মাই মিস্টিরিয়াস প্রিন্স - পর্ব ৩৭ - মৌমিতা মৌ - ধারাবাহিক গল্প


অনন্যা রাস্তার ধারে খালি পায়ে দাঁড়িয়ে আছে। একটু আগে তাড়াহুড়ো করে হাঁটতে গিয়ে আবারো পা মচকে যায় তার। আর বছরখানেক আগের পুরোনো এক জোড়া জুতো একসঙ্গে ছিঁড়ে যায়। আরণ্যক ঠিক পিছনেই ছিল, তাই ওসব নিয়ে বেশি ভাবার সময় পায়নি অনন্যা। জুতো দুটো রাস্তায় ফেলেই সামনে হাঁটা ধরেছিল তখন।

এখন কোথায় এসে দাঁড়িয়েছে, সেটাই বুঝতে পারছে না অনন্যা। চারপাশে উঁচু বিল্ডিংয়ের সারি, মাঝে মাঝে উড়ে আসা গাড়ির হর্ন, হেঁটে যাওয়া দু একজন পথচারী। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পর একটা বয়স্ক লোককে থামিয়ে জায়গা জেনে নিলো সে। ব্যাগ থেকে ফোন বের করে ভাবলো তামংকে ফোন দেবে। কিন্তু আঙুল স্ক্রিনে পড়তেই এক ঝটকায় ফোনকে আঁকড়ে ধরে রাখা হাত দুটো থেমে গেল।

'Sir' নামটা জ্বলজ্বল করছে স্ক্রিনে। নিচে বড়, লাল হরফে লেখা ৪৫টা মিসড কল।

ঢোক গিললো অনন্যা। স্যার এতবার ফোন করেছে? অথচ সে একবারও শুনতে পায়নি! এখন লোকটা নিশ্চয়ই খুব রাগে আছে?

পায়ের নিচের রুক্ষ কংক্রিট হঠাৎ আরও কঠিন হয়ে উঠলো। অনন্যার পায়ের পাতা গরম হয়ে গেলো। সে ধীরে ধীরে কৌশিক স্যারকে কল করে ফোনটা কানে চেপে ধরলো। প্রায় দুই সেকেন্ডের মধ্যে কল রিসিভ করলো কৌশিক আর গম্ভীর স্বরে সোজা প্রশ্ন করে বসলো,
'কোথায় আছো?'

অনন্যা এড্রেস জানালো। কৌশিক এরপর একটা শব্দও উচ্চারণ করলো না। ঠাস করে ফোন কেটে দিলো। হতবাক হয়ে ফোনের স্ক্রিনে তাকিয়ে রইলো অনন্যা। ঠাণ্ডা আলোয় ভেসে থাকা স্ক্রিনের অন্ধকারে নিজের প্রতিচ্ছবিটাই কালো করে দেখতে পেলো সে। নিজের মনকে নিয়ে নিজেই দ্বিধায় ভুগছে অনন্যা। এই মন জিনিসটা কেনো থাকে মানুষের? কেনো ভালোবাসতে হয় কাউকে? আর কেনই বা কষ্ট পেয়ে কাঁদতে হয়?

পাশের এক বিল্ডিং থেকে ভেসে আসছে কর্কশ স্পিকারের গান,

হার কিসিকো নেহি মিলতা ইয়াহা পেয়ার জিন্দেগি…

লাইনটা অনন্যার বুকের গভীরে ছুরির মতো গেঁথে গেল। মনে হলো, কারও অদৃশ্য হাত তার শ্বাসরোধ করছে। আরণ্যকের জন্য ওর নিজেরই কষ্ট হচ্ছে। 

