"একটা কথা জিজ্ঞেস করি?"
কৌশিক ধীরে ধীরে দুদিকে মাথা নাড়িয়ে বললো,
"নাহ!"
অনন্যা চোখ বড় করে, অবাক হয়ে শুধালো,
"কেনো?"
কৌশিকের ঠোঁটে এক রহস্যময় হাসি ফুটে উঠলো। মৃদু স্বরে বললো,
"কারণ আমি জানি তুমি কী জিজ্ঞেস করতে পারো!"
"কী জিজ্ঞেস করবো?"
"জানতে চাইবে, আমি যদি মানুষ না হই, তাহলে আসলে কী! তাই না?"
কথাটা শুনে অনন্যা থমকে গেল। বিস্মিত চোখে তাকিয়ে ধীরে ধীরে মাথা নাড়লো।
কৌশিক হালকা হাসি দিয়ে অনন্যার সেই বিস্ময়ের জবাব দিলো,
"এটার উত্তর আমি দেবো না। দিতে হলে অনেক আগেই দিতাম। আমার সম্পর্কে যতটা না জানবে, ততই তোমার জন্য ভালো। এই কথাটা আগেও বলেছিলাম, মনে আছে তো?"
অনন্যার চোখে কৌতূহল আর দ্বিধা একসঙ্গে খেলা করছে। সে সোজাসুজি শুধালো,
"কেনো?"
কৌশিক তার গম্ভীর কণ্ঠে জবাব দিলো,
"কারণ তোমার জন্য এটাই ভালো হবে।"
এক মুহূর্তের নীরবতা। অনন্যা নিরবচ্ছিন্নভাবে স্যারের চোখে তাকিয়ে থাকলো। চিন্তাগুলো ভেতরে বুদবুদ হয়ে ফুটছে। হঠাৎ নির্ধারিত ভঙ্গিতে বললো,
"কিন্তু আপনার সম্পর্কে না জেনে আমি আপনাকে মানতে পারবো না। আপনাকে স্বামীর স্বীকৃতি দিতে পারবো না। বিশ্বাস করতে পারবো না আপনাকে।"
"কিন্তু চেষ্টা করতে কী সমস্যা? প্রথম প্রথম তো ঠিকই মানতে চেয়েছিলে, কতো ঝগড়া করেছিলে।"
অনন্যা ঠোঁট কামড়ে বিরক্তি প্রকাশ করলো,
"তখন আমি জানতাম না আপনি এমন বের হবেন। উপরে গম্ভীর, ভেতরে আরেক জিনিস! একেক সময় একেক রূপ! তার উপর মানুষ না।"
কৌশিক চিন্তিত হয়ে বললো,
"হুমম! বেশ চিন্তায় ফেলে দিলে তুমি তো।"
অনন্যা তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বললো,
"অনেক নাটক হয়েছে। এবার চুপচাপ বেরিয়ে যান। প্লিজ আর মাথা খারাপ করিয়েন না, ইঁদুর মশাই!"
কৌশিক নড়লো না, উল্টো আরাম করে বিছানায় দু হাত রেখে হেলান দিয়ে বসলো। অনন্যার চোখের ভ্রু কুঁচকে গেলো।
"কি হলো? যাচ্ছেন না কেনো?"
কৌশিকের ঠোঁটে একটুখানি হাসি খেলা করলো,
"ইঁদুররা সহজে পিছু ছাড়ে না। জানো না নাকি!"
অনন্যা গভীর শ্বাস ফেলে বিরক্তি চেপে বললো,
"কী চাইছেন?"
"আমাকে ব্যবহার করো, শিকদার!"
"কি বললেন?"
অনন্যা বিস্ময় ধরে রাখতে পারলো না।
"হুম, ঠিক বলেছি। ইচ্ছেমতো ব্যবহার করো। ঠিক যেভাবে তুমি চাও ইউস করো।"
কৌশিক আবারো বলে উঠলো,
"আচ্ছা, যেহেতু আমরা হাসবেন্ড-ওয়াইফ, একটা নাম ঠিক করা দরকার, তাই না? যেটা দিয়ে আমি সবসময় তোমাকে ডাকবো। ওকে! ক্যান আই কল ইউ বেইবি?"
