোখ করে দেখতে লাগল। লাবিবের পেটের কাছে হাত খামচানো দৃশ্য আর মুখটা খিঁচুনি দিয়ে কিছু বলার চেষ্টা করছে। ফাহাদ মুখের কাছে মুখ এগিয়ে বলল, “তুই গর্ভবতী স্টাইলে পেট ধরে আছিস কেন? পেটে কী হয়েছে?” লাবিব এবার ব্যথা সহ্য করতে না পেরে খামচানো হাতটা দিয়েই সজোড়ে ধাক্কা মারল ওকে। ওমনেই কয়েক সেকেন্ডের জন্য ট্রাউজারের কাহিনি বুঝতে পেরে খলখলিয়ে হেসে দিচ্ছিল ফাহাদ! তাড়াতাড়ি লাবিব ট্রাউজার ছেড়েই বন্ধুর মুখে হাত চাপা দিয়ে ধরল। রাগারুণ মুখে কিড়মিড় করে বলল, “পাসরা পাসরা লাগিয়েছিস! শা. লা মূর্খ, পাসরা কোনো শব্দ হয়? তোকে পা সরাতে বলেছি! তুই পায়ে পা পারা দিয়ে . . .” আর বলার ক্ষমতাটুকু পেল না লাবিব। গা কাঁপানো দৃশ্যটা দেখতে পেয়ে দুই বন্ধুই একসঙ্গে কথাটা বিড়বিড় করল, “কী করতেছে দোস্ত?”
দু'হাতে ট্রাউজারের ফিতাটা প্যাঁচাতে প্যাঁচাতে শিহাবের পেছনে গেল সাঈদ। শিহাব তখনও চোখ বুজে পানির ঝাপটা দিচ্ছে। কিন্তু বিধি বাম! আর কিছু বুঝে উঠার আগেই গলায় কঠিনভাবে ফাঁ স লাগল তার। আকস্মিকভাবে নিঃশ্বাস আঁটকে আসার দরুন কঠিন যন্ত্রণায় দাপিয়ে উঠল শিহাব।পাগলের মতো দু'হাত দিয়ে গলার ফাঁসটা সরাতে চাইছে সে। কিন্তু পারছে না! অসহ্য মৃত্যুযন্ত্রনায় সারামুখ ঘেমে উঠল, তবু নিজেকে ছাড়াতে পারল না শিহাব। দম আঁটকে ফুসফুস যেন ফেটে আসতে চাইছে। কপালের কাছে ফুটে উঠেছে শিরা-উপশিরা। গোঙানির মতো গো গো শব্দ করতেই আচানক বলশালী হাতদুটো শিথিল হয়ে যায়। মা র ণ যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেতেই ধপাস করে ফ্লোরে পরল শিহাব। গলায় হাত দিয়ে যক্ষ্মা রোগীর মতো কাশতে শুরু করলে সেই কাতরানো দৃশ্যটা খুব মনোযোগ দিয়ে দেখল। এটা যদি আজ বিয়েবাড়ি না হতো, যদি এখানে ওর বাবা-মা আর সেই একান্ত মানুষটি না থাকতো, তবে এই নি র্ল জ্জ শ. য় তা নটাকে বাঁ চা র মতো ছাড়তো না। যেই হাতটা দিয়ে সুন্দর নাটকটা সাজিয়েছিল; ইচ্ছে করছে, ওই হাতের মাং স ছাড়িয়ে হা ড় বের করে দিতে! হিংস্র জানোয়ারের মতো ফোঁস ফোঁস দু'বার দম ছাড়তেই সেখান থেকে প্রস্থান করল।
লাবিব আর ফাহাদ কতক্ষণ ধরে ভয়াল দৃশ্যটুকু দেখল, তা নিজেরাও জানে না। সামান্য একটা ট্রাউজারের ফিতা দিয়ে ছেলেটার দমটা যেন বন্ধই করে দিয়েছিল। আর কিছু ভাবনার অবকাশ না দিতেই সাঈদ ফিরে এসে বলল,
