অঝরে ঝরছে তুষার। সমস্ত শহর জুড়ে যেনো তুষারের সাদা গালিচা বিছানো। সবগুলো গাছেই যেনো সাদা ফুল ফুটেছে। ফুরফুরে শীতল ঠান্ডা বাতাস বইছে। গভীর রাতে। চাঁদের ঈষৎ আলোয় বাড়ির ছাদ, শহরের রাস্তা তুষারে জ্বলজ্বল করছে। উত্তরদিকটার বিশাল বড়ো উইন্ডোর সামনে দাঁড়িয়ে রোদেলা। মনটা কেমন অস্থির হয়ে উঠেছে। বিছানায় শুয়ে ছিল এতক্ষণ সে। অনেকবার এপাশ ওপাশ করেও দু'টি চোখের পাতা এক করতে পারে নি। ঘুমের সঙ্গে যুদ্ধ করে একপ্রকার হেরে গিয়ে বিছানা ছাড়ে। স্বচ্ছ কাঁচ গলিয়ে বাইরে দেখল সে, সহসা বুকটা ভারী হয়ে ওঠল। হুট করে মনে এলো, কোথায় যেনো পড়েছিল। সময় কারো জন্য থেমে থাকে না। রোদেলা একবার পেছন ফিরে বিছানার দিকে তাকালো উন্মুক্ত বক্ষ, লম্বা চুলের, সুঠাম দোহী পুরুষকে একপলক দেখে ভ্রু কুঞ্চিত করে রোদেলা। চট করে এসে বিছানা ঘেঁষে দাঁড়াল। রোদেলা হতবিহ্বল। ও সেহরিশের চেহারা দেখে চমকে উঠল। সেহরিশের চোখ বন্ধ। তবে চোখের মণি কেবল ঘুরছে। রোদেলা শাড়ির আঁচল টেনে আলতোভাবে মুছে দিলো সেহরিশের কপালে জমা স্বেদজল। রোদেলা ভাবনায় পড়ে গেলো। সেহরিশ কী তবে খারাপ স্বপ্ন দেখছে? রোদেলা একটু চিন্তা করলো। রোদেলা এবার নিঃসংকোচে মানুষটাকে স্নেহময় কণ্ঠে ডাকলো, 'শুনছেন? আপনি কি আমাকে শুনতে পাচ্ছেন?'
আকস্মিকভাবে চোখ খুলে তাকায় সেহরিশ। ঘনঘন নিঃশ্বাস ফেলে দ্রুত সোজা হয়ে বসে গেলো। গলা শুঁকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে যেন। স্বেদজলে শরীর ভিজে চিপচিপে হয়ে আছে। সেহরিশ ক্লান্ত দৃষ্টিতে তাকাল রোদেলার দিকে। নিবিড় কণ্ঠে বলল,
'রোদ, রোদ।'
সেহরিশ ওঠে রোদেলাকে জড়িয়ে ধরে। ভারী নিঃশ্বাস ফেলো। রোদেলা জিজ্ঞেস করলো, 'আপনার কি হয়েছে?'
সেহরিশ আলতোভাবে রোদেলার মাথায় তার হাতটা রেখে বলল, 'রোদ, আমাকে আরেকটু শক্ত করে জড়িয়ে ধরো। আমার ভয় হচ্ছে, আমি স্বপ্নে দেখলাম তোমাকে হারিয়ে ফেলেছি। তুমি আমায় কখনো ছেড়ে যেও না। আমি তোমাকে ছাড়া থাকতে পারবো না।'
রোদেলা নরম গলায় বলল,
'আমি আছি। কোথাও যাচ্ছি না।আপনি একটু শান্ত হন।'
বেশ খানিকক্ষণ কেউ কথা বলল না। চারিদিক এখন নিরব, নিস্তব্ধ। নিরবতা টুকু কাটিয়ে সেহরিশ বলল,
'তুমি এখনও ঘুমাওনি যে?'
রোদেলা জবাব টুকু দিলো কেবল,
'ঘুম আসছিল না। এজন্য.'
রোদেলার কথাটুকু শেষ করতে দিলো না সেহরিশ।
'কি হয়েছে? কোনো কারণে তোমার মন খারাপ নয়তো?'
