বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বিতীয় ভবনের তিন তলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে ইশতেহার কৌশিক। চারপাশে সন্ধ্যার নরম আলো ছড়িয়ে পড়েছে, কিন্তু কৌশিকের ভেতরে আগুন জ্বলছে। অনবরত ফোন করে যাচ্ছে অনন্যাকে, কিন্তু মেয়েটার পক্ষ থেকে কোনো সাড়া নেই। কৌশিকের কপালে চিন্তার ভাঁজ গাঢ় করে পড়লো। গালের মাংসপেশী রাগে টনটন করছে, আঙুলের চাপ ফোনের স্ক্রিনে বেড়ে যাচ্ছে।
একটু আগেই তামংকে ফোন করেছিল। ও জানালো, অনন্যা বান্ধবীর সাথে ঘুরতে গেছে। কৌশিক গভীরভাবে শ্বাস নিলো। না জানিয়ে বেরিয়েছে অনন্যা। শুধু তাই নয়, তামংও কিছু জানায়নি তাকে। যদিও কৌশিক অনন্যাকে এই বিষয়ে কখনো জোরাজুরি করেনি। ছুটির পর যে অনন্যা টিউশনিতে যায় এটা কৌশিক জানে। কিন্তু অন্য কিছু করলে আপডেট দেওয়া নিয়ে কখনো মাথা ঘামায়নি। আজ মনে হচ্ছে, আগেভাগে মাথা ঘামানো উচিত ছিল। তাহলে হয়তো এখন এই দুশ্চিন্তায় পড়তে হতো না।
চোয়াল শক্ত হয়ে গেলো কৌশিকের। ফোনের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষণ। মনে মনে ভাবলো, 'এখন যদি তামংকে ফোন না করতাম, তাহলে তো জানতেই পারতাম না বিষয়টা!'
অনন্যা ফোন ধরছে না। ও কোথায় গেছে, কার সাথে গেছে, সব ঠিক আছে তো? কেন জানি মনের ভেতর অস্বস্তি কাজ করছে। হাতের মুঠোয় ফোনটা শক্ত করে ধরে একবার ভাবলো, নিজেই বেরিয়ে পড়বে কি না অনন্যাকে খুঁজতে। এই চিন্তায় কৌশিকের মাথা গরম হয়ে যাচ্ছে, রাগের তোপ সামলাতে কাউকে বকাঝকা দিতে ইচ্ছে করলো।
রূপালী কবিরের চোখে পড়লো কৌশিককে। সে বাসায় যাওয়ার জন্য নিজের অফিস রুম থেকে বেরিয়েছিল মাত্র। কৌশিককে চিন্তিত অবস্থায় দেখে এগিয়ে এল।
জিজ্ঞেস করলো,
'কি ব্যাপার, কৌশিক স্যার? কি নিয়ে এতো চিন্তিত?'
কৌশিক প্রতিউত্তর করলো না। নিশ্চুপ হয়ে ফোনের কললিস্টে চোখ বুলাতে লাগলো।মোট ত্রিশ বার কল দেওয়া হয়ে গেছে। রিং হচ্ছে, কিন্তু অনন্যা ধরছে না। মেয়েটার সাহস তো কম নয়! কৌশিককে ইগনোর করছে, অনন্যা? দাঁতের চোয়াল শক্ত হলো কৌশিকের, তপ্ত নিঃশ্বাস ফেললো সে।
রূপালী আরেকটু এগিয়ে এসে বললো,
'এক্সকিউজ মি! আপনি কি এখন বাসায় যাচ্ছেন না? অফিস টাইম তো শেষ!'
'হ্যাঁ যাবো।'
কৌশিক অন্যমনস্ক স্বরে বললো।
'আমিও যাচ্ছি। কিন্তু আমার গাড়িটা নষ্ট হয়ে গেছে। তো বলছি, আপনি কি....!
