এক হাজার টাকা - পর্ব ১৪ - মৌরি মরিয়ম - ধারাবাহিক গল্প


মাছ ও কাদায় মাখামাখি হয়ে রিসোর্টে ফিরে সোজা গোসলে ঢুকলাম। ভালো করে সাবান দলে গোসল করলাম। কাচা মাছের গন্ধ আমি একেবারেই সহ্য করতে পারি না। মাছ কাটা ধোয়া আমার পক্ষে অসম্ভব। অথচ কমল মাছ ভীষণ পছন্দ করে। ভবিষ্যতে ওকে মাছ খাওয়াব কী করে আমি! আমরা যে সব মাছ ধরেছি তারমধ্যে যেগুলোতে ছোট ছোট কাটা নেই সেগুলো বারবিকিউ করার কথা। মাছ পোড়ানো দেখার জন্য গোসল করেই বাইরে বের হলাম। বাইরে তখনও বৃষ্টি তাই বোধহয় রান্নাঘরের বারান্দায় বারবিকিউয়ের ব্যবস্থা করা হয়েছে। রান্না ঘরটা রিসর্টের পেছন দিকে। মাটির চুলায় রান্না হয় সেখানে। রিসর্টের লম্বা বারান্দার শেষ প্রান্তে গিয়ে দাঁড়ালে সেখান থেকে রান্না ঘরটা দেখা যায়। আমি ঘর থেকে বেরিয়ে দেখি কমলও গোসল করে এসে দাঁড়িয়েছে।

জিজ্ঞেস করলাম,
"কোথায় যাচ্ছো?"

"স্পেসিফিক কোথাও না। ঘরে থেকে কি করব তাই বের হলাম। তুমি?"

"আমি মাছ পোড়ানো দেখতে যাব। তুমি যাবে?"

"চলো।"

দুজনে বারান্দার গ্রিল ধরে দাঁড়িয়ে ছিলাম। মাছ পোড়ানো দেখতে দেখতে কি যেন বলছিলাম আমি। এর মাঝেই হঠাৎ খেয়াল করলাম কমল অনেকক্ষণ ধরে আমার দিকে তাকিয়ে আছে।

আমি বললাম,
"কী হয়েছে তোমাকে অন্যমনস্ক লাগছে যে! কিছু ভাবছো? বলবে কিছু?"

কমল ঘোর লাগা গলায় বলল,
"একটা মেয়ে কাছেই আছে, পাশেই দাঁড়ানো। সে আমার বউ হতে যাচ্ছে কিন্তু বউ হয়নি এখনো। আমি তার উপর সব অধিকার পাব কিন্তু পাইনি এখনো। এই অনুভূতিটা অদ্ভুত বেদনার।"

আমি কী বলব বুঝতে পারলাম না। রোমান্টিক পরিবেশ ওর মাথা আউলে দিয়েছে! অনেক দিন পর আজ শাড়ি পরেছি। শাড়ি পরার অভ্যাস নেই আমার। যতক্ষণ শাড়ি পরে থাকি খুব অস্বস্তি লাগে। যেদিন কমলদের বাড়ি থেকে আমাকে দেখতে এলো সেদিন শাড়ি পরিনি। এঙ্গেজমেন্টের দিন লেহেঙ্গা পরায় সেদিনও শাড়ি পরা হয়নি।

