বজ্রমেঘ - পর্ব ১০ - ফাবিয়াহ্ মমো - ধারাবাহিক গল্প


মুখ চাওয়াচাওয়ি করল রাফান ও পার্থ। মাথাটা এবার ভোঁ ভোঁ করছে। এই তথ্য কীভাবে জানে? কীভাবে খোঁজ করেছে এই খবর? জার্মানি থেকে বাংলাদেশের দূরত্ব চাট্টিখানি কথা নয়! তার উপর বিশাল দূরত্বের নেটওয়ার্ক থাকার প্রশ্নেই যে ওঠে না। তাহলে? তাহলে ঘটনার সূত্র আসলে কী? সেলিম হড়বড় করে কথাগুলো বলার পরও স্থির থাকেনি। তার দুচোখ বিস্ফোরিত ভঙ্গিতে একজোড়া চাহনির গহনে আঁটকে রয়েছে। সেই চাহনির ভাষা কেমন বর্ণনাতীত ভয়ংকর। যেন কিছুই ঘটেনি, কিছু হয়নি, তবু যেন স্বাভাবিক শান্ত। সেলিমের শঙ্কিত চোখের দিকে চোখ রেখে এক কদম এগিয়ে আসে শোয়েব। সম্পূর্ণ ঠাণ্ডা স্বরের উপস্থিতি ঘটিয়ে সেলিমের উদ্দেশ্যে বলল, 

  - এসব ভেবে বলছ সেলিম? আমি তোমার অনুমান করা ব্যক্তিটা নাও হতে পারি। না হবার চান্স, নাইন্টি নাইন পয়েন্ট নাইন নাইন পার্শেন্ট। আমার ঠিক মনে পড়ে না, আমি কবে জার্মানির ফ্রাংকফুর্টে আলোড়ন তুলেছি। ভেবে দেখো। 

তার বলার এই ধরণটা যেন অস্বাভাবিক রকম হিমশীতল। যেন প্রতিটি শব্দের আড়ালে বরফের চাক লুকোনো। সেই লুকোনো আতঙ্কে সংকুচিত হয়ে সেলিম খুব জড়গ্রস্ত হয়ে রইল। কপালের দুপাশে বিন্দু বিন্দু ঘাম এনার্জী বাল্বের আলোতে চিকচিক করে ফুটছে। দলের বাকিরা প্রশ্নাত্মক চোখে সেলিমের দিকে মুখিয়ে আছে। কিন্তু ঘটনার আদ্যোপান্ত যেন তারাও কিছু বুঝে উঠতে পারছে না। কেমন যেন অদ্ভুত বিচিত্র ঘটনার মতো ঠেকছে সব! কেমন ধোঁয়া ধোঁয়া কুয়াশায় ঘেরা কুহেলিকার মতো লাগছে। জিদান ভ্রুঁজোড়া কুঁচকে নিম্ন অধরে কামড় বসিয়ে ভাবে। চোখেমুখে প্রশ্নাতুর ছাপ মেখে জিজ্ঞাসু কণ্ঠে ডাকল,

  - স্যার, 

সম্বোধন শুনে চোখ ফেরায় শোয়েব ফারশাদ। চোখে তার রিমলেস চশমা, পাতলা দুটো কাঁচের আড়ালে নীল জ্বলজ্বলে চোখজোড়া, চোখের চাহনিও যেন তীরের মতো বিঁধানো। শোয়েব দুহাত বুকের ওপর ভাঁজ করে সায়টুকু দিল, 

  - জ্বী জিদান। 

একটু থেমে নিজেকে গুছিয়ে নিল জিদান আলমগীর। লোকটা ওদের চেয়ে বয়সে বড়। পদমর্যাদায় উচ্চ। বলার ধরণেও প্রচণ্ড সাবধান। যেন বলার আগে প্রতিটি শব্দ আলাদা করে ওজন করে নেয়। জিদান বেশ রয়েসয়ে প্রশ্নটা করে উঠে,  

  - আপনি কী কখনো উত্তরার দিকে গিয়েছেন স্যার? বা, ফরেস্ট ডিপার্টমেন্ট থেকে এমন কোনো সেমিনার, যেখানে আপনি চিফ গেস্ট হিসেবে প্রেজেন্ট ছিলেন? 

