আশিয়ানা - পর্ব ৮৪ - শারমিন আক্তার বর্ষা - ধারাবাহিক গল্প


রোদেলা খুবই অসুস্থ। আজকাল শরীরটা ভালো যাচ্ছে না ওর। বৃদ্ধ মানুষের মতো ভারী লাগে শরীর। বিছানা থেকে উঠতে ইচ্ছা করে না। হাত পা ভেঙেচুরে আসে যেন। আজ অনেক দিন পর বাড়ির বাহিরে এসে গার্ডেনে বসেছে। গাছের ডালে দুটো জোড়া পাখি বসে মৃদু আওয়াজ কিচিরমিচির করছে। ওদের দেখে মনে হবে একে অপরের সঙ্গে গল্পগুজব করছে। শীতল বাতাস বইছে থেমে থেমে। বেশ কিছু গাছে ফুল ফুটেছে। বাতাসের সঙ্গে সুঘ্রাণ ভেসে নাকের ডগায় বাড়ি খাচ্ছে। রোদেলা জোরে শ্বাস ফেলল। 
বহুদিন পর আজ পৃথিবীর মাঝে নিজেকে মেলে ধরেছে সে। টেবিলের উপর কয়েক ধরনের ফল ও খাবার রেখে গেছে স্টাফ নেনি। রোদেলা সেসবে চোখ বুলিয়ে দেখল, হুট করে আজ সবকিছু একসাথে খেতে ইচ্ছা করছে। কিন্তু খেতে পারলো স্বল্প।  
     রোদেলা চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। বাড়ির দিকে যাবে তখন দেখল সেহরিশের গাড়ি গেট দিয়ে ঢুকছে। গার্ডেনে যেতে সরু পথটার সামনে দাঁড়িয়ে পড়ল ও। সেহরিশের গাড়ি থামল। একজন বডিগার্ড এগিয়ে এসে দরজা খুলে দিতে সেহরিশ বের হলো। রোদেলাকে দেখে স্মিথ হাসল সেহরিশ। রাস্তার এপাশে এসে সামনে দাঁড়াল রোদেলার। 

গভীর চোখে রোদেলাকে পরখ করে সেহরিশ। জিজ্ঞেস করল,
  'অসময়ে বাগানে যাচ্ছ কেন? ঠান্ডা বাতাস বইছে। শরীরে শাল ও নেই।'
  'বাগানে যাচ্ছি না। বাগান থেকে রুমে যাচ্ছিলাম। আপনাকে আসতে দেখে দাঁড়ালাম।'
সেহরিশ আর কিছু বলল না। ওর একহাতে একটা ফুলের তোড়া, সেটা রোদেলার দিকে বাড়িয়ে দিল সেহরিশ। 

রোদেলা কম্পিত গলায় জিজ্ঞেস করল,
  'আজকেও ফুল নিয়ে আসছেন?'

সেহরিশ এক শ্বাসে বলল,
  'তোমার জন্য কখনো ফুল না নিয়ে এসেছি? উঁহু, না। আর কখনো না আমি এই নিয়মের বাহিরে যাবো না। এই পৃথিবীতে যতদিন বাঁচবো রোজ নিয়ম করে তোমার জন্য ফুল নিয়ে আসবো। যদি কখনো নিয়মের বাইরে যাই তাহলে আচ্ছে করে কান মলে দিও।' সেহরিশ কুটিল হাসল। তারপর ভারী নিঃশ্বাস ফেলে বাম হাতটা রোদেলার কানের উপর রাখল। নরম গলায় বলল, 
 
  'এই পৃথিবীর পরে আর-ও একটা জীবন আছে। সেটা হচ্ছে, আখিরাত। আমি পরকালে আল্লাহ-র কাছে জান্নাত চাইব। আর সেখানে তুমি রবে।'
মুচকি হাসল রোদেলা।
সেহরিশ আলগোছে রোদেলার হাত ধরে খোলা আকাশের নিচে হাঁটতে লাগল। বহুদিন পর এমন সুযোগ সে আবার পেয়েছে। রোদেলার মন আগের চেয়ে বেশ ভালো। আজ ইচ্ছে করছে সেহরিশের সব কিছুতেই সঙ্গ দিতে। সেহরিশের অগোচরে একগাল হাসি মুখে নিয়ে তৃপ্তিময় ঢোক গিলল রোদেলা। 