- স্যরি। হাতের কাছে যা পেয়েছি, তাই দিয়ে একটু ধরেছিলাম। এই কুকুরটার জন্য একটু আগে ভুল একটা কাজ করেছি। ছেড়ে দিলে একটা মেয়ের উপর অবিচার হতো। তোরা উপরে যা। আমি আসছি।
লাবিব স্থিরচোখে টান টান গলায় বলল,
- এটা বিয়েবাড়ি সাঈদ। সেম কাজটা তুই ফাহিমের সাথে করেছিস। আর এখন এই —
কথাটা শেষ করতে দিল না সাঈদ। মুখের কথাটা দাপটের সাথে কেড়ে নিয়ে বলল,
- আমার জায়গা থেকে আমি ঠিক আছি। না করলেই ব্যাপারটা বেশি খারাপ হতো। প্লিজ কথা বাড়াস না। তুই আর ফাহাদ যেই নামগুলোর কথা উচ্চারণ করছিস, ওদের নাম শুনলে আমার ঘেন্না হয়। কাইন্ডলি কাজটা করিস না। রিকোয়েস্ট করছি।
লাবিবের কাঁধে ফিতাটা ঝুলিয়ে চলে গেল সাঈদ। ভালোমতো চুপি দিয়ে দেখল, শিহাব এখনো কাতরাচ্ছে। মারণ কাশিগুলো এখনো বন্ধ হয়নি। এই অবস্থা দেখে যদি কেউ সন্দেহ করে? সঙ্গে সঙ্গে লাবিব আর ফাহাদ নিজেদের দিকে মুখ চাওয়াচাওয়ি করল। একসঙ্গে দুই বন্ধুই বিড়বিড় করে বলল — “সোয়াদ আঙ্কেল! তাড়াতাড়ি এখান থেকে পালা। কুইক!”
•••••••••••••
অসহ্যকর গরম শেষে বাইরে একটু বাতাস ছেড়েছে। ধূলোবালি মাখা শোঁ শোঁ বাতাসে দেহমন ঠান্ডা হলেও চোখে এসে বালি লাগে। চোখ কচলাতে কচলাতে জানালাটা টেনে দিল ফিহা। সদ্য স্নান শেষে শরীরটা এখন হালকা হালকা অনুভব হচ্ছে। মায়ের দেওয়া হলুদের শাড়িটা আলনায় ভাঁজ করে নীচের তাক থেকে ওড়না টেনে নিল। চুলে জড়ানো তোয়ালেটা দু'হাতে আলতো করে খুলতেই ঝপ করে চুলগুলো পিঠ বেয়ে নামল। ধূসরবর্ণের ঢিলেঢালা কামিজটা আরেকটু বোধহয় ঢিলে হয়ে গেছে। একটু বড়ো হয়ে থাকা চারকোণা গলা দিয়ে দু'কাঁধের হাড্ডি, আর গলার নীচে হাড় ফুটে উঠা শুকনো দেহটা আন্দাজ করতে পারল। চুলের পানিতে পিঠ ভিজে গেলেও হাতের তালদুটো সাবধানে রাখল ফিহা। দু'হাত ভরা মেহেদি যেন এতটুকুও নষ্ট না হোক। খুব আনন্দ নিয়ে ঝুমু আপুর কাছ থেকে দিয়ে এসেছে। গলায় পাতলা ফিনফিনে সাদা ওড়না জড়িয়ে একটু বাইরে থেকে ঘুরে আসার চিন্তা করল। এমন সময় দীপের ফুপু মাজেদা বেগম তাড়াহুড়ো ভঙ্গিতে যেতে নিচ্ছিলেন, কিন্তু ফিহার উপস্থিতি দেখে মনে মনে কিছু একটা ভেবে ডাকলেন তিনি,
- মা শুনো তো একটু?
ফিহা মুখ তুলে দেখল, মাজেদা ফুপু ডাকছে। ফুপুর সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই তিনি হাতের দিকে বললেন,
- মেহেদি কী শুকিয়ে এসেছে মা?
