বসার রুমেই ছিলেন রাশেদ জামাল। কুহুকে বেরিয়ে যেতে দেখে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। মেয়েটার অন্তত বলে যাওয়া উচিত ছিল। আশফিকের সঙ্গে হেসে কথা বলে এগিয়ে আসলেন শারমিন বেগম। টিভির স্ক্রিনে দৃষ্টি রেখেই গম্ভীর স্বরে বললেন রাশেদ জামাল,
"রওনক ফোন করেছিল। বলল কুহুকে নিয়ে কোথাও একটা যাবে। বাড়িতে ফিরবে না আজ। মাত্রই বেরিয়ে গেল কুহু।
শারমিন বেগমের হাসিমাখা মুখ চুপসে গেল। ছেলের পরিবর্তন ভালোই হয়েছে। ছুটি পেলেই বউ নিয়ে দেশান্তর হয়ে যায়। রওনক যে এতটা বউ পাগল হবে সেটা ঘুনাক্ষরেও বোঝা যায়নি আগে। কুহুর প্রতি সেভাবে ভালো লাগাও তো দেখেনি কোনোদিন। বিয়ের পর কিভাবে এতখানি বশ হলো কিভাবে? আশফিক যাওয়ার জন্য বিদায় নিল খালা, খালুর থেকে। হাসিমুখেই ভাগ্নেকে বিদায় দিলেন শারমিন বেগম। আসার সময় ছেলেটাকে যতটা উৎফুল্ল দেখেছিলেন এখন ততটা নেই। মলিনই লাগলো মুখাবয়ব। দু'জনের মধ্যে আবার মনোমালিন্য চলছে না তো? এই সম্পর্কের কথা শুনে ভীষণ খুশিই হয়েছিলেন শারমিন বেগম। এমন সোনার টুকরা ছেলে কি সহজে মেলে আজকাল? একেবারে নিজ হাতে গড়া ছেলে। রিশাকে আর একবারের জন্যও দেখা গেল না। চরম রাগ হলেন শারমিন বেগম। মেয়েটার কি বোধবুদ্ধি কোনোকালেই হবে না? ছেলেটা চলে যাচ্ছে অন্তত বিদায় তো দিতে আসবে! দুদিন পর স্বামী হবে সে।
◼️
উবার নিয়ে এই রাতেই সূদুর গাজীপুর চলে এসেছে কুহু। ঘড়িতে এখন রাত দশটা চল্লিশ মিনিট। গাড়ি থেকে নামতেই মনে হলো টাকা সঙ্গে নিয়ে আসেনি সে। মাথায় যেন বাজ পড়লো! সামনেই নক্ষত্রবাড়ি রিসোর্ট। সেদিকে একবার দৃষ্টি বুলিয়ে নিয়ে কানে থাকা স্বর্ণের দুল খুলতে লাগলো কুহু। গম্ভীর স্বর তাকে থামিয়ে দিল। চিরচেনা কন্ঠস্বর পেয়ে বক্ষস্থল ধ্বক করে উঠলো কুহুর। ততক্ষণে রওনক এগিয়ে এসে ভাড়া মিটমাট করে দিল। এই মুহূর্তে ঠিক কি রকম প্রতিক্রিয়া জানাবে বুঝতে পারলো না কুহু। গভীর দৃষ্টি ফেলে রওনকের দিকে তাকিয়ে রইল। শুভ্র রঙা শার্ট আর ছাই রঙা ফর্মাল প্যান্ট পরে দাঁড়িয়ে আছে রওনক। পায়ে ফর্মাল ব্রাউন স্যুজ। লোমশ হাতে ঝুলছে ঘড়ি। দৃষ্টি কুহুতে নিবদ্ধ। নীল রঙা সাদামাটা সুতির থ্রিপিস পরে দাঁড়িয়ে আছে কুহু। শিফনের ওড়না বাতাসে দুলছে। মুহূর্তেই দৃষ্টি পায়চারি করতে লাগলো কুহুর। আশেপাশে খুঁজতে লাগলো কাউকে। ঠোঁটে মৃদু হাসি নিয়ে বলল রওনক,
"যাকে খুঁজছো সে এখানে নেই! এতটা ভালোবাসো আমাকে? যার জন্য শাহিনূর মাহি ম্যামের নাম শুনতেই ছুটে এলে? একবার আমাকে ফোন করবার প্রয়োজন মনে করোনি! এভাবে কেউ প্ল্যান করে খুব সহজেই তো তোমাকে কিডন্যাপ করে নিতে পারবে!
কুহু কোনো উত্তর দিল না। রাগে ফুসলো। তারমানে রওনক ইচ্ছে করে তাকে এই রিসোর্ট পর্যন্ত নিয়ে এসেছে! কয়েক কদম হেঁটে কুহুর মুখোমুখি দাঁড়ালো রওনক। আশেপাশে বেশ গ্রামীণ পরিবেশ। মৃদুমন্দ বাতাসে বইছে। কুহুর কপাল ছুঁয়েছে এলোমেলো চুল। খানিকটা নিচু হয়ে কপালে ফু দিয়ে বলল রওনক,
" তুমি কি জানো কুহু, এই বোকামো আমাকে বারবার তোমার প্রেমে পড়তে বাধ্য করে। পৃথিবীর আনাচকানাচে কোথাও তুমি আমার মতো আশ্চর্য প্রেমিক পুরুষ পাবে না, যে তার প্রিয়তমার বোকামো দেখে ঘায়েল! ওই সরল, মায়াবী চেহারা নিমেষে আমার জগৎ ভুলিয়ে দিতে সক্ষম!
রওনকের কথার মাঝে একটা তরুণী আসলো। হাস্যজ্জল মুখে জানালো তাদের জন্য বরাদ্দ কটেজটা সাজানো হয়ে গেছে। পকেট থেকে মানিব্যাগ বের করে মেয়েটাকে কিছু টাকা দিল রওনক। কুহু অবাক দৃষ্টি ফেলে তাকিয়ে আছে। কি হচ্ছে কিছুই বোধগম্য হচ্ছে না তার। মেয়েটা প্রস্থান করতেই কুহুর হাত ধরে সামনে এগিয়ে গেল রওনক। কাঠের ব্রিজ পেরিয়ে হেঁটে যাচ্ছিল রওনক। আশপাশে দৃষ্টি বুলিয়ে যাচ্ছিল কুহু। সারিবাঁধা কয়েকটা কটেজ জলের উপর। টিনের ছাদ। অজস্র ঝিঁঝি পোকার ডাক কানে বাজছে। একদম শেষের রুমটায় গিয়ে দরজা ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করলো রওনক। আবছা অন্ধকারে কিছুই দেখতে পেল না কুহু। নাকে গোলাপের সুমিষ্ট ঘ্রাণ ধাক্কা খাচ্ছে। আচমকা হলদে আলো জ্বলে আলোকিত হয়ে গেল গোটা কক্ষ! সামনে বিছানা লাল, সাদা গোলাপ দিয়ে সাজানো। পাশে ছোট টেবিলে ল্যাম্পশিট। বরাবর সামনে তাকাতেই বেশ বড়সড় আয়নায় দৃষ্টি আঁটকে গেল কুহুর। রওনক তার দিকে তাকিয়ে আছে গভীর মনোযোগ নিয়ে। হাতে একটা ব্যাগ। এগিয়ে এসে কুহুর হাতে ধরিয়ে দিয়ে তৈরি হতে বললো ঝটপট। রাতের খাবারের অর্ডার করার জন্য বেরিয়ে গেল রওনক। কুহু থ মেরে দাঁড়িয়ে রইল। একমুহূর্তের জন্য মনে হচ্ছে কোনো কল্প জগতে সে! চারিদিকের পরিবেশ খুবই সুন্দর! যতটা মন খারাপ নিয়ে এসেছিল ঠিক তারচে দ্বিগুণ ভালো লাগছে এখন। ব্যাগ খুলতেই একটা লাল টুকটুকে শাড়ি পেল কুহু। কিয়ৎক্ষণ হাতে নিয়ে তাকিয়ে রইল। মুহূর্তে একরাশ লজ্জা ঘিরে ধরলো তাকে। শাড়ি দিয়ে তৎক্ষনাৎ মুখ ঢেকে নিল সে। মিনিট দশ পরে রওনক এসে দরজায় কড়া নাড়লো। সবে শাড়ি পরে আয়নার সামনে দাঁড়িয়েছিল কুহু। রওনকের উপস্থিতি তার স্পন্দন বাড়িয়ে দিল। হেঁটে কাঠের দরজার সামনে এসে বলল সে,
"কি শাড়ি নিয়ে এসেছেন এটা?
ওপাশ থেকে বলল রওনক,
" এটা শুধু আমার সামনে পরলেই হবে। অন্য কেউ তো আর দেখবে না। দরজা খোলো।
মিনিট এক কোনো সাড়া মিলল না। আচমকা খট করে কাঠের দরজার শব্দ হলো। রুমে প্রবেশ করতেই ভ্রু কুঁচকে গেল রওনকের। সম্পূর্ণ রুম অন্ধকার। খোলা জানালার পাশে দাঁড়িয়ে আছে কুহু। দূর থেকে আবছা আলো এসে প্রবেশ করছে রুমে। এগিয়ে গিয়ে টেবিলে থাকা ল্যাম্পশিট টা জ্বালিয়ে দিল রওনক। কুহুর অবয়ব এখন স্পষ্ট তার চোখের সামনে। বাহিরে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে জোনাকিপোকা দেখছে কুহু। ধীর পায়ে এগিয়ে আসলো রওনক। কুহুর হাত ধরতেই ভীষণ চমকালো কুহু। ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল মুহূর্তে। কুহুকে টেনে নিয়ে আলোর সামনে এসে দাঁড়াল রওনক। পাতলা টিস্যু শাড়ি গায়ে জড়ানো কুহু লজ্জায় দৃষ্টি নিচু করে রাখলো। মিনিট এক পর সেই তরুণী মেয়েটার কন্ঠস্বর পাওয়া গেল। খাবার নিয়ে এসেছে সে। এগিয়ে গিয়ে খাবার নিয়ে ফের দরজা আঁটকে দিল রওনক। পাশেই বেতের টেবিলের উপর রাখলো। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে কুহুকে ডাকলো খাওয়ার জন্য। খাবার এক এক করে নিজেই টেবিলে সাজিয়ে নিল।
"আচ্ছা, মিথ্যে বলে হুট করে এখানে কেন নিয়ে এলেন আমায়?
দৃষ্টি তুলে কুহুর দিকে তাকিয়ে তপ্ত শ্বাস ফেলে বলল রওনক,
" তোমার সঙ্গে লুকোচুরি খেলবো তাই। প্লিজ এখন বোকা বোকা কথা বলে এই সুন্দর মুহূর্ত টা নষ্ট করে দিও না।
কুহু পাল্টা আর কিছু বলল না। আঁচল টেনে গা ঢেকে নিয়ে জড়োসড়ো হয়ে বসলো। সবটাই নীরবে পর্যবেক্ষণ করলো রওনক। পরক্ষণে খাবার প্লেটে তুলে নিয়ে খাইয়ে দিল কুহুকে। ফ্যালফ্যাল দৃষ্টি ফেলে তাকিয়ে রইল কুহু। এতটা ভালোবাসা প্রাপ্য ছিল তার? একটা অপছন্দের মানুষ কি করে এতটা পছন্দের হয়? প্রায় মিনিট বিশ পর আবারো সেই মেয়েটির কন্ঠস্বর পাওয়া গেল। কুহু দরজা খোলার জন্য উঠতেই রওনক গম্ভীর স্বরে বলল,
"এই শাড়ি পরে যেতে হবে তোমাকে। আমি যাচ্ছি।
" সমস্যা কি? সে তো মেয়ে।
"তো? মেয়ে বলে কি তার চোখ নেই?
পাল্টা আর কিছু বলল না কুহু। এগিয়ে গেল জানালার পাশে। এখানকার মধ্যে সবচেয়ে ভালো লেগেছে এই জায়গাটাই। দূরে গ্রামীণ পরিবেশ দেখা যাচ্ছে অনায়াসে! নিচে তাকালেই জলে ফুটে আছে লাল শাপলা। অগণিত জোনাকপোকা দল বেঁধে উড়ছে! যেন আকাশের নক্ষত্র গুলো চোখের সামনে নেমে এসেছে! হাত বাড়ালেই ছোঁয়া যাবে এত কাছে! ভাবনার মাঝেই একজোড়া হাত পেছন থেকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে নিল কুহুকে। কুহু পেটের কাছে তাকাতেই দেখলো একগুচ্ছ লাল গোলাপ রওনকের হাতে। ততক্ষণে কানের পাশে ফিসফিস করে বলল রওনক,
" শুভ জন্মদিন বউ!
কানের পাশে উষ্ণ শ্বাস পরতেই মৃদু কেঁপে উঠলো কুহু। নিজের জন্মদিন বেমালুম ভুলে বসে ছিল! আচমকাই তার মনে পড়লো প্রতিবছর তার জন্মদিনে তার রুমের বেলকনিতে নুপুর আর গোলাপ রেখে যেত কেউ। সেটা কে আজও অজানা কুহুর। ততক্ষণে গোলাপ বাড়িয়ে ধরলো রওনক। সাথে ছোট্ট একটা চিরকুট। হাসিমুখে হাতে নিল কুহু। এযাবৎ তার জন্মদিন এত আয়োজন আর সুন্দর করে পালন করা হয়নি। ঝাপসা চোখে চিরকুটের লেখাটা পড়লো, " আই লাভ ইউ সো মাচ, কুহু. ইউ আর দ্য হার্টবিট অফ মাই সোল. ফ্রম মাই বিগেনিং টু মাই এন্ড, ইউ আর এভ্রিথিং. আই ওয়ান্ট টু সেলিব্রেট দিস ডে উইথ ইউ এভ্রি ইয়ার।
টেবিলের উপর হার্ট শেইফ কেকের চারিপাশের মোমবাতি গুলো জ্বালাতে জ্বালাতে বলল রওনক,
"বোকা মেয়ে, তুমি আমার জন্মদিন কিভাবে পালন করেছিলে মনে আছে? বুকে তো রীতিমতো ছু্-ড়ি বসিয়ে দিয়েছিলে! কেক কা-টার পরিবর্তে আমার হৃদপিণ্ড কা-টতে চেয়েছ! অথচ দেখো আমি কত যত্ন আর আদর নিয়ে তোমার জন্মদিন পালন করছি!
কুহু যেন খানিক লজ্জা পেল। ঘড়ির কাটা বারোটা ছুঁয়েছে। কুহুকে ফের টেনে এনে পাশে বসিয়ে দিল রওনক। একত্রে কেক কা-টলো দু'জন। খানিকটা কেক নিয়ে কুহুকে খাইয়ে দিল রওনক। কুহু কেক হাতে তুলতেই বাঁধ সাধলো রওনক। জিগ্যাসু দৃষ্টি কুহুর। ঈষৎ হাসি রওনকের ওষ্ঠজুড়ে। মাথা খানিকটা নামিয়ে কুহুর ঠোঁটে লেগে থাকা ক্রিমটুকু জিভ দিয়ে স্পর্শ করে খেয়ে নিল রওনক। কুহু যেন বরফের মতো জমে গেল মুহূর্তে। তার মস্তিষ্ক এটুকু বুঝতে পারলো রওনক ইচ্ছে করেই তার ঠোঁটে কেকের ক্রিম মেখে দিয়েছে। কুহুর পেছনে হাত রেখে খানিকটা কাছে টেনে নিয়ে ফিসফিস করে বলল রওনক,
"গেট রেডি টু এক্সেপ্ট মাই লাভ!
কুহু তাকিয়ে রইল রওনকের ঘোরলাগা চোখে। কপালে চুল এলোমেলো হয়ে আছে। হাত দিয়ে ঠিক করে দিতে লাগলো কুহু। হাত ধরে থামিয়ে দিল রওনক। এই মুহূর্তে কুহুর কাঁপা ঠোঁট জোড়া ভীষণ ভাবে আকৃষ্ট করলো তাকে। মৃদু চুম্বনে জড়িয়ে গেল সে। পুরো সময় তাকে থমকে দিল মুহূর্তে! চোখ বুজে ফেলল কুহু। নিঃশ্বাসের গতিপথ বৃদ্ধি পেল তার। জড়িয়ে নিল রওনককে। কাঁধ থেকে চুল সরিয়ে দিয়ে গলায় উষ্ণ চুমুতে ডুবে গেল রওনক। ভয়ানক কেঁপে উঠলো কুহু।মেরুদণ্ড বরাবর শীতল স্রোত বয়ে গেল। ভয়ানক সব অনুভূতিরা চোরাবালির মতো তাকে টেনে নিলো অতল গহ্বরে! মুহূর্তে কুহুকে কোলে তুলে নিল রওনক। শুভ্র রঙা চাদরে অজস্র ফুলের পাপড়ি বিছানো। কুহুকে নামিয়ে দিল রওনক। পায়ের কাছ থেকে শাড়ি খানিকটা তুলে দিয়ে পকেট থেকে নুপুর বের করে যত্ন নিয়ে পরিয়ে দিল। পরক্ষণে তাকালো কুহুর চোখের দিকে। এলোমেলো শাড়িতে যেন কুহুর সৌন্দর্য বেড়েছে বহুগুণ! শার্টের বোতাম খুলতে খুলতে এগিয়ে গেল রওনক। উন্মুক লোমশ বক্ষস্থলে দৃষ্টি পরতেই তৎক্ষনাৎ দু'হাতে মুখ ঢেকে নিল কুহু। এখন যে ভালবাসার প্রলয়ঙ্কারী ঝড় বইবে, তার পূর্ভাবাস মন জানিয়ে দিল! মুহূর্তে হৃৎস্পন্দন বেড়ে গেল। অনুভূতির সায়রে ডুবে আজ নির্ঘাত ম-রণ হবে তার।
◼️
পরীক্ষার আর হাতেগোনা তিনদিন বাকি। রিশা সকালে উঠেই মায়ের কাছে খবর পেয়েছে আজ তার এনগেজমেন্ট। আশফিক চলে যাবে আর বিশদন পর। রিশার পরীক্ষার পর বিয়ের আয়োজন হবে। হতভম্ব হয়ে বসে রইল রিশা। ভেবেছিল আশফিক ভাই তাকে বিয়ে করতে রাজি হবে না। বিয়েতে রাজি এমন কিছুও তো বলেনি! একবার কি রিশার মত নেওয়ার প্রয়োজন ছিল না? বিছানা থেকে হাতড়ে ফোন নিল। রাতিমকে ম্যাসেজ পাঠালো একঘন্টার মধ্যে যেন দেখা করে। একটা রেস্টুরেন্টের ঠিকানা লিখে দিল। উঠে ঝটপট তৈরি হয়ে বেরিয়ে গেল রিশা। কিচেন থেকে লক্ষ্য করেছে কুহু। এই ক'দিন আশফিক ভাইকে নিয়ে কিছুই বলেনি রিশা। ব্যাপারটা তাকে অবাক করেছে! তবে কি রিশা এই বিয়েতে রাজি নয়? কিন্তু এটা কিভাবে সম্ভব?
•
রেস্টুরেন্টে অনেক্ষণ যাবৎ বসে আছে রিশা। আজকে সে সরাসরি রাতিম ভাইয়ের সাথে কথা বলবে। যদি ফিরিয়ে দেয় তাহলে আর কখনোই তার সামনে এসে দাঁড়াবে না। কয়েক মিনিটের মধ্যে রাতিমকে আসতে দেখা গেল। প্রায় দু'ঘন্টা সময় লাগিয়ে দিয়েছে সে। আকাশী রঙা চেক শার্ট গায়ে জড়িয়ে। কপাল জুড়ে ঘাম। আশপাশে কিছু খেয়াল করলো না রিশা। উঠে গিয়ে রাতিমকে জড়িয়ে ধরে ভাঙ্গা স্বরে বলল,
"আমার বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে রাতিম ভাই। আমি আপনাকে চাই। অন্য কাউকে মানা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। কেন দূরে ঠেলে দিচ্ছেন আমাকে? আপনার জব নেই এই কারণে? আমি কিছুই জানতে চাই না। কিছুর প্রয়োজনও নেই। শুধু আপনাকে চাই। হোক সেটা যেকোনো কিছুর বিনিময়ে!
রিশাকে জোরপূর্বক ছাড়িয়ে গালে সজোড়ে থাপ্পড় বসিয়ে দিল রাতিম। ক্রোধে কাঁপতে লাগলো। রিশা হতভম্ব! শক্ত গলায় বলল রাতিম,
" আর কতবার বোঝালে বুঝবে তুমি? কোন অধিকারে জড়িয়ে ধরো? একজন মেয়েকে এতটা নির্লজ্জ হওয়া মানায় না আইরিশ। আমি যদি বিয়ে করে সুখী হতে পারি তাহলে তুমি কেন বোকার মতো আমার জন্য কষ্ট পাবে?
রাতিমের শেষের কথাটা তরঙ্গের মতো কানে বাজলো রিশার। পাল্টা প্রশ্ন করলো সে,
"বিয়ে? কার বিয়ে? আপনি বিবাহিত?
" হ্যাঁ। গতসপ্তাহে বিয়ে করেছি আমি। আমার স্ত্রীর নাম রূপা। খুব সুখেই আছি আমি। দয়া করে এভাবে আর বিরক্ত করো না আমাকে।
রিশার চোখ বেয়ে জল পরছে। হাতের উল্টো পিঠে মুছে নিয়ে বলল,
"বিশ্বাস করি না আমি।
রাতিম কিছু বলল না। পকেট থেকে ফোন বের করে তাদের বিয়ের ছবি দেখালো। মেয়েটা অতিব সুন্দরী। রিশার চেয়েও বেশি। লাল টুকটুকে শাড়ি জড়িয়ে আছে। পাশেই সাদা পাঞ্জাবি পরে আছে রাতিম। মুহূর্তে কলিজা ছ্যাত করে উঠলো রিশার। নিশ্বাস ভারী হয়ে আসলো। পুরো পৃথিবী তাকে কেন্দ্র করে ঘুরতে লাগলো! অসহনীয় এক যন্ত্রণা শরীর জ্বা-লিয়ে দিল! এলোমেলো পা ফেলে প্রস্থান করলো সে। রাতিমের চোখ ভিজে উঠলো। পরিস্থিতির কারণে আজ রিশাকে হারিয়েছে সে! জীবন আমাদের চাওয়া মতো সরলরৈখিক ভাবে চলে না। আজ হয়তো রাতিমের প্রতি একরাশ ঘৃণা নিয়ে চলে গেছে রিশা। এমনটাই চেয়েছে রাতিম। দিনশেষে রাতিমকে স্বার্থপর ভেবে ভালো থাকুক মেয়েটা। এভাবে কষ্ট পেতে দেখলে রাতিমেরও কষ্ট হয়। তার অনুভূতিটুকু নীরবেই রয়ে যাক। গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে হলো রাতিমের। নিজেকে কেমন পাথর মনে হলো!
•
রিশার ঘর গুছিয়ে দিচ্ছে কুহু। ইদানিং কেমন এলোমেলো থাকে ঘরটা। আচমকা রুমে এসে দরজা লাগিয়ে হাউমাউ করে কেঁদে ফেলল রিশা। কুহু আশ্চর্য হয়ে গেল! কিয়ৎক্ষণের জন্য তার মস্তিষ্ক কাজ করা বন্ধ করে দিল। দৌড়ে এসে রিশাকে বুকে জড়িয়ে নিল। কুহুকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরে বাঁধভাঙা কান্নায় ভেঙ্গে পরলো রিশা। কুহু কিছুই বুঝতে পারলো না কি হয়েছে! বারংবার রিশাকে জিগ্যেস করলো কান্নার কারণ। কাঁদতে কাঁদতে কুহুকে রাতিমের কথা জানিয়ে দিল রিশা। চোখমুখ কুঁচকে বলল কুহু,
"আমার সাথে বিয়ে ঠিক হয়েছিল ওই রাতিম? তার সাথে তোর পরিচয় হলো কি করে? কি বলছিস এসব?
কান্নার দাপটে কথা বলতে পারলো না রিশা। থেমে থেমে বলল,
" রাতিম ভাই তো ভাইয়ার বন্ধু! তোর সাথে তার বিয়ে হওয়ার কথাই ছিল না! সব ভাইয়ার প্ল্যান।
ঘর মোছার জন্য জুলেখা দরজায় কড়া নাড়লো৷ রিশা কোনোরকম উঠে ওয়াশরুমে চলে গেল। কুহু হতভম্ব হয়ে বসে রইল। কোথাও একটা হিসেব মিলছে না তার। তবে কি রওনক ভাই ইচ্ছে করে রাতিমকে দিয়ে বিয়ের নাটক সাজিয়েছে? কুহুকে হাসির পাত্রী বানিয়েছে সবার কাছে? চোখ জলে ভেসে উঠলো। কোনোরকম দরজা খুলে নিজের রুমে চলে আসলো কুহু। কেন জানি খুব কান্না পাচ্ছে তার। টেবিলের উপর থেকে খাতা আর কলম নিয়ে লিখতে বসলো। চোখ বেয়ে জল পরছে তার। রওনক ভাইয়ের থেকে অনেক অনেক দূরে চলে যাবে সে।
.
.
.
চলবে........................................................