কৌশিক রূপালীকে বাক্য শেষ করার সুযোগ দিলো না। কিছু না বলে সোজা হাঁটা দিলো। রূপালী বিরক্ত হলো, তবুও কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে কৌশিকের পিছু নিলো। কিছুক্ষণ পর কৌশিকের পিছু পিছু সিঁড়ি দিয়ে নিচতলায় নেমে এলো সে। কিন্তু নিচে নেমেই থমকে দাঁড়ালো রূপালী। চোখের সামনে দেখা যাচ্ছে ফাঁকা দুই তলার বারান্দা আর কক্ষগুলো, কিন্তু দেখা গেলো না বিদেশি প্রফেসরকে।
একটু আগেই তো কৌশিককে উপর থেকে এখানে নামতে দেখেছে রূপালী! কয়েক সেকেন্ডের ব্যবধানে কোথায় গেলো সে? রূপালী চারপাশে তাকিয়ে খোঁজার চেষ্টা করলো। কিন্তু কৌশিক কোথাও নেই! তাই মুখ থেকে বিরক্তিকর শব্দ করে নিচে নেমে গেল সে।
•••••••••••••
চারপাশের কোলাহলে অনন্যা খেয়ালই করেনি যে, ওর ব্যাগে থাকা ফোনটা বারবার কাঁপছে। রিংটোনের শব্দ বাতাসে মিলিয়ে হারিয়ে গেছে হাসি-ঠাট্টার ভিড়ে। কিন্তু অনন্যার মনোযোগ এখন অন্য কোথাও, সরাসরি সামনে দাঁড়িয়ে থাকা আরণ্যকের দিকে। আরণ্যক সবার জন্য হালকা খাবারের আয়োজন করেছিল। অনন্যার থাকতে ইচ্ছে হয়নি, কিন্তু ছেলেটা ওর হাতটা একবারের জন্যও ছাড়ছিল না।
আরণ্যক ধীরে ধীরে স্টেজে উঠলো। গলার কাছে মাইক্রোফোন আটকে নিলো সযত্নে। আশপাশের কথাবার্তা ধীরে ধীরে স্তিমিত হতে থাকলো। একে একে সবাই ওর দিকে মনোযোগ দিলো। সন্ধ্যার আলো-আঁধারিতে, মৃদু বাতাসের ছোঁয়ায়, আরণ্যককে আরো উৎফুল্ল দেখাচ্ছিলো।
আরণ্যক মৃদু হেসে বললো,
'অনেকেই জানেন, আবার অনেকেই জানেন না আজকের এই পার্টি কীসের জন্য!'
একটু থামলো ও। হাসলো। তারপর চোখ ঘুরিয়ে নিলো সকলের মাঝে।
'যারা জানেন না, তাদের জন্য বলছি, এই পার্টি আমার একজন ‘প্রিয় মানুষ’ এর জন্য। আমার ভালোবাসার মানুষকে আমার মনের কথা বলার জন্য।'
আরণ্যকের এসব কথা শুনে অনন্যার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসার উপক্রম হলো। শরীর নিস্তেজ লাগছে তার।
আরণ্যক বলা শুরু করলো,
'ভার্সিটিতে ভর্তি হওয়ার পর অনেকের সাথে পরিচিত হয়েছি। নতুন সম্পর্ক গড়েছি, কিছু মজবুত হয়েছে, কিছু এখন ফিকে হয়ে গেছে। সিনিয়রদের সাথে, শেষ বর্ষের শিক্ষার্থীদের সাথে, এমনকি যারা এখন কর্মজীবনে আছে, তাদের সাথেও যোগাযোগ ছিল। ছোটবেলা থেকেই মাল্টি-ট্যালেন্টেড হওয়ার চেষ্টা করেছি। নতুন কিছু জানার তৃষ্ণা সবসময় ছিল আমার। তাই সবার সাথে কথা বলা, যোগাযোগ রাখা আমার পছন্দের একটা ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছিল। এই স্বভাবের কারণেই অনেকের সাথে ভালো সম্পর্ক গড়েছে, আবার কিছু সম্পর্ক তিক্ততায় শেষ হয়েছে।
কিন্তু আজকের এই মুহূর্তে এখানে দাঁড়ানোর একটাই কারণ। তার কথা বলার জন্য। এমন একজন, যাকে আমি জীবনের শেষ পর্যন্ত চাই।
