"ঘুমানো কী সুখের হয়, শিকদার?"
ঘুমের সুখ? ঘুমের সুখ পেতে হলে ঘুমাতে হয়, স্যার। নির্ঘুম থাকলে সুখ কী তা বোঝা যায়? আপনি ঘুমিয়ে দেখুন না! ঘুম সত্যি সুখের হয়, স্যার! কিন্তু সবসময় নয়। ঘুম তখন সুখের হয় না, যখন মস্তিষ্কের ভেতরে হাজারো চিন্তা আনাগোনা করে।
এই যে আপনি এতো রহস্যময় হয়ে আমার সারা শরীরে চিন্তা মিশিয়ে দিলেন, আমি তো ঘুমাতে পারছি না। ঘুমিয়েও শান্তি পাচ্ছি না। আমি কী আপনাকে বিশ্বাস করবো? আপনার সাথে সারাজীবন থাকার প্রয়াস করবো? নাকি এখনি মায়া না বাড়িয়ে দূরে সরে যাবো? কি করবো একটু বলে দিন! বলে তো দিলেন রেখে দাও! রেখে দাওয়া দুই শব্দ! কিন্তু এর অর্থ বেশ বড়, স্যার! রাখলেই রাখা হয় না! ভরসা, বিশ্বাস, ভালোবাসা সব দরকার হয়। আপনি কেমন বলুন তো! খুব অন্যরকম! বুঝি না আপনাকে! আপনি নিজেও হয়তো বুঝেন না! তাইতো জানতেন না আপনার অন্তরে হৃদয় রয়েছে! ধুকপুক করে আওয়াজ করে হৃদয়টা! উফফ! আপনার বুকের যাঁতাকলে পিষে কানের বারোটা বাজিয়ে দিয়েছে সারা রাত। ঘুমিয়েও ঘুমাতে পারিনি। আর আপনি বলছেন হৃদয় নেই? মন নেই? উঁহু, নিজেকেই বোঝেন না। আপনি বেশ অন্যরকম! কেমন জানি! আচ্ছা, স্যার! আপনি কি আজ ও ঘুমাননি?
ঘুম ভেঙেছে অনন্যার। হুটপাট করে কথাগুলো মাথায় এসে ভর করলো। তার ঘুমন্ত চোখে চিন্তারা ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। কপাল দু'টো ভাঁজ হয়ে আছে। ঘুমের ঘোর থেকে বের হতে কিছুটা সময় নিচ্ছিলো চোখ দুটো। ধীরে ধীরে চোখ দ্বয় খুললো অনন্যা, ঘোলাটে দৃষ্টিতে সামনে তাকালো সে। কিছু দূরে একজন পুরুষ শরীর পিছমুখী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। শরীরের উপর অংশে কোনো পোশাক নেই, সূর্যের কোমল আলোয় ফর্সা-হলুদ টানটান পিঠটা মসৃণ আর মোলায়েম ঝলক দিচ্ছিল। মুহূর্তের জন্য অনন্যার চোখ আটকে গেল সেই দৃশ্যে। কয়েক সেকেন্ড সময় লাগলো অনন্যার। অতঃপর সে কিছু না বুঝেই চিৎকার করে বসলো।
কৌশিক দ্রুত পিছনে ফিরে অনন্যার দিকে তাকালো। জোর গলায় বললো,
"হোয়াট হ্যাপেন?"
অনন্যা কৌশিক স্যারকে পোশাক বিহীন দেখে অপ্রস্তুত অনুভব করলো। স্যারের চওড়া কাঁধ, চিকন দেহ, বুকের উঁচু অংশ, গ্রীবা থেকে কোমর পর্যন্ত সুঠাম গড়ন শিল্পীর আঁকা এক নিখুঁত চিত্রের ন্যায়, অনন্যার শরীরের পশম দাঁড় করিয়ে দিচ্ছে, কয়েক সেকেন্ডের জন্য সে শিউরে উঠলো। মনে হলো কি না কি দেখে ফেলেছে! অনন্যা পাশ থেকে বালিশ টেনে মুখের সাথে চেপে ধরে বললো,
"আপনি এভাবে...কী করছেন! শরীর দেখাচ্ছেন কেনো?..... আচ্ছা, রাতে কি কিছু হয়েছিল?"
