দিনের শেষ বোম ফাটিয়ে নীহম বলে উঠল,
-“আমি এখন তোমার বাসার ঠিক সামনের রাস্তাতে আছি। মিট মি, নাও।”
স্মরণ দ্রুত গতিতে উঠে বারান্দার গ্লাস স্লাইড করল। রাস্তার সামনে এক হুডি পরা নীহমকে প্রথম দেখাতেই চিনে ফেলল। পিছে নক্ষত্র সোফায় গা এলিয়ে দিলো। দুই পা তুলে নিল সেন্টার টেবিলের ওপর। চোখে ধীরতা, ঠোঁটের কোণে রসাত্মক হাসি। সে চোখ মেরে বলল,
-“খুশিতে একটু কোমর দোলাও, স্মরণপাখি। আগুন লেগে যাবে।”
স্মরণ পানির খালি বোতলটা নক্ষত্রের দিকে ছুঁড়ে মেরে বলল,
-“মুখ বন্ধ রাখ।”
নক্ষত্র বোতলটা ধরে নিয়ে চোখ বন্ধ করে হাসল,
-“ভাবি অপেক্ষা করছে, যা৷”
-“এড্রেস তুই দিয়েছিস? তোরা কন্ট্যাক্টে আছিস?”
নক্ষত্র সে কথার উত্তর না দিয়ে বলল,
-“তুই কি চাইছিস, আমি এখন তোকে কোম্পানি দিই? নিচে গিয়ে ভাবির সাথে মিট করি?”
স্মরণ সোফা থেকে কুশনটা তুলে নক্ষত্রের মুখ বরাবর ছুঁড়ে মেরে বেরিয়ে গেল। নক্ষত্র একহাতে কুশনটা ধরে সোফাতেই শুয়ে পড়ে হাসতে লাগল। ভাবতে লাগল প্রীতির কথা। মেয়েটার কি আবারও জ্বর এসেছে?
স্মরণ নিচে গিয়ে দেখতে পেল নীহম বিপরীত রাস্তার ফুটপাতে বসে আছে। সে দ্রুতপায়ে এগিয়ে গেল। নীহমের হাত ধরে উঠে দাঁড় করিয়ে বলল,
-“ঠিক আছো?”
নীহম কপাল কোঁচকাল,
-“বেঠিক থাকার কারণ কী হবে?”
-“এত রাতে এখানে?”
-“এমনিই। ইচ্ছে করল তাই।”
স্মরণ বলার মতো পেল না। শান্ত হলো। কোনো সমস্যা নেহাত হয়নি। মেয়েটা মর্জিমাফিক এসেছে। সে নীহমের হাত ছাড়ল না। সেভাবেই হাঁটতে লাগল। কোনো কথা খুঁজে পাচ্ছিল না বলে একটু মজা নিতেই জিজ্ঞেস করল,
-“উহুম? মিস করছিলেন নাকি, ম্যাডাম?”
নীহম যেন আরও দু'কদম এগোনো। সঙ্গে সঙ্গে প্রত্যুত্তর করল, না ভেবেই,
-“আনডাউটেডলি ইয়েস।”
স্মরণের হাত ঢিলে হয়ে এলো কিঞ্চিৎ বিস্ময়ে। যেন এতটাও মনমতো ঘটনা পৃথিবী ঘটতে পারে না। সে নিশ্চিত হতে জিজ্ঞেস করল,
-“আসলেই?”
নীহম আলগা হয়ে যাওয়া হাতটা নিজ থেকে শক্ত করে ধরল। সামনের পথের দিকে তাকিয়ে বলল,
-“একা একটা মেয়ে, এই রাতের প্রায় বারোটা বাজে একজন ভদ্রলোকের বাড়ির সামনে এসে দাঁড়িয়ে পড়ল। তার দিন-দুনিয়ার কিচ্ছু ভালো লাগছিল না। স্বস্তি পাচ্ছিল না। শান্তি পাচ্ছিল না। যেন এই মুহূর্তে! এই মুহূর্তেই নির্দিষ্ট ভদ্রলোককে দেখতে না পেলে তার অনেক বড়ো ক্ষতি হয়ে যাবে। কেন এমনটা মনে হচ্ছিল, জানো?”
এটুকু বলে নীহম থামল। ফিচকে এক হাসির সাথে ফের বলল,
-“জানো না। জানবে না। স্মরণেরা অবুঝ হয়। তারা চোখের সামনে স্বর্গ দেখেও, কুয়াশা ভেবে চোখ সরিয়ে নেয়।”
_________
প্রীতিলতার রাতে আরেকদফা জ্বর এলো। এই জ্বরটাকে নাটকীয়তার সাথে “প্রেমজ্বর” বলে সহজেই আখ্যায়িত করা যায়। মজার কথা হচ্ছে, প্রীতির ভালো লাগছে। জ্বরের ঘোরে গুনগুন করে গান গাইছে,
“আমায় ভাসাইলি রে, আমায় ডুবাইলি রে -
অকূল দরিয়ার বুঝি কূল নাই রে....”
