কাছে আসার মৌসুম - পর্ব ০৩ - নুসরাত সুলতানা সেঁজুতি - ধারাবাহিক গল্প


তুশির ভয়-ডর পালটে গেছে মেজাজ খারাপে। যার পুরোটা বর্তাল প্রথম দেখা নব্য মুখের ওপর। দাঁত-মুখ খিঁচে সে চেয়ে রইল ইয়াসিরের দিকে। 
একটু পকেটে হাত দিয়েছে বলে সোজা জেলে ভরতে হবে? এটা কি মগের মুল্লুক নাকি! আইনের কোন সূত্রে এমন নিয়ম আছে শুনি! তুশি চোটপাট করতে গিয়েও থমকাল। আইনের সূত্র তো দূর,ওতো সূত্র বানানই পারে না। 
মেয়েটার তিরিক্ষ তবিয়তে বদল এলো জেলের সাইনবোর্ড দেখে। কাওরান বাজারের জ্যাম ঠেলে মতিঝিল আসতেই প্রায় রাত নেমে গেছে। সোডিয়ামের ম্যাড়মেড়ে আলো ছাড়া কোথাও কিচ্ছু নেই। তুশির ফরসা আদল আমের মতো চুপসে বসল অমনি। তাহলে জীবনে প্রথম জেলে ঢুকবে সে! হাজতে রাত কাটাবে! 
হায় হায়। বস্তিতে এতদিন বুক চিতিয়ে ঘুরেছে। সবাইকে বলে বেড়িয়েছে,৫০০ পকেট মেরেও ওকে কেউ কখনো ধরতে পারেনি। আর আজ কী হোলো? ৫০২ নম্বরটায় এইভাবে ধরা খেল তুশি? 
টিনটিন আর বাবলু তো সব দেখেছে। ওরা গিয়ে সবাইকে বলে দেবে না? তুশির এতদিনের অর্জিত সুনাম সব তো ধূলোয় মিশে গেল! 

তুশি অদৃশ্য হাতে কপাল চাপড়াল। কেন এসেছিল ইয়াসিরের পকেট হাতাতে? অতী লোভে তাতি নষ্টের ফল এখন ভোগ হতচ্ছাড়ি।  

তক্ষুনি কনস্টেবল ধমকালেন,
“ কী হলো? নামো!” 
মেয়েটা নড়ে ওঠে। সতর্ক চোখ আশেপাশে ঘোরাতেই দেখল ইয়াসির ঢুকছে থানায়। পেছনে শরিফ।
দুজন পুলিশ মিলে ধাক্কা দিতে দিতে নিচ্ছে আরেকজন কে। এও বোধ হয় আসামি। এটাও কী পকেট কাটতে গিয়ে ধরা পড়েছে? যখন পাশে বসেছিল,গা থেকে ভকভক করে মদের গন্ধ পাচ্ছিল তুশি। 
ও নামল জিপ থেকে। কনস্টেবল ওর দিকে ভ্রু কুঁচকে চেয়ে। জীবনে কত কী দেখলেন,কিন্তু এমন মহিলা পকেটমার বিরল। তাও আবার অল্পবয়সি! চেহারা সুরতও তো খারাপ না। মনের কথা বলেই ফেললেন ভদ্রলোক,
“ কার বুদ্ধিতে এই ধান্দায় নেমেছিলে? মেয়ে মানুষ! এর থেকে তো লোকের বাড়ি কাজ করে খেলেও পারো।” 

তুশির নাক ফুলল। ত্যাড়া জবাব দিলো,
“ কাজ কি ইয়র বাপ দেবে?” 

 গর্জে উঠলেন তিনি, 
“ অ্যাই, একদম বাপ তুলে কথা বলবি না।” 
“ তাহলে ইউও আমার ধান্দা নিয়ে টক করবেন না। হুহ!” 

তুশি মুখ বাঁকায়। হাঁটা ধরে তেজ দেখিয়ে। ওর হাতেও হ্যান্ডকাফ। ব্যাপারটায় কনস্টেবল আহাম্মক বনে গেলেন। কী মেয়ে রে বাবা! এ্যারেস্ট হয়েছে,তাও পুলিশের সাথে তেজ কমেনি! 

ইয়াসির সোজা গিয়ে নিজের রুমে ঢুকেছে।
তুশি থানায় এসে চারপাশ দেখল। সিনেমা ছাড়া সামনাসামনি প্রথম দেখছে এসব। ভয় পাবে না,অবাক হবে দ্বিধাদ্বন্দ্ব তাতে। 
প্রত্যেকটা লকাপের ভেতর কেউ না কেউ আছে। এখন কী ওকেও এদের সাথে থাকতে হবে? না না, তা কখনো হয়? 
তুশির একটা প্রেসটিজ আছে না! এগুলো নির্ঘাত নিম্নবিত্ত চোর-ছ্যাচড়। ও তো আর তা নয়! ও হলো সেলিব্রিটি। বস্তির একমাত্র জনপ্রিয় মুখ। ওর সাথে কী সবার তুলনা চলে?  

