প্রাণসখা - পর্ব ০৩ - নাদিয়া সাউদ - ধারাবাহিক গল্প


আশেপাশে সারি বেঁধে আরো অনেক বাস থেমে আছে।চারিদিকে ভালমতো দৃষ্টিপাত করতেই বোঝা গেল, বাস কুমিল্লা'তে যাত্রাবিরতি দিয়েছে!শুকনো ঢোক গিলে মাথায় বড়োসরো ঘোমটা টেনে নিল অগ্নিলা।মুখ অনেকাংশ ঢেকে সম্মুখে দোকানের দিকে পা বাড়াতে'ই,গম্ভীর স্বর তাকে থামিয়ে দিল।

"গাড়ি থেকে নামতে'ই এমন চোরের মতো বেশভূষা ধরেছেন কেন?নাকি কোনো সেলিব্রিটি আপনি?অবশ্য টিভিতে দেখেছি বলে মনে হচ্ছে না।

ঠাঁয় দাঁড়িয়ে জুবরানে'র কথা শুনছিল অগ্নিলা।রাগে তাঁর সর্বাঙ্গ রি-রি করে উঠলো!ঘুরে তাকিয়ে জোড়াল স্বরে বলল সে,
" আশ্চর্য!আমার পিছু কেন নিয়েছেন আপনি?শুরু থেকেই আপনাকে সন্দেহ হচ্ছে!কি চাই আপনার?

বোকার মতো কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলল জুবরান,
"আপনার ফোন ফেলে এসেছেন!কল এসেছিল।তাই দিতে এলাম।এত সহজে মানুষ'কে জাজ় করে ফেলতে পারেন?বাহ!দারুণ ক্ষমতা আপনার!

জুবরানে'র হাত থেকে একপ্রকার ছিনিয়ে ফোন নিল অগ্নিলা।হাত ভীষণ কাঁপছে তাঁর।গন্ডস্থল বুঝি শুকিয়ে এলো।সবটাই পর্যবেক্ষন করলো জুবরান।মেয়ে'টাকে যত দেখতে অবাক হচ্ছে!কিছু তো একটা লুকায়িত ব্যাপার আছে তার মধ্যে!অগ্নিলার হাতে থাকা ফোন'টা ফের বেজে উঠলো।ভয়ানক আৎকে উঠলো সে।স্ক্রিনে রুহি'র নাম দেখে স্বস্তির স্বাস ফেলল।রিসিভ করে কানে জড়াল।ওপাশ থেকে চিন্তিত স্বরে শুধাল রুহি,
" তোমার ফোন পাওয়া'র পর তো,আমার আর ঘুম'ই হলো না দুশ্চিন্তা'য়।পাশে'র ছেলে'টা আর কিছু বলেছে?

একপলক জুবরানে'র দিকে তাকাল অগ্নিলা।পরক্ষণে বলল,
"নাহ।

কি বুঝে যেন জুবরান হনহন করে ফের বাসে উঠে গেল।সেদিকে ঠাঁয় তাকিয়ে থেকে'ই বলল অগ্নিলা,
" তুমি সাজেক যাওয়ার বন্দোবস্ত করবে যদি একবার আমাকে আগে'ই জানিয়ে রাখতে,তাহলে আমি কষ্ট করে ঢাকায় যেতাম না।আমার বাড়ি'র কাছ থেকে'ই বাস ধরতে পারতাম।

"কিন্তু আমি তো জানি না তুমি কোথায় থাকো!নিজের পরিচয় তুমি কখনই বলোনি আমাকে।তাছাড়া সাজেক যাওয়ার সিদ্ধান্ত হুট করে'ই নেওয়া হয়েছে।সেটা সম্পূর্ণ তোমার ইচ্ছেতে'ই!

আচমকা চুপ হয়ে গেল অগ্নিলা।এভাবে বলা ঠিক হয়নি তাঁর।দ্রুত কথার প্রসঙ্গে পাল্টে দিল সে,
" বাড়ি'র কাছে হলেও আমার পক্ষে টিকিট কাটা,আর সবকিছু ম্যানেজ করা সম্ভব হতো না রুহি।তোমার এই উপকার আমি কখনো ভুলবো না।

অগ্নিলার কথায় নিশ্চুপ হয়ে গেল রুহি।মেয়ে'টা কি ভেতর থেকে কষ্ট পেয়ে এই কথাটা বলল?নিজে'র কাছে অপরাধী লাগছে কেমন।যৌথ পরিবার হওয়ায় অগ্নিলা'কে নিজের বাড়ি'তে নিয়ে আসতে পারেনি রুহি।তা ছাড়া বাড়ি'র লোকদের হাজার'টা প্রশ্নের সম্মুখীন হতো সে।অগ্নিলার ব্যাপারে কিছু'ই জানা নেই তাঁর।কথা'র মাঝে'ই বলল অগ্নিলা,
"আমার পাশে যে ছেলে'টা বসেছে একটু আগে ভালমতো খেয়াল হতে'ই দেখলাম তাঁর থুতনিতে কাটা সেলাইয়ের দাগ!ভয় আমার বাড়ছে'ই রুহি!

