কামিনী - পর্ব ১২ - মম সাহা - ধারাবাহিক গল্প


 রাজা হ্যাভেন.. ক্যামিলাস রাজ্যের সবচেয়ে শক্তিশালী এবং বুদ্ধিমান রাজা। যারা ছায়াতলে একটি নিবিড় রাজ্য পরিচালিত হচ্ছে৷ প্রজাদের সবচেয়ে পছন্দের রাজা। প্রজাদের প্রাণ বলা যায় রাজা হ্যাভেন। ঘোলাটে চোখের, সুঠামদেহী পুরুষটি তার বৈঠক খানায় প্রবেশ করল বুক ফুলিয়ে। সাহসের সাথে। আত্মবিশ্বাসে পরিপূর্ণ তার দেহ। 
সকলের মাঝে প্রবেশ করে গিয়ে বসল রাজ সিংহাসনে। দৃষ্টি তার উপস্থিত সকলের উপর। ঝমঝমে কণ্ঠের স্বর,
"প্রিয়, শ্রদ্ধেয় সকলে, আমার রাজ্যে আসার জন্য সকলকে কৃতজ্ঞতা। আমার ভালোবাসা নিবেন।"

সকলে হাসিমুখে সেই ভালোবাসা গ্রহণ করলেও রানির বাজের ন্যায় দৃষ্টি তীক্ষ্ণ ভাবে ঘুরে বেড়াতে লাগলো রাজার দেহে।
 রাজা বসতেই তার পাশেই একটি খাঁচা রাখা হলো। খাঁচাটিতে উড়ে বেড়াচ্ছে একটি সাদা পায়রা। কী সুন্দর করে খাঁচার চারপাশে ঘুরে বেড়াচ্ছে। রাজা হ্যাভেনের সাথে সাথে এই পায়রাটিকেও রানি চেনেন। এই পায়রাটির মতনই একটি পায়রা রানির কাছে আছে। হ্যাভেনই দিয়েছিল তাকে। 
 সন্দেহ হয় সেনাপতি হ্যাব্রোও। সে কিঞ্চিৎ মাথা ঝুকিয়ে রানির কানে ফিসফিস করে বলল, "রানি কামিনী, পায়রাটা ভীষণ পরিচিত মনে হচ্ছে।"

রানির ধ্যান ভাঙে হ্যাব্রোর কথায়। তিনি কিছুটা চমকেও যান হ্যাব্রো পায়রাটি চিনে ফেলেছে ভেবে। কিন্তু হ্যাভেনের চতুরতার কথা তিনি বলেন না সেনাপতিকে। বরং স্বাভাবিক কণ্ঠেই জবাব দেন,
"পৃথিবীর প্রতিটি পায়রাই দেখতে এক। তাই একে বিশেষ ভাবে পরিচিত মনে হওয়ার কারণ নেই।"

 "কিন্তু রানি আপনি খেয়াল করে দেখবেন পৃথিবীর প্রতিটি পায়রা এবং এই পায়রার ভেতর পার্থক্য রয়েছে। পায়রাটির চোখ গুলো দেখুন নীল। গলাতেও নীল রঙের একটি কী যেন আছে। মূল্যবান কোনো পাথর মনে হচ্ছে।"

রানি এবার সত্যি সত্যি অবাক হলেন। সত্যিই তো! পায়রাটির চোখ দু'টো নীল। গাঢ় নীল। গলাতেও একটি নীল পাথর আছে। পরানো হয়েছে সেটি। রানি এবার নিজের কাছে থাকা পায়রাটিকে কল্পনা করার চেষ্টা করলেন। তার নিজের পায়রাটির চোখগুলো কোন রঙের তা মনে করার চেষ্টা করলেন। কিন্তু ঠিক মনে পড়লো না। 
তন্মধ্যেই হ্যাব্রো বলল, "মনে পড়েছে। আপনার পায়রাটিও ঠিক এমন।"

 হ্যাব্রোর কথায় হতচকিত হলেন রানি। কপাল কুঁচকে বললেন, "আমার পায়রাটি এমন বলতে?"

 "আপনার পায়রাটিরও চোখদুটো নীল। সেদিন দেখেছিলাম।"

"তাই কি!"

 "আপনি পায়রাটি খেয়াল না করেই এনেছিলেন! তাছাড়া আপনার পায়রার খাঁচাটি এবং রাজার খাঁচাটিও যে ভীষণ মিল।"

রানি খেয়াল করলেন হ্যাব্রো ঠিক বলছে। আসলেই খাঁচা দুটোও ভীষণ মিল। রানি কথা ঘুরালেন। মিথ্যে বললেন,
"মিল হতেই পারে। হয়তো একই বিক্রেতা আমাদের কাছে পায়রা বিক্রি করে ছিলেন।"

 হ্যাব্রো যদিও আর কোনো প্রশ্ন করল না কিন্তু তার মনে খচখচ রয়ে গেলো। খাঁচাটি খেয়াল করলেই বুঝা যাচ্ছে স্বর্ণ এবং রৌপ্যের সংমিশ্রণে তৈরি। একজন পায়রা বিক্রেতা এত মূল্যবান খাঁচা তৈরি করার মতন অর্থ কোথায় পাবেন? একজন বিক্রেতার আদৌও এত অর্থ থাকে? 
এতশত প্রশ্নের উত্তর আর জানা হলো না হ্যাব্রোর। 