আহ! প্রীতির কী সে সুখ! নক্ষত্র যখন চলে যায়, তখনই পৌলি বাড়ি আসেন। প্রীতি জিজ্ঞেস করে,
-“মা, আমার বিয়ে কার সাথে ঠিক হয়েছে?”
-“তাতে তোমার কী?”
প্রীতির রাগ লাগলেও সে শান্ত থাকার চেষ্টা করে বলে,
-“জানতেও পারব না?”
-“ওহ। আসলে প্রথমে স্মরণের সাথে ঠিক হয়েছিল। কিন্তু স্মরণ নাকি তোমাকে বিয়ে করবে না। পছন্দ করেনি বোধহয়৷ তবে ওর মা ভীষণ রকমের ভদ্রমহিলা। তাই বিয়েটা ভাঙতে পারেননি। ওনার ছোটছেলেকে দিয়ে তোমায় নেবে। ছোটছেলেকে চেনো তো? নক্ষত্র! তোমার টিউটর। সে।”
সবকিছু বুঝতে পারল প্রীতি। পৌলি ফের বলল,
-“আমি ভাবছিলাম, যার সাথে বিয়ে হবে তার এরকম বাড়ি এসে পড়িয়ে যাওয়া বিষয়টা কেমন না? নক্ষত্রকে বলেছিলাম, অন্য কোনো মেয়ে টিউটর খুঁজে দিতে। ছেলেটা কী ভালো! দায়িত্বশীল! আমাকে বলল, সে নাকি অন্য কারো ওপর তোমার পড়াশোনার দায়িত্ব দিয়ে নিশ্চিত থাকতে পারবে না। সামনে এইচএসসি, তাই সবটা নিজেই দেখবে। কী ভালো! কী বুঝদার!”
পৌলি আরও গুনগান গাইতে লাগল। প্রীতি বাবার রুমে চলে এলো। শামীম সাহেব তাকে দেখেই সিগারেট নিভিয়ে ফেলেন অ্যাশ্যট্রেতে। মুখের সামনে হাত নেড়ে ধোঁয়া সরিয়ে এয়ার ফ্রেশনার দিয়ে দেন। প্রীতি হেসে ফেলে,
-“মা বকে না?”
-“না রে, মা। বোস এখানে।”
প্রীতি পাশে বসল,
-“বাবা, আমার বিয়ের ব্যাপারে তোমার কী মতামত ছিল? তুমি রাজি ছিলে?”
-“সত্য বলব না-কি মিথ্যা?”
-“মিথ্যা বলো।”
-“ছিলাম না।”
প্রীতি অবাক হলো,
-“এ কেমন মিথ্যা!”
শামীম সাহেব হেসে উঠলেন,
-“আম্মাজান, শোনেন। আমি শুরু থেকেই রাজি ছিলাম। কারণ ছেলে আর ছেলের পরিবার সবটাই আমার মনমতো। আমি হয়তো ফিউচারে তোমার জন্য এমন কাউকেই চাইতাম। যেটা সামনে হতেই যাচ্ছে, সেটা এখন হলে সমস্যাটা কোথায়? সামনে ওর চেয়েও বেটার কাউকে পাওয়ার সম্ভাবনাটা কতটা?”
-“তবু, বাবা! এমনও তো হতে পারে যে ইন ফিউচার তুমি একদম তোমার মনের মতো পার্ফেক্ট কাউকে পেয়ে গেলে! তখন আফসোস হবে না?”
প্রীতি এ কথা এমনিই বলল৷ কোনো কারণ ছাড়াই। তবে এ অকারণা প্রশ্নের বিপরীতে শামীম সাহেবের থেকে বেশ চমৎকার এক উত্তর এলো,
-“মা, একটা কথা সবসময় মাথায় রাখবে। যা পাচ্ছ, যেটুকু পাচ্ছ—সবসময় তার শোকর আদায় করবে। বেটার পাওয়ার আশায় এটুকুকে হেলা কোরো না। দেখা গেল, সামনে তাকিয়ে কিছুই পেলে না। আর পার্ফেক্ট? পার্ফেক্ট বলে কিছু হয় না। একটু রাগ, তেজ, স্বভাবের দোষ, চিন্তার বৈপরীত্য সব মিলিয়েই মানুষটা সুন্দর। এগুলো না থাকলে একঘেয়ে লেগে যাবে.. বোঝা গেল?”
প্রীতি মাথা নাড়ল,
-“জি, বাবা।”
-“তুমি কি বিয়েতে অখুশি?”
-“না, বাবা।”
-“তাহলেই ঠিক আছে। বাবার ওপর ভরসা রেখো। হু?”
-“আচ্ছা।”
-“ঘুমাতে যাও এখন। অনেক রাত হয়েছে।”
-“আচ্ছা, বাবা। তুমিও ঘুমাও।”
প্রীতি সেই যে রুমে এসে শুয়েছে। আর ওঠেনি। তার ভালো লাগছে সবকিছু। এতবেশি ভালো লাগছে যে শেষমেষ নেমে যাওয়া জ্বরটা ফের উঠে পড়ল।
মধ্যরাতের শুরুর দিকে আচমকা তার ফোনে একটা আননোওন নাম্বার থেকে ম্যাসেজ এলো,
-“হ্যাল্লো প্রিটি গার্ল!”