মেয়েটার ঘোর ভাঙল শরিফের ধমকে। সামনে এসেই বাজখাই গলায় বলল,
“ এ্যাই মেয়ে,আমার ওয়ালেট দাও। তুমিই নিয়েছিলে না?” 
কথাটা শরিফ আন্দাজে বলেছে । ইয়াসিরের পকেট কাটতে গেছিল যখন,নিশ্চয়ই ওরটাও নেবে ভেবে। 
কিন্তু তুশি অবাক চোখে চাইল। অবুঝের ভান করে বলল, 
“ আমি? ইয়র ওয়ালেট? নো নো। নিইনি তো।” 
 
“ একদম চালাকি করবে না। পুলিশের পকেটমারা? সার্চ করব? পেলে কিন্তু লেডি পুলিশ দিয়ে ডান্ডা দেয়াব পিঠে!” 

তুশি একটু ঘাবড়ে গেল। 
ঝামেলা বাড়ানো বিপদ, তাও আবার থানায় বসে। জলে বাস করে তো আর কুমিরের সাথে কুস্তি করা যায় না। 
থমথম করে বলল,
“ ঠিক আছে,ঠিক আছে। হাতটা ওপেন করে দিন। মানিব্যাগ পকেটে। আউট করে দিচ্ছি।” 
 ইংরেজির এই করূণ দশায় মুখ কোঁচকায় শরিফ। হাত খোলে না। গলা তুলে নেহাকে ডাকে। আদেশ দেয়,
“ এর পকেট থেকে আমার ওয়ালেটটা বের করুন তো, মিস নেহা। তারপর এটাকে লকাপে ভরে রাখুন।” 

তুশির চক্ষু চড়কগাছ। সে কী! কথা নেই,বার্তা নেই সোজা লকাপে? হাঁ করার আগেই, শরিফ চলে গেল কোথাও। ওর ঠায় দাঁড়ানো শরীরটা ঠেলেঠুলে একটা গারদে ভরে দিলেন নেহা। বাইরে থেকে তালা ঝোলাতেই তুশির ঘাম ছুটে গেল। 
ওকে কি সত্যিই এখানে আটকে রাখবে নাকি? খালেদ চাচা যে একবার বলেছিল,এসব পকেটমারাতে বেশি শাস্তি হয় না। ধরা পড়লে পাব্লিক দু চার ঘা দিয়ে ছেড়ে দেয়। আর পুলিশ ধরলে কয়েকটা ঘা বেশি দেয়,এই যা। কিন্তু ওকে যে তালা দিয়ে বন্দি করে ফেলল। আবার ফাঁসি দিয়ে দেবে না তো! 
তুশি হা-হুতাশ করে ভাবল,
“ ও দাদী, আর দেখা হবে না দাদী। আই নট সি ইউ দাদী। নাউ কী হবে দাদী?” 

রুহানকে আলাদা সেলে রাখা হয়েছে। ওটা ঠিক তুশির মুখোমুখি। অদ্ভুত ব্যাপার, জিপের ভেতর ছেলের যা চেতনা ছিল, এখন তাও নেই। ক বোতল গিলেছে কে জানে! কনস্টেবল ওকে জাগালেনও না। দূর্বলের মতো দেয়ালের সাথে পিঠ মিশিয়ে বসালেন। 
ইয়াসির চেয়ারে মাথা এলাতেই ফ্যানের সুইচ টিপল শরিফ। একটু রয়েসয়ে তাকাল ওর দিকে। তার হতভম্বভাব এখনো স্পষ্ট কাটেনি। ইয়াসির কতটা বুদ্ধি রাখে! কতটা সজাগ মস্তিষ্ক তার! 
মেয়েটা তো ওরও পকেট কেটেছিল। কই, ও তো কিচ্ছু টের পায়নি। তাহলে স্যার বুঝলেন কী করে? 
এজন্যেই কি বয়সে ছোটো হয়েও ইয়াসির এএসপির চেয়ারে বসে গেছে? আর শরিফ গত ক বছরে সামান্য প্রমোশনটাও পায়নি! ও দীর্ঘশ্বাস ফেলল। চাইল ফের ইয়াসিরের দিকে। ফোনে কিছু একটা করছে সে। 
চোখমুখ দেখে মনে হচ্ছে খুব গুরুত্বপূর্ণ কিছু। শরিফ আর ঘাটাতে চাইল না। ফিরবে ভাবল, এর মাঝেই ডাকল ইয়াসির। 
“ শরিফ!” 

সে শশব্যস্ত জবাব দেয়,
“ জি স্যার!” 
“ একটা এফ-আই-আর লিখো। রেইপ কেসের সাথে সাথে অন ডিউটি পুলিশ অফিসারের গায়ে হাত, অসভ্যতা। ডিউটিতে বাধা এগুলোও চার্জ করবে। ভিডিও করেছিলে না?” 

“ জি স্যার।” 
“ আমার ফোনে পাঠাও।” 
ঘাড় নাড়ল শরিফ। 
ক্লাবে ঢোকার আগে ইয়াসির বলেছিল, ভেতরে যা হবে সব ভিডিও করতে। ওসব দিয়ে কী হবে কে জানে! শরিফ মাথা ঝেড়ে বাইরে এলো,অমনি কানে পৌঁছাল 
তুশির ক্যানক্যানে স্বর। 
লোহার সেল ধরে ঝুলতে ঝুলতে চ্যাঁচাচ্ছে,
“ ও সার। গো মি পিলিজ। আমাকে আউট করে দিন। পিলিজ সার,ও সার।” 

শরিফ চ সূচক শব্দ করল। কিছু না বলে গিয়ে বসল চেয়ারে। কিন্তু এই ঘ্যানঘ্যানি বেশিক্ষণ সহ্য করা গেল না। তুশির চিৎকার থামার নাম নেই। একইরকম হাহুতাস,
“ সার, ছেড়ে দিন না। এমন কখনো হবে না সার। গো মি নাউ পিলিজ!” 

