কামিনী - পর্ব ০৬ - মম সাহা - ধারাবাহিক গল্প


 রানির কক্ষ জুড়ে শুভ্র রঙের সুন্দর পায়রাটি উড়ে বেড়াচ্ছে। রানি তাকে খাঁচা থেকে বের হওয়ার সৌভাগ্য করে দিয়েছেন বলা যায়। 
উড়ন্ত পায়রাটির দিকে রানি তীর তাঁক করলেন। ঘুম থেকে উঠার ফলে রানির চোখ-মুখে তখনও ঘুমের আভাস জড়ানো। পায়রাটি কক্ষের এধার-ওধার উড়ে বেড়াচ্ছে বলে নিশানা সঠিক ভাবে তাঁক করা যাচ্ছে না। 
তন্মধ্যে যামিনী প্রবেশ করলো হুড়মুড়িয়ে। এসেই রানিকে তীর হাতে দেখে কিছুটা অবাকও হলো বটে। ওষ্ঠে মাখা মিষ্টি হাসিটিকে প্রশস্ত করে বলল,
"এত সুন্দর পায়রাটির দিকে নিশানা তাঁক করেছো কেন?"

রানি নিজের কাজে গভীর মনযোগ রেখেই উত্তর দিলেন, "অবশ্যই এই তীরটা মারার জন্য তাঁক করেছি, সখী।"

 "এত সুন্দর উপহারটি তোমাকে যে দিয়েছে সে নিশ্চয় বড়ো ভালোবেসেই দিয়েছে। তাহলে মারতে চাইছো কেন?"

তীরটা নিশানা থেকে সরিয়ে আনলেন রানি কামিনী। সখীর দিকে তাকিয়ে বাঁকা হেসে বললেন,
 "রানি কামিনীকেও আবার কেউ ভালোবেসে কিছু দিয়েছে না-কি কভু?"

"কভু দিয়েছে কি-না জানা নেই। তবে এবার দিয়েছে বৈকি।"

যামিনীর এত নিশ্চিত বাক্যে খানিক ভ্রু কুঁচকালেন রানি। ভ্রু বাঁকিয়ে শুধালেন, "তুমি কীভাবে বুঝলে এটা ভালোবেসেই দেওয়া হয়েছে?"

যামিনী এবার এগিয়ে এলো। আহ্লাদী ভঙ্গিতে জড়িয়ে ধরল রানির বাহু। ধীর স্বরে বলল, 
"যদি কেবল তোমার মন ভুলানোর জন্য দিতো তাহলে এই পায়রার জায়গায় উপহার থাকতো হিরে, জহরত কিংবা স্বর্ণের কিছু। কিন্তু তার বদলে রয়েছে এখানে একটি পায়রা। সুন্দর এই পায়রাটি কেউ মন ভুলানোর জন্য রানিকে নিশ্চয় দিবে না এতটুকু বুঝতে পারা খুব সহজ, সখী।"

 "আমার মনে হচ্ছে, এবার তোমার জন্য একটি রাজপুত্র শীগ্রই খুঁজতে হবে। তুমি ভালোবাসা নিয়ে খুব আহ্লাদী। একটি রাজপুত্র, যে তোমাকে ভালোবাসবে, তেমন খুঁজে পেতে হবে। যদিও আমার বিশ্বাস হয় না আদৌ পুরুষজাতি ভালোবাসতে পারে বলে।"
কামিনীর শেষ বাক্যটিতে একরাশ মন গড়া সংশয় যেন উদয় হলো। 

যামিনী আগের ন্যায় রানিকে জড়িয়ে ধরে রেখেই বলল, "আমি তোমায় ছেড়ে কোথায় যাবো, সখী? আমার তুমি ছাড়া কে আছে বলো!"

