চারপাশে কোলাহল শোনা যাচ্ছে। বিল্ডিংটায় কোনো অদ্ভুত মানবের প্রবেশ ঘটেছে। গেইটের তালা ভেঙে, দরজার লক ভেঙে, ছিটকানির অবস্থা দফারফা করে সে অন্দরে প্রবেশ করেছে। প্রচন্ড আওয়াজে অনন্যা ধড়মড় করে উঠে বসল। সাথে নোহারাও উঠে বসেছে। বাহির থেকে কয়েক জনের চিৎকার চেঁচামেচির তীব্র আওয়াজ কানে আসছে। অনন্যার গলা শুকিয়ে গেল। সে কি করবে বুঝে পেলো না। নোহারার হাত চেপে ধরলো, লজ্জা পাবে নাকি উঠে তার সামনে চলে যাবে, এই সময়টাতে কিছুই মাথায় ঢুকছে না।
দরজার বাহিরে কিছু দূরে অনন্যার মামার গলা শোনা যাচ্ছে, তিনি চিৎকার চেঁচামেচি করছেন, বলছেন,
"এই ছেলে! দরজা ভাঙছো কেন? কী হচ্ছেটা কী? কি করতে চাইছো আসলে? অনন্যাকে নিতে আসলে ওই রুমে যাও।"
মামী রাগে কাঁপতে কাঁপতে মামার উদ্দেশ্যে বললেন,
" তুমি কী পাগল? ঈরাও আছে সাথে।"
অতঃপর সামনের যুবকের কান্ড দেখে চেঁচিয়ে উঠলেন মামী,
"বিদেশি ছোকরা! মাথা ঠিক আছে তোমার? রাতবিরেতে এভাবে ঘরে ঢুকো না! মেয়েরা ঘুমাচ্ছে ঘুমাতে দাও।"
যুবকটি কারও কথায় কর্ণপাত করল না। ব্ল্যাক শ্যু পরিহিত যুবক ঠক ঠক আওয়াজ করে কঠিন পায়ে অনন্যাদের রুমের দিকে এগিয়ে গেলো। চোখে মুখের ভঙ্গি শান্ত, কিন্তু তার কর্মকাণ্ড নয়। দরজার নব শক্ত করে চেপে ধরল যুবকটি, ধাতব অংশটা তার আঙুলের চাপে কিঞ্চিৎ বাঁকলো। মুহূর্তের মধ্যেই লক খুলে গেল। পায়ের এক ধাক্কায় দরজাও ফটাস করে খুলে গেল।
অনন্যা ততক্ষণে উঠে দাঁড়িয়েছে। আলো আঁধারের মাঝে দাঁড়িয়ে থাকা যুবকটিকে আজ খুব অচেনা লাগছে। নোহারা হাত বাড়িয়ে দ্রুত সুইচ টিপল। হলুদাভ আলোয় উদ্ভাসিত হলো রুম। অনন্যার বিস্মিত দৃষ্টি আটকে গেলো দরজার পানে দাঁড়িয়ে থাকা যুবকটির দিকে। একদম স্যুট বুট পড়ে এসেছে স্যার। অনন্যা কিছু উচ্চারণ করতে যাবে তখনি তড়িৎ গতিতে এগিয়ে গেলো কৌশিক।
রুমের দরজার সামনে ইতিমধ্যেই ভিড় জমে গেছে। কোলাহল বাড়ছে, ওপর তলা থেকেও লোকজন ছুটে আসছে।কৌশিক থেমে গেল অনন্যার সামনে। ধীরে নিচু হলো।
অতঃপর এক ঝটকায় অনন্যাকে কাঁধে তুলে নিল! অনন্যা হতচকিত হয়ে উঠলো ।
চিৎকার করলো,
"কি করছেন, স্যার?"
কৌশিক নির্লিপ্ত গলায় বললো,
"এনাফ টাইম দিয়েছি। ইউস করোনি। আমার অপেক্ষায় ছিলে? আমি কি কি করতে পারি দেখার জন্য বসে ছিলে? নাও দেখো।"
অনন্যার মুখ হা হয়ে গেলো। এতটা ভাবেনি সে! সত্যিই স্যার চলে আসবে! এতো রাতে? কিন্তু এখন এসব ভাবার সময় নেই! নিজেকে ছাড়িয়ে নিতে অনন্যা মরিয়া হয়ে উঠল। আশেপাশের সবাই কীভাবে তাকিয়ে আছে, তা দেখেই অনন্যার মাথা হেঁট হয়ে যাচ্ছে। কৌশিকের শক্ত , চওড়া কাঁধে ঘুষি বসিয়ে চিৎকার করল,
"স্যার! নামান! ভুল হয়েছে আমার!"