অনন্যার উলটপালট কথা শুনে কৌশিক হেসে ফেললো, চুলগুলো হাত দিয়ে অগোছালোভাবে ঠিক করল।
নেশাময় কণ্ঠে বলল,
"অনেক কি~ছু!"
অনন্যা তীক্ষ্ণ স্বরে বলল,
"মিথ্যে বলবেন না... ড্রেস পড়ুন তাড়াতাড়ি!"
কৌশিক কিছুক্ষণ স্থির দাঁড়ালো , তারপর চিন্তিত হয়ে অনন্যার আলমারি খুলে মনমতো পোশাক খুঁজতে লাগল।
অনন্যা বালিশ চেপে ধরে রেখেই আলমারি খোলার আওয়াজ পেলো। জোরে বলে উঠলো,
"ওইগুলো আমার!"
কৌশিক ঘুরে দাঁড়িয়ে বললো,
"আমার পোশাক যদি তোমার পোশাক হয়, তোমার পোশাক ও আমার হবে, শিকদার।"
মৃদু হেসে আবারো কাজে মন দিলো সে।
অনন্যা হার মানলো। ব্যর্থ হয়ে বসে রইলো, লোকটার ড্রেস এনেছে বলে কিছু বলতে পারছে না। নাহলে তো কেউ থামাতে পারতো না অনন্যাকে।
বেশ কয়েকটি টি-শার্ট গুছিয়ে রাখা আলমারিতে। অনন্যাই নিচের রুম থেকে নিয়ে রেখেছে সেগুলো। একটা সাদা ফুল হাতা টি-শার্ট তুলে গায়ে জড়াল কৌশিক।
তারপর অনন্যার দিকে ঘুরে ব্যঙ্গ করে বললো,
"এমন ভাব করছো মনে হচ্ছে প্রথম বার আমাকে এইভাবে দেখলে।"
অনন্যা মুখ থেকে বালিশ কিছুটা সরিয়ে সামনের দিকে তাকালো , কৌশিক স্যারের স্বাভাবিক অবস্থা দেখে নিশ্চিন্ত হলো। বালিশটা পাশে সরিয়ে রেখে বলল,
"সেদিন রাত ছিল! অন্ধকার ছিল। বুঝে কথা বলুন।"
কৌশিক ঠোঁটের কোণে এক চিলতে হাসি নিয়ে বলল,
"কালকেও রাত ছিল, অন্ধকার ছিল! এবার বুঝে বলো।"
অনন্যার চোখ তীক্ষ্ণ হয়ে উঠল।
"আমাদের মাঝে কি হয়েছিল শুনি?"
"বলবো?"
"অবশ্যই! শোনার জন্য বসে আছি।"
কৌশিক তার কথায় হাসি চেপে বলল,
"তোমার মুখ থেকে লোল পড়েছিল! ইশশ! কতখানি ভিজে গিয়েছে আমার শীতের পোশাকটা। ঘুমানোর পর... রাতে কী বেশি খিদে পেয়েছিল? আগে বলতে তাহলে...."
স্যারকে শেষ করতে না দিয়ে অনন্যা বিস্মিত হয়ে বললো,
"কী? লোল! "
লজ্জায় অনন্যার নাক মুখ লাল হয়ে গেলো। ঠোঁটের কোণায় হাত দিয়ে বুঝলো আসলেই বিষয়টা সঠিক। কৌশিক হেসে ফেললো। বিছানার পাশে এসে নিচু হয়ে অনন্যার কাছে বসলো। মেয়েটার নিচু হয়ে থাকা মুখটা দেখে বললো,
"প্রতিদিন এমন হয়?"
"হুম!"