জানেন? তারে আমি অনেক আগেই দেখেছিলাম। ফ্রেশার ছিল সে। তখন নবীন বরণ অনুষ্ঠান নিয়ে ব্যস্ত সময় পার করছিলাম আমরা, দায়িত্ব ছিল আমাদের ব্যাচের ওপর। একটা ট্রেইলার ভিডিও বানানোর পরিকল্পনা ছিল। নবীনদের মধ্যে কারা অংশ নেবে, সেটার জন্য ওদের ক্লাসে গিয়েছিলাম। তখনই ওকে দেখেছিলাম,সঙ্কোচে ডুবে থাকা একটা মেয়ে, দ্বিধাগ্রস্ত। নাম দেবে কি দেবে না, ঠিক বুঝে উঠতে পারছিল না। কিন্তু পাশের মেয়েটি জোর করেই নামটা লিখে দিলো। মেয়েটির মুখের সেই অসহায় ভঙ্গিটা কেন জানি মনে গেঁথে গেলো আমার।
এরপর আবার দেখা হলো রিহার্সালের দিন। মেয়েটা নাচ জানে, অসম্ভব সুন্দর করে জানে। কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার, কখনো নিজে থেকে এগিয়ে আসেনি। ওর সেই দ্বিধা-সঙ্কোচ আমাকে অবাক করেছিল। নাচের লিস্টে নাম ছিল না ওর আমি তা জানলাম, জোর করেই নাম দিয়ে দিয়েছিলাম। কিন্তু মেয়েটা এই বিষয়ে জানতো না। সে ভেবেছিল, আমাদের কালচারাল ক্লাবের স্যারই তার নাম লিখে দিয়েছিলো।
নবীন বরণ অনুষ্ঠানের পর আর কোনো মঞ্চে তাকে দেখা যায়নি। অথচ আমি জানি, সে যখন পারফর্ম করে, তখন পুরো পরিবেশ বদলে যায়। বিলিভ মি, তার নৃত্য দেখেই আমি প্রথম প্রেমে পড়েছিলাম। জীবনের প্রথম প্রেম, একটা ঠান্ডা স্বভাবের মেয়ের প্রতি! আহ! কাউকে বোঝাতে পারবো না। কি ফিলিংস ছিল সেটা!
নবীন বরণে আমি এঙ্কারের দায়িত্বে ছিলাম। তার নামটা ডেকে আমি স্টেজের পাশেই দাঁড়িয়ে ছিলাম। তার চোখে মুখে নার্ভাসনেস ছিল। কিন্তু মুহূর্তের মধ্যেই সব কাটিয়ে উঠলো, আত্মবিশ্বাসী ভঙ্গিতে পারফর্ম করলো, ভরা মানুষের মাঝে তার কনফিডেন্স দেখে অবাক হয়েছিলাম সেদিন। তারপরই শুরু হলো দূর থেকে একটু করে দেখা। ভিড়ের মাঝে, করিডোরের কোণে, লাইব্রেরির জানালার পাশে! আমার চোখ বারবার তাকে খুঁজে নিতো। সবচেয়ে মজার ব্যাপার জানেন? সেও তাকাতো, সেও খুঁজতো আমাকে। আমি প্রথম দিন অবাকই হয়েছিলাম। দ্বিধায় ছিলাম! আমি যাকে পছন্দ করি সেও কি আমাকে পছন্দ করে? অদ্ভুত অনুভূতি হলো।
সে এক মুহূর্তের জন্য তাকাতো, আবার দ্রুত চোখ ফিরিয়ে নিতো। কিন্তু তার চোখের ভাষা আমি পড়ে ফেলেছিলাম খুব গভীরভাবে।
দুই দিনের বেশি লাগেনি বুঝতে যে....আমার মতো সেও আগ্রহী। হয়তো দ্বিধাগ্রস্ত, হয়তো সাহস করে এগিয়ে আসতে পারছে না। কিন্তু অনুভূতিগুলো লুকিয়ে রাখার চেষ্টায় বারবার ব্যর্থ হচ্ছিলো।
তবুও আমি অপেক্ষা করতে থাকলাম। একটা সঠিক মুহূর্তের জন্য, একটা সঠিক সময়ের জন্য। অপেক্ষা করতে কেমন লাগছিলো জানেন? মনে হলো কেউ অদৃশ্য সুতোয় আমাকে আটকে রেখেছিল! আমি এগিয়ে যেতে চাইছি, কিন্তু ইচ্ছে করেই পিছিয়ে যাচ্ছি। একদিন সে নিজে থেকেই আসলো একটা ক্লাবের ফর্ম খুঁজতে। এসব ক্ষেত্রে বেশীরভাগ দায়িত্বে আমি এগিয়ে ছিলাম, তাই অবশ্যই আমার কাছে আসলে কাজ দ্রুত হয়ে যেত। তারপর আর কী? কথা হতো আমাদের! যদিও দরকারেই বেশি! ফোন নাম্বার আদান প্রদান হলো একদিন। রাতে কথা হতো বেশি। মাঝেমধ্যে সে দরকারে ফোন করতো নয়তো আমি। কথা বেশিক্ষণ নয় সবোর্চ্চ দশ মিনিট। দেখাও কম হতো। কিন্তু যতটুকুই হতো আমি ওইটাতেই খুশি ছিলাম। খুব মিস করি দিনগুলো।
