নির্মোচন - পর্ব ২৭ - ফাবিয়াহ্ মমো - ধারাবাহিক গল্প


চোখ দুটো হিংস্র শ্বাপদের মতো জ্বলজ্বল করছে। ঠোঁটের আগায় জিহবার লেহন যথেষ্ট বিশ্রী ও কুৎসিত। কুটিল চাহনিতে কোমল দেহের প্রতিটি ভাঁজে ভাঁজে কেমন অমানবিক আকাঙ্ক্ষার তীব্রদৃষ্টি চালাচ্ছে কেউ জানে না। হাত বাড়িয়ে পাতলা নির্মেদ কোমরটা জড়িয়ে ধরে ঠিক ক্ষুধার্ত জানোয়ারের মতো গা শুঁকতে মন চাইছে, কিন্তু তা এখন সম্ভব নয়। শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত আরামদায়ক বাসের ভেতর বাল্যবন্ধু সরফরাজ দীপের বাড়িশুদ্ধো আত্মীয় যাত্রা করছে। উচ্চশব্দে প্রায় কান ফাটিয়ে দুটো সাউন্ড বক্স বাসের ভেতরে উল্লাসপূর্ণ বরযাত্রীর মনে আনন্দের হিল্লোল বইয়ে দিচ্ছে। গানের তালে তালে সুর মিলিয়ে, হাতে তালি ঠুকে ' এই যে বেয়াইন সাব ' গানে অঙ্গীভঙ্গি শুরু করেছে ক'জন বরযাত্রী সদস্য। উৎসবপূর্ণ আমেজ। এতোসবের মাঝেও গভীর ছাঁচের লালসাপূর্ণ চোখদুটো বাঁয়ে দৃষ্টি ঘুরিয়ে দু'সীট সামনের প্রাণোচ্ছল মেয়েটিকে আড়চোখে দেখছে। এশিয়ান মেয়েদের গায়ের চামড়ায় যেটুকু প্রবল আকর্ষণীয় ভাব লুক্কায়িত থাকে, তা যেন মার্কিন মুলুকে ফুটফুটে সাদা শেতাঙ্গিণীর দেহে তেমন খুঁজে পায় না। বড্ড অসহ্য লাগছে বাংলাদেশে এসে। অ্যালকোহলিক মন বারবার পিপাসার্ত হয়ে পরছে। কিন্তু দু'ঢোক গিলে তৃষ্ণা নিবারণের সুযোগটুকু এখানে নেই। পিঠটা সীটের সাথে হেলিয়ে দিতেই অফ হোয়াইট রঙের পান্ঞ্জাবীর হাতাটা কনুইয়ে একটু গুটিয়ে নিল। পাশ থেকে ভিডিয়ো ক্যামেরা অন করা হাসিব সকলের আনন্দঘন মূহুর্ত ধারণ করতেই মৃদু গলায় বলল, 

  - বাংলাদেশী ওয়েডিং বোরিং লাগছে ডাক্তারসাব? 

গলার দু'দিকে হাত বুলিয়ে সেই অল্প ব্যথার জায়গাটুকু নিশ্চিত করল তৌকির আহমেদ শিহাব। গলার ফর্সা চামড়ায় লাল থেকে খয়েরি বর্ণ হয়ে আছে ব্যথাতুর দাগটা। কালরাতে কোন জানোয়ারের বাচ্চা তার উপর অতর্কিত হামলা করল ধারণা নেই, তবে মন বলছে জানোয়ারটা বেশ শক্তিশালী এবং দৈহিকভাবে তার মতোই নিয়মিত শরীরচর্চা করা পুরুষ। নাহলে কয়েক সেকেন্ডের মাথায় মৃত্যুর দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে দেওয়াটা চাট্টিখানি কথা নয়। মাথাটা সীটের হেডসাইডে ঠেকিয়ে কিছুটা সামনে থাকা রমণীকে লোভাতুর নজরে খুঁটে খুঁটে দেখতে থাকে। দুপুরের একফালি সোনা রোদ্দুর পর্দার ফাঁক গলে খিলখিলে হাসির মুখটাতে ছেঁকে আছে। পড়ণে আইভরি গোল্ড রঙের লম্বা ঘেরওয়ালা গোল জামা। দুর্দান্ত মানিয়েছে! ঠিক যেন পাকিস্তানি অপ্সরী মেয়েদের মতো সুন্দর শালীন দেখাচ্ছে। সোনালি সুঁতোর বর্ণিলময় কারুকাজের সাথে ছোটো ছোটো নক্ষত্রের মতো জ্বলজ্বল করছে জামার সামনের অংশটা। ডানকাঁধ থেকে ঝুলিয়ে রেখেছে লম্বা ওড়না এবং কোমল হাতদুটো কবজি পর্যন্ত ঢাকা বলে অন্য মেয়েদের মতো চুড়ি পরেনি হাতে। মাথার ডানদিকে সিঁথি তুলে সমস্ত চুল বুকের বাঁপাশটায় এনে ছেড়ে রেখেছে। সীটের সামনে থেকে পিছে ঘুরে পেছনের সীটের মানুষদের সাথে ফুরফুরে আনন্দে মেতে আছে। ক্যামেরায় সেটা দৃষ্টিবন্দি করতেই হাসিব একটু বাঁকা হেসে বলল, 

  - এতোগুলো পরিবারের মধ্য থেকে দীপের খালাদের পরিবারটা খুবই স্মার্ট মনে হলো। কথাবার্তা, পোশাক-আশাক, চলাফেরা সবদিক দিয়ে এই খালাদের পরিবার বেশ অন্যরকম। তুই কি এসবের সাথে অ্যাডজাস্ট করে নিতে পারবি? 

শিহাব নিজেও ব্যাপারটা লক্ষ করেছে। বড়ো খালা বেশ কাঠখোট্টা গোছের মানুষ, সেনার বউ। আর ছোটো খালাটা নির্ভেজাল মনের, স্বামী ছোটো একটা গার্মেন্টস ফ্যাক্টরির কাটিং সেকশনের ম্যানেজার। কিন্তু তবু এদের মধ্যে পারিবারিক যে দৃষ্টিকোণ, সেটা দীপের অন্যান্য প্রভাবশালী আত্মীয়ের মতো নীচু, খারাপ, গল্পবাজ লাগল না। হ্যাঁ চলবে! শিহাবকে চুপ থাকতে দেখে হাসিব আবারও প্রশ্ন একটা ছুঁড়ে দিল, 

  - আজরাতে এক্সিকিউজ করবি ওটা? আজকের মতো ব্যস্ততা আর পাবি না শিহাব। আমি সবকিছু বন্দোবস্ত করে রেখেছি। ওদেরকেও বলেছি রেডি থাকার জন্য। কেউ কোনো সন্দেহ করবে না গ্যারান্টি দিচ্ছি। আর বিয়েবাড়ি থেকে ফিরে এসে সবাই একপ্রকার টায়ার্ড থাকবে, কি বলিস তুই? 

হাসিবের কথাগুলো মন দিয়ে শুনলেও তার মনটা পড়ে আছে দু'সীট সামনে। সূঁচালো সুন্দর নাকটার নীচে দুটো তুলতুলে লোভী ঠোঁট। সেদিক পানে চেয়ে নীচের ঠোঁটটা দাঁতে কামড়ে কি যেন ভাবতে ভাবতে বলল, 
  
  - হুঁ, সময়মতো আমাকে ফোন দিবি। আমি আসব। সবাই ঘুমাক আর না-ঘুমাক আজ গলাটা না ভেজালে চলছে না। আই অ্যাম ফ্যামিশ্ড। 

  - চিন্তা করিস না। যত লাগে তত পাবি। মাল খসালে মামা, বাঘের দুধও এখানে পাওয়া যায়। আর এটা এমন আহামরি কি জিনিস! আচ্ছা রেডি থাক। 

কেমন চতুর পরিকল্পনা এঁটেছে তিনবন্ধু সেটা ঘুণাক্ষরেও কেউ জানে না। তিনজনের অস্থির মন রাতটুকুর জন্য ব্যাকুলভাবে অপেক্ষা করছে। যেন রাতের আঁধারে নিজেদের খোলস ছেড়ে ধরা দিবে তারা। 