আজ কমলদের বাসায় আমাদের সবার দাওয়াত। কমল শাড়ি পরার জন্য অনুরোধ করল। আমি বললাম, আমার অস্বস্তি লাগে। তখন সে বলল, তাহলে দরকার নেই। বারবার অনুরোধও করল না, জোরও করল না। ঠিক সেই মুহূর্তেই মনে হলো, এই মানুষটার জন্য পরি না একবার শাড়ি! পরে ফেললাম। কমলের ছোট বোন জেরিন আমাকে কমলের ঘর দেখাতে নিয়ে গেল। জেরিন কলেজে পড়ে। ওর বোধহয় আমাকে খুব পছন্দ হয়েছে। যতবার আমাদের দেখা হয়েছে, সারাক্ষণ আমার সাথে লেগে থেকেছে। আমারও অবশ্য ওকে খুব ভালো লেগে গেছে। কিছু মানুষ থাকে যাদেরকে প্রথম দেখাতেই খারাপ লাগে। শত চেষ্টা করেও তাদের প্রতি ভালো লাগা আনা যায় না। আবার কিছু মানুষ আছে যাদেরকে প্রথম দেখাতেই অকারণে ভালো লেগে যায়। জেরিন দ্বিতীয় দলের। এ ক'মাসে সে তার ভাইকে নিয়ে হাজারটা গল্প আমাকে শুনিয়ে ফেলেছে। কমলের ঘরটা দেখে আমার মনটা একটু খারাপ হয়ে গেল। কারণ ঘরে কোনো বারান্দা নেই। বারান্দা আমার খুব প্রিয় জায়গা। বারান্দা না থাকলে আমার গাছগুলো রাখবো কোথায়?

এসব ভাবনার মাঝেই কমল এসে বলল,
"জেরিন মা তোকে ডাকছেন।"

জেরিন বেরিয়ে গেল। আমি যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই কমল বলল,
"তুমি কোথায় যাচ্ছো?"

"আন্টি জেরিনকে ডাকছেন। আমিও তো ওর সাথে ছিলাম। আমাকেও হয়তো খুঁজবেন।"

"তোমাকে কেউ খুঁজবে না। আর মা জেরিনকে ডাকেনি। ওকে বিদায় করার জন্য এ কথা বলেছি।"

আমি লজ্জা পেয়ে গেলাম। লজ্জা ঢাকতে তাড়াতাড়ি ওর ঘরের জিনিসপত্রগুলো ধরে ধরে দেখতে লাগলাম।

কমল বলল,
"অস্বস্তি লাগলে শাড়ি পরলে কেন? আমি এমনিই বলেছিলাম। শাড়ি পরা দেখিনি কখনো তাই। আমি কিন্তু কখনোই চাইনা আমার ইচ্ছে পূরণের জন্য তুমি এমন কিছু করো যা তোমাকে অস্বস্তি দেয়।"

আমি বললাম,
"জোর করলে পরতাম না। জোর করোনি বলেই ইচ্ছে হলো। কখনো কখনো অন্যের ইচ্ছে পূরণ করাতে আনন্দ লাগে।"

"সে তো প্রিয়জনের ক্ষেত্রে। সেই হিসাবে কি আমি বলতে পারি, আমি তোমার প্রিয়জন?"

ওর কথায় হেসে ফেললাম।

ও কাছে এসে বলল,
"তোমাকে শাড়িতে অনেক সুন্দর লাগছে।"

"শাড়ি না পরলে সুন্দর নই বলছ?"

"তুমি সবসময় সুন্দর। তোমার চোখে, তোমার পরিমিত হাসিতে, তোমার অনাড়ম্বর চেহারায় এবং তোমার ব্যক্তিত্বে সবখানেই একটা ভীষণ গভীরতা আছে। সেই গভীরতাটা খুব কৌতূহল জাগায়। কিন্তু গভীরতাটা কীসের তা আজও আবিস্কার করতে পারিনি।"

আমি নিজেই চিন্তায় পড়ে গেলাম। আমার মধ্যে যে এরকম কিছু আছে তা তো আমার কখনো মনে হয়নি! ও কি সত্যি বলছে নাকি ঢপ মারছে? মেয়ে পটানোর কৌশল? ধুর কমল কেন আমাকে পটাতে যাবে? পটালে শুরুতে পটাতো। এখন যেখানে সম্পর্ক এতখানি এগিয়ে গেছে এখন পটিয়ে কী করবে? পটালেও বিয়ে হচ্ছে, না পটালেও হচ্ছে। শুধু শুধু পটাবে কেন? তাহলে ব্যাপারটা আসলে কী?