কিন্তু কৌশিক থামল না। বরং গলায় ঝাঁঝ তুলে বলল,
"শাট ইউর মাউথ!"
অনন্যা থতমত খেয়ে চুপ হয়ে গেলো। কৌশিক ওকে সেভাবেই বয়ে নিয়ে দরজার দিকে এগোল, আর সবাই নিঃশব্দে সরে গিয়ে জায়গা করে দিলো।
চেঁচামেচির শব্দে ঈরাও উঠে বসেছে। চোখ কচলাতে কচলাতে দরজার দিকে তাকিয়ে ছিল, তখনই নোহারা তার হাত চেপে ধরে বলল,
"ইয়ে সাব ক্যায়া দেখনা পার রাহা হে? হাম সিঙ্গেল লোগ হে!"
ঈরা চোখ কুঁচকে ঠোঁট বাঁকিয়ে বলল,
"আচ্ছা হুয়া মে আন্ধা নেহি হু!"
নোহারা ঈরার দিকে প্রশ্নসূচক দৃষ্টিতে তাকাল। ঈরার ঠোঁটের কোণে দুষ্টুমি ফুটে উঠলো, সে নোহারাকে ঝাঁকিয়ে বললো,
"ইশশ! আমারও বিয়ে করতে ইচ্ছে করছে, নোহা ভাবী। আমিও চাই, কেউ সবার সামনে আমাকে এভাবে তুলে নিয়ে যাক!"
নোহারা উঠে ঈরার কাঁধ চেপে ধরে বললো,
"বোন, কৌশিক স্যারের মতো ব্যাডা এক পিস! সত্যি বলতে আমার ও বিয়ে করতে ইচ্ছে করতাছে। অ্যাএএএ!"
নোহারা ঈরার গলা জড়িয়ে ধরলো। দুজনেই লজ্জায় লুটোপুটি খাচ্ছে।
কৌশিক অনন্যাকে নিয়ে বাইরে বের হতেই সবাই গোল হয়ে চারপাশে ভীড় জমিয়েছে। সকলের চোখেমুখে কৌতূহল, ফিসফাস চলছে থেমে থেমে। চারপাশের অবস্থা দেখে কৌশিক চিন্তায় পড়ে গেলো। তারপর কঠোর গলায় বলে উঠল,
"শিকদার, এতো মানুষ কেনো? "
অনন্যা এতক্ষণ ধরে রাগ চেপে রেখেছিল। এবার আর পারল না! কৌশিকের পিঠে জোরে এক থাপ্পড় বসিয়ে বলল,
"আপনিই জড়ো করিয়েছেন! বেশরম লোক! নামান আমাকে।"
"বেশরমির কিছুই দেখায়নি। এই ভরা লোকজনের মাঝেই কত কিছু করতে পারি। বাট..! আহ, ফরগেট ইট!"
কৌশিক ধীর নিঃশ্বাস নিলো। চোখ দ্রুত গতিতে বন্ধ করল সে, তারপর ডান হাত বাড়িয়ে বাতাসে এক প্রবল শক্তি সৃষ্টি করল। হাত নাড়াতেই সেই শক্তির ঢেউ ছড়িয়ে গেল চারপাশে।
কোনো শব্দ নেই, শুধু হালকা বাতাসের স্রোত হুড়মুড়িয়ে ছড়িয়ে পড়েছে চারপাশে। কিন্তু বাতাসের ধাক্কায় আশেপাশের সবাই চমকে উঠে, পায়ের নিচে থরথর করে কেঁপে উঠে মাটি। ঘড়ির সেকেন্ডের কাঁটা পরের সেকেন্ডে পরতেই একে একে সবার চোখ ঘোলাটে করে দুলে উঠে। কয়েক মুহূর্ত। শুধু কয়েক মুহূর্তের মধ্যে গোটা ভিড় নিস্তেজ হয়ে যায়। অনন্যার চোখের সামনে ধপধপ করে একের পর এক শরীর মাটিতে লুটিয়ে পড়ে।
কৌশিক চারপাশ মেলে একবার তাকায়। অনন্যা এহেন পরিস্থিতিতে অবাক হয়ে পড়লো। এত মানুষ একসঙ্গে নিস্তেজ হয়ে পড়ে আছে, প্রাণ টান চলে গেল নাকি সকলের?
বুকটা হাহাকার করে উঠলো। অনন্যা চেঁচিয়ে উঠে বললো,
"সবাইকে মেরে ফেললেন?"
কৌশিক হতাশ কণ্ঠে বলে,
'আহ! মাথায় বুদ্ধি সুদ্ধি একদম নেই! ইমোশনাল ফুল!
