ঝর্ণার কলকলানি সুর। মোহময় একটি অপরিচিত পুষ্প ঘ্রাণে হৃদয় আকুল হতে শুরু করলো। রানি কামিনীর দেহের ভেতর খেলা করতে লাগলো কৌতূহল। গলায় তার তখনো অস্ত্র ধরে দাঁড়িয়ে আছে একজন অপরিচিত পুরুষ।
রানির ঠোঁট জুড়ে খেলা করলো কুটিল হাসি। ভয়হীন কণ্ঠে বাহবা দিয়ে বললেন,
"এ্যাজেলিয়া রাজ্যে দাঁড়িয়ে, সেই রাজ্যের রানি কামিনীকাঞ্চনের গর্দান নেওয়ার মতন সাহস এই রাজ্যের কারো আছে ভেবেই আমি ভীষণ অবাক হলাম। তা, আমার গর্দান নেওয়ার উপযুক্ত কারণ কি আমায় বলবেন, জনাব?"
রানির গলার সামনের ধারালো অস্ত্রটি সরিয়ে নিলো অজ্ঞাত সেই মানবটি। ছোট্টো ছুঁড়িটাকে জামার এক অংশে রেখে দিতে দিতেই জবাব দিলো,
"আমার পায়রা যুগলের দিকে আপনি তীর তাঁক করে ছিলেন।"
"এই সামান্য অপরাধেই রানির প্রাণ নিতে চেয়েছেন? আপনার হৃদয় একটিবার কাঁপছে না? এই যে আমি জীবিত রইলাম। এখন যদি আমি আমার প্রাণ নিতে চাওয়ার অপরাধে আপনাকে কঠিন থেকে কঠিনতম শাস্তি দিই, তখন কী হবে?"
রানির কথা যেন গায়েই মাখলো না মানব। বরং বেশ অনায়াসেই হেঁটে গিয়ে বসল খোলা জায়গাটির মাঝখানে থাকা তামাটে রঙের শক্ত পাথরটির উপর। পা দুটোকে নাড়াতে নাড়াতে বলল,
"শাস্তি মাথা পেতে নেওয়া ছাড়া আমার কি আর কোনো গতি আছে, রানি কামিনীকাঞ্চন?"
ছেলেটির ভাবলেশহীন মুখাবয়ব। চোখের কোথাও নেই ভয়ের লেশমাত্র। বুকের শিরা উপশিরা টান টান। বাদামি রঙের কোঁকড়া চুল। এই রাজ্যে এই মানুষটিই হয়তো প্রথম কেউ যে রানিকে দেখে মোটেও বিচলিত নয়। বরং প্রকৃতির মতনই ঠান্ডা। নিশ্চুপ।
রানি এগিয়ে গেলেন মানবটির কাছে। রুনুঝুনু শব্দে বাজলো পায়ের নূপুর জোড়া।
"আপনার পরিচয় কী? কোথায় বাস করছেন?"
"কাউকে শাস্তি দিতে হলে তার পরিচয় জানতে হয় নাকি, রানি কামিনীকাঞ্চন?"
কী কাঠ কাঠ গলার স্বর! রানি নিজের জীবনে প্রথম এমন একটি পুরুষকে দেখে কেবল অবাকই নয়, হতবিহ্বল হয়ে গেলেন।
কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে বললেন, "শাস্তির জন্য পরিচয় জিজ্ঞেস করলাম সেটা আপনি জানলেন কীভাবে?"
"যেভাবে জানি রানি শাস্তি দিতে পছন্দ করেন।"
কোন ভয় নেই, দ্বিধা নেই কণ্ঠে। রানি কামিনীর রাগ হলো। কিন্তু তিনি আপাতত কথোপকথন বাড়াতে চাইলেন না। তার আগে শত্রুর একটা গতি করতে হবে। শত্রুকে বেশিক্ষণ আশেপাশে রাখলেই বিপদ। তারপর নাহয় আগন্তুকের একটা ব্যবস্থা করা যাবে!
এই ভেবেই রানি কামিনী নিজের ঘোড়াটার দিকে যেতে আরম্ভ করলেন। এবং অনুভব করলেন অপরিচিত পুরুষটিও রানির পেছন পেছন আসছে। রানি কামিনী তার পিঠে লুকানো তলোয়ারের নিচটাতে হাত দিলেন। মনে মনে বললেন সামান্য কিছু করার আগেই এক কোপে লোকটির প্রাণ নিয়ে নিবেন। কিন্তু রানিকে অবাক করে দিয়ে পুরুষটি রানির ঘোড়ার পাশে এসে দাঁড়ালেন। চোখ-মুখ আগের মতনই শক্ত। কিন্তু কণ্ঠে রইলো অনুগত্য। বললো,
"আসুন রানি, আপনাকে এই জঙ্গল থেকে বের হতে সাহায্য করে দিই।"
এহেন কথাটি রানির গর্বের দর্পচূর্ণ করল যেন। রেগে গেলেন রানি। চোখ গুলো খানিকটা বড়ো হলো সেই রাগে। রণমুর্তি ধারন করে ফেললেন নিমিষেই। হুঙ্কার ছেড়ে বললেন,
"রানি কামিনীকাঞ্চন কারো সাহায্য কিংবা দয়ায় চলে না।"
"সাহায্য অথবা দয়া করছি সেটা আপনাকে কে বলল? আমি দায়িত্ব পালন করছি। আপনি এই রাজ্যের রানি। আপনার নিরাপত্তা দেওয়া প্রজা হিসেবে আমার দায়িত্ব।"
রানির স্ফুটিত অগ্নির মতন রাগে যেন হুট করে নেমে এলো বর্ষণ। নিভে গেলো সেই রাগের অগ্নি। এই মানুষটার একেক কথাই রানি যেন বিশ্ব ব্রহ্মান্ডে নতুন করে পুরুষের উপমার সাথে পরিচিত হচ্ছেন। তবুও দমে যাওয়ার পাত্রী রানি নন। তাই নিছকই কথাটিকে উড়িয়ে দেওয়ার ভঙ্গিতে বললেন,
"আপনার দায়িত্বজ্ঞান প্রশংসনীয়। তবে আমি নিজেকে নিরাপত্তা দেওয়ার ক্ষমতা রাখি।"
লোকটি হাসলো এবার। মনোমুগ্ধকর সেই হাসি। সদা শুনে আসা কথ্য বচন 'হাসি সুন্দর নারীর'— তা যেন মুহূর্তেই মিথ্যে হয়ে গেলো। রানি কিয়ৎক্ষণ চুপ করে পরখ করলেন সেই হাসি। এত সুন্দর দৃশ্য তার জীবনে বোধকরি এই প্রথম দেখলেন।
"যদি তা-ই হয়, বলুন তো এখানে ক'জন আছে?"
রানি কিছুটা ভড়কালো। পুরুষটির ভীষণ ভড়কে দেওয়ার ক্ষমতা রয়েছে। রানি এবার নিজের প্রতি বিরক্ত হলেন। কোনো পুরুষকে এভাবে নিখুঁত ভাবে তিনি কেন পর্যবেক্ষণ করছেন তা ভেবে ভেবেই হয়রান হলেন।
রানি নিজেকে ধাতস্থ করলেন। এই পুরুষটির হেঁয়ালিপূর্ণ প্রশ্নে ভ্রু কুঞ্চিত করলেন। কর্কশ স্বরে বললেন,
"এখানে ক'জন আছে তা কি আপনি দেখতে পারছেন না? আপনার দৃষ্টি ক্ষমতা কি লোপ পয়েছে, জনাব?"
"আপনি অনুগ্রহ করে আমাকে হ্যাভেন ডাকবেন, রানি কামিনীকাঞ্চন। আমার নাম হ্যাভেন।"
"আমি কি নাম জানতে চেয়েছি?"
"প্রজা হিসেবে আমি রানিকে এতটুকু জানাতেই পারি। এবার বলুন এখানে আমরা ক'জন আছি?"
রানি অতিষ্ঠ হলেন, "আপনি কি হিসেব করতে অক্ষম? না-কি এখানে আমাকে একা পেয়ে হেঁয়ালি করছেন? রানি কামিনীকাঞ্চনের সাথে হেঁয়ালি করলে প্রাণও যেতে পারে তা কি জানেন?"
"মার্জনা করবেন। আমি হেঁয়ালি করছি না। আপনি আমার প্রশ্নের উত্তর দিলেই আমি বাকি কথা টুকু সম্পূর্ণ করতে পারবো। এবং আপনি তখন বুঝতে পারবেন আমি কী বুঝাতে চেয়েছি।"
রানি মনে মনে ভাবলেন হ্যাভেনের কথায় উত্তর দিবেন না। কিন্তু পরমুহূর্তে না দিয়ে পারলেন না। বললেন, "দু'জন।"
রানির উত্তরে হ্যাভেনের ঠোঁট জুড়ে ছুটে বেড়ালো হাসি। রানির উত্তরটি ভুল হয়েছে তা যেন সেই হাসিতে স্পষ্টত প্রতীয়মান হলো।
হ্যাভেন চারপাশে একবার চোখ ঘুরিয়ে দেখে বলল,
"কে ওখানটাতে?"
রানি চমকালেন। কোথায় কে? প্রশ্নটি করার আগেই একটি দ্রুত বেগে চলা পদধ্বনি তার কর্ণগোচর হলো। হ্যাভেন গননা শুরু করলেন। রানির দিকে তাকিয়ে হাসিমুখে বললেন,
"দেখেছেন তো, রানি কামিনীকাঞ্চন, আমরা ক'জন ছিলাম?"