••••••••••••••

দুর্বার গতিতে চলতে থাকা বাস শেষ বিকেলের কমলা রোদ মাখিয়ে গন্তব্যে এসে পৌঁছল। ঘড়িতে তখন সাড়ে পাঁচটা। ময়মনসিংহ শহরের চমৎকার একটি কমিউনিটি সেন্টারের সামনে সবাইকে নামিয়ে দিয়ে বাসদুটো একটু দূরে খালিস্থানে পার্ক করা হয়েছে। মরিচা বাতির আলোকসজ্জা এবং রমরমা শৌখিন বিত্তশালী আয়োজন দেখে ম্লান হাসেন নিয়াজ উদ্দীন। এতোটা জাঁকজমকপূর্ণ আয়োজন করার সামর্থ বা সুযোগ তাঁর নেই। মেয়েদুটোকে নিয়ে বুকভরা স্বপ্ন তিনি দেখে যেতে পারবেন কিনা সন্দেহ। তাঁরও যে খুব ইচ্ছে করে মেয়েদুটোকে এভাবেই ধুমধাম করে বিয়ে দেবার! কিন্তু অর্থনৈতিক দিকটার কথা ভাবলে বুকের ভেতরে টনটন করে ব্যথা হয়। প্রচণ্ড দুঃখ লাগে। মনে হয় মেয়েদুটোর জন্য কিছুই তিনি করতে পারবেন না। চোখদুটো মাটির দিকে নামিয়ে সহজাত সরল ভঙ্গিতে হেঁটে চলেন নিয়াজ। পেছন থেকে আফসানার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা নাজনীন স্বামীর অসহায়ত্ব যেন হাড়ে হাড়ে টের পান। সংসারের পেছনে সর্বস্ব ঢেলে দেওয়া এই পুরুষটি আজও বিশ্রামের সুযোগ পায়নি। একাধারে শ্রম দিতে দিতে জীবনের দুই তৃতীয়াংশ বয়স শেষ। তবু যেন দায়িত্বের বোঝা কাঁধ থেকে নামলো না। স্বামীর মলিন মনটা অনুমান করেই নিজেদের আরো ছোটো ভাবতে শুরু করলেন নাজনীন। আজও বড়োবোনের পাশে নিজেকে বড়ো তুচ্ছ, বড়ো বেমানান বলে মনে হচ্ছে। চিকন চিকন দুটো সাধারণ চুড়ির দিকে দুঃখ ভরা চোখে চেয়ে থাকতেই ভাবলেন, এখানে সব মহিলার গায়ে ভুরি ভুরি অলংকার, আর তিনি কিনা সংসার চালানোর পেছনে সবটুকু ঢেলে দিয়ে প্রায় নিঃস্বই হয়ে আছেন। ফোনে কথা বলতে থাকা আফসানার চোখ এবারও ব্যাপারটা লক্ষ করতে পারল। অফিসের ম্যানেজারকে কল রাখতে বলে তিনি ছোটোবোনের দিকে প্রশ্নাতুর চোখে চাইলেন, 

  - নাজু, তোকে না বলেছি এদিককার বড়লোকি হাবসাব দেখে ঘাবড়াবি না? তাহলে তুই হাতের চুড়ির দিকে কি দেখছিস? আমার চুড়ি খুলে দিলে পড়বি? এখনো সময় আছে বল। এই ফাঁকে পরে নে। 

আফসানার অমন বলা দেখে হেসে ফেলেন নাজনীন। ফ্যাকাশে হাসিটা বুকের ভেতরে গোপন করে সরলহাস্যে বলে উঠেন, 

  - না বু, রাখো। ঘাবড়ানোর কিছু নাই। আল্লাহ যা দিয়েছেন তাতে শোকর গোজার করি। এই যে শান্তির নিঃশ্বাস নিতে পারছি, কোনো ঋণের কর্জ নাই মাথায়, এটাই তো অনেক। অনেক না বু? 

ছোটোবোনের মুখের দিকে তাকিয়ে ভেতরে ভেতরে সুখ অনুভব করেন আফসানা। আজও তার ছোটোবোনের সাংসারিক মনোবল দেখে আশ্চর্য হন, খুশি হন, গর্বের নিঃশ্বাসে মাথা নুয়ে আসে তাঁর। তিনি হ্যাঁ সূচকে মাথা দুলিয়ে আফসোসের ব্যাপারটুকু বুঝতে পেরে বলেন, 

  - মেয়েদুটোকে নিয়ে চিন্তা করিস না নাজু। তোর মেয়েরা যথেষ্ট মেধাবী, বুদ্ধিমান। আমরাও তো একসময় তিন তিনটা মেয়ে আব্বার কাঁধে বোঝাস্বরূপ ছিলাম। ছিলাম না রে? আমাদের কি ব্যবস্থা হয়নি কোনো? আব্বার জন্য সবকিছু আসান হয়ে যায়নি? সব হয়েছে। ওসব নিয়ে দুর্ভাবনা করতে যাবি না। ওদের পড়াশোনা যখন করাচ্ছিস, কষ্ট করে সেটাই করা। যখন যেটার সময় হবে, সেটা সুযোগমতো হবেই। চল, ভেতর যাই। হাতের চুড়ির দিকে না তাকিয়ে জীবনের দিকে তাকা। ওই চুড়ি তো কবরের নীচে যাবে না। যাবে? আয়। 

বড়োবুর কথায় নীরবে হেসে হাঁটা দেন নাজনীন মিলা। মাথার উপর ছাদটুকু ছাড়া ধন বলতে ঘরে কিছুই নেই, এ কথা কি কেউ বিশ্বাস করবে? স্বামীর স্বল্প বেতনের চাকুরিতে কি কি পন্থায় তিনি সংসার চালাচ্ছেন, কীভাবে একটু একটু করে চাহিদা চেপে মেয়েদের জন্য সর্বস্ব বিকিয়ে চলছেন, আর কীভাবেই একজন বীরাঙ্গণার মতো জীবনযুদ্ধে হাসিমুখে মাথা উঁচু করে হেঁটে চলছেন, তা কি প্রতিবেশির দল বা স্বজনরা কেউ জানবে? জানবে না। শহরে একখানা দোতলা বাড়ি, ভাড়া দিবে, মাস শেষে আয়েশী ভঙ্গিতে টাকা তুলবে, খরচ করবে— বাস্তবতা এতো সহজ নয়। পায়ের তলায় শত শত কাঁটা ফুটিয়ে রক্তাক্ত হয়ে হাসিমুখে এগিয়ে চলার নামই জীবন-যুদ্ধ। এই যুদ্ধে সেনাপতি সে নিজে, যোদ্ধা সে নিজে, অধিনায়কও একমাত্র সেই-ই! ফলাফল পাবে মৃত্যুর পর পরকালীন জীবনে। মানুষের কাছে নয়।

••••••••••••

একজন হিংস্র মানুষ বলেই এতোদিন নিজেকে জানতেন ডেরেক ফার্নান্দেজ। কিন্তু এ ধারণা ভুল প্রমাণিত হয়েছে আজ থেকে ক'বছর আগে। তিনি এখন মনেপ্রাণে বিশ্বাস করেন, তাঁর পেশাগত জীবনে এর চাইতে নির্মমতার পরিণতি সাড়ে তিন বছরেও তিনি দেখেননি। ব্যাপারটা মনে করলেই হাত-পা বরফের মতো ঠান্ডা হয়ে আসে। পাথর বনে যাওয়া মনটা ভয়ের কাতরে শিরশিরে অনুভূত হয়। তাঁর ডানপাশে থাকা ব্যক্তিটি দক্ষ চালে মহাসড়কের বুকে ড্রাইভ করে যাচ্ছে। স্থির চোখদুটো যেন জলজ্যান্ত নিষ্ঠুরতায় ধক ধক করে উঠছে, আর রুক্ষ হাতের গ্রিপ যেন শক্ত করে ধরেছে গোলাকার কালো স্টিয়ারিংটা। ডানহাতে তীব্রগতিতে স্টিয়ারিংটা ঘুরাতে ঘুরাতে ডানে গাড়িটা মোড় নিয়ে ফেলল একজন সুদক্ষ চালকের মতো। বহুক্ষণ যাবৎ নীরবতা শেষে আপাত কঠিন শঠতায় বলে উঠল সাঈদ, 

  - নিজের কাজ নিজে করতে শিখুন ডেরেক সাহেব। সবসময় আপনাকে উদ্ধারের জন্য আমি হাজির হব না। আজ যদি আমি গাজীপুর অন সাইটে অ্যাভেইঅ্যাবেল না থাকতাম, আপনার পরিণতি কেমন করুণ হতো, নিজেই সেটা ইতিমধ্যে বুঝে গেছেন। চাকরি বাঁচাতে যা ইচ্ছা করুন, কিন্তু মেইন ট্র‍্যাক থেকে দূরে সরে গেলে আমি তা একদম বরদাস্ত করব না।