আমি জানি আমি অন্যরকম! খুব সহজেই সবার সাথে মিশতে পারি! কিন্তু এতো মানুষের ভিড়ে সেই একটি মেয়ে আমার মনে ঘুরে বেড়াতো। বিভিন্ন কাজের চাপে আমি তাকে সবসময় সময় দিতে পারতাম না। সময় দিতে চেয়েও কতো বাধা এসে পড়তো, কত পরিকল্পনা করেও বাদ দিতে হতো। তার মনে বারবার কষ্ট দিতাম আমি। সময় দেই না বলেই আমাদের দুই বছরের সম্পর্ক এক নিমিষেই ছোট একটা ঘটনার কারণে ভেঙে গেলো। কিন্তু সে কি জানে? তার দূরে চলে যাওয়া, কল ধরে হ্যালো না বলা আমাকে ধীরে ধীরে শেষ করে দিচ্ছে? সে কি জানে আমি তার জন্য অনেকের সাথে কথা বলা ছেড়ে দিয়েছি এখন? সে কি জানে রাতে আমি ঘুমাতে পারি না? সে কি জানে তাকে ছাড়া আমার মনটা অচল হয়ে পড়েছে?
আমি নিজের অসুস্থতায় তাকে মনে করি, সকাল হতেই তার 'গুড মর্নিং, বয়ফ্রেন্ড ' বলা মেসেজেটি খুব খারাপভাবে মিস করি, রাতের দিকে ফোনে তার কণ্ঠে 'গুড নাইট, বয়ফ্রেন্ড' কথাটা আমি বড্ড মিস করি। তাকে জড়িয়ে ধরি না কতদিন, সেই উষ্ণতা অনুভব করি না কতদিন। আমি তাকে কি পরিমাণে ভালোবাসি সত্যিই বলে বোঝাতে পারবো না। তার সাথে ভালোবাসার থেকেও বেশি ছিল বন্ধুত্ব! সেটাও হারিয়ে ফেলছি ধীরে ধীরে। কিন্তু আমি তার ভালোবাসা হারাতে চাই না। এক বিন্দুও না!
হ্যাঁ, আমাদের দুই বছরের সম্পর্ক ছিল। আমি কাউকে কিছু বলিনি।
ইংরেজিতে একটা বিখ্যাত প্রবাদ আছে --
'Keep it private, until it's permanent.'
আমি বিশ্বাস করতাম এই প্রবাদে। আমার ভালোবাসা ছিল শুদ্ধ, পবিত্র। আমি চাইনি এটা কারও চোখে পড়ে নোংরা হয়ে যাক। খুব যত্নে লুকিয়ে রাখতে চেয়েছিলাম। আমি শুনেছি, প্রকাশ করলেই নাকি ভালোবাসারা হারিয়ে যায়। তাই তো! আরেকটা কারণও ছিল, আমি চাইনি ভার্সিটির কেউ আমাদের দুজনকে আলাদা চোখে দেখুক। কিন্তু সব ভেস্তে গেলো। সব হারিয়ে গেলো, যখন মেয়েটি আমাকে ভুল বুঝলো। একবার বলা উচিত ছিল! বলা উচিত ছিল তোর, তুই আমাকে দেখেছিস সেদিন। তখন দেখে নিতি আমার ব্যবহার। বুঝিয়ে দিতাম ওই মেয়েটা আমার কাজিন ই ছিল। বন্ধুদের মতো কাজিন। বিশ্বাস কর, আমার মনটা শুধু তোর মাঝে বিলীন করে দিয়েছি। তাহলে অন্য কেউ এর মাঝে কি করে আসতে পারে?
আমি দাঁড়ি রাখতে চাইতাম না, সে চাইতো। তাই রাখতাম। আজ দাঁড়িগুলো বেশ বড় হয়ে গেছে, তাই না? মাথার চুলগুলোও অবহেলায় বড় হয়ে গেছে। সে আমায় খুব অবহেলা করছে। আমার একদম পছন্দ হচ্ছে না এই অবহেলা। ভেতরটা পুড়ে পুড়ে যাচ্ছে। তার অভিযোগ, আমি ভীতু!