আমাকে চিন্তিত দেখে কমল বলল,
"আচ্ছা তিন্নি বাদ দাও এসব। কাজের কথা বলি। ঘরে কি কোনো পরিবর্তন আনতে হবে?"

আমি অবাক হয়ে বললাম,
"কীসের পরিবর্তন?"

"না মানে এই যেমন ধরো দেয়ালের রঙ, বাথরুমের দরজার রঙ এসব তো ভালো নাও লাগতে পারে তোমার। জানালা ছোট মনে হতে পারে। বিছানাটা ছোট মনে হতে পারে। কোল বালিশ লাগতে পারে। আরও কিছু ফার্নিচার লাগতে পারে, যেমন আমার ফাইন্ডিংস বলে একটা ড্রেসিং টেবিল লাগবে। তাও আমার নিজের মাথাতে আসেনি। জেরিন বলার পরে খেয়াল হলো। আলমারিতেও সম্ভবত দুজনের কাপড়-চোপড় রাখার জায়গা হবে না। আরও কিছু যদি লাগে আগেই বলো। অর্ডার করে দেই। রেডিমেট জিনিস ভালো হয় না। আর কাঠের জিনিস অর্ডার করলে মিনিমাম এক মাস সময় দিতে হয় নাহলে ফিনিশিং ভালো হয় না।"

আমি অবাক হয়ে বললাম,
"এতকিছু ভেবে ফেলেছো!"

"একটা মানুষ তার বাসা ফেলে রেখে আমার বাসায় এসে থাকবে। এই বাসার সবকিছু তো তার মন মতো করতে পারব না, কিন্তু তার ঘরটা তো তার মন মতো করতেই পারি। তাই না?"

আমি ওর কথার সূত্র ধরে বললাম,
"দেয়ালের রঙ, বাথরুমের দরজার রঙ কোনোটাই আমার পছন্দের রঙের না। তবে এরকমই থাকুক সবকিছু। আমার ঘরের দেয়ালের যে রঙ সেটাও আমার পছন্দ না কিন্তু ছোটবেলা থেকে আমি ওই ঘরটাতেই থেকেছি। এটা তেমন বিশেষ কোনো ব্যাপার মনে হয় না আমার কাছে। কখনো যদি পছন্দের রঙ করতে মন চায় তোমাকে আমি বলব। জানালা ঠিকাছে। বিছানাটা দুজনের জন্য যথেষ্ট, আর কোল বালিশ ব্যবহারের অভ্যাস নেই আমার। আমি অনেক সাজগোজ করিনা সুতরাং ড্রেসিং টেবিলও প্রয়োজন নেই। তবে বড় একটা আয়না লাগবে যা তোমার ঘরে নেই। ৫ ফিট বাই দুই ফিট একটা আয়না লাগবে। আর আলমারিতেও আপাতত হয়ে যাবে। কারণ আমার কাপড়চোপড় খুব বেশি না। সামনে বিয়েতে অনেক খরচ শুধু শুধু এসব অপ্রয়োজনীয় খরচ করার দরকার নেই। যা লাগবে পরে দেখা যাবে।"

"আমার ম্যাক্সিমাম বন্ধু রাই বিয়ে করেছে। তাদের কারও স্ত্রী'রা তো স্বামীর খরচ বাঁচানোর কথা ভাবে না এভাবে। উলটো স্ত্রী'দের চাহিদা মেটাতে মেটাতে নিজের জন্য খরচ করার আর কিছু থাকে না ওদের। আর তুমি কী বলছো এসব!"