ব্যাপারটা ভাবার জন্য দু সেকেণ্ড ব্যয় করল শোয়েব ফারশাদ। চোখদুটো মেঝেতে রেখে তার নিখুঁত ঠোঁটজোড়ায় ভাবুক ভঙ্গিটা ফোটাল। সে ভাবছে। রোজা দেখতে পাচ্ছে, ওই চোখদুটো নীচু করার সঙ্গে সঙ্গে চোখের ঘন পল্লববিশিষ্ট পাপড়িগুলো দৃশ্যমান হয়েছে। সেখানে একপলক তাকালে বুকের বাঁপাশে মোচড় তোলার মতো ভয়ংকর লাগে! রোজা তৎক্ষণাৎ চোখ সরিয়ে নিজের চোরা অবস্থাটা গোপন করল। না, লোকটার চোখের দিকে তাকানো যাবে না। তাকালে ভীষণ বিপদ! এমন সময় জিদানের প্রশ্নে প্রত্যুত্তর করল শোয়েব, 

  - না। আমার সেরকম কিছু মনে পড়ে না। আমি ঢাকায় সেরকম যাইনি। এছাড়া জার্মানির ফ্রাংকফুর্টেও যাইনি। আমি দেশের বাইরে দু একবার গিয়েছি। কিন্তু সেটা জার্মানি নয়, স্টেটস ছিল। 

কপালে দারুণ ভাঁজ নিয়ে নাযীফ আশ্চর্য চোখে তাকাল। নিমিষের ভেতর ফট করে বলে উঠল, 

  - স্টেটস মানে? ইউনাইটেড স্টেটস? 

চ্যাঁচানো কণ্ঠটার দিকে চোখ ঘুরাল শোয়েব। একটা মুহুর্তের জন্যও আই কন্টাক্ট ব্যাপারটা ক্ষান্ত দেয়নি সে। উপর্যুপরি দৃঢ়তা যেন চোখের চাহনিতে স্থির রেখেছে। নাযীফের দিকে পেশাসুলভ স্থানটা বজায় রেখে বলল, 

  - জ্বী। সেরকম কিছুই। ইউনাইটেড স্টেটস। 

উত্তরটা দেবার পরপরই চারপাশ থেকে যেন তাপমাত্রা ছাড়তে শুরু করল। সেলিমের যেই কথাটা এক ঝটকায় আগ্নেয়গিরির অগ্নুৎপাত ঘটিয়েছিল, সেটা যেন নাইজেরিয়ার আইসবার্গে পরিণত হচ্ছে। রাফান সুক্ষ্ম জরিপে বুঝতে পারছে, তাদের স্যার খুব স্থির মাথায় সাথে সবকটা প্যাটার্ন ঘুরিয়ে এনেছে। সেলিমের দিক থেকে মূল দৃষ্টিটা নিজের কথার মাঝে ঘুরিয়ে এনেছে। হলঘরের জায়গাটা ব্যাপক বিশাল। ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা সাদা গদির সোফাগুলো অতিথি আপ্যয়নের চিহ্ন বহন করে। ওদের দিকে চোখের ইশারায় বসতে বলে নিজেও একটি সিঙ্গেল সোফায় বসে পড়ে শোয়েব। মুখোমুখি সোফার আসনে বসে পড়ল ওরা ছয়জন। রাফান আর পার্থ অবশ্য জায়গা পেয়েও বসল না। তারা দুজন বডিগার্ড ভঙ্গিতে সিঙ্গেল সোফাটার দুধারে দাঁড়িয়ে রইল। ঘড়িতে তখন সোয়া দশটা। গোটা এলাকার নিস্তব্ধতা যেন জানান দিচ্ছে, এ তল্লাটে কোনো জনপ্রাণী নেই। এতো নিঃশব্দ, যেন মাঝ রাত। গলা সামান্য খাঁকারি দিয়ে অখণ্ড নীরবতা ছেদন করল শোয়েব। ইঙ্গিতে সুক্ষ্মভাবে বুঝিয়ে দিল এবার তার মূলপর্বের তলব শুরু। পড়ণে তার কালো শার্ট, ঘরোয়া বেশধারী কালো ট্রাউজার, বাঁহাতের মুঠোতে সেলফোন। ছয় জোড়া চোখের চাপা উদ্বেগকে জেরায় ফেলল সে, 

  - উপরে যে ব্যক্তি শুশ্রূষা নিচ্ছে, তার অবস্থা আমার দৃষ্টি থেকে পজিটিভ নয়। পিঠের বাঁদিকে ছুরির চোট। ছয়টা সেলাই লাগার মতো অবস্থা ছিল। কিন্তু এ যাত্রায় সে বেঁচে গেছে। 