দু'হাত সামনে এনে আবারও একবার দেখে নিল ফিহা। শুকিয়ে এসেছে, কিন্তু আরেকটু রাখবে। ফিহা সরলহাস্যে বলল,
- আরেকটু রাখব। রঙটা গাঢ় হলে আমার কাছে ভালো লাগে।
মাজেদা পালটা হাসি দিয়ে এবার মূলকথাটা বলেই দিলেন,
- মেহেদি যেহেতু শুকিয়ে এসেছে, তাহলে আমার একটা উপকার করবে তুমি? একটু তিনতলায় গিয়ে কাঠ আনা দরকার। গ্যাসের চুলায় একদমই আগুন নেই। খাবারগুলো গরম না করলে কি বিচ্ছিরি একটা অবস্থা যে হবে! মা একটু তিনতলায় গিয়ে কিছু কাঠ এনে দিবে? আমার আবার হাঁটুর ব্যথায় হাঁটতে অসুবিধে হচ্ছে। কাছেপিঠে কাউকেই দেখছি না। সব আড্ডার মজলিশে বসে আছে।
মুখ ফুটে কোন উত্তরটা দিবে বুঝতে পারছে না ফিহা। সরাসরি 'হ্যাঁ' বলে দিলে ফুপুর একটু উপকার হয়, কিন্তু কাঠ আনতে গিয়ে শুকনো মেহেদি ঝরঝর করে পরে যাবে। আবার 'না' বলে দিলে খুবই খারাপ দেখায়। মায়ের বয়সী মানুষ। ফিহা মন খাটো করলেও বাইরে থেকে ঝলমলে হাসিটা উপহার দিয়ে বলল,
- কাউকে আপনার ডাকতে হবে না ফুপু। আপনার কাজ আমি করে দিচ্ছি। কাঠ আনার ঘরটা কোনদিকে সেটা একটু বলে দিন। আমি তিনতলার ঘরগুলো খুব একটা চিনি না।
মাজেদা খুব সুন্দরভাবে বুঝিয়ে দিতেই ফিহা তিনতলার দিকে হাঁটা দিল। বাইরে জোরে একটু বাতাস ছাড়লেই কারেন্ট বাবাজি ফুরুৎ হয়, আজও তাই হয়েছে। যদিও মাঝখানে দশমিনিটের জন্য গিয়েও আবার চলে এসেছিল, কিন্তু এবারের বেলায় মনে হচ্ছে দেরি হবে। তিনতলায় উঠে আধো আধো অন্ধকারের ভেতরে এদিক-ওদিক তাকিয়ে একদম ডানদিকের দরজাটা দিয়ে ঢুকে পড়ল। খোলা জানালা দিয়ে যেটুকু অন্ধকার ভাব কেটেছে, তাতেই চোখ সয়ে সয়ে কাঙ্ক্ষিত রুমটা খুঁজে দরজাটা ধাক্কা দিল। ভেতরে একটা বুনো বুনো গন্ধ, নিঃশ্বাস নিলে কাঠের উগ্র গন্ধে পেট গুলিয়ে আসে। কোত্থেকে যেন মৃদু আলো এসে ঘরটাকে তুলনামূলক আলোকিত করেছে। ফলে কোন কাঠগুলো দেয়ালে ঠেস দিয়ে রাখা, কোনগুলো ফ্লোরে পাতা, আর কোনগুলো লাকড়ি হিসেবে আনতে হবে। সেইমতো ফিহা ঘুটুরঘুটুর করে কাঠ টানতেই হঠাৎ ঘরটা কেমন মিষ্টি মিষ্টি গন্ধে ভরে উঠল। নিঃশ্বাস টানতেই ভীষণ মিঠে মিঠে গন্ধে মনের কুঠিরে দোল লাগিয়ে দিল। নিজেকেই নিজে আপনসুরে বলল, ' আমি কী এটা আগেও পেয়েছি? ঘ্রাণটা কেমন চেনা চেনা না? কোথায় পেয়েছি এই সুগন্ধ? ' আপন মনে ভাবতে থাকলে হঠাৎ নিজেকে কষে দুটো গালি, একটা বকা, তিনটে ধমক মেরে বলল, ফিহার বাচ্চা! তুই এখানে ঘ্রাণ বিশেষজ্ঞ হতে এসেছিস? তাড়াতাড়ি কাঠ নে, হাতে তোল্, চুপচাপ ফুপুকে বুঝিয়ে দে। তোর মা এমন চুল ছাড়া অবস্থায় দেখলে তোকে লোহা দিয়ে পেটাবে! ' তাড়াতাড়ি একঝাঁক কাঠ তুলে যেই পিছু ঘুরবে ও, ওমনেই পেছনে সটান দাঁড়িয়ে থাকা পুরুষটিকে দেখে ভয়ে অন্তরাত্মা কেঁপে উঠল! তৎক্ষণাৎ কাঠগুলো ফেলে দিয়ে দু'কদম পিছিয়ে যায় ও। ঢোক গিলে অস্থির দমগুলো টানতে থাকলে হাঁপানোর সুরে বলল,
- এভাবে কেউ দাঁড়িয়ে থাকে? আরেকটু হলে স্ট্রোক করতাম! আপনি এমন কেন? শব্দ করে আসা যায় না?