শরিফ বিড়বিড় করল,
“ আচ্ছা জ্বালা তো।” 
 ধমকে বলল,
“ অ্যাই মেয়ে,চুপ করো।” 

তুশি থমকায়। ঠোঁট উলটে চুপ করে। ঠিক দু সেকেন্ড? ফের চ্যাঁচায়,
“ ও লম্বা সার, পিলিজ সার গো মি। হাউসে গোয়িং করতে হবে। দাদী ওয়েটিং ফর মাই। ও সার শুনছেন?” 
মেয়েটার নজর ইয়াসিরের কক্ষের দিকে। স্যার স্যার বলে ডাকছেও ওকে। 
নেহা মোটা লাঠি হাতে তেড়ে এলেন। তপ্ত চোখে বললেন,
“ আবার চিল্লাচ্ছিস? স্যার চুপ করতে বলেছে না? বেশি ফাতরামি করলে কিন্তু এক বাড়িতে সিধে করে দেবো !” 

তুশি ঠোঁট কামড়ে চোখ গোছাল। উহ,থানায় বসে হম্বিতম্বি করা হচ্ছে। সাহস থাকলে বাইরে চল না! ডান্ডা মেরে কাকে কীভাবে ঠান্ডা করতে হয়,তুশি খুব ভালো করে জানে। 
তাকে থামতে দেখে নেহা হাসল। গর্বের চকচকে হাসি। জায়গায় ফিরতে এক পা বাড়াল, তুরন্ত জ্বিভ নাড়ল তুশি। ফের চ্যাঁচাল,
“ ও সার! ও সার! হোয়ার ইউ স্যার? কাম পিলিজ সার। ” 
ভদ্রমহিলা থতমত খেলেন।  
চাইলেন বিফল চোখে। আচ্ছা ঘাড়ত্যাড়া মেয়ে তো। নেহার পুলিশি মনটা খুব করে চাইল,তুশিকে পিটিয়ে চ্যাপ্টা বানিয়ে আসতে। কিন্তু ইয়াসির স্যার তো এমন কোনো কমান্ড দেয়নি এখনো। ওনার আসামি,উনিই বুঝবেন! 
হতাশ শ্বাস ফেলে চলে গেল বেচারি। 
শরিফও নাক-মুখ কোঁচকাল। বুঝল, ধমকে কাজ হবে না। ইয়াসির ধরে এনেছে বলে ,সেও কিছু বলতে পারছে না। 
কানের জান বাঁচাতে তুলো গুজল সে। এমনিতেও একটু পর এখানে সার্কাস শুরু হবে। রুস্তম কমিশনারকে নিয়ে এলেন বলে! এলে আসবে। ওর কী! ও তো ঠিক ইয়াসিরকে দেখিয়ে বলবে,
“ আমি কিছু জানি না।” 

তুশি অনেকক্ষণ ডাকল। চিল্লিয়ে গলা ফাটাল। কিন্তু ইয়াসিরের দেখা নেই। ওকে লকাপে আটকে এসি রুমে গিয়ে মরেছে। ফালতু! 
ভীষণ রাগ হলো তুশির। দাঁত চিবিয়ে বলল,
“ বদ পুলিশ!  
একবার ছাড়া পাই। তোর চৌদ্দ গোষ্ঠির পকেট যদি না কেটেছি আমিও দি সেলবিরিটি তুশি পকেটমার না। 
কিন্তু সেজন্যে তো আগে বাইরে যাওয়া চাই। উফ! না, এসটপ করলে হবে না। চিল্লাতে থাকি।” 

তুশি ফের মুখ খুলল। ডাকল জোরে জোরে,
“ ও লম্বা সার। পিলিজ ছেড়ে দিন না আমাকে।” 
তার চ্যাঁচানোর তোড়ে রুহানের নেশা ছুটে গেল। নড়েচড়ে উঠল এতক্ষণে। 
শরিফের তুলোতেও বিশেষ কাজ দিলো না। হার মেনে দুম করে চেয়ার ছাড়ল সে। ধুপধাপ গিয়ে দাঁড়াল ইয়াসিরের সামনে। মহাবিরক্তি নিয়ে বলল,
“ স্যার,মেয়েটা তো খুব চ্যাঁচামেচি করছে। কী করব?” 
ইয়াসির ফোনে ব্যস্ত ছিল। তাকাল চোখ তুলে, 
“ চ্যাঁচাচ্ছে, কেন?” 

“ জানি না স্যার। কী সব উল্টোপাল্টা ইংরেজি!
গো মি স্যার, হাউস গোয়িং স্যার। উহ, পুরো মাথা খেয়ে নিলো। প্লিজ স্যার, এর কিছু একটা বন্দোবস্ত করে দিন না! নাহলে এমন চ্যাঁচিয়ে তো কানের পোঁকা খেয়ে ফেলবে।” 

ইয়াসির বীতঃস্পৃহ। উঠে এলো তাও। চেনা দেহ দেখেই তুশির মুখটা ঝলমল করে উঠল। হড়বড়িয়ে বলল,
“ হট ইচ দিস সার? 
একটু পকেটই তো মেরেছি। মানুষ তো আর মারিনি। সিমপোল একটা কাজের জন্যে আমাকে জেলে কোলোজ করে রাখবেন?” 