কিন্তু, অনন্যা!
তোর বয়ফ্রেন্ড ভীতু ছিল… শুধুমাত্র তোর জন্য।'
নিজের নাম শুনতেই অনন্যার বুকটা কেঁপে উঠলো হঠাৎ। মনে হলো, কেউ যেন ভিতরটা মুচড়ে ধরছে। শ্বাস আটকে আসছে, চোখের কোণে গরম অশ্রু জমে উঠলো, মুহূর্তেই গাল বেয়ে নেমে এলো নোনা পানি।
দূর থেকে একটা সাদা আলো তার ওপর এসে পড়লো। মুহূর্তের মধ্যে সবার দৃষ্টি ওর দিকে নিবদ্ধ হলো। আশপাশের কোলাহল থমকে গেছে, ফিসফাস শুরু হলো। কারও মুখে বিস্ময়, কারও চোখে সংশয়।
কেউ কল্পনাও করেনি যে, জুনিয়র লেভেলের কোনো মেয়ে হবে আরণ্যকের প্রেমিকা।
অনন্যা নিজের গালের অশ্রু দ্রুত মুছে নিলো। আরণ্যক তো এসব কখনোই বলেনি! তাহলে আজ কেন? কেন এতদিন পর হঠাৎ করে সবকিছু বলে ওর কষ্ট আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে?
অনন্যার শ্বাস ভারী হয়ে আসছে। চারপাশের আলো, মানুষের কোলাহল! সব কিছু কেমন যেন ঝাপসা লাগছে। সে নোহারার হাত শক্ত করে চেপে ধরলো। নোহারা তাকে শান্ত হতে বললো।
আরণ্যক অনন্যার দিকে এগিয়ে আসলো। পাশ থেকে কয়েক জন শিক্ষার্থী সরে জায়গা ফাঁকা করে দিলো। আরণ্যক অনন্যার সামনে দাঁড়িয়ে মেয়েটার গালে দুই হাত রেখে বললো,
'অনন্যা শিকদার, ভালোবাসি ইয়ার! কত কষ্ট দিবি আমায়? এবার নাটক থামা, প্লিজ। অনেক হয়েছে। এক মাস হয়ে যাচ্ছে। আমি আর সহ্য করতে পারছি না।'
আরণ্যক অনন্যার চোখের কোণ মুছিয়ে দিয়ে আবারো বললো,
'কাঁদছিস কেনো? এই যে নিজেই তো কষ্ট পাচ্ছিস। তারপরও আমাকে কষ্ট দিতে চাস?'
অনন্যার চোখ দুটো বারবার ছলছলিয়ে উঠছে। সে দুই হাত দিয়ে আরণ্যকের হাত সরিয়ে দিলো। ঢোক গিলে বললো,
'আমি আগেই সব ক্লিয়ার করেছিলাম তাও কেনো বারবার....!'
'তুই বলেছিলি বাসায় গিয়ে নিজেকে আয়নায় দেখতে... আমি দেখেছিলাম সেদিন। তুই বলেছিলি, আমি ভালো মানুষ! আমি চেষ্টা করেছিলাম সেদিন... কিন্তু নিজেকে ভালো মানুষ মনে হয়নি আমার। তোর সাথে নিশ্চয়ই খুব খারাপ করেছিলাম! তাই তো এভাবে বারবার দূরে ঠেলে দিচ্ছিস?