শোয়েবের এমন তথ্যে প্রত্যেকের মুখে অন্ধকার জমছে। কেউই মুখ তুলে সামনে তাকাতে পারছে না। মেঝের উপর দৃষ্টি নত রেখে সবাই কেমন ছটফট, দিশেহারা, অস্থির বোধ করছে। একটু বিরতি দিয়ে আবার ওদের প্রত্যেককে কড়া জবানে বলল সে, 

  - চারজন মিলে একজনকে উদ্ধার করো। কিন্তু পাঁচজন মিলে শেষজনকে চোখেই দেখো না! তাকে ছুরির কাছে ছেড়ে দাও। দূর্বৃত্তের সামনে ফেলে পালাও। এরপর রাফানের কাছে জানাও তোমরা চেষ্টা করেছ, বাট সফল হওনি। এরকম ভণ্ডামি কাজের প্রেরণা পাও কোত্থেকে! কীভাবে চিন্তা করো এসব? 

একেকটা কথা ছুরির মতো বিঁধিয়ে বিঁধিয়ে বলল। সেই ছুরির ফলাটা কোপ বসাচ্ছে ওদের মনে। সবচেয়ে বেশি কাঁচুমাচু মুখে বসে আছে রোজা হায়দার। ভয়ে নীল হয়ে আছে মুখ। হাতদুটো কোলের ওপর সমানে কচলে যাচ্ছে। পাশ থেকে সেটা লক্ষ করেছে শ্রেষ্ঠা। দুপাটি দাঁত কঠোর হয়ে যাচ্ছে ওর। কখন যেন ঠাস করে এক চড় বসিয়ে ছাড়ে! কিন্তু একজন মান্য ব্যক্তির সামনে আছে বলে কিছু করছে না ও। রোজা আড়চোখে সামনে থাকা ব্যক্তির অবস্থা বুঝতে চাইল। তাকাতে দেরি, ওমনেই বুঝতে পারল, লোকটা ওর দিকেই এখন তাকিয়ে আছে! মনে হচ্ছে যেন চোখ দিয়ে সব ধরে ফেলছে সে। কী ভয়াবহ! এভাবে রাক্ষসের মতো তাকিয়ে আছে কেন? কী সমস্যা? এমন সময় রোজার চিন্তাকে উষ্কে দিয়ে বলেই বসলো লোকটা, 

  - রোজা মনে হচ্ছে বাবার নাম্বারে একটা ডায়াল করতে চাচ্ছ। ফোন লাগবে? নেটওয়ার্ক-সহ প্রোভাইড করব? 

সাথে সাথে রোজা বরফের মতো জমে গেল! পিঠের শিরদাঁড়া বেয়ে যেন ঠাণ্ডা স্রোত নামল। এই লোক টেলিপ্যাথি সিস্টেমে সব পড়ছে নাকি? নাকি দৈবক্রমে ওর মনের অংশটা মুখস্ত পড়ে যাচ্ছে? রোজা নিজেকে স্থির বানিয়ে কঠোর মুখ করে বলল, 

  - কী বলছেন আপনি? আমি কিন্তু কিছু বুঝতে পারছি না। যা বলবেন না, পরিষ্কার করে বলুন। আমি ঘূরপ্যাঁচ কথা ধরতে পারি না। 

শোয়েব যেন চোখের চাহনিতে হাসলো। কিন্তু ঠোঁটের ভাঁজে কিছুই ফুটল না। কণ্ঠে দাম্ভিকতা নেই। তবু কেমন হিমশীতল অবস্থা। শোয়েব পালটা জবাবে পালটা প্রশ্ন ছুঁড়ে দিল, 

  - ভেতরে ভেতরে অতো ক্ষোভ জমাচ্ছ কেন? জমিয়ে আসলে লাভ কী? 

রোজা আরো একবার স্থির হয়ে যায়। মুখ হয়ে যায় হিম। চোখদুটো ফ্যাকাশে দেখাচ্ছে এখন। যেন দীর্ঘদিনের রোগ থেকে উঠে আসা রোগী। মুখের অবস্থা সাদাটে করে ঢোক গিলল রোজা, 

  - আপনি আসলে কী বলছেন কিছুই বুঝতে পারছি না! কীসের ক্ষোভ? আমি এখানে বাবাকেই বা ডাকব কেন?