বয়সের কাঠগড়ায় নিজে বেশ বড়ো হলেও পাশের এই পুরুষটিকে চরম ভক্তির নজরে দেখেন ডেরেক। আজও তিনি গলাটা নরম সুরে মাখো মাখো করে বিগলিত সুরে বললেন, 
 
  - ঈশ্বরের দোহাই, আপনাকে আর কখনো এরকম পরিস্থিতির ভেতর ফেলব না। কথা দিচ্ছি। আমি নিজেও ব্যাপারটার জন্য খুব লজ্জিত। রাত আড়াইটার সময় ডাক . . . প্লিজ পারডন মি ফর দিস টাইম। 

গলাটা চরম ক্রোধে ঝাঁঝিয়ে উঠতে চাইলেও নিজেকে বেশ কট্টরভাবে সামলে নেয় জুনায়েদ সাঈদ। কালো হাতঘড়িতে সময় দেখাচ্ছে সাতটার কাছাকাছি। আজ সারাটাদিন বাইরে কাটালেও ওই কোমল মুখটা দেখবার জন্য প্রচণ্ড ব্যাকুল হয়ে উঠছে। রুক্ষ আঙুলের মাঝে একবার শুধু নরম আঙুলের স্পর্শ পড়ুক, গতরাতের মতো মায়া ভরা চোখদুটো দিয়ে চুপ করে তাকিয়েই থাকুক, আর কিচ্ছু চাই না তার। ডেরেক ফার্নান্দেজ মাথা ঘুরিয়ে গাড়ির ব্যাকসীটটার নীচে থম মারা দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। গাড়ির ভেতরে জ্বলে উঠা হলুদ টিমটিমে আলোয় স্পষ্ট ওই নারী মুখ। মুখটি ভীষণ রকমের সুন্দর। হাত-পা শক্ত করে বেঁধে মুখটাও নির্দয়ের মতো গায়ের ওড়না দিয়ে বেঁধে রাখা হয়েছে। বেদনাদায়ক যন্ত্রণার প্রবল ছাপে ফুলে উঠা চোখদুটো থেমে থেমে ফেলছে অশ্রুকণা। আর সহ্য করতে না পেরে গোঙানির মতো অস্ফুটস্বরে কাতরাতে থাকে। দুর্বল, ভঙ্গুর শরীরে নড়াচড়াটুকু করতে না পেরে দরদর করে দু'চোখের পানি ছেড়ে দেয়। ডেরেককে আড়চোখে পেছনের দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে মেঘ গম্ভীর স্বরটা অবিচল কণ্ঠে বলল, 

  - বাকি মেয়েগুলো তু° লে আনুন যেভাবেই হোক!এসব ছোটোখাটো কাজের জন্য আমাকে কল করতে যাবেন না। সাবধান করে দিচ্ছি আপনাকে এবং আপনার পুরো টিমকে। মেয়েটাকে ধানমন্ডির ভেতর কোথায় রাখবেন ইমিডিয়েটলি সেটা ফাইনাল করে জানাবেন দ্রুত। এই মেয়েকে আমার চাই ডেরেক সাহেব। বায় হুক অর বায় ক্রুক— ইট শ্যুড বি ডান। 

ব্যাকসীট থেকে চোখ ঘুরিয়ে সতর্কভঙ্গিতে ' হ্যাঁ ' জানায় ডেরেক ফার্নান্দেজ। এ পর্যন্ত হিসাবের ছকে কতটা সংখ্যা পূরণ হলো সেটা মনে মনে যোগ করতেই ভারি ঠোঁটের কোণায় রহস্যময় হাসি ফুটে উঠল। ডানে তাকাতেই কর্পোরেট অফিসের দুর্ধর্ষ এইচ ও ডি'র দিকে তাকিয়ে দিকে ইঙ্গিতপূর্ণ চাহনি বুঝিয়ে বললেন, 

  - আর মাত্র ক'জন বাকি, হেড। শেষ। আবদুল সোহাইল গ্রুপের কোয়ালিটি ডিপার্টমেন্টে আপনার এইচ. ও. ডি. পজিশনটার সময়সীমা ফুরিয়ে আসছে। রিজাইন দেওয়ার আগেই আমাদের সব কাজ হয়ে যাবে। 

কানে পুরোটা কথা শ্রবণ করলেও দুম করে আদরের ব্ল্যাক মাম্বাটা নোয়াহ্ ব্রান্ডের গাড়ির কাছে থামিয়ে দিল সাঈদ। হাতঘড়িতে বিপ্ বিপ্ শব্দে অ্যাকুরেট রাত আটটার জানান দিচ্ছে। স্টিয়ারিং ধরা হাতদুটো তখনো সেভাবে স্থির রেখে চোখ-মুখ শক্ত করে বলল, 

  - আমার কি এখন ঢাকা বিভাগে কাজ শেষ?

  - জ্বী। আপনারটা অন্য বিভাগে পরেছে। খুব সম্ভবত একমাসের মধ্যেই সবগুলো কাজ শেষ হয়ে আসবে। তাই বেশি দেরি নেই। 

  - সময় কতদিন বললেন? 

  - অলমোস্ট একমাস। এর মধ্যেই সব শেষ হয়ে আসবে আই হোপ। অন্য বিভাগের কোন জেলায় পরেছে সেটা আমি গতকাল রাতে আপনার ডিভাইসে জানিয়ে দিয়েছি। চেক করবেন। 

  - বেশ। এবার যেতে পারেন ডেরেক সাহেব। মেয়েটাকে আপনার গাড়িতে তুলে হাইওয়ে রোড দিয়ে চলে যান। 

  - আসি। সেফ জার্নি। 

কুশলী কায়দায় সম্মতি বুঝিয়ে ডেরেককে বিদায় জানাল সাঈদ। রাস্তার এ পথে সুনশান একটু, বেশ জনমানবশূন্য ফসলি ক্ষেত। এই সুযোগে ব্যাকসীট থেকে ঝামেলার বোঝাটা কাঁধে তুলে নিজের গাড়িতে নিয়ে গেলেন ডেরেক। পুরো সাক্ষাৎ, আলাপ, সিদ্ধান্তের সময় চোয়াল শক্ত করে কথা বললেও এখন মনটা আর স্বাভাবিক নেই। ঝুরঝুরে বালির মতো তার রঙিন নরম প্রাসাদটায় কি ধস নেমে গেল? একমাস? স্রেফ একটা মাস? এই একমাস কি ঢাকার তল্পিতল্পা গুটাতে আর মায়ের কাছ থেকে দূরে যাওয়ার জন্য যথেষ্ট? মা জননী কি ঢাকার বাইরে যাওয়াটা মেনে নিতে পারবে? চাকরির এতোগুলো বছরেও মায়ের চোখ থেকে ওরকম দূরে থাকেনি সাঈদ। আফসানা কাদিরের গর্ভ থেকে প্রথম ও শেষ সন্তান যে সে নিজে, এরপর সেই গর্ভের জরায়ু টিউমারের গ্রাসে ফেলে দেওয়া হয়েছে, এরপরও কি কাপুরুষের মতো চাকরির টানে যেতে চাইবে? স্টিয়ারিং ধরা হাতদুটো আস্তে আস্তে ঢিলে হয়ে আসলে আজও অন্তর্মুখী মনটা বিড়বিড় করে উঠল,

  - যার প্রথম ও শেষ সন্তান শুধু আমি। আর কোনোদিন কোনো সন্তান যার কোল জুড়ে আসেনি আর আসবেও না এতোসব কিছু জেনেও অমানুষের মতো দায়িত্বে ফাঁকি দেব? জানা নেই। জানিও না। বারবার আমাকে এমন কঠিন চ্যালেঞ্জের ভেতর ফেলা হচ্ছে। রক্ষা করুন ইয়া কারীম! আই অ্যাম টোটালি ব্ল্যাক আউট!

