প্রাণোদাহ - পর্ব ১১ - নবনীতা শেখ - ধারাবাহিক গল্প


তখন নক্ষত্র এডমিশন ক্যান্ডিডেট। বয়সে উনিশের তরুণ। স্বভাবে অন্তর্মুখী অথচ রগচটা, তবে ভীষণ শান্ত আর প্রচণ্ড বুদ্ধিদীপ্ত। একা থাকতে পছন্দ করে। এদিকে বাবা-মার থেকে “অসামাজিক” বলে গালিটা তার পছন্দ না। কাজেই প্রতিবছর ইদের ও শীতের ছুটিতে তার দাদার ভিটেতে ময়মনসিংহ যাওয়া লাগে। 

এবারের শীতে বাড়ি ফিরে দেখতে পেল ভিন্ন ঘটনা। প্রতিবারের তুলনায় ভীষণরকম অস্বাভাবিক সময় কাটতে লাগল তার। অন্যান্য সময় সে বাড়ি গেলে সব কাজিনদের আলোচনার মধ্যমণি হয়ে থাকে। আর এবার অন্য এক মেয়ে এসে ভাগ বসাল। মেয়েটার নাম অতসী। তার ফুপাতো বোন। জন্ম, বড়ো হওয়া, বেড়ে ওঠা সব ইউকেতে। ছুটিতে এসে বেড়িয়ে যায়। অথচ মুখোমুখি হওয়া হয়নি সেভাবে, খেয়াল করা হয়নি। বড়ো হওয়ার পর তো দেখাই হয়নি।

নক্ষত্রের হিংসের বহিঃপ্রকাশ শীতের শীতলতায় মিশে গেল। মুখোমুখি কয়েক দফা দেখা হওয়ার পরও অতসী বা নক্ষত্র, কেউই কারো সাথে কথা বলল না৷ তাদের মধ্যে চলতে লাগল নীরব যুদ্ধ। কেউ কাউকে সহ্য করতে পারছে না। নিজেদের অহংবোধে যেন বরফ মেশানো পানি পড়েছে, ভালোবাসায় বসেছে ভাগ। 

চতুর্থদিনের ঘটনা। ছাদের একপাশে বসে রুবিক্স কিউব মেলানোর সময় আচমকা তার পাশাপাশি এসে কেউ একজন দাঁড়াল। কিছুক্ষণ সময় নিল। তারপর বসে পড়ল। ওদিকে না তাকিয়েও নক্ষত্রের কপাল কুঁচকে এলো আস্তে-ধীরে।

অতসী বসে বসে ঠোঁট কামড়াচ্ছে। তাকিয়ে আছে ছাদের অমসৃণ মেঝেতে। নখ চুলকাচ্ছে। পরনে কালো শাল টাইপের কিছু। কাঁধ অবধি চুলগুলো ছেড়ে রাখা। ছোট, গোল ও ভীষণ ফরসা মুখটায় অসম্ভব কাঠিন্য।

নক্ষত্র মেয়ে মানুষদের লক্ষ করতে পছন্দ করে না, তাদের দিকে তাকাতে অপ্রস্তুত বোধ করে, কথা বলতে তো দুনিয়ার যত আলস্য আছে সবই যেন গায়ে চলে আসে। কাজেই সে তাকাল না। কিউবের দিকে চোখ ও হাতের গতিবিধিতে লক্ষ রেখে সে বলল,
-“কিছু বলতে চাও?”

অতসী এবার সোজা প্রসঙ্গে চলে এলো,
-“ইগনোর করছ কেন?”
-“ইগনোর করছি না।”
-“যাই করছ না কেন, লোকে নোটিস করছে। ডোন্ট ডু দ্যাট।”

অতসী থামল। জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে নক্ষত্রের দিকে তাকাল,
-“তুমি আমার কাছে ম্যাটার না করলেও, লোকের উইয়ার্ড কোয়েশ্চনগুলোর এন্সার করতে আমার নিজেকে কাইন্ড অভ স্টুপিড লাগে।”

কথাটা সম্পূর্ণ যুক্তিসঙ্গত। যা সব প্রশ্ন! সেসবের উত্তরটা স্বাভাবিকভাবে দেওয়া গেলেও, উত্তর দেওয়ার পর খুব একটা সময় স্বাভাবিক থাকা যায় না।
নক্ষত্র বলল,
-“আমাকে কেউ কিছু আস্ক করেনি।”
-“কজ দ্যে আর নট মাচ ফ্রি উইথ ইউ।”
-“তোমাকে কী বলা হয়েছে?”
-“শ্যুড আই টেল ইউ?”
-“আমাকে নিয়ে হলে বলা উচিত।”