তারপর মুখ ঘুরিয়ে হেসে বলল,
"এভাবে চলতে থাকলে আমার বউয়ের তালিকা থেকে বাদ পড়ে যাবে!"
অনন্যা হতবাক! মুখে কথা আটকিয়ে গেছে। কৌশিক আর সময় দিল না। মুহূর্তের মধ্যে ঝড়ের গতিতে ওকে নিয়ে বাইরে বেরিয়ে এলো। গাড়ির দরজা খুলে অনন্যাকে ভেতরে বসিয়ে দিল। অনন্যা দিশেহারা হয়ে পেছনে তাকিয়ে রইলো। বুঝতেই পারছে না কী হচ্ছে!
তারপরই ধাতস্থ হয়ে দরজা খুলে বেরিয়ে যেতে চাইল, কিন্তু জানালা দিয়ে তাকাতেই চোখ কপালে উঠলো। চারদিক নিশ্চুপ হয়ে আছে।। কোনো কোলাহল নেই। কোনো শব্দ নেই। মনে হচ্ছে পুরো বাড়িটা জমে গেছে সময়ের এক ফ্রেমে।
মাথার ভেতর রাগের ঝাঁজ ছড়িয়ে পড়লো। কৌশিকের দিকে ঘুরে কাঁপা কাঁপা গলায় বলে উঠলো,
"আমি যাবো না! আমি এখানেই থাকবো!"
কৌশিক ঠান্ডা চোখে তাকালো, একটুও অবাক হয়নি সে। গাড়ি স্টার্ট দিল। স্টিয়ারিং একপাশে ঘোরাল। তারপর কঠোর গলায় বলল,
"দে উইল বি অ্যাস্লিপ ফর ফাইভ মিনিটস! সো, রিল্যাক্স।"
অনন্যা চোখের পলক ফেললো কয়েক বার। তারপর জানালায় তাকাতেই বাড়ির পাশে থাকা সাইকেলটার দিকে চোখ পড়লো। সে আবার বলে উঠলো,
"সাইকেলটা!"
কৌশিক বিরক্তির সঙ্গে এক দমকা শ্বাস ছাড়লো। তারপর এক হাত তুলল, দুই আঙুল দিয়ে চুটকি বাজালো। সেকেন্ডের ভগ্নাংশের মধ্যে বাড়ির পাশে রাখা সাইকেলটা হাওয়ায় ভাসতে শুরু করল! কোনো দৃশ্যমান শক্তি ছাড়াই সেটা ধীরে ধীরে উঠে এলো, নিখুঁতভাবে গিয়ে বসলো গাড়ির ছাদে! অনন্যার চোখ বিস্ময়ে আরো বড় হয়ে গেল।
সে হা করে তাকিয়ে থাকলো কয়েক সেকেন্ড। তারপর হঠাৎ চিৎকার করে উঠলো,
"আমি কি কোনো ম্যাজিকেল দুনিয়ায় বসবাস করছি? কী হচ্ছে এগুলো?"
কৌশিক একপাশে মুখ টিপে হাসলো। গাড়ির গতি একটু বাড়িয়ে দিল, তারপর ফিসফিসিয়ে বলল,
"এন্ড দিস ইজ দ্য বিগিনিং অফ দ্য স্টোরি।"
******
কৌশিকের হাত ধরে অনন্যা বাড়িতে প্রবেশ করেছে। ড্রয়িং রুম থেকে টেলিভিশনের শব্দ ভেসে আসছে। শব্দ অনন্যার কর্ণকূহরে পৌঁছাতেই সে কৌশিকের হাত ছাড়িয়ে দ্রুত এগিয়ে গেল সেখানে।
রিডো ড্রয়িং রুমের এক কোণে নিশ্চুপ হয়ে বসে ছিল , অনন্যাকে দেখে দাঁড়িয়ে পড়লো।হালকা গলায় শব্দ করে উঠল।অনন্যা হাসিমুখে তার দিকে হাত নেড়ে সামনে এগিয়ে গেল। রিডো ধীরে ধীরে নুয়ে পড়ল। কৌশিক বিষয়টা দেখে মুখ বিমূঢ় করে ফেললো, মুখ থেকে কয়েকটা ইংরেজি গালি বের করলো। কৌশিক এগিয়ে বাঘটার বড় কান ধরে হালকা টান দিলো। কণ্ঠে মৃদু শাসন নিয়ে উচ্চারণ করলো,
"মেয়ে দেখলেই তোদের লজ্জা লাগে, হু?"