একটি মুদ্রার দুই পিঠ থাকে। মানুষও কি তেমনি নয়? এক সম্পর্ক, এক ঘটনা, দুই ভিন্ন দৃষ্টিকোণ। আরণ্যকের প্রেমে পড়াটা ছিল একদম ভিন্নভাবে,একতরফা অনুভূতি, যার ভার সে নিজেও টের পায়নি। অথচ অনন্যার কাছে সম্পূর্ণ ঘটনাটি একটা সিনেমার ডিলিটেড সিনের মতো। এখন মনে হচ্ছে, আরণ্যক যদি ওর জীবনে নাই আসত, তাহলে হয়তো এতটা কষ্ট পেতে হতো না তাকে।

হাতের তালুতে নখ বসিয়ে দাঁড়িয়ে রইল অনন্যা। শীতল বাতাস ওর চুলের গোছা উড়িয়ে আনমনে খেলতে থাকলো। মনে পড়লো কিছুক্ষণ আগের কথা।

আরণ্যক তখন বলেছিলো,
'দেখতে চাই সেই ভাগ্যবান পুরুষকে, যে তোকে বিয়ে করেছে! দেখতে চাই সেই ভাগ্যবান পুরুষকে যে তোকে আমার কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়েছে। দেখাতে পারবি?'

অনন্যা স্থির দাঁড়িয়ে ছিল তখন। কয়েক মুহূর্ত নির্বাক থেকে ধীরে ধীরে পিছন ফিরে আরণ্যকের দিকে তাকাল। এগিয়ে গেলো ধীরে ধীরে, মুখে অল্প হাসি ফুটিয়ে বলেছিল,
'কি দরকার? শুধু শুধুই কষ্ট পাবে তুমি!'

আরণ্যকের মুখের হাসি মুহূর্তেই মুছে গেল।মনে হলো কেউ এক ঝটকায় সব আলো নিভিয়ে দিয়ে গেছে। চোখে নিঃশব্দ এক আকুতি। সে অস্থিরতার সাথে বলেছিলো,
'এতোই কি মহান সে? এতোই কি হ্যান্ডসাম যে আমি দেখতে পারবো না তাকে? তারপর ও আমি দেখতে চাই, অনন্যা! কষ্টে আমার চোখ দুটো ঝলসে গেলেও যাক, তাও একবার আমি তাকে দেখতে চাই।'

অনন্যা একটা গভীর দীর্ঘশ্বাস ফেলল।
'আমি চাই না তোমার কষ্ট বাড়াতে। বলেছিলাম না? তুমি ভুল মেয়ের প্রেমে পড়েছো। ভুল মেয়েটা তোমাকে অনেক কষ্ট দিয়েছে, ভাইয়া। আর না।'

'তুই মিথ্যে বলছিস। তাই তো দেখাতে পারবি না। কারণ তোর কেউ নেই। থাকলেই তো দেখাতি। আমি জানতাম...!'

অনন্যা ঠান্ডা গলায় উত্তর দিলো,
'আমি তোমাকে জোর করে বিশ্বাস করাতে পারবো না, আরণ্যক ভাইয়া। কিন্তু মনে আছে, একদিন বলেছিলাম আমি আর মামার বাসায় থাকি না? মনে থাকার কথা। ওই বাসায় থাকি না কারণ আমি আমার বরের বাসায় থাকি।'

একটা মুহূর্তের বিরতি নিল অনন্যা। চোখ নামিয়ে নিল সামনের রাস্তায়। তারপর আবার বলল,

'আমাকে নিয়ে দুশ্চিন্তা বন্ধ করো। নিজের দিকে খেয়াল দাও। আগের মতো হয়ে যাও, ভাইয়া। আমি চাই, যেদিন হুট করে তোমার সঙ্গে আবার দেখা হয়ে যাবে, সেদিন ঠিক দুই বছর আগে প্রথম দেখা হওয়ার মত প্রাণোচ্ছল থাকো। তোমাকে সেভাবেই মানায়। আমার মতো খারাপ একটা মেয়ের জন্য তুমি নিজেকে হারিয়ে ফেলছো... এরকম তোমার স্বভাবে যায় না।'

তারপর এক শ্বাসে বলে গেল,

'আর হ্যাঁ, আমিও তোমাকে মিস করি। আমিও তোমাকে মনে করি। কিন্তু সেই ভুল বোঝাবুঝির পর মনটা তেতো হয়ে গিয়েছিল। রাগের মাথায় তোমাকে কিছুই জানাইনি। তারপর একসময় এই অনুভূতিগুলো কোথায় যেন হারিয়ে গেল। এখন নিজের মনকেই ঠিক বুঝতে পারছি না। তোমাকে কী বলব বলো?'