"আমি ছাড়াও যেন কেউ তোমার থাকে সেই ব্যবস্থাটা তো করতে হবে, সখী। আমার প্রাণের নিরাপত্তা আমি সর্বোচ্চ দিলেও, আমার কেন যেন মনে হয় আমি দীর্ঘদিন বাঁচবো না। হয়তো আমাকে মেরে ফেলা হবে। তখন তোমার কী হবে তা-ই ভেবে ভেবেই আমার মন ভড়কে যায়। তাই আমি তোমার একটি গতি করতে চাই।"

 "অমন করে কেন বলছো, সখী? তোমার প্রাণনাশের আশংকা থাকলে আমরা প্রয়োজনে আরও নিরাপত্তা বাড়াবো। সেনাপতি হ্যাব্রোকে বলো তোমার চারপাশের প্রহরী বাড়াবো।"

"প্রহরী! নাথানও আমার প্রহরী ছিলো। আর রেবেকা ছিলো খাসদাসী। বেইমানি কাছে থেকে, কাছের লোকেরাই করে, সখী।"

 "তা ভুল বলোনি।" কথাটা বলেই যামিনী হতাশ শ্বাস ফেলল। এরপর তার মনে একটি প্রশ্ন হুট করেই আগমন হলো। কিছুটা রয়েসয়ে বলল,
"আচ্ছা সখী, তুমি কীভাবে বুঝলে রেবেকা তোমার ক্ষতি চায়? ও কী করেছিলো?"

কামিনীর চোখে তখন খেলে গেলো ক্রোধ। উড়ে ঘুরে বেড়ানো পায়রাটির দিকে তাকিয়ে তার মনে পড়লো গতকালের সন্ধ্যার পরের কথা। যখন তিনি গ্রহাচার্যের বাড়ি থেকে নিজের জন্মকুণ্ডলী সম্বন্ধে জেনে বেরিয়ে ছিলেন। এরপর সেই অস্বাভাবিক অনুভূতি হওয়া। সেই বাঁশির সুর। সেই ঝর্ণা, ঝর্ণার ধারের অপরিচিত পুরুষ....

 "সখী, বললে না তো, কীভাবে বুঝলে তুমি রেবেকা তোমার ক্ষতি করতে চাচ্ছিলো?"

রানি কামিনী সেই রাতের পুরো বিশ্লেষণে গেলেন না। বললেন না এক বাঁশির সুর তাকে উন্মনা করে দিয়ে ছিলো। তিনি দিকভ্রান্ত হয়ে সেই বাঁশির সুরের পেছনে ছুটে গিয়ে ছিলেন। 
 কেবল বললেন,
"আমি গ্রহাচার্যের নিকট গিয়েছিলাম একটু প্রয়োজনে। ফেরার পথে আমাকে আক্রমণ করা হয়। কাল বা'হাতের যে ক্ষতটায় তুমি পরিচর্যা করে, দিয়ে ছিলো পথ্য লাগিয়ে, সেই ক্ষতটা তখনেরই। আমি তখন আমার চুলের কাটা তিনটে ছুঁড়ে মেরেছিলাম অপরাধী চেনার নিমিত্তেই। এবং আমার নাকে পরিচিত সুবাসও তখন লেগেছিল। আর তাছাড়া নাথানের সঙ্গে রেবেকার একটি প্রেমের গুঞ্জন প্রাসাদের ভেতর উঠেও ছিলো বেশ কিছুদিন আগে। প্রাসাদে ফিরেই তাই চোখ রাখলাম রেবেকার শরীরে। এবং খেয়াল করলাম ওর গলার নিচেই সামান্য কেটে যাওয়ার চিহ্ন বিরাজমান। এবং অবশ্যই এটি আমার কাটার চিহ্ন। ঐ কাটা কোথাও লাগলে কেমন ক্ষত হয় তা আমার অবগত ছিলো।"

"তুমি দুর্দান্ত, সখী। তোমার বুদ্ধিমত্তা সত্যিই প্রশংসনীয়।"

 যামিনীর অতি প্রশংসায় সামান্য হাসলেন রানি। কিন্তু মাথার ভেতর ঘুরতে লাগলো তার অন্য ভাবনা। কাল রাতের দেখা হওয়া লোকটিই আজকে পায়রা পাঠিয়েছে। কী যেন নাম ছিলো? রানি কিছুটা ভাবনায় জোর দেওয়ার পর মনে পড়লো, স্বর্গ। কিন্তু না স্বর্গ তো ছিলো না। মনে মনে কয়েকবার রানি আওড়ালেন 'স্বর্গ, স্বর্গ' বলে। এরপর আচমকাই তার মনে এলো, লোকটির নাম হ্যাভেন ছিলো। হ্যাঁ, হ্যাভেনই তো! রানির মনে খচখচ করতে লাগলো এই হ্যাভেন নামের অপরিচিত মানবটি। কে এই মানব? কী তার উদ্দেশ্য! 