তুই বলেছিলি আমি ভুল মানুষের প্রেমে পড়েছি। কিন্তু কথাটা একদম ভুল, অনন্যা। আমি ভুল মানুষের প্রেমে পড়িনি। আমার হৃদয় ভুল মানুষের জন্য এভাবে উতলা হয় না, বারবার তোকে দেখার জন্য ছটফট করে না। আমার এই হৃদয় আমার থেকেও অবাধ্য, জানিস? আমার কথা শোনে না, আমার চিন্তা না করে শুধু তোর কথাই ভাবে।'
আরণ্যক এক টানে কথাগুলো বলে অনন্যাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো। মুহূর্তের জন্য সবকিছু থমকে গেল। চারপাশের আলো, মানুষের ফিসফাস, চোখের দৃষ্টি সব জমে গেল সেই দৃশ্যের কেন্দ্রবিন্দুতে।
আরণ্যক জোর গলায় বললো,
'আই লাভ ইউ, অনু! প্লিজ এক্সেপ্ট মি।'
অনন্যার শরীর ঝটকা খেলো, কান লাল হয়ে গেল লজ্জায় আর রাগে। সে দ্রুত আরণ্যকের বাঁধন থেকে বেরোনোর চেষ্টা করলো, কিন্তু ছেলেটা আঠার মতো লেগে আছে। আশপাশের লোকজন হাঁ করে তাকিয়ে, কেউ অবাক, কেউ উৎকণ্ঠিত, কেউ মুচকি হাসছে।
আরণ্যক এবার মাইক্রোফোন সরিয়ে আনমনে ফিসফিস করে বললো, 'এটাই তো চেয়েছিলি, তাই না? সবার সামনে তোকে স্বীকার করি? করলাম তো! তাও কিসের এত!'
আরণ্যকের দু'চোখে তীব্র জেদ, কণ্ঠে ঝাঁঝ। অনন্যার বুক ধক করে উঠলো। শরীরে শীতল স্রোত বয়ে গেল, কিন্তু মাথার ভেতর গমগম করে দাবানল জ্বলছে। সে দুই হাত আরণ্যকের বুকের ওপর ঠেলে দিলো, কিন্তু ছেলেটা এক চুলও সরছে না।
চারপাশে আরণ্যকের কণ্ঠ প্রতিধ্বনিত হচ্ছে, মানুষের গুঞ্জন বাড়ছে, মোবাইল ক্যামেরাগুলো জ্বলজ্বল করছে আর এই ভিড়ের মাঝখানে অনন্যার মনে হচ্ছে, সে একটা দুঃস্বপ্নের মধ্যে আটকে গেছে।
এক প্রকার বাধ্য হয়ে অনন্যা চেঁচিয়ে উঠলো,
'আমি বিবাহিত। ছাড়ো আমাকে।'
কয়েক সেকেন্ড সব থেমে গেল। আরণ্যকের মাথায় বাজ পড়লো অনন্যার কথায়। চারপাশের কোলাহল মুহূর্তেই থেমে গেলো মনে হলো। সে বিস্ময়ে অনন্যার চোখে তাকিয়ে রইলো, হাতগুলো আস্তে আস্তে আলগা হয়ে গেলো।
অনন্যা আর এক মুহূর্তও দাঁড়ায়নি। আরণ্যককে ধাক্কা দিয়ে বেরিয়ে গেলো মানুষের ভিড় পেরিয়ে, বুক ফাটানো কান্না গিলে ফেলে ছুটে গেলো গেটের দিকে।
আরণ্যক হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে থাকলো কয়েক সেকেন্ড, তারপর সম্বিত ফিরে পেলো সে। 'বিবাহিত?' শব্দটা মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল, কিন্তু চিন্তার সময় নেই। অনন্যা পালাচ্ছে, আরণ্যকও ছুটলো তার পেছনে।
গেট পার হতেই অনন্যার পা হঠাৎ মচকালো, ভারসাম্য হারিয়ে সোজা রাস্তায় পড়ে গেলো। তার কপালটা মাটির সাথে ঠেকে গেল, চোখের পানি থামার বদলে আরও উপচে পড়লো। মাথাটা ঘুরছে, সবকিছু দুলে যাচ্ছে চোখের সামনে।
আরণ্যক দ্রুত তার কাছে এসে হাঁটু গেড়ে বসে বললো, 'অনন্যা! ঠিক আছিস?'
সে হাত বাড়িয়ে তুলতে চাইলো, কিন্তু অনন্যা ক্ষিপ্তভাবে তার হাত ছুঁড়ে দিয়ে বললো, 'আমি নিজেই উঠতে পারি!'
কণ্ঠে কাঁপন, চোখে অশ্রু, কিন্তু তবু জেদে ভরা আরণ্যকের মুখশ্রী।সে কঠোর গলায় উচ্চারিত করলো,
'মিথ্যে বললি কেনো?