"ওকে, ব্যাপার না।"
কৌশিক উঠে দাঁড়ালো। কিন্তু তার পূর্বেই ধপ করে কিছু একটা পড়ে যাওয়ার শব্দে থমকে গেল। দু'জনেই চমকে একে অপরের দিকে তাকালো,দুজনেই নিশ্চিত হতে চাইছে আসলেই ঠিক শুনেছে কিনা। তারপর বোঝা শোনা হয়ে গেলে কেউ কোনো কথা না বলে, দ্রুত পা ফেলল তারা।
সিঁড়ি বেয়ে নেমে ড্রয়িং রুমে এসে থামলো, চোখে বিস্ময় নিয়ে দেখল নিক মাঝ রাস্তায় পড়ে আছে। তার অসাড় দেহ দেখে মুহূর্তের জন্য হতবাক হয়ে গেল দুজন। ঠিক তখন তামংও ছুটে এল, তার চোখে উৎকণ্ঠা ছড়িয়ে পড়েছে। মুখে যদিও কিছু বলেনি কিন্তু সেও চিন্তায় পড়ে গেছে।
কৌশিক নিকের পাশে বসে কাঁপা গলায় বলল,
"নিক! কী হলো? কীভাবে পড়লে?"
নিক ধীরে মুখ তুলে তাকাল। তার চোখ ভেজা, কান্নায় ছলছল করছে। নাক টেনে কিছু বলতে গিয়েই হঠাৎ চারপাশে রক্ত ছিটকে পড়ল।
অনন্যা এই দৃশ্য দেখে হতবাক। মুখ থেকে অস্ফুট শব্দ বের হলো, তারপর নিচু হয়ে দ্রুত নিকের পিঠে হাত রেখে বলল,
"এ কি হচ্ছে? রক্ত কেন বের হচ্ছে?"
অনন্যার ছোঁয়া দেখে মাথা গরম হয়ে গেলো কৌশিকের। সে রাগে গর্জে উঠল। কটমট করে কথায় রাগ ঝাড়লো নিকের উপর,
"নিক! হোয়াট ইজ দিস? তোমার শরীরের ভার এতো কেনো? আরেকটু হলে আমার সুন্দর সাজানো বিল্ডিংটা ধসে পড়তো!"
নিক হালকা হাসার চেষ্টা করল। নাক টেনে অস্পষ্ট গলায় বলল,
"ব্রো!এটা শরীরের ভার নয়, আমার কষ্টের ভার!"
নিক চিৎকার করে কাঁদলো। তার চোখ থেকে অশ্রু ফোঁটায় ফোঁটায় গড়িয়ে পড়লো। নিকের কথা শুনে সবাই হাসবে নাকি কাঁদবে বুঝতে পারছে না। নিক উঠে বসার চেষ্টা করল, কিন্তু তার মুখের অবস্থা দেখে সবাই স্তম্ভিত। গালের একপাশে গভীর নীলচে দাগ পড়েছে, চোখের নিচে কালসিটে। কৌশিক ও চিন্তিত হয়ে তাকালো।
তামং নিকের দিকে হাত বাড়িয়ে উঠতে সাহায্য করল, অনন্যাও নিকের আরেক হাত ধরলো। কিন্তু কৌশিক কিছুতেই অনন্যাকে নিকের কাছে যেতে দিতে চায় না। নিকের দাঁড়ানো মাত্রই সে অনন্যার হাত ধরে একপাশে সরিয়ে দিল। রাগী চোখে তাকালো অনন্যার দিকে। অনন্যা কিছু বলতে নিয়েছিল তার আগেই কৌশিক বললো,
"আমার কথা আছে নিকের সাথে!"
রাগে ঠোঁট চেপে নিকের বাহু ধরে ধীরে ধীরে নিয়ে যেতে লাগল কৌশিক।
অনন্যাও পিছু পিছু হেঁটে গেলো আর বললো,
"কিন্তু! কি করে হলো? কিছুই তো জানলাম না।"
"আমি জেনে নেবো। তুমি যাও। তোমার ক্লাস আছে।"
অনন্যা মাথা হেলিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লো। তামং দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দিলো, ভেতরে ঢোকার সুযোগ পেল না সেও। তার আগেই কৌশিক মুখের ওপর দরজা বন্ধ করে দিল। অনন্যা হতাশ হয়ে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে রইল। দুজনের এমন ব্যবহার দেখে চিন্তায় পড়ে গেলো সে।
•••••••••••
কৌশিক নিকের রুমে প্রবেশ করে প্রথমেই জানালার পর্দা গুলো বন্ধ করে দিল। ঘরটা সম্পূর্ণ অন্ধকার করে টিস্যু বক্স খুঁজে নিকের সামনে রেখে শান্ত হয়ে ডিভানে বসলো। নিক টিস্যু দিয়ে মুখ মুছছে। কিছু উচ্চারণ করতে গিয়ে আবারো রক্ত পড়লো মুখ থেকে। নাক টেনে কৌশিকের দিকে তাকালো সে।
কৌশিক গম্ভীর কণ্ঠে বলল,
"সকাল হয়ে গিয়েছিল জানতে না? আজ অনিয়ম কেনো হলো?"