ইয়াসির ওর দিকেই আসছিল। সহসা কথা বলল রুহান। টলটে টলতে দাঁড়িয়েছে সে। হুঙ্কার ছুড়ল আচমকা,
“ এই অফিসার! তোর বুকের এত পাটা যে আমাকে এ্যারেস্ট করিস? এত সাহস তোর! এর জন্যে তোকে যে কত দাম দিতে হবে তুই নিজেও জানিস না। এখনো সময় আছে,ভালোয় ভালোয় ছেড়ে দে আমায়।” 
অমনি থমকে দাঁড়াল ইয়াসির। তুশির দিকে বাড়ানো পা-টা ফেরত নিলো সবেগে। শরীর পুরো ঘুরিয়ে ফিরল ওর দিক। ভীষণ শান্ত থেকে শুধাল,
“ কী বললি?” 

রুহান ফুঁসছে। কটমটিয়ে বলল,
“ আমার বাবাকে তুই চিনিস না। তোদের কমিশনার সকালের রুটিটা গিয়ে আমার বাসায় গিলে আসে। বাবা যদি একবার জানতে পারে আমাকে এখানে আটকে রেখেছিস, তোর কপালে কোন শনি নাচছে তুই নিজেও আন্দাজ করতে পারবি না। নিজের ভালো চাস তো, ছাড় আমাকে।” 

তুশি গাল চুলকাল। রুহানের কথাবার্তা সে মন দিয়ে শুনছে। বিড়বিড় করল একা একা,
 “ এই মালটা আবার কে? কোত্থেকে টপকাল? কমিশনারের সাথে এত পিরিত! ও মাই গড! আমার তো কমিশনারও নেই। তার সাথে পিরিতও নেই। আমার কী হবে? হট ডু আই নাউ?” 

এতগুলো কথার পিঠে নিশ্চুপ ইয়াসির। সরু চোখে কয়েক পল দেখল রুহানকে। ঠিকঠাক সোজা হয়ে দাঁড়াতেও পারছে না। অথচ কথায় কী তেজ! 
 তারপর ঘাড় বাঁকাল অদূরের কনস্টেবলের দিকে। তুরন্ত চাবি হাতে ছুটে এলেন তিনি। 
 লকাপের তালা খুলতে দেখে হাসল রুহান। চোখেমুখে পৈশাচিক আলো নামল সহসা। গর্বে বুকখানা ফুলল দ্বিগুণ। এসব পুলিশ-টুলিশ তো আর নতুন দেখছে না। এদের দৌড় ওর জানা আছে। 
মুখোমুখি লকাপে থাকা তুশি হতাশ শ্বাস ফেলল সেসময়। শালার বদ পুলিশ!  
ক্ষমতা দেখে ছেলেটাকে ছেড়ে দিচ্ছে। ওর তো ক্ষমতার খ-ও নেই। তার মানে ওকে ছাড়বে না। 
হুহ! 
তুশি দাঁত চেপে গালি দিলো,
“ ভণ্ড পুলিশ,ছাগল পুলিশ, বালের পুলিশ।” 

শরিফ শিরদাঁড়া করে দাঁড়িয়েছিল এতক্ষণ। ইয়াসিরকে তালা খোলাতে দেখে,কপালে ভাঁজ বসল তার। রুহানের এক হুমকিতে স্যার ভয় পেয়ে গেলেন? নাহ,এতদিনে যতটুকু ওকে দেখেছে,তার সাথে ব্যাপারটা তো যাচ্ছে না! 
থানার বাকিদের কাজে মন নেই। সবার তটস্থ নজর এদিকেই আটকে। 
ইয়াসিরকে ভেতরে ঢুকতে দেখে রুহান ভ্রু গোছায়। চোখে ভাসা প্রশ্নের মাঝেই, ঠিক গালের মাঝে সপাটে এক চড় মারল সে। 
তুশির বক্ষঃস্থল ছ্যাৎ করে উঠল। নেতানো চোখমুখ ছলকাল বিস্ময়ে। 
শরিফ চোখ খিচে নিলেন। অবাক হননি,তবে ঘাবড়ে গেছেন। এত জোরে মারল,যে ঠাস শব্দটা এখান থেকেই পরিষ্কার শোনা গেছে। 

রুহান থ বনে গেল। এক চড়ে সে দেয়ালে সেটে গেছে। গালে হাত চেপে বুদ্ধিভ্রষ্টের ন্যায় ফিরে চাইল ছেলেটা। ইয়াসির দমল না। চিতার বেগে জামার কলার খাবলে ধরল ওর। টেনে এনেই,একের পর এক প্রহার করল তলপেটে। হাঁটুর শক্ত হাড়ের পোক্ত ঘায়ে রুহান নুইয়ে যায়। ব্যথায় ককিয়ে ওঠে। তার আর্তনাদে জমে গেল থানা। পিনপতন নীরবতায় ভারি হলো দেওয়াল। 
 হাত তুলে কপালের ঘাম মুছল শরিফ। বেচারার গলা শুকিয়ে যাচ্ছে। নেহার চোখেমুখে আতঙ্ক। 
বেশ কয়েকটা ঘায়ের পর থামল ইয়াসির। রুহানের তখন আধমরা দশা। মদ ছাড়া পেটে কিছু নেই। তারওপর এত মার! যন্ত্রণায় চামড়া সহ ফেটে যাওয়ার জোগাড়। 