•••••••••••••••••

ডানহাতে কপাল টিপতে টিপতে পরিচিত কাউকে খুঁজতে লাগল ফিহা। সাউন্ড বক্সের শব্দদূষণে মাথার ভেতর অসহ্য রকমের যন্ত্রণা হচ্ছে। খাবারের সেকশনে সবাই খাবার খেতে বসেছে, কিন্তু মাথাব্যথার যন্ত্রণায় মুখে কিছু তুলার মতো রুচি নেই। কপালের দু'পাশ থেকে রগ খিঁচে দুর্বহ একটা ব্যথা হচ্ছে। একদমই সহ্য করা যাচ্ছে উহঃ! আর সেখানে দাঁড়াতে না পেরে হনহনিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নেমে যায় ফিহা। শব্দের ধুকধুক কাঁপুনিতে মাথাটা যেন বড্ড বেশি বিষিয়ে উঠছে। চোখ মেলে কোনোরকমে তাকিয়ে দেখল, আরামে বসার মতো আহামরি তেমন জায়গা নেই। থাকলেও মানুষজন এখানে-ওখানে ছবি তোলায় ভারি ব্যস্ত। ব্যথায় কপাল কুঁচকে থাকলে হঠাৎ যেন ওর মনে পড়ল, একটু দূরেই তো খালি বাসদুটো থেমে আছে। ওখানে নিশ্চয়ই বিরক্ত করার কেউ থাকবে না। এমনকি সবাই আসতে আসতে আর বেরোতে বেরোতে যতক্ষণই লাগুক, ততক্ষণে তো একচোট পাতলা করে ঘুমও দিতে পারবে! ইশ, দূর্দান্ত একটা বুদ্ধি খেলেছে! এমন পাকা খেলুড়ে বুদ্ধিগুলো পরীক্ষার হলে কেন আসে না? মীরজাফরের মতো ছোট্ট মাথায় শুধু শুধু ফাজিলটা ঘাপটি মেরে থাকে। পা চালিয়ে সেন্টার এরিয়া থেকে বেরোতেই আর কিছুমাত্র পথ হাঁটা দিতে হবে। বিশাল বিশাল বাসদুটো রাখার জন্যও তো বিশাল বিশাল জায়গা রাখতে হবে, তাই আজগর জেঠু দূরের দিকেই বাসদুটো রেখে আসতে বলেছেন ড্রাইভারকে। নিরিবিলি মেঠো প্রশস্ত পথ, দু'পাশ থেকে ঝিঁঝিপোকার একটানা ডাক, নিঝুম রাত্রির অন্ধকার ঘনানো স্তব্ধতা আর ময়মনসিংহের বুকে শান্তি ছড়ানো বাতাস এসব শুষে নিতে নিতে বাসের কাছে পৌঁছল ও। 

যাক, বাসের ভেতরে ড্রাইভার মামাটা লাইট ধরিয়ে গেছে। একা একা, দুরন্ত, সাহসী কপট মেয়ের মতো বাসের ঠিক মধ্যখানের একটা সীট বেছে প্রায় ঘুমোনোর মতো বসে পড়ল ফিহা। এসির ঠান্ডা হাওয়ায় শরীর-মন জুড়িয়ে এসে মাথাটাও যেন স্বস্তি অনুভব করছে। ফোমের তুলতুলে নরম সীটে ফুরফুরে আরামে মন ঠান্ডা হলে দু'চোখ জুড়ে রাজ্যের ক্লান্তি এসে জুটলো। মিঠে মিঠে তন্দ্রায় তলিয়ে যেতেই সারাদিনের শূন্যতাটুকুর মাঝে কালরাতের ওই মুখ, ওই ঠান্ডা ঘন স্বর, ওই স্বরের নীচে ভারিক্কি চালের কথাগুলো, সবটুকুই বদ্ধ চোখের ক্যানভাসে ভেসে উঠল। অবচেতন মন যেন ছন্দে ছন্দে শুধিয়ে উঠে, 

“এ কেমন ভালোলাগা?
কাছে থাকলে বড্ড জ্বালায়, 
দূরে থাকলে যন্ত্রণা।

না পেলে কষ্ট বাড়ায়,
সামনে থাকলে অবহেলা!

এ কেমন কষ্ট বলুন?
মন বোঝেনা কিছুতে,
হাজার সময়, হাজার ভাবনা,
শান্তি পাই না মনেতে।” 

নিজের বোকা বোকা কথার বুনন দেখে আনমনে হেসে ফেলল ফিহা। চোখদুটো বন্ধ করে সীটের কোণায় জানালামুখো হয়ে গুটিশুটি মেরে রইল। ঠান্ডা নিস্তব্ধতার ভেতর হঠাৎ বাসটা মৃদু ঝাঁকুনির মতো কেঁপে উঠলে কিছুটা বিরক্তই হলো যেন। ঠান্ডা হাওয়ায় খুকখুক করে কাশতেই ঘুম জড়ানো কণ্ঠে ফিহা বলল, 

  - আহ্, বাসে আস্তে উঠুন ড্রাইভার মামা। ঘুমাচ্ছি। 

ড্রাইভার মামার কোনো সাড়াশব্দ-ই এলো না। কয়েক সেকেন্ড পুরোপুরি শান্ত থাকতেই হঠাৎ ক্যাচচ্ করে কিছু একটা আঁটকানোর শব্দ হলো। চকিতে ফিহার তন্দ্রাচ্ছন্ন মন সহসা ধক্ করে উঠল! বুকের ভেতরে কু ডাকা পাখিটা সেকেন্ডের মধ্যে হৃৎপিণ্ডের গতি বাড়িয়ে দিয়েছে! সটান মুখটা জানালার কাছ থেকে উঠাতেই দুম করে বাতিটা নিভে যায়। কেমন একটা দুর্বোধ্য ভয়ে সারা শরীর কাঁটা দিয়ে উঠেছে। " ইয়া আল্লাহ্ পাক " বলে দুরুদুরু করে কাঁপতে থাকা পাঁজরটা লম্বা নিঃশ্বাসের ভেতর হাতের তালু ঠান্ডা করে দিচ্ছে। বাসের সামনের দিকে ঘুটঘুটে অন্ধকারের জন্য কিচ্ছু দেখা যাচ্ছে না। তবু বুকে জমা ভয়টা সামাল দিয়ে গলা তুলল ফিহা, 
  
  - গাড়ির ভেতরে কে আছেন? কে আপনি? কথা বলছেন না কেন? 

এবার যেন চোখ সয়ে আসা অন্ধকারে কালোমূর্তিটা দেখতে পেল ও। নিশ্চল ভঙ্গিতে কুচকুচে মূর্তিটা ওকেই যেন দেখছে! ব্যাপারটা ভাবতেই গা ছমছম করে কেঁপে উঠল ফিহা। চিৎকার দেওয়া যাবে না ভুলেও! প্রচণ্ড ঠান্ডা মাথায় ব্যাপারটা এবার সামলাতেই হবে, যে করেই হোক! ধীরগতিতে সীট থেকে দাঁড়িয়ে পরতেই হঠাৎ ওই মূর্তি সামনে থেকে এগোতে শুরু করল। ভয়ে হাত-পায়ের শিরাগুলো খিঁচুনি দিয়ে আসছে, তবু শক্ত করে নিজের সাহসিকতায় যুঝতে লাগল ও। আরো একবার গলা উঁচিয়ে প্রায় চিৎকার করে বলল, 

  - কে আপনি? কথা বলছেন না কেন? কেন এদিকে এসেছেন? আপনি আর এক-কদম এগোলে এক্ষুণি আমি অঘটন একটা ঘটিয়ে দেব! 