অনন্যা চোখ তুলে তাকাল আরণ্যকের দিকে, গলার স্বর গাঢ় হয়ে এল,

'আমার বিয়ে হয়েছে। আমি এভাবে তোমার এক বলাতে একজনকে ছেড়ে আসতে পারি না। এটা তুমি জানো, তুমিও বোঝো, তাই না? যদি ছেঁড়ে চলেও আসি! তখন না আমি নিজে নিজেকে মানতে পারবো, না সমাজ আমাকে মানবে। তাই প্লিজ, আমার চিন্তা বন্ধ করে নিজের খেয়াল রেখো। ভালো থেকো।"

অনন্যা চিন্তায় ডুবে ছিল, হঠাৎ দৃষ্টি চলে গেল সামনের রাস্তায়। আচমকা গরম বাতাসের ঝাপটা লাগলো মুখে, সঙ্গে তীব্র ব্রেকের শব্দ। একটা গাড়ি প্রচণ্ড গতিতে ছুটে এসে তার সামনে দাঁড়াল। অনন্যার পা আপনাতেই কয়েক ইঞ্চি পিছিয়ে গেল। গাড়িটা চেনে সে। প্রতিদিনই দেখা হয়, কখনো দূর থেকে, কখনো বা কাছ থেকে। আজও চিনতে ভুল হলো না। গাড়ির দরজা খুলে ধীর, নিশ্চুপ হয়ে নেমে আসলো কৌশিক স্যার।

কৌশিক একদম অনন্যার কাছে এসে দাঁড়াল। চোখে তার স্থির দৃষ্টি, সুন্দর মুখশ্রী হালকা আলোতে অন্ধকার দেখাচ্ছিল যেখানে কোনো অনুভূতির অস্তিত্ব আছে কিনা বোঝা বড় দায় হয়ে পড়েছে, লোকটার কণ্ঠস্বর কেমন ধাতব ঠান্ডা শোনালো,

'কি করছিলে এখানে?'

অনন্যা থমকে গেল। ঢোঁক গিলে শব্দ সাজাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। সে আমতাআমতা করে বলল,

'আসলে... আমি নোহারার সাথে...!'

কথাটা শেষ করতে পারল না অনন্যা। কৌশিকের ভ্রু কুঁচকে গেল, ঠোঁট টাইট হয়ে এল। সে গম্ভীর স্বর এই উচ্চারণ করল,
'সেটা জানি। কিন্তু তোমার বান্ধবী কোথায়? এখানে একা একা কি করছো?

অনন্যা মাথা নিচু করে পায়ের দিকে তাকালো। কৌশিক এক মুহূর্ত অনন্যার দিকে তাকিয়ে রইল, তারপর তার চোখ অনন্যার চোখ অনুসরণ করলো। দৃষ্টি নামল নিচের দিকে। খালি পা। ধুলো মাখা, ক্লান্ত পা দুটো দেখে কিছুক্ষণ চুপ করে রইল সে। তারপর গভীর শ্বাস ফেলে এক ঝটকায় সামনে এগিয়ে এলো।

অনন্যা কিছু বুঝে ওঠার আগেই নিজেকে পেলো কৌশিকের বাহুতে। বিস্ময়ে বড় বড় চোখে তাকালো অনন্যা। কৌশিক কোনো কথা বলল না, চুপচাপ হালকা ঝাঁকি দিয়ে অনন্যাকে কোলে তুলে নিলো।