 রাজা হ্যাভেন সগর্বে বলল, "আপনাদের রাজ্যের সাথে আমি সুসম্পর্ক গড়তে চাই। এবং সেই জন্যই আমি আপনাদের এখানে আমন্ত্রণ করেছি। এখানে মোট তিনদিন আপনারা থাকবেন এবং সমগ্র উপভোগ করবেন। আপনাদের মনোরঞ্জনের জন্য বিভিন্ন আয়োজন করা হয়েছে।"

রাজা হ্যাভেনের কথা থামতেই উপস্থিত অপরজন রাজা বললেন, "বাহ্! তা কী কী আয়োজন করেছেন?"

 রাজা হ্যাভেন তার মন্ত্রীকে ইশারা করতেই মন্ত্রী পরপর বলতে লাগলেন, "ঘোড়া দৌড়, বাঈজী ঘর, তীর নিক্ষেপ, নারীদের জন্য বাগানবিলাস ইত্যাদি।"

 "নারীদের জন্য কেবলই বাগান বিলাস? পুরুষদের জন্য যদি বাঈজির ব্যবস্থা থাকে তাহলে নারীদের জন্য নয় কেন?" রানি কামিনীর উদীপ্ত কণ্ঠস্বর। ঝলমলে হাসি। 
রানি কামিনীর কথায় ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেলেন উপস্থিত সকলে। উপস্থিত কিছু কিছু রানি এবং রাজকন্যা তো মুখ চোখ কুঁচকে ছি করে উঠলেন। 
সকলে অবাক হলেও অবাক হলো না রাজা হ্যাভেন। সে-ও রানির ন্যায় বাঁকা হেসে বলল, "আপনার জন্যও বাইজি ঘরের ব্যবস্থা করা কয়েছে, রানি কামিনীকাঞ্চন। চিন্তা করবেন না।"

হ্যাভেনের কথায় চমকে উঠলেন সকলে দ্বিতীয়বার। দক্ষিণ রাজ্যের এক রাজা তো ঘোর বিরোধিতা করে বললেন,
"কী বলছেন, রাজা হ্যাভেন? একজন রানি কি-না আমাদের সাথে বসে বাইজি নৃত্য দেখবেন?"

 রানি কামিনী জবাব দিলেন না। হ্যাভেন কী বলে সেটা দেখার অপেক্ষাতেই আছেন তিনি। কিন্তু হ্যাভেনও এক্ষেত্রে নিজের চতুরতার পরিচয় দিল, বলল, "কেন নয়? রানি অভ্যস্ত।"

সেই রাজা মানতে নারাজ। বুক ফুলিয়ে গর্বের সাথে বললেন, "আমি রাজা প্রতাপ কখনো কোনো নারীর সাথে বসে বাইজি নৃত্য দেখিনি এবং দেখবোও না।"
 কথাটি বলেই গর্বের সাথে হাসলেন। তার হাসিকে রানি চূর্ণবিচূর্ণ করে দিয়ে বললেন, "নারীর সাথে বসে বাঈজি নৃত্য আপনি দেখবেন না বুঝলাম। এতে আপনার সম্মান যাবে। তা একজন বাঈজিও তো নারীই! তার নৃত্য দেখতে সম্মানে লাগবে না? এবং যেই দাসীগুলোর সাথে রাত্রি যাপন করেন তাদের সাথে কীভাবে রাত কাটান? তারাও তো নারী!"

রাজা প্রতাপ হুঙ্কার দিয়ে উঠলেন। রাগে, ক্ষোভে কাঁপতে লাগল তার পা। তিনি ভয়ংকর ক্রোধের সাথে বললেন,
 "সবকিছুর সাথে সবকিছু মেলানো যায় না। তাছাড়া আপনি পুরুষের সমকক্ষ হয়ে বাইজি নৃত্য দেখবেন যে, তা পুরুষের সমকক্ষ হয়ে তীর নিক্ষেপ করতে পারেন তো? ঘোড়া দৌড়?"

 রাজা প্রতাপের এহেন প্রশ্নে বড়ো অবহেলাতেই হাসলেন রানি। সেই হাসির ভেতরও কেমন মন্ত্রমুগ্ধ সুর। উপস্থিত কত পুরুষ সেই হাসিতে ভুলে গেলেন দিক। কত নারীও তাকিয়ে রইল ড্যাবড্যাব করে। 

 "রানি কামিনীকাঞ্চনকে নিয়ে আপনার জানা বাকি, রাজা প্রতাপ। তাছাড়া রানি কামিনীকাঞ্চন কখনো পুরুষের সমকক্ষ হতেও চান না। কারণ আমি জানি আমি সর্বশ্রেষ্ঠ। তাই অন্যের মতন হওয়ার কোনো আবশ্যকতা আমার নেই। অন্তত কোনো পুরুষের মতন তো নয়ই! যে পুরুষ নারীকে হেয় করে।"

 "আপনার এত স্পর্ধা! আপনি কার সাথে কথা বলছেন জানেন?"

