মাই মিস্টিরিয়াস প্রিন্স - পর্ব ৩৫ - মৌমিতা মৌ - ধারাবাহিক গল্প


'দরজা খোলো, শিকদার!

'নাহ!

'একটু আগেই তো বলে গেলাম দরজা বন্ধ না করতে। তাও কেন করেছো? এই দরজা খোলা আমার জন্য মাত্র কয়েক সেকেন্ডের ব্যাপার!

'খুলুন দেখি।

কৌশিকের আঙুল নব স্পর্শ করতেই ভেতর থেকে লকের শব্দ হলো। দরজা খুলতে গিয়েই দেখতে পেলো, অনন্যা পড়ার টেবিল ঠেলে দরজার সামনে দাঁড় করিয়ে রেখেছে। দরজার ফাঁক দিয়ে মেয়েটাকে দেখা যাচ্ছে, মুখে জেদ আর চোখে অভিমান নিয়ে হাত ভাঁজ করে দাঁড়িয়ে আছে।

কৌশিক চোখ সরু করে তাকাল, কণ্ঠে স্থিরতা ধরে রেখে বললো,
'টেবিল কেনো রেখেছো?

'আমি একা থাকতে চাই। আপনি নিজের রুমে যান। 

কৌশিক সূক্ষ্ম চোখে অনন্যার দিকে তাকালো। শান্ত স্বরে বললো,
'কিন্তু আমি তোমার সঙ্গে থাকতে চাই।

অনন্যা এক মুহূর্ত চুপ থেকে উত্তর দিলো,
'আমি আপনাকে মানতে পারছি না।

'ওকে! সময় নাও। না তো করিনি আমি! কিন্তু দরজাটা খোলো।

'নাহ! পরবর্তীতে যার সাথে বিয়ে করবেন, তার সাথেই গিয়ে থাকুন আপনি।

কৌশিক এবার ভ্রু কুঁচকে তাকালো, কণ্ঠে অসন্তোষ মিশ্রিত। 'আমি ওইটা কথার কথা বলেছিলাম।

'আমার কিন্তু সেটা মনে হচ্ছিল না। 

কৌশিক ধীর পায়ে দরজার সামনে এল। দু’হাত দিয়ে দরজা ঠেলে সামান্য ফাঁক করলো, কিন্তু টেবিল বাধা হয়ে রইলো। এক দৃষ্টি অনন্যার মুখে রাখলো, তারপর শান্ত কণ্ঠে বললো,
'এই টেবিল সরানো আমার জন্য কোনো ব্যাপার না। কিন্তু তুমি কি সত্যিই চাও আমি জোর করি?

অনন্যা ঠোঁট চেপে কিছুক্ষণ চিন্তা করলো। অতঃপর জোর গলায় বললো,
'ঠিক আছে! শর্ত মানলে দরজা খুলবো।

'আমার রুমে ঢোকার জন্য আমাকেই শর্ত মানতে হবে?

'হু! নাহলে আমি আরো জিনিসপত্র নিয়ে দরজা বন্ধ করে দিবো।

কৌশিক বাঁকা হেসে বললো,
'ঠিক আছে, যাও। শর্ত মানলাম।

'আগে শর্ত শুনে নিন।

'দরজা খুলে শর্ত বলো। আমি তোমার সব শর্তে রাজি আছি।

'শিউর?

'হ্যাঁ!

অনন্যা দ্বিধাগ্রস্তভাবে এগিয়ে গেলো। ধীরে ধীরে টেবিলটা সরিয়ে দিলো। দরজা পুরোপুরি খুলতেই কৌশিক ভেতরে প্রবেশ করলো, গম্ভীর মুখে হাত ভাঁজ করে দাঁড়িয়ে রইলো।
'শুনি! কী শর্ত?

অনন্যা কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেলো। চোখ নামিয়ে ফেললো, আঙুলগুলো কুঁচকে ধরলো অজান্তেই। কৌশিক ভ্রু উঁচিয়ে তার মুখের ভাষা বোঝার চেষ্টা করলো।

ধীর পায়ে এগিয়ে এসে মেয়েটার সামনে ঝুঁকে পড়লো। গলার স্বর খানিক নরম করলো,
'লজ্জা পাচ্ছো কেনো? কি শর্ত? উমম.....ওয়েট! তুমি কি...বেবি চাইছো?

অনন্যা মুহূর্তের মধ্যে চোখ বড় করে তাকালো, মনে হলো যেন বড়সড় বাজ পড়েছে মাথার ওপর। এক ঝটকায় পেছনে সরে গিয়ে অনন্যা চিৎকার করলো,
'নাহ না! কি উল্টা পাল্টা বলছেন?