রানি হ্যাভেনের এতটা চতুরতায় মুগ্ধ না হয়ে পারলেন না। তবে সেই মুগ্ধতা তিনি প্রকাশ করলেন না। বরং কথা ঘুরিয়ে বললেন,
"কোনো একজন এখানটায় ছিলো।"
হ্যাভেন মাথা নাড়াতে নাড়াতে বলল, "আবারও ভুল। এখানে দু'জন ছিলো। এর মাঝে একজন নারী ছিলেন।"
দু'জন ছিলো কি-না তা ঠিক ঠাহর করতে পারলেন না রানি কামিনী। তবে যেই ছিলো সে যে মেয়ে ছিলো তা ঠিকই বুঝতে পারলেন রানি। তবুও হ্যাভেনকে প্রশ্ন করলেন,
"আপনি কীভাবে জানলেন দু'জন?"
"কারণ আমি দু'টো আলাদা হাঁটার শব্দ পেয়েছি। একটি একদম ধীরে হাঁটার শব্দ এবং আরেকটি পা টেনে টেনে হাঁটার শব্দ।"
হ্যাভেনের দূরদর্শিতা রানি কামিনীর বুকে জমলো অগাধ বিস্ময়। চোখেমুখে যতই কাঠিন্যতা রাখুক সেই বিস্মময়ের তাপ ছুঁয়ে যাচ্ছে সেখানেও। হ্যাভেন রানিকে কিছু বলতে না দিয়েই তাড়া দিলো,
"আপনার এখান থেকে বের হয়ে যাওয়াটাই মঙ্গলজনক বলে মনে করি। মার্জনা করবেন আপনাকে এটা বলছি। কিন্তু আমার মনে হচ্ছে জায়গাটি আর আপনার জন্য নিরাপদ নয়।"
রানি কামিনী আর বাক্য ব্যয় না করেই ঘোড়ায় উঠে বসলেন। হ্যাভেন বড়ো বড়ো পা ফেলে দূরে গেঁথে রাখা মশালটা নিয়ে এলো। রানির ঘোড়ার পাশে পাশে হাঁটতে লাগলো চঞ্চল পায়ে। চোখ তার দিগবিদিক ঘুলে বেড়াচ্ছে। কী ধারালো দৃষ্টি! মাঝে মাঝে জোরে শ্বাস নিচ্ছে। থেকে-থেকে কিছু বুঝাে চেষ্টা করছে। সবটাই রানি নীরবে পর্যবেক্ষণ করলেন। রানি নিজেও রইলেন সচেতন। কিন্তু হ্যাভেনের এই তীক্ষ্ণতা তাকে ভেতর ভেতর বেশ ভাবালেন। পুরুষ নিয়ে এতদিন তার বুকে জমে থাকা ঘৃণার পাহাড় টলে উঠলো।
নিজেই মনকে প্রশ্ন করলো, কে এই হ্যাভেন? যার দূরদর্শিতায় রানি কামিনীর বহু বর্ষের ভাবনায় ভাঁটা জন্মে? কী তার পরিচয়! মনে মনে ভেবে নেয় আজ নিরাপদের সাথে মহলে ফিরুক, অবশ্যই অবশ্যই তিনি এই হ্যাভেনের খোঁজ নিবেন। পুরো পরিচয় মাটি খুঁড়ে হলেও বের করবেন।
রানিরা তখন জঙ্গলের মাঝামাঝি। ছমছমে চারপাশ। একটি মশাল জ্বলছে নির্নিমেষ। মৃদু হাওয়ায় সেই মশালের আগুনটা এধার-ওধার নড়ছে। এই আগ্নি নৃত্য মুহূর্তটাকে আরও থমথমে আর গা শিরশির করে তুললো।
জঙ্গলের প্রায় শেষ দিকটাই আসতেই দূর থেকে একটি ছুড়ি এসে রানির বা-হাতের কনুইয়ের পাশ কেটে চলে গেলো ছোঁ করে। আচমকাই এটা ঘটায় চমকে উঠলো হ্যাভেন। রানি চেপে ধরলো নিজের হাতটা। তবে তার মুখ চোখে কোনো পরিবর্তন হলো না।
হ্যাভেন রানির হাতটি দিয়ে গলগল করে র ক্ত বের হতে দেখেই বিচলিত হলো। ছুটে গিয়ে কী যেন আশেপাশে খুঁজলো। এরপর একটি গাছের ডাল থেকে কতক গুলো জংলী পাতা ছিঁড়ে এনে হাত দিয়ে থেঁতলে রানির সামনে ধরলো। উত্তেজিত কণ্ঠে বলল,
"ধরুন, রানি কামিনীকাঞ্চন। এগুলো তাড়াতাড়ি হাতের কাটা জায়গায় লাগিয়ে নিন। র ক্ত বন্ধ হবে।"