নিক সামান্য চুপ থেকে টিস্যুটা শক্ত করে চেপে ধরল, নিজেকে স্থির করার চেষ্টা করলো। গলাটা ভারী শোনাল তার,
"আমি তো ঘুম থেকে উঠেই দেখি রেস্টুরেন্টের রেস্ট রুমে শুয়ে আছি। তখন ভোর হয়ে গিয়েছিল। আমি বুঝতে পারিনি।"
কৌশিক নিশ্চুপ! দুনিয়ার কাছে ভ্যাম্পায়ার হলেও কৌশিকের কাছে নিক বাচ্চা সমেত। সে জানে, নিক কখন কি রকম আচরণ করতে পারে! সে হাত গুটিয়ে নিকের দিকে তাকিয়ে তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বলল,
"তো রাত বিরাতে রেস্টুরেন্টে কার সাথে দেখা করতে গিয়েছিলে, হুম?"
নিক চুপ করে রইল। চোখ আবারো ভিজে উঠল। সে টিস্যু টেনে নাক মুছল, তারপর হালকা গলায় বলল,
"একটা মেয়ের সাথে।"
কৌশিক ঠোঁট উল্টে ভ্রু তুলে বলল,
"ওওও! এটা আর নতুন কি? তুমি মেয়ে ছাড়া কিইবা বুঝো? নতুন কিছু বলো!"
নিক হঠাৎ ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল। অনেক গভীর কষ্ট হচ্ছে তার। নোহারা কি করে তাকে সকলের সামনে মারতে পারলো? বেশির থেকে বেশি না বলতে পারত কিন্তু সবার সামনে এভাবে মেরে বিদেশি ভাল্লুক নাম দেওয়া ছেলেটার শরীর মন কাঁদিয়ে তুলেছে। কৌশিক নিকের অবস্থা দেখে বিরক্ত হলো। মাথা চেপে ধরে বিরক্ত মুখে বলল,
"কি হচ্ছে? মেয়েদের মতো কান্না করছো কেন?"
নিক গভীর দুঃখের সঙ্গে বলল,
"ব্রো! তুমি যদি আমার মনের কষ্টটা বুঝতে পারতে তাহলে তো হয়েই গিয়েছিল।"
কৌশিক একটা উপহাসের হাসি দিয়ে বলল,
"মনের কষ্ট? নিশ্চয়ই কোনো আলতু ফালতু মেয়ের পাল্লায় পড়েছ, যে তোমাকে মেরে এই হাল বানিয়ে দিয়েছে। রাইট? তোমার থেকে আর কি-বা আশা করা যায়? মেয়েরা এসে মেরে যায় আর তুমি কিছু বলতেও পারো না। উল্টো মেয়েদের মতো কান্না করছো। আবার নিজেকে বড় মাপের ভ্যাম্পায়ার বলো! রিডিকুলাস!"
নিক চিৎকারে ফেটে পড়ল, তার কণ্ঠে বেদনার তীব্রতা আরও গভীর হয়ে উঠল,
"তুমি আমাকে হার্ট করছো, কৌশিক। আমি এমনিতেই ব্রোকেন হয়ে আছি।"
কৌশিক নির্লিপ্ত মুখে হাসতে হাসতে বলল,
"ব্রোকেন মানুষেরাই একসময় সকলের বার্ডেন হয়ে যায়! হা হা!"