  - ডাকার কথা বলিনি। ডায়ালের কথা বলেছি। অতো ঘাবড়ানোর মতো কিছু ঘটেনি। কাম ডাউন প্লিজ। 

এই লোক হাড়ে হাড়ে বুঝতে পারছে রোজা কেমন অস্থির। কেমন হাঁশফাঁশ করছে ও। সত্যিই ওর মাথায় এখন বাবার কথাই ঘুরছিল। কিন্তু বাবার ব্যাপারে মনস্তাত্ত্বিক কথাটা উনি কীভাবে জানল? এটা তো রোজা মুখে উচ্চারণ করেনি! এমনকি ফোন হাতে হাবভাবেও না! তাহলে ব্যাপারটা কেমন দাঁড়াল? ভাবতে গিয়ে ধন্দে পড়ল রোজা। তস্তত মুখে গলাটা শক্ত করে বলল, 

  - আপনি আমার সাথে এভাবে কথা বলছেন কেন? যা বলতে চান, সোজাসুজি বলুন না! আমি তো আপনার সঙ্গে ঘুরপথে কথা বলব না। যা বলার সরাসরিই বলব। 

  - আচ্ছা তাই?  

  - জ্বী। 

শোয়েব মনে মনে এমন উত্তরের প্রতীক্ষাতেই ছিল। মানানসই জবাবটা পেয়ে এবার ভূমিকা ছেড়ে বলল, 

  - রোজা, তোমার ভাষাতে সোজাসুজি বলি। তোমার বাবা বাংলাদেশের ‘প্রেসিডেন্ট’ হলেও ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের ব্যক্তি, অর্থাৎ আমি, শোয়েব ফারশাদ তাকে কিছুই ভাবব না। সেকেণ্ড টাইম কল কোরো না। আমার ফোনে আজেবাজে কল এলে সোজা ব্লক করব। 

এমন অদ্ভুত, উদ্ভট, অকল্পনীয় কথা শুনে সেলিম, জিদান, নাযীফরা প্রবল বিস্ময়ে হাঁ হয়ে গেল। চোয়াল ঝুলিয়ে ফেলল শ্রেষ্ঠা ও সোহানা। এ কী বলছেন উনি? কী বললেন মাত্র! তার মানে? তার মানে কী রোজা ওর বাবাকে জানিয়ে দিয়েছে? ওই ভদ্রলোক কী তাহলে জেনে গেছে? এখন কী ওদের বাড়িতেও খবর দিচ্ছে? সর্বনাশ! এটা কী হলো? 


বাইরে মুক্তা শুভ্র জোৎস্না। জোৎস্নার ধবল আলোকে স্নান করছে প্রকৃতি। রাতের গহন গভীর অন্ধকারে ঝিঁঝি ডাকছে বিরামহীন স্বরে। মন্দ লাগছে না। জানালার কপাটটা খোলাই রাখলেন ফাতিমা। জায়গাটা এতো নীরব, এতো নিঝুম, এমন নিঃশব্দ যে বুকে ভয় হয়। গা ছমছমে একটা অনুভূতি শিহরণ তোলে। কাজ সমাধা করে নিজ কক্ষে ফিরে এসেছেন তিনি। বিছানা টানটান করে নরম বালিশে মাথা রেখে গায়ে কাঁথা টানলেন। ভারি আরাম অনুভূত হচ্ছে। চোখজোড়া মুদে আজও অতীতে ফিরে গেলেন ফাতিমা। উনার কোলজুড়ে এসেছিল দুটো পুত্র। পুত্রদের হাত ধরে এল দুটো ফুটফুটে পুত্রবধূ। বধূদের সঙ্গে হাল মিলিয়ে কাটল একটা যুগ। এই যুগের মাঝে জায়গা করল নাতি-নাতনির ভীড়। বিধাতা যেন এ বংশে পুত্রের সংখ্যাই দিলেন বেশি। কন্যা দিলেন এক। সেই নাতিদের সংখ্যা দাঁড়াল চারের পর পাঁচজন। কিন্তু নাতনী হলো আদরের একখানা। সকালের মিঠে রোদ যখন জানালা ছুঁয়ে যেত, তিনি তখন শুনতে পেতেন কচি গলার সুর। তারপর একদিন কালরাত্রি নামল, সব হারিয়ে গেল কোথায় জানি। আর কোনোদিন ফিরে পেলেন না সেই সোনালি দিন। সেই রোদ রাঙা দুপুর, ছায়া-গহন বিকেল, জোৎস্না ধবল রাত্রি। চোখের কার্নিশ বেয়ে দর‍দর করে অশ্রু ঝরছে উনার। বালিশের ওপর ফোঁটায় ফোঁটায় পড়ছে বিন্দু। শীর্ণ হাতে চোখ ডলে মুছতেই বুকটা হুঁ হুঁ করে উঠে। আজও মনে পড়ে ছোট পুত্রকে, মনে পড়ে পুত্রের বধূকেও। সেদিন যদি তিনি বাড়িতেই থাকতেন? যদি একবার, শুধু একবার ভুল করে থেকে যেতেন? তবে কেমন হতো বতর্মান দিনগুলো? কেমন লিখনে সাজতো ভাগ্যলিপি? সেদিন পৃথিবীর বুক থেকে তিন তিনটে মানুষ চলে গেল, আর এক অবুঝ বাচ্চা হারাল পুরো পৃথিবীটাই। ঠক্ ঠক্ শব্দে তড়িৎ গতিতে চোখ মুছে তাকালেন বৃদ্ধা। চোখদুটো ফেরালেন ভেজানো দরজার দিকে। চোখে চশমাটা পরতে পরতে তিনি গলা স্বাভাবিক করে বললেন,