ইয়াসির শক্ত হাতে গাল চেপে ধরতেই,আরেকদফা ব্যথায় মুচড়ে উঠল ছেলেটা। 
তার কথায় অদম্য সাহস। শব্দ-বাক্যে পিষে নিলো দন্তপাটি,
“ তোর বাপ এলে বলিস, তোকে শুধু ধরেই আনিনি, মেরেওছি। 
দেখব কী করে!
একজন কেন? তোর দশটা বাপ এলেও আমার কিচ্ছু ছিড়তে পারবে না।” 
উচ্ছিষ্টের মতো রুহানকে ঝাড়া মারল ইয়াসির। ছেলেটা দূর্বলের মতো খসে পড়ল মেঝেতে। 
এই সবটা ঠায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখে গেল তুশি। ঘাড়ে তার দরদর করছে ঘাম। ফরসা মুখ ফ্যাকাশে। মারবেল চোখে একবার ইয়াসিরকে দেখল,একবার রুহানকে। 
মনে মনে ভাবল,
“ কী পুলিশ মাইরি! এমপির সন জেনেও মারলো? এ তো তাহলে আমার মতো পকেটমারকে আঙুলে পিষে ফেলবে। ও দাদী,এবার আমার কী হবে?” 

এর মাঝেই রুস্তম ঢুকলেন। পেছনে তিনজন সাঙ্গপাঙ্গ। সাথে কমিশনারও আছে। তাদের দেখেই শরিফ তটস্থ হয়ে দাঁড়াল। নিষ্পাপ নিষ্পাপ ভান টানল মুখে। 
রুস্তম এসেই ছেলের দিকে চাইলেন। চড়ের তোড়ে আগেই নাক ফেটে রক্ত পড়ছিল,এখন নেতিয়ে গেছে পুরো। বাবাকে দেখেই নড়ে উঠল সে। 
কণ্ঠে উৎকণ্ঠা,
“ ড্যাড, তুমি এসেছ? দেখো কী অবস্থা করেছে আমার! আমাকে নিয়ে যাও এখান থেকে। আমি এখানে আর এক মুহুর্তও থাকতে পারছি না।।” 
ছেলের দশায় রুস্তমের ব্রক্ষ্মতালু অবধি জ্বলে উঠল।  
ক্রুদ্ধ হয়ে বললেন,
“ দ্যাখেন,এই পুলিশ আবার আমার পোলার গায়ে হাত উঠাইছে।” 

কমিশনারের জবাব ধীর।
“ আমি দেখছি, তুমি শান্ত হও। মাথা ঠান্ডা করো। ” 
তারপর ইয়াসিরের দিকে ফিরলেন তিনি । নরম স্বরটা পালটে গেল নিমিষেই। রেগে রেগে বললেন,
“ মিস্টার ইয়াসির, কী করতে চাইছেন আপনি? কতবার ফোন করেছি! ফোন বন্ধ করে রেখেছেন কেন?
আর আপনি জানেন আপনি কাকে তুলে এনেছেন?” 
ইয়াসির নিষ্প্রভ। ডিউটির খাতিরে সালাম ঠুকলেও, জবাব দিলো ফটাফট,
“ জি। রুহান আহমেদ নামক একজন রেপিস্টকে। যে মহিলা হোস্টেলের রাস্তা থেকে একটা বাইশ বছরের মেয়েকে তুলে নিয়ে গিয়েছিল। মেয়ে নিজে এসেছে কমপ্লেইন করতে, স্যার। আমিতো আমার ডিউটি করেছি,তাই না?” 

“ কথা সেটা নয়। কথা হলো,ও রুস্তমের একমাত্র ছেলে। এই এলাকার এমপি রুস্তম। আমার চাচাতো ভাই। আপনার আগে আমার সাথে আলোচনা করা উচিত ছিল না? এভাবে হুট করে গিয়েই ওকে তুলে এনেছেন।” 

ইয়াসির যেন আকাশ থেকে পড়ল। চোখেমুখে মেকি বিস্ময় নিয়ে বলল,
“ ঠিক বুঝলাম না। আপনার আত্মীয় বলে আলোচনা করে তারপর এ্যারেস্ট করতে হবে? কিন্তু স্যার,শপথ বাক্য পাঠের সময় তো এমন কিছু লেখা দেখিনি ওখানে।”  

মুখের ওপর মোক্ষম জবাবে কমিশনারের জ্বিভ রুদ্ধ হলো। কিছু 
থতমত খেলেন। একবার চারপাশের সবার দিকে চোখ বুলিয়ে বললেন,
“ দেখুন অফিসার, নিজেদের মধ্যে অহেতুক ঝামেলা করে লাভ নেই। রুহানকে ছেড়ে দিন।” 
“ কেন? এফ-আই-আর লেখা শেষ। সাক্ষি প্রমাণ সব যখন তৈরি, তাহলে ছেড়ে দেব কেন?” 

ভদ্রলোক এবার তুমিতে নেমে এলেন। গলার জোর কমিয়ে বললেন,
“ বোঝার চেষ্টা করো, ইয়াসির। শুধু শুধু কেন ঝামেলা করছো?” 
তারপর ওর কাছে এগিয়ে এলেন আরেকটু। কণ্ঠ চেপে বললেন,
“ রুস্তমের সাথে কিন্তু মন্ত্রী রূপকের সম্পর্ক ভালো। তোমার চাকরি নিয়ে টানাটানি পড়তে পারে। কী দরকার এসবের? এর থেকে এফ আই আর ছিড়ে ফেলো। সাক্ষিকে ওরা সামলে নেবে। তুমি ওকে ছেড়ে দাও। কোথাকার কোন মেয়ের জন্যে অন্যের শত্রু হবে কেন?” 

ইয়াসির থম মেরে গেল। যেন মাথায় ধরেছে কথাটা। তাকে নিম্নোষ্ঠ দাঁতে পিষতে দেখে বিজয়ী হাসলেন কমিশনার। এক পল মুখ চাওয়াচাওয়ি করলেন রুস্তমের সাথে। ভদ্রলোকের ওষ্ঠপুটে বাকা হাসি নেমেছে। মোল্লার ছোটাছুটি যে মসজিদ অবধি,সে কি আর জানেন না! একবার ছেলেটা ছাড়া পাক এখান থেকে। মিডিয়া তিনি ঠিক সামলে নেবেন। পাব্লিককে দেয়ার জন্যে ভুজুংভাজুং তার রগের সাথে মিশে। কিন্তু সত্যি হলো, এই পুলিশকে তিনি ছাড়বেন না। কত বড়ো কলিজা! তার ছেলের গায়ে হাত? 
ভদ্রলোকের ধ্যান ভাঙল ইয়াসিরের আওয়াজে। 
“ আপনার কথা আমি বুঝেছি,স্যার। কিন্তু মিডিয়া…” 
 
পথিমধ্যেই কথা টেনে নিলেন কমিশনার। 
“ আহহা, মিডিয়াকে নিয়ে তোমার ভাবতে হবে না। ওসব রুস্তম বুঝে নেবে। তাছাড়া আমরা যা জানাব,ওরা তো তাই জানবে। সাক্ষি তো মেয়ে। একটু ভয়-টয় দেখালেই মত ঘোরাবে। এখন তোমাকে যা বললাম তাই করো।” 
 ইয়াসিরের কণ্ঠে আক্ষেপ। বলল,
“ সরি স্যার, আপনি আরেকটু আগে এলে হতো। আমি ছেড়ে দিতাম। 
 কিন্তু এখন সম্ভব নয়।” 

সবাই তাজ্জব হলো।
 রুস্তমের কণ্ঠে উদ্বেগ,
“ সম্ভব নয়,কেন?” 

“ কারণ,ভিক্টিম আমাকে যা যা প্রমাণ দিয়ে গেছিল আমি সব মিডিয়ায় জমা করে দিয়েছি। স্বপ্ন টেলিভিশন সহ সমস্ত সাংবাদিকদের হোয়াটসঅ্যাপ নম্বরে চলে গেছে ওসব।” 
রুস্তমের মাথায় বাঁজ পড়ল। স্তম্ভিত শরিফ নিজেও। গোল চোখে ইয়াসিরকে দেখল সে। অস্পষ্ট আওড়াল,
“ স্যার এসব কখন করলেন?” 

কমিশনার হতবাক হয়ে বললেন,
“ এসব কী বলছো? তুমি,তুমি সব মিডিয়ায় দিয়ে দিয়েছ মানে?” 
“ হ্যাঁ। এই একটু আগেই করলাম। শরিফ বলল, ওকে জিপে তোলা নিয়ে খুব হইচই বেধেছে,ভিডিয়ো ক্লিপ পেলে হয়ত আরেকটু হবে। তাই আর কী! কিন্তু শরিফ,তুমি আমাকে বলোনি কেন যে ও এমপি রুস্তম আহমেদের ছেলে?” 
প্রশ্নের তির হঠাৎ তেড়ে আসায়,শরিফ থতমত খেল। ভ্যাবাচ্যাকার প্রকাণ্ড ছাপ বসল মুখে। ও তো বারবার বলেছিল। স্যার শোনেনি। তাহলে এখন মিথ্যে বলছেন কেন? 

শরিফ চটজলদি কিছু বলতে পারল না। 
“না মানে স্যার, আমি-তে” এসে লটকে রইল আওয়াজ। রুহান শিকের ওপাশ থেকে সজাগ চোখে চেয়ে। ইয়াসিরের কণ্ঠ ধীরুজ। ও ভালো করে শুনতে পাচ্ছে না। তারওপর চড়ের তোপে কানের কাছে ভোঁ ভোঁ করছে কিছু একটা। মদ আর মার মিশিয়ে সব ঝাপসা তার। 

ইয়াসির ভীষণ বিনয় নিয়ে বলল,
“ সরি স্যার! আমি জানতাম না এই রেপিস্ট ছেলেটা আপনার। ক্রিমিনাল তো,ভাবলাম দেশের মানুষের এমনিতেই পুলিশের ওপর ভরসা নেই। তাই দেখুক, এরকম অপরাধ করলে তার কী শাস্তি হয়! 
তবে আমার মনে হয়, এতক্ষণে ভিডিয়ো ক্লিপগুলো সবদিকে ছড়িয়ে পড়েছে। এই মুহুর্তে আপনার ছেলেকে ছাড়লে ওরই বিপদ। জনগণ ক্ষেপে গেলে কী হয়,জানেন তো তাই না? গনধোলাইয়ে মরার থেকে জেলে থাকা ভালো নয় কি?” 