নিক ঠোঁট চেপে কৌশিকের দিকে তাকাল, ছেলেটার দৃষ্টিতে তীব্র ক্ষোভ আর অভিমান ধরা পড়েছে। কৌশিক নিকের দৃষ্টি দেখে হাসি থামিয়ে কিছুটা গম্ভীর সুরে বলল,
"ওকে! রেস্ট নাও। সূর্যের আলো তোমার শরীরে পড়ে আরও খারাপ অবস্থা করে দিয়েছে। আই উইশ, আমি যদি তোমার মেডিসিন বানাতে জানতাম। কিন্তু কিছু করার নেই। কয়েকদিন বাইরে বের হইয়ো না। রক্তের ব্যবস্থা হয়ে যাবে। রিল্যাক্স!"
নিক চটজলদি বলল,
"তুমি কোথায় ছিলে?"
কৌশিক ঠান্ডা গলায় উত্তর দিল,
"গিয়েছিলাম অনেক দূরে!"
"ল্যুমিস নদী?"
"হু!"
নিক একটু হেসে বলল,
"যাক ভালো! বেশ সুস্থ আর হ্যান্ডসাম হয়েছো। তুমিও অনিয়ম করো না! নাহলে আমার মতো অবস্থা হবে।"
কৌশিক এক গাল হাসল,
"ওকে!"
নিক একটু থেমে নিজের চিরচেনা দুষ্টু সুরে বলল,
"কিন্তু তোমার সাথে দাঁড়ালে আমাকে কেউ চোখ তুলেও দেখবে না। এই একটা কষ্ট থেকে গেলো।"
কৌশিক ঠোঁট বাঁকিয়ে বলল,
"ব্রোকেন অবস্থায় থেকেও যদি কেউ মেয়ের চিন্তা করতে পারে, তাহলে সেটা তুমি। ক্যারি অন!"
কৌশিক উঠে চলে গেলো। নিক ও কিছু বলল না, শুধু টিস্যু বক্সটা হাতে নিয়ে ধীরে বিছানায় শুয়ে পড়ল। তার বুকটা তীব্র ব্যথায় কুঁকড়ে উঠছে। কিন্তু শারীরিক কষ্টের চেয়েও মনের ভাঙা টুকরোগুলো তাকে আরও বেশি পীড়া দিচ্ছে।
নোহারার হাতের আঘাত তার শরীরে পড়েছে, কিন্তু সেই আঘাত শরীরের চেয়ে বেশি ভারী হয়ে বসেছে নিকের মনে। কৌশিকের কথাগুলো সেই ক্ষতকে নোনাজলের মতো জ্বালিয়ে দিয়েছে। নিক চোখ বন্ধ করে একটা দীর্ঘ শ্বাস নিতে চাইল, কিন্তু সেই শ্বাস ভারী পাথরের মতো বুকে চেপে বসলো।
নোহারার প্রতি অজান্তেই জন্ম নেওয়া ভালো লাগা এখন নিকের জন্য বিষের মতো। মেয়েটা যেভাবে বলেছে আর কখনোই তো সামনে যাওয়া যাবে না। নোহারার শেষ কথাগুলো নিকের মনের গভীরে কাঁটার মতো বিঁধে আছে, যে কাঁটা সহজে ছাড়ানো যাবে না। এক মুহূর্তে মনের মধ্যে এক প্রবল অন্ধকার তাণ্ডব শুরু হলো। দাঁতে দাঁত চেপে সে সিদ্ধান্ত নিলো, যদি কোনোদিন নোহারা তার সামনে আসে, সেই দিনই নোহারার জীবনের শেষ দিন হবে। আর কোনো মাফ নেই! অনেক সহ্য করেছে। অনেক ভালোভাবে কথা বলার চেষ্টা করেছে। কিন্তু আর নয়। তার কাজ তো মেয়েদের পিছনে পড়ে থাকা নয়! নিকের জীবনের আসল লক্ষ্য একটাই,নিজেকে আরও শক্তিশালী আর পরিপূর্ণ করে তোলা।
নিকের মাথায় চিন্তারা ঘোরাঘুরি করতে লাগল। প্রতিদিন একটু একটু করে শরীরের সৌন্দর্য আর শক্তি বাড়ানোই তার একমাত্র উদ্দেশ্য। যত বেশি মানুষের রক্ত সে নিজের শরীরে গ্রহণ করবে, ততই তার শরীর আরও আকর্ষণীয় হবে। তার চেহারায় এক অদ্ভুত সৌন্দর্যের ঝলকানি ফুটে উঠবে, যেটা যেকোনো মানুষকে মুগ্ধ করতে বাধ্য। সেইসঙ্গে নিকের জীবনের সীমাও বাড়বে, এক অবিনশ্বর সত্তায় রূপান্তরিত হবে সে।
••••••••••
"প্রিন্স! আমার চুল বেঁধে দাও!"