নিক সোফায় গা এলিয়ে দিয়ে ইমোশনাল একটা মুভি দেখছিল। স্ক্রিনে নায়ক করুণ মুখে কিছু বলছে, আর তৎক্ষণাৎ নিকের চোখ থেকে টপটপ করে পানি গড়িয়ে পড়ছে! অনন্যা কয়েক সেকেন্ড ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো, তারপর বিরক্ত মুখে সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। নিক পাশে মাথা হেলিয়ে টেলিভিশনের দিকে মনোযোগ দেওয়ার চেষ্টা করল কিন্তু হলো না , তার হাত থেকে রিমোটটা ছিনিয়ে নিয়েছে অনন্যা। পরবর্তী মুহূর্তেই সেটা সামনের দেয়ালে ছুড়ে মারলো! নিক চোখ বড় বড় করে চিৎকার করল,
"একটু আগে রিমোটটা কিনে এনেছি! আবার ভেঙে ফেললে?"
অনন্যা এক মুহূর্ত চুপ করে তাকিয়ে রইলো, তারপর পাশের সোফা থেকে বালিশ তুলে নিকের দিকে ঝাঁপিয়ে পড়ল। নিক কিছু বুঝে ওঠার আগেই একের পর এক বালিশের আঘাতে ওলটপালট হতে লাগল।
মুখ থেকে বের হলো,
"অ্যানা! থামো। মারছো কেন?'
কৌশিক এগিয়ে এল, অনন্যার হাত চেপে ধরলো।
"অনন্যা থামো!"
কিন্তু অনন্যা থামলো না।
অনন্যা রাগান্বিত স্বরে বললো,
"এই লোকটা আমার বান্ধবীকে কিস করেছে।"
কৌশিক বিস্ময়ের সাথে নিকের দিকে তাকালো, অনন্যার হাত ছেড়ে দিলো। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,
"কি? কিস? কিস করেছে?"
"হ্যাঁ, স্যার। সাহস কত বড় উনার। একবার ভাবেন আপনি।"
"একদম! কত বড় সাহস, নিক? তুমি অনন্যা শিকদারের বান্ধবীকে কিস করতে পারো না!"
কৌশিক কটমট করে তাকিয়ে রইল।
নিক জোরালো গলায় বললো,
"হ্যাঁ কিস করেছি। তাতে কী? সামান্য কিস ই তো। আর তোমরা নিজেরা কী করো? তোমাদের জন্য তো রুম থেকে বের হওয়া যায় না।"
অনন্যা দাঁতে দাঁত চেপে নিকের টিশার্ট ধরে সামনে আনলো। উচ্চারণ করলো,
"কী বললেন?"
নিককে অনন্যার এতো কাছে দেখে কৌশিকের মাথা এলোমেলো হয়ে গেলো। সে কঠিন দৃষ্টিতে কিছু বলতে চাইলো তার আগেই অনন্যা কঠিন গলায় বললো,
"তুমি ভ্যাম্পায়ার হয়ে আমার ফ্রেন্ডের লাইফে পা রেখেছো বুঝলাম! কিন্তু ওকে ঠকানোর সাহস কি করে পেলে? ওর সাথে সব ঠিকঠাক করো। নোহারার কিছু হলে তোমাকে কিন্তু আমি ছাড়বো না বলে দিলাম।
নিক পড়েছে মহা ফ্যাসাদে। কৌশিক ভ্রু কুঞ্চিত করে তাকিয়ে আছে। পরক্ষণেই অনন্যার হাতের কব্জি ধরে নিচুতে বসে বললো,
"প্রিন্সেস। তোমার এতোটা কাছে আসার অধিকার শুধু আমার আছে।"
নিক কাশতে লাগলো। কৌশিকের উদ্ভট কথাবার্তা শুনে মুখ বিকৃত করে বললো,
"ইয়াক! ঠু ড্রামাটিক ব্যাপার স্যাপার।"
অনন্যা চোখ ফিরিয়ে কৌশিকের দিকে তাকাল। এই সুযোগে নিক দ্রুত হাতে অনন্যার থেকে নিজের টিশার্ট ছাড়ানোর চেষ্টা করল। কিন্তু কৌশিকের হাত ওর আগেই এগিয়ে গেল। একঝটকায় শক্তভাবে ধরল, তারপর নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে নিজেই টিশার্টটা ছাড়িয়ে দিল। অনন্যার হাত ধরে উপরে নিয়ে যেতে লাগলো কৌশিক।
******
রাত ১.৩০! অনন্যা বসে বসে একের পর এক হাই তুলছে। ক্লান্ত চোখ দুটো বন্ধ হয়ে আসছে ধীরে ধীরে।কৌশিক বাসার পোশাকে রুমে ঢুকলো। নিঃশব্দে এক পা এক পা করে এগিয়ে এলো অনন্যার দিকে।
অনন্যা আরেকটা লম্বা হাই তুলে বলল,
"স্যার! ঘুম এসে পড়েছে। আপনার শেষ হলে ঘুমাতে যাই আমি?"