নিজের অবিচল, দৃঢ় সত্তাটা বজায় রেখে হাতদুটো বুকে ভাঁজ করল। কপালের মধ্যখানে মৃদু কুঁচকানো ভাব। ওই অটল ভাবে দাঁড়িয়ে থাকা ব্যক্তিটি নির্বিকার চিত্তে বলল,
- আমি কথা বলতে এসেছি। বলে এখান থেকে চলে যাব।
ফিহা ঢোক গিলে আস্তে আস্তে পেছনের দিকে পেছাতে লাগল। মৃদুস্বরে তেজ দেখিয়ে বলল,
- আপনার কথা আমি শুনতে চাইব? এমনটাই ভেবেছেন আপনি? একটা ম্যানার্সলেস মেয়ের কাছে কেন এসেছেন? আমার মধ্যে তো শিষ্টাচার বলতে কিছুই নেই!
যতটুকু দাবড়ের সাথে কথাগুলো শোনাল, ততগুণ ভয় এখন আষ্টেপৃষ্ঠে ঘিরে ধরেছে। পাকনামো করে তো ঠিকই কথাগুলো শুনিয়ে দিল, কিন্তু এর পরিণাম এখন কী হবে? পিছাতে পিছাতে কোনদিকে যাচ্ছে তা অনুমান করতে পারছে না। ফিহার ক'হাত পেছনে একস্তুপ কাঠ ঠেস দিয়ে রাখা, সামান্য ধাক্কা খেলেই সবগুলো কাঠ ওর শরীরের উপর পড়বে। এরপর কোন অবস্থায় হাসপাতালে নিতে হবে কে জানে। এমন বিপত্তি দেখে নিজেই চুপচাপ পিছাতে লাগল সাঈদ। তার উদ্দেশ্য, ও যেন কোনোভাবেই না পিছাক, তাকে সরতে দেখে ও থেমে যাক। সাঈদের সম্পূর্ণ দৃষ্টি তখনো সেই কাঠগুলোর দিকে, একটা অদ্ভুত অস্থিরতায় তনুমন বিচলিত হয়ে যাচ্ছে। বাধ্য হয়ে ডানহাত বাড়িয়ে থামতে ইশারা করল সাঈদ,
- আমি সরে যাচ্ছি। আর পিছাতে হবে না। প্লিজ ওখানেই থাম!
কথাটা বলার সাথে সাথেই পায়ে একটা হোঁচট খেল ফিহা। আর্তস্বরে কঁকিয়ে উঠতেই ভুলবশত হাতটা ব্যালেন্সের জন্য ডানদিকে চাপলো। ও বুঝতে পারেনি হালকা ব্যালেন্সেই সবগুলো কাঠ জায়গামতো নড়ে গেছে। চোখ তুলে ডানদিকে তাকাতেই গগনবিদারী চিৎকারে ' মা ' বলে প্রচণ্ড ভয় পেল ফিহা। চোখ-মুখ খিঁচিয়ে দু'হাতে কানদুটো চেপে ধরল। চরম অপ্রত্যাশিত ঘটনায় ধুপ ধুপ করে সবকটা কাঠ মেঝেতে পরতেই ভয়ংকর ভাবে খিঁচে রইল ও। অনেকক্ষণ পর চোখ খুলে তাকালে প্রথম ক'মিনিট কিছুই বুঝতে পারল না। পাঁজরের তলায় তখনো ধড়াস ধড়াস চাবুক পিটিয়ে যাচ্ছে! নিঃশ্বাসের টালমাটাল অবস্থা একটুও শান্ত হয়নি। চরম উত্তেজনার ভেতর ঢোক গিলতেই পিঠের পেছনে দেয়াল অনুভব করল। সামনে থেকে বলশালী ঢালের মতো মাথা নুয়ে আছে মানুষটা! তার হাতদুটো ওর দু'কাঁধ ধরে ঠাঁই তখনো দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু মুখটা ওভাবে নীচু করা কেন? ভয়ে বুজে আসা স্বরটা খুঁজে পেতেই শুকনো গলায় ডেকে উঠল ফিহা,
- জনাব?
