তোকে চাই - পর্ব ০৩ - নৌশিন আহমেদ রোদেলা - ধারাবাহিক গল্প


হ্যাং মেরে দাঁড়িয়ে আছি। যাকে আমি যমের মতো ভয় পাই, সে যদি অর্ধ উলঙ্গ অবস্থায় আমাকে দেয়ালে চেপে ধরে দাঁড়িয়ে থাকে, তবে তা ভয় পাওয়ার জন্য যথেষ্ট সুইটেবল বলে আমি মনে করি। শরীরে বাথ টাওয়াল জড়িয়ে আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছেন শুভ্র ভাইয়া, উন্মুক্ত বুকে লেপ্টে থাকা লোম আর বিন্দু বিন্দু জল জানান দিচ্ছে মাত্রই শাওয়ার নিয়েছেন তিনি। ফরসা মুখটাকে হালকা লাল হয়ে থাকা চোখ দুটো আরও আকর্ষনীয় করে তুলছে। কিন্তু প্রশ্নটা হলো, আমাকে এখানে কেনো আনা হয়েছে? আর এভাবে চেপে ধরে থাকার কারনটাই বা কি? মেয়ে হিসেবে অবশ্যই আমার রেগে যাওয়া উচিত, কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো আমার রাগ ভয়ের নিচে চাপা পড়ে আপাতত তান্দুরী চিকেনে পরিনত হয়েছে। আমি যেভাবে ভয়ে কাঁপা-কাঁপি করছি, আমার ধারনা রাগের যদি কোনো ক্রোমোজোম থেকে থাকে তাহলে তারাও ইতোমধ্যে এই ব্যাটার ভয়ে রীতিমতো কাঁপা-কাঁপি শুরু করে দিয়েছে। এই ব্যাটা যে লুচু নাম্বার ওয়ান, সে সন্দেহ আমার প্রথম দিনই ঘুচে গেছে। উনি যে হাই লেবেলের বেশরম সেটাও আজ জানা হয়ে গেলো। ভয়ে-লজ্জায় না পারছি ওনাকে কিছু বলতে, না পারছি উনার দিকে তাকাতে। এভাবে বেশিক্ষন দাঁড়িয়ে থাকাও আমার পক্ষে সম্ভব না, হাত-পা অসম্ভব ঠান্ডা হয়ে আসছে। তার ওপর নেমক হারাম হার্টটা আমার বিরুদ্ধেই বিদ্রোহ শুরু করে দিয়েছে ইতোমধ্যে। উনিও কিছু বলছেন না, তাই ভয়ে ভয়ে আমিই বলে উঠলাম,
"আ....আমাকে এ...এখানে কেনো এ...এনেছেন?"

"গুড কোশ্চেন। তোমাকে এখানে আনার পেছনে আমার বড় সড় একটা প্লেন আছে।" (শয়তানী হাসি দিয়ে)

"ম...মানে? ক...কি পপপপ্লেন?" (কাঁদো কাঁদো গলায়)

"এই মেয়ে এতো কাঁপছো কেন?" (রাগী গলায়)

"আ...আ...আপনি প...প্লিজজ আমার সাথে এ...এমন কিছু করবেন না।" (কাঁদো কাঁদো হয়ে)

"এমন কিছু মানে? (ভ্রু কুঁচকে) লাইক সিরিয়াসলি? (চিৎকার করে) এই মেয়ে, তোমার মাথায় কি আসলেই কয়েকটা তাড় ছিঁড়া নাকি? হাউ কেন ইউ থিংক এবাউড ইট? সারাদিন সিরিয়াল দেখলে তো এসব চিন্তায় মাথায় ঘুরবে। ফুপ্পিকে জানাতেই হবে।"

আমি থতমত খেয়ে গেলাম, প্রচুর লজ্জা লাগছে। ছি ছি সত্যি তো আমি অনেক বেশি ভেবে ফেলেছি। কিন্তু আমি মোটেও সারাদিন সিরিয়াল দেখি না, হুহ। আচ্ছা উনি মা কে কি জন্য বিচার দিবে? আল্লাহ বাঁচাও আমায়,
"ক...কি বলবেন ম....মাকে?"

