সকালের সূচনা হতে না হতেই সূর্য যেনো তার রুপের আগুনে ঝলসে দিচ্ছে সমস্ত পৃথিবীতে। আজ তাপমাত্রা বেশি। গরম গরম বাতাসের সাথে বোধহয় অনেকের সকালটা শুরু হলো। স্মরণের সকালও শুরু হলো ঘামে জর্জরিত হয়ে। প্রচন্ড গরমে ঘেমে-নেয়ে একাকার হয়ে উঠলো সে। চোখ খুলে দেখলো মাথার উপরে ফ্যান চলছে না। সকাল সকাল বিদ্যুৎ যাওয়া দেখে রাগে মুখ দিয়ে গালি বের করলো সে,
"শালা শুয়োরের বাচ্চা। মানুষজনকে শান্তিতে ঘুমাতেও দিস না। ঘরে বউ বাচ্চা নেই? এতো সকালে কারেন্ট নিস কীভাবে!"
বলতে বলতে উঠে পড়লো স্মরণ। রাতে একটা স্যান্ডু গেঞ্জি পরে ঘুমিয়েছিলো। ঘামে ভিজে থাকায় গেঞ্জিটা খুলে বালতির ভেতর ছুঁড়ে ফেলে সে। আজ খালাকে বলে এতোদিনের কাপড়গুলো কাচাতে হবে। কিন্তু অতি শীঘ্রই এই খালাকে বদলাতে হবে। দিনকে দিন তার হাতের রান্না বিচ্ছিরি থেকেও বিচ্ছিরি হচ্ছে। উপরন্তু তার ভাবখানা এমন যে তিনিই এ বাসার মালিক। এসবই সিঙ্গেল জীবনের জ্বালা যন্ত্রণা। বিরক্তিতে তিতকুটে অনুভূতির স্বাদ নিয়ে সে ব্যালকনিতে গিয়ে দাঁড়ালো। বাহিরে মৃদুষ্ণ হাওয়া বইছে। ব্যালকনিতে সকালের কড়া রোদ এসে আছড়ে পড়েছে। তবুও রুমের তুলনায় ব্যালকনিতে গরম কম। স্মরণ চোখ মুখ কুঁচকে আধো আধো চোখে সূর্যের দিকে তাকানোর চেষ্টা করলো। নাহ, তাকানো যাচ্ছে না৷ সূর্যের তেজিরূপ দেখে স্মরণ নিজের মধ্যেই আওড়ালো,
"আজ রক্ত, পানি সব শুষে নেবে বোধহয়।"
এই বলতে বলতে সে রুমে গিয়ে ফোন এনে ব্যালকনিতে দাঁড়ালো। কেবল বাজে সকাল সাতটা৷ নীলিমা উঠেছে কি না কে জানে। এসব ভেবে তবুও স্মরণ ফোন দিলো নীলিমাকে। একবার, দুবার, তিন বারের বার ফোন রিসিভ করলো নীলিমা। ওপাশ থেকে ঘুম জড়ানো ভারী কণ্ঠ ভেসে এলো,
" হ্যালো? কে বলছেন?"
স্মরণ হাসলো। বললো,
" আমি! স্মরণ!"
মুহূর্তেই নীলিমার চোখ হতে ঘুম পালালো। বড় বড় চোখে কান থেকে ফোন নামিয়ে দেখলো স্মরণের নাম ভেসে উঠছে। তড়াক করে উঠে বসলো সে। গলা পরিষ্কার করে বললো,
" স্মরণ ভাই আপনি! এত সকালে!"
স্মরণ লম্বা করে নিঃশ্বাস ছেড়ে বললো,
" কারেন্ট নেই। ঘুম ভেঙে গিয়েছে। তাই ভাবলাম তোমাকে কল করি৷ ঘুমিয়ে আছো কি না। "
" জি স্মরণ ভাই, ঘুমিয়েই ছিলাম৷ ক্লাস না থাকলে ১০টার আগে উঠি না। "
" আমার অফিস থাকে ৯টায়। পৌনে ৮টার মধ্যে উঠে পড়ি আমি। ফুপার সাথে কথা হয়েছে?"
" না। এখনও হয়নি। আজ দেখি বলবো।"
স্মরণ এবার নাজমা বেগমের মেয়ে খোঁজা নিয়ে কিছু বলতে গিয়েও বললো না। ওপাশে নীলিমার কেমন প্রতিক্রিয়া হবে জানা নেই। যদি মন খারাপ করে বসে? এজন্যই তার ব্যাপারটা এড়িয়ে গিয়ে আরোও নানা কথায় সময় কাটালো তারা।
নীলিমার সাথে কথা শেষে ফোন রেখে এক কাপ গরম লেবুর পানি নিয়ে ব্যালকনিতে বসলো স্মরণ। হঠাৎ তার ফোনে নাজমা বেগমের ফোন এলো। সে স্বাভাবিকভাবেই ফোন রিসিভ করলো। নাজমা বেগমও প্রথমদিকে ভালোমতো কথা বললেও শেষে তার কথার সুঁই আটকে গেলো স্মরণের বিয়ের উপর।
" স্মরণ? "
" হ্যাঁ মা বলো।"
স্মরণের অতি স্বাভাবিক সুর। নাজমা বেগম বললেন,
" তোর জন্য ঐ মেয়ের খোঁজ নেই?"
" না মা। আমি তো বলেইছি ঐ মেয়েকে বিয়ে করবো না। "
এবার নাজমা বেগম দ্বিধাদ্বন্দ্বে জিজ্ঞেস করলেন,
" তোর কি কোনো পছন্দ আছে বাবা? থাকলে সেই মেয়ের সাথেই বিয়ে দিবো তোকে। "
স্মরণ নিজেকে শান্ত রেখে বললো,
" হুম পছন্দ আছে। "
উচ্ছ্বসিত হলেন নাজমা বেগম। বললেন,
" তাই! মেয়ের নাম কি? বল। আমরা খোঁজ নেই।"
" নামধাম এখন কিছুই বলবো না। আর খোঁজ নেয়ারও দরকার নেই। মেয়ে অনেক ভালো। তোমার পছন্দ হবে।"
" তাহলে একটু নামটা বল। "
" উহুঁ নাম বলা যাবে না। সঠিক সময় এলে বলবো। আর সাদ কবে আসবে? ওর যে আর ক'দিন পর ক্লাস শুরু হয়ে যাবে।"
" কাল পরশু যাবে হয়তো। "
" আচ্ছা, মা। আমি তাহলে রাখি। অফিসের জন্য বের হতে হবে। আর তুমি আপাতত আমার বিয়ের টেনশন বাদ দাও। চিন্তামুক্ত থাকো। রাখি।"
বলেই খট করে কল কেটে দিলো স্মরণ। ওদিকে দুঃখ ভারাক্রান্ত হৃদয় নিয়ে ঘরের কাজে ফিরে গেলেন নাজমা বেগম।
----------------
ইমাদ সাহেব আকাশের সাথে নীলিমার বিয়ের ব্যাপারে কথা বলতে এসেছেন। নীলিমা তখন ফোনে স্মরণের সাথে কথা বলছিলো। ইমাদ সাহেবের উপস্থিতি টের পেতেই মুহূর্তেই সে সতর্ক হলো। ফোন রেখে স্বাভাবিক দৃষ্টিতে তাকালো বাবার দিকে। ইমাদ সাহেবও স্বাভাবিক কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলেন,
" আকাশের ব্যাপারে কি চিন্তা করেছিস? আজকে বন্ধু ফোন করেছিলো। কবে আংটি পরাতে আসবে জিজ্ঞেস করছিলো। "
নীলিমা কিঞ্চিৎ ভীত গলায়,
" না করে দাও আব্বু। আমি উনাকে বিয়ে করবো না। " বলেই শুকনো একটা ঢোক গিললো সে। অন্যান্য সময় হলে বেশ বন্ধুবৎসল গলায়ই ইমাদ সাহেবকে জবাব দিতো। কিন্তু গত পরশু স্মরণের সাথে ঘুরে আসার পর যা ঘটলো তাতে সে বেশ ভয় পেয়েছে। সতর্কও আছে। কখন না জানি কি ঘটে বসে!
" বিয়ে না করার কোনো কারণ? "
" পছন্দ হয়নি। আমার মন থেকে পছন্দ না হলে তো বিয়ে করতে পারি না তাই না আব্বু?"
" হুম বুঝেছি তোর কথা। আচ্ছা আমি ওর সাথে কথা বলি তবে।"
বলেই চলে গেলেন তিনি। মেয়ের পছন্দ অপছন্দের ব্যাপারে যথেষ্ট সচেতন তিনি৷ মেয়ের যা পছন্দ নয় তা জোর করে কখনো চাপিয়ে দেননি তিনি। সবসময় দু মেয়ের পছন্দের ব্যক্তি হিসেবে থাকতে চেয়েছেন ইমাদ সাহেব। এতে যার মনে যা আসুক বলুক সে। তাতে নিজের কি!
বাবা চলে যেতেই খুশিতে আত্মহারা হয়ে ফোন দিলো স্মরণকে। উচ্ছ্বসিত গলায় বললো,
" স্মরণ ভাই! আমি আজ আকাশের কথা বলেছি আব্বুকে। "
স্মরণের উৎকণ্ঠিত মনের প্রশ্ন,
" কি বললো ফুপা?"
নীলিমার খুশিতে গলা কাঁপছে। নিজেকে সামলে সে বললো,
" আমি আকাশকে বিয়ে করবো না বলেছি। আব্বু শুধু জিজ্ঞেস করেছিলো কেনো বিয়ে করবো না। বলেছি, ভালো লাগে না। আব্বু আর এ নিয়ে ঘাঁটায়নি।"
স্মরণের হৃদয়ে যেনো শীতল বর্ষন হলো। স্বস্তিতে কিছুক্ষণ চোখ মুদে রইলো সে। অতঃপর নির্বিঘ্ন গলায় বললো,
" এখন তবে আর বাধা নেই। আমার প্রোমোশনটা হয়ে নিক। এরপর তুমি শেখ পরিবারের বউ হতে চলেছো নীলি। "
নীলিমা লজ্জায় কুঁকড়ে এলো। স্মরণের সাথে বিয়ের কথা ভাবলেই সমস্ত অঙ্গে অদ্ভুত শিহরণ বয়ে যায়। মাঝেমধ্যে অবিশ্বাস্য লাগে সবটা। আসলেই কি তাদের বিয়ে হবে! সত্যিই কি সে স্মরণের বউ হবে? সবকিছু এত অবিশ্বাস্য কেনো! নীলিমার এ মুহূর্তে প্রচন্ড শান্তি অনুভূত হলো। মাথার উপর থেকে যে বড় একটা চিন্তার পাথর সরে গিয়েছে এতেই সে যারপরনাই খুশি।
---------------------
সাদের ক্লাস শুরু হয়েছে প্রায় এক মাস। অলস ছেলেটা বেশ ক্লাস মিস দেয়। কিন্তু দুদিন আগে স্মরণের বকুনি খেয়ে সোজা হয়ে গিয়েছে। এখন রোজ রোজ ক্লাসে যায়। তবে ঘুম ঘুম চোখে। কারণ রাতের অর্ধেক সময়ই সে জেগে জেগে স্মরণের পিছনে গোয়েন্দা অভিযান চালায়।
স্মরণ ও সাদ যে বাসায় থাকে সেটা দু রুমবিশিষ্ট৷ ড্রইং ডাইনিং একটা। আর বেডরুম একটা৷ স্মরণ ও সাদ বেডরুমেই ঘুমায়৷ কিন্তু সাদ আজকাল লক্ষ্য করে স্মরণের ভাবভঙ্গি পরিবর্তন হয়েছে। আজকাল আগের চেয়েও বেশি আদরেও রাখে, আবার কাজ না হলে শাসনও করে৷ আগের চেয়ে বেশি হাসিখুশি থাকে। সাদের মতে এসব লক্ষণ অন্য কিছুর সাথে মিলে যায়। সেই 'অন্যকিছু' নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করতেই বেরিয়ে আসে আশ্চর্যজনক তথ্য!
সাদ খেয়াল করেছে সে ঘুমিয়ে পড়লে স্মরণ উঠে যায়। কখনও অন্য রুমে, কখনও বা ব্যালকনিতে। গিয়ে কার সাথে যেনো কথা বলে। অনেকক্ষণ যাবত। এটা তার নিত্য দিনের রুটিন হিসেবে দেখা যাচ্ছে। যদিও সাদ ঘুমায় না। এজন্যই তো স্মরণের কথা টুকটাক শুনতে পায়।
সাদের দীর্ঘ কয়েকদিনের গবেষণার ফল হিসেবে বের হলো যে স্মরণ প্রেম করছে। যেনো তেনো প্রেম নয়। একদম কঠিন প্রেম! এমন প্রেম সে তার বন্ধুদের করতে দেখেছে। বন্ধুদের মধ্যে যারা প্রেম করতো তাদেরকে 'নিব্বা' বলে ক্ষ্যাপাতো সিঙ্গেলরা। এখন দেখছে নিজের ভাই-ই এই বুড়ো বয়সে এসে নিব্বাদের মত আচরণ করছে। অবাক হলো সাদ। ভাবলো, যে ভাই কৈশোর, যৌবনের অর্ধেক সময় প্রেম না করেই কাটিয়ে দিলো সে এই ত্রিশের কোঠায় এসে কার প্রেমে পড়লো! কে সেই নারী যে স্মরণের হৃদয়ের ডঙ্কা বাজিয়ে দিয়েছে!
সাদ এখন সতর্ক হয়ে থাকে। তার সুযোগসন্ধানী চোখজোড়া স্মরণের অজান্তেই স্মরণের উপর ঘুরে। অপেক্ষায় আছে, কবে হাতেনাতে ধরবে স্মরণকে।
আরোও বেশ কিছুদিন অতিবাহিত হওয়ার পর সাদের সেই বহু প্রতীক্ষিত দিনটি এলো। শুক্রবার জুমার নামাজের জন্য স্মরণ গিয়েছে গোসল করতে। এমন সময় তার ফোনে নীলিমার ম্যাসেজ এলো। নীলিমা লিখেছে, "স্মরণ ভাই? আজ কখন দেখা করবেন? আমি লিসাকে বলে রাখবো বাসা থেকে ফোন দিলে ও যেনো মিথ্যে বলে সামলে নেয়। "
এই ম্যাসেজ দেখে সাদের মাথায় হাত। তবে কি নীলিমাই সেই নারী! সাদ উত্তেজিত হয়ে পড়লো। কখন স্মরণ বের হবে আর কখন সে এ নিয়ে জিজ্ঞেস করবে।
টানা দশ মিনিট পর গোসল সেরে বের হলো স্মরণ। বের হওয়া মাত্রই সাদ তার একদম মুখের সামনে ফোন ধরে খেঁকানো গলায় জিজ্ঞেস করলো,
" ভাইয়া? তুমি নীলু আপুর সাথে প্রেম করছো!?"
স্মরণ ভীত হলো। তার বিচলিত দৃষ্টি গিয়ে ঠেকলো ফোনের স্ক্রিনে। সেখানে নীলিমার ম্যাসেজ ভেসে উঠছে। আজ বিকেলে তাদের দেখা করার কথা ছিলো। কিন্তু এর আগেই সব ফাঁস হয়ে গেলো!
ঢোক গিললো স্মরণ৷ আমতাআমতা করে বললো,
" দে-দেখ সাদ, তু-তুই যা ভাবছিস এমন কিছুই নেই। "
সাদ ফোন সরিয়ে কোমড়ে হাত রাখলো। নাক উঁচিয়ে বললো,
" তোমার তোতলানোই সব বলে দিচ্ছে ভাইয়া। তুমি সত্যিই নীলু আপুর সাথে প্রেম করছো!"
হাল ছাড়লো স্মরণ। সে জানে এখন সাদকে যত ধরণের যুক্তি দিয়েই বোঝানো হোক না কেনো, সাদ বুঝবে না৷ তাই সে ফোঁস করে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,
" হুম। করছি ওর সাথে প্রেম। "
বলেই সে গলার স্বর চওড়া করলো,
" তাতে তোর কি? ওর সাথে প্রেম করলে তোর সমস্যা কোথায়? এতো গার্লফ্রেন্ডের মতো বিহেইভ করছিস কেনো?"
সাদ ভ্রু কুঁচকালো। বললো,
" আমার সমস্যা একটা জায়গাতেই। নীলু আপু তোমার সাথে প্রেম করছে কি করে! আপুর রুচি এমন খারাপ হয়ে গেলো!"
এ কথা শোনা মাত্রই সাদের পিঠে দুমদাম দুটো কিল বসলো। ব্যাথায় গোঙানি দিয়ে আবারও পূর্বের ন্যায় জোর গলায় বললো,
" দেখো ভাইয়া! তোমাকে সাবধান করছি। ডিটেইলস না জানালে এসব কিছু কিন্তু মা'র কানে চলে যাবে। মা তো শুনেই বেহুঁশ হয়ে যাবে যে তার চির জন্মের শত্রু ইমাদ ফুপার মেয়ের সাথে তুমি প্রেম করছো!"
স্মরণ এবার স্তিমিত হলো। ব্যবহার আগের তুলনায় নম্র করলো। কণ্ঠে খানিক অনুনয় মিশিয়ে বললো,
" মা কে বলিস না সাদ। এবার ঈদে গিয়ে মা'সহ সবাইকে জানাবো আমাদের কথা।"
সাদ এবার বাঁকা হাসলো। মনে মনে আওড়ালো,
'এইবার বাগে পেয়েছি তোমাকে।'
সাদ এবার বললো,
" আচ্ছা বলবো না। তবে আমার একটা শর্ত আছে। "
স্মরণ সন্দিগ্ধ গলায় শুধালো,
" কি শর্ত? যদি উল্টাপাল্টা ডিমান্ড করেছিস তো এখানেই তোকে পুঁতে ফেলবো।"
সাদ ভ্রু নাচালো। বিস্তৃত বাঁকা হেসে বললো............
.
.
.
চলবে.......................................................................