রুস্তম দাঁত পিষে রইলেন। ক্ষুব্ধ চোখ ইয়াসিরে বন্দি। ছেলেটার গলার স্বরে প্রচুর বিনয়। কিন্তু চোখ? চোখের ভাষা ভিন্ন। এসব ভাষা রুস্তম বোঝেন। এ তো ভদ্রতা বা আপোষের ভাষা নয়। কী চাইছে এই ছেলে? স্বপ্ন টেলিভিশন তো সব সময় রুস্তমের পেছনে পড়ে থাকে। ওদের কাজই তার কাজের ফাঁকফোকর বের করে আনা। 
ইয়াসির তবে জেনে-বুঝেই এই খেলা খেলল? বাহ, এতটুকু বয়সে প্রহেলিকার সাথে লড়াই! 
রুস্তমের বুঝতে ভুল নেই,ইয়াসির মিথ্যে বলছে। ইচ্ছে করে ভিডিয়ো ক্লিপ মিডিয়ায় ছড়িয়েছে নিশ্চয়ই। 
কিন্তু এখন কী করবেন তিনি? 
এই খবর পুরো দেশে ছড়াবে। তুলকালাম শুরু হবে তারপর। জনগণ আওয়াজ তুললে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কেন, কেউ কিচ্ছু করতে পারবে না। ওনার চেয়ারটাও নড়বড়ে হবে তখন। 

তিনি কমিশনারের দিকে চাইলেন। ভদ্রলোক নিজেও চিন্তায়। ইয়াসির এমন একটা চাল চালবে,কেউ ভাবেনি। এখন তো হম্বিতম্বি করেও লাভ হবে না। 
নিরাশ মুখায়বে দুদিকে মাথা নাড়লেন তিনি। বোঝালেন,আপাতত উপায় নেই। 

রুস্তম চটে গেলেন। ক্ষোভ বর্তাল ইয়াসিরের প্রতি। পরিবেশ,পরিস্থিতি হেরে গেল মেজাজের কাছে। সবার সামনেই আঙুল তুলে বললেন , 
“ কামডা ভালো করলা না, অফিসার। এর মাশুল তোমারে কড়ায়-গণ্ডায় বুঝামু।” 

ইয়াসির হাসল। ঠান্ডা হাসি। 
শরিফের মনে হলো এতটা শীতলতা হয়ত হিমালয়েও নেই। 
 
ইয়াসির ঘাড় নেড়ে বলল, 
“ আগে ছেলের পাপের মাসুল গুণুন। আমারটা গোণার সময় আপনাকে নিশ্চয়ই ডাকা হবে। এনি ওয়ে, সব কথা শেষ? 
ইউ মে গো নাউ।” 
হাত লম্বা করে সদর দেখাল সে। রুস্তম ফোসফোস করতে করতে বেরিয়ে গেলেন। উদ্বেগী পায়ে পিছু নিলেন কমিশনার। বাবার প্রস্থান দেখে রুহানের আশার আলোটা দপ করে নিভে গেল। শিকের বাইরে হাত দিয়ে আহাজারি করে চ্যাঁচাল,
“ ড্যাড,ড্যাড আমাকে নিয়ে যাও। কোথায় যাচ্ছো? এই পুলিশটা আমাকে মেরে ফেলবে তো!” 

ইয়াসির দুই গাল ফুলিয়ে শ্বাস ফেলল। স্বস্তি চেহারায়। শরিফের দিকে চোখ পড়তেই, দেখল সে হাঁ করে চেয়ে। শুধু শরিফ একা? থানার প্রত্যেকটা মানুষের তাজ্জব দৃষ্টি তার ওপর আটকে। 
ছেলেটার অস্বস্তি হলো। জ্বিভে ঠোঁট চুবিয়ে বলল,
“ এভাবে দেখার কী আছে? গেট ব্যাক টু ইয়র ওয়ার্ক।” 
এক কথায় নড়েচড়ে উঠল সবাই। হতবুদ্ধি ভাব কাটাতে মাথা নেড়ে ফিরে গেল কাজে। 
শুধু শরিফ নড়েনি। ওর সব কিছু বিশ্বাস-অবিশ্বাসে ঝুলে আছে এখনো। 
ইয়াসিরের এই টুকু মাথায় এত বুদ্ধি?
এজন্যেই সব কিছু ভিডিয়ো করে রাখতে বলেছিল? যাতে ঝড় আসার আগেই শেষ খুঁটিটা মাটিতে পুঁতে ফেলতে পারে? 
এখন তো, এই খবর প্রত্যেকটা চ্যানেলের শিরোনাম হবে। নাহ,রুহান আহমেদের জামিন হওয়ারও কোনো সুযোগ নেই। 

আচমকা ইয়াসির পিছু ফিরে চাইল। দূরদর্শী চোখদুটো তড়াক করে এসে 
 বর্তাল তুশির পানে। ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকা মেয়েটার,কলিজা লাফিয়ে উঠল অমনি। হেলে থাকা শরীরটা তড়িৎ সোজা করে দাঁড়াল সে। 