যদিও শেষের কথাটা মুখ ফসকে এমনিতেই বেরিয়ে গেছে, তবু সেটা নিয়ে এখন ভাবনার বুদ্ধি খেলছে না। নিজেকে চূড়ান্তরূপে বাঁচানোর জন্যই সীট থেকে বেরিয়ে ধীরে ধীরে পেছনের দিকে পিছোতে থাকে ও। মাথা খাটাতে লাগল ওর কাছে কি এমন কিছু আছে কিনা যেটা দ্বারা আহত করা সম্ভব। দ্রুত মাথা খাটানোর পূর্বেই ওই কালো মূর্তি এতোটা নিকটে এসে পরল যে কিছু বুঝে উঠার আগেই হ্যাঁচকা টানে ডানকাঁধ থেকে ছিঁড়ে নিল ওড়নাটা! সেফটিপিনের খোঁচায় চোখ-মুখ কুঁকড়ে উঠলে চরম ধাক্কায় ওকে সীটের উপরে শুইয়ে ফেলল মূর্তিটা! অস্পষ্ট অন্ধকারে দেখতে পেল ওর ওড়নাটা ডানহাতে প্যাঁচাচ্ছে ওই জানোয়ার। হাত-পা ছুঁড়ে গলা ফাটিয়ে কিছু বলার আগেই পাশবিক হাতে ওর মুখটা চে পে ধরে জবানটা প্রায় বন্ধ করে দিতে চাইল! ফিহা নিঃশ্বাসের কষ্টে চোখ দিয়ে পানি ছেড়ে দিলে নখ দিয়ে ওই হাতের চামড়া যেন ছিঁড়ে আনতে চাইল। তবু পাষাণ ভার হাতটা মুখ ও নাক থেকে না সরলে সর্বশক্তি দিয়ে মু°ষ্টি কষালো মুখে! শক্ত ঘু°ষিটা বোধহয় নাকের আশেপাশে লাগতেই কঁকিয়ে উঠা যন্ত্রণায় কয়েক কদম পিছিয়ে পরে মূর্তিটা! এই সুযোগে সীট থেকে উঠতেই শেষ সম্বল হিসেবে পায়ের হিল জুতোটা হাতে তুললেও চুলের মুঠিটা যেন খামচে ধরে পা°ষ°ণ্ডটা। চিৎকার করে বারবার চ্যাঁচিয়ে যাচ্ছে, “কাপুরুষ! অন্ধকারে একটা মেয়ের উপর প°শু°র মতো আচরণ করতে এসেছিস! তুই .. আহ মা!” চুল খামচে ধরার ফলে আর কিছু বলতে পারল না ও। 
এসি বাস বলে জানালার পর্দাগুলোও দেওয়া। প্রবল জেদে চোয়ালজোড়া শক্ত করতেই ডানহাতে হিল জুতোটা তুলে নিয়ে এলোপাথাড়ি হিলের অংশটা দিয়ে আঘাত করল ফিহা। পরপর আঘাতে পা°ষ°ণ্ডটা কোনোভাবেই মুখ তুলে তাকানোর সুযোগ পাচ্ছিল না। অস্ফুট আর্তনাদে দু-একটা তীব্র শব্দ করতেই চুল খামচানো হাতটা প্রায় ঢিলে করে ফেলেছিল। ফিহা নিজেকে ছাড়িয়ে ওই জুতোটা ওদিকেই ঢিল মেরে দৌড়ে পালাল দরজার মুখে। ঝটপট হাতে দরজার লকটা খুলে ফেলতেই আবারও দানবের মতো পেছন থেকে খামচাতে চাইল জা°নো°য়া রটা! সিঁড়িতে সবে পা দিতেই জানোয়ারটার হিংস্র থাবার আঁচড়ে বাঁকানটা যেন ছিঁড়ে যাবার মতো পীড়া হলো ওর। গগনবিদারী আর্তনাদে বাঁকান ধরে দ্রুত বাস থেকে বেরিয়ে পরলেও ডানহাত দিয়ে দরজাটা সজোড়ে ধাক্কা মেরে আলতো বন্ধের মতো ঝটপট নামল। শরীর ঝিমঝিম করা ব্যথায় পা টলে যাচ্ছে। অকুস্থল থেকে একদৌঁড়ে রাস্তার দিকে ছুটে যেতেই হঠাৎ গগনবিদারী হর্ণের জ্বলজ্বলে দুটো হেডলাইটের কাছে থমকে যায় ফিহা! দ্রুতগতির ওই গাড়ির কাছে চোখ-মুখ খিঁচিয়ে দুইকান চেপে ' মা ' বলে তীব্র আর্তনাদটা করলে চারধার যেন কাঁপিয়ে তুলল! বাতাসে বাতাসে গমগম করে উঠল মেয়েলি ভীতস্বরটা, নীড়ের পাখিরা যেন প্রচণ্ড ভয়ে দূর আকাশে উড়াল দিয়েছে।

•••••••••••••••••

টায়ারের তীব্র ঘর্ষণের শব্দে প্রবল হুঙ্কার ছড়িয়ে চলন্ত ইন্ঞ্চিনটা থমকে যায়! চোখ ঝলসানো দুটো হেডলাইটের আলোয় ভীতিগ্রস্ত পাখির ডাকগুলো চারধারে মিলিয়ে যাচ্ছে। নিশাচরের মতো শান্ত স্তব্ধ পরিবেশে কতক্ষণ ওভাবে কান চেপে চোখ খিঁচে দমবন্ধ অবস্থায় ছিল, তা নিজেও জানে না ফিহা। বুকের ভেতরে অসহ্য কাঁপন, মাথার ভেতরে মাইগ্রেনের পীড়া, অটলভাবে দাঁড়িয়ে থাকলেও থরথর করে সারা শরীর কাঁপছে। ভয়ে, যন্ত্রণায়, তুমুল আতঙ্কে চোখ খুলে সামনে তাকালে কয়েক সেকেন্ড ওকে হেডলাইটের আলোর সাথে যুঝতে হলো। হাতদুটো চোখের সামনে আড়াল হিসেবে রাখতেই আঙুলের ফাঁকফোঁকর দিয়ে যেটুকু দৃশ্য দেখতে পেল, তাতে বুকের রক্ত যেন আরেকবার হিম হয়ে আসে! দু'হাতে স্টিয়ারিং ধরা তীব্র কাঠিন্য মুখটি চরম শান্ত চোখে ওর দিকেই চেয়ে আছে। চোখের পলকও যেন একটা মূহুর্ত্তের জন্য পরছে না। দৃঢ়, অবিচল ওই মুখটির সামনে এভাবে এই অবস্থায় পরবে এ যেন কল্পনাও করতে পারেনি। বুকের ভেতরে উত্থাল করা ঝড়টা ঠোঁট মুচড়ে চোখের জলের সাথে টপটপ পরতে শুরু করেছে। মুখ ফুটে কিছু বলার প্রয়োজন বুঝি তাঁর সামনে হলো না ফিহার। সারাদিন অসহ্য পরিশ্রমের ধকল শেষে এভাবে চোখের সামনে কোমল মুখটা দেখতে পাবে এখনো এটা বিশ্বাস করতে পারছে না সাঈদ। স্টিয়ারিং ধরা হাতদুটোর উপর প্রবল আক্রোশ ঢেলে চোয়াল আরো শক্ত হয়ে উঠল। যদি আকস্মিকভাবে ব্রেকটা না কষাতো? কি হতো? চোখের সামনে থেকে মৃদু মৃদু কাঁপতে থাকা হাতদুটো আস্তে আস্তে নীচে নামাতেই লালবর্ণের চোখদুটো দেখতে পায় সাঈদ। স্টিয়ারিং খামচানো আঙুলগুলো হালকা হয়ে তার বুকের ভেতরেও অসহ্য রকমের শূঁল বিঁধিয়ে দিচ্ছে। হাসিতে খিলখিল করা মুখ তার সামনে কান্না গিলে গিলে তাকিয়ে আছে। কেন এরকম অবস্থা? এই.. এই অসহ্যকর অবস্থাটা কেন সহ্য করতে পারছে না সে! রোবটের মতো স্থির চাহনি অটল রেখে 'টুট টুট' শব্দে গাড়িটা আনলক করল। শব্দটা শুনেই দু'চোখ ভরা অশ্রুটা অবাধে ছেড়ে দিয়ে কাঁপতে থাকা হাতটা ডানদিকে ইঙ্গিত করল ফিহা। বোঝাল, রাস্তার ওপাশে থাকা একটু দূরেই স্থির বাসদুটোর দিকে। মুখ দিয়ে কোনো শব্দ উচ্চারণ না করলেও দৈবগুণে কিছু অশুভ আঁচ, আসল ইঙ্গিত বুঝতে পেরে যায় সাঈদ। কোনো টু শব্দটি না করে সরাসরি রাস্তার ওপারে থাকা প্রথম বাসটার মধ্যে তল্লাশি চালায় সে। পুরো বাস খালি। কেউ নেই, ফকফকা শূন্য। মোবাইলের ফ্ল্যাশ লাইটের আলোয় বিন্দু বিন্দু রক্ত আর এক জায়গায় রক্তের আলতো ঘেঁষাটে খাওয়া অবস্থাটুকু ছাড়া তেমন কিছু আবিষ্কার করতে পারল না। যে-ই ছিল নিশ্চয়ই পালিয়েছে। সীটের নীচে এদিক-ওদিক ছিটকে থাকা জুতাজোড়া নিয়ে সে ফিহার সামনে এসে দাঁড়াল। বাঁহাতে জুতা ধরা, অন্যহাতে ফিহার ডান কবজিটা খাবলে পিছু পিছু ওকে গাড়িতে এনে বসিয়ে দেয়। জুতার হিলে থাকা রক্তের আলামতটা বাঁচিয়ে রাখার জন্য জুতাটা ওকে পরতে দিল না। প্লাস্টিক ব্যাগে ভরে সেটা গাড়ির পেছনে রেখে আসে। 

ড্রাইভিং সীটে ফিরে আসতেই হেডলাইটের আলো নিভিয়ে ভেতরকার আলোটা জ্বালিয়ে দেয় সাঈদ। আজ আর আপোস করে না ওর প্রতি। কোলের দিকে দৃষ্টি ফেলে রাখা রমণীর মুখটা দু'হাতে ধরে সরাসরি নিজের দিকে ঘুরিয়ে ফেলে। অশ্রুতে টলমল করা চোখদুটোতে কোমলভাবে তাকিয়ে কণ্ঠস্বর নীচু করে বলল, 

  - বাসে কে ছিল? 

