নির্মোচন - পর্ব ০৯ - ফাবিয়াহ্ মমো - ধারাবাহিক গল্প


অমীমাংসিত প্রশ্নের কাছে বসে আছে সাঈদ। যার কোনো সূত্রপাত এখনো ধরতে পারেনি। কী হয়েছিল সেদিন রাতে, কী এসেছিল জানালার কাছে, এটা বুঝার জন্য ঘন্টাখানিক ধরে মাথা খাটাচ্ছে সে। বাঁ-হাতে কালো মার্কার, সামনে একটি ক্যানভাসে খাটানো আয়তাকার সাদা বোর্ড। বোর্ডের ঠিক মাঝ বরাবর লম্বা রেখা টেনে দু'অংশে বিভক্ত করা হয়েছে। ডানপাশে বড়ো বড়ো অক্ষরে ' INCIDENCE ' লেখা, আর বাঁ-পাশে লেখা ' CLUES '. এ দুটোর ছকের মাঝে কাজ করছে এখন। চোখের তীক্ষ্মদৃষ্টি সাদা বোর্ডের উপর বিঁধে আছে, বাঁ-হাতের আঙুলে-আঙুলে খেলা করছে মুখ খোলা মার্কারটি। মস্তিষ্কের প্রতিটি নিউরন যেন সচল কার্যক্ষমতা চালিয়ে গভীর কিছু ভাবছে এখন। কারা লেগেছে ওর পেছনে এবং সেটা কী জন্য? একজন সদ্য কলেজ পড়ুয়া শিক্ষার্থীর পিছে হুঁশিয়ারির কারণ কী? কিছু একটা সাংঘাতিক কাহিনি সন্তপর্ণে লুকিয়ে-ছুপিয়ে আছে। গা ঢাকা দেওয়া গুপ্তচরের মতো কাজটা করছে কেউ। এভাবে পাক্কা খেলোয়াড়ের মতো কাজটা করা সাধারণ ব্যক্তির পক্ষে সম্ভব না। এটার জন্য প্রয়োজন বুদ্ধি, ধৈর্য এবং কলাকৌশল পাকানোর মতো ক্ষিপ্র চিন্তা। উপস্থিত বুদ্ধি তো আছেই, সঙ্গে চালাকির সাথে চালটাও বিদ্যমান। হঠাৎ ' ঠক ঠক ' করে ঘরের দরজায় শব্দ হলো। সচেতন হয়ে সাদা বোর্ডটার উপর পর্দা ফেলল সাঈদ। হাতদুটো কোমরের পেছনে আবদ্ধ করতেই মার্কারের দৃশ্যটুকু আড়াল করে ফেলল। দরজার দিকে অনুমতির ভঙ্গিতে ক্ষমতাবান ব্যক্তির মতো বলল, 

  - কাম ইন। 

দরজা ঠেলে উঁকি দিলেন সুফিয়া। সহজাত মিষ্টি হাসি দিয়ে মিষ্টি সুরে বললেন, 

  - বাবা কী ব্যস্ত আছনি? 

এই একটা মানুষের কাছে কখনো দম্ভপূর্ণ আচরণ করে না সাঈদ। মন থেকে গভীর শ্রদ্ধা করে সে। ঠোঁটে মৃদু হাসির ছটা টেনে ভেতরে আসতে বলে, 

  - আসুন। আপনার জন্য অবশ্যই ফ্রি আছি। বলুন, কী বলতে এসেছেন। 

সুফিয়া দরজা ছেড়ে ভেতরে ঢুকে বলেন, 

  - তুমি কী ফিহার ব্যাপারডা ইট্টু দেখবা? মাইয়াটার উপর কোন জাlনোয়াlর জানি কুনজর দিছে। ওর বাড়িতে কে জানি চোরের মতো আইছিল। আমার তো শুইনা ডর করতাছে সাঈদ। যুগ জমানা ভালা না, আবার মাইয়াডাও জোয়ান। কহন কী হইয়া যায় কওন তো যায় না। এই বাড়িতে এহনো সমস্যা দেহা নাই, কিন্তু ঘটতে কতখন? 

সাঈদ স্পষ্ট সুরে জানাল, 

  - আপনি কী চাচ্ছেন ওর ব্যাপারটা নিয়ে আমি কিছু করি? 

সুফিয়া দেরি না ল বললেন, 

  - হ। এইডাই চাইতাছি। তুমার উপর চোখ বন্ধ কইরা বিশ্বাস করতে পারমু। এহন কথা হইল গিয়া তুমি কী কাজটা করবা? 

  - আমি পুলিশের লোক না খালা। সাধারণ একটা জব করা মানুষ আমি। এ ধরনের প্রবলেমের জন্য পুলিশ-র‍্যাব আছে। আপনি আপনার মাননীয় আপাকে বলুন সে যেন সোর্স খাটিয়ে কোনো একটা ব্যবস্থা করে দেন। আমি এসবের জন্য কিছু করতে পারব না। 

সুফিয়া রুষ্ট হলেন। অনেক আশা নিয়ে সাঈদের কাছে হাজির হয়েছেন। এই সমস্যাটার কূলকিনারা ধরবার জন্য চৌকশ বুদ্ধি প্রয়োজন, যেটার জন্য তিনি এখন পযর্ন্ত শুধু সাঈদের মধ্যেই দেখে আসছেন। সুফিয়া আরো একবার মুখ তুলে আকুতির স্বরে বললেন, 

  - বাবা, দ্যাখ আমি কিন্তু শুদু শুদু চিন্তা করতাছি না। তুমি এইডাও ভালা কইরা জানো তোমার সুফি খালা বেহুদা জায়গায় সময় নষ্ট করনের মানুষ না। বিরাট কোনো কাহিনি না হইলে আমি মুখ বন্ধ কইরা সইরা যাইতাম, কিন্তু নাবিলার কথা হুইনা মনডার ভিতর কু ডাকতাছে। কোন চাlমাlরের বাlচ্চায় কামডা করতাছে হেইডা তো জানি না। জ্বিiন-আiত্মা হইলে এইসব অকাম করব এইডাও হুদা কথা। জ্বিlনেরা আইলে শরীর অসুস্থ কইরা দেয়। ইচ্ছা হইলে মাlইiরা ফালাইব, নাইলে অন্য কুনো কাম কইরা যাইব, কিন্তু ওর কথা শুইনা মনে হইতাছে এইহানে জটিল কিছু লুকায়া আছে। পুlলিlশের কাছে গেলে যদি মীমাংসা হইয়া যাইত, আমগোর গেরামে তিন খুiনেiর মামলায় আiসাiমীরে খালিহাতে ছাইড়া দিতো না। 

সুফিয়া নিজের মতামত জানিয়ে কাঙ্ক্ষিত ব্যক্তির দিকে উত্তরের জন্য তাকিয়ে আছেন। আজও তার মুখটা সদাসর্বদার মতো নীরব। এটাকে বিচক্ষণতার কথা না বলে চিন্তাশীলতার কথা বললে বোধহয় খাপে খাপ মানায়। সাঈদ এখন চিন্তাই করছে অবশ্য। সুফিয়ার দিকে আরো কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে স্পষ্ট সুরে জানাল, 

  - খুবই দুঃখিত। এই ধরনের কর্মকাণ্ডের প্রতি আমার বিশেষ কোনো আগ্রহ নেই। এই মূহুর্ত্তে অফিসের কিছু ম্যাটার নিয়ে আমি বেশ ঝামেলার মধ্যে আছি। তাই কিছু করতে পারছি না খালা। আপনার আপা একজন রিনাউন্ড বিজনেসের মোস্ট পাওয়ারফুল ব্যক্তি। তার হাতে এমন কিছু কানেকশন নিশ্চয়ই আছে যেটা দ্বারা আমার চাইতেও দ্বিগুণ কাজ করার ক্ষমতা রাখেন। আমার মতো নরমাল একজন চাকুরীজীবি ছেলের পক্ষে এগুলো দেখা সম্ভব না। 

পরাস্ত মুখে নিভে গেলেন সুফিয়া। আশাহত চোখে আর কিছু না বলে বেরিয়ে গেলেন তিনি। অকপটে আচরণটার জন্য মনে মনে খারাপ লাগাটা বেড়ে গেল সাঈদের। নিঃশব্দে শ্বাস ছাড়তেই সাদা বোর্ডটার দিকে ঘুরল। আগে সে যাচাই-বাছাই করবে, প্রমাণ দাঁড় করাবে, কারণ উদঘাটন করবে, তারপর বিষয়টা সুফিয়ার কাছে বলতে যাবে। তার আগে তো অবশ্যই নয়।

•••••••••••••

রাতের খাওয়াটা একটু আগে শেষ হয়েছে সবার। সবাই এখন নিজ নিজ ঘরে শুয়ে বিশ্রাম নিচ্ছে। আলোগুলো জ্বলছে ঠিকই, কিন্তু ঘুমের জন্য প্রস্তুত হয়নি। ফিহা হোমওয়ার্কের লেখাগুলো শেষ করে টেবিল থেকে কেবল উঠতে যাচ্ছিল, তখনই খাতার পাশে জোরে জোরে ফুল সাউন্ডে মোবাইল ফোনটা বাজতে লাগল। রি রি করে বিদঘুটে শব্দটা বন্ধ করে ফোনটা কানে চাপল সে। রুমের দরজাটা বন্ধ করে বিছানা ঝাড়তে ঝাড়তে বলে, 

  - কী রে? সূর্য কোনদিকে উঠল? আজ তুই আমাকে কল দিয়েছিস? আমার কিন্তু বিশ্বাসই হচ্ছে না! আচ্ছা বল, কেমন আছিস? কলেজে যাস? 

কলটা দিয়েছে সাফা। ফিহার একমাত্র কাছের এবং প্রাণপ্রিয় বান্ধুবী। সাফা কথা শুনে বেজার মুখে বলল, 

  - তুই তো নবাবজাদির বেটি! তুই আমাকে কল দিবি কেন? তুই তো আমাকে ভুলেই গেছিস। খালার বাসায় যে গেলি একটাবার কল দিয়ে বলেছিস কেমন আছস দোস্ত? তোদের মতো কিছু জোlচ্চোlর ফ্রেন্ডের জন্য ফ্রেন্ডশিপটা এখন ব্রেকআপের মতো ফিল দেয়। 

ফিহা বুঝতে পারল সাফা রেগে আছে। অথবা কোনো কারণে বফের সাথে খটোমটো কিছু চলছে। সে হাসি দিয়ে বলল, 

  - অতো চেতিস কেন? আমি কী ইচ্ছে করে কাজটা করেছি? এখানে এসে সবকিছু গোছগাছ করতে করতেই সময় তিরতির করে চলে যায়। টেরই পাই না কখন সকাল হলো, আর কখন রাত। আচ্ছা শোন, কলেজে কিছু বলেছে? 

সাফা কোমর বেঁধে বলার জন্য উদগ্রীব হয়ে বলল, 
 
  - সেজন্যই তো তোকে বেহাiয়ার মতো আমি-ই ফোনটা দিলাম। তুই এক খাiটাiশ ফোন তো দূরে থাক, কবে যে খালার বাড়ি টপকালি সেইটাই বললি না। সে-কথা বাদ দেই এখন। যেজন্যে কল দিয়েছি সেটা শোন, কলেজ থেকে আগামী বুধবারে নবীনবরণের আয়োজন করছে। বিশাল বড়ো আয়োজন। কলেজের বড়ো গেট থেকে শুরু করে ভেতরের ছোটো গেট পযর্ন্ত বাঁশ টাঙিয়ে সাজাচ্ছে। এবার নাকি আমাদের কলেজে জেলা পরিষদের লোকজন আসবে, সেজন্য হেড ম্যাডাম তাদের জন্য হেব্বি প্রস্তুতি নিচ্ছে। আমি একটু আগে সুবর্ণা, রিমা আর ইলার সাথে কথা বললাম। সবাই শাড়ি-টাড়ি কেনার জন্য এখনই লিস্ট করে ফেলল। আমাদের পাঁচজনের গ্যাংটা কিন্তু শাড়ি পড়বে। এর মধ্যে তুইও শামিল। কী রে, তুই শাড়ি পড়বি না? 

ধন্দে পড়ল ফিহা। এই জীবনে শাড়ি নামক বস্তুটির সাথে একেবারেই যোগাযোগ হয়নি। এমনকি ফিমাও শাড়ি পরাটা নিয়ে ব্যাপক নাক ছিঁটকায়। শাড়ির মতো ফালতু অসহ্যকর পোশাক দ্বিতীয়টা হয় না, এটা নাকি মেয়েদের জন্য একপ্রকার অত্যাচার। ফিহা দ্বিধাগ্রস্তে বলল, 

  - আমি তো শাড়ি-টাড়ি কিছু আনিনি। তাছাড়া আমার তো কোনো শাড়িও নেই। শাড়ি না পড়লে হয় না? 

জোর দেখিয়ে বলল সাফা, 

  - চiড় লাগাব! পড়বি না মানে? আমরা সবাই শাড়ি পরে যাব আর তুই বসে বসে মুড়ি খাবি? তোর বড়োলোক খালাকে বল, এক্ষুণি একটা লাল টুকটুকে শাড়ি কিনে দিতে। সঙ্গে দু'মুঠো রেশমি চুড়ি। কানে মাঝারি সাইজের ঝুমকা। মাথায় পড়ার জন্য আর্টিফিশিয়েল ফুলের মুকুট। যা, এটুকু খালার কাছে যেয়ে বল। তোর খালা না তোকে মেয়ের মতো আদর করে? তাহলে এটুকু করতে সমস্যা কী? 

 ফিহা নারাজ গলায় বলল, 

  - আমি পড়ব না সাফা। প্লিজ এসব নিয়ে খামোখা লেকচার দিস না। খালামনি আমাকে আদর করে বলে তার কাছে এসব চাইতে হবে? এগুলো কী ধরণের লজিক? সে আমাকে আদর করে বলে শাড়ি কিনে দেওয়ার সাথে সম্পর্ক কী? আমি কী আজাইরা জিনিস দিয়ে তার ভালোবাসা মাপব? 

সাফা একটু দমে গেল। ভুল একটা কথা বলে ফেলেছে সে। কেন যে সঠিক কথাটা বলতে যেয়ে অন্য বাক্য বলে ফেলে! সাফা শুধরানো গলায় বলল, 

  - দ্যাখ, আমি সেটা বলছি না। আমি শুধু বলেছি খালা তো আমাদের আপন মানুষ। তাদের কাছে কিছু চাইতে তো কোনো ক্ষতি নেই। তাছাড়া আমিও তো আমার খালার কাছ থেকে প্রত্যেক ঈদে ঈদে জামাকাপড় নিচ্ছি। সেখানে তুই আবার শেলফ রেসপেক্ট বজায় রেখে এসবের আবদার করতে যাস না, সেটা তোর সমস্যা। কিন্তু এবার তো অকেশানটার উছিলায় কিছু বলতে পারিস। আমরা খুব এক্সাইটেড হয়ে শাড়িটা পড়তে চাইছি দোস্ত। প্লিজ রাজি হয়ে যা। খালামনিকে বল কাজটা করে দিতে, অথবা আমার এখান থেকে আম্মুর একটা শাড়ি চুজ করে যা। দুইটা অপশন দিচ্ছি ফিহা। ভেবে দ্যাখ কোনটা তোর জন্য বেষ্ট হবে। আজ রবিবার যাচ্ছে। অকেশানটা বুধবারে। এইটুকু সময়ের ভেতর ডিসিশানটা নিয়ে ফ্যাল। 

দ্বিধায় পড়ল ফিহা। চট করে শাড়ি পরার কথাটা বলবে কিনা বুঝতে পারছে না। একবার হলেও ব্যাপারটা নিয়ে খালামনি বা বড়ো আপুর সাথে খোলামেলা কথা বলা দরকার। ফিহা ঠোঁট কামড়াতে কামড়াতে বিছানা ঠিক করে বলল, 

  - তোকে আমি কাল বলি? আজ একটু ভাবতে চাচ্ছি। চট করে বলে দিলে পরে দেখা গেল বিরাট সমস্যায় পড়লাম। আমি তো কোনো শাড়ি আনিনি। আবার ফিমা আপুও শাড়ি-টাড়ি পড়া নিয়ে খুব তাচ্ছিল্য করে। সবটা ভেবে দেখি কী করা যায়। 

  - ঠিক আছে, কালই জানা। বেশি দেরি করিস না। সবকিছু কনফার্ম থাকলে টাইমটাও ফিক্সড করে দিস। কখন রওনা দিবি সেটাও বলে দিলে তোর জন্য নারায়ণগঞ্জ আসতে ইজি হবে। 

  - আচ্ছা আমি জানাব। আমি খালামনির সাথে কথা বলে দেখছি। এখন তাহলে রাখি। কাল সকালের দিকে কল দিচ্ছি। আল্লাহ্ হাফেজ। 

কলটা কেটে দিয়ে দারুণ চিন্তায় পড়ল ফিহা। এ কী মসিবত! কলেজে নবীনবরণ হবার কথা প্রায় বাতিলই ছিল, মেয়েরাও আশাভঙ্গ করে মনঃক্ষুণ্ণ হয়ে এসব নিয়ে খুব রাগারাগী করেছিল। আজ সেখানে আবার হুট করে আয়োজনটা করছে কলেজ? ফিহা বোনের সাথে আলোচনার জন্য ফিমার রুমের কাছে ঠকঠক করে বলল, 

  - আপু, আসব? 

ভেতর থেকে বিরক্তির গলায় উত্তর আসলো,

  - আয়। 

ফিহা ভেতরে ঢুকতেই দেখল, ফিমা মুখে শীট মাস্ক লাগিয়ে আলগা মুখোশের মতো পাতলা কিছু পড়ে আছে। চোখের বন্ধ পাতায় দুই টুকরো শসা রাখা, ফ্যানের নীচে নিবিষ্ট মনে রাত্রিকালীন রূপচর্চা করছে। ফিহা সামনে গিয়ে ভূমিকা ছাড়াই আসল কথাটা বলল, 

  - একটা ব্লান্ডার হয়ে গেছে আপু। কলেজে নাকি নবীনবরণ হবে। আমার সব বান্ধুবিরা এখন শাড়ি পড়ে কলেজে যাবে, আর আমি কখনো শাড়ি-ই পড়িনি। এখন কী করব আপু? আমার তো কোনো শাড়ি নেই। 

ফিমা সবগুলো কথাই দু'কানে শুনতে পেল। নিরুত্তাপ স্বরে দাপটের সাথে বলল, 

  - যাওয়ার দরকার নেই। বাসায় থাকবি। বেলাiল্লাiপনা করার জন্য কলেজের মাঠে কী করতে যাবি সেটা আমার জানা আছে। ওই কাiলিভূiত সাফার বাiচ্চাকে বলে দে, তুই কোথাও যাচ্ছিস না। 

আবারও কর্ণকুহরে ' কাiলিভূiত ' সম্বোধনটা শুনে কষ্ট পেল ফিহা। মানুষের গায়ের রঙটা চাপা বলে এভাবে ছোটো করার মানে আছে? কেন যে ফিমা আপু ইডেনের মতো ভালো একটা প্রতিষ্ঠানে পড়াশোনা করা সত্ত্বেও এরকম বিশ্রী ধরণের মন-মানসিকতা পুষে রাখে! ফিহা সেখানে একটাও কথা বলল না। বলার জন্য যে পরিমাণ আগ্রহ নিয়ে এসেছিল, তা বান্ধুবীর নামে অপমানজনক কথাটা শুনে চলে গেছে। ফিহা রুম থেকে যেতে যেতেই হঠাৎ মুখটা রাগারুণ করে বলল, 

  - শোনো, তোমার ভেতর লজ্জার সেন্সরটা বাজেভাবেই নiষ্ট আপু। এভাবে অশিক্ষিতের মতো মন্তব্য শুনে তোমাকে আমার ম্যাচিউর বলে মনে হচ্ছে না। নিজের মুখে রূপচর্চা করছ ঠিকই, কিন্তু অন্যের গায়ের রঙ নিয়ে কীভাবে কথা বলছ? শিক্ষিত আর অশিক্ষিতের মধ্যে যে ফারাকটুকু থাকে, তা বোধহয় তোমাদের মতো মেয়েদের জন্য বোঝা যায় না। 

আচানক উদ্ভট কথার মুখোমুখি হয়ে ফিমা শষা নামিয়ে তাকাল। দরজার দিকে ভ্রুঁকুটি করে তাকাতেই ততক্ষণে ফিহা চলে গেছে। মুখটা বিকৃত করে শীট মাষ্কটা একটান মেরে তুলে ফেলে। সজোড়ে সেটা নিক্ষেপ করল ফ্লোরে। শূন্য দরজার দিকে কেমন ক্রোধের চোখে তাকিয়ে আছে, তা যদি একবার জানতে পারতো ফিহা, তাহলে বুঝতে পারতো নিজের ফিমা আপুটা কষ্মিনকালেও তাকে দেখতে পারে না। মনে মনে ঝাঁজালো, মন্দ বাক্যগুলো দাঁত খিঁচিয়ে বলল, 

' শয়iতাiন কোiথাiকার! তুই আমাকে সেন্সর শেখাতে এসেছিস? দুটো মিনিট এখানে দাঁড়িয়ে থাকলে তোকে সেন্সরের ভাষাটা বুঝিয়ে দিতাম জানোয়ার! '

••••••••••••••

মুখটা বিবর্ণ, ক্ষুণ্ণ ও ভারাক্রান্ত করে চলে এলো ফিহা। কাউকে তুচ্ছ করতে মানুষের কী আনন্দই না লাগে! ধিiক্কার ওইসব মানুষকে, যারা অন্যের বাহ্যিক রঙটা দেখে তাচ্ছিল্য করার হিম্মত রাখে। কতটুকু নির্লজ্জ হলে একটা মানুষকে উiগ্র সম্বোধন করতে আনন্দ পায়? একটা ঘটনা হঠাৎই মনে পড়ে গেল ফিহার। সেদিন এসএসসি পরীক্ষার রেজাল্ট দিয়েছে বলে ফিহা হাসিখুশি আনন্দে সাফাকে সঙ্গে নিয়ে নিজের বাসায় আসে। দুই বান্ধুবী টিভির রুমে তখন সোফায় বসে গল্পগুজবে ব্যস্ত ছিল। এমন সময় কোত্থেকে ফিমা তার আধুনিকা ছলাকলা নিয়ে সেখানে উপস্থিত হয়। কোনোরকম সংকোচ ছাড়াই এমন অপমানজনক কথা বলে, সেদিনের পর থেকে আর কোনোদিন সাফা ওদের বাসায় যায়নি। কী লজ্জার ব্যাপার! ফিহা নিজের রুদ্ধ অবস্থা ও খারাপ লাগাটা সহজে ফিমার কাছে প্রকাশ করে না। বড়ো বোন বলে যেটুকু সম্মান ও শ্রদ্ধাবোধ থাকা প্রয়োজন তার জন্য কড়া ভাষায় কিছু বলার জন্য নিজেরই রুচিতে বাঁধে। আজ কেন যে অতগুলো শক্ত কথা বলে এসেছে তা সঠিক জানা নেই। এক বোতল পানি আনার জন্য সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে ওসব চিন্তা করছিল ফিহা, হঠাৎ শেষ ধাপে পা ফেলতে গিয়ে ডাইনিং টেবিলের দিকে নজর পড়ল। একা একা ব্যান্ডেজ করা হাতটা দিয়ে চামচ নাড়াচ্ছে সাঈদ। প্লেটে অল্পকিছু ভাত, সঙ্গে যেটুকু তরকারি নিয়েছে তা চামচ দিয়ে মাখার জন্য আস্তে আস্তে নাড়াচাড়া করছে। ফিহা জানে না, এই মানুষটাকে দেখলে কেন যে তার প্রতি মায়া লাগে! মনে হয় মানুষটা খুব একা। মনে হয় তার কাছে কেউ নেই। সে নিভৃতচারী মানুষের মতো গুটিয়ে গুটিয়ে থাকে। ফিহা গুটিগুটি পায়ে কাছে গিয়ে প্রশ্ন গলায় বলল,

  - আপনি এখনো ঢিলেমি করছেন? 

চামচ নাড়াটা থামিয়ে স্থির হলো সাঈদ। মুখটা ডানে ফিরিয়ে ফিহার দিকে তাকালে কী যেন ভেবে দু'পা এগিয়ে আসল ও। প্রসন্নকণ্ঠে বলল, 

  - রাতেরবেলা এইটুকু খাবার খান? হাতটা একটু দেখি? আপনি কী ডাক্তার দেখিয়েছেন?

বলতে বলতেই ফিহা বিচলিত হয়ে একটা চেয়ার টেনে পাশে বসে পড়ল। হাতটা নিজ দায়িত্বে টেনে নিয়ে আবারও লক্ষ করে বলল, 

  - এবার ঠিক আছে। পার্ফেক্ট! ডাক্তারের চেকআপটা দরকার ছিল। কিছুদিন হাতটাকে বিশ্রাম দিবেন। ইনশাআল্লাহ্ ঠিক হয়ে যাবে। 

হাতটা পুনরায় ফিরিয়ে দিয়ে ফিহা খালি একটা বনপ্লেটে নিজের ডানহাতটা ধুয়ে নিল। সাঈদ আঁচ করতে পারছে ও এখন কী করতে চাইছে। ওর কাছে ক্ষণিকের এই সমাদরটুকু পাওয়ার জন্য মনটা ব্যাকুল হয়ে উঠল। ফিহা নিঃসংকোচে প্লেটটা নিয়ে যত্নের সাথে ভাত মাখাতে শুরু করল। সেদিকে নীচু দৃষ্টি রেখে বলল, 

  - আজকে কী আপনার অফ-ডে ছিল? 

আবারও ছোটো ছোটো কথাগুলো আচ্ছন্ন করল তাকে। এভাবে কাছে টেনে দু'দণ্ড প্রশ্ন করার সাহস কেউ তার প্রতি দেখায়নি। সাঈদ মৃদু স্বরে বলল, 

  - হুঁ। 

প্রথম লোকমাটা খাইয়ে দিয়ে একটু চিন্তায় পড়ল ফিহা। এভাবে প্রশ্ন করার ফলে অনেকেই তো তার প্রতি মহাবিরক্ত হয়। মানুষ তার মুখের উপর সরাসরিই বলে দেয়, ' বাচাল কোiথাiকার! এতো কথা বলিস কেন? চুপ কর! '। কিন্তু এদিকে যে উলটো ঘটনা ঘটে আছে তা বোধহয় আন্দাজ করেনি ফিহা। কেউ যে ওর অবুঝ বাচাল বাক্যগুলোই শোনার জন্য চুপ করে আছে, তা ফিহা বুঝতে পারেনি। এই যে ওর কথাগুলোর মাঝে সুপ্ত অধিকারবোধ লুকায়িত থাকে, কোনো খারাপ অবস্থা দেখলে সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসে, এগুলো কী তার প্রতি কেউ করতে পেরেছে? নিজের মা-ই তো আজ পযর্ন্ত পারল না। মহাব্যস্ত মা সবকিছু সামলাতে সামলাতে আপন ভুবনে আজীবনের জন্য গুটিয়ে গেল। সাঈদের সরল চোখের চাহনি দেখে ফিহা মৃদু হাসিতে বলল, 

  - খাবারটা মজা হয়েছে না? আরেকটু ভাত নেই?

কথাটা শুনে সাঈদ একটুখানি হাসতে চাইল। কিন্তু আম্ভরিক স্বভাবটার জন্য হাসিটুকু ফুটল না। চোখের প্রসন্ন সরল চাহনিতে এমন কিছু বুঝিয়ে দিলো তা দেখে ফিহা আবারও মিষ্টি হাসি দিয়ে বলল, 

  - ঝুটা করবেন না, ঠিক আছে? 

নরম হাতে খেতে পারার যে অনুভূতি তা কতো মধুর, সুন্দর, মনোরম! এই অনুভূতি আরো বাড়তে বাড়তে মনটা এখন লোভাতুর হয়ে যাচ্ছে। একটা মূহুর্ত্তের জন্য কোমল মুখটা থেকে দৃষ্টি সরায়নি সাঈদ। গতকালও যে মেয়েটির বিষয় নিয়ে চিন্তাকুলিত ছিল, আজ সেই দ্বিধার মেঘে জ্বলজ্বল করে সূর্যের আলো উঁকি দিচ্ছে। সাঈদ খাবার চিবোতে চিবোতে স্থিরচোখে বলল, 

  - সামনে কী হওয়ার ইচ্ছা? 

ফিহা দৃষ্টি তুলে অবাক হতে গিয়ে শেষপর্যন্ত মৃদু হাসি ফেলল। ঠোঁটে হাসি রেখেই বলল, 

  - একজন শিক্ষিত মানুষ হওয়ার ইচ্ছা। যতটুকু শিক্ষা অর্জন করলে আমার বাবা নিশ্চিন্তে থাকতে পারবেন, ঠিক ততটুকুই পড়াশোনা করতে চাই। 

  - আর কোনো ইচ্ছা নেই? 

  - না, আর ইচ্ছা নেই। আমি খালামনির মতো জব করতে চাই না। সারাক্ষণ অফিসের কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকা লাগে এগুলো আমার কাছে অসহ্যকর! আমি ওরকম জব করবই না। 

  - তাহলে কী করতে চাইছিস? সংসার? 

খট করে কথাটা বিঁধল ফিহার। বয়সের গণ্ডি মাপ-যোগ করলে আর মাত্র ক'টা বছর বুঝি বাবার সঙ্গে কাটাতে পারবে। এরপর চিরদিনের জন্য বিদায়। ফিহা মুখ ভার করে বিষণ্ণ গলায় বলল, 

  - আমার হাতে যে কতখানি সময় আছে, তা আমি জানি না। বাবার সাথে থাকতে পারলে আর্থিক ব্যাপারটা দেখতে পেতাম। কিন্তু তা তো সম্ভব না। 

সাঈদ এক চুমুক পানি খেয়ে বলল, 

  - কেন? তোর হাসবেন্ড কী এসব দেখবে না? 

ফিহা অন্যমনষ্ক হয়ে হাসল। লম্বা শ্বাস ছেড়ে বলল, 

  - বলতে পারলাম না। যদি দেখা গেল আমি যা চাইছি তা উনি পূরণ করলেন না, তখন আমার আশাটা চুরচুর হয়ে ভেঙে যাবে। আমাকে বাবা, মা আর খালামনি ছাড়া তেমন কোনো মানুষ বুঝতে পারেনি। আমার ওই হাসবেন্ড নামক মানুষটা আদৌ আমাকে বুঝতে পারবে কিনা জানি না। তাই আশা রেখে মনটা ছোটো করতে চাইছি না।

কিছু কথার ভাবার্থ বুঝে অবাক হলো সাঈদ। বয়সের সংখ্যাটা বোধহয় সতেরো, কিন্তু চিন্তার পরিধি যেন তার চেয়েও বেশি। এই বয়সী মেয়েগুলো কাল্পনিক দুনিয়ায় বিচরণ করতে একটু বেশিই পছন্দ করে, সেখানে ওর কথার ধরণ ও আচরণ পরিপাটি ও সুসংগত। ফিহা কাজটা শেষ করে হাতটা ধুয়ে এক বোতল পানি নিয়ে চলল। সাঈদ ততক্ষণে রুমে চলে গেছে। ডাইনিং রুমে লাইট নিভিয়ে সবে রুমেই ঢুকছিল ফিহা, হঠাৎ পেছন থেকে গম্ভীর একটা কণ্ঠস্বর ওকে দাবড়ের সাথে থামিয়ে দিলো,

  - নাবিলা, 

আচানক চমকে উঠল ফিহা! দু'কানের কর্ণকুহরে ঝংকারের মতো কী যেন বাজতে লাগল। পিছু ঘুরে কাঙ্ক্ষিত দরজার দিকে চাইলে ঢোক গিলল ফিহা। কালো ট্রাউজারের পকেটে দু'হাত গুঁজে দাম্ভিক ভঙ্গিতে তাকিয়ে আছে। মানুষটা তীক্ষ্ম চোখে কাঠিন্য মুখে অভ্রান্ত সুরে বলল, 

  - তোর হাসবেন্ডটা প্রোবাবলি স্ট্রিক্ট হবে। প্রিপেয়ার ইউরসেলফ্। ইন ফিউচার, তোর যেন হ্যান্ডেল করতে অসুবিধে না-হয়। ব্যাপারটার জন্য কেয়ারফুল থাকিস। 

বুদ্ধিভ্রংশের মতো তাকিয়ে রইল ফিহা! হাতের মধ্য থেকে পানির বোতলটা ফস করে পড়তে নিলে তড়িঘড়ি করে সেটা ধরে ফেলল। আবারও চোখ তুলে সেই দরজাটার দিকে তাকালে মানুষটা তখন নেই! সে চলে গেছে ভেতরে। 
.
.
.
চলবে.....................................................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

WhatsApp