বাইরে কালবৈশাখীর রুদ্র তাণ্ডব। ঝোড়ো হাওয়ার শিস, মেঘের গর্জন, আর প্রকৃতির প্রচণ্ড শক্তির উন্মাদনায় পুরো শহর কাঁপছে। রাতের বৃষ্টি থেমে গেলেও শেষ রাতে ঝড়ের তীব্রতা বেড়েছে আরও কয়েকগুণ। প্রবল বাতাসে কাঁপতে থাকা গাছপালার শাঁ শাঁ শব্দে বারবার ছুটে যাচ্ছিল গুলনূরের ঘুম।
হঠাৎ সমস্ত শব্দ ছাপিয়ে গভীর অন্ধকারের বুক চিরে ভেসে আসে গোঙানোর শব্দ। ভারী, চাপা, তবু স্পষ্ট। থেমে থেমে কেউ ডাকছে, মা... মা...
গুলনূরের বুকের ভেতর একটা শীতল শিরশিরে স্রোত বয়ে যায়। শব্দটা জাওয়াদের ঘর থেকে আসছে। অজানা আশঙ্কায় পায়ের কাছে রাখা ওড়নাটা টেনে নিয়ে মাথায় আলগোছে ঘোমটা টেনে ধীরে ধীরে এগিয়ে যায় দরজার দিকে।
জাওয়াদ সবসময় দরজাটা হালকা চাপিয়ে রাখে, যেন গুলনূর রাতের আঁধারে ভয় পেলে চুপিসারে চলে আসতে পারে।
পা টিপে টিপে ঘরের ভেতরে ঢুকে হারিকেন জ্বালানোর জন্য চিমনিটা খুলে কাঁপা হাতে। হারিকেন জ্বালিয়ে আলো ফেলতেই দেখে, জাওয়াদ বিছানার এক কোণে কুঁকড়ে পড়ে আছে। শরীরটা একটানা ধুকপুক করছে। ঠোঁটের ফাঁক দিয়ে ভেসে আসছে গোঙানোর শব্দ, নিঃশ্বাস ভারী।
আতঙ্কিত গুলনূর কাছে গিয়ে দাঁড়ায়। এক মুহূর্ত ইতস্তত করে হাত বাড়িয়ে কপাল স্পর্শ করতেই শিউরে ওঠে। শরীর জ্বালামুখী আগুনের মতো তপ্ত!
ভয়, দ্বিধা ভুলে দ্রুত ছুটে যায় নিজের ঘরে। কোণের হাঁড়ি থেকে এক টুকরো পরিষ্কার কাপড় ভিজিয়ে তৎক্ষণাৎ ফিরে আসে।
সতর্ক হাতে ভেজা কাপড়টা জাওয়াদের কপালে রাখে, তারপর আলতো করে ঘাড়ে ছোঁয়ায়, যেন জ্বরের উত্তাপ কিছুটা প্রশমিত হয়। বিছানার কোণায় পড়ে থাকা পাতলা চাদরটা তুলে এনে ঢেকে দেয় তার জীর্ণ শরীর।
একসময় ঝড় থেমে যায়। ভোরের প্রথম আলো ফোটার আগে জাওয়াদ ধীরে ধীরে চোখ খুললেও বাস্তব আর স্বপ্নের সীমানা তখনও তার মনের গভীরে মিলেমিশে একাকার। সে অনুভব করে, কোনো দূরদেশের রক্তাক্ত যুদ্ধক্ষেত্রে পড়ে ছিল আহত, নিঃশেষিত, বিধ্বস্ত অবস্থায়। সেখান থেকে কেউ তাকে তুলে নিয়ে এসেছে।
চোখ মেলে দেখে, এক রাজকুমারীকে!
হারিকেনের ক্ষীণ আলোয় স্বপ্নের মতো বসে আছে সে...মায়াময়, অনিন্দ্যসুন্দর! ছোট সিঁথি করা লম্বা চুল, কালো মখমলের মতো গভীর চোখ, তুলির আঁচড়ে গড়া নিখুঁত মুখশ্রী। তার ত্বকের আভায় জ্যোৎস্নার কোমলতা মিশে আছে, আর চোখের দৃষ্টিতে ঝিলমিল করছে দূর সমুদ্রের আহ্বান।
জাওয়াদ নিঃশব্দে চেয়ে থাকে। শরীর অবসন্ন, কিন্তু চোখ তার বিশ্রাম নিতে রাজি নয়।
“তুমি এলে?”
ঠোঁটের কোণে অস্ফুট ফিসফিস।
গুলনূর সাবধানে কপালে জলপট্টি চেপে ধরে। তার নরম আঙুলের স্পর্শে জাওয়াদ যেন চন্দন-মেহগনির মৃদু সুগন্ধ পায়। একটা ঘোর তাকে গ্রাস করে নেয়।
সে হাত বাড়ায়, গুলনূরের মুখ ছুঁতে চায়। আঙুলগুলো অর্ধেক পথ পেরোতেই হঠাৎ গুলনূর সরে যায়।
জাওয়াদের চোখ কুয়াশার মতো ঝাপসা হয়ে আসে। আহত শিশুর মতো তাকিয়ে থাকে সে। কেন সরে গেল রাজকুমারী? নাকি তার গায়ে কোনো অদৃশ্য অভিশাপ লেগে আছে?
জাওয়াদ ধীরে ধীরে উঠে বসার চেষ্টা করে। শরীর দুর্বল। মাথাটা ঘুরে ওঠে, তবুও সে কোনোমতে ফিসফিস করে,
“কি হলো?... কি হলো?”
গুলনূর পিছু হটে, পাশের ঘরের দরজার দিকে ছুটে যায়। ক্ষীণ আলোয় শুধু তার ছায়াটা দুলে ওঠে, তারপর মিলিয়ে যায় অন্ধকারে।
বাইরে দুপুর গড়িয়ে এলেও সূর্যের সোনালি আভা মেঘের মখমল চাদরে লুকিয়ে আছে। এদিকে ঘরের ভেতর অবচেতনের মতো ঘুমাচ্ছে জাওয়াদ। হঠাৎ দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ হতেই তার চেতনা ফিরে আসতে থাকে।
চোখের পাতার নিচে টনটনে ব্যথা, মাথার ভেতর একধরনের অসহ্য যন্ত্রণা। উঠে বসার চেষ্টা করতেই টের পায়, দমে আসা ক্লান্তি আচ্ছন্ন করে রেখেছে পুরো শরীর। তবু এক হাতে বিছানার কিনারা ধরে কোনোমতে ভারসাম্য রক্ষা করে।
ঢিলেঢালা ফতুয়ার বোতাম ঠিক করতে করতে টলমল পায়ে এগিয়ে যায় দরজার দিকে।
কপাট খুলে সামনের মানুষটিকে দেখে বিস্ময়ে স্থবির হয়ে যায়। মুহূর্তে কত স্মৃতি, কত বছর পেরিয়ে আসে চোখের সামনে। চোখ কচলে আবার তাকায়। তিনি কি সত্যিই এখানে? এত বছর পর? ঠোঁটের কোণ থেকে অস্ফুট স্বর বেরিয়ে আসে,
“দাদিজান!”
দরজার সামনে মহিমাময় ব্যক্তিত্ব নিয়ে মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়িয়ে আছেন কোহিনূর। জাওয়াদকে এক নজর দেখেই বুঝে গেলেন, ছেলেটা ভালো নেই। রক্তহীন মুখ, অনুজ্জ্বল চোখের লালচে আভা, ক্লান্ত শরীর।
সঙ্গে সঙ্গে উদ্বেগে এগিয়ে এসে স্নেহভরে কপালে হাত রাখলেন। উৎকণ্ঠাভরে জিজ্ঞাসা করলেন, “দাদুভাই, শরীর খারাপ? কী হয়েছে? চোখ ওমন লাল দেখাচ্ছে কেন?”
পিছনে দ্রুত তাকিয়ে অস্থির স্বরে ডাকলেন, “এই আসাদ, আশেপাশে কোনো ডাক্তার আছে কি না দেখ!”
জাওয়াদ হতভম্ব হয়ে চেয়ে রইল।
আসাদ বাইরে বেরিয়ে যেতে উদ্যত হতেই সে দ্রুত হাত বাড়িয়ে থামিয়ে দিল, “না, কোথাও যাবে না। দাদিজান, অস্থির হবেন না। জ্বর ছিল, এখন ঠিক আছি।”
কোহিনূরের চোখের গভীর অনুসন্ধান থামল না। অভিজ্ঞ দৃষ্টিতে তিনি খুঁজে যাচ্ছেন সত্যের চিহ্ন। মায়ায় ভরা হাতে জাওয়াদের মুখ ছুঁয়ে নিজের উদ্বেগ সংবরণ করলেন। মনের ভেতর দুশ্চিন্তার ঢেউ উঠলেও মুহূর্তেই প্রশমিত করে নিলেন অভিজ্ঞতার সংযমে। নরম স্বরে বললেন, “জ্বর বাঁধল কী করে?”
জাওয়াদ মাথা নিচু করে সামান্য অপরাধবোধ নিয়ে বলল, “গতকাল বৃষ্টিতে ভিজেছিলাম… তাই হয়তো। বাইরে দাঁড়িয়ে থাকবেন না দাদিজান। ভেতরে আসুন।”
দ্রুত দরজা ছেড়ে সরে দাঁড়াল জাওয়াদ। কোহিনূর ধীর পায়ে ভেতরে এসে একপাশে রাখা চেয়ারে বসলেন। চারপাশ খুঁটিয়ে দেখে স্বগতোক্তির মতো বললেন, “তাহলে এটাই তোর নতুন ঠিকানা।”
জাওয়াদ হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়িয়ে বিছানার এক পাশে বসল। বাবা-মা কি দাদিজানকে পাঠিয়েছেন? নাকি তিনি নিজেই এসেছেন? এত বছর পর হঠাৎ? আর এই ঠিকানাই বা কী করে পেলেন?
জাওয়াদকে উদাসীন দেখে কোহিনূর বললেন, “তোর মায়ের কথাতেই এসেছি, কিন্তু তোকে ফিরিয়ে নিতে নয়। বড় হয়েছিস, যা ভালো মনে হয়, তাই করবি। ছোট্ট খোকনটা আর কই?”
কোহিনূরের অভিমানী স্বর টের পেয়ে জাওয়াদ চুপচাপ বসে রইল। তার পক্ষে সম্ভব নয়, বাড়ি ছেড়ে আসার সত্য উচ্চারণ করা।
কোহিনূর কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললেন, “তোকে দেখতে ইচ্ছে করছিল। কিছুদিন যাবৎ স্বপ্নে তোর দাদা আসে, আমাকে ডাকে, কোথাও নিয়ে যেতে চায়... বোধহয় মরণের সময় এসে গেছে।”
এই কথায় জাওয়াদের মন ভিজে উঠল। সে বলল, “এসব ভাববেন না দাদিজান। আপনি ছাড়া আমাদের কে আছে? ওসব দুঃস্বপ্ন, আর কিছু না।”
পাশের ঘর থেকে ধীরপায়ে বেরিয়ে আসে গুলনূর। তার দু’হাত সামান্য সামনের দিকে বাড়ানো, আঙুলের ফাঁকে ভারসাম্য রক্ষা করে রাখা একখানা ট্রে। তাতে ধোঁয়া ওঠা এক বাটি সুগন্ধী লেবুপাতা দেওয়া গরম স্যুপ, পাশে মধুর শিশি, আর তুলসীপাতার সতেজ রস।
জাওয়াদ ও কোহিনূর দুজনেই একসঙ্গে তাকায় তার দিকে।
চোখাচোখি হতেই মুহূর্তের জন্য স্তব্ধ হয়ে যায় জাওয়াদ। রাতের অস্পষ্ট স্মৃতিগুলো মনের গহীনে ঢেউ তুলে ফিরে আসে।
হারিকেনের নরম আলো ছুঁয়ে ছিল এক রাজকুমারীর মুখ। যার গভীর দুটি চোখের দৃষ্টি তার দগ্ধ দেহে একটুখানি প্রশান্তির ছোঁয়া এনে দিয়েছিল।
উষ্ণ, আশ্বাসবাণী হয়ে আসা হাতের স্পর্শ কপালের ওপর পড়তেই মনে হয়েছিল, সব জ্বালাপোড়া প্রশমিত হয়ে গেছে।
জাওয়াদ অপলক তাকিয়ে রইল। দৃশ্যটি সত্যি ঘটেছিল নাকি স্বপ্ন ছিল? কারো স্পর্শে শরীরের জ্বালাপোড়া কমে?
সুতীক্ষ্ণ তলোয়ারের মতো দৃষ্টি নিয়ে গুলনূরকে আপাদমস্তক নিরীক্ষণ করছেন কোহিনূর। তারপর সোজাসুজি জাওয়াদের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন,
“তোরা কি বিয়ে করেছিস?”
প্রশ্নটা বজ্রপাতের মতো পড়ল ঘরের নিস্তব্ধ বাতাসে।
জাওয়াদ চমকে ওঠে। এমন প্রশ্ন সে আশা করেনি। গুলনূরের প্রতিক্রিয়াও একই। সে সামান্য সঙ্কুচিত হয়ে চোখ নামিয়ে নিয়েছে।
জাওয়াদ বিস্মিত গলায় বলল, “তেমন কিছু না দাদিজান!”
কোহিনূর ঠাণ্ডা গলায় বললেন,
“তেমন কিছু না কেমন কিছু সেটা জানতে চাইনি! বিয়ে করেছিস কি করিসনি? হ্যাঁ অথবা না বল।”
গলার তীক্ষ্ণতা মুহূর্তেই পরিবেশের তাপমাত্রা কয়েক ডিগ্রি কমিয়ে দিল।
জাওয়াদ থতমত খেয়ে বলল, “না।”
কোহিনূরের চোখদুটো সংকীর্ণ হয়ে আসে। ঠোঁট কেঁপে উঠে ঘৃণায়।
“বিয়ে ছাড়া একটা যুবতী মেয়েকে নিয়ে একই ছাদের নিচে...!”
ঘৃণায় বুজে আসে গলা। চেয়ারের পায়ায় লাথি দিয়ে মুহূর্তেই উঠে দাঁড়ান।
“দাদিজান!” জাওয়াদ দ্রুত তার সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। “আপনি ভুল বুঝছেন! মা আপনাকে যা বলেছে, তাই সত্য নয়!”
কোহিনূর স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন কিছুক্ষণ।
তারপর দ্রুত চোখ সরিয়ে বলে উঠলেন, “আসাদ!”
ঘরের দরজার কাছে দাঁড়িয়ে থাকা আসাদ সাড়া দিল, “জ্বি, দাদিজান।”
“কাজী নিয়ে আয়। রাস্তায় যাকে পাবি, তাকেই স্বাক্ষী বানিয়ে নিয়ে আসবি। আজই এ দুটো নাফরমানকে বিয়ে দেব আমি।”
গুলনূরের হাতের ট্রে হেলে যায়। সে দ্রুত সামলে নেয় সেটা।
জাওয়াদ বিস্ময় নিয়ে বলল, “দাদিজান, আপনি কী বলছেন?”
“যা বলেছি, তাই করব।”
আসাদ ঘুরে দাঁড়াতেই জাওয়াদ শক্ত গলায় বলল, “দাঁড়াও! কোথাও যাবে না!”
কোহিনূর কঠিন কণ্ঠে বললেন,
“তুই যা, আসাদ!”
আসাদ এবার সত্যিই দরজার দিকে পা বাড়াল।
জাওয়াদ তার কাঁধ চেপে ধরে বলল,
“দাঁড়াও বললাম! কোথাও যাবে না! আগে আমার কথা শুনুন দাদিজান!”
কোহিনূর কঠোর দৃষ্টিতে তাকালেন, “এক ছাদের নিচে এতদিন ধরে আছিস, অথচ বিয়ে করিসনি! ধর্মে সইবে? এটা কী অনাচার নয়? আমার বাবার বংশধর এমন কলঙ্ক নিয়ে বাঁচবে, তা আমি হতে দেব না! তোদের আজই শুদ্ধ করব! আসাদ, যা!”
“তুমি যাবে না বলছি!”
আসাদ দরজা পর্যন্ত গিয়ে থমকে দাঁড়ায়। দ্বিধাগ্রস্ত দৃষ্টিতে তাকায় দাদি-নাতির দিকে।
কোহিনূরের চোখে একচুল নড়চড় নেই। তার শিরা-উপশিরায় রক্ত টগবগ করছে। সাদা বালিশের কভারে যে লম্বা কালো চুল তিনি দেখেছেন, সেটা নিশ্চয়ই ওই মেয়ের। ছি! তার রক্ত এমন অধর্ম করবে! ভুঁইয়া ঘর পাপের আস্তানা হবে?
জাওয়াদ ধীর কণ্ঠে বলল, “জেদ করবেন না, দাদিজান।”
কোহিনূর টলে গেলেন না।
“আসাদ, বলেছি যা! এক মুহূর্ত দেরি করবি না!”
আসাদ এবারও পা বাড়াল, কিন্তু জাওয়াদের ধমক তাকে আবার থামিয়ে দিল। এভাবে কয়েকবার থেমে যাওয়ার পর আসাদ হাঁপিয়ে উঠে মেঝেতে বসে পড়ে।
জাওয়াদ শান্ত কণ্ঠে বোঝানোর চেষ্টা করল, “এভাবে কারও পবিত্রতা নির্ধারণ করা যায় না, দাদিজান। আপনি আমার বিচার করছেন, অথচ সত্য জানেন না।”
কোহিনূরের কপালে গভীর ভাঁজ পড়ে। সত্য? আর কী সত্য আছে এখানে? ধর্ম যা স্পষ্টভাবে নিষেধ করেছে, তা কীভাবে অগ্রাহ্য করবেন? অবিবাহিত যুবক-যুবতী এক ছাদের নিচে বসবাস করবে, এটাই তো অনুচিত! এমন সম্পর্ক তো পাপ ছাড়া কিছু নয়! ওরা তো এতদিন বিয়ে ছাড়াই একসঙ্গে ছিল। একজন আরেকজনকে স্পর্শ করেনি, এই নিশ্চয়তা কে দেবে? মানুষের মন তো দুর্বল, শয়তানের ধোঁকা বড়ই প্রবল!
১৯৮৬ সাল।
রাত বারোটার বেশি। শহরের বাতাসে ধুলো মিশে ঠান্ডা আরও চেপে বসেছে। রাস্তার ল্যাম্পপোস্টগুলো আলো ফিকে, নিভে যাওয়ার অপেক্ষায়। একটি বারের সামনে দাঁড়িয়ে একের পর এক সিগারেট টেনে চলেছে কামাল।
আচমকা খেয়াল করল, বারের সামনের রেলিংয়ে একটা ছায়ামূর্তি দাঁড়িয়ে আছে। কালো স্যুট-কোট, মাথায় হ্যাট, রাতেরবেলা চোখে ডার্ক শেডস। হাতে সিগারেট। শহরের ব্যস্ত রাতের ভিড়ে এ ধরনের পোশাক একটু বেশি শৃঙ্খলাবদ্ধ। মনে হচ্ছে কোনো প্রভাবশালী মানুষ, হয়তো বিদেশফেরত ব্যবসায়ী বা হয়তো আরও গভীর, আরও অন্ধকার কোনো কিছু।
লোকটা ধোঁয়া ছাড়ল, তারপর ধীর পায়ে এগিয়ে এল। সোজাসুজি চোখে তাকিয়ে বলল,
“কামাল?”
কামাল সোজা হয়ে দাঁড়াল। এই লোক তার নাম জানে? কীভাবে?
সে দ্রুত লোকটাকে পরখ করল। এই পোশাক, এই আত্মবিশ্বাস, এই কণ্ঠস্বর সব নতুন, অথচ কোথাও যেন দেখেছে। কিন্তু ঠিক মনে করতে পারছে না।
“আপনি কে?”
লোকটা হাসল। বলল, “কেউ একজন। তোমাকে আমার দরকার। তুমি আমাকে পথ দেখাবে।”
কামাল এবার পুরো মনোযোগ দিল। এই শহরে কেউ কাউকে এমনি এমনি খোঁজে না। এই ধরনের মানুষের আগ্রহের পেছনে কারণ থাকে।
“আমি কি পথ দেখানোর লোক?”
লোকটা মাথা একটু কাত করল। তারপর বলল, “নাহ। আমি ঠিক পথ দেখানোর লোক খুঁজছি না। আমি পার্টনার খুঁজছি।”
কামালের ভ্রু কুঁচকে গেল।
“কিসের পার্টনার?”
“আমাদের ভাষায় বললে… দামী জিনিস এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় পাঠাই।”
কামাল যেহেতু মাদক ব্যবসার সঙ্গে জড়িত তাই সে আন্দাজে বলল, “বৈধ নাকি অবৈধ? এতো রাতে নিশ্চয়ই...”
লোকটা কথার মাঝেই হাসল।
“এখানে কথা বলা নিরাপদ না। কাছেই একটা জায়গা আছে, সেখানেই চলো। নিজে দেখে নিতে পারবে, তারপর সিদ্ধান্ত তোমার।”
কামাল চুপ রইল। মনের মধ্যে হিসাব কষল। এই লোক কে? এটা কি ফাঁদ, নাকি সত্যিই বড় কোনো সুযোগ?
এই শহরে তার শত্রুর অভাব নেই। প্রতিদ্বন্দ্বী আছে, আছে বিশ্বাসঘাতকতা, কিন্তু সে এমন কোনো খেলোয়াড় নয় যার ওপর কেউ এত সহজে চাল চালতে পারে। তাছাড়া, ইদানীং ব্যবসার অবস্থা ভালো যাচ্ছে না। নতুন সুযোগ দরকার।
কিন্তু অচেনা কাউকে বিশ্বাস করা?
লোকটা শান্তভাবে অপেক্ষা করছে, যেন নিশ্চিত যে কামাল রাজি হবেই।
আর ঠিক সেই কারণেই কামাল শেষবার সিগারেটে লম্বা টান দিল, ধোঁয়া ছেড়ে বলল,
“ঠিক আছে। আমি দেখব।”
দুজন একটা গলির সামনে এসে দাঁড়াল। কামাল খানিকটা ইতস্তত করল।
লোকটা তখনও নির্বিকার ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে।
“চলো, কাছেই।”
কামাল আবারও এক কদম এগোল, কিন্তু কেমন একটা অস্বস্তি হচ্ছে মনে।
একজন সম্পূর্ণ অচেনা লোকের সঙ্গে এভাবে অজানা গলির ভেতর ঢুকে যাওয়া কি সত্যিই বুদ্ধিমানের কাজ?
সে থেমে গেল।
কামাল এই অন্ধকার জগতের নিয়মকানুন ভালোই বুঝে। রাতের জনশূন্য গলিতে এভাবে কাউকে ডাকা কখনোই সাধারণ ব্যাপার নয়।
সে ধীরে ধীরে একপাশে সরে দাঁড়াল, চোখ সরু করে লোকটাকে পর্যবেক্ষণ করল। তারপর নির্লিপ্তভাবে কোমরে হাত রেখে পিস্তল বের করল, ঠান্ডা গলায় বলল, “আমি কি বাচ্চা ছেলে যে হুট করে অচেনা কেউ এসে বলবে আর তার সঙ্গে চলে যাব?”
লোকটা এবার হেসে ফেলল। তবে সেই হাসিতে কোনো বিস্ময় বা অস্বস্তি নেই।
“ভেবেছো তুমি খুব স্মার্ট, তাই না?”
কামাল ঠোঁটের কোণে হালকা হাসি টেনে বলল, “স্মার্ট না হলে এই শহরে টিকে থাকা যায় না।”
লোকটা মাথা ঝাঁকাল। সে কামালের কথার সঙ্গে একমত।
“ঠিক বলেছো। যাও, তুমি যদি মনে করো এটা ফাঁদ, তাহলে ফিরতে পারো।”
এত সহজে ছেড়ে দিল? কামাল খানিকটা অবাক হলো। নাকি সে অহেতুক সন্দেহ করছে?
সে পকেট থেকে একটা কার্ড মাটিতে ফেলে বলল, “যদি সত্যিই আমার সঙ্গ চান এই ঠিকানায় চলে আসবেন।”
এই বলে সে ঘুরে দাঁড়াল।
আর ঠিক তখনই—
ধপ!
বিস্ফোরণের মতো ব্যথা মাথার পেছন থেকে ছড়িয়ে পড়ল!
সব কিছু দুলে উঠল। চারপাশের আলো ধীরে ধীরে অন্ধকারে মিশে যাচ্ছে। পায়ের নিচের মাটিটা যেন সরে যাচ্ছে।
জ্ঞান হারানোর আগ মুহূর্তে, অন্ধকারের মাঝেও সে এক ঝলক দেখতে পেল একটা চেনা মুখ।
সকালে রাজধানীর এক পরিত্যক্ত গুদামের সামনে ভিড় জমেছে। পুলিশের গাড়ি দাঁড়িয়ে, কয়েকজন সাংবাদিক দ্রুত ছবি তুলছে। সাধারণ কৌতূহলী মানুষও জড়ো হয়েছে।
মাটিতে পড়ে আছে একটা ছিন্নভিন্ন দেহ।
মুখ বিকৃত, শরীর ক্ষতবিক্ষত। এক চোখ ফাঁকা, অন্যটা স্থির হয়ে আকাশের দিকে চেয়ে আছে। শরীরের কিছু অংশ পোড়া, চামড়ার জায়গায় দগদগে ঘা।
মৃত্যুর আগে লোকটাকে ভয়ংকর কষ্ট দেওয়া হয়েছে।
পুলিশ অফিসার মনসুর পাশের কনস্টেবলকে বলল,
“পরিচয় জানা গেছে?”
কনস্টেবল মাথা নাড়ল।
“এখনো না।”
.
.
.
চলবে.........................................................................