"রাত এখনো অনেক বাকি।"
অনন্যা বিরক্ত চোখে তাকিয়ে বলল,
"রাতের বেলা আপনার ভীমরতি ধরে নাকি ভূতে কামড়ায়? মানুষ রাতে ঘুমায় আর আপনি রাতে উদ্ভট উদ্ভট কাজ করতে বেরিয়ে পড়েন!"
কৌশিক ঠোঁটের কোণে রহস্যময় হাসি ফুটিয়ে বলল,
"ঠিক ধরেছো। আজও একটা উদ্ভট কাজ করবো। আর সে কাজে তোমাকেও আমার সঙ্গে সামিল করবো।"
"উফফ! এমনিই আপনার কত রূপ দেখে ফেলেছি। আরো কী দেখা বাকি আছে?"
কৌশিক ঠান্ডা গলায় বলল,
"অবশ্যই। আমাকে সম্পূর্ণ দেখা বাকি আছে এখনো।"
অনন্যা চমকে উঠে চেঁচিয়ে উঠল, ভয়ে স্যারের দিকে তাকিয়ে বললো,
"কী! কি দেখানোর কথা বলছেন আপনি?"
"যা ভেবেছো তাই।"
কৌশিক বাঁকা হেসে অনন্যাকে কোলে তুলে নিলো। অনন্যা কৌশিকের পোশাক টান দিয়ে ধরে বললো,
"স্যার! আপনি আমার ভার্সিটির প্রফেসর!"
কৌশিক দুই পা এগিয়েছে মাত্র। অনন্যার মুখের কথা শুনে সে থেমে গেল। অনন্যার চোখের দিকে ছোট ছোট করে তাকিয়ে বললো,
"শুভ মুহূর্তে এ কথা কেন বললে?"
অনন্যা ফিক করে হেসে ফেলল। কৌশিক অনন্যাকে আরও শক্ত করে আঁকড়ে ধরে বলল,
"ভার্সিটির প্রফেসর ভার্সিটিতে। বাসায় আমি তোমার হাসবেন্ড।"
অনন্যা মুখ ফুলিয়ে তার গলা জড়িয়ে ধরলো। কৌশিক হাঁটতে হাঁটতে বলল,
"I am the darkness, you are my light.
Let's create our own world where darkness meets light."
অনন্যা ভ্রু কুঁচকে উচ্চারণ করল,
"ডার্কনেস? লাইট? কী বলছেন? আর কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন?"
কৌশিক কোনো জবাব দিল না, শুধু অনন্যাকে শক্ত ধরে এগিয়ে গেলো নিজের রুমের দিকে। নিচতলায় শুধু টেলিভিশনের ক্ষীণ আওয়াজ শোনা যাচ্ছে, তাছাড়া পুরো বাড়ি অন্ধকারে ডুবে গেছে।
রুমে ঢুকেই কৌশিক সরাসরি বাম পাশে থাকা বাথরুমের দরজা খুলে ভেতরে প্রবেশ করলো। অনন্যাকে নিয়ে এলোমেলোভাবে দাঁড় করালো আয়নার সামনে।
অনন্যার বিস্ময় এখন চরমে পৌঁছেছে। সে আশেপাশে চোখ বুলিয়ে বললো,
"তো বাথরুমে আপনি কী চমক দেখাতে চাচ্ছেন?"
কৌশিক নিজের জামাকাপড় খুলতে লাগলো। অনন্যা চোখ বড় বড় করে এক চিৎকার দিয়ে উল্টো ঘুরে দাঁড়াল।
"আপনার কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে?"
কৌশিক নিঃশব্দে হাসল, শরীরে বাথরোব জড়িয়ে নিয়ে আয়নার সামনে দাঁড়ালো, চুলে হাত বুলিয়ে বলল,
"আমি দুই বার গোসল করি। মর্নিংএ কুল বাথ নিয়েছি, নাইটে ওয়ার্ম বাথ নিবো। এজন্যই তোমাকে নিয়ে এসেছি। ইউ উইল গিভ মি ওয়ার্মথ, এস ইউ আর মাই ওয়ার্মনেস!"
অনন্যা বিরবির করে উচ্চারণ করলো,
"রাত করে এসব কী দেখতে হচ্ছে, আমাকে ধৈর্য দাও গো।"
কৌশিক অনন্যাকে এক ঝটকায় কাছে টানলো। অনন্যা থতমত খেয়ে গেল, ওর দুই হাত গিয়ে পড়লো কৌশিকের বুকে। কৌশিক কাছে এগিয়ে মেয়েটার বন্ধ চোখে গোলাপী ঠোঁট চেপে হালকা চুমু খেলো। অনন্যার দিকে বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল। অনন্যা পরিস্থিতি বুঝতে ধীরে ধীরে চোখ খুললো। স্যারের অদ্ভুত তাকানো দেখে কেমন মোহিত হয়ে পড়লো সে। হাত দিয়ে স্যারের মুখশ্রী আলতো করে ছুঁয়ে দিলো, সবকিছু কেমন স্বপ্ন স্বপ্ন মনে হতে লাগলো অনন্যার। অনন্যা স্যারের সুন্দর সিল্কি চুলগুলো ছুঁয়ে দিলো, চুল নিয়ে খেলতে লাগল সে।
কৌশিক মৃদু হাসলো। অনন্যার হাত মুঠোয় ধরে ঠোঁটের সামনে নিয়ে স্পর্শ বসালো সে হাতে। নিজের পাঁচ আঙুল দিয়ে হাতের মুঠো পেঁচিয়ে ধরলো। দ্রুতগতিতে শ্বাস প্রশ্বাসের আদান প্রদান হচ্ছে দুজনের। মনকাড়া সুঘ্রাণ ছড়িয়ে পড়েছে চারপাশ।
কৌশিক ফিসফিস করে বললো,
"প্রিন্সেস! মানুষ কি সত্যিই ভালোবাসতে জানে?"
"হুম!"
কৌশিক মোয়ময়ী চোখে তাকিয়ে ফিসফিস করে বললো,
"তুমি আমাকে ভালোবাসবে?"
অনন্যা মৃদু হাসলো, তার চোখের তারায় এক রহস্যময় আভা ঝিলিক দিলো।
"বাসবো যদি মন চায়।"
কৌশিক অনুনয়ের সুরে বললো,
"প্লিজ, কিপ লাভিং মি টিল ডেথ।"
অনন্যা চোখ বড় করে চাইলো। কৌশিক অনন্যার গালে হাত রাখলো পরম আদরে। স্যারের আকাশি মণির চোখ দুটো ছলছল করছে। অনন্যা স্যারকে কখনো কান্না করতে দেখে নি। হঠাৎ লোকটার কী হলো তাহলে?
কৌশিক আবারো উচ্চারণ করলো,
"এই পৃথিবীতে আমার ধ্বংস হওয়ার আগ মূহুর্ত পর্যন্ত তোমাকে পাশে চাই। থাকতে চাও?"
"আপনি ধ্বংস কেনো হবেন?"
অনন্যার কণ্ঠস্বর কেঁপে কেঁপে উঠলো।
কৌশিক দুদিকে মাথা নাড়িয়ে বললো,
"হবো না, পসিবিলিটি কম। তবে, যদি, তারপরও।"
অনন্যা কৌশিকের বাহু ধরলো। মাথা নাড়িয়ে বললো,
"আমি জানি না, কখনো আপনাকে ভালোবাসতে পারবো কিনা। কিন্তু যদি কখনো ভালোবাসি, প্রথম মানুষটা আপনিই হবেন, যার কাছে তা স্বীকার করবো। তবে আমি সবসময় তোমার পাশে থাকবো, যতদিন বেঁচে আছি। কিন্তু মানুষ তো মরণশীল, একদিন আমাকেও চলে যেতে হবে। তখন হয়তো আর আপনার পাশে থাকতে পারবো না। যতদিন আমার শ্বাস আছে, আমাকে আপনার পাশে পাবেন, এটা কথা দিলাম।"
কৌশিক তার মুখে মৃদু হাসি ফুটিয়ে অনন্যার এলোমেলো চুলগুলো ঠিক করে দিল, ললাটে আলতো চুম্বন বসিয়ে বললো,
"আমি চাইলে তোমাকে বাঁচিয়ে রাখতে পারি, প্রিন্সেস। জানি, সেটা নীতি বিরুদ্ধ কাজ হবে। তার জন্য আমাকে কঠোর শাস্তি পেতে হবে। কিন্তু তোমাকে পাশে রাখতে হলে যা যা দরকার আমি করবো। আই উইল প্রটেক্ট ইউ আনটিল মাই লাইফ গন।"
অনন্যা অল্প হেসে দুদিকে মাথা নাড়লো,
"স্যার, আপনি কি জানেন, মানব জীবন কেন এতো ক্ষুদ্র হয়? কেন মনে হয় চোখের এক ঝাপটায় সময় চলে যাচ্ছে? এর কারণ খুব সহজ। মানুষের জীবন এতই ক্ষুদ্র, যাতে তারা এই অল্প সময়টাই সঠিকভাবে ব্যয় করতে শিখে। পৃথিবীটা বড়, সময়টা কিন্তু সীমিত। মানুষের অগণিত লোভ থাকে, তারা যতটা জীবন পায়, ততটাই আরো কিছু অর্জন করতে চায়। কিন্তু আসল সত্যটা এই যে যত বড় হবে, তত বেশি দিক থেকে চাপ আসবে। আর জীবন শেষ হওয়ার আগেই মানুষ বুঝে, আসলে ওই অল্প সময়টাই সবচেয়ে বেশি মূল্যবান।
সময় বেশি পেলে মানুষ আর মানুষ থাকবে না। সে লোভের সাগরে ডুবতে থাকবে। যা আছে তার থেকেও আরো বেশি করে চাইবে, খারাপ কাজ করবে। অসৎ পথে হাঁটবে। অমানুষ এ পরিণত হবে। তাই দরকার কী? এতো সুখ ভোগ করে কী হবে? এই ছোট্ট জীবনটাতেই চাইলে আমরা সুখ পেতে পারি। একসাথে সুন্দর সুন্দর সময় কাটাতে পারি। একসময় আমরা বুঝতে শিখি। জীবন সত্যিই খুব লম্বা, স্যার। কিন্তু সময়টাই হয় সীমিত।
আমার এই জীবনে কোনো লোভ নেই। আমি জানি না আপনি কে! আমি জানি না আপনি কীভাবে এতো কিছু করতে পারেন। হয়তো কোনোদিন জানতে পারবো। অথবা না জানলেও আমি অনন্যা! আমার জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত আপনার পাশে থাকবো।"
কৌশিক নিঃশব্দে অনন্যার দিকে তাকিয়ে থাকলো, তার দুই চোখজুড়ে এক অদ্ভুত প্রশান্তি ছড়িয়ে পড়েছে। হাত দুটো অগোচরে আলগা হয়ে গেছে। এই দীর্ঘ জীবনযাত্রার এই পর্যায়ে এসে কৌশিকের মনে হচ্ছিল, সে কোনো ভুল করেনি। যদি সত্যিই ভুল করতো, আজ এমন স্নিগ্ধ মুহূর্তে, অনন্যা চোখের সামনে থাকতো না।
কৌশিক অনন্যার পোশাক খোলার জন্য তার হাত পোশাকের উপর অতি যত্নে রেখেছিল। অনন্যা কিছুটা অস্বস্তি অনুভব করে ঠোঁট উল্টে ফেললো। মাথা নামিয়ে বললো,
"স্যার!"
কৌশিক অনন্যার এই বাচ্চামো আচরণে হাসলো। ফিসফিসিয়ে বললো,
"দিস ইজ নট ফেয়ার! তোমার উপর আমার সম্পূর্ণ অধিকার আছে। তোমার প্রতিটি অংশ ছুঁয়ে দেখার অধিকার ও আমার। তোমাকে খুব কাছ থেকে, ঠিক এই পজিশনে দাঁড় করিয়ে তোমার চোখ দুটো দেখার অধিকার ও আমার।"
অনন্যা নিশ্চুপ রইলো। বেসিনের উপরে অবস্থিত আলমারির দরজা খুলে, কৌশিক আরেকটা বাথরোব বের করে অনন্যার হাতে দিলো। অনন্যা দূরে সরে গেলো। কৌশিককে চোখের ইশারায় অন্য দিকে তাকাতে বললো।
কৌশিক ধীরে ধীরে বাথটাবের গরম পানিতে শরীর ডুবিয়ে বসল। পানি তার চারপাশে একটুকরো শীতল প্রশান্তির আস্তরণ তৈরি করল, কৌশিকের দেহের শীতলতা উষ্ণ পানিকে গভীর ঠান্ডায় মুড়িয়ে দিয়ে গেলো।
কিয়ৎক্ষণ পর অনন্যা নীরবে তার সামনে এসে দাঁড়ালো, ওর দৃষ্টি দ্বিধা মিশ্রিত। কৌশিক চোখ তুলে অনন্যার শ্যামল পায়ের দিকে চোখ ফেরালো। মোহময় দৃষ্টি নিয়ে ধীরে ধীরে উপরে তাকালো , অনন্যার হাতের মুঠো ধরলো। অনন্যার শরীর জুড়ে শিহরণ খেলে যাচ্ছে, কোনো অধরা কোমল অনুভূতি স্পর্শ করছে তার মনে। অনন্যা কিছুটা ইতস্তত করলেও কৌশিকের আকর্ষণীয় দৃষ্টিতে বাঁধা পড়ে গেলো।