রোদেলা মাথা নাড়লো। 'আমার কিছু হয়নি। আপনি শুধু শুধু চিন্তা করছেন।'
'তোমাকে নিয়ে আমার কোনো চিন্তাই অযথা নয়।'
রোদেলা জবাব দিলো না। সেহরিশ রোদেলার দিকে তাকিয়ে ছিল এতক্ষণ উত্তরের আশায়। সেহরিশ দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বলল, 'এখন ঘুমিয়ে পড়ো। সকালে তোমাকে নিয়ে বের হবো।'
সেহরিশ ঘরের আলোটা নিভিয়ে দিলো। তারপর শান্ত চোখে রোদেলাকে পরখ করে। রোদেলা সেহরিশের বুকে মাথা রাখল। রোদেলার মনে হচ্ছে আজ রাত অনেক লম্বা, সময় একদম কাটছে না। ঘড়ির কাঁটা যেন এক জায়গায় থেমে গেছে। রাতটা একসময় ঘুম জড়িয়েই কেটে গেল। স্নান করে তৈরী হয়ে রোদেলা যখন ঘরে আসে তখনও সেহরিশ ঘুমাচ্ছে। বাইরে তখন সবে ভোর হচ্ছে। বিছানার দিকে এগোল রোদেলা। এই মুহূর্তে স্নিগ্ধ এবং সুন্দর লাগছে মানুষটাকে। সেহরিশ ঘুমাচ্ছে একেবারে ছেলেমানুষের মত, দুটো হাত বুকের কাছে নিয়ে এসে। রোদেলা সেহরিশকে ডেকে বলল, 'উঠুন, সুসি চা নিয়ে এসেছে।'
কথাটা কানে আসা মাত্র ধড়মড়িয়ে উঠে বসল সেহরিশ। জানালা দিয়ে বাহিরে দেখে জিজ্ঞেস করল, 'কটা বাজে?'
রোদেলা স্বাভাবিক গলায় বলল, 'সকাল তেমন হয়নি। কিন্তু আপনি তো বলেছিলেন আজ ছয়টা বাজার আগে তুলে দেওয়ার জন্য।'
সেহরিশ এক মূহুর্ত ভাবলো। এরপর দরজাটা খুলে টেরেসে এসে দাঁড়াল সে। বের হওয়ার সময় এখনও হয়নি।
•
তূর্ণর কোঁকড়া চুলগুলো এলোমেলোভাবে কপালে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। কয়েকটা চুল চোখের পাতায় খোঁচা দিচ্ছে, বিরক্তিতে ভ্রুকুটি করে, তূর্ণ চোখ খুলল। ও চুল পিছনে ফেলে বিছানা থেকে উঠে গেল। ভ্রুকুঞ্চিত করে জুবিয়াকে খুঁজে তারপর বাথরুমে ঢুকলো। একটু পর তোয়ালে পরে রুমে ঢুকতে নজরে পড়ে জুবিয়াকে। ঢিলেঢালা পোশাক পরে ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসে আছে ও। পিছন থেকে ভারী নিঃশ্বাস নিয়ে জিজ্ঞেস করল তূর্ণ,
'এতদিন কোথায় ছিলে?'
জুবিয়া তূর্ণর দিকে তাকাতেই হঠাৎ তূর্ণ পা পিছলে গিয়ে মেঝেতে পড়ে গেলো। তূর্ণ রূদ্ধ হয়ে বলল,
'মুখে কি দিয়েছ? ভূতের মতো লাগছে।'
জুবিয়া শান্ত গলায় বলল,
'কন্সিভ করার পর থেকে মুখটা কেমন ফুলে আছে। ক্লিনিকে গিয়েছিলেন ত্বকের যত্নের জন্য। ডক্টর, ত্বকে ব্যবহার করার জন্য এই কালো মাস্কটি দিয়েছিলেন। তুমি ঘুমাচ্ছিলে তাই মুখে দিয়েছি।'
তূর্ণ বলল,
'প্রেগন্যান্সির সময় তোমাকে এসব করার কুবুদ্ধি কে দিয়েছে?'
জুবিয়া মাথা নিচু করে রাখল। তূর্ণ বলল, 'জুবি, তোমাকে এই প্রসাধনী ব্যবহার করে সুন্দর দেখাতে হবে না। আমার চোখে তুমি সবসময় সুন্দর। কন্সিভ করার পর থেকে তুমি আমার চোখে আরও সুন্দর হয়ে উঠেছো। তাই তোমাকে এসব মাস্ক-টাস্ক ব্যবহার করতে হবে না।'
জুবিয়া হাসতে গিয়েও নিজেকে সামলে নিলো।
তূর্ণ জুবিয়ার পেটে হাত রেখে মৃদু গলায় বলল, 'নড়ছে?'