  - কে? কে বাইরে? 

দরজার ওপাশ থেকে জবাব এল, 

  - দাদী, রাফান। ভেতরে আসি? 


পুরো ব্যাপারটা হলঘরের বাইরে থেকে দেখেছে অধরা। তার পেছনে ক্রমান্বয়ে দাঁড়িয়ে ছিল মিথিলা ও তাহিয়াও। সমস্ত ঘটনা জানার পর ওদের ভেতরে প্রচণ্ড উদ্বেগ কাজ করছে। বিশেষ করে উদ্ভট লাগছে কিছু ব্যাপারও। সেগুফতা নিজ ঘরে ক্লান্তির কারণে ঘুমিয়ে পরলে বাকিরা তখন মিথিলার ঘরে বসা। তিনজনই বিছানায় বসে নানাভাবে নান কিছু ভাবছে। মিথিলা বিছানার হেডসাইডের সাথে পিঠ হেলিয়ে চিন্তিত স্বরে বলল, 

  - এখানে আজ না এলে অনেক কিছুই জানতাম না। যদ্দুর বুঝতে পেরেছি, শোয়েব ভাই এখানেও শান্তিতে নেই। এই জায়গাটা একদম ভালো না। প্রথমত বন্য পরিবেশ, দ্বিতীয়ত মানুষ সুবিধা না। 

মিথিলার যুক্তিতে সমর্থন জানিয়ে সায় জানাল তাহিয়া। কোলের উপর বালিশ রেখে সে নিজেও কিছুটা বিভ্রান্তির স্বরে বলল, 

  - আমারও সেরকম কিছু মনে হচ্ছে। কিন্তু বারবার এটা মনে হচ্ছে, এই জায়গাটা শোয়েব ভাই বিনা কারণে পছন্দ করেনি। ঢাকা থাকতে, সিলেট থাকতে, এই অজ জায়গায় উনার কী? 

কথাটা পছন্দ হলো না অধরার। সে কিছুটা বুদ্ধি খাটিয়ে উর্পযুক্ত সত্যটা গুছিয়ে বলল, 

  - এই জায়গা নিয়ে এখনি কিছু মন্তব্য করা ঠিক না। আমার মনে কিছু একটা সন্দেহ আছে। সন্দেহটা পরিষ্কার না হওয়া অবধি কিছুই বলতে পারছি না। কিন্তু, এটা জেনো রেখো এখানে কিছু সমস্যা আছে। আসার সময় যখন চেকপোস্টে থামাল, তখনো ব্যাপারটা আমি লক্ষ করেছি। এরা কেমন যেন ছাড়া ছাড়া। মানে কেমন একটা ভঙ্গি যেন লুকোনো। 

অধরার বক্তব্য শুনে কপালে মৃদু খাঁজ পড়ল। মিথিলা দুই ভ্রুঁর মাঝে চিন্তার রেখে ফেলে সোজাসুজি প্রশ্নটা শুধিয়ে উঠল, 

  - জিলাপি না বানিয়ে সোজাসুজি বল তো ছোট। আমার কেন জানি মনে হচ্ছে, তুমি হয়তো কিছু একটা ধরে ফেলেছ। 