অনন্যা ধীরে ধীরে নেমে এলো, কৌশিকের সাহায্যে বাথটাবে তার উপর বসে পড়লো। কৌশিক তাকে পেছন থেকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরলো। অনন্যার ঘাড়ে গলায় ঠোঁটের ঠান্ডা চুমু বসিয়ে দিলো। অনন্যা শীতল পানিতে বসেই কাঁপতে লাগলো, হিম হয়ে গেছে তার দেহ। নিশ্চুপ হয়ে রহস্যময় মানবের মাঝে বিলীন হয়ে গেলো।কৌশিকের হাত অনন্যার শরীরকে বেঁধে ফেলেছে। অনন্যার স্পর্শেও কৌশিক উষ্ণ হয়ে উঠেছে। অনন্যার নরম হাত কৌশিকের মোলায়েম গালে গিয়ে ঠেকছে।
কৌশিক অনন্যার গালে গভীর চুম্বন বসিয়ে বললো,
"প্রিন্সেস, উপরে তাকাও।"
অনন্যা ঝটপট চোখ খুলে উপরে তাকালো। বাথরুমের পরিবেশ ইতিমধ্যেই বদলে গেছে, এক অদ্ভুত মায়াবী অন্ধকার চারপাশে ছড়িয়ে পড়েছে। কোন এক অজানা জগতে প্রবেশ করেছে তারা। জানালার পাশের ফুলের টব থেকে হঠাৎ করে এক বিশাল ফুল ফুটে উঠেছে, তার মোহনীয় গন্ধ বাতাসে মিশে এক মায়াবী আবেশ ছড়াচ্ছে। জঙ্গলের সবুজ জোনাকিরা চারপাশে জমে উঠেছে, ক্ষুদ্র আলোক বিন্দুরা ঘিরে ধরেছে পরিবেশকে, আর রঙিন প্রজাপতিরা মুক্ত ডানায় ভেসে বেড়াচ্ছে। অনন্যা বিস্ময়ে চারপাশে তাকিয়ে রইলো, কৌশিক ততোই তাকে আরো কাছে টেনে নিল।
মনে হলো বাথরুমের ছাদজুড়ে এক টুকরো আকাশ ঝুলে আছে। নরম, ঝলমলে জোনাকির আলো ছায়ার মতো খেলা করছে, ঠিক রাতের আকাশে ছড়িয়ে থাকা অসংখ্য তারার প্রতিচ্ছবি। হালকা মৃদু নীলাভ আভা ছড়িয়ে পড়েছে চারপাশে, গাঢ় অন্ধকারের মাঝে এক সুন্দরী মোহময়তা তৈরি করেছে।
অনন্যা উপরে তাকিয়ে বিস্ময়ে পড়ে গেলো, মনে হলো কোনো জঙ্গলের মাঝখানে বসে দুজনে মিলে আকাশ দেখছে, খুব সুন্দর আবহাওয়া। চারপাশ থেকে সুন্দর বাতাসরা বয়ে এসে পরিবেশটাকে আরো প্রকৃতিময় রূপে পরিবর্তন করে ফেলছে। অনন্যার ভালো লাগছে, খুব ভালো লাগছে। মনে হচ্ছে এই রহস্যময় জগতের প্রধান মধ্যমণি সে। কৌশিক তার দিক দর্শন।
কৌশিক নেশালো কণ্ঠে বললো,
"তোমার আরো অনেক কিছু দেখার বাকি, প্রিন্সেস।"
অনন্যা বিস্ময়াভিভূত হয়ে মিটিমিটি হাসলো, ছাদের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে বললো,
"স্যার! একটা কথা।"
"বলো।"
"আপনি হঠাৎ প্রিন্সেস কেনো ডাকা শুরু করেছেন?"
কৌশিক অনন্যার ঘাড়ের মাঝে, চুলের মাঝে ডুব দিয়েছে। সে একটু সরে অনন্যার কানে আলতো চুম্বন বসিয়ে বললো,
"আমি তোমার প্রিন্স হলে, তুমি আমার প্রিন্সেস।"
অনন্যা ধীরে ধীরে পেছনে ফেরলো। কৌশিক সময় ব্যয় করলো না , দ্রুত অনন্যার গলায় ডান হাত গলিয়ে ঠোঁটের দিকে এগিয়ে শক্ত করে ঠোঁট চেপে ধরলো। গভীর চুম্বন বসালো সে স্থানে। অনন্যা কৌশিকের মোহে কারাগারের মতো আটকে পড়ে গেলো। দুজনে সমান তালে ধীরে ধীরে, সময়ের স্রোতে একে অপরের মাঝে ভেসে যেতে লাগলো। কৌশিকের আসক্তি অনন্যা, যা দিনকে দিন তীব্র আকার ধারণ করছে, সীমানা ছাড়িয়ে যাচ্ছে। কিন্তু সময় যদি তার উল্টো পথে হাঁটা শুরু করে। তখন?
.
.
.
চলবে........................................................................