"বাচ্চা মেয়ের মাথায় যে এসব বাজে চিন্তা-ভাবনা ঘুরে বেড়ায় সেটা তো মা হিসেবে ফুপ্পির জানার পুরো অধিকার আছে। আর ভাই হিসেবে বিষয়টা উনাকে জানানো আমার কর্তব্য, তাই না?" (চোখ টিপে)

"ন...না। প...প্লিজ মাকে কিছু বলবেন না। প্লিজজজ! বি...বিশ্বাস করুন আমি মোটেও ওমন কিছু ভাবিনি।" (মাথা নিচু করে করুন গলায়)

"কেমন কিছু?"

"ওই তো...."

বলতে গিয়েই দেখি উনি মুখ চেপে হাসছেন, তাই আর কথা না বাড়িয়ে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইলাম।

"আচ্ছা তুমি চাচ্ছো যে, আমি তোমার মা কে কিছু না বলি, রাইট?"

"হুমম।"

"ওক্কে, বলবো না।"

"সত্যিই..." (খুশি হয়ে)

"হুমমম। বাট একটা শর্ত আছে। তোমাকে আমার জন্য একটা কাজ করতে হবে। ইউ কেন টেক ইট লাইক আ ডিল, ইউ নো না? গিভ এন্ড টেক।" (বাঁকা হাসি দিয়ে)

"ক...কি করতে হ...হবে?"

"সিম্পল। তোমার রুমে একটা পার্সেল রেখে আসছি, ওইটা তুমি কাল কলেজ যাওয়ার সময় নীলিকে দেবে।"

"আমি ওনাকে কোথায় পাবো?" (অবাক হয়ে)

"আমাদের ভার্সিটি গিয়ে দিয়ে আসবা।"

"কিহ্। আপনার মাথা খারাপ? আমি একা কিভাবে? আর আপনার জিএফ আপনি যেতে পারেন না?" (রেগে গিয়ে)

"আমি যেতে পারবো না, কজ বাবা আমাকে কাল এক মিনিটের জন্যও ছাড়বে না। তাছাড়া ম্যাডাম আমার উপর রেগে আছে, ওর মানও ভাঙাতে হবে। সো ইউ আর দ্যা বেটার অপশন ফর মি।" (চোখ টিপে)

"আমি যাবো না।" (অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে)

"ওকে যেয়ো না, আমি যাচ্ছি ফুপ্পির কাছে। কতো কিছু বলার আছে।" (যেতে নিলে)

"এই নাহ নাহ, আমি যাবো।" (মুখ গোমরা করে)

"গুড গার্ল।"

হাঠৎই অভ্র ভাইয়া রুমে ঢুকে, আমাদের এভাবে দেখে অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে। ভাইয়াদের জন্য চা নিয়ে এসে আপু শুভ্র ভাইয়াকে এভাবে দেখে চায়ের কাপ ফেলে দিয়ে চোখ চেপে ধরে চিৎকার দিয়ে ওঠে। তারপর বাকিসব ইতিহাস। আপুর চিৎকারে আর কাপ ভাঙার শব্দে সবাই রুমে এসে হাজির। সবাই চোখে এক ঝাঁক প্রশ্ন নিয়ে আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে, আর আমি? সে আর নাই বা বলি। অবশেষে নীরবতা ভেঙে আম্মু গম্ভীর কন্ঠে বলে উঠলো,
"রোদ? তুমি এই সময় এখানে কি করছিলে?"

"আ...আসলে পার...পার..." (শুভ্র ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে থেমে গেলাম)

"কি পার... পার... করছিস?" (ভ্রু কুঁচকে জিগ্যেস করলো আপু)

তারপর আমি যা বলেছিলাম তাতে করে শুভ্র ভাইয়াসহ সবারই চোখ বেরিয়ে আসার উপক্রম হয়েছিলো। আমি তাদেরকে বলেছিলাম, আমি এখানে গোসলের পারমিশন নিতে আসছিলাম। জানি কথাটা শুনে অবাক হওয়াটাই স্বাভাবিক, কিন্তু কি করা? মাথা দিয়ে অন্য কোনো ওয়ার্ড আসছিলোই না, আর উনার টাওয়ালটা দেখে গোসল ওয়ার্ডটাই ফট করে বেরিয়ে গেলো। এরপর শুভ্র ভাইয়া ওনাদের কিছু বুঝিয়েছিলেন, কি বুঝিয়েছিলেন তা আমি এখনও জানতে পারিনি। তারপর থেকেই সবাই এই বিষয়টা নিয়ে মজা নেয়, আর হুহা করে হাসাহাসি করে।

——————
বর্তমান......
——————

দাদীর কথায় বাস্তবে ফিরে এলাম,
"ওইতো আমার দাদুভাই চলে এসেছে। কি গো দাদুভাই মুখটা এমন করে রেখেছো কেন? আদর কম হয়েছে নাকি?" (মুখ টিপে হেসে)

ইশশশ, এবার আমার লজ্জায় মরে যেতে ইচ্ছে করছিলো। দাদীটাও না, কি দরকার ছিলো এভাবে লজ্জায় ফেলার? এবার আমি আড়চোখে ওনার দিকে তাকালাম, উনার রিয়েকশনটা দেখতে চাচ্ছি। কিন্তু আমাকে ব্যর্থ হতে হলো, উনার মুখে রাগ বা লজ্জা কিছুই খুঁজে পাচ্ছিলাম না। দাদীকে কিছু না বললে চুপচাপ পাঁচ মিনিটের মধ্যে খেয়ে উঠে গেলেন। আমি ব্যাপারটা নিতে পারছিলাম না। আমার ধারনা মতো এই মুহূর্তে উনার আমার প্রতি প্রচুর রেগে থাকার কথা। কিন্তু এখানে তো কাহিনীই উল্টায় গেছে। শাস্তি পেতে হবে না ভেবে, আমার খুশি হওয়ার কথা। কিন্তু এই মুহূর্তে আমি খুশি হতে পারছি না, একটা খটকা রয়ে যাচ্ছে। এরমধ্যে মামু বলে উঠলেন,
"রোদ মা, কাল কিন্তু তোমাদের বাড়ি যাওয়ার কথা, সব গুছিয়ে নিও। শুভ্রকে আমি বলে দিবো। অভ্র-রুহি তোমরাও তৈরি হয়ে নিও।"

আমরা সবাই সম্মতি জানাতেই মামু লেপটপটা হাতে নিয়ে অফিসে চলে গেলেন। সারাটা দিন আপু আর মামানিকে কাজে হেল্প, আর দাদীর সাথে দুষ্টামি করে কেটে গেলো। কিন্তু অবচেতন মন শুধু একটা কথাই ভাবছে, এই ব্যাটার মাথায় চলছে টা কি? এতো সহজে ছেড়ে দেওয়ার পাত্র তো উনি নন। রাতে আরেকটু জ্বালিয়ে বাজিয়ে দেখতে হবে, ব্যাপারটা কি?

রাত প্রায় ১২ টা বাজতে চললো উনার কোনো খোঁজ নেই। সেই সকালে বেরিয়েছিলেন আর ফিরেননি। এবার বেশ দুশ্চিন্তা হচ্ছে। উনার নাম্বার আমার কাছে আছে, কিন্তু আমার পক্ষে উনাকে ফোন দেওয়া পসিবল নয়। ফার্স্টলি উনি আমার ফোন পিক করবেন না, এন্ড সেকেন্ডলি উনাকে ফোন দেওয়ার প্রশ্নই আসে না। ইউ অল নো, ইগো ইজ আ বিগ ম্যাটার। ঠিক ১২ঃ৩০ মিনিটে উনি বাসায় ফিরলেন। এসেই বিছানায় গা এলিয়ে দিলেন। উনাকে বড্ড ক্লান্ত দেখাচ্ছে। আমার খুব ইচ্ছা করছিলো উনার সাথে কথা বলি, কিন্তু উনার সাথে কথা বলার মতো কোনো টপিকই আমাদের মধ্যে নেই। কি বলা যায় ভাবছি,
"এই যে মিস্টার?"

ইচ্ছা করেই কাঁচা ঘুমটা ভাঙালাম, যেনো রেগে যায়। কিন্তু উনি আমার ইচ্ছায় এক বালতি পানি ঢেলে দিয়ে ভ্রু কুঁচকে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,
"কিছু বলবা?"

উনার কথাটা স্বাভাবিক হলেও তার সেই অতি স্বাভাবিক কথাটা আমার কাছে অতি অস্বাভাবিক বলে মনে হচ্ছে। আমি উনার দিকে সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললাম,
"কি ব্যাপার? আপনি এখানে শুয়েছেন কেন?"

"তো কই শুবো?"

"তা আমি কি জানি? আমি এখন ঘুমাবো, আর আমি আপনার সাথে এক বিছানায় কিছুতেই শোবে না। সো ইউ কেন গো নাও।"

অনেকটা ঝাঁঝালো কন্ঠেই বললাম। কিন্তু এবারও রাগ না করে কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে থেকে একটা বালিশ নিয়ে সোফায় শুয়ে পড়লেন। এবার আমি অবাকের চরম সীমায় পৌঁছে গেলাম। হচ্ছে টা কি এসব? উনি কি করতে চাইছেন? চুপিচুপি আমাকে মেরে নদীতে ফেলে দেওয়ার প্লেন করছেন না তো? হায় আল্লাহ! কি হবে এখন? সেদিন রাতে ঘুমেরা আর চোখে ধরা দিলো না। সকাল সকাল উঠে নামাজ পড়ে নিলাম। উনি বাচ্চাদের মতো ঘুমোচ্ছেন, খুব নিষ্পাপ লাগছে দেখতে, কিন্তু মুখে একটা ক্লান্তির ছাপ। আচ্ছা উনার কিছু হয়েছে কি? হঠাৎ এমন পরিবর্তন কি আদৌ মেনে নেওয়া যায়?

ব্রেকফাস্ট করেই বেরিয়ে পড়লাম আমাদের বাসার উদ্দেশ্যে। খুবই ভালো লাগছে, বাবা-মার সাথে পুরো একটা দিন থাকবো ভাবতেই নাচতে ইচ্ছা করছে। আবার পুষে রাখা অভিমানটাও চাড়া দিয়ে উঠছে বার বার। উনি পুরো রাস্তা নির্বাক ছিলেন, গম্ভীর মুখে গাড়ী ড্রাইভ করে গেছেন শুধু। উনার এমন ব্যবহার আমায় বড্ড ভাবাচ্ছে। বাইরের দৃশ্য আর পিছনের সিটে বসে থাকা আপু আর ভাইয়ার খুনসুটি ঝগড়া ইনজয় করতে করতেই বাড়ি পৌঁছে গেছি। বাড়ি এসে বাবা-মাকে ভালোমন্দ জিগ্যেস করা ছাড়া আর একটা কথাও বলেননি উনি। সকাল থেকেই চুপচাপ বসে আছেন রুমে। দুপুরে কোনোরকম খেয়ে আবার রুমে চলে গেছেন। সবাই ড্রয়িংরুমে আড্ডা দিচ্ছিলো কিন্তু আমার মন পড়ে আছে উনার কাছে। আচ্ছা উনার সাথে কি আমার কথা বলা উচিত? আর কিছু না ভেবে চলে গেলাম রুমে। উনি কপালে হাত রেখে বিছানায় শুয়ে ছিলেন। কোনোরকম ভনিতা না করে বলে উঠলাম,
"এই যে শুনছেন?"

"হুমম। কিছু বলবে?"

"আপনি কি ঠিক আছেন? না মানে বলছিলাম যে আপনাকে মোটেও ঠিক লাগছে না। কোনো সমস্যা হচ্ছে আপনার? চাইলে আমাকে বলতে পারেন।" (এক নিশ্বাসে বলে গেলাম)

"রোদ......"

উনার ডাকে আমি কেঁপে উঠলাম। এতো নরম আর করুন সুরে কেউ আমায় ডাকেনি এর আগে। উনার কন্ঠটাতে যেনো হাজারো আকুতি মিশে আছে,
"রোদ... আমার সাথে একটু বাইরে কোথাও যাবে প্লিজজ?"

★★★★★

উনার কথাটা শুনে যেনো আকাশ থেকে পড়লাম। যে মানুষটা আমাকে এক মিনিটের জন্য সহ্য করতে পারে না, সে কিনা আমাকে তার সাথে ঘুরতে যেতে বলছে। ব্যাপারটা হজম করতে বড্ড কষ্ট হচ্ছে।

"যাবা রোদ? প্লিজজ, আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে রোদ।" (করুন চোখে)

উনার কথায় কি রিয়েকশন দিবো বুঝতে পারছি না। মস্তিষ্ক বলছে কোথাও গন্ডগোল আছে, নো রোদ ডোন্ট গো। কিন্তু মনটা তো নাছোড়বান্দা, তাই মনটাকে জয়ী করে রাজি হয়েই গেলাম।

গাড়িতে বসে আছি আর উনি ড্রাইভ করছেন। জানি না কোথায় যাচ্ছি, কেনো যাচ্ছি? মনের মধ্যে নানা কথা উঁকি দিচ্ছে। আচ্ছা উনি যদি নির্জন জায়গায় নিয়ে গিয়ে আমাকে মেরে ফেলেন? এসব ভেবে ভয়ে কেঁপে উঠছি। কিন্তু ওই যে মন, যে সবর্দা মস্তিষ্কের বিপরীতে হাঁটে। সে বড্ড নিশ্চিন্তে বসে আছে। কেনো যেনো মনে হচ্ছে উনার সাথে থাকলে কোনো বিপদ আমায় ছুঁতেই পারবে না। হঠাৎ করে ব্রেক কষাতে ভাবনার সুতো কাটলো। উনি আমাকে নামতে বলে সামনের দিকে চলে গেলেন। একটা নির্জন জায়গায় গাড়ি থামিয়েছেন তিনি। পরিবেশটাতে বেশ শান্তি শান্তি ভাব আছে, মন ভালো হয়ে যাবার মতো পরিবেশ। উনার দিকে এগিয়ে গেলাম, ঘাসের উপর মাথা নিচু করে বসে আছেন তিনি। একদিনেই মুখটা কেমন শুকিয়ে গেছে। বড্ড মায়া লাগছে, মনে হচ্ছে উনি ভেতরে ভেতরে গুমরে মরছেন। জানি না কি ভেবে হঠাৎ উনার কাঁধে হাত রাখলাম। তিনি যদি এক ঝটকায় আমার হাতটা কাঁধ থেকে সরিয়ে দিতেন, তাহলে হয়তো তা আমার জন্য স্বাভাবিক একটা ব্যাপার হতো। কিন্তু তিনি যা করলেন তার জন্য আমি কোনো কালেই প্রস্তুত ছিলাম না। উনার কাঁধে হাত রাখতেই উনি বাচ্চাদের মতো ফুঁপিয়ে উঠলেন। আমি কি করবো বুঝতে পারছি না। এমন কিছু হতে পারে আমি স্বপ্নেও ভাবিনি। এই মানুষটাকে হাসতে দেখেছি, রাগতে দেখেছি, ধমকাতে দেখেছি, কিন্তু কাঁদতে দেখিনি কখনো। এমন পরিস্থিতিতে আগে কখনো পড়িনি, কি বলে সান্ত্বনা দেওয়া যেতে পারে তাও জানা নেই। তার উপর উনার এমন অদ্ভুত বিহেভিয়ারের কারণটাও জানি না, তাই চুপ করে রইলাম, কিছু বললাম না। এই অসীম নীরবতায় শুধু উনার কান্নার আওয়াজ ভেসে আসছে। আমার ভেতরটাও দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছে। হঠাৎ উনি আমার হাত উনার বুকে রেখে কান্না জড়িত কন্ঠে বলে উঠলেন,
"এইখানটাই খুব কষ্ট হচ্ছে রোদ, আমি নিঃশ্বাস নিতে পারছি না রোদ, আমি নিঃশ্বাস নিতে পারছি না। বড্ড ভালোবাসি আমি নীলিকে, বড্ড ভালোবাসি। ওকে ছাড়া আমি বেঁচে থাকতে পারছি না, মরে যাচ্ছি আমি, মরে যাচ্ছি। জানো রোদ ভালোবাসার পাল্লায় আমি সবসময় নীলির কাছে হেরে যেতাম। আমার থেকেও বেশি ভালোবাসতো ও আমায়। তবু ধরে রাখতে পারলাম না। দেখো এই হাতটা আজ ফাঁকা, ও বলছিল কখনো ছাড়বে না এই হাত। কিন্তু ও কথা রাখেনি, ধোকা দিয়েছে আমায়, ধোকা...।"

আমি আর নিজেকে ধরে রাখতে পারলাম না, উনার কষ্টগুলো আজ বেরিয়ে আসছে সাথে আমাকেও কাঁদিয়ে মারছে। একটু থেমে আবার বলতে শুরু করলেন তিনি,
"ওকে আমার চাই রোদ, এনে দিবে ওকে? দাও না এনে, প্লিজ এনে দাও না, প্লিজজজজ।"

বাচ্চাদের মতো আবদার করে যাচ্ছেন তিনি, কিন্তু উনাকে আমি কি করে বুঝাবো এটা যে আমার সাধ্যের মধ্যে নেই। আমিও অঝরে কেঁদে চলেছি, উনার চোখের জল যে বড্ড পোড়াচ্ছে আমায়।

"রোদ, এই রোদ, বলো এনে দিবা? কিছু বলছো না কেন? জানো ওর শেষ কথা কি ছিলো? ও বলেছিলো, শুভি একটা মিষ্টি মেয়ে দেখে বিয়ে করে নেবে কথা দাও। ওর কথা আমি রেখেছি, ওর পছন্দের মেয়েকেই বিয়ে করেছি। তোমাকে খুব ভালোবাসতো নীলি, সবসময় বলতো তোমার কাজিনটা বড্ড মিষ্টি শুভি। কিন্তু ও আমার কথা রাখেনি, চলে গেছে, আমাকে ছেড়ে চলে গেছে। আমি বড্ড বাজে রোদ, বড্ড বাজে। তুমি কাল ঠিকই বলেছিলে, আমি খুব নিচ একটা মানুষ। এতটাই নীচ যে নিজের ভালোবাসার মানুষটাকেও ধরে রাখতে পারিনি। তোমার জীবনটাও নষ্ট করে দিয়েছি রোদ, সব স্বপ্ন ভেঙে দিয়েছি। আমি বাঁচতে চাই রোদ, আমি নীলিকে চাই, নীলি কে......"

বলতে বলতেই উনি আমার কাঁধে ঢলে পড়লেন, গায়ে হাত দিয়ে দেখি জ্বরে শরীরে পুড়ে যাচ্ছে। অনেক ডাকার পরও যখন উনার সাড়া পেলাম না, তখন আমি রীতিমতো ভয় পেয়ে গেলাম। এই নির্জন জায়গায় আমি কার কাছে সাহায্য চাইবো? হঠাৎ ফোনে রিং বেজে উঠলো, স্ক্রিনে ভাইয়ার নাম ভাসতেই জানে পানি এলো যেনো, দ্রুত ফোন পিক করে ভাইয়াকে উনার অসুস্থ হয়ে পড়ার কথা বললাম, কিন্তু ঠিকানা? আমি তো নিজেই জানি না কোথায় আছি এই মুহূর্তে, কি করবো এখন? আর কিছুক্ষণ পরই সন্ধ্যা নেমে আসবে, ভয়ে হাত-পা ঠান্ডা হয়ে আসছে আমার। ভাইয়া হঠাৎ বলে উঠলেন,  আমি যেনো ফোনের লোকেশন অন রাখি। উনারা ট্রেস করে চলে আসবেন। কথাটা শুনে কিছুটা হলেও শান্তি পেলাম। একটা আশার কিরন উঁকি দিয়ে গেল মনে। উনার গায়ে হাত দিয়ে দেখলাম জ্বর বাড়ছে। নিজেই তো একটা বাচ্চা আমি, মাত্র ১৭ বছর বয়স, কতই আর বড় হয়েছি? ভয়ে হাত পা কাঁপছে আমার, চারপাশে কারো সাড়াশব্দ নেই। এই সময় আমার সাথে খারাপ কিছু হয়ে গেলে? কে বাঁচাবে আমায়? তার ওপর উনি। কি করবো কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। উনার মাথায় পট্টি দেওয়া উচিত, কিন্তু এখানে কিভাবে? গাড়ি চেক করে একটা ওয়াটার পট পেলাম, তাতে পানিও ছিলো, কিন্তু কাপড়? বাংলা সিনেমার দরদী নায়িকা সাবানার মতো অনেক চেষ্টা করেও শাড়ির আঁচল ছিড়তে পারলাম না। মেজাজটাই বিগড়ে গেলো। ধেৎ, সামান্য একটা শাড়ির আঁচল ছিড়তে পারি না আমি? শুভ্র ঠিকই বলে আমি আসলেই একটা মগা। শুভ্রর পাশে বসে একমনে এসব ভাবছিলাম, হঠাৎ কি যেনো ভেবে উনার পকেটে হাত দিলাম। অনেক খুঁজে একটা রুমালও পেলাম। ব্যস হয়ে গেলো। রুমাল ভিজিয়ে উনার কপালে রেখে, উনার বলা কথাগুলোই ভাবছিলাম। একটা মানুষ এতটা ভালো কি করে বাসতে পারে? নীলিমা আপু বড্ড লাকি, তাকে ভালোবাসার মতো একটা মানুষ আছে। যে তাকে কেউ এতো পাগলের মতো ভালোবাসে। নীলিমা আপু আর শুভ্রকে দেখে আমারও বড্ড ইচ্ছে হতো শুভ্র ভাইয়ার মতো আমাকেও কেউ এমন করেই যদি ভালোবাসতো। কিন্তু কে জানতো যে আমি শুভ্র ভাইয়াকেই পাবো, আর শুভ্র ভাইয়া হারাবে তার ভালোবাসাকে। নিয়তি এতো নিষ্ঠুর কেনো? আমার এখনো সেই দিনের কথা স্পষ্ট মনে আছে, কতো হাসি-খুশি ছিলো সবাই। কিন্তু একটা ঝড় এসে আনন্দমাখা দিনগুলোকে লন্ডভন্ড করে দিয়ে গেলো। স্বপ্নগুলোকে তছনছ করে দিলো। কি ভয়ঙ্কর ছিলো সেই দিনটা....

——————
ফ্ল্যাসব্যাক......
——————

পরীক্ষা দিয়ে বের হতেই দেখি শুভ্র ভাইয়া গেটে দাঁড়িয়ে আছে। উনাকে আমার কলেজের সামনে দেখে অবাক হলাম। উনি এখানে কেন?
.
.
.
চলবে...................................................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

WhatsApp