মেজো ভাবী মিথিলার দিকে মুখ তুলল অধরা। মাথাটা হ্যাঁ সূচকে নাড়িয়ে কথা শুরু করল, 

  - শোনো বলি। আমরা যখন গাড়িতে করে আর্মি চেকপোস্ট পার করি, সেসময় ওখানকার একজন এটা জিজ্ঞেস করে যে, আমরা কোন জায়গার জন্য যাচ্ছি। তখন তুমি আর সেজো ভাবী তাহিয়া ঘুমাচ্ছিলে। আর বড় ভাবী সেগুফতা বড় ভাইয়ের সঙ্গে কথা বলছিল। আমি যখন অফিসারটাকে বললাম, আমরা ফরেস্ট অফিসার শোয়েব ফারশাদের আত্মীয়, তখন ওই অফিসার কেন যেন কয়েক সেকেণ্ড তাকিয়েই ছিল। পুরো চুপচাপ। একটাও কথা বলেনি। পরে সঙ্গে থাকা আরেক অফিসারের দিকে মুখ চাওয়াচাওয়ি করে যে কথাটা ওইসময় বলল, ওটা শোনার পরপরই আমি আশ্চর্য হয়ে যাই! উনি আমাকে বলল, " আপনাদের তো ওইদিকে যাওয়া ঠিক না। উনার বাড়িতে অসময়ে যাচ্ছেন কেন?"। পরে আমি সরাসরি জিজ্ঞেস করলাম, অসময় মানে কী? এরপর সে আর কথা বলে না। তারপর তো সামনে থেকে গাড়ি পাস হওয়া শুরু করল। আর আমরাও সোজা গন্তব্যের দিকে আসলাম। 

অধরার এই কথা শুনে তাহিয়া ব্যাপক গম্ভীর হয়ে গেল। কোনো কিছু বুঝতে না পারলে তাহিয়া গম্ভীর হয়ে যায়। এটা বলা উচিত তার চারিত্রিক মুদ্রাদোষ। তাহিয়ার গুমোট অবস্থা দেখে মিথিলা দুইয়ে দুইয়ে চার মেলাতে বলল, 

  - আচ্ছা, এটা কী হতে পারে না? ওই অফিসারটা আগে থেকেই জানে গেছিল শোয়েব ভাই বাংলোতে নেই, আর উনি এমন একটা সমস্যার ভেতর জড়িত? 

অধরা ডানে বাঁয়ে মাথা নাড়িয়ে বলল, 

  - না, ভাবী। এটা সম্ভব না। কারণ ওসময় বিকেল ছিল। আর ওদের মুখ থেকে যা শুনলাম, তখন সন্ধ্যা পুরোপুরি শেষ। রাত্রি তখন কয়টা জানি। বিকেল বেলা আগেভাগেই একজন অফিসার রাতের ঘটনা নিয়ে ভুলেও কথা বলতে পারবে না। এটা সম্ভবই না ভাবী। 

মিথিলা ওর যুক্তিতে নিজেও সম্মত হতে বাধ্য হল। এটা ঠিক, কেউ আগেভাগে রাতের ঘটনা নিয়ে সাবধান করতে যাবে না। সাবধান করলে অন্যকিছু নিয়েই করেছে। তার মানে আগে নিশ্চিত কিছু খারাপ ঘটনা ঘটেছে। ফলে ওদের এই হঠাৎ আসা নিয়ে সেই অফিসার লোকটা মুখ ফসকে সাবধান করে ফেলেছে। মিথিলা চোখমুখ কৌতুহলী করে কী যেন ভাবতে ভাবতে বলল, 

  - সমস্যা আছে ছোট। বিরাট কোনো সমস্যা আছে। আমাদের দেবর শোয়েব ফারশাদ মোটেও চায়নি আমরা এখানে আসি। সে সবসময় একপ্রকার বারণ করে এসেছে। অথচ, আসার কথা বললে সে সবসময় কক্সবাজারের রুট ধরতে বলতো। এটা কেন? এত বড় একটা বাংলো থাকতে কেন সে চাইতো আমরা কেউ না আসি? 

আকারে ইঙ্গিতে বলা মিথিলার বাক্যে ফট করে বলল তাহিয়া, 

  - এর মানে এটাই, এখানে ঝামেলা আছে। শোয়েব ভাই চাচ্ছে না আমরা এখানে জড়াই। উনি আমাদের সেফ করতে বারবার এখানে আসতে নিষেধ করতেন। 

কথাটা পুরোপুরি সত্য হলেও শক্ত কোনো প্রমাণ নেই। ওরা কেউই জানে না, এসবের ব্যাখ্যাটা কী। যুক্তি দাঁড় করাতে গেলে অনেক কিছুই উলোটপালোট হয়ে যাবে। তন্মধ্যে একটা সেই ঘটনার রহস্য। এর মানে কী সুঁতোয় ঝুলতে ঝুলতে সেই ঘটনার আবহ এখানেও এসেছে? অধরা ব্যাপারটা নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা করতেই বাকি দুজনের দিকে চোখ ফেলে বলল,

  - একটা মানুষ আমেরিকার মতো সুযোগ ছেড়ে এই বন্য জায়গায় পড়ে আছে কেন? সে তো চাইলে দিব্যি সবকিছু সাজিয়ে গুছিয়ে আরাম আয়েশ করতে পারতো। এটা কী একটু বেশি তাজ্জব না? 

অধরার কথাকে উপেক্ষা করে মিথিলা এবার অন্যদিকে মনোযোগী হলো। তেমনি ভাবনার উপর ভাবনা বসিয়ে চট করে ওদের দিকে বলল, 

  - আচ্ছা, মেয়েটা কী তোমরা দেখেছ? 

এই প্রশ্নে তাহিয়া উত্তর দিয়ে উঠল, 

  - দেখে এলাম। ঔষুধের জন্য ঘুমোচ্ছে। কিন্তু অবস্থা বেশি ভালো না। দাদী আশঙ্কা করছেন রাতে হয়তো তাপমাত্রা বাড়তে পারে। 

তাহিয়ার কথার রেশ ধরে মিথিলা বলে উঠল, 

  - এরকম কিছু না হোক। আমি একটু আগে গিয়ে দেখে আসলাম। দেখে ভালো লাগছে না জানো? আমি প্রথমে বুঝতেই পারিনি মেয়েটা যে কে। প্রথমে তো মহোদয়ের কোলে দেখে খুশি হয়ে গিয়েছিলাম, কিন্তু পরে জানলাম অন্যকিছূ। শেষে যখন দেখলাম ওই ছয়জন আবার কে, পরে সেগুফতা ভাবী হালকা আভাস দিয়ে বলল, হয়তো ওই মেয়েটার সঙ্গী সাথী হবে। আর দেখো, তাই-ই হয়েছে। 

মিথিলার কথা শেষ হতেই খুব চিন্তিত ভঙ্গিতে বলে উঠল তাহিয়া, 

  - কিন্তু মিথিলা ভাবী, তুমি একটা জিনিস ভাবো, ট্যুরিষ্ট স্পষ্টে এসেছে ভালো কথা। এখানে এরা এমন বেখাপ্পা কেন? মানে আমি বোঝাতে চাচ্ছি, এরা কিন্তু এক পরিবারের সদস্য না। এমনকি একই স্ট্যাণ্ডার্ডের সহপাঠীও না। আমি কিছুক্ষণ আগে সোহানা নামের মেয়েটার সাথে কথা বলেছি। মেয়েটা ভালো ভয় পেয়েছে। আমি ওকে ফ্রেশ হতে যখন সাহায্য করছিলাম, তখন ওর দিক থেকে একটা ঘটনা শুনলাম। ওই ঘটনা হেব্বি ডেঞ্জারাস জানো? শুনলে গায়ের লোম দাঁড়িয়ে যাবে! 

এক প্রসঙ্গ নিয়ে বলতে বলতে তাহিয়া অন্য প্রসঙ্গে ঢুকে গেছে। কিন্তু তা নিয়ে দ্বিরুক্তি করল না কেউ। বরং, ওই 'ডেঞ্জারাস' ঘটনাটুকুই শোনার জন্য উৎসুক দৃষ্টিতে বলল, 

  - কী সেটা? বলো দেখি ছোট করে। আমি তো এখন যেটাই শুনছি, সেটাই আমার কাছে তাজ্জব লাগছে। আচ্ছা ছোট করে ফটাফট বলে যাও। শুনি। 

তাহিয়া একটু চুপ থেকে নিজেকে গুছিয়ে নিচ্ছে। মনে মনে পুরো ঘটনাটা সাজিয়ে গুছিয়ে উদগ্রীব কণ্ঠে বলে,  

