বারান্দার একপাশে বসে ঝিমাচ্ছে সাদাফ। মাথাটা ঝিমঝিম করছে। দু-হাতে মাথা চেপে ধরে চোখ দুটো বন্ধ করে ফেলল। এক সপ্তাহ হয়েছে ছেলে মা-রা গেছে। এই এক সপ্তাহ বিশ্রাম নেয়নি সে। শহরের অলিগলিতে ঘুরেছে। খুঁজে বের করেছে তার সন্তানের খুনীদের। আজ নিজ হাতে তাদের শেষ করেছে। তবুও শরীরের জ্বালা কমেনি।
পাঁচ জন পুরুষ মানুষ ছিল। মৃত্যুর মুখে থেকেও একবারের জন্য উচ্চারণ করেনি সে মানুষের নাম। যে ওদের টাকা দিয়েছিল।
সাদাফ মাথা তুললো। সেহরিশ সরু চোখে ওর দিকে তাকিয়ে আছে। তূর্ণ রেলিঙ ঘেঁষে দাঁড়াল। সাদাফ বলল, 'আমি তোকে বলেছিলাম, দুই বছর আগের ঘটনা মনে আছে? রোদেলা কে কিডন্যাপ করে যে গোডাউনে রাখা হয়েছিল সেখানে তৃতীয় ব্যক্তি ও ছিল। আর সে আমাদের ওদিন দেখেছিল। খটকা আমার তখনও লাগছিল। আমাদের দেখার পর সে চুপ ছিল। কোনো হাঙ্গামা করে নি। আমাদের পদক্ষেপ সম্পর্কে ওর ধারণা আছে। তাই সে নিজেকে আড়ালে রেখে আক্রমণ করছে। ও হয়তো জানে আমরা কিভাবে লোকদের খুঁজে বের করি। তাই দু'বছর ধরে তাকে পাচ্ছি না। দুটো বছর সব ঠিক ছিল। হঠাৎ সব কিছু এলোমেলো হয়ে গেল। একবার আসল মানুষ টাকে পাই। তারপর বুঝাব আমাদের সঙ্গে শত্রুতা কতখানি ভারী।'
তূর্ণ আকাশের দিকে তাকাল। ভারী নিঃশ্বাস ফেলে বলল,
'জুবিয়া আমাকে রোজ প্রশ্ন করে। আমরা ছাড়া ও অনেক সেলেব্রিটি আছে। তাদের জীবন এত জরাজীর্ণ নয়। তাহলে আমাদের কেন? মিথ্যা বলতে হয়।'
সেহরিশ সাদাফের হাতটা শক্ত করে চেপে ধরল। বলল,
'উমাইয়ার এখন কি অবস্থা? শুনেছিলাম ওর মানসিক ও শারীরিক সমস্যা হয়েছে।'
সাদাফ হতাশাজনক শ্বাস ফেলে বলল,
'চিকিৎসা চলছে। এখন মোটামুটি ভালো। আমাকে চিনতে পারছে। আমাদের সাদের একটা পুতুল আছে। ওটাকেই সাদ ভাবে সে৷ আমি বুঝতে পারছি না উমা ঠিক হতে কত সময় নিবে।'
তূর্ণ পেছন থেকে সাদাফকে জড়িয়ে ধরল। সাদাফ ম্লান কণ্ঠে বলল,
'আই অ্যাম ওকে।'
সেহরিশ তীক্ষ্ণ গলায় বলল,
'আমাদের শত্রু এ শহরেই আছে। আর সে আমাদের সব রকম খোঁজ খবর রাখছে। এজন্য আমাদের খুব সতর্কতার সঙ্গে তাকে চিহ্নিত করতে হবে। কিন্তু তার আগে আমাদের নিজেদের সেফ থাকতে হবে। কোনো ভাবেই জেনো ভুল না হয়।'
সাদাফ মাথা নাড়লো। তূর্ণ বলল,
'আমার কাছে একটা প্ল্যান আছে। আমাদের তিনজনের মধ্যে একজন একা বের হবো। আর খুনি যখন একজন কে ধরতে আসবে তখন আমরা তাকে ধরে ফেলবো।'
সেহরিশ বিরক্ত হলো। তূর্ণর মাথায় টোকা দিয়ে বলল,
'স্টুপিট! যত সহজে বলছিস তত সহজ না। আর আমি কারো জীবন বাজি ধরতে পারব না। এমনিতে হারানোর পাল্লা অনেক ভারী হয়ে গেছে। আর না।'
••••••••••••
দেখতে দেখতে ছয় মাস কেটে গেছে। শীতকাল শেষ। গরম কালের মাঝামাঝি সময়। রাস্তার পাশে ও বাড়ির আঙিনার গাছগুলোর পাতা আবারও সতেজ হয়ে উঠেছে। চারিদিক এখন স্বচ্ছ সবুজ! গাছের ডালে বসা পাখির কিচিরমিচির শব্দ শোনা যায় । রাস্তার দু'ধারে ফোঁটা ফুল দেখলে মন প্রফুল্লে ভরে যায়। পূর্ব দিকের দেয়ালে বিশাল জানালা। কোনো গ্রিল নেই। রোদেলা জানালার পাশে বসল। একটু পর ওদের দিকে ছুটে এল সোহা। ওর দুটো হাতে চকলেট। রোদেলা ঘুরে তাকাল। সোহা ওর শাড়ি খাবলে ধরে টানছে। রোদেলা ভ্রু তুলে জিজ্ঞেস করল,
'কি হয়েছে পাকা বুড়ি?'
সোহা আধো আধো গলায় বলল,
'মামমাহ।'
রোদেলা হাঁটু ভাজ করে বসে গেল। সোহার দিকে হাসি মুখে আবারও বলল,
'মাম্মাহ কি?'
সোহা দু'বার চোখের পলক ফেলল। তারপর ওর হাতের একটা চকলেট রোদেলার হাতে দিয়ে দিল। রোদেলা হঠাৎ হেসে ফেলল। সোহা আবার দৌঁড়ানো শুরু করে। এরপর চলে যায় ড্রয়িংরুমের দিকে। উমাইয়া ওখানে নিথর বসে আছে। সোহাকে দেখে হাসার চেষ্টা করে উমাইয়া।
তার চোখে অশ্রু।
সোহা সোফার কভার খাবলে ধরলো। তারপর একটু কসরত করে উঠল সোফায়। উমাইয়ার সোজাসুজি বসে গেল সোহা। সোহা ওর হাত দিয়ে উমাইয়ার চোখের জল মুছে দিল। কোমল ও অস্ফুটস্বরে বলল,
'কা,কা, কাঁদছ কেনো মামনি?'
উমাইয়া ডান থেকে বামে নিবিড়ভাবে মাথা নাড়লো। কণ্ঠস্বর নরম করে বলল,
'কোই? আমি কাঁদছি না তো।'
সোহা এবার ওর হাতের দ্বিতীয় চকলেট উমাইয়ার হাতে দিল। বলল,
'মামনি এটা তোমার! খাও!'
উমাইয়া কুটিল হাসল। সোহা আবার বলল,
'তুমি ইট্টু খাবে আর ইট্টু আমার।'
উমাইয়া ঝুকে পড়ল। হাত বাড়িয়ে সোহাকে কোলে নিল সে। সোহার কপালের বড় বড় চুলগুলো কে আলতোভাবে সরিয়ে দিয়ে কপালে শুঁকনো চুমু খেলো। সোহা চোখ বন্ধ করে হাসল। একটু পর উমাইয়া ওকে ছাড়তে সোহা সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে গেল। ও কিছু করতে চাচ্ছে। উমাইয়া বিস্ময়ে চোখ পাকালো। সোহা একটু সামনে গেল। উমাইয়ার মতো করে সে-ও উমার কপালে ঠোঁট ছোঁয়ালো। উমাইয়া বিস্মিত। আচমকা হেসে উঠল ও।
রোদেলা ড্রয়িং রুমে এল। রোদেলা আর জুবিয়া উমাইয়ার সঙ্গে দেখা করার জন্য ওর বাড়িতে আসছে। জুবিয়া নিজ হাতে সবার জন্য নাস্তা বানাচ্ছে। একাই সব করবে। এজন্য কাউকে রান্নাঘরে ঢুকতে দেয় নি।
রোদেলা সোফার দিকে তাকাল। সোহা আর উমাইয়া হাসছে। উমাইয়ার হাসি ভীষণ সুন্দর। হাসলে তাকে ভালো লাগে। রোদেলার ঠোঁটে হাসি ফুটে উঠল। উমাইয়ার সামনে বসে রোদেলা জিজ্ঞেস করল,
'মামনি কে পেয়ে মাম্মাহ কে ভুলে গেছো? এখন তো মাম্মাহ কেউ নই। সব ভালোবাসা মামনির জন্য।'
সোহা না বুঝে হেসে উঠল। ওর কয়েকটা দাঁত উঠেছে। হাসির সময় ফাঁকা অংশ দেখা যায়। সোহা উমাইয়া কে ছেড়ে রোদেলার দিকে এগিয়ে যেতে লাগল। হঠাৎ সোহার হাত ধরে ফেলল উমাইয়া। তারপর রোদেলা আর উমাইয়া সোহাকে কাতুকুতু দিতে লাগল। সোহা শুয়ে পড়ে শব্দ করে হাসতে লাগল।
জুবিয়া নাস্তা তৈরি করে। এরপর একসঙ্গে খাওয়া দাওয়া করে ওরা বাড়ির বাহিরে এল। আকাশটা স্বচ্ছ, সূর্যের প্রখরতা নেই। ঠান্ডা বাতাস বইছে। রোদেলা, উমাইয়া, জুবিয়া ওরা তিনজন সোহার সাথে গেল।
বাড়ির দক্ষিণ দিকে একটা বাগান। বড় বড় গাছ এর পাশে বেশ কিছু ফুলের বাগান। পায়ের তলায় ঘন সবুজ ঘাস। ঘাসের ওপর গাছ থেকে ঝরে পড়েছে ফুল ও ফল। গাছের ছায়ায় চেয়ার পাতা। সোহা দৌঁড়ে গিয়ে একটা চেয়ারে বসল। সোহা একবার তাকাল রোদেলার দিকে। দেখেই হাসল সে। রোদেলা উমাইয়ার হাত ধরে চেয়ারে নিয়ে বসালো। উমাইয়া উদাস হয়ে তাকাল আকাশের দিকে। পায়ের শব্দ শুনে সরে পথের দিকে ফিরে তাকাল। মাত্রই বাহির থেকে এল ওরা। ওদেরকে বাগানে দেখে সেদিকটায় এগিয়ে গেল সাদাফ, তূর্ণ আর সেহরিশ। উমাইয়ার মুখ নির্বিকার। একপলক সাদাফকে দেখে আবার আকাশের দিকে তাকাল। আকাশ অদ্ভুত নীল! সমুদ্রের দিক থেকে আসছে হু হু করা শীতল বাতাস। বাতাস ছাড়া আর কোনো শব্দ নেই। স্নিগ্ধ, মায়াবী ধরনের রোদ । রোদের উষ্ণতা নেই।
সাদাফ বাড়ির দিকে চলে গেল। ফ্রেশ হয়ে আবার আসবে।
চা-কফি খেতে খেতে গল্প করতে লাগল। সোহা ওর চেয়ার থেকে নামল। বাগানের ফুল গাছগুলোর যে গাছে কাটা নেই। ওই গাছ থেকে একটা ফুল ছিঁড়ে নিয়ে আসলো। সোহা ছুটে গেল সেহরিশের দিকে। বলল,
'নিচ,নিচে আসো।'
সেহরিশ ওর হাতের কাপটা রাখল। এরপর একটু ঝুঁকে এল সোহার দিকে। সোহা একগাল ভরে হাসল। ওর হাতের ফুলটা সেহরিশের বড় বড় চুলের মাঝে গুঁজে দিল। সেহরিশ বিস্মিত হয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে মৃদু হেসে ফেলল সে। সোহা সেহরিশকে ভীষণ পছন্দ করে। সেহরিশের সঙ্গে খেলা দুষ্টুমি করে লুকিয়ে থাকে।
তূর্ণ ভ্রু কুঞ্চিত করল। সোহার উদ্দেশ্য বলল,
'সোহা, বাবার মাথার ফুল কোথায়?'
সোহা ওর দুটো হাত দিয়ে মুখ চেপে ধরে হাসতে লাগল। হাসতে হাসতে ঘাসের উপর বসে পড়ল। উমাইয়া উঠে দাঁড়াল। সোহাকে কোলে নিল। ফল গাছের সব থেকে মিষ্টি ফলটা গাছ থেকে পেড়ে সোহাকে দিয়ে বলল,
'তোমার মম কে বলো এটা তোমাকে কেটে দেওয়ার জন্য। ভারী মিষ্টি ফল। তুমি যদি এটা একটু খাও তারপর গাছের সবগুলো খেতে চাইবে।'
সোহা আবার হাসতে লাগলো। দুই হাতে ফলটা ধরে উমাইয়ার গালে আলতো করে চুমু দিল। সোহা মিষ্টি কণ্ঠে বলল,
'লাভ ইউ মামনি।'
.
.
.
চলবে..........................................................................