গাড়ির সামনে পৌঁছে দরজা খুলতে গিয়ে একটু ঝুঁকতে হলো কৌশিককে। সেই মুহূর্তে হালকা ঠান্ডা বাতাসের সাথে অনন্যার উষ্ণ নিঃশ্বাস ছুঁয়ে গেল তাকে। আর তক্ষুনি কৌশিক থমকে গেল। তার নাক ছুঁয়ে গেল অনন্যার গাল। নিঃশব্দে কোথাও কিছু একটা বদলে গেল। দ্রুত তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে অনন্যার চোখে চোখ রাখল সে, গভীরভাবে, স্থির হয়ে তাকালো মেয়েটার দিকে। অনন্যা কৌশিকের আচরণে কোনো কিছু আন্দাজ করতে পারছে না।

তারপর, আবারো কিছু বুঝে ওঠার আগেই অনন্যাকে নিচে নামিয়ে দিলো কৌশিক। অনন্যার খালি পায়ের তালু কংক্রিটের রাস্তা ছুঁয়ে গেলো। কৌশিক অপেক্ষা করলো না, নিজের ডান হাত দিয়ে গাড়ির ছাদে জোরে আঘাত করলো, খুব শব্দ করে আওয়াজ হলো। 
কৌশিক দাঁত কিড়মিড়িয়ে বললো,
'হু ইজ হি?

অনন্যা চমকে উঠলো। ভ্রু কুঞ্চিত করে বললো,
'মানে?

'তুমি জানো আমি কি জিজ্ঞেস করেছি। কে সে?

অনন্যা প্রশ্নবিদ্ধ চাহনি নিয়ে উচ্চারণ করলো,
'আমি সত্যিই বুঝতে পারছি না আপনি কি বলছেন! 

কৌশিক মাথা নাড়িয়ে হাসলো। আচমকা কাছে এগিয়ে অনন্যার গাল চেপে ধরে বললো,
'তোমার দেহে অন্য কারো স্পর্শ পেয়েছি আমি। কে? আরণ্যক? বলেছিলাম না... ওই ছেলেটা থেকে দূরে থাকতে? হুম? তাও কেনো আবারো ওর সাথে....হাহ!

অনন্যা কিছু বলতে গিয়েও বলতে পারলো না। কৌশিক এক ঝটকায় অনন্যার গাল ছাড়লো। গাড়ির দরজা খুলে অনন্যাকে শক্ত করে ধরে টেনে ভিতরে বসিয়ে দিলো। অনন্যা কিছু বলার চেষ্টা করছিল, কিন্তু ঠোঁটের কাছে শব্দগুলো কেমন গুলিয়ে আসছিল। পাশ থেকে কৌশিক ভিতরে ঢুকে দরজা ধাক্কা দিয়ে বন্ধ করলো, তারপর স্টিয়ারিংয়ে শক্ত করে হাত রেখে গাড়ি চালানো শুরু করলো।

গাড়ির গতি বাড়তে থাকল, কৌশিকের চোখ দুটো সামনের রাস্তায় স্থির হয়ে আছে, কিন্তু মুখশ্রী এমন কঠোর যে দেখে মনে হচ্ছে এক মুহূর্ত কারও কথা শুনতে রাজি নয় সে। অনন্যা তাও কাঁপা কাঁপা গলায় বলল,
'স্যার, শুনুন তো! প্লিজ, আমার একটা কথা...'

কোনো জবাব এল না।

কৌশিক গাড়ি নিয়ে বাসায় পৌঁছালো। গাড়ি ব্রেকের বিকট শব্দ তুলে এক ধাক্কায় থেমে গেলো বিশাল প্রাচীরঘেরা বাড়ির সামনে। কৌশিক দরজা খুলে নেমে পড়লো, গার্ডের দিকে গাড়ির চাবি ছুঁড়ে দিয়ে ঠান্ডা গলায় বলল,
'গ্যারেজে পার্ক করো।'

তারপর অনন্যাকে টেনে বের করলো। টানতে টানতে নিয়ে গেলো বাড়ির ভেতরে। দ্রুত পায়ে বাড়ির ভেতর ঢুকে সরু করিডোর পার হয়ে সোজা বাথরুমের দরজা ঠেলে খুলে দিলো সে।
অনন্যা কাঁপা কাঁপা গলায় বলে উঠলো,
'আমার ব্যাগ!