এই ভাবনার মাঝেই বাহির থেকে হ্যাব্রোর কণ্ঠস্বর ভেসে এলো, 
"আসবো, রানি?"

 যামিনী রানিকে ছেড়ে দিলো হ্যাব্রোর গলা পেতেই। এরপর রানিকে তৈরি হতে বলেই চলে গেলো। রানি নিজের হাতের কাছে উড়ে বেড়ানো পায়রাটিকে ধরে আবার আটকে দিলেন খাঁচায়। হ্যাভেন সত্যি বলেছিল। কাছের কিছুর বুকে তীর নিক্ষেপ করা যায় না। ভীষণ কঠিন কাজ সেটা। রানি আশ্চর্য না হয়ে পারলেন না। একটি লোক যাকে রানি ভালো করে চেনেও না, সেই লোকটি কীভাবে রানিকে এত সুক্ষ্ম ভাবে বুঝলো? ব্যাপারটা যেমনটা আশ্চর্যের, তেমনটা অবিশ্বাস্যকর, এবং ততটাই সন্দেহের। 

নিজের ভাবনার বিরতি দিয়ে রানি হ্যাব্রোকে ভেতরে আসার নির্দেশ দিলেন। নত মস্তকে ভেতরে এলে হ্যাব্রো। রানিকে কুর্নিশ করে বলল,
"রানি, নাথানের মৃত দেহটাকে কী করবো সেটা জানতেই এসেছি।"

 "রেবেকার সংবাদ আগে চাই।"

"ওকে তো রাজ কারাগারে নিক্ষেপ করা হয়েছে।"

"ওর চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে?"

 "হ্যাঁ, হয়েছে।"

"ঠিক আছে, ওকে সুস্থ করে তোলার সর্বোচ্চ চেষ্টা যেন করা হয়। ওকে মরতে দিও না। বিশ্বাসঘাতকেরা এত দ্রুত এবং এত সহজে মরে গেলে হয় নাকি! ওদের মারতে হয় ধীরে ধীরে।"

 "ঠিক আছে, রানি।"

"নাথানের মৃতদেহটা দক্ষিণের নদীটায় ফেলে দিয়ে আসো। অনেকদিন হলো নদীর কুমির গুলো কিছু খাবার পাচ্ছে না।"

"যথা আজ্ঞা।" কথা শেষ করেই আবারও কুর্নিশ করে চলে গেলো হ্যাব্রো। রানি গিয়ে বসলেন নিজের বিশাল আরামকেদারায়। ভাবতে লাগলেন রাজ্য নিয়ে, রাজ্যের মানুষ নিয়ে। 

 ৮.

 রানি আজ রাজপ্রাসাদে নেই। সকালেই বেরিয়ে ছিলেন। রানির সাথে দেখা করতে এসেছে কয়েকজন লোক। খবরটি যামিনীর কাছে পৌঁছালো একজন প্রহরী। 
যামিনী ছিলো প্রাসাদের পেছনের পুকুরটির সামনে বসা। সেখানে রাজহাঁস কতকের বসতি। কী সুন্দর বড়ো বড়ো রাজহাঁস! যামিনীর খুব পছন্দের জায়গা এটা। তবে কেবল পুকুরটি নয় এই রাজপ্রাসাদের কোনায় কোনায় সৌন্দর্য। সখী যে সবটা কীভাবে এতটা সুন্দর আর নিখুঁত ভাবে তৈরি করেছে! পুরো রাজ্য জুড়েই কেমন স্নিগ্ধ, শান্ত ও পবিত্রতা ভাব। অথচ প্রজাদের চোখে রানির এই কৃতিত্ব নেহাৎ সামান্য। তাদের কাছে রানির রাগ, জেদ, তেজই সব।

রানির খোঁজে প্রাসাদে কেউ এসেছে কথাটি শুনেই যামিনী প্রাসাদে এলো। বিরাট বৈঠকখানার একদিকে দু'জন লোককে বসে থাকতে দেখা গেলো। যামিনীকে দেখতেই লোক দু'জন দাঁড়িয়ে গেলেন। 
 যামিনী এসে বেশ বিনয়ের সঙ্গেই উনাদের বসতে বললেন। দাসীকে ডেকে তাদের জন্য কিছু খাবারও পাঠাতে বললেন। এরপর লোক দু'টোর উদ্দেশ্যে প্রশ্ন ছুঁড়লেন,
"রানির সাথে কি দরকারী কথা ছিলো আপনাদের?

