প্রেমান্বেষা - পর্ব ৩৫ - সারা মেহেক - ধারাবাহিক গল্প


স্মরণের প্রমোশন হয়েছে৷ এ ব্যাপারে সে সর্ব প্রথম নাজমা বেগমকে জানিয়ে তৎক্ষণাৎ জানিয়েছে মিলি বেগমকে। মিলি বেগমকে সেদিন বহু কষ্টে রাজি করিয়েছিলো স্মরণ। মিলি বেগম রাজিও হয়েছিলেন, এ বিয়ে প্রায় অসম্ভব জেনেও। এখনও অব্দি তিনি কাউকে এ বিষয়ে বলেননি। তিনি জানতেন স্মরণ নীলিমার ব্যাপারে কেউ জানেন না। যদিও পরে নওরীন, সাজিদ, সাদ ও রাফার কথা জানতে পেরেছেন।

মিলি বেগম আছেন বড়ই দুশ্চিন্তায়। স্মরণ তাঁর ভাইয়ের ছেলে, ছোট থেকে দেখে এসেছেন। জানেন স্মরণ কেমন ধাঁচের ছেলে। নীলিমাকে স্মরণের সাথে বিয়ে দিয়ে যে ঠকবেন না এ বিষয়ে সম্পূর্ণ বিশ্বাসী তিনি। কিন্তু বড়দের মধ্যে একমাত্র স্মরণ ও নীলিমার প্রেমের ব্যাপারে জানেন বলে পরোক্ষভাবে তাঁকেই বাড়ির সবাইকে বুঝিয়ে রাজি করাতে হবে। এ নিয়েই আজকাল দুশ্চিন্তায় সময় কাটে মিলি বেগমের। ইমাদ সাহেব স্ত্রী'র এরূপ দুশ্চিন্তাগ্রস্ত চেহারা দেখে প্রায়শই জিজ্ঞেস করেন কি হয়েছে। মিলি বেগম তৎক্ষণাৎ হাসিমুখে এসব এড়িয়ে যান। আর ভাবেন, সামনের দিনগুলোতে কত বড় ঝড় আসতে চলেছে। 

মিলি বেগমকে প্রমোশনের সংবাদ জানানোর পর স্মরণ ফোন করে নীলিমাকে। নীলিমা তখন রুমেই ছিলো। ভার্সিটি বন্ধ দিয়েছে আরও তিন চারদিন আগেই। এখন তাই বাসায়ই শুয়ে বসে সময় কাটে তার। স্মরণ ফোন দিতেই সে ফোন নিয়ে বারান্দায় ছুটলো। গিয়ে ফোন রিসিভ করে মিহি সুরে বললো,
" কেমন আছেন স্মরণ ভাই? "

স্মরণ লম্বা নিঃশ্বাস ছাড়লো। নীলিমার কণ্ঠ শুনতেই তার ঠোঁটের কোনে দেখা মিললো মুচকি হাসি। অফিসের রকিং চেয়ারে হেলান দিয়ে আয়েশ করে বসলো সে। মাথার পিছে হাত রেখে মোলায়েম কণ্ঠে বললো,
" শুনছো নীলি? প্রোমোশনটা আমার হয়ে গেছে। "

নীলিমা হাসলো। এ হাসিতে মিশে আছে স্বস্তি, নিশ্চয়তা ও ভালোবাসা। এই দিনটির জন্য তার অপেক্ষা যেনো বহু যুগ পেরিয়েছে। স্মরণের প্রোমোশন ছিলো তাদের ভবিষ্যতের নিশ্চয়তা। এবার আর বাবা চাকরী নিয়ে খোঁটা দিতে পারবেন না। নীলিমা এবার বারান্দার গ্রিলে হেলান দিয়ে বললো,
" কংগ্রাচুলেশনস মিস্টার স্মরণ শেখ। "

স্মরণ ফের মুচকি হাসলো। আজ এক পলের জন্যও তার মুখশ্রী হতে হাসির আভা হটেনি। আজ যেনো তার ঈদ লেগেছে! স্মরণ বললো,
" এবার আর তোমাকে আমার মিসেস হতে কেউই বাধা দিবে না। "

নীলিমার ওষ্ঠজোড়া এবার মিইয়ে এলো। হাসি উবে গেলো মুহূর্তেই। সে জানে, আর কেউ বাধা না দিলেও তার বাবা ও স্মরণের মা এ বিয়ের তীব্র বিরোধিতা করবেন। ঘোর প্রতিরোধ করবেন এই দুজন। অন্য সকলকে রাজি করানো সম্ভব হলেও এদের রাজি করানো হবে এভারেস্ট জয়ের চেয়েও কঠিন। তাই নীলিমা এ কথার প্রত্যুত্তর দিলো না। বরং কথা ঘুরিয়ে বললো,
" আপনার ছুটি কবে থেকে স্মরণ ভাই। "

" আরও প্রায় এক সপ্তাহ পর ছুটি হবে। বোঝোই তো, কোরবানি ঈদে খুব বেশি ছুটি দেয় না। "

" হুম বুঝেছি। আম্মুকে জানিয়েছেন প্রোমোশনের ব্যাপারে?"

স্মরণ হাসলো। বললো,
" তোমাকে জানানোর আগেই ফুপিকে জানিয়েছি। আমাদের বিয়ের প্রপোজাল দিবে সে। তাকে তো এটুকু প্রায়োরিটি দিতেই হয়! "

নীলিমাও আলতো হাসলো। বললো,
" তা অবশ্য ঠিক বলেছেন। "

" আচ্ছা নীলিমা থাকো। স্যার ডাকছে আমাকে। বাসায় গিয়ে কথা বলবো তাহলে। "

" আচ্ছা, ঠিক আছে। "
নীলিমা ফোন রেখে দিলো। তার বুক চিরে বেরিয়ে এলো দীর্ঘশ্বাস। নিশ্চয়তার মাঝেও দুজনকে নিয়ে চরম অনিশ্চয়তায় দিন কাটছে তার। মাঝে মধ্যে এ নিয়ে বেশি ভাবলে মাথা ব্যাথা বেড়ে যায়। সবকিছু তখন অন্ধকার বোধ হয়। 

--------------------

কোরবানি ঈদের এখনও পাঁচ দিন বাকি আছে। বাহাদুর শেখ জরুরী তলব করে প্রত্যেককে বাড়িতে ডেকেছেন৷ শরীর তার ভীষণ অসুস্থ। যে কোনো সময় পরকালে পাড়ি জমাতে পারেন। আসমানী বেগম থাকেন দুশ্চিন্তায়। আজকাল রাতে ঠিক মতো ঘুমাতেও পারেন না। সারারাত স্বামীর পাশে অতন্দ্র প্রহরীর ন্যায় জেগে থাকেন। হঠাৎ চোখ লেগে আসলে চোখ খোলা মাত্রই বাহাদুর শেখের বুকের উঠানামা দেখেন, শ্বাস প্রশ্বাস নিচ্ছেন কি না এই দেখতে।

আনিস সাহেবও ইদানীং বাহাদুর শেখের রুমে যান। আগে খুব একটা যেতেন না। কিন্তু এখন এক ঘণ্টা বাবাকে না দেখলে তাঁর বুকের ভেতর অস্থিরতা কাজ করে।
বাহাদুর শেখ এই দূর্বল শরীর নিয়েই নিজে ফোন করে ডেকেছেন দু মেয়েকে। চিন্তায় আছেন, মেয়ে দুটোকে শেষ দেখা দিতে পারবেন কি না৷ লিলি বেগম বাবার ফোন দেয়ার পরের দিনই স্বামী, ছেলেমেয়েসহ চলে এসেছেন বাবার বাড়ি। এবারের ঈদটা শ্বশুরবাড়িতে করার কথা ছিলো।যেহেতু গত ঈদ বাবার বাড়িতেই করেছেন, মানতাসার বিয়ের জন্য। এদিকে ইমাদ সাহেব অনিচ্ছা সত্ত্বেও শ্বশুরবাড়িতে গেলেন। এভাবে পরপর দু ঈদ শ্বশুরবাড়িতে করা কি ভালো দেখায়! লোকে তো ভেবে বসবে, এই ব্যাটা নিশ্চিত ঘর জামাই। এসব কারণে ইমাদ সাহেব কিছুটা বেঁকে বসেছিলেন। কিন্তু শ্বশুরের শারীরিক অবস্থার চরম অবনতি, স্ত্রী ও মেয়ের কান্নায় তিনি যেতে বাধ্য হোন। দাদা-নানার শরীরের কথা শুনে নওরীন ও মানতাসা দুজনই শ্বশুরবাড়ি থেকে ছুটে চলে আসে। 

বাহাদুর শেখের জীবন প্রদীপ যেনো নিভু নিভু করছে। যে কোনো সময়ই তা নিভে যাবে বোধ হচ্ছে। তবে আল্লাহ চাইলে বাহাদুর শেখের হায়াত আরোও বাড়তে পারে!
বাহাদুর শেখের রুমে বাড়ির প্রতিটি সদস্য উপস্থিত। তিনি শুয়ে আছেন বিছানায়। আসমানী বেগম তার পাশে বসে নীরবে কাঁদছেন ও দোয়া কালাম পড়ছেন। তাঁদের মেয়ে দুটোও অবিরত কাঁদছে। ছেলের বউ দুটোও শাড়ির আঁচলে চোখ মুছছে। সকলের এই কাঁদো কাঁদো অবস্থা দেখে বাহাদুর শেখ দূর্বল ও কম্পিত গলায়ই ধমক দিলেন,
" ঐ তোরা কাঁদতেছিস ক্যান? আমি কি মরে গেছি নাকি! আমার মরবার আগেই তোরা আমারে মাইরা ফেলতেছিস দেহি! "

নানার কথা শুনে হি হি করে হেসে ফেললো রাফি। এগিয়ে গিয়ে বললো,
" আমিও তো তাই বলি নানাভাই। তোমার ছেলেমেয়েগুলো কেমন দেখছো! তোমার কিছু হওয়ার আগেই কান্না জুড়ে বসে আছে। "

বাহাদুর শেখ সশব্দে হাসতে চাইলেন। কিন্তু তার দুর্বল শরীর তাতে সায় দিলো না। ফলে মৃদু হাসলেন তিনি। রাফির দিকে হাত এগিয়ে দিলে রাফি তাঁর কাছে গিয়ে বসলো। 
আনিস সাহেব এবার বললেন,
" আব্বা? কিছু কি বলবেন? এভাবে ডাকলেন যে?"

বাহাদুর শেখ একটু কাশি দিলেন। তাতেই যেনো সকলের প্রাণপাখী উড়ে যাবার জোগাড় হলো! অতঃপর তিনি মুহূর্তেই আশ্বাস দিলেন সকলকে,
" ভয় পাইস ক্যান! আমি এতো সহজে মরতেছি না। তোগোর একটা ব্যবস্থা করেই মরমু আমি। "

এই বলে তিনি এক নজরে সবাইকে দেখলেন। সকলের মুখের অবস্থা করুণ। মেয়ে, বউ, নাতনিগুলোর চোখে পানি, মুখখানা লাল। ছেলে, জামাই, নাতিগুলোর মুখ শুষ্ক, ঠোঁট শুষ্ক।

বাহাদুর শেখ এবার বললেন,
" শোন, আমার বেশি সময় নাই। মরবার আগেই প্রতিটা জীবই বুঝে। ওমনে আমিও বুঝতেছি। তোরা চার ভাইবোন এতোগুলা বছর ধইরা মিইল্যা মিশা রইছোস। আমি মরবার পরও তোরা এমনে থাকোস। জমিজমা কেউ কারোরডা মাইরা খাইস না। এই দুনিয়ায় ভাইবোনের হক মাইরা খাইলে কবরে গিয়া ট্যার পাবি। এই জন্যি তোগোর যার যা হক সব মিটাইয়া দিবি। "

এবার আনিস সাহেব ও আনোয়ার সাহেবও এগিয়ে এলেন। আনিস সাহেব বাহাদুর শেখের হাতের মুঠোয় হাত আগলে আশ্বস্ত করে বললেন,
" আপনি চিন্তা করবেন না আব্বা। আমি, এই আনিস শেখ, আপনাকে ওয়াদা করছি, আমি বেঁচে থাকতে আমার কোনো ভাইবোনের হক মেরে খাবো না। আর কাউকে হক মারতেও দিবো না। "

বাহাদুর শেখ সন্তুষ্ট হলেন। অতঃপর আসমানী বেগমের দিকে চেয়ে বুক ভরে নিঃশ্বাস নিলেন। তার দুর্বল ছানি পড়া দৃষ্টিজোড়া ভিজে আসছে। আসমানী বেগম তা দেখে শাড়ির আঁচল দিয়ে পরম যত্নে মুছে দিলেন। বাহাদুর শেখ এবার মাথা ঘোরালেন। খানিক সময় নিয়ে বললেন,
" যে জরুরী কথা বলবার জন্যি তোগোরে ডাকছিলাম আমি। শোন, আমি আমার সব নাতি নাতনিরেই সমান ভালোবাসি। আমি চাই সগলে য্যান সুখে থাহে। মানতাসার পর এবার নীলুর বিয়া নিয়া চিন্তা থাহি আমি। আমার সোনার মানিকডা কোনে যাইবো, ক্যামনে থাকবো এই নিয়াই ভাবি আমি। আমি চাই আমার নীলু য্যান সুখে থাকে৷ ও যানি ঘরের হইয়্যা ঘরেই থাহে। তাই আমি চাইতেছি স্মরণের লগে নীলুর বিয়া দিয়া নীলুরে আমাগোর বাড়িই রাখতি। "

বাহাদুর শেখের এহেন কথায় উপস্থিত সকলে স্তম্ভিত হয়ে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলো। কারোর মুখ দিয়ে টু শব্দটুকু বের হচ্ছে না। প্রত্যেকেই সমান তালে বিস্মিত। এমনকি স্মরণ ও নীলিমাও। এ যেনো না চাইতেই হাতের কাছে দূর্লভ বস্তু পাওয়ার শামিল!

বাহাদুর শেখের এমন সিদ্ধান্তে সকলে খুশি হলেও তীব্র নাখোশ হলেন ইমাদ সাহেব ও নাজমা বেগম। ইমাদ সাহেব একটি কথাও বললেন না। বরং তৎক্ষনাৎ বেরিয়ে এলেন রুম থেকে। তিনি যে বাহাদুর শেখের সিদ্ধান্ত অমত জানিয়ে বেরিয়ে এসেছেন, এটুকু বুঝতে কারোর খুব একটা মাথা খাটাতে হয়নি।

ইমাদ সাহেবের পিছু পিছু বেরিয়ে এলো মিলি বেগম, আনিস সাহেব, নাজমা বেগম, স্মরণ, সাজিদ, নওরীন ও নীলিমা। ইমাদ সাহেব রুম থেকেই বেরিয়েই দৃঢ় গলায় বললেন,
" অসম্ভব। আমি আমার মেয়েকে কখনোই এ বাড়ির বউ হতে দিবো না। আমি স্মরণ ও নীলিমার বিয়ের ঘোর বিরোধিতা জানাচ্ছি। এ বিয়ে আমি হতে দিবো না। "

নাজমা বেগমও কম যান না। চাচাতো ভাইয়ের এ কান্ডে তাঁর পায়ের রক্ত যেনো মাথায় উঠে গেলো! তিনিও তেজস্বী গলায় বললেন,
" আমার ছেলেকে রিজেক্ট করার সাহস কোথ থেকে পেলি তুই! আমি তোর মেয়েকে রিজেক্ট করছি ইমাদ। আমার ছেলের সাথে কখনোই তোর মেয়ের বিয়ে দিবো না। কখনোই না। "
.
.
.
চলবে.........................................................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

WhatsApp