ঘোর কাটতে'ই কিয়ৎক্ষনে'র জন্য স্তব্ধ হয়ে গেল রুহি!দুয়ে দুইয়ে চার হিসেব মিলিয়ে নিয়ে বলল সে,
" একমিনিট!আমি তোমাকে একটা ছবি পাঠাচ্ছি।দেখো তো এই ছেলে'টা কিনা।

রুহি'র কথা কিছু'ই বুঝতে পারলো না অগ্নিলা।ততক্ষণে লাইন কেটে গিয়ে ম্যাসেন্জারে একটা ছবি আসলো।ভাবনার মাঝে'ই ওপেন করলো সে।মুহূর্তে ভয়ানক চমকে উঠলো!এটাই তো এই ছেলে!কিন্তু রুহি'র কাছে ছবি আসলো কোথা থেকে?আবারো রুহি'র কল আসলো।রিসিভ করে দ্রুতই বলল অগ্নিলা,
"হ্যাঁ রুহি!এই ছেলেটাই!তুমি কি তাকে চেনো?

তপ্ত শ্বাস ফেলে বলল রুহি,
"তোমার বর্ননা শুনে আগে'ই একটু সন্দেহ হয়েছিল।আরে এটা আমার বড়ো চাচ্চুর ছেলে।জুবরান ভাই।একদম চোখ বুজে ভরসা করতে পারো তাঁকে!তুমি যদি রেডিও শুনতে তাহলে তাঁকে চিনতে!সে রেডিও শো করে।অবশ্য আমিও রেডিও শুনি না।জানো,আমার ট্যুরে যাওয়ার শখ হয় ভাইয়া'কে দেখে'ই।জুবরান ভাই'ই প্রথম একটা ট্রাভেল গ্রুপে'র সাথে আমাকে কক্সবাজারে পাঠিয়েছিল।সবাই মেয়ে ছিল।সেদিন যে কি আনন্দ হয়েছিল আমার!সে থেকে একটা নেশা হয়ে গেছে!বাড়ি'তে এই নিয়ে দুই ভাইবোন কত কথা শুনি ইয়ত্তা নেই!তবুও ঘুরে বেড়াই।তুমি এক্ষুনি ফোন নিয়ে যাও,আর বলো রুহি কথা বলবে।জুবরান ভাই তোমার সাথে আছে শুনে আমার চিন্তা সম্পূর্ণ কমে গেছে।সেখানে গিয়ে কোথায় থাকবে সব সে'ই ঠিক করে দিবে।

রুহি'র কথা শুনে ভয় অনেক'টা দূর হয়েছে অগ্নিলার।এই জন্য'ই বুঝি ছেলেটা এমন ক্যাপ মাথায় দিয়ে, অর্ধেক মুখ ঢেকে ছিল ডাকাতে'র মতো!আমতাআমতা করে বলল অগ্নিলা,
" থাক না।পরিচয় দেবার দরকার নেই।কোনো সমস্যা'য় পরলে না হয় জানাব।

"আমি কিছু শুনছি না,তুমি যাও তো!বললাম তো জুবরান ভাই খুব ভাল।কখনো মেয়েদের কাছও ঘেঁষেনি।

বাসে'র জানালা গলিয়ে মাথা বের করে সে'ই ভদ্রলোক ডাকলো অগ্নিলা'কে।বাস ছেড়ে দিবে জানাল।দৌড়ে গিয়ে বাসে উঠে পরলো অগ্নিলা।কানে হেডফোন গুঁজে সিটে মাথা এলিয়ে দিয়ে,চোখ বুজে আছে জুবরান।কাঁধে কারো স্পর্শ পেতে'ই চোখ মেলে তাকাল সে।সম্মুখে অগ্নিলার রাগত্ব দৃষ্টি!দাঁত চেপে বলল সে,
" কখন থেকে ডাকছি?শুনতে পান না?বাস ছেড়ে দিয়েছে।এভাবে কতক্ষণ দাঁড়িয়ে ঢুলবো?সরুন।বসবো আমি।

জুবরান উঠে দাঁড়াতে'ই নিজের ফোন বাড়িয়ে দিল অগ্নিলা।ভ্রু কুঁচকে বলল জুবরান,
"আপনার ফোন আমি কি করবো?

বার কয়েক চোখের পাতা ঝাপটে নিয়ে বলল অগ্নিলা,
" আপনার বোন রুহি কথা বলবে।

অগ্নিলার মুখে রুহি'র কথা শুনে অবাক হলো জুবরান।পরক্ষণে ফোন হাতে নিয়ে কানে জড়াল।পাশ কাটিয়ে সিটে গিয়ে বসলো অগ্নিলা।

"জুবরান ভাই আমার বান্ধবী'কে দেখে রেখো একটু।মানে খেয়াল রেখো।কখনো এতদূর যায়নি সে।এই প্রথম ট্যুর তাঁর।

" কখনো যখন যায়নি এখন কেন যাচ্ছে?নির্ঘাত বাড়ি থেকে পালিয়ে এসেছে!