দু'জন মাথা নাড়ালেন। তাদের মাঝে একজন বললেন, " আমরা রানির কাছে দরকারেই এসে ছিলাম।"

যামিনী বলল, "কী দরকার? আমাকে বলুন।"

 "আসলে এ বছর আমাদের খাজনা দিতে একটু বিলম্ব হবে। বাণিজ্যে তেমন লাভ দেখা যাচ্ছে না। সে জন্য রানিকে বলতে এসেছিলাম যেন আমাদের কিছুটা সময় দেওয়া হয়।"

যামিনী স্থির ভঙ্গিতেই শুনলো কথাগুলো। কিয়ৎক্ষণ চুপ থেকে বললেন, 
"তাহলে এক কাজ করুন, আপনারা সময় নিন। প্রয়োজনে পরের রাজস্বের সাথে মিলিয়ে একসাথে দিবেন।"

যামিনীর প্রস্তাবে কৃতজ্ঞতায় চোখ চকচক করে উঠল দু'জনেরই। উনারা দু'জনই জয় জয়কার করলেন যামিনীর। 
একজন বললেন, "আপনি মহান।"
আরেকজন প্রশংসা আরেক ধাপ উপরে তুলে বললেন, "আপনি আমাদের রানি হলে কতই না ভালো হতো!"

 যামিনী হাসলো। নম্র ভাবেই বলল, "আপনাদের রানি আমার থেকে দ্বিগুণ ভালো। কেবল তাকে আপনারা বুঝতে পারেন না।"

দু'জন তবুও ইনিয়েবিনিয়ে বুঝালেন রানির চেয়ে যামিনী দশগুণ ভালো। তাদেরকে বসতে বলেই বেরিয়ে এলো যামিনী। সিঁড়ির গোড়ায় আসতেই হ্যাব্রোর সাথে দেখা হলো তার। হ্যাব্রোর চোখ-মুখ টান টান। যামিনী হ্যাব্রোকে পেছনে রেখে দু'কদম এগুতেই হ্যাব্রো বলল,
 "আপনার রাজস্বের ব্যাপারে এমন সিদ্ধান্ত দেওয়া উচিত হয়নি।"

থেমে গেলো যামিনী। ঘাড় ঘুরিয়ে বরাবরের মতনই ঠোঁটে হাসি বজায় রেখে বলল, "সিদ্ধান্ত তো কিছু একটা দিতে হতো তাই না!"

 "সেটা রানির দেওয়ার কথা, আপনার নয়।"

 "কিন্তু সখী এখন তো মহলে নেই।"

 "মহলে নেই কিন্তু এসে তো পড়তেন।"

 "ততক্ষণ কি উনারা অপেক্ষা করতেন?"

 "পরে আসতে বলতেন। তাছাড়া উনাদের দরকারে উনারা সারাদিন অপেক্ষা করতেও রাজি। দরকারটা উনাদের এটা মনে রাখতে হবে।"

যামিনী এবার পূর্ণ দৃষ্টিতে অবলোকন করলো হ্যাব্রোকে। হ্যাব্রোর কড়া কড়া কথায় যামিনীর হাসি ততক্ষণে কিছুটা দমে এসেছে। সে বলল,
 "সখী নেই বলেই আমি সিদ্ধান্তটা জানিয়ে দিয়েছিলাম। এতে তো সমস্যা নেই।"

"রানির অবর্তমানে কেউ সিদ্ধান্ত জানানোর ক্ষমতা রাখেন না। আর যদি কিছু বলতে হয় তবে সেটা মন্ত্রী বলবেন তাও যদি রানি এই অনুমতি দিয়ে থাকেন তবেই। আপনি নন। কারণ রাজস্ব, রাজকোষ কিংবা রাজ্য নিয়ে আপনাদের ধারণা নেই। আপনার একটি সিদ্ধান্ত রাজ্যের জন্য ক্ষতি বয়ে আনতে পারে। সিদ্ধান্ত যদি সবাই নিতে পারতো তাহলে আর রানি ডাকটির তাৎপর্য রইলো কোথায়!"

যামিনীর গালে যেন সপাটে চড় বসালো কেউ। কিছুটা রাগান্বিত ও অপমানিত বোধ করলো সে। ক্ষুব্ধ স্বরে বলল, 
 "আমার সাথে এভাবে কথা বলার অপরাধে তোমার কী হতে পারে জানো?"

 "সে যা-ই হোক, সত্য বলতে আমি কখনো পিছপা হই না। আপনার এতদিনে এতটুকু ধারণা হওয়া উচিত ছিলো।" 
কথা শেষ করেই হ্যাব্রো প্রস্থান নিলো। না কোনো কুর্নিশ করলো আর না কোনো তোষামোদ। হ্যাব্রোর যাওয়ার পথে তাকিয়ে রইলো যামিনী। চোখে তার জল জমেছে। 

*

 এ্যাজেলিয়া রাজ্যের বাহিরে একটা জায়গা আছে যেটার নাম- অন্ধকুটির। জায়গাটি বেশ অনেকটা অনেকটা জায়গা জুড়ে। এই অন্ধকুটিরে আনাগোনা হয় অনেক রাজ্যের রাজাদার। তাদের যৌন পিপাসা মেটানোর একটি অন্যতম জায়গা হলো এই অন্ধকুটির। 
রানি কামিনী সেই অন্ধকুটিরেই এসে উপস্থিত হলেন। সাদামাটা তার পোশাক। তিনি যে কোনো একটি রাজ্যের রানি তা বোঝার উপায় নেই তার বেশভূষায়। তবে হোক রানির বেশে কিংবা সাধারণ রমনীর বেশে, সবসময় তাকে দেখা যায় স্বর্গের অপ্সরাদের মতন। কী অপরূপ রূপের শোভা! কী মোহনীয় তার চোখের টানা। কী মায়াময় তরঙ্গিণী তার কেশ গুচ্ছে! এমন অপরূপ সুন্দর মানুষ এই পৃথিবীতে আর দ্বিতীয়টি নেই বোধহয়। 

 রানি অন্ধ কুটিরের সাত নাম্বার ঘরটিতে প্রবেশ করলেন। বিনা অনুমতিতে কক্ষটিতে প্রবেশ করে তিনি দুয়ারটাও আটকে দিলেন।
কক্ষটির বড়ো বিছানার একদম মধ্যিখানে বসে আছেন অন্ধকুটিরের মালকিন আনারকলি। চোখে গাঢ় সুরমা দেওয়া। চুলের বেণীগাঁথনে আটকে আছে একটি ফুলের মালা। বেশ মোটাসোটা শরীর মহিলার। স্থুল আকৃতির মুখটিতে একদম গোল। রানিকে দেখেই ভদ্রমহিলা উঠে এলেন। বেশ আনন্দিত স্বরে বললেন,
"আরেহ্, রানি কামিনী যে! এবার অনেকদিন পর এলেন তো!"

আনারকলি হাসলেও, হাসলেন না রানি। মুখ রইলো তার চিরকালের মতনই গম্ভীর। স্তব্ধ স্বরে বললেন, 
"যার জন্য এসেছি তার কোনো খোঁজ পেয়েছেন কি?"

 রানির প্রশ্নে আনারকলি গদোগদো হাসলেন, "খোঁজ পেলে কি আর আপনাকে না বলে থাকতাম নাকি!"

"দীর্ঘ এতগুলো বছর যাবত খোঁজ নিচ্ছি আর আপনি খোঁজ দিবেন দিবেন করে আমাকে ঘুরিয়েই যাচ্ছেন। আদৌ খোঁজ দিতে পারবেন তো?"