  - শোনো তাহলে। কথার মাঝে প্রশ্ন কোরো না। আমি বলে চলি। তারপর যা জানার পরে প্রশ্ন করো। সোহানা ওদের দল থেকে আলাদা হয়ে গেছিল। কীভাবে হয়ে গেছিল ওটা তো তোমরা শুনেছই। হালকা পাতলা ঘটনা পার্থও আমাদের কিছুটা বলেছে। পরিস্থিতি তখন এতোটাই নরকের মতো বীভৎস হয়েছিল যে, শোয়েব ভাই তখন সোহানাকে নিয়ে একটা বাগানের মাঝে আশ্রয় নেয়। সে তখন এক এক করে সমস্ত কথা খুঁটিয়ে শোনে। কুটিরের অবস্থান জেনে নিতেই হঠাৎ একটা লোক। কালো কাপড়ে ঢাকা পুরো মুখ। হাতে বিরাট বড়ো একটা বন্দুক। ওই বন্দুকের নল সরাসরি শোয়েব ভাইয়ের দিকে নিশানা করা। সোহানা তখন ভয়ে পাথর! কী করবে, কীভাবে রক্ষা পাবে, এসব নিয়েই ওর মাথা তোলপাড়। শোয়েব ভাই তখন ঘাসের ওপর বসেছিল, পরে সে আস্তে আস্তে সারেণ্ডার করে উঠে দাঁড়াল। সোহানা ভয়ে মনে মনে একনাগাড়ে কালেমা তাইয়্যেবা পড়ছে। মৃত্যু তখন যেন সন্নিকটে। এরপর যা ঘটলো, তা নাকি ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। বন্দুকধারী লোকটা যেই দু একটা গালভরা কথা শোনাল, ঠিক তখনই শোয়েব ভাই কী যেন একটা করল। তারপর . . তারপর . . ওই লোক . . 

কথাটা বলেই হঠাৎ একটু থামল তাহিয়া। পাশের টেবিল থেকে গ্লাসটা তুলে ঢকঢক করে পানিটুকু খেয়ে নিল। এদিকে তুমুল উত্তেজনার ভেতর ছটফট করছে ওরা। পরের অংশটুকু শোনার তেষ্টাতে অধরাই তাগাদার ভঙ্গিতে বলে উঠল, 

  - এরপর? এরপর কী হলো বলো? 

  - তারপর ওই লোক ধিড়িম করে মাটিতে পড়ে গেল। একদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার, অন্যদিকে গোলাবারুদের ঝাপসা ধোঁয়া। সোহানা নাকি বুঝতেই পারেনি কী যে ঘটেছে। পরে যখন ভালোভাবে তাকিয়েছে,ওর সমস্ত শরীর নাকি ভয়ে কাঁটা দিয়ে উঠেছে! লোকটার কণ্ঠনালীটা একদম দুই ভাগ হয়ে গেছে! মুরগী জবাই করলে যেরকম হয়, ঠিক সেরকম! সোহানা নাকি বুঝতেই পারেনি কখন যে শোয়েব ভাইয়ের হাতে ছু রি ছিল। আরেকটু হলে নাকি বন্দুকের গুলিটা তার মাথার বাঁদিক থেকে খুলিই চেঁছে ফেলতো। ভাগ্যিস, শেষ মুহুর্তে সব আয়ত্তে নিতে পেরেছে। এরপর তাড়াতাড়ি সোহানাকে একজন উদ্ধার সদস্যের হাতে তুলে দিয়ে সে ঝটপট অন্যদিকে সরে যায়। এই হলো সোহানার মুখ থেকে শোনা কাহিনি। বাকিদেরটা তো একটু আগেই জানলে। কিন্তু আমার মনে হচ্ছে, এদের সবাই দোষী না। মানে, একজন দোষ করলে বাকিদের ঘাড়ে দোষ চাপে না? এখানে বিষয়টা সেরকমই। 

তাহিয়ার কথা শেষ হতেই তিনজন সামান্য গল্পগুজব করল। কিছু মত বিনিময় হল। কিন্তু কোথায় যেন তিনজনের মন একটা সুক্ষ্ম সুঁতোয় বাঁধা রইল। যেন বলি বলি করেও বলতে পারছে না। মনে খোঁচা দেওয়া কথাটা জানানো যাচ্ছে না। একপাশ থেকে টান খেলে কথাটা বলতে উদ্যত হয়, কিন্তু আমতা আমতা করে কেউই আর ঠোঁট ফসকে বলে না। এমন নীরব যুদ্ধ কিছুক্ষণ চলল। তিনজনই সাহস সঞ্চয় করল। এরপর আড় ভাঙল মিথিলা। উল বোনা বাদ দিয়ে যেই কথাটা বলতে উদ্যত হল, ঠিক তখনই বাকি দুজন একইসাথে একইভাবে ফট করে উঠল,  

   - “মেয়েটা একদম পার্ফেক্ট না?”
.
.
.
চলবে.....................................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন