কামিনী - পর্ব ০৮ - মম সাহা - ধারাবাহিক গল্প


পর্দার আড়াল থেকে এলোমেলো সমীরণে যখন হ্যাব্রোর ক্লান্ত দেহটি প্রায়ই খানিক ঘুমে নিমগ্ন হয়ে যাচ্ছিলো তখনই চোখে মেলে অবসন্ন ভাবে তাকালো যামিনী। জ্বরটা নেহাৎ বাড়াবাড়ি নেই বলেই চোখ মেলবার শক্তিটুকু অর্জন করতে পেরেছে সে। চোখটা মেলেই প্রথমে সে তাকালো তারা ডান দিকে বেশ খানিকটা দূরে কেদারায় বসে ঘুমে তলিয়ে যাওয়া হ্যাব্রোর দিকে। 

 ঘুমের ভেতরও কতটা জাগরণ তার ইন্দ্রিয় সকল! বন্ধ আঁখির পত্র যুগল কাঁপছে থেমে-থেমে। যামিনী অসুস্থ কণ্ঠে আধ ভাঙা স্বরে বলল, 
"জায়গায় গিয়ে ঘুমোও, হ্যাব্রো। আমি এখন ঠিক আছি।"

যামিনীর এই ক্ষীণ রুগ্ন স্বর ঠিক কর্ণগোচর হলো হ্যাব্রোর। চমকে গেলো কিঞ্চিৎ। ঘুম জড়ানো নেত্রগুলো টান টান করে উঠে দাঁড়ালো ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে। ঘোরগ্রস্তদের মতন কিছুটা অস্ফুটস্বরে বলল, "কী?"

 যামিনী কিছুটা উঠে পালঙ্কের সাথে হেলান দিয়ে বসলো। আবারও বলল, "এখন গিয়ে ঘুমোও।"

হ্যাব্রোর নিদ্রায় ভারি হওয়া আঁখি পল্লব এবার স্পষ্ট ভাবে খুললো। দৃষ্টি রইলো মাটিতে। মাথা নাড়িয়ে বলল,
"আমি এখানেই আছি। আপনার কিছু লাগবে?"

 "আমার কিছু লাগবে না। তুমি ঘুমে ঢুলে পড়ছো! তুমি যাও গিয়ে ঘুমিয়ে নাও।"

"না। আমি যেতে পারবো না।"

 "যেতে পারবে না? কিন্তু কেন?"

যামিনীর প্রশ্নাত্মক চোখ গুলো ঘুরপাক খেলো হ্যাব্রোর দেহ জুড়ে উত্তর জানার আকাঙ্ক্ষায়। মনে মনে সুখী কল্পনাও করলো কিছুটা। ভাবলো হয়তো তার শারীরিক অসুস্থতার পীড়নেই হ্যাব্রো নড়তে চাইছে না তার থেকে! 
 অথচ যামিনীর সেই সুখী কল্পনাকে প্রায় নিষ্ঠুর ভাবেই হত্যা করলো হ্যাব্রোর মুখের বুলি। বলল,
"রানি কামিনীকাঞ্চনের আদেশ আছে এই কক্ষে যেন আমি থাকি। এবং সেই আদেশ আমি অমান্য করতে পারবো না।"

 হ্যাব্রোর কথা শুনে ব্যথিত হলো যামিনীর হিয়া। সে লুকায়িত দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, "আমিই তো এখন বললাম চলে যেতে। সখী তো আমার জন্যই বলেছিলো থাকতে। আমি যেহেতু যেতে বলেছি সেহেতু যেতে কী সমস্যা?"

 "আমি রানির আদেশ ছাড়া কিচ্ছুটি করবো না। আপনার আর কিছু প্রয়োজন আছে কি? আপনার দাসী ম্যালোনাকে আমি বিশ্রামে পাঠিয়েছি। আপনি বললে ডেকে দিবো।"
হ্যাব্রোর কাঠ কাঠ জবাব। কারো হৃদয়ে এই জবাব আঁচড় ফেলতে পারবে সেটা অব্দি ভাবলো না। দায়িত্ব পালনে সে একনিষ্ঠ। তাকে হারাবে এমন সাধ্যি কারই-বা আছে? 

যামিনী যদিও জানে হ্যাব্রোর এই স্বভাব সম্পর্কে তবুও ক্ষণকাল বসে রইলো স্থির। নিজেকে নিজে বুঝিয়ে নিলো ভীষণ যতনে। অতঃপর কথা ঘুরিয়ে বলল,
 ”সখী কোথায়? খেয়েছে তো রাতে?"

 "রানি ঘুমুচ্ছেন। রাতে তিনি খেয়েছেন কি-না ঠিক অবগত নই।"

যামিনী আর কিছু বলল না। চিন্তিত হয়ে শুয়ে পড়ল বিছানায়। কী জানি সখীটা ঠিকঠাক খেয়েছে কি-না! ঘুমিয়েছে কি-না! জানালার পর্দাটা আটকিয়েছে কি?
এসব জল্পনা-কল্পনায় আবার ঘুমে তলিয়ে গেলো যামিনী। হ্যাব্রো দাঁড়িয়ে রইলো আগের মতনই, মাথাটা নত করেই। 

 ১০.

রানির আজ ঘুম ভেঙেছে একটু দেরিতেই। দাসী এসে খবর যখন দিলো বৈঠক খানায় মন্ত্রী, বৈদ্য হতে সকলেই উপস্থিত তখন রানি আড়মোড়া ভেঙে ওঠল। দাসীটির নাম— ফ্রেয়া। কালো মিচমিচে শরীরের বর্ণ তার। চুল গুলো কিছুটা লাল খয়েরীর মিশেলে। চোখের মণি গুলো নীল। 
রানি ঘুম থেকে উঠেই ফ্রেয়াকে নির্দেশ দিলেন জানালার পর্দা গুলো সরিয়ে দিতে। যেহেতু ফ্রেয়া নতুন তাই রানির ভাবনা-চিন্তা, পছন্দ-অপছন্দ ঠিক আয়ত্তে আনতে পারেনি। তাই রানিই যখন যা লাগবে বলে দেন। রেবেকা থাকতে এতটা অবশ্য কথা ব্যায় করতে হতো না তার। তিনি কিছু বলার আগেই রেবেকা ঠিক বুঝে যেতো রানির কী প্রয়োজন। 

ফ্রেয়া পর্দাটা সরিয়ে দিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো কাঁচুমাচু করে রানির দ্বিতীয় নির্দেশ পাওয়ার উদ্দেশ্যে। রানি গম্ভীর কণ্ঠে বললেন,
 "আমি প্রতিদিন ঘুম থেকে উঠার সাথে সাথে তুমি পর্দাগুলো মেলে দিবে। এরপর আমাকে মদ্যরস দিবে। অতঃপর গিয়ে আমার স্নানের ব্যবস্থা করবে। একশো একটি লাল গোলাপ এবং লাল চন্দন দিয়ে আমার স্নানের জল তৈরি করবে। সাথে সুগন্ধি, ধূপ সব যেন থাকে। আমার স্নানে সাহায্য করে যেই দাসীরা তাদের স্নানাগারে অবস্থান করতে বলবে। এরপর আমি স্নান সেড়ে উপস্থিত হওয়ার আগেই সকালের খাবার গুছানোর আয়োজন করতে বলবে ওখানে থাকা রান্নার ঠাকুরকে। বুঝেছো?"

 দাসী ফ্রেয়া মনযোগ দিয়ে সবটুকু শুনলো এরপর ঘাড় কাঁত করে হ্যাঁ বোধক জবাব দিলো।
রানি এবার চোখ পিটপিট করে ফ্রেয়ার দিকে তাকিয়ে খানিকটা ধমক দিয়ে বললেন,
"বুঝলে দাঁড়িয়ে আছো কেন? আমি ঘুম থেকে উঠে এই তো বসে আছি। মদ্যরসের পাত্রটা এনে দাও।"
রানির ধমকিতে ভীত হলো ফ্রেয়া। কাঁপতে লাগলো অনবরত। এবং তার কম্পন স্পষ্ট, দৃশ্যমান। রানির কৌতূহল জন্মালো এই ভীতি দেখে। যদিও জবাবটি তার ধারণায় আছে তবুও শুধালেন, 
 "তুমি কাঁপছো কেন এভাবে? কী হয়েছে?"

ফ্রেয়া রইল চুপ। মাথা নাড়িয়ে বুঝালো, কিছু হয়নি। 
রানির এবার রাগ হলো খানিক। আবারও উচ্চস্বরে বললেন, "আমার সাথে স্পষ্ট ভাষায় কথা বলতে হবে। ঘাড় নাড়িয়ে কথা না আমি বলি আর না পছন্দ করি। আর যার মনে সততা আছে তার তো এত ভয় পাওয়ার কিছু নেই! তুমি ভয় পাচ্ছো মানে তোমার ভেতর কোনো অসৎ ভাবনা, উদ্দেশ্য আছে।"

ফ্রেয়া এবার চমকে উঠল। রানি যা বলছেন তা যে সম্পূর্ণ মিথ্যে! সে এগিয়ে এলো। হাত জোড় করে অনুনয় বিনয় করে বলল,
 "আমি আপনার কোনো ক্ষতি করার ভাবনা আমার কল্পনাতেও আনি না, রানি। মার্জনা করবেন আমার অপরাধ। আপনি আপনার খাসদাসী রেবেকা উযোয়ারকেও তো নির্মম শাস্তি দিয়েছেন তাই আমার ভয় হচ্ছিলো।"

 "কিন্তু রেবেকার সাথে তোমার কীসের তুলনা? রেবেকা বিশ্বাসঘাতক ছিলো। তুমিও কি তাই?"

 "না না, রানি। প্রাণ থাকতে এমন অপরাধ আমি করবো না।"
ফ্রেয়ার উত্তরে মনে মনে কিছুটা খুশি হলেন রানি। এবং এই উত্তরে যে সততা রয়েছে তা-ও বেশ আঁচ করা গেলো। রানি ফ্রেয়াকে স্নানের জল প্রস্তুত করতে বললেন। ফ্রেয়া নির্দেশের সাথে সাথে চলেও গেলো। 

ফ্রেয়া বেরিয়ে যেতেই আড়মোড়া ভাঙলেন রানি। বিছানা থেকে নামতেই অনুভব করলেন আজ বেশ আরাম বোধ করছেন পায়ে। এক রাতের ভেতর যেন জাদুর মতন তার পায়ের সকল জ্বালা সেড়ে উঠেছে। কী আশ্চর্য! কাল রাতেও যে পা নিয়ে হাঁটতে পারছিলেন না সেই পা এখন দিব্যি ভালো। কীভাবে সম্ভব? তবে কি স্বপ্নে দেখার ভাবনাটি সত্যি ছিলো? নাকি স্বপ্নের জড়িবুটি বাস্তবে কাজ করে ফেললো?
 অবাকে রানি কিছুটা সময় থমই মেরে গেলেন যেন। ধীর পায়ে গিয়ে লাল তরলের পাত্রটি তুলে নিলেন মুখে। ভাবুক সত্তাটি বড়ো দুশ্চিন্তায় পড়ে গেলো। 

স্নানাগারে কুসুম গরম জলে ভাসছে গোলাপের সতেজ পাঁপড়ি গুলো। কী এক মাধুর্যতা পূর্ণ সুঘ্রাণে ভরে উঠেছে এই বিশাল কক্ষটি। ছোটো একটি পুকুরের মতন জলাশয় আছে এখানে। সাথে দু'টো লাগোয়া সিঁড়ি। যেখানের একটিতে বসে আছেন রানি এবং আরেকটিতে চন্দন বাঁটা, হলুদ বাঁটা, গোলাবজল সহ বিভিন্ন ধরণের প্রসাধনী। 
রানি পা ডুবিয়ে হেলান দিয়ে সিঁড়িতে বসে আছেন। বিশাল কেশগুচ্ছ কিছুটা সিঁড়ির উপর আর কিছুটা ভাসছে স্বচ্ছ জলগুলোতে। বক্ষের দিকে ঘিয়ে রঙের একটি স্নানের কামড় শৌখিন ও দক্ষ হাতে পরা। তাই বুকের কিয়দংশ গাঢ় ভাঁজ থেকে শুরু করে দেখা যাচ্ছে মাখনের ন্যায় মোলায়েম, কোমল ও দৃষ্টি কাঁড়া বাহু, কাঁধ। কাপড়টি হাঁটুর উপর অব্দি হওয়ায় মসৃণ পাগুলোও বেশ উন্মুক্ত। 

রানি যখন আরামদায়ক স্নানে ব্যস্ত তখন বাহিরে দাঁড়ানো দাসী এসে ফ্রেয়ার কানে কানে মিহি শব্দে কিছু বলল। কোনো একটি সংবাদ দিয়ে চলে গেলো। 
 দাঁড়িয়ে থাকা ফ্রেয়া এলো রানির কাছে। কুর্নিশ করে বলল,
"রানি, সেনাপতি হ্যাব্রো এসেছেন দরকারি খবর নিয়ে।"

 রানির চোখের পাতা তখনও বন্ধ। তিনি আগের মতনই স্থির বসে থেকে অনুমতি প্রদান করে বললেন, 
"আসতে বলো হ্যাব্রোকে।"

ফ্রেয়া রানির এরূপ আদেশে অল্প ভড়কে গেলো বোধহয়। কিছুটা অবাক মেশানো অদ্ভুত স্বরে বলল, "এখানে! এই স্নানাগারে আসতে বলবো?"

 রানি এবার চোখ মেলে বাঁকা করে তাকালেন ফ্রেয়ার দিকে। উপহাস্য হাসি হেসে বললেন,
"আমি তা-ই তো নির্দেশ করলাম বোধকরি। গিয়ে বলো আসতে হ্যাব্রোকে। এবং হ্যাব্রো যতক্ষণ এখানে থাকবে ততক্ষণ তোমরা কক্ষের বাহিরে থাকবে। যাও। এখুনি।"

ফ্রেয়াসহ এখানে চারজন দাসী উপস্থিত ছিলো। রানির আদেশের সাথে সাথে প্রত্যেকেই মাথা নত করে বেরিয়ে গেলো। ঠিক তার পর পরই হ্যাব্রো এসে ঢুকলো রানির স্নানাগারে। পশ্চিমের দিকে থাকা সাদা যবনিকাটির কিছুটা আড়ালেই যেন দাঁড়ালো হ্যাব্রো। মাথার দৃষ্টি একদম নিচ থেকে নিচে। এসেই রানিকে কুর্নিশ করে হড়বড়িয়ে বলল,
 "ক্যামিলাস রাজ্য থেকে আমন্ত্রণ পত্র এসেছে, রানি।"

"আমন্ত্রণ পত্র? কীসের সেটা?" নিজের গায়ে চন্দনের মলিন লেইটুকু মাখাতে মাখাতে শুধালেন রানি।  

"বিভিন্ন রাজ্যের সাথে মিত্রতা অক্ষুণ্ন রাখার জন্য একটি আয়োজন করে হবে, সেখানে সকল রাজ্যের রানি-রাজাদের উপস্থিতি কামনা করছেন উনারা।"

 "উপস্থিতি! মিত্রতা? ক্যামিলাস রাজ্যের রাজা পাগল হলেন নাকি? উনার মস্তিষ্কে ভ্রম জেগেছে মনে হয়। কাল যে রাজ্যকে এমন একটি হুমকি বার্তা পাঠিয়েছিল আজ সেই রাজ্যের সাথে মিত্রতা করার আহ্বান জানাচ্ছে? হ্যাব্রো, তোমার এখানে কিছু গণ্ডগোল মনে হচ্ছে না?"

হ্যাব্রো মাথা ঠাঁই নত করে বলল, "এখানে ঘোলাটে ভাব বিদ্যমান। উনারা আমাদের সাথে ছলচাতুরী করার চেষ্টা করছেন।"

 "আচ্ছা, ক্যামিলাস রাজ্যের বর্তমান রাজা কে? গুপ্তচর পাঠানো হলো অথচ খবর পাওয়ার আগেই মৃতদেহ পেলাম। একটু খোঁজ নিয়ে জানিও তো। আর উনারা যেই আয়োজনটির কথা উল্লেখ করেছেন তা কবে?"

 "আর আঠারোদিন পরে।"

"তাহলে আজকের বৈঠকে আর ক্যামিলাস নিয়ে মাথা ঘামানোর দরকার নেই। আমরা বরং রাজা ইনানের ডেইজি রাজ্য নিয়ে ভাবি।"

 হ্যাভেন আর রানির কথোপকথন চলতেই থাকলো। অপরদিকে বাহিরে দাঁড়িয়ে থাকা দাসীদের ভেতর একটি গুঞ্জন চলছে চাপা স্বরে। যেহেতু ফ্রেয়া দাসী হিসেবে নতুন তাই তাদের গুঞ্জন নিয়ে তেমন ভীতি ভাব নেই অন্তরে। রেবেকা থাকতে অবশ্য তারা এটা করার সাহস পেতো না। 
 একজন চাপা স্বরে বলল,
 "কী জানি দু'জন কী করছেন ভেতরে! কী লজ্জা ছাড়া কাজকর্ম রানির! স্নানাগারে নাকি পুরুষ প্রবেশ করতে দিচ্ছেন!"

আরেকজন তাকে পরিহাস করে বলল, "এ আর নতুন কী? এর আগেও বহু বার সেনাপতি মশাই রানির স্নানঘরে ঢুকেছেন।"

 "আমার তো মনে হয় রানির সাথে সেনাপতি মশাইয়ের সম্পর্কটা বেশ ঘনিষ্ঠ।"

"তা নয় তো কী! দেখো না সবসময়, সব জায়গায় সেনাপতি মশাই রানির সাথেই থাকবেন। ওনাদের ভেতর সম্পর্ক অনেকটাই ঘনিষ্ঠ।"
এই কথাটির বিপরীতে একজন ঠাট্টা করে বলল, "কতটা ঘনিষ্ঠ? বিছানার রঙ্গ লীলা অব্দি? রানির আর কী লাগে! ঘরে পুরুষ, বাহিরে পুরুষ।"

ঠাট্টা করা দাসীটির সাথে তাল মিলিয়ে বাকিরাও হাসলো। কেবল ফ্রেয়া দাঁড়িয়ে রইলো এক কোনায় চুপটি করে। দেখেই বুঝা যাচ্ছে রানির ব্যাপারে বলা এসব কথা তার শুনতে বড়োই বিদঘুটে লাগছে। 
ম্যালেনা সবটুকু দেখেই খবর নিয়ে গেলো যামিনীর জন্য। 

নিজ কক্ষে যামিনী তখন শুয়ে আছে। রুগ্ন দেখাচ্ছে তার মুখখানি। ম্যালেনা যামিনীর কাছে অনুমতি নিয়েই ঢুকলো কক্ষটিতে। হলুদ দুধটা এগিয়ে দিলো যামিনীর দিকে। ইতিউতি করে এরপর বলল,
 "একটা কথা বলবো?"

যামিনী দুধের পাত্রটিকে চুমুক দিতে দিতে অনুমতি দিল, "বলো।"

 "আপনি রাগ করবেন না তো?"
যামিনী চোখ উল্টে তাকিয়ে দুধ পান করতে করতে বলল, "কী এমন কথা যা শুনলে রাগ করবো আমি? বলো দেখি।"

"রানির সাথে সেনাপতি মশাইয়ের একটি প্রেমের গুঞ্জন শুনলাম।"

 দুধটুকু যামিনীর নাকে মুখে উঠে গেলো আচমকা। শুরু হলো কাঁশি। অনবরত কাশতে লাগলো সে। ম্যালেনা তাড়াতাড়ি যামিনীর মাথায় ফু দিয়ে দিলে। হাত বুলিয়ে দিলো পিঠে। 
অনেক সময় পর স্বাভাবিক হলো যামিনী। কাশতে কাশতে তার অবস্থা বেশ নাজেহাল হয়ে গেছে। গলা দিয়ে শব্দও আসছে না। তবুও বেশ রাগান্বিত স্বরে বলল, 
"কে বলেছে এসব কথা? আমি এখুনি সখীর কাছে গিয়ে সবগুলোর নামে নালিশ করবো। যার ছায়াতলে থাকছো তার নামেই এসব বলতে তোমাদের বিবেকে বাঁধে না! তোমরা আদৌ মানুষ!"

ম্যালেনা ভয় পেয়ে গেলো যামিনীর আচমকা রাগে। দ্রুত গিয়ে সে জড়িয়ে ধরলো যামিনীর পা দুটো। আকুতি করে বলল,
"আর বলবে না। ক্ষমা করুন। ক্ষমা করুন আমাদের।"

যামিনীর নরম মন গলে গেলে আকুতিতে। তবে কণ্ঠ রইলো গম্ভীর। আদেশ ছুঁড়ে বললেন,
"ঠিক এই মুহূর্তে গিয়ে যারা এসব আলোচনা করছে, সবাইকে বলবে আলোচনা থামাতে। নয়তো ফল ভালো হবে না। যাও এখুনি।"

ম্যালেনা দ্রুত ছুটে গেলো। যামিনীর কাছে যেই আশকারাটুকু পাবে ভেবেছিলো তার এক ফোঁটাও না পেয়ে সে বেশ ভড়কেই গিয়েছিলো বলা যায়!
 ম্যালেনার যাওয়ার পথে তাকিয়ে থাকে যামিনী। কী এক খারাপ লাগায় তার বক্ষদেশ আনচান আনচান করে উঠলো! কিন্তু খারাপ লাগাটা আসলে কীসের ছিলো? রানির নামে বিদঘুটে বলাতে না-কি হ্যাব্রোর সাথে নিজের জায়গায় রানিকে কল্পনা করতে! 

 ১১.

রাজ সভায় বৈঠক বসলো। রাজ্যের সমস্যা নিয়ে কথা হলো। মন্ত্রী রবার্ট ব্রিফল্ট খুব গম্ভীর মানুষ। গম্ভীর কণ্ঠে রাজ্যের খবরা-খবর দিলেন রানিকে। রাজ সভায় উপস্থিত সকলেই। 
 রানি ব্রিফল্টের কথা শুনলেন। কোন কোন জায়গায় কত খরচ হবে তার একটি তালিকা দিলেন মন্ত্রী। রানির মুখে চিন্তার উদয় হলো। রাজকোষে এবার অর্থ সংকট প্রায়। তার উপর রাজ্যের বড়ো একটি অংশ থেকে রাজস্ব এবার নেওয়া হলো না যামিনীর জন্য। এই কথোপকথনের মাঝেই গ্রহাচার্য অনুমতি চাইলেন কথা বলার। 
রানি অনুমতি দিতেই তিনি দাঁড়ালেন, 
 "আপনাকে একটি কথা বলব রানি। কথার মাঝে কথা বলায় মার্জনা করবেন অপরাধ।"

"বলুন, কী কথা?"

 "আমাদের রাজ্যে এবছর দুর্যোগের আশঙ্কা আছে। কেতুগ্রহের দোষ লেগেছে।"

রানির চিন্তা আরেকটু বাড়লো। সব সমস্যার উদয় যেন এক সাথেই হলো। 
 রাজ সভা শেষ হলো। জঙ্গলের কথা উঠায় রানির মনে পড়লো হ্যাভেনের কথা। রাজ গ্রহাচার্যকে তিনি আলাদা করেই ডাকলেন। যদিও তার জিজ্ঞেস করতে বড়ো অস্বস্তি হচ্ছিলো তবুও জিজ্ঞেস করলেন,
 "রাজ গ্রহাচার্য, জঙ্গলে একটি অপরিচিত পুরুষকে দেখলাম সেদিন আপনার কুটির থেকে আসার সময়। তাকে নিশ্চয় আপনি চিনবেন যেহেতু আপনিও সেখানে থাকেন! কে সে জানেন?"

রানির প্রশ্নে বেশ অবাক দেখালো গ্রহাচার্যকে। তিনি বিস্মিত ভাবেই শুধালেন, 
"জঙ্গলে? তাও পুরুষ? কোথায় রানিমা? এমন তো শুনিনি! এমন কেউ তো নেই!"

রানি চমকে গেলেন। গ্রহাচার্যকে বিদায় দিয়ে তিনি হ্যাব্রোকে ডাকলেন। হ্যাব্রোকে পাঠালেন হ্যাভেনের খোঁজে। রানির মনে উদিত হলো কেমন ভাবনা। তবে কি হ্যাভেন কেবল তার কল্পনামাত্র?
.
.
.
চলবে....................................................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

WhatsApp