প্রথম ক'মিনিট কোনো সাড়া-ই দিল না। কানে শুধু ফোঁস ফোঁস করে ঘন নিঃশ্বাস টানার শব্দ পাচ্ছে। মুখের খুব নিকটেই মানুষটার মাথা ঝুঁকানো চুল। ফিহা ভয়ে ভয়ে ডানহাতটা চুলের উপর রাখতেই একগুচ্ছ ঠান্ডা শিরশিরে পরশ ওর নরম হাতের তালুতে ছুঁয়ে গেল। আঙুলে আঙুলে আস্তে করে বুলিয়ে দিতেই ধীরগতিতে মাথা তুলল লোকটা। চোখে চোখ মিলিয়ে জবাব দেবার আগেই তার চোখে-মুখে ব্যথাতুর ছাঁপটা ফুটে উঠল একটুখানি। নীচের ঠোঁটটা কামড়ে সে ঠান্ডা কণ্ঠে শুধাল,
- কোথাও লেগেছে?
ফিহা প্রশ্নাত্মক মুখে চুপচাপ মাথাটা ডানে-বামে 'না' ভঙ্গিতে নাড়িয়ে দেয়। অকপটে কথাটা ও বলেই ফেলে,
- আমার দিকে ঠিকঠাক মতো তাকান। মাথা ঝুঁকাবেন না। আমি নিশ্চিত, আবারও জংলীদের মতো আঁচড় খেয়ে বসে আছেন।
এবার মাথাটা তুলে মুখ বরাবর থামিয়ে রাখল সাঈদ। আর একটুখানি দূরত্ব ঘুচালে ওর কেঁপে কেঁপে উঠা অধরদুটো তার অধরে ডুবে যাবে। তবু এই নিষিদ্ধ চাওয়াটুকু প্রাণপণে চেপে সাঈদ নির্লিপ্ত স্বরেই জানাল,
- ঢাকার জ্যামে সাড়ে তিনঘণ্টা লেট হয়। কাউকে অপমান করতে লেট করিনি। গাড়িতে একবার স্যরি বলেছিলাম। আপনি আমার হাতে বেহুঁশ ছিলেন। আমি
কথাগুলো কথাপর্যায়ে বলতে বলতেই ফিহা ঠোঁটের উপর ডানহাত চাপা দেয়। অন্যহাত তখন হাতড়ে বেড়াচ্ছে সুঠাম পিঠে। অতঃপর হাতটা কাঙ্ক্ষিত জায়গাটায় আঁটকে যেতেই ভীষণ ক্রুদ্ধ হয়ে ধমকের সুরে বলল,
- আপনি একটা জংলী! আস্তো জংলী! আবারও একই কাজ করে বসে আছেন! কালরাতেই আপনার কপালটা সুস্থ সমেত দেখেছিলাম, আজ সেখানে ব্যান্ডেজ চিপকে এসেছেন। আপনি কী মানুষের মধ্যে পড়েন? কী করতে গিয়ে এগুলো করেন? আমিও আপনার বক্তব্য একটু শুনি। শুনে বোঝার চেষ্টা করি ভেতরে ভেতরে কী চাপাতে চাইছেন। বলুন!
শেষের শব্দটা যেন চিৎকার করে বলল ফিহা! দুইচোখ ভরা ক্রোধ নিয়ে ওভাবেই একজন নীরবঘাতী পুরুষকে শাষিয়ে যাচ্ছে ও। সেই নীরব চক্ষুর পুরুষটি উক্ত অবস্থা দেখতে পেয়ে তখনো স্বভাবসুলভ নীরব। যেন এটুকু ব্যবহার সে পেতেই চাইছে। চাইছে আরো একটু রাগ, ক্ষোভ, অভিমান; আর একটুখানি কোমল সান্নিধ্য।
.
.
.
চলবে.....................................................................