অতসীর ঠোঁটের চামড়া ছিঁড়ে গেছে কামড়াতে কামড়াতে। বড়ো বাজে এই স্বভাবটা তার ছোট থেকেই৷ কোত্থেকে শিখেছে, কীভাবে শিখেছে তার জানা নেই। সে জিভ দিয়ে ঠোঁট ভেজাতে গিয়ে লবণাক্ত কিছু টের পেতেই চোখ-মুখ কুঁচকে গেল। ওভাবেই বলল,
-“রাইমা আর অর্থী আমাকে এ নিয়ে ফোর্থ টাইম আস্ক করেছে, আমি তোমার সাথে ঝগড়া করেছি কি না। আর অভি ময় নাকি কী যেন একটা ওয়ার্ড ইউজ করল..”
-“অভিমান।”
-“হ্যাঁ। মান। ওই অভি আর মান করেছি কি না। জিজ্ঞেস করলাম এর অর্থ কী।”
-“কী বলল?”
-“বলল, হোয়েন উই আর ক্লোজ টু সামওয়ান, তখন আমরা অনেককিছু এক্সপেক্ট করি তাদের থেকে, না পেলে বা পেতে লেইট হলে অযথা যে রাগটা হয়, ওটাকে নাকি মান বলে।”

নক্ষত্রের কিউব মিলে গেছে। সে পুরোটা উলটে পালটে দেখছে। অতশী একনাগাড়ে খুব বেশিক্ষণ বাংলা বলে যেতে পারে না। হাঁপিয়ে ওঠে। তাই থামে। দুটো বাক্য পর পর অর্ধেকটা মিনিটের জন্য থেমে নেয়। এরপর দম নিয়ে ফের বলা শুরু করল,
-“অভিমান? মিনিংলেস শব্দ! আমি ইংলিশে এরকম কোনো ওয়ার্ডই খুঁজে পাইনি।”
-“এটাকে এক ধরনের রাগ ভেবে নেওয়া যেতে পারে, যা কেবল নিজের মানুষদের সাথে করা যায়।”

অতসীর চোখ মুখ কুঁচকে আসে,
-“লুক নক্ষত্র, এই টাইপের রাগ করার জন্যও কিন্তু আমাদের মধ্যে একটা ওই টাইপের কিছু থাকা লাগবে। কী যেন বলে না? ওইযে..”
-“ভালোবাসা বা টান?”
-“এক্স্যাক্টলি। ওটাই। ওরকম কিছু নেই। তাই উই শ্যুড বি নরমাল।”
-“ওকে।”

অতসী হাঁপ ছাড়ল। আর কথা বলার প্রয়োজন নেই। অনেকক্ষণ কথা বলেছে। এখন হাঁপাচ্ছে রীতিমতো। চারচোখা ছেলেটা অল্পতেই বুঝে গেছে। সে স্বস্তি পেল। 
নক্ষত্র তখন জিজ্ঞেস করল,
-“এখানে কতদিন থাকবে?”
-“নট সো শিওর। মেবি সিক্স মান্থস। ওয়ান মান্থ অলরেডি চলে গেছে।”
-“ফুপিরা আসেননি?”
-“নাহ।”
-“এলোন জার্নি?”
-“হ্যাঁ। তুমি প্যানিকড হয়ো না। আর অনলি ফাইভ ডেইজ। তুমি তো ঢাকা ফিরে যাবে। আমিও আমার আন্টির বাড়ি চলে যাব।”

নক্ষত্র বড়ো স্বস্তি পেল। অতসী আর কিছু না বলে চলে গেল। এরপরের পাঁচটা দিন খুবই স্বাভাবিকভাবে কেটে যায়। দুইজন মুখোমুখি পড়ে গেলে কথা বলে। বাকিরা তাদের অকস্মাৎ পরিবর্তন বাঁকা নজরে দেখা শুরু করে। কী এক মুসিবত! আগে কথা বলত না, তখনও ঝামেলা। এখন বলে, এখন আরও বেশি ঝামেলা। 

নক্ষত্র অতসীর চোখ-মুখ কুঁচকে গাল ফুলিয়ে বলা এসব কথায় না হেসে পারে না,
-“যা ভাবার ভাবতে দাও। ওদের ভাবনাতে চললে কখনো স্বস্তিতে থাকতে পারব না।”
-“হুম। ওরা নটি মাগি।”

নক্ষত্র হাসি আটকানোর প্রয়াসে দাঁতে ঠোঁট চেপে নেয়, ইতস্তত করতে করতে বলে,
-“একচুয়ালি অতসী, তুমি কারো সামনে মুখ খুলো না।”
-“কেন?”
-“ওগুলো খুব কঠিনভাবে বাংলা গালি।”
-“কোনগুলো? নটি-মাগি?”

নক্ষত্র ওপর-নিচ মাথা নাড়ে। অতসী অবাক হয়,
-“যাহ! এসব স্ল্যাং কী করে হয়? সেদিন ছোটমণিকে বলতে শুনেছিলাম এই ওয়ার্ডদুটো। নটি অর্থ তো দুষ্ট, আই নো দ্যাট। আর মাগি যেটা! রাইমাকে জিজ্ঞেস করলাম। ও বলল, মাগি মানে মেয়ে। তো এখানে স্ল্যাং কই?”