 "উত্তেজিত হচ্ছেন কেন, রাজা প্রতাপ? কখনো বোধহয় ভাবেননি কোনো নারী আপনার মুখের উপর কথা বলবে তাই না?"

রাজা প্রতাপ আর রানির সাথে কোনো বাক্যব্যয় করলেন না। কেবল হনহনিয়ে বেরিয়ে গেলেন বৈঠক ছেড়ে। রানি কামিনী সেদিকে তাকিয়ে কুটিল হাসলেন। হ্যাভেনের দিকে তাকিয়ে ভারি কণ্ঠে বললেন, 
 "আপনার নিশ্চয় আমাকে নিয়ে অভিযোগ নেই, রাজা হ্যাভেন?"

হ্যাভেন এতক্ষণ সবটা চুপচাপ পরখ করছিলো। রানির প্রশ্নে সে বেশ সহজ ভাবেই জবাব দিল, "একদমই নেই। আমি বরং আপনার এমন আচরণে মুগ্ধ হলাম।"

রানি আর কিছু বললেন না। কারণ তার মনে হলো হ্যাভেন খুব সহজ মানুষ নয়। অন্যান্য রাজাদের মতন তাকে বোকা বানানো সহজ নয়।

 ১৫...

রানি কামিনীকে থাকতে দেওয়া হলো যেই কক্ষটিতে সেটি অপরূপ সুন্দর। তবে কক্ষটির রঙ লাল। কী সুন্দর করে সাজানো হয়েছে কক্ষটিকে! চারপাশ ঘেরা সুন্দর, রঙিন ফুল। বোঝায় যায় খুব কড়া পর্যবেক্ষণে সাজানো রুমটি। 
 তখনই রুনুঝুনু নূপুরের ছন্দ তুলে উপস্থিত হলো কেউ। রানি প্রথমে ভেবেছিলেন যামিনী এসে হয়তো কারণ যামিনীও উনার সাথে আজ এই রাজ্যে উপস্থিত হয়েছে। কিন্তু রানিকে অবাক করে দিয়ে উপস্থিত হলো একটি অপরিচিত নারী। সুন্দর দেখতে নারীটির মুখ। তিনি দরজায় এসে অনুমতি নিলেন ভেতরে প্রবেশ করার জন্য। রানি অনুমতি দিতেই সেই নারীটি ভেতরে প্রবেশ করল। নারীর চোখে-মুখে উচ্ছ্বাস বড়ো। রানিকে যেন সে কত বছর যাবত চেনে!

সেই নারীটি উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে বলল, "আপনি তো রানি কামিনীকাঞ্চন! আমি বড়ো দিন অপেক্ষা করেছি আপনাকে দেখার জন্য।"

 রানি শুধালেন, "আমাকে দেখার জন্য? কেন?"

"লোক মুখে শুনেছিলাম আকাশে যদি একটি চাঁদ থাকে, মাটিতেও একটি চাঁদ আছে। আর সেই চাঁদের নাম রানি কামিনীকাঞ্চন।"

নারীটির সহজ-সরল বচন ভঙ্গিতে কিছুটা কৌতূহলী হলেন রানি। নিপাট হেসে বললেন, "লোকে কেবল এতটুকুই বলেছে? আর কিছু বলেনি?"

 "আরও তো কতকিছুই বলে লোকে।"

 "সেই কতকিছুটা কী?"

রানির প্রশ্নে কথা ঘুরিয়ে নেয় সেই নারীটি। হাসি হাসি মুখে বলে, "থাক না সেসি। আমার কাছে কেবল এতটুকুই সত্য যে, আপনি এখন আমার সামনে আছেন। আপনাকে আমি ছুঁতে পারছি।"

 "আপনি তো দাঁড়িয়ে রইলেন এক হাত দূরে। ছুঁলেন আর কোথায়?"

রানির বাক্যে আশকারা পেতেই নারীটি ছুটে গেলো। রানির একটি হাত চেপে ধরলো নিজের হাতের মুঠোয়। মিষ্টি হেসে বলল,
"এই যে ছুঁয়ে দিলাম। এবং বুঝলাম, লোকের বলা সব কথা সঠিক নয়। লোকে সব বললেও এটা বলেনি যে, রানি কামিনীর একটি সুন্দর মন আছে।"

 এই উচ্ছ্বসিত, নিজের বয়সের থেকে ছোটো মেয়েটির দিকে তাকিয়ে রইলেন রানি। কী সুন্দর মেয়েটি আপন করে নেওয়ার শক্তি রাখে নিজের ভেতরে! রানি আগ্রহী হলেন। জিজ্ঞেস করলেন,
"আপনার পরিচয়টা ঠিক জানলাম না!"

 "আমি রানি ইথুন। রাজা হ্যাভেনের স্ত্রী।" কথাটা কর্ণগোচর হতেই রানি চমকে উঠলেন।
 কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে বললেন, "রাজা বিবাহিত!"
.
.
.
চলবে..........................................................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

WhatsApp