রানি থেঁতলানো পাতা গুলোর দিকে এক পলক তাকিয়ে বললেন, "লাগবে না। আমি দেখতে চাই কে এই কাজটি করেছে। আপনি সরুন। আমি ঘোড়া থেকে নামবো।"
হ্যাভেন গলায় জোর দিলো। ব্যস্ত কণ্ঠে বলল, "এই ভুলটি করবেন না, রানি। আপনি দ্রুত জঙ্গল ছেড়ে বের হোন। এই জঙ্গলে আপনার বিপদ।"
রানি ঠিক তখনই পুব দিক থেকে ভেসে আসা একটি শব্দ শুনলেন। মাথায় থাকা ধার ক্লিপ গুলো খুলেই ছুঁড়ে মারলেন অন্ধকারে ঘেরা সেই পুব দিকটাই।
এরপর নিজের ঘোড়ার দঁড়ি শক্ত করে ধরে গতি বাড়ালেন। টগবগিয়ে ছুটতে লাগলো রাজ ঘোঁড়া। হ্যাভেন দাঁড়িয়ে রইলো পেছনেই। ছুটতে ছুটতে রানি একবার পেছনে তাকালেন। দেখলেন হ্যাভেন দাঁড়িয়ে আছে আগের জায়গাটিতেই, মশাল হাতে। চোখের মনি গুলো মশালের আলোয় হলুদ দেখালো। মনে হলো দু'টো চোখ যেন দু'টি অগ্নি স্তূপ।
৬.
কুয়াশায় ঢেকে আছে রাজমহলের বিশাল প্রাসাদের বেশ কিছু অংশ। চিন্তিত ভঙ্গিতে প্রাসাদের বিশাল গেইটির সামনে দাঁড়িয়ে আছে যামিনী। তার সাথে রয়েছে রেবেকা উযোয়ারসহ আরও বেশ কয়েকজন দাসদাসী। হ্যাব্রো বেশ কিছু সংখ্যক পহরিকে জায়গায় জায়গায় পাঠিয়েছে রানির খোঁজে। যামিনীর চোখে একটু পর পরই অশ্রু ভরে উঠছে। রেবেকার হাতটা চেপে ধরছে ক্ষণে ক্ষণে। আতঙ্কে মুখটি তার এতটুকুন হয়ে এসেছে। থেমে-থেমেই বলছে,
"রেবেকা, কী হলো সখীর? আমি যে কেন সখীর সঙ্গে গেলাম না! সখী ঠিক আছে তো?"
রেবেকা এই কথার বিপরীতে স্বান্তনার স্বরে বার বার বলছেন, "রানি ঠিক আছে একদম। চিন্তা করবেন না আপনি।"
এরপর আবার হ্যাব্রোর খোঁজ নিচ্ছে। হ্যাব্রোকে জিজ্ঞেস করছে কোনো খোঁজ পেলো কি-না। প্রতিবার হ্যাব্রো মুখ কালো করেই বলছে, 'না'।
দাসদাসীদের ভেতর গুঞ্জন ভেসে আসছে ক্ষণে ক্ষণে। কেউ বলছেন রানিকে বোধহয় রাজা ইনান নিয়ে গেছেন, কেউবা বলছেন মনে হয় জঙ্গলে গিয়েছেন কোনো জন্তু খেয়ে নিয়েছে।
এই কলরবের মাঝেই রানির রাজ ঘোড়া সশব্দে এলো। রানির আগমন ঘটলো রাজকীয় ভাবে। যামিনীর প্রাণ ফিরে এলো যেন। সে ছুটে রানির কাছে আসার আগেই রানি ঘোড়ায় বাঁধা অতিরিক্ত দড়িটি ছুঁড়ে মারলেন হ্যাব্রোর দিকে। বজ্রপাতের মতন কণ্ঠে হুঙ্কার তুলে বললেন,
"হ্যাব্রো, ওকে বাঁধো।"
রানির কথায় সবাই চমকে গেলো। সকলে তাকালো ইশারা করার মানুষটির দিকে। হ্যাব্রোও স্বয়ং অবাক হয়ে শুধালো!
"উনাকে বাঁধবো? উনি তো আপনার প্রি...."
"আমার কথার উপর কোনো কথা নয়, হ্যাব্রো। দ্রুত বাঁধো।" রানির উচ্চ বাক্যে হ্যাব্রো থতমত খেলো তবে সে তখনও বিশ্বাস করতে পারলো না রানি নিজের প্রিয় কাউকেও শাস্তি দেওয়ার জন্য মনস্থির করে ফেলেছেন।
.
.
.
চলবে......................................................