নক্ষত্র অতিষ্ঠ হয়ে মাথা নাড়ে,
-“মেয়ে, আগে এগুলো বুলি ছিল। এখন গালি। বাজে চরিত্রের মেয়েদের এসব বলা হয়।”
-“ওহ ফাক! সরি সরি।”

অতসী দু-হাতে ঠোঁট চেপে নেয়। নক্ষত্রের হাত উঠে আসে কপালে। মেয়েটাকে নিয়ে কী করবে সে! মুখ খুললেই তো বোম ফাঁটে।
  
ধীরে ধীরে ওদের চলে যাওয়ার দিন এলো। দেখা গেল মন খারাপ করে অতসীও লাগেজ গুছিয়ে রেডি। মা বলেছে, ঢাকায় গিয়ে মামার বাসায় থাকতে৷ আন্টির সাথে কথা কাটাকাটি হয়েছে তার। মামাও নাকি তার বাসায় থাকার জন্য খুব করে বলেছে। মামার বাসা মানে নক্ষত্রের বাসা। আহ কী অশান্তি!

গাড়িতে ওঠার সময়ও অসহায় চোখে তাকায় অতসী। নক্ষত্র হেসে ফেলে। মেয়েটাকে তার আর বিরক্ত লাগে না। বয়সে তার চেয়ে এক বছরের ছোট, অথচ দেখতে বাচ্চা, আবার একটু লক্ষ করলে দেখা যায় মেয়েটার সবেতেই অনেক অনেক বেশি ম্যাচিউরিটি। নক্ষত্রের মজা লাগে। 
অতসীর অবাক হওয়া, শান্তমুখে রাগ করা, অবুঝ সেজে অজানা বাংলা গালি দেওয়া, বিরক্তিতে ঠোঁট কামড়ানো, হুটহাট একনাগাড়ে খুবই দ্রুতভাবে ইংরেজিতে কথা বলা, আর তারপরই থেমে গিয়ে বড়োবড়ো চোখে তাকিয়ে জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে সরি বলা—এ সব কিছু নক্ষত্র বেশ উপভোগ করে। 

পাঁচ ঘন্টার জার্নি শেষে মামা-মামী আর মামাতো ভাই স্মরণ ও নক্ষত্রের সাথে অতসী তার মামার বাসায় প্রবেশ করল। এখানে আসার পর প্রথম যেই পরিবর্তনটা নক্ষত্রের জীবনে দেখা গেল, তা হচ্ছে অতসীর জন্য তার রুম ছেড়ে দেওয়া। ভাগ জিনিসটা নক্ষত্র কখনো মানতে পারত না। অথচ এবার যে তার কী হলো! একটা কথাও নেতিবাচকতায় বলল না। নিজের জামা-কাপড় সহ যাবতীয় যা লাগে সব নিয়ে ভাইয়ের রুমে শিফট হয়ে গেল। 

অতসী প্রথম প্রথম ভেবেছিল, বড়ো অস্বস্তিতে পড়া লাগবে। অথচ এখানে আসার পর যেন সবকিছুতে স্বস্তি। মামা-মামি একদমই তার মা-বাবার মতো। স্মরণ তো সারাদিন বাসায়ই থাকে না। ইউনিভার্সিটি, টিউশনি নিয়ে ব্যস্ত। ফেরে রাত করে। আর নক্ষত্র? তাদের বন্ধুত্বটা হয়ে গেল অদ্ভুতভাবে, না জেনে, না বুঝে, কিছু না বলেই। 

দুইজন দুইজনকে খুব বুঝত। স্বভাবে, আচরণে প্রায় একই রকমেরই ছিল তারা। খুবই বুঝদার। সবচেয়ে অবাক করা বিষয় হলো, তাদের মধ্যে আলোচনা করার মতো অনেক অনেক বিষয় খুঁজে পাওয়া গেল। বই নিয়ে, জার্নাল নিয়ে, ঘোরাঘুরি নিয়ে। তারা একে-অপরের সবেতেই আগ্রহ পেতে লাগল। একে-অপরকে প্রশ্ন করতে লাগল কারণে, অকারণে, অসময়ে, অযথা। 

তারপর এলো দিন পরিবর্তনের সাঁঝ। দুই সপ্তাহ পরের এক সন্ধ্যা, বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকা আড্ডায় অতসী নামের মেয়েটার থেকে আচমকা একটা প্রস্তাব এলো, একদম সোজাসাপটা প্রস্তাব, 
-“ওয়ানা বি মাই বয়ফ্রেন্ড?”

বড়ো অস্বাভাবিকতার সাথে তৎক্ষনাৎ নক্ষত্র উত্তর দিলো,
-“ইয়েস, ইউ আর মাই টাইপ।”
.
.
.
চলবে................................................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন