প্রেমান্বেষা - পর্ব ৩০ - সারা মেহেক - ধারাবাহিক গল্প


সন্ধ্যার দিকে বাসায় ফিরলো নীলিমা। এর আগে সন্ধ্যে পর্যন্ত বাসার বাইরে থাকেনি সে। সর্বোচ্চ বিকেল অব্দি দেখেছে। ইমাদ সাহেব কোনো অভিভাবক ছাড়া মেয়েকে এতক্ষণ বাহিরে থাকার অনুমতি দেন না। হাজার বন্ধু বান্ধবী হলেও না। এদিকে নীলিমা আজ বান্ধবীর কথা বলেই বাসা থেকে বেরিয়েছিলো। ভেবেছিলো বিকেলের মধ্যেই চলে আসবে৷ কিন্তু আজ সারাদিন স্মরণের সাথে সময় কাটিয়েছে সে। হঠাৎ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় ঘুরবার ইচ্ছে পোষণ করেছিলো সে। স্মরণও এ নিয়ে কিছু বলেনি। উল্টো ঘুরতে নিয়ে গিয়েছে তাকে। ফেরার পথে পড়েছিলো লম্বা জ্যামে। ওখান থেকে আসতেই যত দেরি হয়েছে তাই। 
নীলিমা নিশ্চিন্তে বাসায় প্রবেশ করলো। কিন্তু প্রবেশ মাত্রই ইমাদ সাহেবকে দেখে তার গলার পানি শুকিয়ে এলো। ইমাদ সাহেব সাধারণত এ সময়ে বাসায় থাকেন না। কিন্তু আজ দূর্ভাগ্যবশত তিনি বাসায় আছেন। 
মেয়েকে দেখে ইমাদ সাহেব শীতল কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলেন,
" কি ব্যাপার নীলু? কোথায় ছিলি এতক্ষণ? "

নীলিমা শুকনো ঢোক গিলে বললো,
" বান্ধবীর সাথে ঘুরছিলাম আব্বু৷"

ইমাদ সাহেব চোখ কুঁচকে হাত ঘড়ির দিকে চাইলেন। হাত উঁচু করে নীলিমার সামনে ধরে জিজ্ঞেস করলেন,
"কয়টা বাজে এখন?"

নীলিমা আমতাআমতা করে বললো,
"সা-সাতটা। "

" এই সময়ে কোনো ভদ্র ঘরের মেয়ে বাইরে থাকে? বল?"

নীলিমা ভীত চাহনিতে এপাশ ওপাশ মাথা নাড়ালো। বললো,
" রাস্তায় অনেক জ্যাম ছিলো আব্বু।"

" তাই বলে সাতটা বাজবে! কোন বান্ধবীর সাথে গিয়েছিলি? দেখি ফোন লাগা ওকে। "

নীলিমার হাত পা যেনো মুহূর্তেই বরফ শীতল হয়ে এলো। এভাবে ফেঁসে যাবে কল্পনাও করেনি সে। এদিকে কোনো বান্ধবীকে আগ থেকেই বলে রাখবে যে বাসা থেকে ফোন করলে সামলে নিতে,সেটাও করেনি। নীলিমা পড়লো মহাবিপদে। বাবাকে এ নিয়ে কিছু বলা যাবে না। যতই বলবে ততই বাবা সন্দেহ করবে। এজন্য আল্লাহর নাম নিতে নিতে ব্যাগ থেকে ফোন বের করলো। ফোন অন করে লিসার নাম্বার খোঁজার বাহানা করলো। সময় লাগালো এতে। নীলিমার মনে হলো একমাত্র লিসাই পারে তাকে এই পরিস্থিতি থেকে বের করতে।

নীলিমাকে এতক্ষণ ধরে ফোন ঘাঁটতে দেখে ইমাদ সাহেব পূর্বের ন্যায় বললেন,
" কি ব্যাপার? যে বান্ধবীর সাথে বাইরে বেরিয়েছিলি তার নাম্বার কল লিস্টে নেই?"

নীলিমা আবারও ঢোক গিলে বললো,
" না মানে ম্যাসেঞ্জারে কথদ বলেছিলাম। ফোনে টাকা নেই তো। 
এই যে ফোন দিয়েছি। নাও আব্বু। "
বলে সে ইমাদ সাহেবের কাছে ফোন দিলেন। 
কয়েকবার রিং হওয়ার পর ফোন ধরলো লিসা। 
" হ্যাঁ বল নীলু। "

 ইমাদ সাহেব বললেন,
" নীলু না। নীলুর বাবা বলছি।"

তটস্থ হলো লিসা। হাসিমুখে বললো,
" জি আংকেল। আসসালামু আলাইকুম। ভালো আছেন?"

" ওয়ালাইকুমুস সালাম। হ্যাঁ ভালো আছি। তুমি নীলুর বান্ধবী? "

" জি আংকেল। "

" নীলু আজ তোমার সাথেই বাইরে বেরিয়েছিলো না?"

এ প্রশ্ন শুনতেই নীলিমার হাত পা ধীরেধীরে কাঁপতে আরম্ভ করলো। গলা শুকিয়ো এলো তার। ওপাশে লিসা যে কি বলবে এই চিন্তা তাকে আধমরা করে দিলো। আজ বোধহয় ফেঁসেই যাবে সে। প্রেম শুরু করার আগেই প্রেমের অন্ত দেখতে পারছে নীলিমা। 

এদিকে লিসা ইমাদ সাহেবের প্রশ্নে একটু অবাকই হলো বটে। সে তো নীলিমার সাথে ঘুরতে যায়নি। তাহলে কার কথা বলছে নীলিমার বাবা? নাকি নীলিমা ওদিকে কোনো ঝামেলা বাঁধিয়েছে বলে তাকে কল করেছে?
একটু ভেবেচিন্তে লিসা জবাব দিলো,
" জি আংকেল। আমার সাথেই বেরিয়েছিলো ও। "

" তাহলে এতো দেরি হলো কেনো? জানো না ঢাকায় এত রাত পর্যন্ত দুটো মেয়ের একা বাইরে থাকা সুবিধার না?"

ইমাদ সাহেবের এরূপ কথায় নীলিমা চিন্তামুক্ত হলো। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো সে। বুকের ধুকপুক শব্দটা ক্রমেই কমে আসতে লাগলো। ওদিকে লিসা বললো,
" জি আংকেল। আসলে জ্যামে পড়ে গিয়েছিলাম। আবার আমারও মার্কেটে কিছু কেনাকাটা ছিলো।এজন্যই দেরি হয়েছে। "

" আচ্ছা ঠিক আছে। পরেরবার থেকে বিকেলের মধ্যেই বাসায় ফিরে আসার চেষ্টা করবে কিন্তু। "

" জি আংকেল। অবশ্যই। আপনি চিন্তা করবেন না। "

" আচ্ছা নীলিমার সাথে কথা বলো। "
বলেই তিনি ফোন এগিয়ে দিলেন নীলিমার দিকে। নীলিমা দ্রুত ফোন নিয়ে নিজের রুমে গেলো। গিয়েই দরজা আটকে লিসাকে বললো,
" থ্যাংকস দোস্ত। থ্যাংকস আ লট। আজ তুই মিথ্যা না বললে আমার গর্দান যেতো। "

লিসা একটু ভাব নিয়ে বললো,
" হয়েছে হয়েছে থাক। এবার বল কি অকাম করে এসেছিস যার জন্য আমাকে মিথ্যা বলতে হলো?"

" বলবো বলবো। সব বলবো। আমাকে একটু সময় দে। ১২টার পরে ফ্রি আছিস না?"

" হ্যাঁ আছি। "

" আচ্ছা, তখন বলবো সব। একদম ডিটেইলসে।"

" ঠিক আছে। অপেক্ষায় থাকলাম। "
বলেই কল কেটে দিলো নীলিমা। অতঃপর ফোন রেখে বড় বড় নিঃশ্বাস ছেড়ে এক গ্লাস পানি খেয়ে নিলো। রুমে এসে ড্রেস বদলিয়ে ফ্রেশ হয়ে নিলো। অতঃপর ফোন দিলো স্মরণকে। স্মরণও বাসায় ফিরেছে কিছুক্ষণ আগে। এসেই সে ফ্রেশ হয়ে শুয়েছিলো। আজ সারাদিন ঘুরাঘুরি করে তার পায়ের অবস্থা শোচনীয়। নীলিমা কল করায় সে ফোন রিসিভ করে বললো,
" বাসায় পৌঁছে গিয়েছো তো?"

" হ্যাঁ স্মরণ ভাই। বাসায় পৌঁছে আরোও কত কাহিনিও ঘটিয়ে এসেছি। "

" মানে?"

" মানে আব্বু আজকে বাসায় ছিলো। একদম হাতেনাতে ধরে ফেলেছিলো আমাকে। "

উদ্বিগ্ন হলো স্মরণ। উৎকণ্ঠা নিয়ে শুধালো,
" তারপর কি হলো?"

" কি আর হবে। এক ফ্রেন্ডকে দিয়ে মিথ্যে বলিয়ে কাজ সেরেছি। "

স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো স্মরণ। বললো,
" যাক। এ যাত্রায় তাহলে বেঁচে গেলে।"

" হুম। মনে মনে ভাবছিলাম প্রেম শুরু হওয়ার আগেই বোধহয় শেষ হয়ে গেলো। "

হাসলো স্মরণ৷ বললো,
" তোমার বাবা যে ডেঞ্জারাস। এমন হলেও হতে পারতো আজকে। "

নীলিমা ঠোঁট ফুলালো। মৃদু শাসানী দিয়ে বললো,
" সাবধানে কথা বলুন স্মরণ ভাই। সে কিন্তু আমার বাবা। "

সশব্দে হাসলো স্মরণ। বললো,
" ট্রিগার্ড হলে নাকি?"

" হবো না তো কি! আপনি আমার আব্বুকে ডেঞ্জারাস বলবেন কেনো?"

" ডেঞ্জারাস না বলে উপায় আছে? আমাদের প্রেমের প্রথমদিনই উনি গোয়েন্দাগিরি শুরু করে দিয়েছেন। না জানি সামনে কি হবে।"

স্মরণের প্রথম কথায় সমর্থন না দিলেও শেষোক্ত কথায় ঠিক সমর্থিত হলো নীলিমা৷ আসলেই ইমাদ সাহেব আজ বড়সড় রকমের গোয়েন্দা মিশনে নেমেছিলেন যেনো। নীলিমা এবার উদ্বিগ্নতা নিয়ে বললো,
" আমিও তাই ভাবছি। আপনি যে বললেন কোরবানি ঈদে বিয়ের কথা বলবেন। কিন্তু এর আগেই তো আমাদের দফারফা হয়ে যাবে৷ "

" উঁহু, তা হতে দিবো কেনো। এত কষ্টে তোমাকে পেয়েছি। ফুপা দফারফা করলেও আমি করতে দিবো না। 
ওহ হ্যাঁ, ভালো কথা, আকাশের সাথে বিয়ের ব্যাপারে কোনো কথা হয়েছে?"

" না, এখনও হয়নি। আব্বু জিজ্ঞেস করলে তারপর বলবো। "

" এর আগেই যদি ফুপা কিছু করে বসে?"

" আরে না না। করবে না। আব্বুকে তো বলেই রেখেছি। "

নীলিমার ফোন থাকতে থাকতেই স্মরণ দেখলো তার মা কল দিয়েছে। সে নীলিমাকে বলে ফোন রেখে নাজমা বেগমের কল রিসিভ করলো। 
শুরুতেই ছেলের হালচাল জিজ্ঞেস করলেন নাজমা বেগম। আজ কি খাওয়াদাওয়া করেছে এ নিয়েই বেশ কিছুক্ষণ কথা হলো। অতঃপর নাজমা বেগম খানিক দ্বিধাদ্বন্দে বললেন,
" শোন স্মরণ। তোর জন্য একটা মেয়ে দেখেছি। "
এই কথা শোনা মাত্রই স্মরণের চেহারার রঙ যেনো উড়ে গেলো। অবাক স্বরে মা'কে বললো,
" মেয়ে? মেয়ে দেখেছো কেনো? আমি কি মেয়ে দেখার কথা বলেছি?"

" ওমা! মেয়ে দেখবো না তো কি করবো। বিয়ে করবি না তুই? বিয়ের বয়স তো পেরিয়ে যাচ্ছে। "

" পেরিয়ে গেলে যাক। আমি কি একবারো বলেছি এখন বিয়ে করবো আমি? আমার প্রমোশন হওয়া বাকি এখনও। "

" তো এখন বললে এখনই বিয়ে হয়ে যায় নাকি। মেয়ে খুব সুন্দর। দেখে রাখ। আংটি পরিয়ে রাখি। তারপর প্রমোশনের পর বিয়ে দিবো।"

স্মরণ প্রচন্ড বিরক্ত হয়ে বললো,
" তুমি এতো কিছু করতে গেলে কেনো? আমি কাউকে এখন বিয়ে করবো না। "

নাজমা বেগমও বেঁকে বসলেন। জিজ্ঞেস করলেন,
" কেনো বিয়ে করবি না? মেয়ে দেখতে সুন্দর, বংশ ভালো৷ "

" আরে মা রাখো তো এসব!"

ছেলের ব্যবহারে নাজমা বেগম এবার সন্দিগ্ধ কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলেন, 
" তোর কি কোনো পছন্দ-টছন্দ আছে নাকি রে স্মরণ? যার জন্য আমাকে মানা করছিস তুই?"

স্মরণ আরোও বিরক্ত হলো। কিছু না বলেই খট করে ফোন কেটে দিলো। চাপা ক্রোধ ও বিরক্তি নিয়ে বিড়বিড় করে বললো,
" এতদিন নীলিমার বিয়ে ঠেকাতে ব্যস্ত ছিলাম। আজ আমার বিয়ে ঠেকাতে ব্যস্ত হবো। উফ, এই জালিম দুনিয়া আমার আর নীলিমার প্রেম টিকতে দিবে না বুঝতে পারছি। একের পর এক মহা ঝামেলা এসেই যাচ্ছে। "
.
.
.
চলবে........................................................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

WhatsApp