অনন্যা ও জেদ দেখিয়ে বললো,
'যা বলেছি সত্যি বলেছি। সেমিস্টার ব্রেকে আমার বিয়ে হয়েছে। আমি এখন অন্য কারো। এটা যত তাড়াতাড়ি মানতে পারবে তত ভালো তোমার জন্য।
আরণ্যক দ্রুত কাছে এসে অনন্যার গাল স্পর্শ করলো। নরম গলায় বললো,
'অনন্যা! কি বলছিস এসব? আমি মানতে পারছি না। বল এসব মিথ্যে! বলে দে তোর বিয়ে হয়নি। আমার মাথাটা খারাপ হয়ে যাচ্ছে। দয়া করে এভাবে খেলিস না আমার সাথে।
'সত্যি বিয়ে হয়েছে আমার।
কঠোর গলায় বললো অনন্যা।
'নাহ! আমি ছাড়া অন্য কেউ তোকে যত্নে রাখবে আমি মানতে পারছি না। তুই... তুই এক কাজ কর।ওই লোকটাকে ছেড়ে দে। চলে আয় আমার কাছে। আমি তোকে ভালো রাখবো। আমি..... আমি বিয়ে করবো তোকে। সব বাদ! আমি শুধু তোকে চাই, অনু!
'আমি ভালো আছি, ভাইয়া!
আরণ্যকের আঙুল কেঁপে উঠলো, বুকের ভেতর ধুকপুকানি বেড়ে গেল। কণ্ঠ বুঁজে বুঁজে এলো, তবু সে ঠেলে বের করলো শব্দগুলো,
'মিথ্যে! আসলে তোর বিয়েই হয়নি! তুই এখনো ভাবছিস আমি তোকে ঠকাচ্ছি, তাই না? আমি সত্যিই...'
কথা শেষ করার আগেই অনন্যা এক ঝটকায় হাত সরিয়ে নিলো। গাল ফুলিয়ে, চোখে আগুন ঝরিয়ে বললো,
'কতবার বলতে হবে? কতবার? আমার সত্যি বিয়ে হয়েছে!'
অনন্যা শ্বাস টেনে নিলো গভীরভাবে, গলা ঝাঁঝালো হয়ে উঠলো তার,
'ঈরাকে জিজ্ঞেস করো। ও জানে। আমি ওকে বলতে না করেছিলাম কাউকে, কিন্তু তুমি যদি বিয়ের ব্যাপারে জিজ্ঞেস করো, ও এবার সত্যি বলবে যে আমার বিয়ে হয়েছে!'
কথাগুলো বলেই অনন্যা শক্ত হাতে নিজের খয়েরি রঙের ঢিলেঢালা সালোয়ার-কামিজ থেকে ধুলো ঝেড়ে ফেললো।
তারপর,
'ভাইয়া,' শব্দটা ছুরির মতো শাণিত হয়ে পৌঁছুলো আরণ্যকের কণ্ঠে!
অনন্যা উচ্চারণ করলো,
'আর কখনো আমাকে ডিস্টার্ব করবে না!'
আরণ্যক নিঃশব্দে উঠে দাঁড়ালো। শরীরে অদৃশ্য কোনো ভার নেমে এলো তার, পা স্থির হয়ে গেল। অনন্যা গন্তব্যহীন পায়ে সামনে এগোতে লাগলো।
কয়েক সেকেন্ডের নিস্তব্ধতা! আরণ্যকের কণ্ঠ এবার তীক্ষ্ণ হলো, কয়েক পল অন্ধকারে ছুরি ছোঁড়ার মতো ছুটে এলো অনন্যার কানে,
'দেখতে চাই!'
অনন্যা থমকে দাঁড়ালো।
'দেখতে চাই সেই ভাগ্যবান পুরুষকে, যে তোকে বিয়ে করেছে! দেখতে চাই সেই ভাগ্যবান পুরুষকে যে তোকে আমার কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়েছে। দেখাতে পারবি?'
আরণ্যকের ঠোঁটের কোণায় এক চিলতে হাসি ফুটে উঠলো। আত্মবিশ্বাসে ভরা সেই হাসি। আরণ্যকের বিশ্বাস ছিল, অনন্যা কাউকে দেখাতে পারবে না। কারণ সে মন থেকে বিশ্বাস করে, অনন্যা ওকে না জানিয়ে বিয়ে করতে পারে না।
অন্ধকারের নিচে দাঁড়িয়ে থাকা দুই মানুষ। একজনের মনে দ্বিধা, ভয়! তো অপরজন নিজের ভালোবাসায় বিশ্বাসী।
.
.
.
চলবে.......................................................................