কৌশিক গভীর শ্বাস ফেলে মুচকি হাসলো। কাঁধ ঝাঁকিয়ে বললো,
'যাক! আমি তো খুব ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম।

'আপনার সাথে আমার অমন গভীর সম্পর্ক হয়েছে নাকি যে আমি বাচ্চা চাইবো?

'সেটাই তো। তাহলে কী চাইছো, সেটা বলো।

অনন্যা কিছুক্ষণ চুপ থেকে মাথা চুলকে নিলো।তারপর এক নিঃশ্বাসে বলে ফেললো,

'অন্য কোনো মেয়েকে বিয়ে করতে পারবেন না আপনি। আমাদের এই বিয়েই আপনার জীবনের শেষ বিয়ে হওয়া চাই। না মানলে চলে যান রুম থেকে।

কৌশিক কয়েক সেকেন্ড স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। তারপর হেসে ফেললো। তার আকাশি চোখের মণিতে ঝলকে উঠলো অদ্ভুত এক উষ্ণতা। ধীরে ধীরে তার মুখ অনন্যার দিকে ঝুঁকে এলো, কিন্তু ঠোঁটের সামনে এসে থেমে গেলো। কৌশিক মুচকি হাসি দিলো, অনন্যাকে দুই হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরলো। হতবাক হয়ে গেল অনন্যা। চোখ তুলে কিছু বলতে চাইলেও পারলো না। স্যারের শরীর থেকে সুন্দর ল্যাভেন্ডার ফুলের গন্ধ নাকে এসে লাগছে, কেমন ঘুম ঘুম লাগছে। অনন্যা চোখ বন্ধ করে ফেললো।

কৌশিক গভীর স্বরে ফিসফিস করে বললো,
'তাহলে শর্ত মেনে নিলাম, প্রিন্সেস।

অনন্যা কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে মুখ তুলে বললো,
"আরো শর্ত আছে।"

কৌশিক ভ্রু উঁচিয়ে তাকালো, ঠোঁটের কোণে একচিলতে হাসি,
"আর কী?"

অনন্যা স্যারের বুকের কাছে মাথা রেখে মৃদু স্বরে বললো,
"আমাকে সাইকেল চালানো শেখাবেন।"

কৌশিক হাসলো,
"ওকে!

"তীর চালানোও শিখতে চাই।

কৌশিক এবার সত্যিই ভাবল, তারপর ধীরে মাথা নাড়লো,
"ঠিক আছে।

অনন্যা এক মুহূর্ত চুপ থেকে ফিসফিস করে বললো,
"তলোয়ার চালানোও শিখতে চাই!

কৌশিক এবার একটু অবাক হলো, চোখে কৌতূহল নিয়ে বললো,
"ওহ! আরও কী শিখতে চাও?

অনন্যা নিঃসঙ্কোচে বললো,
"আপনি যা পারেন, সব।

কৌশিক এবার আর নিজেকে থামাতে পারলো না, হেসে ফেললো। ব্যঙ্গের সুরে বললো,
"এত কিছু শিখতে গেলে বুড়ি হয়ে যাবে তুমি!

অনন্যা কৌশিকের বুকের ওপর মৃদু ধাক্কা দিয়ে মুখ তুলে তাকালো, 
"তাহলে বাদ দিন! ওই তিনটে সহ ড্রাইভিং শেখাবেন, যদি কখনো দরকার পড়ে যায়। তাই শেখা উচিত।

কৌশিক মাথা নাড়িয়ে বললো,
'অস্ত্র চালানো কেনো শিখতে চাও?

অনন্যা চুপ রইলো। চোখ নামিয়ে অন্যদিকে তাকিয়ে থাকলো, মনে হলো এই প্রশ্নের উত্তর এড়িয়ে যেতে চাইছে সে।

কৌশিক কিছুক্ষণ ওর মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো, তারপর ধীরে হাতে মেয়েটার কাঁধ ছুঁয়ে বললো,
'হুম, বুঝতে পারছি। আমি যদি কখনো নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়ি, তখন এগুলো কাজে লাগতে পারে, তাই তো?

অনন্যার আঙুলগুলো কেঁপে উঠলো, কিন্তু সে কোনো কথা বললো না।

কৌশিক অল্প হেসে বললো,
'শিখিয়ে দেবো, তবে আমার ও এক শর্ত আছে।

অনন্যা অবাক হয়ে তাকালো,
'কি শর্ত?

কৌশিক অনন্যার হাতটা আলতো ছুঁয়ে টেনে ধরে নিজের বুকের ডান পাশে স্থির করে রেখে বললো,
'যদি কখনো আমি তোমাকে মা/রতে উদ্যত হই, তাহলে তুমি হাতের কাছে যা-ই পাবে তা দিয়ে আমার বুকের এই স্থানে আঘাত করবে।

অনন্যা বিস্মিত হয়ে বললো,
'এই স্থানে আঘাত করলে কী হবে?

'তোমাকে আঘাত করার ফল পাবো। শারীরিক যন্ত্রণায় ভুগবো কয়দিন।

অনন্যা দ্রুত হাত সরিয়ে নিলো। কৌশিক হেসে মেয়েটার মাথায় হাত রেখে বললো,
'তুমি ভাবছো আমি খুব তাড়াতাড়িই চলে যাবো? উঁহু না! আমার যেতে অনেক দেরি আছে। এতো সহজে তোমার পিছু ছাড়ছি না।

'চলে গেলে তো রেখেই যাবেন আমাকে।

'দেখা যাক! সময়ই সব বলবে। যাই হোক, ছুটির দিন থেকে আমরা শেখা শুরু করবো। ভোর সকালে উঠতে হবে। ঠিক আছে?

'ভোরে কেনো?

'ভোরেই ভালো শেখা হয়। আমিও ভোরে চর্চা করি।

অনন্যা মাথা নাড়িয়ে নিশ্চুপ হয়ে তাকিয়ে রইল স্যারের দিকে। 

••••••••••••

বেশ কিছুদিন কেটে গেছে ইতিমধ্যে। অনন্যা মাত্র ইউনিভার্সিটিতে এসেছে। গেইট পার করার সাথে সাথেই নোহারার সাথে দেখা হয়ে গেলো। অনন্যা নোহারার মুখটা ভালো করে লক্ষ্য করলো। কেমন মনমরা লাগছিলো মেয়েটাকে। নোহারার চোখের কোণে এক ধরনের অন্যমনস্কতা, ঠোঁট একটু ফোলা, মনে হচ্ছিল কোনো বিষয় নিয়ে চিন্তিত সে।

অনন্যা নোহারার হাতটা শক্ত করে চেপে ধরে বললো,
'কি হয়েছে, নোহা? পেঁচার মতো মুখ করে রেখেছিস কেন?

'না এমনি।

'সত্যি করে বল! কি হয়েছে?

নোহারা এক মুহূর্ত চুপ থেকে দীর্ঘশ্বাস ফেললো, তারপর নিচু স্বরে বললো,
'মিস করছি!

অনন্যার চোখ কপালে উঠে গেলো,
'কাকে?

নোহারা কিছুক্ষণ চুপ থেকে হাসার চেষ্টা করলো। ধীর স্বরে বললো,
'আছে একজন!

অনন্যা ভ্রু কুঁচকে বললো,
'উহুম! বল না! কে?

নোহারা কিছু বলতে নিচ্ছিল তার আগেই ওর ফোনে একটা মেসেজ আসে, তাই মনোযোগটা ওদিকেই চলে যায় নোহারার। নোহারা ফোন বের করে মেসেজটা দেখে অনন্যার দিকে তাকিয়ে অপ্রস্তুত অনুভব করলো। তারপর হাসি মুখ করে বললো,
'অনন্যা! আজ আমরা ছুটির পর ঘুরতে যাবো। ওকে?

'ঘুরতে যাবো? অনন্যা একটু অবাক হলো। 'তোর না সন্ধ্যায় পার্ট-টাইম জব থাকে? আমারও তো টিউশনি আছে!'

নোহারা জোর করে হাসলো, 'আজ বাদ দে না! আমিও বাদ দিচ্ছি। অনেক দিন একসাথে কোথাও যাওয়া হয়নি। চল না!

অনন্যা দ্বিধায় পড়ে গেলো, 'কিন্তু...!

'না, কোনো কিন্তু না! তুই যাবি, ওকে? 
নোহারার গলায় জোর।

অনন্যা কী বলবে ভাবছে, ঠিক তখনই নোহারা তাড়াহুড়ো করে বললো, 'আচ্ছা, তুই ক্লাসে যা। আমি একটু আসছি, দরকার আছে।'

বলেই দ্রুত ছুটে চলে গেলো নোহারা।

অনন্যা কপালে ভাঁজ ফেলে ওর চলে যাওয়া পথের দিকে তাকিয়ে রইলো। এ মেয়েটার আচরণ আজ এত অদ্ভুত কেন?

তিনটে ক্লাস শেষ। নোহারার জন্য অপেক্ষা করছে অনন্যা। আজ মেয়েটা একটাও ক্লাস করেনি। কোথায় যে গেলো, কিছুই বুঝতে পারছে না। সকাল থেকে আচরণটাও কেমন অদ্ভুত! হুট করে একটা মেসেজ দেখে বদলে গেলো, তারপর ঘুরতে যেতে চাইলো, এরপর উধাও! এখন ফোনও ধরছে না।

অনন্যা উদ্বিগ্ন হয়ে আবার কল করলো। ফোনটা কানের সামনে চেপে ধরে হাঁটতে হাঁটতে নোহারাকে খুঁজতে লাগলো। চিন্তাটা মনের মধ্যে কুঁকড়ে উঠছে, মেয়েটা আবার কোনো ঝামেলায় জড়ায়নি তো?

ঠিক তখনই দূর থেকে দেখা গেলো নোহারাকে। অনন্যার চোখে স্বস্তি ফুটে উঠলেও ভ্রু কুঁচকে গেলো। এতক্ষণ কোথায় ছিলো? প্রথমে এই প্রশ্ন ই জিজ্ঞেস করবে ভেবে রাখলো অনন্যা। কিন্তু সুযোগ আর হলো কই!

নোহারা কাছে এসেই হাসিমুখে বললো, 'চল!'

অনন্যা ঠোঁট শক্ত করে বললো, 'কোথায় যাবো? সেটাই তো জানলাম না।'

নোহারা রহস্যময় এক হাসি দিলো, 'গেলেই তো জানতে পারবি। অনেক দিন তোকে সারপ্রাইজ দেইনি। আজ একটা সারপ্রাইজ আছে তোর জন্য।'

অনন্যা তার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো। এই মেয়ে নিশ্চয়ই কিছু লুকাচ্ছে!

অনন্যা আগেই তামংকে বাসায় চলে যেতে বলে দিয়েছে। ঘুরতে গেলে আর গাড়ি দিয়ে বাসায় ফেরা হবে না, তাই আজ তাকে দরকার নেই। এতদিনে পথ চিনে গেছে, কাজেই কোনো সমস্যা হবে না।

নোহারা একটা রিকশা ডাকলো। রিকশাওয়ালাকে শুধু বললো, 'সোজা যেতে থাকেন।'

অনন্যা প্রশ্নবিদ্ধ চাহনি নিয়ে তাকালো নোহারার দিকে। কোথায় যাচ্ছে, সেটারও ঠিক নেই! কিন্তু নোহারা পুরোপুরি ফোনে ডুবে আছে, যেন কোনো গুরুত্বপূর্ণ কিছু দেখছে।

অনন্যা আর চুপ থাকতে পারলো না, 'ক্লাস করিসনি কেন?'

নোহারা উদাসভাবে বললো, 'একটু কাজ ছিল রে!'

'কি এমন কাজ?'

নোহারা মুচকি হেসে বললো, 'পরে জানাবো। প্রশ্ন করিস না, দেখতে থাক!'

অনন্যা নোহারার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো। বেশ কিছুক্ষণ পর নোহারা রাস্তার দিক নির্দেশনা দিতে লাগলো। প্রায় আট মিনিটের মতো সময় লাগলো পৌঁছুতে। অনন্যা রিকশা থেকে নেমে সামনে তাকালো। গেইটের উপরে বড় করে লেখা 'দ্য ভিলেজ রেস্টুরেন্ট'।

অনন্যা বললো,
'রেস্টুরেন্টে কেনো?

নোহারা কোনো উত্তর দিলো না। ভাড়া মিটিয়ে অনন্যাকে ভেতরে নিয়ে গেলো।

সময়টা বিকালের। বিকেলের ম্লান আলো এখনো আকাশে ঝুলে আছে। গেট পেরিয়ে ভেতরে ঢুকতেই অনন্যার দৃষ্টি আটকে গেলো,সামনের খোলা জায়গায়। স্থানটি সাজানো একদম বাগানের মতো। সারি সারি টেবিল, চারপাশে নরম আলোর সাজ, বাতাসে হালকা সুরের দোলা ভেসে উঠছে।

কয়েক কদম এগোতেই নজরে পড়লো সম্মুখে থাকা দুটি ছোট্ট কুঁড়েঘরের দিকে। সেখানেই রেস্টুরেন্টের খাবার দাবার তৈরি করা হচ্ছে, অর্ডার নেওয়া হচ্ছে, গরম কফির গন্ধ, খাবারের সুঘ্রাণ ভেসে আসছে, কর্মীরা দ্রুত হাত চালিয়ে পরিবেশন করছে খাবার।

কিন্তু সবচেয়ে বেশি চোখে পড়লো ভিড়টা। সিনিয়রদের একঝাঁক পরিচিত মুখ, কয়েকজন ক্লাসমেটও রয়েছে চারপাশে। অনন্যা কপালে ভাঁজ ফেলে নোহারার দিকে তাকালো। নোহারা ঠোঁটের কোণে মুচকি হাসি নিয়ে শুধু ইশারা করলো, বাঁ পাশে রাখা ছোট্ট স্টেজের দিকে।

অনন্যার নিঃশ্বাস মুহূর্তের জন্য আটকে গেল। স্টেজের আলোয় নিখুঁত ভাবে দেখা যাচ্ছে আরণ্যককে, সেই চিরচেনা ভঙ্গি, আত্মবিশ্বাসী হাসি, উজ্জ্বল শ্যামলা মুখশ্রী। একসময় যে যুবক অনন্যার হৃদয় দখল করে রেখেছিল, আজ সেই পুরোনো অনুভূতিগুলো আবার উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে মনের মণিকোঠায়।

নোহারা অনন্যার হাত টেনে স্টেজের দিকে এগোতে লাগলো, কিন্তু মাঝপথে বাধা হয়ে দাঁড়ালো স্পর্শ, আরণ্যকের ক্লাসমেট। চোখের পলকে অনন্যার অভিজ্ঞতার ঝাঁপি খুলে গেলো। এই মেয়েটাই একদিন সবার সামনে তাকে অপমান করেছিল, আর দূরে দাঁড়িয়ে থাকা আরণ্যক তখন কিছুই বলেনি। নিশ্চুপ হয়ে দেখছিলো সবকিছু।

স্পর্শ অনন্যার সামনে এসে দাঁড়ালো, মুখে এক আধিক হাসি মিশিয়ে।

'তুমি? কী করছো এখানে?

অনন্যা কিছুটা অপ্রস্তুত বোধ করলো, চোখের পলক ফেললো। নোহারাই মুখ খুলে বললো, 'আরণ্যক ভাইয়া, আমাদের ইনভাইট করেছে।

স্পর্শ হাসলো, ঠাট্টার সুরে বললো, 'আরণ্যক তোমাদের কেনো ইনভাইট করবে? এখানে তো সবাই ওর পরিচিত। এই প্রোগ্রামে জানো কী হবে? আরণ্যক আমাদের মধ্য থেকে একজনকে সবার সামনে প্রপোজ করবে। তো, ও তোমাকে কেনো ডাকবে?

অনন্যা থমকে দাঁড়ালো, বুকের ভেতরটা খচখচ করতে লাগলো, মনে হলো এখনি এই স্থান থেকে চলে যাওয়া উচিত। মনে হলো এখানে থাকা আর এক মুহূর্ত ও ঠিক হবে না। নোহারার মুখেও উদ্বেগের ভাঁজ, কিন্তু সে কিছু বলার আগেই সামনে এলো আরণ্যক।

'আমিই ডাক দিয়েছিলাম ওদের। এসো, তোমরা!

স্পর্শ কিছুটা অবাক হয়ে গেলো। ভ্রু কুঞ্চিত করে তাকালো ওদের দিকে।

অনন্যার হাত খপ করে ধরে তাকে সামনে নিয়ে যেতে লাগলো আরণ্যক। অনন্যা খুব করে চাইছিলো চলে যেতে। কিন্তু আরণ্যকের মুখটা খুব খুশি খুশি লাগছিল আজ যা দেখে অনন্যার বুকে ভয় চেপে ধরেছে। এই মুহূর্তে কি করা উচিত অনন্যা ঠিক করতে পারছিলো না। যদি আগে জানতো আরণ্যক এমন সাহস দেখাবে তাহলে বারবার ছেলেটাকে অপদস্থ করতো না। সোজা বলে দিতো, আমার বিয়ে হয়ে গেছে!

তাহলে কি আজ ভীত ছেলেটা সাহসী হতে চলেছে? পুরোনো সেই লোকলজ্জা ভুলে সকলের সামনে নিজের মন ঘটা করে খুলে ফেলতে চলেছে? কিন্তু অনন্যা! অনন্যাও কী সকলের সামনে সাহস দেখাতে পারবে? ভীতু ছেলেটার সাহসী মনকে বিধ্বস্ত হতে কীভাবে দেখবে সে!
.
.
.
চলবে........................................................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

WhatsApp