অনন্যার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালো কৌশিক। 'প্রিন্স' এই শব্দটা ব্যবহার করে অনন্যা কিছুটা ভীত হয়ে পড়লো। যদি সেদিনের মত আচরণ করে বসে লোকটা? বলা তো যায় না কখন কি করে! তাই অনন্যা বড় শ্বাস নিয়ে নিজেকে প্রস্তুত করলো। কিন্তু অনন্যাকে অবাক করে দিয়ে কৌশিক তেমন কিছুই ঘটায়নি।
কৌশিক কিছুক্ষণ একদৃষ্টে অনন্যার দিকে তাকিয়ে থাকলো। অনন্যার মুখটায় একটু সাহসী ভাব দেখা যাচ্ছে। মেয়েটার মুখভঙ্গি কৌশিককে খানিকটা মজা দিচ্ছে। সেদিনের ঘটনার পর থেকে কৌশিক নিজেও নিজেকে খানিকটা সংযত রেখেছে। যদিও সেদিন কৌশিক বেশ দুর্বল ছিল, তার শরীরে কম শক্তি ছিল। কিন্তু আজ সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে ফিরেছে কৌশিক। তাই ওরকমটা হওয়ার কোনো কারণ নেই। মূলত সেই কারণে আজকের এই অনুরোধে সে একটুও বিরক্ত হলো না। তবে প্রিন্স শব্দটা কৌশিকের কানে পৌঁছাতেই তার শরীরে একটা হরমোন নিঃসৃত হতে শুরু করে, যারপরনাই কৌশিক নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়ে। বিশেষ করে অনন্যার ডাকেই এটা হয়! কিন্তু কেনো হয় এটাই প্রশ্ন! ভেনোরাও কয়েক বার ডেকেছিল তাকে প্রিন্স বলে কিন্তু এমনটা তো হয়নি কখনো।
চিরচেনা সেই ডাক! বহুকাল আগে একজন মাত্র ব্যক্তি ডাকতো। আর সেই ডাকটাই অনন্যার মুখ হতে হঠাৎ শুনে কৌশিক নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে। সে নীরব হয়ে চুপচাপ এগিয়ে আসে, অনন্যার চুলটা আলতো হাতে বাঁধা শুরু করে। তার আঙুলগুলো চমৎকার দক্ষতায় চুলের প্রতিটি আলগা অংশকে বশে আনছে। কাঁটা চামচের সাহায্যে ঠিকঠাক করে আটকে দেয় গুছিয়ে রাখা চুল। কেশ বাঁধা শেষে একবার পেছনে সরে দাঁড়িয়ে নিজের কাজটা নিরীক্ষা করে কৌশিক।
অনন্যা নিশ্চুপ হয়ে ছিল পুরোটা সময়, স্যার হাত সরিয়ে ফেলতেই একটা প্রশ্ন মাথায় আসতেই সে না করে পারলো না,
"মেয়েদের চুল বেঁধে দেওয়া কোথা থেকে শিখেছেন, স্যার?"
