রাতের নিস্তব্ধ অন্ধকারের বুক চিরে উঁকি দিল সকালের আলো। গাছের চিকন ডালে বসা ভোরের দুটো পাখি গান গেয়ে ওঠে। বিশাল আকাশে সাদা মেঘ ভরা। নীল সাদা মেঘে ছেয়ে গেছে। শুভ্র সকালের ঝর ঝরে মিষ্টি বাতাস উইন্ডোর পর্দার ফাঁক গলিয়ে রুমে আসে, স্নিগ্ধতা নিবেদন করে রোদেলার গালে মুখে এসে বারি খাচ্ছে। রোদেলা পিটপিট করে চোখ খুলল। সেহরিশ আধশোয়া হয়ে বসে আছে। হাতের তালুতে ভর রেখে গভীর মনোযোগ দিয়ে রোদেলাকে দেখছে। রোদেলা হকচকিয়ে গেল। সহসা কম্বল টেনে মুখ ঢেকে ফেলল। রোদেলার কান্ড দেখে
সেহরিশ কোমল গলায় জিজ্ঞেস করল,
'মুখ ঢেকেছো কেনো?
'আপনি কখন উঠেছেন?'
'প্রায় অনেকক্ষণ। এখন কম্বল সরাও। আমি তোমাকে দেখব।'
রোদেলা কম্বলের নিচে থেকে বলল,
'আপনি আমাকে এভাবে দেখবেন না, কারণ আমার হৃদয় ও নিজেকে সামলাতে পারব না।'
সেহরিশ খানিকটা ঝুঁকে পড়ল। কম্বলের উপর দিয়ে রোদেলার কপালে ঠোঁট স্পর্শ করল। অন্যরকম ভালোলাগা অনুভব করল রোদেলা। হাজারও লজ্জা ক্রমশ তাকে ঘিরে ধরেছে। সেহরিশ রোদেলাকে নাস্তার জন্য নিচে যেতে বলে সে নিজে বেরিয়ে গেল। রোদেলা যতক্ষণে ফ্রেশ হয়ে নিচে নামবে ততক্ষণে সেহরিশ ওদের জন্য নাস্তা বানিয়ে ফেলবে। রোদেলা কম্বল সরিয়ে উঠে বসল। হাতটা দিয়ে আলতোভাবে কপাল স্পর্শ করল সে। হাজারও কষ্টের ভেতর এই একটা মানুষ তার ভালো লাগার কারণ। রোদেলার মুখে প্রাণখোলা হাসির রেখা ঢেউ খেলছে। সেহরিশ আলমিরা থেকে মেরুন রঙের একটা শাড়ি নামিয়ে সোফার উপর রেখে গেছে। রোদেলা শাড়িটা দেখে আরেকটু হাসল। এরপর ফ্রেশ হতে এগিয়ে গেল বাথরুমে।
বিরাট আকাশে আজ ফালি ফালি মেঘের আনাগোনা। নীল আকাশের মনে আজ আনন্দ লেগেছে যেন। রোদেলা সিঁড়ি ভেঙে নিচে এলো। খাবার টেবিলে এসে চমকে গেল ও। সেহরিশ অল্প করে তিনটা আইটেম বানিয়েছে। খাবারের ঘ্রাণ নাকে এসে লাগছে। মনে হচ্ছে দারুণ মজা হয়েছে। টেবিল দেখে হতবাক হতে গেল রোদেলাকে । বিশাল বড় টেবিলে শুধু একটা চেয়ার। যেখানে পঁচিশটা চেয়ার ছিল সেখানে মাত্র একটা। রোদেলা করুণ চোখে সেহরিশের দিকে তাকিয়ে।
সেহরিশ উপহার স্বরুপ একগাল হেসে বলল,
'ব্রেকফাস্ট পছন্দ হয়েছে? এত অল্প সময়ে এগুলোই করতে পারলাম।'
কি বলবে? রোদেলা বুঝে উঠতে পারছে না। একটা গ্লাসে পানি ঢেলে তারপর চেয়ারে বসে গেল সেহরিশ। এসময় লম্বা শ্বাস ফেলে রোদেলা বলল,
'এখানে আর চেয়ার কোথায়?'
সেহরিশ রোদেলার দিকে তাকিয়ে বলল,
'সরিয়ে ফেলেছি।'
'আমি বসব কোথায়?'
'আমার কোলে।'
রোদেলা বিস্মিত। সেহরিশ তার বাঁ হাতখানা পায়ের উপর দু'বার থাপথাপিয়ে বলল,
'বসো।'
রোদেলা কিংকর্তব্য বিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বুকের ভেতর ধকধক শব্দ হচ্ছে। সেহরিশ রোদেলার দিকে তাকিয়ে আবারও বলল,
'কি হলো? বসো।'
রোদেলা ইতস্তত করে বলল,
'কিন্তু?'
সেহরিশ রোদেলার হাতটা ধরে কাছে টানলো। এরপর বলল, 'আমি তোমার হাসবেন্ড। আমার কাছে লজ্জা কিসের?' এটুকু বলে থামল সেহরিশ। মূহুর্তে মুখের আদল বদলে গেল তার। গম্ভীর কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল,
'বিয়ের দুবছর হয়ে গেছে তুমি এখনো লজ্জা পাও? ওরে আমার লজ্জাবতী বউ।'
সেহরিশ সশব্দে হেসে উঠল। তারপর বলল, 'চিন্তা নেই। তোমার লজ্জা আমি কাটাতে বলব না। তোমার এই লজ্জা আমাকে তোমার প্রতি আকৃষ্ট করে। দূর্বল হয়ে যাই এখানেই।'
ঘড়ির কাঁটা অবিরাম ঘুরঘুর করছে। একপলক হাত ঘড়ির দিকে তাকিয়ে সময় দেখে নিল সেহরিশ। বারান্দার রেলিঙ ঘেঁষে চেয়ার টেনে নিয়ে বসে গেল। এই জায়গায় বসে সহজে পুরো গার্ডেন দেখা যায়। সকালের এই সময়টা রোদেলা বাগানে কাঁটায়। মালী থাকার পরও নিজে হাতে গাছকে পানি দেয় সে। এতে নাকি ওর মন ভালো হয়। সেহরিশ এজন্য আর আপত্তি করে না। সেহরিশ ওর কাজ এখানে বসে ল্যাপটপে করে নেয়। ফাঁকে ফাঁকে রোদেলা কি করছে? সেটাও দেখে। বাগানের উত্তর দিকে বিশাল বড় একটা গাছ আছে। সেদিক থেকে একটা আওয়াজ আসছে। রোদেলা আওয়াজ শুনে দেখার জন্য পা বাড়াল। একটু পর গাছের আড়ালে চলে গেল সে।
লম্বা হাই তুলে বাগানের দিকে তাকাল সেহরিশ। রোদেলা নেই। বিস্ময়ে কপালে চার ভাজ ফেলে উঠে দাঁড়াল। মোটা গাছের আড়ালে চলে যাওয়ায় তাকে দেখতে পেল না সেহরিশ। দ্রুত সিঁড়ির দিকে ছুটে গেল।
শরীরের সবগুলো পশম ফকফকা সাদা। একটা পশম ও সাদা বা অন্য কালার নেই। শরীরে তুষার লেগে আছে। ঠান্ডায় হাঁটতে পারছে না। গাছের নিচে শুয়ে কুহি পারছে। রোদেলা ধীরে ধীরে কুকুরটার দিকে এগিয়ে গেল। ওর সামনে বসে তারপর শরীর থেকে তুষার ঝেড়ে ফেলে দিল। শরীরে কোথাও ব্যথা পেয়েছে কি-না সেটা দেখতে লাগল। এরইমধ্যে হঠাৎ কারন এল সেহরিশের ডাক।
সেহরিশ গাছটার সামনে এসে থামল। রোদেলা কে ওর শরীরে প্রাণ ফিরে এল। এমন ভাবে গভীর নিঃশ্বাস ফেলল। রোদেলা সেহরিশের দিকে তাকিয়ে বলল,
'ওর কোথাও কষ্ট হচ্ছে। ওকে হয়তো কারো পালিত। এজন্য বাহিরের আবহাওয়ার সঙ্গে খাপ খাচ্ছে না। হতে পারে ওর মালিকের থেকে কোনোভাবে হারিয়ে গেছে।'
সেহরিশ গম্ভীর গলায় বলল,
'তুমি কি চাচ্ছ?'
রোদেলা বলল,
'ওকে আমাদের বাড়ি নিয়ে যাই? এভাবে বাহিরে থাকলে ঠান্ডায় মারা যাবে।'
সেহরিশ জিজ্ঞেস করল,
'তুমি ওকে নিজের কাছে রাখতে চাও?'
রোদেলা দৃঢ় চোখে কুকুরটাকে দেখল। শরীরে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল,
'ওর চোখ দুটো প্রায় জোজোর মতো।' বলে থামল রোদেলা। নরম গলায় বলল, 'আমি ওকে রাখতে চাই না৷ পালিত কিছু হারানোর যন্ত্রণা কেমন আমি জানি। তাই চাই না। এমন যন্ত্রণা অন্য কেউ পাক। আমি এখন ওকে আমার সঙ্গে নিতে চাই। ও পায়ে আঘাত পেয়েছে। চিকিৎসা প্রয়োজন। যখন ওর মালিক ওকে নিতে আসবে তখন দিয়ে দেবো।'
সেহরিশ দুবার উপরনিচ মাথা ঝাঁকাল।
দুপুর গড়িয়ে বিকাল নামল। এরমধ্যে কুকুরের খোঁজে কেউ আসে নি। রোদেলা প্রায় সময় সাদা কুকুরটার সঙ্গে কাটাচ্ছে। আগের চেয়ে অবস্থা বেশ ভালো। ঠিকমতো খাবারও খাচ্ছে। সেহরিশ বুঝতে পারল রোদেলা তার মাঝে জোজোকে দেখতে পাচ্ছে। তাই কুকুরটার সঙ্গে সময় কাটানোর জন্য রোদেলা কে একা ছেড়ে দিল।
বাড়ির সামনের দিকে বারান্দায় এসে দাঁড়াতে সেহরিশের ভ্রু কুঁচকে গেল। গেটে দাঁড়িয়ে আছে পুলিশের গাড়ি। ওরা প্রবেশ করতে পারছে না কারণ দারোয়ান গেট খুলছে না। সেহরিশের ম্যানেজার ফ্রাঙ্ক পুলিশের সঙ্গে কথা বলতে এগিয়ে যায়। ওনাদের কথা মতে সেহরিশের বাড়ির পেছন দিকে একটা লাশ রয়েছে। ওনারা খবর পেয়ে এসেছে। ফ্রাঙ্কের মুখখানা গম্ভীর হয়ে উঠল। পুলিশের সঙ্গে বাড়ির পেছন দিকে এল সে। বেশ কিছুক্ষণ খোঁজা খুঁজির পর পুলিশ হতাশ হল।
ফ্রাঙ্ক বলল,
'কেউ হয়তো আপনাদের সঙ্গে প্রাঙ্ক করেছে।'
অফিসার দুবার মাথা ঝাঁকিয়ে বলল,
'তাই হবে। এভাবে আসার জন্য সত্যি মাফ চাচ্ছি।'
পুলিশ অফিসার অন্য অফিসারের সঙ্গে চলে যাবে এমন সময় ওদের সঙ্গের একজন কাঁপা গলায় চেঁচিয়ে উঠল,
'স্যার এদিকে আসুন।'
অফিসারের সঙ্গে এগিয়ে গেল ফ্রাঙ্ক নিজেও। একজন পুরুষ লোকের লাশ। মাটিতে উল্টে পড়ে আছে। শরীর রক্তাক্ত। মুখ থেঁতলে ফেলা হয়েছে। অফিসারের চোখমুখ মলিন হয়ে গেল। ব্যক্তিগত আক্রোশ থেকে হত্যা করেছে। এটা বোঝা যাচ্ছে। লাশ পোস্টমর্টেমের জন্য হাসপাতালে পাঠিয়ে দিল অফিসার। রোদরিশ মঞ্জিলের বাহিরে দাঁড়ানো অফিসার। সেহরিশ বাড়ির ভেতর থেকে বেরিয়ে আসে। ওর দু'পাশে বেশ কয়েকজন বডিগার্ড। লাশের কথা শুনে ঠোঁট প্রসারিত করে হাসল সে। অফিসার ক্রোধের কারণে এক পা এগিয়ে এলো। তাত্ক্ষণিক দুজন বডিগার্ড সেহরিশের সামনে এসে দাঁড়ায়। যার জন্য অফিসার সেহরিশ কে ছুঁতে পারে না।
ম্যানেজার ফ্রাঙ্ক বলল,
'বাড়ির পেছনে লাশ পাওয়া গেছে মানে এটা নয় খুন স্যার করেছে। পাকাপোক্ত প্রমাণ ও এরেস্ট ওয়ারেন্ট ছাড়া আপনি সেহরিশ ফাতিন চৌধুরী কে খুনি সাবস্ত করতে পারেন না৷ আপনি অফিসার বলে এখনো সম্মান দিয়ে কথা বলছি। এখানে সময় নষ্ট না করে আসল খুনিকে খুঁজে বের করুন। আমাদের বস। একজন বড় সেলেব্রিটি। ওনার শত্রুর অভাব নেই। এটা কারো চক্রান্ত। আমি গ্যারান্টি দিয়ে বলছি।'
পুলিশ অফিসার ফ্রাঙ্কের দিকে তাকিয়ে বলল,
'অপেক্ষা করুন। পোস্টমর্টেম রিপোর্ট নিয়ে জলদি ফিরবো।'
.
.
.
চলবে........................................................................