আনারকলি ব্যস্ত কণ্ঠে বললেন, "পারবো, পারবো। এই অন্ধকুটির থেকেই তো মেয়েদের কেনা-বেচা হয়। রাজারা এমন অনেক মেয়ে আছে যাদের কিনে নিয়ে যান। এরপর মন ভরে গেলে আবার ফেরত দিয়ে যান।"

 "থামুন। এতকিছু শুনতে চাইনি।"

"শুনতে না চাইলেও, বলা তো আমার কর্তব্য তাই না! তাছাড়া আপনি যার খোঁজে আসেন তারও তো আর কম রূপ না। হয়তো এখনো যে রাজা নিয়েছেন তার তৃষ্ণা মিটছে.... "

বাকি কথা সম্পন্ন হওয়ার আগেই রানি গলা চেপে ধরলেন আনারকলির। রেগে গেলেন প্রচন্ড। নিজের সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে আনারকলির গলা চেপে ধরে রেখেই বললেন,
"যতটুকু বলেছেন অতটুকুতে না থামলে এখুনি আপনার গলা চেপে মেরে ফেলবো। রানি কামিনীকাঞ্চনকে নিয়ে আপনার ধারণাও নেই।"

আনারকলির নামের মহিলাটির প্রায় চোখ-মুখ উল্টে এলো। আপ্রাণ চেষ্টা করলো ছাড়া পাওয়ার। রানি ছেড়ে দিলেন মহিলাকে। ছেড়ে দিলেনই কেবল নয়, প্রায় ছুঁড়ে মারলেন বলা যায়। 
ছাড়া পেয়ে আনারকলি প্রাণ ভরে শ্বাস নিলেন। হাঁফাতে হাঁফাতে বললেন, "মার্জনা করবেন, রানি। আর কখনো বলবো না।"

রানি আর কথা না বাড়িয়ে একটি স্বর্ণমুদ্রার ছোটো থলে ছুঁড়ে মারলেন বিছানায়। বজ্রকণ্ঠে নির্দেশ দিলেন,
 "সেই মহিলার খোঁজ পেলেই কালবিলম্ব না করে আমাকে জানাবেন। আর তার খোঁজ দিতে পারলে জানেনই তো কী হবে!"

"জানি জানি, রানি। আপনার এ্যাজেলিয়া রাজ্যে গণিকালয় খোলার অনুমতি এবং জায়গা দিবেন।"

 "একদম।" কথাটি বলেই রানি বের হয়ে যাওয়ার জন্য উদ্যত হতেই আনারকলি বললেন,
"একটা কথা জিজ্ঞেস করবো, রানি?"

রানি কামিনী সেই শক্ত দৃষ্টিতে তাকিয়েই বললেন,
 "অদরকারী হলে বলার প্রয়োজন নেই।"

আনারকলি তবুও বললেন, "আপনার যেই পবিত্র রাজ্য তা পৃথিবীতে আর একটিও আছে বলে আমার জানা নেই। গণিকালয় দূরে থাক, নারীদের নিয়ে সামান্য তিল থেকে তাল হলে যেই রাজ্যে শাস্তি হয় গুরুতর এবং বাইজিঘর অব্দি যে রাজ্যে রাখা হয়নি সেই রাজ্যে আপনি গণিকালয় করার অনুমতি অব্দি দিতে রাজি কেবল একটি নারীকে পাওয়ার জন্য! কে সেই নারী?"

রানি ভেতর ভেতর এই আশংকাতেই ছিলেন। তবে উপর দিয়ে উনি রইলেন কঠিন। উত্তর না দিয়ে বেরিয়ে এলেন চুপ করেই। কে সেই নারী এই উত্তর কী তিনি জানেন আদৌ? জানেন না। 
 সব উত্তর, জীবনের মানে খোঁজার জন্যই তো তিনি হন্যে হয়ে খুঁজছেন মানুষটাকে। হয়তো এই মানুষটাকে পাওয়ার জন্যই তিনি বেঁচে আছেন। তার জীবনের এই একটি লক্ষ্যের জন্যই তো তার বেঁচে থাকা। নয়তো প্রজাদের এত ঘৃণা, নিজের প্রতি নিজের এত ঘৃণা নিয়ে তিনি কি আদৌ বাঁচতেন?
.
.
.
চলবে.............................................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন