মাই মিস্টিরিয়াস প্রিন্স - পর্ব ৩৪ - মৌমিতা মৌ - ধারাবাহিক গল্প


নোহারা কাজ শেষে বাসায় ফিরছে। মনটা উৎফুল্ল হয়ে আছে। কয়দিন যাবত বিদেশি ভাল্লুকটা জ্বালাচ্ছিলো তাকে। আজ আশা করা যাচ্ছে লোকটা আসবে না। তাই বেশ খুশি নিয়ে লাফিয়ে লাফিয়ে হাঁটছিল নোহারা। বাসায় যাওয়ার জন্য সেই গলির সামনে এসে পা দুটো থেমে গেল। এই গলির সামনেই সন্ধ্যা ব্রোকে দেখা যেতো প্রতিদিন। আজ সে নেই,নোহারার মুখে বিস্তৃত হাসি দেখা গেলো। সে খুশি , খুশি হওয়ারই তো কথা। কয়দিন মনে হচ্ছিল সে একটা খাঁচায় বন্দী ছিল। আজ সেই খাঁচা থেকে মুক্তি পেয়েছে। স্বাধীনতার অনুভূতি হচ্ছে নোহারার মনে। গলির অন্দরে প্রবেশ করে ধীর পায়ে হাঁটছে নোহারা। মাথায় ঘুরপাক খেলো কালকের কথা। লোকটাকে মারার পর সে একটা শব্দও উচ্চারণ করেনি। কিন্তু যখন নোহারা রেস্টুরেন্ট থেকে বের হতে নিয়েছিল, তখন সেই ভাঙাচোরা গলায় অনুরোধ,' ডোন্ট লিভ মি প্লিজ!' 

পা দুটো নিজের অজান্তেই থেমে গেলো নোহারার। সে এক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে রইলো। এরপর কিছু একটা ভেবে দ্রুত পেছন ফিরে দৌড় দিলো।

ভেস্পার অর্থ সন্ধ্যা! যাকে শুধুমাত্র সন্ধ্যা হওয়ার পরই চোখে দেখা যায়। মনের দিক দিয়ে খারাপ না নিকোলাই ভেস্পার! নোহারাকে লিটিল গার্ল বলে ডাকে! আদুরে ডাকই তো মনে হয়েছিল প্রথম দিন। কিন্তু সন্ধ্যা ব্রোর অদ্ভুত আচরণে নিজের জীবন নিয়ে শঙ্কা উৎপন্ন হয়, যার ফলে লোকটার প্রতিটি কথায় বিরক্ত অনুভূত হয় নোহারার। প্রথম দিন স্বচক্ষে দেখা গিয়েছিল তার লাল মণির চোখ দুটো যা অন্ধকারে জ্বলজ্বল করছিল, রক্ত পান করার চেষ্টা আর মেয়েদের বশে আনা।সব দেখেছিল নোহারা। বুকের রক্ত ছলকে উঠেছিল তার। মনে হয়েছিল ভয়ংকর দুঃস্বপ্ন চোখের সামনে দেখে ফেলেছে যা সত্যি হতে মাত্র কয়েক সেকেন্ড বাকি। 

সন্ধ্যা ব্রোর আচরণ নোহারার প্রতি অদ্ভুত রকম নমনীয় ছিল। যত্নে মোড়ানো ডাক, চোখের নরম দৃষ্টি সব মিলিয়ে মনে হতো, লোকটা তাকে বিশেষভাবে দেখছে। অনন্যার কথাই কি তবে সত্যি? সন্ধ্যা ব্রো কি সত্যিই তাকে পছন্দ করে? কিন্তু নোহারা তো পছন্দ করে না! একজন ভ্যাম্পায়ার, যার অস্তিত্বই মানুষের বিরুদ্ধে, তাকে কীভাবে বিশ্বাস করবে নোহারা? যদি হঠাৎ করে সেই প্রশান্ত, কোমল স্বর একদিন দানবীয় হয়ে ওঠে? যদি এক মুহূর্তের দুর্বলতায় সে নোহারার শরীর থেকে সবটুকু রক্ত শুষে নেয়? জীবনের শেষ দিন দেখার জন্যই কি এই অনুভূতি মনে বসাবে নোহারা? একজন ভ্যাম্পায়ার কি সত্যিই ভালোবাসতে পারে? যার জন্য মানুষ শুধু এক ধরনের চাহিদা পূরণের উৎস! সে কি করে ভালোবাসতে পারে?

নোহারা বাড়ির উল্টো দিকে রেস্টুরেন্টটা। অনেক খানি যেতে হয়, নোহারা দৌড়ে সেখানে পৌঁছে হাঁপাতে লাগলো। কয়েক সেকেন্ড সময় নিয়ে ভেতরে প্রবেশ করলো। মোটামুটি বড়লোকি রেস্তোরাঁ! রেস্তোরাঁর ভেতর আলোর ঝলকানি, সাজানো টেবিলের সারি, আর ব্যস্ত পরিবেশনকারীদের আনাগোনা। অনন্যা একজনকে ডাক দিলো। পরিবেশনকারী সামনে আসতেই নোহারা জিজ্ঞেস করে বসলো,
'কাল রাতে, এই সময়ে, এখানে একজন লোকের সঙ্গে মারামারি হয়েছিল। তারপর কী হয়েছিল, আপনি জানেন?'

পরিবেশনকারী কিছুক্ষণ ভ্রু কুঁচকে মনে করার চেষ্টা করছিল। কিন্তু মনে করতে না পেরে সে আরেকজনকে ডাকলো। দ্বিতীয় পরিবেশনকারী আসতেই প্রথম জন তাকে বিষয়টা জিজ্ঞেস করলো। তখন দ্বিতীয় পরিবেশনকারীর মনে পড়ল বিষয়টা। 
সে উত্তর দিলো,
'জ্বি, ওই কাস্টমারকে আমরা কয়েকজন মিলে রেস্টরুমে নিয়ে গিয়েছিলাম। পরে তিনি সেখানেই অনেকক্ষণ যাবত অজ্ঞান হয়ে থাকেন নাকি ঘুমিয়ে থাকেন বলতে পারছি না। এরপর শুনলাম তিনি ভোর সকালে উঠে বাইরে বেরিয়ে যান।'

'আপনারা ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাননি?
নোহারা আগ্রহের সহিত প্রশ্ন ছুঁড়ে বসলো।

'আহ...না! উনি তো বিল দেয়নি। তাই আমরা এখানে রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। পরে সকালে উঠে বিল মিটিয়ে তারপরে যেতে দিয়েছি।

'কিরকম মানুষ আপনারা? অন্তত ডাক্তারকে তো ডাকতে পারতেন।
নোহারার বেশ রাগ হলো।

পরিবেশনকারী নির্বিকার ভঙ্গিতে বললো,
'আমাদের রেস্টুরেন্টে এরকম কোনো পলিসি নেই, দুঃখিত।

নোহারার রাগ এবার তুঙ্গে, কণ্ঠ কাঁপছে ক্ষোভে।
'কী? মনুষত্ব দেখানোর জন্য পলিসি দরকার হয়?

লোকটি এবার কিছুটা বিরক্ত হয়ে বললো, 'দেখুন, ম্যাম, আমরা এখানে কাজ করতে এসেছি। কে পড়ে গেল, কে ব্যথা পেল, এসব দেখার জন্য আমাদের রাখা হয়নি। আমাদের কাজ হলো কাস্টমারদের খাবার পরিবেশন করা, সেটাই করছি। যার জন্য টাকা পাই, শুধু সেটাই করি।

নোহারা ঠোঁট চেপে হাসলো, ব্যঙ্গ করে বললো,
'ওহ! তাই তো! একটা মানুষকে সাহায্য করার জন্য তো আপনাদের টাকা দেওয়া হয় না, তাই না? দেশে নতুন জব আইডিয়া আনতে হবে - একজন মানুষকে সাহায্য করলে পাবেন বোনাস টাকা! তখন নিশ্চয়ই দৌড়ে আসতেন, তাই না? ফালতু মানুষ! আপনাদের রেস্টুরেন্ট সম্পর্কে খারাপ রিভিউ দেবো আমি!'

বলেই ঘুরে বেরিয়ে গেলো নোহারা, রাগে তার শ্বাস দ্রুত উঠানামা করছে। চোখের সামনে কল্পনা করে নিলো নিকোলাই ভেস্পার কীভাবে কষ্ট সহ্য করে ভোর সকালে বাড়ির দিকে রওনা হয়েছে। কীভাবে তার শরীর রৌদ্রের আলোয় পুড়ে যাচ্ছিলো! বুকের ভেতরটা অজানা ব্যথায় কুঁকড়ে উঠলো তার। লোকটা কী ঠিক আছে আদৌ? 

সূর্যের আলোয় ভ্যাম্পায়াররা পুড়ে যায়। এই বিষয়টা নোহারা খুব ভালো করেই জানে। ছোটবেলা থেকেই ভিন্নধর্মী, রহস্যময় জিনিসের প্রতি তার অদ্ভুত টান ছিল। অনন্যাও একই রকম। দুজনে মিলে কত রাত জেগে মুভি দেখেছে, কত বই পড়েছে, কত তর্কে জড়িয়েছে।ভ্যাম্পায়াররা আসলেই আছে কি না, থাকলে কীভাবে বেঁচে থাকে, কীভাবে শিকার করে! তাদের জানা ছিল এসব গল্প কথা, কল্পনার জগতে বন্দি রহস্যগুলো। কিন্তু বাস্তবের মাটিতে দাঁড়িয়ে, নিজের চোখের সামনে এমন কিছু সত্যি হতে দেখবে। এটা কখনো কল্পনাও করেনি তারা।

•••••••••••••••••

'তো আপনি বলছেন জাহাঙ্গীর পুত্র শাহজাহানের ১৪ টি সন্তান?

কৌশিক অনন্যার প্রশ্ন শুনে মাথা নেড়ে,
'হুম!

'মমতাজ চৌদ্দ নাম্বার সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে মারা যান?

'হ্যাঁ!

অনন্যা একটু চুপ থেকে বলল,
'তো এদিকে তো শাহজাহানের দোষ! তাজমহল বানাক অথবা স্বর্ণমহল। সে বেচারিকে দিয়ে এতো সন্তান পয়দা করালো কেন?

কৌশিক ঠোঁট চেপে হাসল। মেয়েটার মাথার মধ্যে কেমন সব চিন্তা আসে! সে অনন্যার মাথায় আলতো একটা টোকা মেরে বলল,
'এদিকে শাহজাহানের ও কোনো দোষ নেই।‌
আগেকার দিনে জন্ম নিয়ন্ত্রণ করার পদ্ধতি ছিল না তাই মিলন হলেই বাচ্চা আসতো। সো, এভাবে এভাবেই।

'আচ্ছা, এই ব্যাপার। শাহজাহান আবার তিনটে বিয়ে করেছে। এটা মেনে নিতে পারছি না। মমতাজকে ভালোবাসলে আরো দু'টো বিয়ের কি দরকার ছিল?

'মমতাজ দ্বিতীয় স্ত্রী ছিল। আগেকার রাজা-বাদশাহরা সাধারণত কূটনৈতিক কারণে একাধিক বিয়ে করত। রাজ্য বাড়ানো, ক্ষমতা ধরে রাখা! এসব কারণেই এসব বিয়ে হতো।

'তারপর ও মমতাজের পর আরেকটা কেন বিয়ে করলো?মমতাজ কিছু বললো না কেন?

'হয়তো দরকার ছিল তাই!

'তাহলে প্রয়োজনের তাগিদে আপনিও আরেকটা বিয়ে করবেন?

কৌশিক অনন্যার আকস্মিক প্রশ্নে চুপ হয়ে গেল। অনন্যা ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছে কৌশিক স্যারের দিকে। স্যার অনেক ক্ষণ কিছু না বলায় অনন্যা ঠোঁট উল্টে কাঁধে হাত রেখে হালকা নেড়ে দিল,
"কী হলো? করবেন, তাই তো? বুঝলাম!"

কৌশিক মুচকি হাসলো। অনন্যা মাথা নিচু করে খাতার দিকে তাকিয়ে রইল। চোখ পড়লেও মনোযোগ ঠিকমতো থাকছে না। নিচু স্বরে বলল,

'ঔরঙ্গজেবের কথা কী বলেছিলেন?

কৌশিক খাতার ওপর কলম চালিয়ে যেতে যেতে বলল,
'শাহজাহান রাজমহল বানাতে পছন্দ করতেন। তাজমহল তো আছেই, তার মতো আরও অনেক কিছু তৈরি করেছিলেন। এমনকি একসময় তিনি শ্বেত তাজমহলের বিপরীতে নিজের জন্য কালো তাজমহলও বানিয়ে ছিলেন। কিন্তু সম্পূর্ণ তৈরি করা হয়নি।

অনন্যা অবাক হয়ে তাকাল,
'কালো তাজমহল? কেনো?

'ধারণা করা হয়, তিনি চেয়েছিলেন সাদা তাজমহলে মুমতাজ শায়িত থাকবেন এবং কালো তাজমহলে তিনি নিজে চিরনিদ্রায় থাকবেন, যাতে তাঁদের প্রেম চিরন্তন হয়ে থাকে।

অনন্যা কিছুক্ষণ ভাবল, তারপর প্রশ্ন করল,
'ওহ, কিন্তু সম্পূর্ণ তৈরি কেনো হলো না?

কৌশিক উত্তর দিল,
'সমস্যা হলো, এত টাকা এসব বিলাসিতায় উড়িয়ে তিনি অর্থনীতির বারোটা বাজিয়ে দিচ্ছিলেন। তার ছেলেরা এতে বিরক্ত হয়ে ওঠে। বিশেষ করে ঔরঙ্গজেব। একদিন সে বাবাকে বন্দি করে ফেলে যাতে তিনি আর এই সব করতে না পারেন।

অনন্যা চুপ করে শুনছিল। একটু ভেবে বলল,
'তাহলে শেষ জীবনটা শাহজাহানের কেমন কেটেছে?

কৌশিক খাতার ওপর কলম ঘুরিয়ে নিয়ে বলল,
'একটা ছোট্ট ঘরে বন্দি ছিলেন, জানলা দিয়ে শুধু দূর থেকে তাজমহল দেখা যেত। সেই তাজমহল, যা তিনি তার সবচেয়ে প্রিয় মানুষের জন্য বানিয়েছিলেন।

অনন্যা নিঃশ্বাস ফেলল।
'মানুষ কখনো কখনো কত নির্মম হয়ে যায়, তাই না?

'কি জানি! এমনিতেও মমতাজ ছাড়া শাহজাহান ভালো ছিলেন না। শেষ দিকে সেই তাজমহলই তার একমাত্র বেঁচে থাকার অবলম্বন ছিল।

অনন্যা নিশ্চুপ হয়ে পড়লো। 
কৌশিক বললো,
'অনেক কিছু বললাম আজ! তোমাকে তো বেশি পড়িয়ে ফেললাম মনে হচ্ছে!

অনন্যা তারপর ও নিশ্চুপ। কৌশিক চিন্তায় পড়ে গেল। নরম গলায় বললো,
'কী? চুপসে গেলে কেনো?

অনন্যা অল্প সময় চুপ করে থেকে, শেষমেশ শান্ত স্বরে বললো, 'না, কিছু না। ধন্যবাদ।

কৌশিক হালকা এক হাসি দিয়ে নিজের শার্টের উপরের বোতাম খুললো, নিজেকে আরামদায়ক অনুভব করালো। তারপর একটু কাছে এগিয়ে এসে অনন্যার দিকে চোখ মেললো। ধীরে ধীরে তার আঙুল অনন্যার থুতনির কাছে গিয়ে স্পর্শ করলো। মেয়েটাকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে অনন্যার আধভেজানো চোখে চোখ রাখল,
'হুমম, রাগ? কিসের জন্য, প্রিন্সেস?

অনন্যা আচমকা চোখ তুলে স্যারের দিকে তাকালো, দৃষ্টিতে কিছুটা বিভ্রান্তি ছিল, কিছুটা বিস্ময় পূর্ণ। কৌশিক মৃদু হাসলো। তারপর কিছুটা নীচু হয়ে অনন্যার গলার ভাঁজে চোখ বোলালো,
' বেশি জোরে আঘাত দিয়েছিলাম কী? ব্যথা করছে এখনো?

অনন্যা দুদিকে মাথা নাড়লো। কৌশিক মেয়েটার থুতনি থেকে হাত সরিয়ে ধীরে ধীরে চেয়ারের দুই হাতলে শক্তভাবে থামিয়ে, নিজের দিকে ঘুরিয়ে নিলো অনন্যাকে। চেয়ারটা সামান্য এগিয়ে এনে অনন্যার আরও কাছে চলে এলো সে। নিঃশ্বাসের উষ্ণতা ছুঁয়ে গেলো অনন্যার নরম গলা। মুহূর্তের জন্য থমকে গেলো মেয়েটা। বুকের ভেতর অজানা উত্তেজনায় একটা ধাক্কা লাগলো।

'কি করছেন! 
কাঁধে হাত রেখে ফিসফিস করে বললো অনন্যা।

কৌশিক কিছু বললো না। নিঃশব্দেই অনন্যার কোমরে হাত রাখলো। হালকা চাপ দিয়ে আরও কাছে টেনে আনলো অনন্যাকে, তারপর গলার ভাঁজে ঝুঁকে এল। কৌশিকের হালকা গোলাপি ঠোঁট ছুঁয়ে গেলো অনন্যার উষ্ণ ত্বক। একবার! দুইবার! বেশ কয়েক বার চুমু খেলো কৌশিক! খুব ধীরে, গভীরভাবে।

অনন্যার শরীর কেঁপে উঠলো, ঠোঁট কাঁপলো কিছু বলার জন্য, কিন্তু শব্দ বের হলো না। তার কোমরে স্যারের হাতের স্পর্শ, আর গলায় অনুরণিত শিহরণ খেলে যাওয়া ঠোঁটের স্পর্শ সমস্ত অনুভূতিকে আটকে রাখলো এক বিন্দুতে।

কৌশিক ধীরে ধীরে মুখ সরিয়ে আনলো। ঠোঁটে মৃদু হাসি দেখা দিয়েছে তার। সে নিচু স্বরে বললো,
'বিয়ে যতবারই হোক, আসক্তি একবারই হয়, ভালো লাগাও একবারই হয়। যদি শাহজাহানের মতো আমাকেও বিয়ে করতে হয়, করবো... কিন্তু তাজমহল? তাজমহল আমি শুধু তোমার জন্যই বানাবো।

অনন্যা নিশ্চুপ হয়ে চোখের পলক ফেললো। কৌশিক অনন্যার কাছে থেকে কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে কপালের দিকে ঝুঁকে গভীরভাবে ওষ্ঠ চেপে ধরলো। চুম্বনের মৃদু আওয়াজ ছড়িয়ে পড়ল। অনন্যা বোকা বনে গেলো। কি করবে বুঝতে পারছিলো না। আটকাবে নাকি মা/রবে? নাকি বকাঝকা দেবে? করবেটা কি আসলে?

কৌশিক অনন্যার চুলগুলো হালকা হাতে ঠিক করে, মৃদু কণ্ঠে বললো,
"খাওয়া-দাওয়া হয়েছে?"

'হুম!

'আমার হয়নি।

'ওহ! খেতে যান তাহলে।

কৌশিক হালকা হাসি দিয়ে অনন্যার কাছে এগিয়ে এলো। সে চোখের পলকে অনন্যার নরম ঠোঁটের দিকে ঝুঁকে গেল। হঠাৎ, অধরে অধর স্পর্শ করলো। খুব মৃদু, অবিচলিত সেই স্পর্শ। অনন্যার শরীর স্থির হয়ে গেল, একটি শিহরণ সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়লো। সে স্যারের কাঁধে হাত রেখে নিজেকে সরিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করলো। কিন্তু স্যারের আসক্তিময় স্পর্শে সব কিছু ভুলে গেল সে। আর কিছুই মনে রইলো না।

কৌশিক অল্প সময়ের জন্য তার ঠোঁট রেখেছিল অনন্যার ঠোঁটে, এক নিঃশ্বাসে অনুভূতির গভীরে হারিয়ে যেতে লাগলো অনন্যা। তারপর, তার ঠোঁট আলতো করে ছেড়ে দিয়ে সুরেলা কণ্ঠে বললো,
'এবার আমার ও হয়েছে।

অনন্যা নিজেকে সামলে চেয়ার ধরলো। কৌশিক উঠে দাঁড়িয়ে আবার বললো,
'দরজা বন্ধ করবে না। আমি আবারো আসবো।

'স্যার!

কৌশিক দরজার দিকে পা বাড়াচ্ছিল, কিন্তু অনন্যার ডাকে থেমে গেলো। সে ধীরে মুখ ঘুরিয়ে মেয়েটার দিকে তাকালো। 
অনন্যা বললো,
'লন্ডনে আপনার নিজস্ব মিউজিয়াম আছে?

কৌশিক একপল চোখের ঝিলিক দিয়ে বললো,
'হুম! কেনো?'

অনন্যা একটু থেমে, আগের প্রশ্নটা আরও খোলামেলা করে বললো,
'আপনি বিদেশে ইউনিভার্সিটির প্রফেসর ছিলেন, নিজের একটা মিউজিয়াম ও আছে। তারপরও বাংলাদেশে কেনো এসেছেন? টাকার তো অভাব নেই আপনার। তাও কেনো?'

কৌশিক দীর্ঘশ্বাস ফেলে কিছুটা দূরে তাকিয়ে বললো,
'কিছু প্রয়োজনেই এসেছি।

'প্রয়োজন মিটলে চলে যাবেন?

সে কিছুটা নিশ্চিতভাবে উত্তর দিল,
'হ্যাঁ! কিন্তু অনেক সময়ের ব্যাপার।'

অনন্যা কিছুটা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো,
'আচ্ছা! আপনি বাংলাদেশের পুরোনো আমলের ইতিহাস সম্পর্কে কীভাবে জানেন?'

কৌশিক স্মিত হেসে বললো,
'এখানে এসে রিসার্চ করেছি!'

অনন্যা আরও একবার চিন্তিত হয়ে কৌশিকের দিকে তাকালো এবং বললো,
'আপনি প্রোগ্রামিং পারেন?'

কৌশিক কিছুটা মুচকি হেসে উত্তর দিল,
'হ্যাঁ, করা হয়েছিল। তবে সব পারি না।'

অনন্যা বিস্মিত হয়ে জানতে চাইল,
'আর কী পারেন?'

'আম... অনেক সাবজেক্ট নিয়ে আমার ধারণা আছে। যখন যেটা মন চায়, আমি সেটা নিয়ে রিসার্চ করি, বই ও লিখি।'

অনন্যা আবারো অবাক হলো, জিজ্ঞেস করলো,
'ওয়াও! আপনি বইও লিখেছেন? 

'হুম! 

'আপনার এতো নাম কেনো?

'নিজেকে লুকিয়ে রাখতে ভালো লাগে।

'কেনো?

' সব তোমাকে বলতে ইচ্ছুক নই আমি।

কৌশিক কথা না বাড়িয়ে দুয়ার খুলে চলে গেলো। অনন্যা তপ্ত নিঃশ্বাস ফেলে চোখ বন্ধ করলো, নিজের গলায় হাত ছোঁয়ালো। কিছুক্ষণ আগের কথা মনে পড়ে গেলো। লজ্জায় কুঁকড়ে উঠলো সে। লোকটা সময়ের সাথে সাথে নিজের সীমানা পেরিয়ে যাচ্ছে। অনন্যা ও কেমন আক্কেল জ্ঞান হারিয়ে লজ্জাবতী লতিকার মতো সব শুষে নিচ্ছে, কৌশিক স্যারের আচরণ নিজের মধ্যে ধারণ করে ফেলছে। অনন্যা নিজেকে ধিক্কার জানালো। কেন সে প্রতিবাদ করতে পারছে না! স্যার যাই করেন না কেনো প্রথমে অনন্যা কথা ওঠাতো, আজ তো তাও করেনি। স্যারের প্রতি এমন তীব্র আকর্ষণ কীভাবে হয়ে যাচ্ছে ওর! লোকটা নিজেকে হাসবেন্ড দাবি করছে কিন্তু ওই যে প্রয়োজন মিটলে ঠিক ই চলে যাবে অন্য স্থানে। তখন অনন্যার কী হবে? অনন্যা তো একাই পড়ে যাবে। আবারও ফিরে যেতে হবে সেই মামার বাসায়। সবার কথা শুনতে হবে। সত্যিই কি স্যার অনন্যাকে আজীবন রেখে দেওয়ার কথা বলেছিল নাকি শুধুই‌ প্রয়োজনে!
.
.
.
চলবে......................................................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

WhatsApp