"তাই নাকি! তাহলে তোমার বন্ধুদের কপাল খারাপ। বেশিরভাগ মেয়েরাই স্বামীর খরচ বাঁচাতে চেষ্টা করে। অল্প কিছু অধিক চাহিদা সম্পন্ন মেয়েদের কারণে দোষ হয় সবার।"

"হয়তো।"

আমাদের ডাক পড়ায় এ বিষয়ে কথাবার্তা এখানেই শেষ হলো।

বাসায় এসে একটা পার্সেল পেলাম। বিকেলের দিকে নাকি এসেছে। পার্সেলটা র‍্যাপিং করা। ভেতরে কী বোঝা যাচ্ছে না। উপরে কোনো নাম ঠিকানাও নেই। এত ক্লান্ত লাগছে যে খুলতেও ইচ্ছে করছে না এখন। আগে শাড়িটা বদলে বাসার জামা পরে নিলাম। এরপর বিছানায় হেলান দিয়ে বসে র‍্যাপিংকটা খুললাম। একটা বাক্স পেলাম। ঢাকনা খুলতেই দেখি বাক্সের ভেতর দুটো গোলাপ, আমার প্রিয় চকলেটের বড় একটা প্যাকেট, একটা চিঠি আর একটা এক হাজার টাকার কচকচে নোট। আমি লাফিয়ে উঠে বসলাম। আমার হৃদযন্ত্র বুঝি এক্ষুণি বন্ধ হয়ে যাবে। দ্রুত চিঠিটা খুললাম। চিঠিতে লেখা,

তিন্নি,
        কথা বলতে জানি না বলে জীবনে অনেক কিছু হারাতে হয়েছে। কথা বলতে জানি না বললেও আংশিক ভুল হবে। কথা বলার মানুষ ছিল না। বাবা মা মারা যাবার পর সেই কিশোর বয়স থেকে কথা বলার কাউকে না পেয়ে কেবলই নিজের সাথে কথা বলে গেছি। বলতে বলতে অভ্যাস হয়ে গেছে। অনেকবছর পর একটা কথা বলার মানুষ পেয়েছিলাম। তাকে যাতে কখনো হারাতে না হয় সেই জন্যই নিজের অতীতটা বলতে চেয়েছিলাম। গোপন রাখতে চাইনি কিছুই। কিন্তু পুরো কথা না শুনেই উধাও হয়ে গেলে। যোগাযোগের কোনো উপায় আর রাখলে না। কিছু দেনাপাওনা বাকি ছিল তিন্নি। তুমি বলেছিলে যে রেস্টু রেন্টে আমার কর্মজীবন শুরু হয়েছিল তার সামনের বাসা তোমাদের। সেই হিসেবে বাসা চিনি কিন্তু লিখিত ঠিকানা জানিনা। কাউকে যে পাঠাব এমন কেউ নেই আমার বাংলাদেশে। অবশেষে দেনা-পাওনা পরিশোধ করার জন্য আমার বাংলাদেশে আসতে হলো। তখনই আসার মত টাকা ছিল না, তাই ৬ টা মাস অপেক্ষা করতে হলো। তোমার কাছে হয়তো মাত্র এক হাজার টাকা। কিন্তু আমার কাছে তখন এই সামান্য টাকাটাই অনেক মূল্যবান হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। বিপদের সময় সাহায্য করার জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ। আমার দেনা আমি শোধ করলাম। এবার তোমার দেনা শোধ করো, আমার চোখের ঘুম ফিরিয়ে দাও। "- আদনান"

        P.S. +8801********* এটা আমার বাংলাদেশী ফোন নাম্বার। আজ দুপুরে ল্যান্ড করেছি। ১ মাসের ছুটিতে এসেছি। আশা করি এবার আমাকে পুরো কথা বলার সুযোগ দেয়া হবে। সব শুনে তুমি যে সিদ্ধান্ত নেবে মেনে নেব। কাল সকাল ১০ টায় তোমার বাসার সামনের ওই রেস্টুরেন্টে অপেক্ষা করব।
.
.
.
চলবে.................................................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

WhatsApp