ছলছল অশ্রুতে চুপ করে তাকিয়ে ফিহা মানুষটার কণ্ঠে, নরম স্বভাবে, ওরকম ঠান্ডা চোখের ঠান্ডা ভাবটুকুতে নির্ভার হয়ে যায়। একটু আগের ভীতিকর পরিস্থিতিটা সামলে নিয়ে শুকনো গলাতে বলে উঠে, 

  - চিনি না। অন্ধকারে মুখ দেখিনি। কোন কাপুরুষ বাসে উঠেছিল আর কেন আমার উপর..

মাঝপথে কথাটা ' শশশ ' শব্দ করে থামিয়ে দিল সাঈদ। আতঙ্কের কোন সীমায় পৌঁছালে আদরের এই মুখটা এভাবেও ঘেমে উঠতে পারে, তা দৃষ্টি এড়াল না তার। মুখের উপর লেপ্টে থাকা দু'একগাছি চুল একটা একটা করে সরিয়ে ওর প্রতি নরম হয়ে বলল, 

  - মানব দরদী সেবাটা বন্ধ করতে হবে নাবিলা। সবাই সবকিছুর জন্য যোগ্য নয়। আমি এখানে কাউন্টার করব না কেন তুই রাতের বেলায় সুনশান বাসের ওখানে গিয়েছিস। কিন্তু একা, এই নির্জন দিকটাতে কেন আসার প্রয়োজন পরল সেটাই জানতে চাইব। 

প্রশ্নটা ছুঁড়ে দিয়ে সামনের ড্যাশবোর্ড থেকে ডানহাত বাড়িয়ে চারকোণা টিস্যুবক্সটা ওর কোলের মধ্যে রাখল। খাবলে খাবলে একসঙ্গে চার-পাঁচটা টিস্যু নিয়ে মুখ মুছিয়ে দিলে ফিহা চোখ নীচু করে বলল,

  - আমি সাউন্ডবক্সের আওয়াজ বেশিক্ষণ সহ্য করতে পারিনি। এখানে এমন একটা শব্দহীন জায়গা নেই, যেখানে একটু শান্তিমতো বসতে পারব। গান বাজানো লোকগুলোকে বারবার রিকোয়েস্ট করলাম সাউন্ডটা কমিয়ে দিতে। ওরা শুনল না। নির্লজ্জের মতো কথাগুলো কানে-ই নিল না। ওদিকে সবাই খেতে বসে পরেছে। এদিকে আমি মাথা নিয়ে স্থির থাকতে পারছিলাম না। বাবাকে বলতাম, কিন্তু সে তখন মার পাশে খাচ্ছিল। চর্তুদিকের শব্দে তখন মনে হচ্ছিল মাথার ভেতরটা যেন ছিঁড়ে আসছে! তাই বাধ্য হয়ে বাসে এসেছিলাম। ভেবেছিলাম এখানে একটু বিশ্রাম নিব, শান্ত হয়ে বসব। তাছাড়া, আর কিছুক্ষণের মধ্যেই সবাই বাসে চলে আসবে। এসব ভেবেই আমি বাসে উঠি। 

ওর বুদ্ধি বা কর্মকাণ্ড দেখে কোনো প্রশ্ন তুলল না জুনায়েদ সাঈদ। বরং, তার রাগ হচ্ছিল লাবিব, ফাহাদ আর সুফিয়া খালার প্রতি। তাদের বারবার করে বলে যাওয়ার পরও যদি এমন একটা তামাশা ঘটে থাকে, তাহলে তাদের অবস্থা কোন পর্যায়ের জঘন্য করে ছাড়বে তারা বোধহয় নিজেরাও তা জানে না। খসখসে রুক্ষ পুরুষালী হাতে আবারও নীচু করে রাখা মুখটা তার দৃষ্টি সমুখে তুলে ধরে। অশ্রুতে ভেজা পাপড়িগুলো, চোখ ভর্তি করা ছলছলে জল, লাল টকটক করা নাকের ডগায় যেন তখনও ব্যথাতুর ছাপটা গেড়ে ছিল। কিন্তু কীসের ব্যথা? নাকের ওই লালচে ডগায় নরম আদর মাখিয়ে জিজ্ঞেস করতে মন চাইছে, 

  - আমি বুঝতে পারছি না কোথায় কি হয়েছে। কিন্তু অনুমান করতে পারছি, কিছু একটা ঠিক নেই। বেজ° ন্মা°টা কোথাও আঘাত করেছে? 

মনে মনে কথাগুলো আওড়ে গেলেও ফিহা তাঁর চুপটি দেখে একটুও ঘাবড়াল না। যে না-বলা ব্যথাটা মুখ বুজে শান্ত করে রেখেছে, সেটা বলে দিয়ে এই মানুষটার অস্থিরপ্রবণ মুখটা দেখতে চাইছে না। মন চাইছে না, এই মানুষটা সারাদিনের অমানুষিক ধকল শেষে ওর ব্যাপারটা নিয়ে মুখ ভার করে থাকুক। কালকের মতো মাদকে ভরা ঠান্ডা ঠান্ডা চোখদুটো দিয়ে অনিমেষ চোখে চেয়ে থাকুক। তার ভালোলাগা, মন্দলাগা নীরবেই বলুক, শুধু কালকের মতো হৃদয় ছোঁয়ানো দৃষ্টিতে থেমে যাক মন। কিন্তু সাঈদ ব্যগ্রভাবে ওর গালদুটো আরেকটু চেপে ধরলে তীক্ষ্ম আর্তনাদে কেঁপে উঠে ফিহা। চোখমুখ খিঁচিয়ে খপ করে ধরে ফেলে সাঈদের বাঁ'কবজি। না চাইতেও বুঝিয়ে ফেলে সমস্যাটা বাঁ'কানে। কানের কাছে আঙুলের স্পর্শ লেগে চিনচিনে ব্যথা শুরু হয়েছে। সাঈদ পলকের ভেতর দু'হাত নামিয়ে ওখানকার সমস্ত চুল পিঠের পেছনে সরিয়ে ফেলে। স্পষ্ট দেখতে পায় ঝুমকোটা রক্তাক্ত এবং কান থেকে রক্ত চুয়ে চুয়ে আইভরি গোল্ড রঙের জামাটা কাঁধের কাছে লাল হয়ে আছে। অদৃশ্য চোখে মনে মনে পণ করছিল, ওই অজ্ঞাত শ°য়°তানটার কান ছিঁড়ে এনে মুঠোর মধ্যে পুড়ে ফেলতে! টিস্যুবক্সের একগাদা টিস্যু নিয়ে মাঝের ক্ষুদ্র দূরত্বটুকু নিজেই ঘুচিয়ে মৃদু শঠতার সাথে বলল, 

  - নড়াচড়া করবি না। আমি এটা ঠিক করে দিচ্ছি। কয়েক মিনিট পুরোপুরি স্থির থাক্। সামান্য একটু পেইন হবে, ব্যস্।

সেই যে চোখদুটো খিঁচুনি দিয়ে বুজে ফেলেছে তা আর খুলেনি ফিহা। শুধু ষষ্ঠ ইন্দ্রীয় দ্বারা বুঝতে পারছে, কালরাতের চাইতেও বুঝি মানুষটার উপস্থিতি বড্ড সন্নিকটে। তর্জনী আঙুলের ডগা দিয়ে কানের কাছ থেকে সবটুকু চুল সে সরিয়ে দিচ্ছে। কানের ছিদ্রপথে ঝুলে থাকা ঝুমকা হালকা একটু নড়াচড়া করতেই প্রবল ব্যথায় ' উহঃ ' করে আঁতকে উঠল ফিহা। চোখদুটো আরো প্রবলভাবে কুঁকড়ে মৃদুস্বরে জানাল, 

  - ব্যথা পাচ্ছি, একটু আস্তে। 

বিড়বিড় করা স্বরটা দু'কানে শুনতে পেয়ে আরো সতর্ক হলো সাঈদ। এরপরই ঝুমকাটা টান দিয়ে খুলতেই তৎক্ষণাৎ টিস্যুটা কানের লতিতে চেপে ধরে। নিজেও বাঁ'হাতের উপর নখের তীক্ষ্ম ব্যথাটা শান্তমুখে হজম করছে। বুঝতে দেয়নি একচুল, ফিহা যে ভুলবশত শক্ত হাতটাকে খামচে ধরেছে। কিছুক্ষণ পর কানে চাপা টিস্যুটা ছেড়ে দিলে ততক্ষণে রক্ত কিছুটা বন্ধ হয়ে আসে। এতোক্ষণ দম আঁটকে রাখা ফিহা একটু সুস্থির হলে সীটের সাথে গা এলিয়ে দুর্বলস্বরে বলল, 

  - পানি খাব..

টিস্যুর ভেতরে রক্ত মাখা ঝুমকোটা মুড়িয়ে এসির পাওয়ারটা বাড়িয়ে দিল। একপলক নিজের বাঁহাতের উলটোপিঠে হাসি হাসি চোখে মেয়েলি নখের আঁচড়গুলো দেখতে পেল সাঈদ। আধ খাওয়া পানির বোতলটা ওর দিকে বাড়াতে গিয়েও অজানা এক কুণ্ঠায় তির্যকভাবে বলে উঠল, 

  - স্যরি, নট অ্যাভেইএব্যাল। অপেক্ষা করতে হবে। 

সঙ্গে সঙ্গে বোতলটা জায়গামতো রেখে দেয় সাঈদ। মাথাটা সীটের হেডরেস্টে রেখেই নিভু নিভু চোখে ডানে তাকায় ফিহা। মাথার ব্যথাটা বড্ড ধিক ধিক করে বাড়ছে, আর অন্যদিকে গলাটা শুকনো। দু'চোখে ও দেখতে পাচ্ছে ড্যাশবোর্ডের ওদিকে একটা পানির বোতল। একপলক সেই বোতলের দিকে দৃষ্টি বুলিয়ে এরপর চোখটা জাঁদরেল মুখের দিকে ফেলল, 

  - ওটা কি পানির বোতল না? 

  - ওটা দেওয়া যাবে না।

ভ্রুঁ কুঁচকে চকিতে প্রশ্ন ছুঁড়ল ফিহা, 

  - কেন দেওয়া যাবে না? 

শান্তমুখে কালো শার্টের স্লিভদুটো ফটাফট কনুইয়ে ভাঁজ করে ব্যস্তভাবে গাড়িটা স্টার্ট দিল সাঈদ। তবু ফিহার উত্তরটা সে এই ফাঁকে দিল না। পাশে বসা রমণীকে অবশ্যই এ কথা বলা যাবে না ওটা তার আধ খাওয়া পানির বোতল। বোতলের মুখে ঠোঁট লাগিয়ে খেয়েছে সে। সে চায় না ঘেন্না ঘেন্না একটা বিচ্ছিরি ভাব এই সুন্দর মূহুর্তটার ভেতর বাঁধা পড়ুক। বোতলটার আধ খাওয়া অবস্থা দেখে ফিহা নিগূঢ় ব্যাপারটা বুঝতে পারল যেন। কিন্তু ছোট্ট একটা বিষয় এভাবে চেপে যাওয়ার ব্যাপারটা দেখে ভীষণ অস্বস্তির ভেতর পড়ল। এটা তো সরাসরি মুখ ফুটে বললেই হয়! দোনোমনা করবার তো প্রয়োজন নেই। সে কি ভাবছে ফিহা তার পানির বোতলটা দেখে ঘিনঘিনে ভাব দেখাবে? ওই খয়েরি রঙা ঠোঁটদুটো কী দেখতে কুৎসিত যে ফিহা তার নরম স্পর্শটুকুতে ওরকম ঘিনঘিন করবে? 

••••••••••••

বিদায়ের পালা চুকাতে চুকাতে রাত তখন নয়টা। ভিডিয়োম্যানদের ক্যামেরার দাপটে সবটুকু মূহুর্ত ধারণ করা হচ্ছে। কণেপক্ষের কান্নাকাটি এবং বিদায় দেবার চিত্রটুকু দেখে চোখ সরালেন নিয়াজ উদ্দীন। আল্লাহ্ ভাগ্য করে তার কপালে দুটি কন্যা সন্তান ভিক্ষা দিয়েছেন, কিন্তু প্রকৃতির নিষ্ঠুর নিয়মের কাছে এই ভিক্ষাদুটো অন্যের কাছে একদিন তুলে দিতে হবে। যদি পাত্রদুটো তার কন্যাদের যথাযথ সম্মান না দেয়? যদি কোনোপ্রকার দুর্ব্যবহার করে তখন? টুকরো টুকরো হয়ে তার বাবাসুলভ মনটা মাথানত হয়ে যাবে। পান্ঞ্জাবীর পকেটে হাত ঢুকিয়ে ছোটো বাটন ফোনটা বের করে সময়ের ছকটা দেখে নিলেন। নয়টা তেরো। পাশ থেকে আজগর দেওয়ান অমন কমদামী ফোনের মডেল দেখে কেমন যেন একটু তুচ্ছ নজরে তাকালেন। শেষমেশ ব্যাপারটা হজম করতে না পেরে ক্ষুদ্র একটা খোঁচা হো হো হাসিতে দিয়ে বসলেন, 

  - ভাইসাব দেখি খানদানী মডেলের ফোন ব্যবহার করতাছেন। তা, ফোনটার দাম কত গো ভাইসাব? কথা কানে টানে শোনা যায় না? 

নিয়াজ উদ্দীন একমুখ লজ্জায় বড্ড বিব্রত হয়ে পড়েন। তবু ঠোঁটে স্বচ্ছ হাসি ফুটিয়ে সরল মনে বলেন, 

  - দাম বেশি না ভাই। কিন্তু তবু গরীবের দিনকাল শোক্করে শোক্করে চালানো যায়। আমি আবার স্মার্টফোন চালাতে পারি না। উলটাপালটা টিপ মেরে কই না কই কী হয়ে যায় . . . বাদ দিয়েছি। 

নিয়াজ উদ্দীনের কথায় হো হো করে হাসি দিয়ে ব্যাপারটাকে কৌতুকের পর্যায়ে নিয়ে যান তিনি। মনে মনে আজগর দেওয়ানের কথা ও ব্যবহারে বিব্রতবোধ করলেও নিয়াজ উদ্দীন তা সামাজিকতার খাতিরে প্রকাশ করতে পারলেন না। হাসি থামিয়ে আবারও আজগর দেওয়ান বলে উঠেন, 

  - তা কথাটা ঠিকই বলছেন ভাইসাব। বয়সের আগে যারা বুড়া হয় আর টাকার কাছে যারা পঙ্গু, তাদের জন্য এইসব বড়োলোকী মালসামান ঠিক না। কমদামী জিনিসই ভালো। কমদামী পাত্র, কমদামী সেট, কমদামী পোশাক . . . বুঝছেন না ব্যাপারটা? এই আমারেই আপনি দেখেন না ভাইসাব, গেল বছর ত্রিশ দিয়ে সেটটা কিনলাম। এখন শুনি সেটটা নাকি ভালো না, পুরানা। পরে আমার ড্রাইভার ব্যাটাকে দিয়ে দিছি। যাহ ব্যাটা, পুরান মাল দিয়ে ফূর্তি করগা। এর মধ্যে দীপের বিয়েতে নানারকম খরচ এসে পড়ল। পরে, এবার আপনার মতোই কমদামী সেট নিলাম . . . হে হে। দাম বেশি পরে নাই ভাইসাব, গরীব মানুষ বুঝেনই তো। আঁটত্রিশ দিয়ে আপাতত এটা কিনলাম, পরে আল্লাহ দিলে ভালো দেখে একটা নিব। 

যেখানে নিয়াজ উদ্দীনের হাতের ফোন মাত্র দুই হাজার তিনশো টাকার, সেখানে তাঁর সামনে একজন আঁটত্রিশ হাজারের ফোনকে মাত্র বলে বুক ফুলিয়ে যাচ্ছে। ক'বছর আগেও তাঁর হাতে বারো হাজার টাকায় কেনা চমৎকার একটি স্মার্টফোন ছিল, কিন্তু সেটা তিনি স্ত্রীর হাতে হাসিমুখে তুলে দিয়েছেন। বাসায় যে টিভি সেটটি ছিল, সেটার মাদারবোর্ড প্রায় অকেজো হয়ে গেছে। টিভি নষ্ট। শহরের বুকে টিভি ছাড়া মূহুর্ত কাটানো একপ্রকার বিষাদগ্রস্ত অবস্থা, তা বুঝতে পেরেই নিয়াজ উদ্দীন হাতের ফোনটা স্ত্রীর জন্য ওয়াইফাই সংযোগে ব্যবস্থা করে দেন। ফোন দেখে দেখে ফিমার মা নিজের সময় কাটান, সেলাই কাজ শেখেন, রান্নাবান্নার ভিডিয়ো দেখেন। নিয়াজ উদ্দীন মনে মনে সুখকর দৃশ্যগুলো স্মৃতিচারণ করতেই হঠাৎ সামনে বড়ো মেয়ে এসে হাজির হলো। কেমন একটা চোখ পাকানো দৃষ্টিতে সরাসরি আজগর দেওয়ানকে মুখ ভাঙা ক'টা জবাব ছুঁড়ে বলল, 