ডানে বামে মাথা নাড়ল জুবিয়া। তূর্ণর মুখ মুহূর্তের মধ্যে ফ্যাকাশে হয়ে গেল। ও একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বলল, 'বেবি, পাপা ওয়েটিং ফর ইউ।'
জুবিয়া হাসিহাসি মুখে রুমটার চারিদিকে তাকায়। বলল,
'শুধু কী তুমি একাই অপেক্ষা করছ? আমি করছি না? আমি তো সে প্রথম দিন থেকে ওর আসার অপেক্ষায় আছি। ও এলেই তো আমরা পরিপূর্ণ হবো। ওর হাসির ছলে পুরো বাড়িটা আলোয় ভরে উঠবে। ছোট্ট ছোট্ট পায়ে বাড়িতে দৌঁড়াবে। ছোট্ট ঠোঁটে খিলখিল শব্দ করে হাসবে।'
জুবিয়া পেটে হাত বুলিয়ে আনন্দের সাথে ভারী নিঃশ্বাস ফেলল।
বিছানায় থাকা ফোনটা হুট করে বেজে উঠল। তূর্ণ আর জুবিয়া এক সাথে সেদিকে তাকালো। তূর্ণ ফোনটা হাতে নিয়ে ভ্রুকুটি করল। সেহরিশ। তূর্ণ ভারী নিঃশ্বাস ফেলল। দু'একবার কাশি দিয়ে শুক্ল গলা পরিস্কার করে বলল, 'হ্যালো!'
সেহরিশ তখন এয়ারপোর্টে দাঁড়ানো। কিছুটা ধীরে বলল, 'আমি দেশে যাচ্ছি। সঙ্গে রোদ ও যাবে। সাদাফের ফোন বন্ধ। তাই তোকে কল করেছি।'
তূর্ণ জুবিয়ার ওপর থেকে দৃষ্টি সরালো। জানালার দিকে তাকিয়ে কৌতূহল কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো, 'হুট করে দেশে যাচ্ছিস। কেনো? কিছু কী হয়েছে?'
সেহরিশ ক্লান্ত স্বরে বলল,
'জানি না। কি হয়েছে? মা সকালে হঠাৎ কল করে। কান্নার জন্য কথা বলতে পারছিল না। তখন, ভাই ফোনটা নিয়ে বলল, যত দ্রুত সম্ভব দেশে ফিরে যেতে। কয়েকবার কারণ জিজ্ঞেস করার পরও, কিছু বলেনি।'
'আগে বললে তো আমরাও তোর সঙ্গে যেতে পারতাম।' বলল তূর্ণ।
সেহরিশ বলল, 'জুবিয়ার তোকে প্রয়োজন আর উমাইয়ার সঙ্গেও সাদ রয়েছে। ওদের এখানে রেখে তোদের যাওয়ার দরকার নেই।'
তূর্ণ ভরসা দিলো সেহরিশকে। বলল,
'দেশে গিয়ে পরিস্থিতি সম্পর্কে আমাদের জানাবি। সমস্যা বড়ো হলে বা যদি দেখিস আমাদের প্রয়োজন বলবি আমরা তাত্ক্ষণিক সেখানে পৌঁছে যাবো।'
সেহরিশ ভীষণ আশ্চর্য হয়েছে। দেশ থেকে হুট করে কল দিয়ে জরুরি তলব করছে। যথাযথ কারণও বলেনি। মা কান্না করছিল কেন? মাঝেমধ্যে তো বাবার সঙ্গেও কথা হয়। বাবা তো ঠিক আছে। অসুস্থ বলে মনে হয়নি। তাহলে কী হয়েছে? বাড়ির কারো কিছু হয়নি তো? সবাই ভালো আছে তো? নাকি ও যা ভাবছে সে-রকম কিছু না। কি ঘটেছে সেখানে। সবাই তার থেকে কারণটাকে লুকাচ্ছে কেনো? নাকি ও যা ভাবছে সে-রকম কিছু না। ঘটেছে অন্য কিছু? সেহরিশ ধুপধাপ পায়ে রোদেলার কাছে এসে দাঁড়াল। সেহরিশ ম্লান কণ্ঠে বলল,
'রোদ, চল। যাই!'
.
.
.
চলবে................................................................