স্বচ্ছ আকাশে জ্বলজ্বল করছে গুটি কয়েক তাঁরা, আকাশের কোলে ঢলে পড়েছে গোল থালার মতো চাঁদ। রেলিঙের পাশে দাঁড়ানো রোদেলা। চোখ বুজে লম্বা শ্বাস টানলো। হঠাৎ একটা কণ্ঠস্বরে ধড়ফড়িয়ে উঠল সে।

সেহরিশ পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে বলল, 
  'ওই চাঁদের মাঝে কি আছে? 
যা তোমাকে আমার থেকে আলাদা করে?'

রোদেলা মাথা নিচু করে মৃদু হাসল। পুরো শরীরে ঘুরে সেহরিশের মুখোমুখি হল। আলতোভাবে সেহরিশের বুকে হাত রেখে বলল,
  'আপনার থাকার অনূভুতি জাগায়।
আপনি কাছে নেই তবু চোখ বুজলে মনে হয়, এই তো পাশেই আছেন।'

সেহরিশ আলগোছে রোদেলার কপালে চুমু খায়। বলল,
  'যেতে ইচ্ছে করছে না। তবু যেতে হবে। ওখানে যত ঘন্টা থাকব আমার তোমার জন্য টেনশন হবে। তুমি সঙ্গে গেলে ভালো হতো।'

রোদেলা বলল, 
  'আমার শরীর ভালো না। ওখানে গিয়ে কি করব? তাছাড়া আপনি তো জানেন আমার গানবাজনা তেমন ভালো লাগে না। আপনি যান। বাড়ি ভরা স্টাফ। আমার কিছু হবে না। চিন্তা করবেন না।'

সেহরিশ দ্বিধায় পড়ে গেল। এরমধ্যে তূর্ণ বাড়ির নিচে চলে এসেছে। তূর্ণ রিকুয়েষ্ট করেছে ওরা একসঙ্গে যাবে। সেহরিশ আরও একবার রোদেলার কপালে ঠোঁট স্পর্শ করে। সেহরিশ লুকায়িত দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, 
  'সন্দেহ জনক কিছু মনে হলেই আমাকে কল করবে।'
রোদেলা ঠোঁটের কোণে হাসি রেখে উপরনিচ মাথা ঝাঁকাল।

_____________

প্রথম সারির সিটে বসে আছে সেহরিশ ওর পাশে তূর্ণ। বেশ পরিপাটি হয়ে এসেছে সে। শার্টের উপর দিকে তিনটা বোতাম খোলা তার। বাবরি চুলে তাকে বেশ ভালো লাগছে। অন্য ব্যান্ডের সদস্য দুজন মেয়ে তূর্ণর পাশে বসা। তূর্ণ সে মেয়ের সঙ্গে হাসিমুখে কথা বলতে আরম্ভ করে। 

সেহরিশ তূর্ণর বাম হাতখানা ধরে টেনে সোজা করে বসালো সিটে। তারপর দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
  'তোর ঘরে বউ আছে। কদিন পর বাবা হবি। এখন অন্তত ফ্লার্টিং বন্ধ কর।'
তূর্ণ মেকি হাসি মুখে জবাব দিল, 
  'আমি কোথায় ফ্লার্ট করছি? সামান্য কথা বলাকে ফ্লার্টিং মনে করছিস।'
সেহরিশ গম্ভীর গলায় বলল, 
  'তুই যতটা তোকে চিনিস-জানিস তার চেয়ে হাজার গুন আমি চিনি৷'
তূর্ণ ঠোঁট উল্টিয়ে ফেলল।
একজন জনপ্রিয় ব্যান্ডের মেয়ে সদস্য হেঁটে এল ওদের দিকে৷ তূর্ণ ভ্রু কুঞ্চিত করে মেয়েটিকে লক্ষ্য করল। মেয়েটি সেহরিশের সামনে এসে সোজা হয়ে দাঁড়াল। তারপর সেহরিশের পাশের খালি সিট টায় বসে গেল। সেহরিশ স্টেজের দিকে তাকিয়ে আছে৷ একটা বয়ব্যান্ড পারফর্ম করছে। 

মেয়েটা হাসির ছলে সেহরিশের দিকে এগোল। সেহরিশ সেদিকে খেয়াল করল না। তূর্ণর ভ্রু জোড়া কুঁচকে গেল। তার সম্পূর্ণ খেয়াল মেয়েটির উপর। সে কি করতে চাচ্ছে? 