ইয়াসির নির্দেশ দেয়,
“ একে বের করো।” 
কনস্টেবল ছুটে এলেন। 
তালা খুললেন ঝটপট করে। 
তুশির এখন বুক ধড়ফড় করছে। চোয়াল ঝুলে গেছে কয়েক হাত। ওকেও কি মারবে না কি? 
যদিও ও টুকটাক মারপিট জানে। কিন্তু, 
এমন দামড়া পুলিশের সাথে পারবে? শরীরে তো মাংসের দোকান। বাহুদুটো কী ফোলা ফোলা। 
ও বাবা না না! এমপির ছেলেকে যে চড় মেরেছে, অমন একটা ওকে মারলে তুশির চ্যাপ্টার এখানেই শেষ।  
মেয়েটা নীরবে মাথা নাড়ল কয়েকবার। মনে মনে বলল,
“ নো তুশি নো। এর সাথে কোনো চোটপাট করা যাবে না। জেন্ডার(জেন্টল) হয়ে থাক।” 

ও ভয়ে ভয়ে বাইরে এসে দাঁড়াল। 
চোখটা ঠিক এসে বিধল ইয়াসিরের ইউনিফর্মে। বুকের এক পাশে ছোটো নেমপ্লেটে লেখা,
“ ইয়াসির।” 
তুশি নামটা মনে মনে পড়ল। ভেঙে ভেঙে। ই, অন্তস্তিয়ায় আকার,স-য়ে ইকার, র। ইয়াসির। 
সে পুরুষ ওর পা থেকে মাথা অবধি দেখল ততক্ষণে। এক ভ্রু উঁচিয়ে বলল,
“ কী সমস্যা? থানার মধ্যে চ্যাঁচাচ্ছিলে কেন?” 
তুশি কী বলবে? হৃদপিণ্ডের লাফ-ঝাঁপে ওতো কিছু শুনতেই পাচ্ছে না। শিষ্টতার প্রয়াসে মাথা নোয়াল শুধু। জলদগম্ভীর প্রশ্নটা ছুটে এলো তখনই,
“ কী নাম?”

ও ঢোক গিলে বলল, 
“ তুশি।” 
“ পুরো নাম..” 
“ মেহরিন রহমান তুশি।” 
“ বয়স?” 
“ মনে হয় ঊনিশ। না না বিশ। না, একুশও হতে পারে।” 
ইয়াসির আশ্চর্য চোখে বলল,
“ নিজের বয়স জানো না, আর রাস্তায় পকেট কাটতে বেরিয়েছো?” 

তুশি মিইয়ে বলল,
“ ইয়ে মানে…” 

ইয়াসির নাক-চোখ কোঁচকায়। মুখায়বে স্পষ্ট বিরক্তি। 
“ দুনিয়ায় এত কাজ থাকতে লোকের পকেট মারো কেন?” 

কনস্টেবলকে যা রাগ দেখিয়েছিল,সেটা এবার আর দেখাল না মেয়েটা। ঐ সাহস ওর নেই। নিভু স্বরে বলল, 
“ আর হবে না, সার। দিস টাইম ফরগিব মাই!’’ 

“ মনে থাকবে?” 
পুরূ কণ্ঠের জবাবে জোরে জোরে মাথা নাড়ল তুশি। 
“ শরিফ,একটা সাইন নিয়ে ছেড়ে দাও। 
সই করতে পারবে?” 
শেষ প্রশ্নটা তুশিকে করেছে ইয়াসির। 

মেয়েটার খুব গায়ে লাগল এতে। পড়াশোনা নিয়ে কোনো খোঁচা সে নিতেই পারে না। 
থমথমে গলায় বলল,
“ য়েস,সার। আই ডুয়িং এসটাডি।” 
“ হ্যাঁ, সেটা তোমার ইংরেজির বহর দেখলেই বোঝা যায়।” 

তুশি ঠোঁট হাঁ করে ফেলল। মুখের ওপর অপমান, তাও আবার ওর ইংরেজি নিয়ে? নেহাৎ থানা বলে কিছু বলছে না।
“ সই নাও ওর।” 
শরিফ মাথা নেড়ে কাগজপত্র আনল। তুশি ওপরের কিছু পড়লোও না। কতটা কী বানান করতে পারবে তা পরের কথা। আসল হচ্ছে
পড়ে হবেটাই বা কী? ওর তো আর জমিজমা নেই,যে বাগিয়ে নেবে। 

সই করল চুপচাপ । সোজা হতেই তর্জন দিলো ইয়াসির,
“ এবারের মতো ছেড়ে দিচ্ছি। 
যদি ফের এসব করেছ,তখন কিন্তু 
সোজা কোর্টে চালান করে দেবো।” 

তুশি বাধ্য মেয়ে। এক কথায় ঘাড় কাত করল।
“ থাংকু সার। আমি যাই?”

ইয়াসির মুখে বলল না। তপ্ত চোখের ইশারায় যেতে বোঝাল। এতক্ষণে হাঁপ ছাড়ল মেয়েটা। চপল পায়ে চলে এলো বাইরে। যাবার আগে 
সাইনবোর্ডটা ঘুরে দেখল আরেকবার। ঠোঁট বেঁকিয়ে ভেঙচি কাটল অমনি। 
শার্টের কলার ঝাঁকিয়ে বিড়বিড় করল,
“ শালার পুলিশ,
আমাকে কোর্টে চালান করার ভয় দেখায়? ও জানে আমি কে? 
নেহাত দাদী একা থাকতে পারে না দেখে একটু মিনমিন করলাম। নাহলে ঠিক বুঝিয়ে দিতাম আমি কী জিনিস! 
তুশি খাওয়া ছাড়বে, কিন্তু চুরি ছাড়বে না।” 
.
.
.
চলবে.........................................................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

WhatsApp