কৌশিক এক ঝটকায় অনন্যার ব্যাগের ফিতা টেনে খুলে ঘরের এক কোণে ছুঁড়ে ফেললো। ধাতব চেইনের শব্দে ঘর কেঁপে উঠলো। অনন্যার শরীর একদম শক্ত হয়ে গেলো, চোখ বিস্ময়ে বড় হয়ে গেলো। পরের মুহূর্তেই কৌশিক তার ওড়নায় টান দিলো। অনন্যা এক হাত দিয়ে গলার কাছের ওড়নাটা শক্ত করে চেপে ধরে বললো,
'স্যার, প্লিজ!'

কৌশিক বিরক্তের সাথে অনন্যার ওড়না ছেড়ে দিলো। কোনো সুযোগ না দিয়েই শক্ত হাতে অনন্যার কব্জি চেপে ধরলো, নিয়ে গেলো বাথরুমের ভেতর। অনন্যা বলতে লাগলো,
'স্যার, কি করতে চাইছেন আপনি? বলুন তো।

কৌশিক কোনো প্রশ্ন কানে নিলো না। অনন্যাকে শাওয়ারের নিচে দাঁড় করিয়ে পানি ছেড়ে দিলো। শাওয়ার খুলতেই ঠান্ডা পানির ধাক্কায় অনন্যার দেহ শিউরে উঠলো। হঠাৎ এমন বিস্ময়কর পরিস্থিতিতে পড়ে সে নিজেকে সামলাতে পারছিল না। কাপড় ভিজে গায়ের সঙ্গে লেপ্টে গেলো। চুল বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়তে লাগলো।

কণ্ঠে রাগ আর বিস্ময় মিশিয়ে চিৎকার করলো অনন্যা,
'কী সমস্যা আপনার? এই রাত করে আমি গোসল করবো?'

কৌশিক এক পা সামনে বাড়ালো। ভিজে শার্টের হাতা মোড়ানো, চোখে আগুন জ্বলছে। এক হাতে সাবানের টুকরো তুলে নিয়ে অনন্যার গালে জোরে সাবান ঘষে দিলো, সাবানের ফেনা গড়িয়ে পড়তে লাগলো তার গাল বেয়ে।

কৌশিক ঠান্ডা গলায় বলল,
'তোমার শরীরে আবর্জনা লেগে আছে। সব ধুয়ে ফেলো।'

স্যারের কণ্ঠস্বরটি এতটাই ঠান্ডা ছিল যে অনন্যা কিছুক্ষণ স্থির হয়ে গেলো। কোন শব্দ উচ্চারণ করতে পারল না। নিশ্চুপ হয়ে পানির স্রোতের নিচে দাঁড়িয়ে থাকলো।এই ঠান্ডা পানির স্রোতের থেকেও বেশি কাঁপুনি ধরিয়ে দিয়েছিলো স্যারের শীতল কণ্ঠস্বর।

কৌশিক অনন্যার হাতে সাবান ধরিয়ে দিয়ে বললো,
'সময় নিয়ে গোসল সেরে বেরিয়ে আসো। আমি অপেক্ষা করবো।'

কিছুক্ষণ পর কৌশিক আবারো ফিরে এল। নিঃশব্দে শুকনো জামাকাপড় নির্দিষ্ট স্থানে রেখে বেরিয়ে গেলো, একবারও পিছনে ফিরে তাকালো না। অনন্যা তখনো নিথর দাঁড়িয়ে, গায়ের ভেজা কাপড় শরীরের সঙ্গে সেঁটে গেছে, ঠান্ডা লাগছে, কিন্তু তার চেয়েও বেশি জমে আছে একরাশ প্রশ্ন। এই মানুষটাকে কি সে এখনো বুঝতে পারলো না?

••••••••••••

বাসার পোশাক পরে ভেজা চুল পেছনে ফেলেই নিজের রুমে এল অনন্যা। দরজার চৌকাঠ পার হতেই চোখে পড়ল কৌশিককে। বিছানায় বসে ফোনে মনোযোগ দিয়ে কী যেন দেখছে সে। অনন্যাকে দেখে চট করে ফোন রেখে উঠে দাঁড়াল। কোনো কথা না বলে আলমারি থেকে একটা তোয়ালে বের করে আনল, তারপর অনন্যাকে টেনে নিয়ে বিছানায় বসাল।

শব্দহীন অনন্যার চুল মুছে দিতে লাগল কৌশিক। পানি টপটপ করে তোয়ালে ভিজিয়ে দিচ্ছে, কিন্তু গোটা ঘর আধো আধো আলোয়, নীরবতার ভারে আচ্ছন্ন হয়ে আছে।

কৌশিক হালকা স্বরে বলল, 'আমার কথা মেনে চললে এরকম হতো না।'

অনন্যার মুখে কথা নেই। কৌশিক মেয়েটার চুল মুছিয়ে তোয়ালে রেখে আসলো। তারপর মেয়েটার গাল স্পর্শ করে বললো,
'এখন একদম পরিপাটি লাগছে। খিদে পেলে লারাকে গিয়ে বোলো।

কথাটা বলে কৌশিক নিচু হয়ে বসে পড়ল।
অনন্যার ডান পা স্পর্শ করলো। অনন্যা চমকে তার পা সরিয়ে ফেললো। জোরেশোরে বললো,
'আপনি কি পাগল হয়েছেন? পা ধরছেন কেনো?

কৌশিক মাথা না তুলেই বলল,
'তোমার পায়ের মাপ নিচ্ছি। জুতো কিনে আনবো।মেঝেতে পা রাখো।

স্তম্ভিত অনন্যা চুপচাপ মেঝেতে পা রাখল। নিচু হয়ে তাকালো। কৌশিক নিখুঁতভাবে নিজের হাত দিয়ে অনন্যার পায়ের মাপ নিয়ে উঠে দাঁড়ালো। এক মুহূর্ত অনন্যার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল, তারপর কপালে আস্তে করে ঠোঁট ছোঁয়াল।
এক পাশে রাখা চিরুনি তুলে এনে অনন্যার হাতে ধরিয়ে বলল,
'চুল আঁচড়াও। আমি খুব তাড়াতাড়িই ফিরবো।

কথাটা বলে দরজার দিকে এগিয়ে গেল কৌশিক স্যার। অনন্যা নির্বাক হয়ে চিরুনি হাতে নিয়ে সামনে তাকিয়ে রইল।

অনেকক্ষণ পেরিয়ে গেল, কিন্তু অনন্যার মন শান্ত হলো না। মাথায় উল্টোপাল্টা চিন্তা ভিড় জমাচ্ছে, কিছুতেই সেগুলোকে সরাতে পারছে না। নিজেকে ব্যস্ত রাখতে ফোনটা হাতে তুলে নিলো, সোশ্যাল মিডিয়ায় ঢুকে এলোমেলো স্ক্রল করতে লাগল।

হঠাৎ চোখ আটকে গেল ওপরের দিকে ভেসে ওঠা এক মেসেজ নোটিফিকেশনে, আরণ্যকের মেসেজ।

অনন্যার ভ্রু কুঁচকে উঠল। দ্রুত মেসেজটা ওপেন করল।

একটা ছবি। আরণ্যক একটা ছবি পাঠিয়েছে। অন্ধকারাচ্ছন্ন ছবি। অনন্যার চোখ দ্রুত স্ক্রিনের দিকে স্থির হলো। ছবিটা জুম করল সে। ছবিতে দেখা যাচ্ছে, সে নিজে! তার সামনে দাঁড়িয়ে কৌশিক স্যার। আলো কম থাকায় স্যারের মুখ দেখা যাচ্ছে না, কেবল পেছনের দিকটাই ধরা পড়েছে।

শরীর শিউরে উঠল অনন্যার। এটা তো কিছুক্ষণ আগের ঘটনা! কিন্তু আরণ্যক ঠিক তখনই ওদের দেখছিলো? কখন? কোথা থেকে?
অনন্যার আঙুল ধরা ফোনটা ভারী লাগতে লাগলো।

আরণ্যক সেকেন্ডের মধ্যে একটা মেসেজ পাঠালো,
'এটাই কি তোর বর?

অনন্যার আঙুল থমকে গেলো। কি উত্তর দেবে? কী বলা উচিত? ভাবতে লাগলো কিন্তু তার আগেই ফোন কেঁপে উঠলো। আরণ্যকের কল দিয়েছে। কিছুক্ষণ দ্বিধায় আর চিন্তায় থাকলেও শেষ পর্যন্ত কলটি ধরলো অনন্যা।

ওপাশ থেকে শোনা গেলো,
'লোকটাকে পিছন দিক দিয়ে চেনা লাগছিল। অন্ধকার ছিল, সামনে দেখতে পাইনি। এখন বল ব্যাটার নাম কী?

অনন্যার গলা শুকিয়ে গেলো। সে বললো,
'তুমি আমার পিছু কেনো করছিলে?

আরণ্যকের নিঃশ্বাস ভারী শোনালো,
'ওই লোকটা সম্পর্কে না জানা পর্যন্ত শান্তি পাচ্ছি না।

অনন্যা চোখ বন্ধ করে ফেললো। মাথার ভেতর চিন্তাগুলো ঘূর্ণির মতো ঘুরতে লাগলো।
সে বললো,
'বলেছিলাম তো, সময় হলে ঠিকই জানবে।

'কিন্তু....

হঠাৎ একটা প্রচণ্ড আঘাতের শব্দ ভেসে এলো অপর পাশ থেকে। সঙ্গে সঙ্গে আরণ্যকের চাপা আর্তনাদ। আচমকা এমন শব্দ শুনে অনন্যার দম বন্ধ হয়ে আসলো। পরপর কয়েকটা আঘাতের শব্দ কানে বাজলো, আরণ্যকের ব্যথায় ককিয়ে ওঠার শব্দ শুনতে পেলো সে। কানের কাছে সূচালো ভাবে শুনতে পেলো কেউ পা দিয়ে মারিয়ে দিচ্ছে আরণ্যকের ফোন। 

অনন্যা শ্বাস আটকে ফোনের স্ক্রিনের দিকে তাকালো। কলটা কেটে গেছে! মাথা ঝিমঝিম করতে লাগলো ওর। আরণ্যককে কেউ মারছে! কিন্তু কেনো?

দ্রুত বিছানা থেকে নেমে ছুটে দরজার কাছে গেলো, হাত কাঁপতে কাঁপতে দরজা ঠেলে বেরিয়ে এল। সিঁড়ি ধরে ছুটতে ছুটতে নিচে নেমে গেলো। কিছু না চিন্তা করে নিকের রুমের দরজায় পৌঁছে এক মুহূর্তও না ভেবে ঘন ঘন কড়া নাড়লো। ভিতর থেকে কোনো সাড়াশব্দ পাওয়া গেলো না। অনন্যা আরও জোরে আঘাত করলো দরজায়।

কিছুক্ষণ পর দরজাটা খুলে গেলো। নিক উদাস দৃষ্টিতে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
'এনিথিং সিরিয়াস?

অনন্যা ধরা গলায় বললো,
'ফোনে... মানে... আরণ্যককে মানে... কেউ ওকে মারছে...!'

কথাগুলো এলোমেলো হয়ে গেলো অনন্যার কণ্ঠে। নিঃশ্বাস ভারী হয়ে এলো। 
অনন্যা আবারো বললো,
'আমার বন্ধুকে কেউ মারছে। আমি কি করবো, বুঝতে পারছি না।'
.
.
.
চলবে.........................................................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

WhatsApp