মেয়েটি সেহরিশের সঙ্গে কথা বলার জন্য প্রথমে তার নাম থেকে শুরু করল। এরপর এদিক সেদিকের কথা বলতে বলতে সেহরিশের মুখের দিকে তাকাল। ডোরা ভারী নিঃশ্বাস ফেলল। তার মনে হচ্ছে কোনো রোবটের পাশে বসে শুধুশুধু বকবক করল। ডোরা ভারী নিঃশ্বাস ফেলে বলল, 
  'আপনার নাম্বার পেতে পারি? একচুয়ালি, আমি আপনাকে ভীষণ পছন্দ করি।'

সেহরিশ চোখের পলক ফেলল। কাঠকাঠ গলায় বলল, 
  'সরি। আমি বিবাহিত। আমার ওয়াইফ আছে।'

ইতালির শহরে বেশিরভাগ পুরুষের ঘরে বউ ও বাহিরে গার্লফ্রেন্ড আছে। এটা সবার কাছে স্বাভাবিক। ডোরা বেশ ফর্সা ও সুন্দর। এক নজরে সব পুরুষের আকর্ষণ আদায় করতে সক্ষম সে। ওর ব্যান্ডের মধ্যে সে সুন্দরের দিক থেকে এগিয়ে। ডোরা সেহরিশের জীবন সম্পর্কে সব জানে। ঠোঁটের কোণে হাসি রেখে বলল, 
  'তাতে কি হয়েছে? তোমার বউ তো বাড়িতে থাকবে। আর আমরা বাহিরে এনজয় করব। বাড়ি গিয়ে বউ আর বাহিরে গার্লফ্রেন্ড।'

সেহরিশ ওর হাত শক্তভাবে মুঠ করল। রাগ ও ক্ষোভে কাঁপতে লাগল ওর হাত। তীক্ষ্ণ চাহনিতে তাকাল সেহরিশ। ঝাঁঝাল গলায় বলল, 
  'আমার স্ত্রী রোদেলা, সে এই পৃথিবী ও সমগ্র বিশ্বে একমাত্র নারী যার প্রতি সেহরিশ ফাতিন চৌধুরী দুর্বল। এবং আমি তাকে ভালবাসি নিজের থেকেও বেশি।' 

ডোরা বলল,
  'আমার চেয়ে সুন্দর তুমি কাউকে পাবে না।'

সেহরিশ ঠোঁট বাঁকা করে হাসল। বলল,
  'অলরেডি পেয়ে গেছি। আমার চোখে দেখো, তার চেয়ে সুন্দর রূপবতী আর কেহু না।'

সেহরিশ ওর জায়গা থেকে উঠে চলে গেল। সঙ্গে সঙ্গে তূর্ণ সেহরিশের জায়গা দখল করে নেয়। ডোরার দিকে খানিকটা ঝুঁকে ঠাট্টার স্বরে বলল,
  'একে পটাতে পারবে না। ও বউয়ের প্রেমে একদম ডুবে গেছে।' বলে শব্দ করে হাসতে লাগল তূর্ণ। ডোরার সঙ্গে কথার মাঝে সেহরিশ ফিরে এল। সেহরিশ কে দেখামাত্র তূর্ণ সোজা হয়ে বসে। জেনো ডোরাকে সে চিনেই না। সেহরিশ বসল। রোদেলার জন্য মনটা কেমন করছে। এমন সময় তূর্ণ ঝাপিয়ে পড়ল সেহরিশের ওপর। সেহরিশের শ্বাস অস্থির; হুট করে অস্বস্তি হচ্ছে। সেহরিশ ফিসফিসে আওয়াজে বলল, 'আমি চলে যাচ্ছি। রোদ, অসুস্থ। আমার এখানে মন টিকছে না।'

বডিগার্ড নিয়ে আসে নি সেহরিশ। তূর্ণর সঙ্গে এসেছে বলে সঙ্গে গাড়ি ও নেই। তাড়াহুড়ো করে ক্যাব বুক করে সে। হুট করে বাড়ি যাওয়ার জন্য উতলা হয়েছে মন। কিছুক্ষণ পর ক্যাব এল। সেহরিশ উঠে বসে। কোথায় যাবে? ঠিকানা জেনে গাড়ি স্টার্ট করল ড্রাইভার। 
   বেশ কয়েকবার রোদেলাকে কল করল সেহরিশ। মিটুকে খাবার দিতে গিয়ে সে রুমে ফোন রেখে আসছে রোদেলা। কয়েকবার রিং হওয়ার পর একজন স্টাফ ফোনের রিংটোন শুনে খুঁজতে খুঁজতে আসে। সেহরিশের নাম দেখে সে রোদেলার ফোন নিয়ে সিঁড়ির দিকে এগিয়ে গেল। 
রোদেলা রুমে আছে। কয়েকবার দরজায় টোকা দিতে দরজা খুলল রোদেলা। সে মূহুর্তে ফোনের রিংটোন আবারও বেজে উঠল।

ফোন কোথায় রাখছিল? বেমালুম ভুলে গেছিল সে। স্টাফ ছেলেটাকে ছোট্ট করে ধন্যবাদ জানিয়ে ফোন নিয়ে রুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করল। রোদেলা কল রিসিভ করে হ্যালো বলল। ওর কণ্ঠ শুনে হাফ ছাড়লো সেহরিশ। এতক্ষণ যেনো এই নিঃশ্বাস টা বুকে চাপা পড়ে ছিল। উত্তেজনায় ঘনঘন শ্বাস ফেলে রোদেলা কে জিজ্ঞেস করে। ফোন এতক্ষণ ধরছিল না কেন? রোদেলা শান্ত গলায় জবাব শোনালো। রোদেলার সঙ্গে কথা বলতে বলতে সেহরিশ খেয়াল করেনি সে কোন পথে যাচ্ছে। 

সেহরিশ আচমকা সামনে তাকাল। দু'দিকে পাহাড়ি রাস্তা। সেহরিশ জিজ্ঞেস করল,
  'এদিকে কোথায় যাচ্ছেন? আপনি ভুল পথে যাচ্ছেন।'
ড্রাইভার বলল,
  'ওদিকে রাস্তা বন্ধ স্যার।'
সেহরিশ এই রাস্তা চিনে। এই রাস্তা ঘন অরণ্যের মাঝখানে গিয়ে শেষ হয়েছে। সেহরিশ আচমকা ওর জায়গা থেকে উঠল। পেছন থেকে হাত বাড়িয়ে গাড়ির ড্রাইভারের গলা চেপে ধরে। শক্ত গলায় ধমকে বলল, 
  'ব্রেক কর।'

ড্রাইভার শ্বাস নিতে পারছে না। সে গাড়ি ব্রেক করার পরপর সামনে থেকে একটা গাড়ির হেডলাইন জ্বলে উঠল। সেদিকে তাকিয়ে সেহরিশের চোখজোড়া বড়বড় হয়ে গেল। দুটো গাড়ির হেডলাইটের আলোয় আর্থেসের মুখখানা স্পষ্ট দেখতে পেল সেহরিশ। আর্থেস খুব স্পিডে গাড়ি চালিয়ে এসে হঠাৎ ক্যাবে ধাক্কা মারলো। একবার এর পর দু'বার। উঁচু পাহাড় থেকে গাড়িটা খুব দ্রুত নিচে পড়তে লাগল। আর্থেস আরও একবার ধাক্কা মারলো। 
সেহরিশের দৃষ্টি স্থির। ক্ষীণ কণ্ঠে উচ্চারণ করল,
  'রোদ।'
.
.
.
চলবে.........................................................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

WhatsApp