কৌশিক বাড়িতে ফিরেছে আধা ঘণ্টা হয়েছে। মাথাটা এখনো ঝাঁঝাঁ করছে, আগুনের নিচে চাপা পড়ে থাকা শীতল লাভার মতো ফুটছে মস্তিষ্কের পেশিগুলো। সে নিজে একটা আইস ম্যান। শরীর সবসময় ঠান্ডা হয়ে থাকে কিন্তু মাথাটা ঠান্ডা করতে এতো সময় নেয় কেনো বুঝে পায় না।
বুক ভরে শ্বাস নিয়ে বাথরুমের দরজা ধাক্কা দিয়ে খুলে ঢুকলো। নিজের রুমের বাথরুমে নয়, নেমে এসেছে গ্রাউন্ড ফ্লোরের বড় বাথরুমটিতে। অনন্যা কয়েক ঘণ্টা আগে এখানেই গোসল করেছিল। পুরো বাথরুমে এখনো হালকা মেয়েলী সুগন্ধ লেগে আছে। কৌশিক গভীর শ্বাস টেনে নিয়ে বাথরুমের পরিবেশে বাতাস ছেড়ে দিলো, নিশ্চুপ হয়ে ভেতরের বিস্ফোরণ চাপা দিতে চাইলো।
ধীরে ধীরে শরীরের সব পোশাক খুলে দূরের এক কোণায় ছুঁড়ে ফেললো কৌশিক। তারপর নিঃশব্দে বাথটাবের গরম পানিতে শরীর এলিয়ে দিলো। চোখ বন্ধ করলো, ঘোরের মাঝে ডুবে যেতে চাইলো। কিন্তু ঠিক তখনই বাইরে থেকে ভেসে এলো রিডোর বিরক্তিকর আওয়াজ। কয়েক সেকেন্ডের জন্যও শান্তি পেলো না কৌশিক। একবার নয়, বারবার। রিডো বুঝেই ফেলেছে, কৌশিক আজ কথা বলতে চায় না, তবুও ইচ্ছাকৃতভাবে বিরক্ত করছে।
বাথটাবের পানি ক্রমেই ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে, অথচ রাগ কমছে না। পানিকণা ছিটকে উঠলো, কৌশিক ধীরে ধীরে চোখ খুলে উঠে বসল। চোখের নিচে হালকা ছায়া, ভিজে চুলের ফোঁটাগুলো গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে। হাতের মুঠো শক্ত হলো। ঠান্ডা পানিতে শরীর জমে আসছে, কিন্তু মাথার ভেতরের আগুন আরও দাউদাউ করে জ্বলছে।
এক ঝটকায় উঠে দাঁড়ালো সে। পানির ছিটা চারদিকে ছড়িয়ে পড়লো। ভেজা শরীরে বাথরোব জড়িয়ে দরজা ঠেলে বেরিয়ে এলো। বাইরে এসে হাত ভাঁজ করে তাকালো সামনের দিকে। রিডো এবার আরও জোরে গর্জন করলো, ইচ্ছাকৃতভাবে কৌশিককে ক্ষেপিয়ে তুলতে চাইছে ডোরাকাটা বাঘটা। চোখ ধীরে ধীরে তীক্ষ্ণ হয়ে উঠলো কৌশিকের। ঠান্ডা, ধারালো, ধ্বংসাত্মক সে চাহনি।
রিডো গর্জন করে উঠলো, ঘর কাঁপিয়ে দেওয়া সেই আওয়াজে কৌশিক বিরক্তিকর আওয়াজ করলো। নিচুতে বসে ঠোঁটের কোণে বাঁকা হাসি ফুটিয়ে তুললো। আচমকা রিডোর কান দুটো জোরে চেপে ধরলো। অনেক জোরে জোরে গর্জন করতে লাগলো রিডো। তার আওয়াজ শুনে লারা ও তামং দু'জনেই ঘুম থেকে জেগে ছুটে এলো।
কৌশিকের মাথায় এখন আগুন জ্বলছে। সে রিডোর কান থেকে হাত সরিয়ে গলার দিকে হাত বাড়ালো। হাতের নখগুলো ধীরে ধীরে অল্প বড় হলো। চোখগুলো ধীরে ধীরে নীলচে বর্ণ ধারণ করেছে।
কৌশিক ঠান্ডা কণ্ঠে ফিসফিস করে বললো,
"বড্ড বেশি বাড় বেড়েছিস, রিডো। তুই ভুলে গেছিস আমি রাগলে কি কি করতে পারি হুম? রাগাচ্ছিস কেনো তাহলে?"
"সাব! ছেড়ে দিন। বুঝতে পারেনি ও।" লারা অনুনয়ের সুরে বললো।
তামং তার পথ আটকালো, চোখের ইশারায় সতর্ক করলো। লারা পশু পাখিদের প্রতি যত্নশীল আর এই বাঘটি তো কয় বছরে বেশ আপন হয়ে গেছে, ঠিক একদম পরিবারের মতো। তাই রিডোর শরীরে একটা আঁচড় ও তার সহ্য হচ্ছিল না।
"স্যরি, রিডো।"
গলার স্বর একেবারে তীক্ষ্ণ হয়ে উঠলো কৌশিকের।
"আমি আজ খুব রেগে আছি। তুই তো এভাবে আমার রাগ ভাঙাতে পারবি না। উল্টো শাস্তি পাবি।"
ঠিক তখনই দরজার কলিং বেল বেজে উঠলো। ভ্রু কুঞ্চিত করে দরজার দিকে তাকালো কৌশিক, তার নখগুলো আগের মতো ছোট রূপ ধারণ করলো, রিডোর লোমশ গলা ছেড়ে ধীরগতিতে উঠে দাঁড়ালো, নিজের শরীরে জড়িয়ে থাকা বাথরোব ঠিক করলো। তারপর ইশারায় লারাকে নির্দেশ দিলো,
"দেখে আসো, কে এসেছে।"
লারা এগিয়ে গিয়ে দরজার পিপহোল দিয়ে দেখে বললো,
"ম্যাডাম! ম্যাডাম এসেছে।"
কৌশিক জোরে শ্বাস ছেড়ে বললো,
"পাঁচ মিনিট পরে দরজা খুলবে। আমি উপরে যাচ্ছি।"
লারা মাথা নাড়ালো। হাতে ঘড়ি নিয়ে দাঁড়ালো। সময় গুনতে ব্যস্ত সে।
••••••••••••
অনন্যা বেশ কিছুক্ষণ ধরে কলিং বেল চাপছে, কিন্তু ভেতর থেকে দরজা খোলার কারো নাম গন্ধ নেই। বিরক্ত হয়ে একসময় দরজায় জোরে এক লাথি মারলো। সঙ্গে সঙ্গে ব্যথা ছড়িয়ে পড়লো তার পায়ে। মুখ কুঁচকে গেল অনন্যার।ঠিক তখনই দরজা খুলে গেল। লারা অন্যমনস্ক ভঙ্গিতে দরজা ধরে দাঁড়িয়ে আছে।
অনন্যা তৎক্ষণাৎ বলল, "স্যারকে ডেকে দাও না।"
লারা শান্ত স্বরে জবাব দিল,
"সাব একটু পরে আসবে। তুমি ভেতরে এসো।"
বলে সে আর অপেক্ষা করলো না, ভেতরে চলে গেল।
অনন্যা দাঁড়িয়ে রইলো, ঠোঁট ফুলিয়ে অসন্তুষ্ট ভঙ্গিতে সামনে তাকিয়ে রইল স্যারের অপেক্ষায়। কয়েক মুহূর্ত অপেক্ষা করলো, তবুও কোনো সাড়া পেল না। ধৈর্য হারিয়ে একসময় সোজা মাথা উঁচু করে চেঁচিয়ে উঠলো,
"স্যার! নিচে আসুন!"
অনন্যার কণ্ঠস্বর পুরো বাড়িতে প্রতিধ্বনিত হলো, কিছু সময়ের জন্য রাতের নীরবতা খানখান করে দিলো।
অনেকক্ষণ ধরে সাড়াশব্দ না পেয়ে স্লিপার পরা অবস্থায়ই ধীরে ধীরে ভিতরে প্রবেশ করলো। জোরেশোরে বলে উঠলো,
"এই বড় ইঁদুর, কোথায় গেলেন আপনি?"
কৌশিক রেলিং ধরে নিচে তাকিয়ে উত্তর দিলো,
"কী চাই?"
অনন্যা ভ্রু কুঁচকে জবাব দিলো,
"নিচে নামুন, তারপর বলছি।"
কৌশিক কিছু সময় চুপ করে রইলো, তারপর ধীর পায়ে সিঁড়ি দিয়ে নামতে লাগলো। অনন্যার চোখ তার পোশাকে আটকালো। এই লোকটার ঘরোয়া পোশাক দেখেও মনে হয় সে বাইরে যাওয়ার জন্য তৈরি হয়েই আছে।
স্যার নিচে নামতেই অনন্যা এক দৌড়ে এসে তার গলা জড়িয়ে ধরলো। কৌশিক হতচকিত। হাত বাড়িয়েও অনন্যাকে ছুঁলো না, শুধু বিস্ময়ে তাকিয়ে রইলো। কয়েক সেকেন্ড পেরিয়ে গেলে সে একটু ঝুঁকে অনন্যাকে ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করলো, তারপর ঠান্ডা গলায় বললো,
"তুমি এই টিশার্ট আর ট্রাউজার পরেই বাইরে গেছো?"
অনন্যা একটু হেসে বললো, "তাড়াহুড়োর মধ্যে কি করবো বুঝতে পারছিলাম না। গলায় ওড়না দিয়েছি, উপরে চাদরও তো ছিল!"
কৌশিক এক মুহূর্ত থেমে থেকে তাকালো, তারপর গলায় টান এনে বললো, "আমার স্লিপার পরেছো তুমি! নোংরা করে দিলে।"
অনন্যা দ্রুত সরে এসে নিচের দিকে তাকালো, তারপর মাথা চুলকে বললো, "হু! বাসা থেকে একটাই জুতো এনেছিলাম। আপনার স্লিপার পায়ে একটু বড় হয়ে গেছে।"
কৌশিক ঠোঁটের কোণে একপাশে হাসি টেনে বললো, "হবেই!"
অনন্যা পেছনে আঙুল দেখিয়ে বললো, "জঙ্গলের নিচের দিকে ট্যাক্সি দাঁড়িয়ে আছে। ভাড়া দেইনি। তাড়াতাড়ি আসুন।"
"কার সাথে গিয়েছিলে?"
"নিক ভাইয়া সাথে গিয়েছিল।"
কৌশিক ভ্রু কুঞ্চিত করে জিজ্ঞেস করলো,
"তো নিক কোথায়?"
"কি জানি। আমি বাইরে বেরিয়ে উনাকে পাইনি। কিন্তু গাড়িটা ছিল। তারপর দশ মিনিট দাঁড়িয়ে ছিলাম। পরে ভাবলাম একটা ট্যাক্সি নিয়ে চলে আসি।"
কৌশিক প্যান্টের পকেট থেকে ওয়ালেট বের করে অনন্যার হাতে দিয়ে বললো, "তুমিই দিয়ে আসো। আমি ঠিক এখানেই দাঁড়িয়ে থাকবো। পাঁচ মিনিটের মধ্যে যাবে আর আসবে।"
অনন্যা নাক ফুলিয়ে রাগ দেখিয়ে হাঁটতে হাঁটতে চলে গেলো।
কৌশিক দরজার সামনে হাত ভাঁজ করে দাঁড়িয়ে আছে। পাঁচ মিনিট পেরিয়ে গেছে, তবুও সে স্থির। কপালে গভীর ভাঁজ পড়ে গেছে গাঢ় করে, চোখেমুখে বিরক্তি ছড়িয়ে পড়েছে। সে ঘড়ির কাঁটায় চোখ রাখলো একবার, তারপর সামনের পথের দিকে তাকিয়ে রইলো। অবশেষে, একটা সময় পর অনন্যা হাঁপাতে হাঁপাতে সামনে এসে দাঁড়ালো। শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে, চুল এলোমেলো হয়ে গেছে।
কৌশিক ঠান্ডা, রাগান্বিত স্বরে বললো, "দেরি করেছো। নয় মিনিট ৪৫ সেকেন্ড লেগেছে তোমার।"
অনন্যা রাগে গলা উঁচিয়ে স্যারের বুকে হাত দিয়ে একটা আঘাত করলো, "রাস্তা কতটুকু? দেখছেন না কীভাবে দৌড়ে এসেছি?"
কৌশিক একটুও নড়লো না, শুধু গম্ভীর দৃষ্টিতে অনন্যার দিকে তাকিয়ে থাকলো। অনন্যা হাঁপাতে হাঁপাতে বললো, "সময় না গুনে বরং এক গ্লাস পানি আনুন। আমি মরে যাচ্ছি!"
কৌশিক ফিচেল হাসি হেসে কিছুটা কাছে এগিয়ে আসলো। রুক্ষ স্বরে বললো,
"পারবো না।"
অনন্যা কিছু সময় নিশ্চুপ হয়ে রইলো। তারপর হুট করে বললো,
"স্যরি!"
"ওকে!" কৌশিক নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে বললো।
"কেনো বললাম জিজ্ঞেস করবেন না?"
"অন্য কারো জন্য কান্নাকাটি করে এসেছো। স্যরি বলা কম হয়ে গেছে।"
অনন্যা চুপ করে গেলো। কি বলবে বুঝতে পারছিলো না। কৌশিক কিছুটা এগিয়ে ওর থুতনি স্পর্শ করে বললো,
"ফিরে আসলে কেনো?"
"কেনো বিশ্বাস ছিল না আমার উপর?"
"না!"
অনন্যা ফিক করে হেসে ফেললো। হঠাৎ করে থেমে স্যারের গলার টিশার্ট টেনে ধরে বললো,
"আমাকে নিজের বলেছেন যেহেতু বিশ্বাস করা উচিত ছিল। তাছাড়া আমি বাঙালি মেয়ে, এতো সহজে ছাড়ছি না আপনাকে।"
কৌশিক থেমে গেলো, চোখ দ্বয়ের পলক ফেলতে পারলো না। ঝুঁকে থাকা দেহটা নিয়ে অনন্যার চোখের দিকে তাকিয়ে রইলো। অনন্যা দু'হাত বাড়িয়ে কৌশিকের মুখ ছুঁয়ে দিলো, গাল দুটো আলতোভাবে ধরে বললো,
"স্যার, আমি আরণ্যক ভাইয়ার কথায় গলে গিয়েছিলাম, এটা সত্যি। ওর সাথে দুই বছরের কিছু সময় ভাগ করে নিয়েছিলাম। নিজের সমস্যার সব কথা বলতাম, একসাথে সমাধান করতাম। তাহলে ওর জন্য মন খারাপ করা কী স্বাভাবিক নয়? কিন্তু শেষমেশ বিয়ে হলো আপনার সাথে। আমি না বিয়ের দিন বুঝতে পারছিলাম না যে আমার ভবিষ্যতে কী হবে! আমি কার সাথে কীভাবে থাকবো? সেই মানুষটি আমাকে কেমন রাখবে? আমি তাকে মেনে নিতে পারবো তো? অথবা আমিই তাকে ঠিকঠাকমতো যত্নে রাখতে পারবো কিনা।
সবচেয়ে বড় চিন্তা ছিল আমি জানতাম ওই লোকটা শুধু শারীরিক চাহিদার কারণে আমাকে বিয়ে করতে চেয়েছিল। হ্যাঁ, স্যার। উনি মানুষ খারাপ ছিল, এটা আমি জানতাম। ঈরা আমাকে বলেছিলো, ওনার অনেক পুরনো মেয়েলী অতীত আছে। সবদিক চিন্তা করে আমি দ্বিধায় ছিলাম, পারবো কী এসব ভুলে সুন্দর মত সংসার করতে?"
অনন্যা কিছুটা থেমে আবার বলল,
"আমি সেদিন খুব করে চাইছিলাম কেউ আসুক যে আমাকে এসব থেকে দূরে নিয়ে যাবে। একটা আশ্রয় দেবে। যত্ন করবে, ভালো রাখবে। আমার ফ্যামিলির মতো দূরে ঠেলে দেবে না,
বরং বলবে, অনন্যা! আমার সাথে থাকো।
আর তারপর আপনি এলেন, স্বপ্নের রাজকুমারের মতো আমাকে বিয়ে করলেন। আমি সত্যিই বিশ্বাস করতে পারছিলাম না ঐদিন।
প্রথমে তো আপনি আমায় সহ্যই করতে পারতেন না। এই বিয়ে মানতে চাননি, আমাকে মারতেও চেয়েছিলেন! কিন্তু জানেন, সবচেয়ে বেশি কী ভালো লেগেছে? আপনার যত্ন, আপনার স্পর্শ। এই ব্যাপারটাই আপনার সাথে থাকতে বাধ্য করেছে আমায়। আপনি খুব রহস্যময় তাও ভালো লাগে। যত জানতে পারি, তত জানতে ইচ্ছে করে। আপনার কাছে বারবার আসতে ইচ্ছে করে, ঝগড়া করতে ইচ্ছে করে। মনে হয়, আপনি আমার ডায়েরি যেখানে আমি মনের সব কথা লিখে রাখতে পারবো। আপনি একটা এনসাইক্লোপিডিয়া বুক! যে বই খুললে আমি অনেক অনেক জ্ঞান আহরণ করতে পারবো।
তাই যাই হয়ে যাক না কেনো এই সময়ে এসে আমি আপনাকেই নির্বাচন করবো। আমি আপনাতেই সীমাবদ্ধ থাকতে চাই, স্যার।"
অনন্যা এক নিঃশ্বাসে সব বলে হালকা দম ছাড়লো। কৌশিক স্যারকে দেখা গেলো নিশ্চুপ হয়ে তাকিয়ে আছে ওর দিকে। গভীর আর তীক্ষ্ণ সেই দৃষ্টি! অনন্যা স্যারের গাল থেকে ধীরে ধীরে হাত সরিয়ে ফেললো। কিন্তু কৌশিক ছাড়লো না। সে আচমকা কব্জি ধরে টান দিলো। হঠাৎ অনন্যাকে সামনে থেকেই কোলে তুলে নিলো।
"স্যা~র!"
শব্দটা ঠোঁটের আগায় আটকে গেলেও শরীরের ভারসাম্য হারিয়ে ফেলার মুহূর্তে অনন্যা কৌশিকের গলা জড়িয়ে ধরলো। ওর নরম আঙুলগুলো আতঙ্ক আর অধিকারবোধে শক্ত হয়ে এঁটে রইলো কৌশিকের কাঁধে। পা দুটো এলোমেলোভাবে জড়িয়ে গেলো স্যারের পায়ের সঙ্গে।
কৌশিক স্থির দাঁড়িয়ে রইলো, গভীর চোখে ওর মুখখানা দেখলো। ঠোঁটের কোণে এক চিলতে হাসি ফুটিয়ে বললো,
"অনেক বলেছো, এবার আমার পালা!"
"মানে?"
কৌশিক বাঁকা হেসে ধীরে ধীরে অনন্যাকে নিয়েই সম্মুখে এগিয়ে গেলো। অনন্যার শ্বাস হঠাৎ অস্থির হয়ে উঠলো, বুকের ভেতর ধুকপুক শব্দটা এতোই জোরে হচ্ছিল যে মনে হচ্ছে স্যারের কানেও পৌঁছাচ্ছে।
সোফার কাছে এসে থেমে গেলো কৌশিক। কয়েক মুহূর্তের জন্য চোখে চোখ রাখলো অনন্যার। তারপর ধীরে, সাবধানতা অবলম্বন করে সোফায় শুইয়ে দিলো অনন্যাকে।
সারা ঘরের আলোছায়ার খেলায় কৌশিকের মুখটা রহস্যময় লাগছিল। কৌশিক ধীরে ধীরে নিজের উপরের পোশাক টেনে খুলে ফেললো। নিঃশব্দে ছুঁড়ে দিলো কিছুটা দূরে, আর সাথে সাথে তার উন্মুক্ত শরীর আলোর ছায়ায় খেলা করতে লাগলো। অদ্ভুত সৌন্দর্য ছেয়ে গেলো চারপাশ। অনন্যার চোখ বিস্ময়ে বড় হয়ে গেলো। কিছুক্ষণ তাকিয়েই রইলো স্যারের দিকে। তারপর হঠাৎই শ্বাস আটকে এলো, দ্রুত চোখ বন্ধ করে ফেললো সে।
কৌশিক মুচকি হাসলো। দু'হাতের ভর দিয়ে অনন্যার উপর ঝুঁকে এলো। অনন্যা স্তম্ভিত হয়ে ছিল পুরোটা সময়। উঠতে গেলেও পারলো না। স্যারের উষ্ণ শ্বাস এসে লাগলো অনন্যার কপালে, গাল বেয়ে নামতে নামতে থেমে গেলো ওর ঠোঁটের কাছাকাছি।
অনন্যা তড়িঘড়ি নিজের মুখ চেপে ধরলো। কৌশিক ফিচেল হাসি হেসে মেয়েটার হাত ধরে নামিয়ে আনলো। ঠান্ডা কণ্ঠে ফিসফিস করে বললো,
"আমাকে পছন্দ করেছো। মূল্য তো দিতেই হবে, প্রিন্সেস।"
কৌশিক দ্রুতগতিতে ঝুঁকে খুব জোরে আঁকড়ে ধরলো অনন্যার ঠোঁট। মেয়েটার মাথার পেছনে হাত দিয়ে নিজের মাঝে বিলীন হতে বাধ্য হলো। ধীরে ধীরে চুম্বনটা আরও গভীর হতে লাগলো, সীমানা ছাড়িয়ে যাওয়ার মতো কিছু। অনন্যা চেষ্টা করছিল সরে আসার, কিন্তু শরীরে সেই সীমাহীন শক্তি নেই ওর, কাঁপছিল গলা। হাঁপিয়ে উঠেছিল সে, মনে হচ্ছিল শ্বাস ফেলার ও কোনো গতি নেই। কৌশিক স্যার এমনভাবে আক্রমণ করে বসেছে মনে হচ্ছে অনন্যার শরীরের সব শক্তিই শুষে নিতে চাইছে। যতোই সে গভীরে প্রবেশ করছে, ততোই তার গলায় উঁচু হয়ে থাকা অ্যাডামস অ্যাপল অনবরত নড়ে যাচ্ছে।
অনন্যা একসময় সইতে না পেরে কৌশিক স্যারের উন্মুক্ত শরীরে জোরে ধাক্কা মারলো। হাঁপাতে হাঁপাতে বললো,
"স্যার! আমি শেষ হয়ে যাবো।"
"এটা তো কিছুই না। আমি চাইলে আরো গভীরে যেতে পারি।"
ফিসফিসিয়ে বললো কৌশিক।
"না, স্যার।"
কৌশিক অনন্যার দিকে ঝুঁকে বললো,
"আই কান্ট হোল্ড ব্যাক এনিমোর, প্রিন্সেস।"
"মরে যাবো।"
"লেটস ডাই টুগেদার, প্রিন্সেস।"
"কিহ!"
কৌশিক হেসে বললো,
"আমি বাঁচাবো তোমাকে।"
কৌশিক থামলো না অনন্যার গলার উষ্ণতার মাঝে মুখ ডুবিয়ে দিলো। সারা শরীরে ধীরে তার হাতের স্পর্শ গভীরভাবে ছুঁয়ে গেলো। অনন্যা বালিশ চেপে ধরে নিজেকে সামলাতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। শেষমেশ স্যারের গুচ্ছ চুলে মেয়েটার হাত পৌঁছে গেলো। টেনে ধরলো স্যারের চুল। উনার শ্বাস মিশে যাচ্ছিল অনন্যার গলার কাছে, কাঁধে, চিবুকে। অনন্যা নিজের অজান্তেই চোখ বন্ধ করে ফেললো, বুকের ভেতর এক অনিশ্চিত কাঁপন ছড়িয়ে পড়তে দেখতে পেলো।
স্যারের আচরণ ধীরে ধীরে আরো হিংস্র হয়ে উঠছিল। আর তার সাথে সাথে অনন্যার শ্বাস ধীর হয়ে আসছিল, কিন্তু হৃদস্পন্দন উল্টো গতিতে চলছিল। স্যারের চোখে হঠাৎ এক অদ্ভুত হিংস্রতা ধরা পড়লো। তার আকাশি চোখ কিছু পাওয়ার আশায় নীলচে বর্ণ ধারণ করে ফেলেছে। মনে হচ্ছিল অনেক বছর ধরে সে ক্ষুধার্ত আজ পাগলের মতো সব ক্ষুধা মিটিয়ে যাচ্ছে।
অনন্যার শরীরে উন্মুক্ত অঙ্গে, প্রতিটি চোখে লাগা তিলে ঠোঁট স্পর্শ করে কৌশিক জোরে কামড়ে দিচ্ছিলো। অনন্যা যথাসম্ভব চেষ্টা করছে আওয়াজ না করতে। কিন্তু হয়ে যাচ্ছে। একসময় কৌশিক অনন্যার মুখ হাত দিয়ে চেপে ধরে শান্ত হতে বললো। টিশার্ট সরিয়ে উন্মুক্ত পেটের দিকে হালকা চুমু খেলো। কেঁপে উঠলো অনন্যা। স্যারের চুল আরো শক্ত করে টেনে ধরলো।
কৌশিক আরো কয়েকটি চুমু বসিয়ে অনন্যার চোখে নীলচে দৃষ্টি রেখে মুচকি হেসে বললো,
"ইউ আর মাই এডিকশন, প্রিন্সেস। আই ওয়ান্ট ইউ ডেসপারেটলি।"
আবারো আক্র'ম'ণ! অনন্যা জোরে জোরে নিঃশ্বাস ছাড়ছে। মুখ দিয়ে গোঙানির আওয়াজ করছে। কিন্তু স্যার এতো শক্ত করে চেপে ধরেছে যে কোনো আওয়াজ ও করা যাচ্ছে না। মনে হচ্ছে শ্বাস আটকে যাবে। কৌশিক মুচকি হেসে ধীরে মুখ হতে হাত সরিয়ে আবারো অনন্যার ঠোঁট চেপে ধরলো। এক ক্ষুধার্ত বাঘের মতো আক্রমণ করে বসলো। অনন্যা লোকটাকে বোঝাতে পারছে না যে অতিরিক্ত হয়ে যাচ্ছে। একসময় রিডোর গর্জনের আওয়াজে কৌশিক থেমে গেলো। অনন্যাকে ছেড়ে দিয়ে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালো রিডোর দিকে। রিডো আবারো গর্জন করলো। কৌশিকের চোখের নীল আলো দপ করে নিভে গেলো, সে দ্রুতগতিতে অনন্যার দিকে চাইলো। অনন্যা অজ্ঞান হয়ে পড়েছে, তার ঠোঁট রক্তাক্ত আকার ধারণ করেছে, শরীরে বিভিন্ন অংশে লাল লাল চিহ্ন দিয়ে ভরিয়ে দিয়েছে কৌশিক।
কৌশিকের গলা শুকিয়ে গেলো। অনন্যার থেকে সরে আসলো সে। মেয়েটাকে শোয়া থেকে উঠিয়ে নিজের বুকে চেপে ধরে ডাকতে লাগলো, গালে আলতো চাপড় মারলো। একসময় পাশের টেবিলে রাখা জগ থেকে পানি নিয়ে অনন্যার চোখে মুখে ছিটিয়ে দিলো। কিছু সময় পর জ্ঞান ফিরলো অনন্যার। কৌশিক মেয়েটার দুই গালে হাত রেখে বললো,
"স্যরি...স্যরি, প্রিন্সেস! আমি আসলে বুঝতে পারিনি।"
অনন্যার ঠোঁটে আঙুল স্পর্শ করে কেঁপে উঠলো কৌশিক। চোখ দিয়ে এক ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়লো। কিন্তু সে খেয়ালই করলো না বিষয়টা।
অনন্যা ধীরে ধীরে আবছা চোখে তাকালো। কৌশিক মেয়েটার মাথায় হাত বুলিয়ে বললো,
"স্যরি। আমি মাঝেমধ্যে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারি না। ভুল হয়ে গেছে।"
অনন্যা কৌশিকের গলা জড়িয়ে ধরে কাঁধে মাথা রাখলো। ডান হাত লোকটার গালে রেখে বললো,
"বুঝতে পেরেছি।"
কৌশিকের শ্বাস কেমন ভারী হয়ে আসছিল। মনে হচ্ছিল, বুকের ভেতর কিছু একটা পাথরের মতো চেপে বসেছে। এক মুহূর্তও দেরি না করে দৌড়ে গিয়ে ফার্স্ট এইড বক্স নিয়ে এলো। হাত কাঁপছিল তার।
অনন্যার ক্ষতস্থানে ওষুধ লাগাতে গিয়ে কৌশিকের বুকের ভেতর হাহাকার করে উঠলো। মনে হলো নিজেকে শেষ করে দিক। যত্ন করে ব্যান্ডেজ বাঁধতে বাঁধতে গলার কাছে একটা কষ্ট দলা পাকিয়ে উঠছিল। শেষে কোনো কিছু না বলে, মেয়েটাকে শক্ত করে বুকের সঙ্গে চেপে ধরলো। এক হাত অনন্যার মাথায় রেখে আলতো করে আঙুল চালাতে লাগলো চুলের ভেতর।
অনন্যা মৃদু হেসে বললো,
"স্যার! আপনি এতো ঠান্ডা কেনো?"
.
.
.
চলবে.........................................................................