কৌশিক এই প্রশ্নে বিভ্রান্ত হলো। তার চোখের সামনে অতীতের একটি ঝাপসা দৃশ্য হুট করে চোখের কোণে ফুটে উঠল। এক অদ্ভুত স্নিগ্ধ আলোয় আবছা মুখ ভেসে উঠল, এক লম্বা চুলের নারীর। যে নারীর মাধ্যমেই কৌশিকের অস্ত্রশিক্ষার হাতে খড়ি হয়। সিনেমার চিত্রের মতো ভেসে উঠলো, সুন্দরীতম সেই নারী তার চুল বাঁধছে। চুল বাঁধার সময় প্রিন্সেস আরিসার মুখে এক শান্ত সৌন্দর্য ফুটে উঠত, সে সৌন্দর্য প্রিন্সেসকে এক অলৌকিক আভায় ঘিরে রাখত। সেই চুল বাঁধার শিল্পকর্ম, সেই তীক্ষ্ণ কোমল হাতের কারুকাজ কৌশিকের মনে চিরদিনের জন্য গেঁথে গিয়েছিল। মুগ্ধ হয়ে দেখতো কৌশিক।
কিন্তু আজ, এত বছর পর, সেই একই প্রক্রিয়া সে ব্যবহার করেছে। এক ভিন্ন মেয়ের জন্য। এক মিষ্টি, অগোছালো মেয়ে, অনন্যা।
অনন্যার কথায় ধ্যান ভাঙল কৌশিকের। অনন্যা জোরেশোরে বললো,
"স্যার! স্যার, কার খেয়ালে হারিয়েছেন? কে সে?"
কৌশিক হাত নাড়িয়ে বললো,
"উঁহু! আমি কারো কাছ থেকে শিখিনি। এমনিই হয়ে গেছে।"
অনন্যা মুখ বিকৃত করে তাকালো। কথা শুনেই বুঝে গেছে, লোকটা মিথ্যে বলেছে। কিছুক্ষণ নিশ্চুপ রইলো সে। অতঃপর খাবারের দিকে মুখ ঘুরিয়ে কিছু চিন্তা করলো। স্যারের দিকে তাকিয়ে বললো,
"প্রিন্স! আআআ!"
কৌশিক চোখ মুখ কুঁচকে বললো,
"কী?"
"খাইয়ে দিন।"
"হাত নেই?"
অনন্যা দুষ্টু হাসি দিয়ে বললো,
"কালকে কেউ একজন বলেছিলো, যত পারো আমাকে ব্যবহার করো। তো আজ পাল্টি কেনো খাচ্ছে?"
কৌশিক শ্বাস ফেলে অনন্যার পাশে বসলো। লারা বাজারে গেছে, আর তার অনুপস্থিতিতে কৌশিক নিজেই রান্না করেছে। এমনটা অনেক দিন হয়নি। এই বাড়িতে আসার পর থেকেই লারা দায়িত্ব নিয়ে রান্না করে। কিন্তু আগে? অন্য দেশে থাকতে! বেশিরভাগ সময় রান্না করে খাওয়া হতো কৌশিকের। সেই হিসেবে আজ অনেক অনেক দিন পর রান্না করলো সে। তাই একটু চিন্তায়ই মাথায় ঘুরছে কৌশিকের! রান্নায় কোনো সমস্যা হয়েছে নাকি তা নিয়ে চিন্তা। খাবার বলতে ডিম পোচ আর নুডলস!
অনন্যার মুখে খাবার তুলে দেওয়ার পর মেয়েটার পরিতৃপ্তির ছোট্ট আওয়াজে কৌশিকের হৃদয় আরও একটু উষ্ণ হলো। ভালো লেগেছে অনন্যার, আর সেই ভালো লাগা কৌশিকের চোখে ফুটে উঠলো এক অদ্ভুত প্রশান্তির আলোয়। মুখে মৃদু হাসি নিয়ে কৌশিক তাকিয়ে রইলো অনন্যার দিকে। মনে হলো, চারপাশে কোথাও এক নীরব গান বেজে উঠেছে। কৌশিকের দৃষ্টি নিবদ্ধ হয়ে রইলো অনন্যার মুখে। অনন্যার প্রতিটি খুঁটিনাটি মুহূর্ত আরও গভীর করে খেয়াল করছিল কৌশিক।
সেই মুহূর্তে কানে ভেসে এলো শব্দগুলো,
You hold me close with your eyes,
With our hearts pressed together.
Time stood still in that moment,
the wind fell silent.
Only you were in front of me...
It felt like,
The whole world belonged to us,
A universe of just you and me!
.
.
.
চলবে......................................................................