কৌশিক স্যার জবাবের জন্য উৎসুক হয়ে অনন্যার দিকে তাকিয়ে রইল।
কিন্তু অনন্যার মুখ ভীষণ বিরক্তিতে কুঁচকে গেলো।
"এসব বেইবি, জান-টান শুনলেই আমার বমি পায়।"
"ওহ! তুমি বেশ ইউনিক বুঝলাম। আচ্ছা, ওই ছেলেটা নাম কি যেন....আহ! আরণ্যক! আরণ্যক কী ডাকতো তোমাকে?"
অনন্যা একটু থেমে শুকনো গলায় বললো,
"অনু।"
কৌশিক মুহূর্তখানেক নিশ্চুপ। তাঁর গভীর দৃষ্টিতে কেমন নির্লিপ্ততা ধরা পড়লো, মনে হলো লোকটার পছন্দ হয়নি বিষয়টা। নাকি হয়েছে? অনন্যা বুঝতে পারছে না, সে শুধু বিস্ময়ে তাকিয়ে রইল। আচমকাই কৌশিকের চোখ জ্বলে উঠলো। কঠিন কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
"ওই ছেলেটা কী তোমাকে ছুঁয়েছে?"
অনন্যা চিন্তিত হয়ে জবাব দিলো,
"হ্যাঁ! রিলেশনে ছিলাম। ছুঁয়েছে তো কয়েকবারই।"
কথাটা শোনা মাত্রই কৌশিক বজ্রের মতো উঠে দাঁড়ালো। হাত শক্ত করে মুঠো করে ফেললো। তাঁর চোখ থেকে বিদ্যুৎ ঝলকাচ্ছে মনে হতে লাগলো। দাঁত চেপে কৌশিক কঠোর গলায় বললো,
"হাউ ডেয়ার হি!"
খুব জোরে! খুব জোরে শব্দটা হলো। তার মুখের শব্দ যেন বজ্রপাতের মতো আছড়ে পড়লো ঘরের নিস্তব্ধতায়। এরপর মুহূর্তের মধ্যে কৌশিকের হাত ঘুরে উঠলো বাতাস চিরে। একটি তীব্র ধাক্কায় ঘরের এক পাশে সুন্দর করে দাঁড়িয়ে থাকা লম্বা আয়নাটা ঝনঝন শব্দে চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে মেঝেতে ছিটকে পড়লো। কৌশিক আয়না ভেঙে নিজের রাগ প্রকাশ করলো। অনন্যা অবাক দৃষ্টিতে হিমশীতল হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। শ্বাস আটকে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে দেখছিল সেই দৃশ্য। ভাঙা কাচের শিখরে কৌশিকের প্রতিফলিত ছায়া এক অন্য রূপে ধরা পড়লো। কেমন ভয়ংকর ভয়ংকর লাগছিল!
কৌশিক নিজের জ্বলন্ত চোখ নিয়ে অনন্যার দিকে তাকালো। অনন্যাও দ্রুত আয়না হতে চোখ ঘুরিয়ে তার দিকে তাকালো, ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে বললো,
"আপনি কী করছেন এসব?!"