কিয়ৎক্ষণ চুপ থেকে বলল রুহি,
"না না তেমন কিছু নয়।আমি সাজেক গিয়েছিলাম যখন,তাকে কয়েক'টা ছবি পাঠিয়েছিলাম তখন।সেটা দেখে'ই তাঁরও যাওয়ার ইচ্ছে হয়েছে।বাড়ি'তে ঝগড়া হচ্ছে জান'ই!নয়তো আমি'ই যেতাম অগ্নিলার সাথে।

" হ্যাঁ বুঝতে পেরেছি।আচ্ছা রাখছি।

কথা শেষ হতে'ই অগ্নিলার দিকে ফোন বাড়িয়ে বলল জুবরান,
"মিস অগ্নি আপনার ফোন।

অগ্নি নাম শুনতে'ই বেশ চমকে তাকাল অগ্নিলা!বিনা বাক্য ব্যয়ে মোবাইল হাতে নিল।রাগ যেন আবারও মাথাচাড়া দিল।

◼️

সকালে খাবার টেবিলে বসে রুহি'র বিয়ের প্রসঙ্গে কথা তুললেন আশফাক আহমেদ।আজকে'ই ছেলেপক্ষ দেখতে আসবে জানান।রুহি'র বাবা আজিজে'র অবর্তমানে বিয়ের দায়িত্ব নিয়েছেন আশফাক আহমেদ।প্রস্তাব খানা শুনে বেশ খুশি'ই হয়েছেন রাজিয়া বেগম।তার দ্বিমত নেই।টেবিলে সবাই উপস্থিত থাকলেও রুহি এখনো ঘরে।মাঝে তানিয়া বলল,
"আমার মেয়ে'টাকে তাহলে আজ রুম থেকে বের'ই করা যাবে না।দেখা গেল রুহির জায়গায় রুশা'কে পছন্দ করে গেল ছেলেপক্ষ!তখন আরেক সমস্যা বাঁধবে।যে মেয়ে রাতবিরেতে দেশে দেশে ঘুরে।পিতা নেই আর মায়ে'র শাষনও নেই!ওমন মেয়ে'কে কে ঘরে'র বউ করবে? 

তানিয়া মুখে যা আসে তাই বলে ফেলে।আজকের কথাটা যেন লাগামহীন হয়ে গেছে!উপস্থিত সবাই স্তব্ধ হয়ে আছে।রুশা সবে নবম শ্রেণিতে পড়ছে।হতে পারে সে রুহির চেয়ে রূপে বেশি!তাই বলে এমন নিচু ধরনের কথা'টা বড্ড বেমানান ছিল!আশফাক আহমেদ ক্রোধান্বিত স্বরে বললেন,
"একটু ভেবেচিন্তে কথা বলো তানিয়া।তোমার মেয়ের বিয়ে'র বয়স হয়নি।বাচ্চা মেয়ে'টা কি শিখবে এসব শুনলে?আজিজ বেঁচে নেই।এখন আমাদের সবার উচিত রুহি'কে দেখেশুনে ভাল জায়গায় বিয়ে দেওয়া।সেখানে তুমি এটা কেমন ধরনের কথা বললে?

জোবেদা বেগম পাশ থেকে বললেন,
"সবসময় সবকিছু নিয়ে গর্ব করতে নেই ছোট।সন্তানকে তুই সুশিক্ষিত করতে পেরেছিস খুব ভাল!আমরা না হয় সন্তান মানুষ করতে পারিনি।তাই বলে আমাদের যা খুশি বলতে পারিস না তুই।

রাজিয়া'র চোখে পানি।খাওয়া শেষ করে স্কুলের জন্য বেরিয়ে গেল রুশা।তানিয়া মাথা নিচু করে খাওয়া'য় মনোযোগী হলো।চেঁচামেচি শুনে ভেতরের রুম থেকে বেরিয়ে এলো রুহি।এই বাড়ি'তে নিত্যনতুন ঝগড়া লেগে'ই থাকে।মায়ে'র থমথমে মুখখানা দেখে আৎকে উঠলো সে।দ্রুত এগিয়ে এসে বিচলিত স্বরে জিগ্যেস করলো,কি হয়েছে!জোবেদা বেগম হাসিমুখে এগিয়ে এসে বললেন,
" তোকে আজকে ছেলেপক্ষ দেখতে আসবে রুহি।ভার্সিটি'তে যেতে হবে না আজ।গিয়ে তৈরি হয়ে নে।
.
.
.
চলবে.....................................................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

WhatsApp