  - আপনার পেছনেই ছিলাম। এইজন্য কথাটা না বলে পারছি না। আপনার মুখটা পশ্চাদদেশের মতো এমন নোং°রা কেন? মুখ দিয়ে ভালো কথা বের করতে পারেন না? যত্তসব দুর্গন্ধযুক্ত কথা বের করা ছাড়া একটাও তো ভালো কাজ করতে দেখিনি। আমার বাবাকে আলগা ফতোয়া না দিয়ে নিজের মেয়েকে বলবেন আরেক সুপুরুষের দিকে চোখ না দিতে। তাছাড়া লজ্জা তো আপনার মেয়ের মধ্যে এমনিতেও নেই। লজ্জা লাগলে বলবেন, আমাদের বাসা থেকে এক কলসী আমদানী দিয়ে যাব। কোনো টাকা লাগবে না। 

একনিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে চরম অপমান করে ছাড়ল ফিমা। ও যে এক কাঠি বেশি অভদ্র সেটা ভালো করে বুঝিয়ে দিল ও। এইটুকু মেয়ের আস্পর্ধা দেখে আজগর দেওয়ান ভয়ানক ভাষায় কিছু বলতে যাবেন, তার আগেই পেছন থেকে ডাক পড়ল তার ও নিয়াজ উদ্দিনের। বাধ্য হয়ে সেমুখো যেতে হলেও গজরাতে থাকা চোখদুটো ফিমার দিকে নিক্ষেপ করে রইলেন আজগর। নিয়াজ উদ্দীন যদিও কখনো মেয়েদের গায়ে হাত তোলেননি, কিন্তু এরকম অশিষ্টতা দেখে চোখ গরম করে চরম কিছুই বলতে যাচ্ছিলেন, তবে বলার সুযোগ পেলেন না। ঘটনাক্রমে দু'হাত ময়লা ঝাড়ার মতো ঝাড়তে ঝাড়তে ঠোঁটে শয়তানি হাসি ফুটালো ফিমা। ছোটোবোন ফিহার স্টাইলে পটাপট কথাগুলো শুনিয়ে দিয়ে পৈশাচিক একটা আনন্দ হচ্ছে! বুড়ো ভিমরুল, আরো শোনাবি কথা? শোনা!

••••••••••••

মহাসড়কের ফাঁকা বুক দিয়ে সাঁই সাঁই গতিতে ছুটছে বাস। রাতের অন্ধকার মাখিয়ে গন্তব্যের পথে ছুটছে তারা। পৌঁছতে পৌঁছতে রাত দুটো বা তিনটে বেজে যেতে পারে, কারণ একটু আগে জ্যামে বসে ক'ঘণ্টা নষ্ট গিয়েছে। আকাশের বুকে ঝলসানো রুটির মতো গমরঙা গোল চাঁদ উঠেছে। চাঁদের মায়া ভরা আলোতে চারধার স্নান করে দুটো ডাগর আঁখির কোটরে দৃষ্টিবদ্ধ সেটা। যার বাঁ'কানের লতিটা ফুলে লাল হয়ে আছে, কাঁধের কাছে সেফটিপিনের আঁচড়, গলার ওড়নাটা দিয়ে মাথা-সহ সারা শরীর শীতের বাহানায় ঢেকে রেখেছে, ছোট্ট মনটার ভেতর ঘূর্ণিঝড়ের আসর। জানালার পর্দা একটু ফাঁক করে চলন্ত গাড়ির চলন্ত চাঁদের সাথে সাথে রূপকথার মতো অলীক রাজ্যে পাড়ি দিয়েছে ও। ভেতরে গুমরে গুমরে উঠছে কয়েক ঘণ্টা আগের বীভৎস স্মৃতি। যে বীভৎসতার কথা একজন ব্যক্তি ছাড়া এখনো পর্যন্ত কাউকে মুখ ফুটে বলেনি, হয়ত ওভাবে সহজস্বরে বলাও যাবে না। এরকম ঘটনার কথা অবশ্যই বাবা-মা বা নিকটাত্মীয় কাউকে জানানো উচিত, কিন্তু জানানোর মতো হিম্মত বা অতোখানি আস্পর্ধা কি একটা মেয়ের বুকে সবসময় থাকে? থাকলেও সেটা মূল্যায়ন হয়? গলা টিপে রাখার মতো জবান করে দেওয়া ছাড়া বড়োরা আর কী করতে পারে? এই ঘটনার কথা মাকে যদি সাহস করে বলতেও যায়, সেখানেও মা সরাসরি মুখের উপর তোপ দেখিয়ে বলবে, 

  - বাসের মধ্যে গেলি কেন? আর জায়গা পাসনি? মাথাব্যথা আমাদের হয় না? আর মানুষের হয় না? তোর বেলাতে এইসব নাটক কোথা থেকে আসে? 

চোখ বুজে হতোদ্যম নিঃশ্বাসটা ফিহা নীরবেই ছাড়ে। যার বিষ, তারই ব্যথা। এটা হয়ত নিজের মাও বুঝবে না। খাবার টেবিলে বসার আগে মাকে একবার বলেছিল, ' মা? মাথাব্যথায় টিকতে পারছি না আমি। চলো না আমরা বাড়ি যাই? সবাই থাকুক, তারা আস্তেধীরে আসুক '। এরপরের উত্তরটুকু মুখ ঝামটা দেওয়া আর নাকোচ করার মতোই ছিল। সবাই যার যার সুযোগ, জায়গা, পরিস্থিতি, অবস্থা, বিবেক, বুদ্ধি অনুযায়ী স্ব স্ব স্থানে ঠিক। বিড়বিড় করে উদাসী মনে চাঁদের পানে নজরুলের বিখ্যাত লাইনটুকু বলে উঠল ফিহা, 

“আমরা সবাই পাপী। 
আপন পাপের বাটখারা দিয়ে অন্যের পাপ মাপি।” 

চোখ বুজে ঠোঁট গোল করে ফোঁস করে দমটা ছাড়ল ফিহা। আগামীকাল বৌভাত অনুষ্ঠান যেমনি হোক, সে যাবে না, যুক্ত হবে না। কালদিন পর এখান থেকে আজন্মের জন্য চলে যাবে। শুধু কালকের দিন। আর মাত্র চব্বিশ ঘণ্টা। কোলের মধ্যে থাকা পার্স ব্যাগটা মৃদু মৃদু শব্দে কাঁপছে। দ্রুত চেইন খুলে ভেতর থেকে মোবাইল ফোনটা বের করে আনলো; স্ক্রিনে উঠে আছে ছোট্ট নাম—Unknown . চুপচাপ সেটা দেখতে দেখতে কলটা কেটে যাওয়ার আগমূহুর্তে সেটা রিসিভ করে ডানকানে চাপল। ক'সেকেন্ড দু'পাশ থেকেই অদ্ভুত নীরবতা বিরাজ করছে। কেউ যেন নিজের গুমোর ভেঙে আগ বাড়িয়ে কথা বলতে রাজি নয়। শেষমেশ একই কলে একইসাথে প্রচণ্ড উৎকণ্ঠায় দু'পাশ থেকে বলে উঠল, 

  — “বাসটা থামাতে বলি?।”  

একজন বাসের সীটে বোকা বোকা কথায় লজ্জারুণ মুখটা নীচু করে রেখেছে। অন্যজন তখন প্রিয় ব্ল্যাক মাম্বা ছুটিয়ে বাসের পিছু পিছু সুদক্ষ হাতে ড্রাইভ করে আসছে। দু'জনের ভেতর তফাত শুধু এটুকুই, তুমুল লজ্জার আবিরে লাল হয়ে আছে একজনের পানপাতা কোমল মুখ, আর ওই মুখটা মনের দর্পণে কল্পনা করছে চরম নিষ্ঠুর এই পুরুষ। 
.
.
.
চলবে.......................................................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

WhatsApp