কৌশিকের মুখ থেকে ক্রোধ ঝরছিল। সে হেঁটে জানালার কাছে এগিয়ে গেলো, নিজের আঙুলগুলো টানটান করে হাত মুঠো করলো, বড় করে শ্বাস নিয়ে সে নিজেকে সামলাতে চাইছে। কিয়ৎক্ষণ শ্বাস প্রশ্বাস হালকা করে অনন্যার দিকে এগিয়ে গেলো, অনন্যার কাঁধে হাত রেখে নিচু গলায় বললো,
"আর কখনো যাতে কোনো পুরুষ তোমাকে ছুঁতে না পারে! এই বিষয়টা খেয়াল রাখবে আর মাথায় ও রাখবে।"
অনন্যা মুখ তুলে হতবাক নয়নে কৌশিকের দিকে তাকিয়ে রইল। কিছু বলার সুযোগই দিলো না কৌশিক। আচমকা শক্ত হাতে জড়িয়ে ধরলো তাকে। অনন্যা স্তব্ধ হয়ে গেলো, তার হাত থেকে তিনটে গোলাপ ধীরে ধীরে মেঝেতে পড়ে ছড়িয়ে গেলো।
কৌশিকের হাত অনন্যার চুলের ভাঁজে ধীরে ধীরে গলিয়ে গেলো, অনন্যা নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে রইলো। মেঝেতে ছড়িয়ে থাকা ভাঙা কাঁচের টুকরোর দিকে চোখ পড়তেই সে অনুভব করলো, নিজের ভেতরটাও সেই কাঁচের মতো টুকরো টুকরো হয়ে যাচ্ছে। কৌশিকের এই অদ্ভুত রূপান্তর তাকে বিভ্রান্ত করে তুলেছে। কখনো আগুনের মতো রাগী, কখনো বরফের মতো নরম। সে আর কিছু বুঝতে পারছে না, তার হৃদয় দ্বিধা আর অনুভূতির ঝড়ে ভেঙে পড়ছে। মনের গভীরে হাজারো জ্বলন্ত প্রশ্ন, কিন্তু কণ্ঠে কোনো শব্দ নেই।
কৌশিক মৃদু সুরে অনন্যাকে ডাকলো,
"অনন্যা!"
অনন্যা গভীর শ্বাস নিয়ে বললো,
"হুম!"
কৌশিকের গলায় একরাশ মমতা ঝরে পড়লো,
"আই মিসড ইউ!"
অনন্যা কিছুক্ষণ চুপ থেকে চোখ তুলে বললো,
"কেনো এমন করছেন?"
কৌশিক সামান্য হাসলো,
"তুমিই তো বলেছিলে, বিয়ে হয়েছে আমাদের। সেটাই মেনে চলছি।"
"আপনাকে আমার ভয় লাগে।"
কৌশিক আলতো গলায় বললো,
"ভয় পাওয়ার কী আছে? এই দেখো! আদর করছি।"
কৌশিক ধীরে ধীরে অনন্যার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলো। অনন্যা চোখ বন্ধ করে ফেললো। সত্যিই লোকটা আদর করছে। সেই স্পর্শে এক অদ্ভুত প্রশান্তি ছড়িয়ে পড়ছে অনন্যার ভেতরে। ভালো লাগছে খুব!
কৌশিক চোখ সরিয়ে নিচের পড়ে থাকা ফুলগুলোর দিকে তাকিয়ে হেসে বললো,
"ফুলগুলো ফেলে দিলে?"
অনন্যা মৃদু গলায় জবাব দিলো,
"আপনার জন্যই পড়ে গেলো।"
কৌশিক সেই ফুলগুলো দিকে ইঙ্গিত করে শান্ত সুরে বললো,
"রেখে দিও যত্ন করে। এই ফুলগুলো কখনো নষ্ট হবে না। অনেক দিন পর যখন তিনটা ফুলের দিকে তাকাবে, তখন বুঝবে, আমি তোমার অতীতেও ছিলাম। এখনকার বর্তমান তখনকার অতীত হবে। কিন্তু তখনকার বর্তমানেও কি আমি পাশে থাকবো? তুমি রেখে দিলে থেকে যাবো হয়তোবা। রাখবে তো?"