প্রীতি চমকে গেল। এ আজব ও আশ্চর্য মালটা কে? এই মধ্যরাতে কোত্থেকে উদয় হলো? ট্রু কলারে দেখতে পেল লোকটার নাম 'ডানাকাটা পরী'। দ্বিতীয় দফায় চমকে গেল প্রীতি। রিপ্লাই করল,
-“আপু, আপনাকে চিনি আমি?”
ওপাশ থেকে এবার কল এলো। প্রীতি ইতস্তত করতে করতেও রিসিভ করল। শ্রান্ত, গম্ভীর ও খানিকটা বিস্ময় নিয়ে ওপাশ থেকে নক্ষত্র জিজ্ঞেস করল,
-“আমাকে কোন দিক থেকে ‘আপু’ লাগে?”
প্রীতি যেন এবার কেঁদেই ফেলে,
-“আপনি কবে থেকে ডানাকাটা পরী হলেন?”
-“মানে?”
-“এ নামে কে সেইভ করে রেখেছে?”
-“কোন নামে?”
প্রীতি স্ক্রিনশট দিতেই নক্ষত্র উঠে বসল। এ কাজটা কার সেটা টের পেতেই বড়ো করে শ্বাস ফেলল। শান্ত গলায় টপিকটা পালটে ফেলল। বলল,
-“জ্বর এসেছে আবার?”
-“হু।”
-“রাতে ওষুধ নিয়েছ?”
-“না।”
-“খেয়েছ আর কিছু?”
-“না।”
-“কেন?”
-“এমনিই। আমার ইচ্ছা।”
-“তুমি কি সবসময়ই এমন?”
-“সবসময় না আসলে। মাঝেমধ্যে। মাঝেমধ্যে অনিয়মের সাথে সখ্য করতে হয়। নাহলে জীবন চলে না।”
প্রীতির দার্শনিক কথাবার্তায় নক্ষত্র ভ্রু-কোঁচকাল। জিজ্ঞেস করল,
-“আমি এখন তোমাকে কেন কল দিয়েছি, জানো?”
-“হ্যাঁ। অসুস্থ আমি। খোঁজ নিতে কল করেছেন। এমনিতেও আমাদের নাকি বিয়ে ঠিক হয়েছে। তো রাতে অসুস্থতার খোঁজ না নেওয়াটা অভদ্রতা হতো। এজন্য আর কী।”
নক্ষত্রের মনে একটা কথা এলো, আর মুখ দিয়ে বেরোল সম্পূর্ণ ভিন্ন আরেকটা,
-“উঁহু। কাপড়গুলো ভাঁজ করা হয়েছে কি না—তা জানতে।”
প্রীতি তাজ্জব বনে গেল। দ্বিধায় পড়ে জিজ্ঞেস করল,
-“আর আমার যে জ্বর এসেছে, সেটা?”
-“সেটা কী?”
-“মানে কিছুই না?”
-“উঁহুম, কিছুই না।”
প্রীতির খুব খারাপ লাগল,
-“আপনি এ কথা বললেন কী করে? কষ্ট পাচ্ছি। মাছি চচ্চড়ি করতে ইচ্ছে করার মতো কষ্ট পাচ্ছি।”
-“তোমার ইচ্ছের কথা শুনে আমার কী কাজ? তুমি বলো, কাপড় সব ভাঁজ করেছ ঠিকঠাক?”
-“হুহ! করেছি।”
-“গ্রেট। রান্না-বান্না পারো কিছু?”
-“কেন?”
-“কেন আবার? বিয়েশাদি করবে, রান্না না পারলে কী করে হয়?”
প্রীতি এবার রেগেই গেল। দাঁতে দাঁত চেপে বলতে লাগল,
-“পারি না মানে? খুব পারি। এমন পারার পারি, আপনার বাপ-দাদাও চমকে যাবে।”
-“হ্যাঁ। ওই তো। দুইগামলা ঘাস দিয়ে আস্ত গুইসাপ, তেলাপোকার চাইনিজ রেসিপি, মশা-মাছির চচ্চড়ি। এসবই পারো।”
এরকম একটা-দুটো কথায় প্রীতিকে রাগিয়ে দিতে নক্ষত্র ভীষণ ভীষণ আনন্দ পাচ্ছে। চোখ বন্ধ করে, ঠোঁটের কোণায় মুচকি হাসি নিয়ে ভীষণভাবে প্রিয় নারীকে টিজ করার মতো ব্যাপারটা আসলেই শব্দে বর্ণনা করার মতো না।
রাতটা কল্পনাতীত সুন্দর কাটলেও, অঘটন ঘটল পরেরদিন। আশকোনার ধারে। পর পর দুটো বড়ো চমক। প্রীতির মিশ্র অনুভূতি হতে লাগল। পালাক্রমে তাকাতে লাগল দুইজনের দিকে।
.
.
.
চলবে..............................................................