অনন্যা আবারো স্তব্ধ হয়ে গেলো। কয়েক মুহূর্ত পরে, কৌশিক স্যারের আলিঙ্গন থেকে নিজেকে জোর করেই মুক্ত করলো অনন্যা। দ্রুত নিচু হয়ে মেঝে থেকে ফুলগুলো তুললো। বিস্ময়ে তার চোখ বড় হয়ে গেলো। ফুলগুলো থেকে একরকম জ্যোতি ছড়াচ্ছে, এক অভূতপূর্ব সৌন্দর্য। মন ছুঁয়ে যাওয়ার মতো।
অনন্যা ধীরে ধীরে বিছানার পাশে ছোট টেবিলটির দিকে এগিয়ে গেলো। সেখানে সাধারণত একটা ল্যাম্প, একটা জগ আর গ্লাস থাকে। কিন্তু ল্যাম্পটা সে খুলে ছুঁড়ে মেরেছিল সেদিন কৌশিক স্যারের দিকে। এখনো সেটা লাগানো হয়নি। অনন্যা তাতে মনোযোগ দিলো না। গ্লাসে পানি ঢেলে তাতে তিনটি গোলাপ ডুবিয়ে রাখলো। পানিতে ফুলগুলো আরও উজ্জ্বল হয়ে উঠলো। অনন্যা নিচু হয়ে ফুলগুলো দেখতে লাগলো কিছু সময়। কৌশিক হাসলো, সে তার উত্তর পেয়ে গেছে ইতিমধ্যে। অনন্যার আচরণ কৌশিককে সব বুঝিয়ে দিলো।
প্রায় অনেকক্ষণ পর পাশ ফিরে কৌশিক স্যারের দিকে তাকাতেই অনন্যা চমকে উঠলো। স্যার বিছানার উপর হাত ছড়িয়ে আরাম করে শুয়ে পড়েছে। চোখ বুজে রয়েছে, কিন্তু ঠোঁটের কোণে এক টুকরো হাসি ঝুলে আছে।
অনন্যা জোর গলায় উঠলো,
"এইই! আপনার রুমে যান।"
"আমারটাতেই আছি।"
"উফফ! এখানে আমি থাকি।"
বিরক্তি ভরা গলায় বলে উঠলো অনন্যা।
কৌশিক হুট করে বসে পড়লো,
"ওহ! তাইতো!"
কথাটা বলে ধবধবে সাদা বিছানায় বসেই কৌশিক একটু এগিয়ে এলো। এক হাত বাড়িয়ে অনন্যাকে হালকা টান দিয়ে বিছানায় নিয়ে এলো। অনন্যা ধাক্কা খেয়ে পড়ে গেলো। এরপর কৌশিক নিজের হাতে বালিশ পেতে জোর করে শোয়ালো অনন্যাকে। দুজনের মাঝখানে অনেকটুকু ফাঁক। কৌশিক অনন্যাকে স্পর্শ করেনি। কিন্তু স্যারের চোখ দুটো! চোখ দুটো অনন্যার মুখ ছুঁয়ে যাচ্ছে। খুব আলতো ছোঁয়া সেই স্পর্শ যার জন্য একটা হাতের ও প্রয়োজন হয় না। শুধু গভীর আবেগময় দুটো চোখই তো যথেষ্ট!
ঘরের একপাশে সাদা আলো টিমটিম করে জ্বলছিল। মূহুর্তটিকে অন্যরকম রোমান্টিকতায় ভরিয়ে দিচ্ছিল। কৌশিক বালিশে হাতে মাথা রেখে নিঃশব্দে তাকিয়ে আছে অনন্যার দিকে। চোখে কোনো তাড়া নেই, নেই কোনো অশান্তি। সেই দুটি চোখের আকাশি দৃষ্টিতে শুধুই শান্ত গভীরতা। অনন্যা চুপচাপ শুয়ে আছে। অনন্যার হৃদস্পন্দন একটু বেখাপ্পা হলেও সে নিজেকে ধরে রেখেছে।
কৌশিক কিছু বলেনি। তার উপস্থিতি নিজেই সব কথা বলে দিচ্ছে। লোকটা বিরক্ত করছে না, একটুও নয়। অনন্যা তাই অবুঝদের মতো আচরণ করলো না। থাকতে দিলো। থাকতে দিলো এক অদ্ভুত, না বুঝতে পারা রহস্যময় পুরুষকে।
অনন্যা হুট করে বলে উঠলো,
"আপনার শরীরে হৃৎপিণ্ড আছে?"
কৌশিক চমকে উঠলো, কিছু সময় পর বললো,
"হুম, আছে তো।"
অনন্যা ধীরে ধীরে নিজের হাত বাড়িয়ে কৌশিক স্যারের ঘন কালো সোয়েটারের উপর দিয়ে বুকের বাঁ পাশে হাত রেখে বললো,
"এখানে আছে?"
"হুম!"
"তাহলে কেনো আপনি মানুষ নন?"
কৌশিক হেসে বললো,
"আমার শরীরে মানুষের মতো সবই আছে। আমি কথা বলি, খাই, চলাফেরা করি, সব কিছুই। তবে একটা জিনিস নেই, যা আসলে কোনো অঙ্গ নয়। মানুষের আছে আমার নেই।"
"কী সেটা?" অনন্যা জানতে চাইলো।
"মন।"
"সেটাও আছে নাহলে আমাকে মিস করতেন না। আমাকে আদর করতে পারতেন না। আপনার আদরে আমি... আমি!"
অনন্যা আর কিছু বলতে পারলো না। নিজের অন্তরের সুখের কথা কাউকে এতো তাড়াতাড়ি জানান দেওয়া উচিত নয়। সব খুলে প্রকাশ তাকেই করা যায় যে বিশ্বাসযোগ্য। আর তাঁকেই সব বলা যায় যে প্রতিশ্রুতি দেয় যে কখনোই মন ভাঙবে না, হৃদয়টা টুকরো টুকরো করে দেবে না কিছু দিন পর।
কৌশিক অনন্যার চুপ হয়ে যাওয়া দেখে জিজ্ঞেস করলো,
"কি হলো?"
"না কিছু না।"
কৌশিক শ্বাস ছেড়ে বললো,
"আমি জানি না। কখনো বুঝিনি আমার এইখানটায় মন থাকতে পারে।"
"রিডোকে যেই ভাবে নিজের বশে এনেছেন, তাতেই বুঝে ফেলার কথা।"
"রিডোর সাথে আমি কথা বলতে পারি। তাই ও আমায় পছন্দ করে আর বুঝতে পারে।"
"বাহ! কীভাবে কথা বলেন ওর সাথে?"
"জানি না, এইভাবেই হয়ে যায়।"
অনন্যা চোখ ছোট করে ফেললো। তার বাম হাত এখনো কৌশিকের বুকের বাঁ পাশে স্থাপিত! অনন্যা নিঃশব্দে তাকিয়ে থেকে নিজের হাত স্যারের বুকের ডান পাশে রেখে জিজ্ঞেস করলো,
"আর এখানে? এখানে কি আছে?"
কৌশিক অনন্যার হাত ছুঁয়ে জবাব দিলো,
"আমার জীবনের সীমারেখা আছে এখানে।"
শিউরে উঠলো অনন্যা। সীমারেখা?এর অর্থ কী?
কৌশিক নিজেই জবাব দিলো,
"আমি একটা ধাঁধা। বহু বছর আগে বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া এক ইতিহাস! যা যুগের পর যুগ মানুষের স্মৃতি থেকে মুছে যাচ্ছে, আর মুছে যেতে থাকবে। সেই প্রহেলিকা আমি।"
অনন্যা বার কয়েক পলক ফেললো। কৌশিক আরো শক্ত করে অনন্যার আঙুল চেপে ধরলো। ঘন স্বরে বললো,
"ঘুমাও।"
"আপনি ঘুমান।"
"ঘুমাই না আমি।"
"হোয়াট?"
"হুম। আমার চোখ দুটো ঘুমের জন্য কাতর হয় না কখনো। তবে, ইদানিং চোখ দুটো কাতর হয় শুধুমাত্র একজনকে দেখার জন্য।"
অনন্যা দ্বিতীয় কথায় গুরুত্ব দিলো না, তার মন রহস্য খুঁজতে ব্যস্ত। কৌশিক স্যারের সাথে তার সম্পর্কটাই তো রহস্যের।
অনন্যা দ্রুত বলে উঠলো,
"কেনো এমন হয়? ১১ দিন না ঘুমিয়ে থাকলে মানুষ মারা যায়। হাড়ে মাংসে গড়া শরীরটা। তাও ঘুম নেই আপনার কেনো?"
কৌশিক মুচকি হেসে অনন্যাকে কাছে টেনে নিলো। শরীরের সাথে মিশিয়ে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরলো। আচমকা এমন কাছে টানাতে অপ্রস্তুত বোধ করলো অনন্যা। কিন্তু কিছু বললো না।
কৌশিক ঘন স্বরে জিজ্ঞেস করলো,
"ঘুমানো কী সুখের হয়, শিকদার?"
"আমি! আমি তো জানি না।"
অনন্যা ইতস্তত বোধ করলো।
"আমিও জানি না। কারণ আমি ঘুমাতে পারি না। তোমার তো জানার কথা। তুমি প্রতিদিনই ঘুমাও।"
অনন্যা কৌশিকের বুকে কিছুক্ষণ কান পেতে রাখলো। ঠিকই সেখানে হৃৎপিণ্ডের অলিন্দ-নিলয়ের লাব ডাব শব্দটা শোনা যাচ্ছে। তাহলে কেনো তিনি অন্যরকম? কেনো তিনি মানুষ হয়েও অমানুষ?
"কি হলো বলো?"
অনন্যা চোখ বন্ধ করে কৌশিকের শরীরের সাথে গুটিসুটি মেরে শুয়ে রইলো। মৃদু স্বরে বললো,
"সারাদিন প্রচন্ড কাজ করার পর শরীরে ক্লান্তি জন্মে। চোখ ব্যথা করে, খুব খারাপ লাগে। তখন শরীরের ক্লান্তি দূর করতে হয়। ক্লান্ত, পরিশ্রান্ত শরীরকে আরাম দেওয়ার জন্য ঘুমাতে হয়, স্যার। শরীরের প্রতিটি অংশের বিশ্রাম প্রয়োজন, তাদের বিশ্রাম দেওয়ার জন্য হলেও ঘুমানো উচিত।আপনার শরীরে কী ক্লান্তি জন্মেনি কখনো? ইচ্ছে করেনি ঘুমাতে?"
কৌশিক চিন্তিত হয়ে বললো,
"আমম! না আমার শরীর ক্লান্ত হয় না। তোমাদের দেখে সত্যি খুব হিংসা হয়। প্রতি রাতে নির্দিষ্ট সময়ে চোখ বন্ধ করে অন্য কোনো দুনিয়ায় চলে যাও তোমরা। আর আমি এক হতভাগা যে বুঝি না আসলে ঘুম কি জিনিস!"
অনন্যা নিশ্চুপ রইলো। রহস্যের সাগরে ডুবে যেতে থাকলো সে। এই লোকটাকে সে আদৌ বুঝতে পারবে কিনা সন্দেহ হচ্ছে! নাকি এক রহস্যময় জীবনে আজীবন আটকে থাকবে অনন্যা। তাও একটা বিষয় অনন্যা বেশ ভালোই বুঝতে পেরেছে,
কৌশিক তার প্রতি অনেকটা নরম হয়েছে। কিন্তু কেনো? নিজেকে শাস্তি দেওয়াই বা কেনো? অনন্যাকে চাইলেই সে মেরে ফেলতে পারে! সেদিন বাঁচানোই বা কেনো? আচ্ছা এটাও কি একটা ফাঁদ যেখানে অনন্যা না বুঝেও ফেঁসে যাচ্ছে। এক প্রহেলিকায় আটকে পড়েছে সে যা থেকে আবারো বের হয়ে আসা অসম্ভব।
কৌশিক আরো শক্ত করে জাপ্টে ধরলো অনন্যাকে। এক পর্যায়ে প্রচন্ড ঘাম ছাড়লো তার শরীরটায় তাও আরাম অনুভূত হচ্ছে কৌশিকের। কারণ সমগ্র মহাবিশ্বকে ভুল প্রমাণিত করে বহু বছর পর কৌশিক আজ দ্বিতীয়বারের মতো ঘুমালো। কয়েক দিন আগেও নিজের অজান্তেই কৌশিক ঘুমের সাগরে হারিয়ে ছিল। যেদিন ভুলবশত অনন্যাকে আক্রমণ করে বসেছিল। অনন্যার শরীরে অযাচিত রক্ত ঝরিয়ে ছিল। সকালে উঠে অনন্যাকে ঠিক করার জন্য দুনিয়া উলটপালট করে ফেলেছিল। এটা ছিল সেই প্রথম দিন। প্রায় তিন ঘণ্টার মতো ঘুমে ছিল সেদিন কৌশিক। যখন চোখ খুলেছিল বুঝে উঠতে পারেনি এটা ঘুম নাকি ভ্রম! কারণ চোখের সামনে এক রক্ত ঝরা মানবীকে দেখে অবুঝ হয়ে পড়েছিল সে।
.
.
.
চলবে.........................................................................